থিয়েটার রোড
১.
থিয়েটার রোডের ট্র্যাভেল অ্যান্ড কার্গো অফিসে বসে অরূপ লাহিড়ি বলেছিলেন, দুবাই এয়ারপোর্টে প্রায় এগারো ঘণ্টা বসে থাকতে হবে আপনাকে। আমি এমিরেটসের সঙ্গে কথা বলেছি। ওরা আগে একটা সময় প্যাসেঞ্জারকে এয়ারপোর্টে না রেখে হোটেলে নিয়ে যেত। এখন নিচ্ছে না। আপনি ভাউচারটা রাখুন। ট্রানজিটেই এদের লাউঞ্জ পাবেন। বিশ্রাম করতে পারবেন।
অন্য এয়ারলাইন্সে গেলে হয় না?
আগামী দশ দিনের মধ্যে জায়গা পাওয়া যাচ্ছে না। তা ছাড়া আপনার নামে আমেরিকা থেকে যে টাকা এসেছে তাতে একমাত্র এমিরেটসের টিকিটটা কভার করছে। চলে যান ভাই, খারাপ লাগবে না। দুবাই এয়ারপোর্ট বিশাল। ঘুরে দেখতে দেখতে সময় কেটে যাবে।
অতএব নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু এয়ারপোর্ট থেকে এমিরেটসের প্লেনে আকাশে উড়েছিল অর্জুন। যখন প্লেন মাটিতে দাঁড়িয়ে ছিল, তখন সুন্দরী এয়ারহোস্টেসরা আরব মহিলার পোশাক পরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। ওড়নায় মুখ অর্ধেক ঢাকা সত্ত্বেও অর্জুনের মনে হয়েছিল, এঁরা ইউরোপ বা আমেরিকার মহিলা। প্লেন আকাশে উড়লে ওঁরা যখন পোশাক বদলে সহজ হলেন, তখন অর্জুন বুঝল তার ধারণা ভুল ছিল না। দুবাইতে নামার আগে আবার ওঁরা আরব মহিলার সাজে ফিরে গেলেন।
সুটকেস প্লেনের পেটে, নিউ ইয়র্কের কেনেডি এয়ারপোর্টে পৌঁছোবার পরে পাওয়া যাবে। অতএব খালি হাতে অর্জুন ট্রানজিট লাউঞ্জে চলে এল। দুবাই ধনীদের জায়গা। কাদের টাকা কত তা নিয়ে তর্ক হয়। দোতলার প্যাসেজে পা দিয়ে অর্জুন যে দৃশ্য দেখল, তাতে ওই তথ্যের সমর্থন পাওয়া গেল। বিশাল আলোঝলমলে ছ’তলা ধরে ডিউটি শপের মেলা। চারধারে যেন হিরে জ্বলছে। দু-দুটো ফুটবল মাঠ এর মধ্যে ঢুকে যাবে। দোকানগুলোর সামনে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মনে হল, গোটা পৃথিবীর মূল্যবান জিনিস এখানে পাওয়া যাচ্ছে।
খুঁজতে খুঁজতে অরূপ লাহিড়ির দেওয়া ভাউচারটা যে লাউঞ্জের, তার সামনে এসে দাঁড়াল সে। ঢুকতেই বাঁ দিকের রিসেপশনে বসা কাঠখোট্টা চেহারার এক মহিলা, যিনি অবশ্যই আরবি নন, বাজখাই গলায় জিজ্ঞেস করলেন, কী চাই?
অর্জুন বলল, আমি নিউ ইয়র্কের ফ্লাইট ধরব। ততক্ষণ কি এখানে থাকতে পারি?
না, পারেন না। যদি না আপনার কাছে অনুমতিপত্র থাকে।
অর্জুন ভাউচার এগিয়ে দিল। সেটার উপর চোখ বুলিয়ে কম্পিউটারে এন্ট্রি করে ভদ্রমহিলা ইশারায় জানালেন যে, ভিতরে যেতে পারে। ভদ্রমহিলা একবার হাসলেন, মুখের পেশি একটুও নরম হল না। এই চাকরি করলে এমন মুখে বসে থাকা ঠিক নয় তা উনি জানেন না।
ভিতরের হলঘর সুন্দর করে সাজানো। টিভিতে আরবি ছবি দেখানো হচ্ছে নিঃশব্দে। সামনে বিশাল কাঁচের দেওয়াল। ওপাশের টারম্যাকে প্লেন নামছে-উড়ছে।
আচমকা এই সফর। নিউ ইয়র্ক থেকে মেজর ফোন করেছিলেন দিন পনেরো আগে। তাঁর শরীর এবং মন খুব খারাপ। এই অবস্থায় হাজার হাজার মাইল আকাশে উড়ে যাওয়ার ধকল সামলানো তার পক্ষে সম্ভব নয়। অথচ কিছুদিন থেকেই উত্তরবাংলাকে দেখতে তার খুব ইচ্ছে করছে। বোধহয় সেই ইচ্ছে এই জীবনে পূর্ণ হবে না। এখন তার মনে হচ্ছে, অর্জুন যদি নিউ ইয়র্কে চলে আসে, উত্তরবাংলা না দেখার সাধ কিছুটা মিটবে। অর্জুন কি তার শেষ ইচ্ছে পূর্ণ করবে? যদি করে তা হলে তিনি খুব খুশি হবেন। আজ সকালের ডাকেই অর্জুনের জন্যে ভিসা পেতে সুবিধে হবে বলে যাবতীয় কাগজপত্র পাঠিয়ে দিয়েছেন। আসতে না পারলে অর্জুন যেন ওগুলো ছিঁড়ে ফেলে। আর আসতে পারলে যেন কাল সকালের মধ্যে তাকে মেল করে জানিয়ে দেয়। তার ই-মেল আইডি হল, মেজর এম রেডিফ. অন।
চারদিনের মাথায় কুরিয়ার কোম্পানি কাগজপত্র পৌঁছে দিল। মা বললেন, আহা, মানুষটি তার শেষ ইচ্ছের কথা জানিয়েছেন, তুই যা। দেখা করে আয়।
দোটানায় পড়েছিল অর্জুন। মাকে একা জলপাইগুড়িতে রেখে দু চারদিন বাইরে থাকা যায়, কিন্তু আমেরিকা মানে কমপক্ষে দু’সপ্তাহের ধাক্কা। গতবারের বিদেশযাত্রার স্মৃতিতে এখন ধুলো জমছে বলে কৌতূহলও হচ্ছিল।
মেজরের পাঠানো কাগজপত্রের সঙ্গে একটা চিঠি ছিল। সেটা পড়ার পর অর্জুন ঠিক করল, যেতে হবে। টেলিফোনে যা বলেছিলেন ঠিক সেসব কথা। লেখার পর মেজর লিখেছিলেন, এই নিউ ইয়র্ক শহরে কয়েকশো জাতি বাস করে। তাদের আচার-ব্যবহার, ভাষা আলাদা। তুমি গতবার যখন এসেছিলে তখন এদের দেখে গিয়েছিলে। কিন্তু নিউ ইয়র্কের মাটির তলায় আর-একটা যে জগৎ আছে, তা তুমি দ্যাখোনি। না, আমি আন্ডারগ্রাউন্ড ট্রেনের কথা বলছি না। যার কথা বলছি তা জানতে হলে তোমাকে নিজের চোখে দেখতে হবে।
মনে বঁড়শি বিঁধল। মেজর জানেন কোন টোপ কোন মাছ গিলে ফেলে। খোদ নিউ ইয়র্ক শহরের নীচে আর-একটা জগৎ আছে এ খবর অর্জুন কখনও পড়েনি। সেটা কি আন্ডারওয়ার্ল্ড? আন্ডারওয়ার্ল্ড মানে অপরাধীদের জগৎ। ই-মেলে অর্জুন জানিয়ে দিল, সে যাচ্ছে।
চিঠিতে ‘ট্রাভেল অ্যান্ড কার্গো’ কথাটি লেখা ছিল। ব্যাগ গুছিয়ে অর্জুন চলে এসেছিল কলকাতায়। শিয়ালদা স্টেশন থেকে সোজা ওদের থিয়েটার রোডের অফিসে। অরূপ লাহিড়ির টেবিলের সামনে গিয়ে নিজের পরিচয় দিতেই তিনি সোজা হয়ে বসলেন, আরে! আপনি অর্জুন! বসুন ভাই। একটু আগে ব্যাঙ্ক থেকে জানিয়েছে আপনার নামে টাকা এসে গিয়েছে। পাসপোর্ট দেখিয়ে তুলতে হবে। কিন্তু ভিসার জন্যে ইউ এস এ কনসুলেট কবে ইন্টারভিউ ডেট দেবে তা বলতে পারছি না। প্রচণ্ড ভিড় ওখানে।
অর্জুন ফাঁপরে পড়েছিল। ভিসার জন্যে বেশিদিন কলকাতার হোটেলে থাকা তার পক্ষে সম্ভব নয়। অরূপ লাহিড়ি কম্পিউটারে কনসুলেট ধরে ভিসার জন্যে অর্জুনের নাম-ঠিকানা লিখে আবেদন করেই অবাক গলায় বললেন, আশ্চর্য!
কী হয়েছে?
আরে, আপনার নাম তো অলরেডি লিস্টে উঠে আছে। আগামীকাল সকালে যেতে হবে আপনাকে। ভিসা ফর্ম ফিলআপ করতে হবে। সঙ্গে ফোটো আছে?
প্রায় যুদ্ধকালীন তৎপরতায় সব কাজ শেষ করা হয়েছিল। পরের সকালে কনসুলেটের ভিসা অফিসার তার কাগজপত্র দেখে জিজ্ঞেস করলেন, কেন যাচ্ছেন?
মেজর আমাকে দেখতে চান। তার শেষ ইচ্ছের প্রতি সম্মান জানাতে যাচ্ছি।
কোনও সত্য অনুসন্ধানের জন্যে নিশ্চয়ই যাচ্ছেন না?
না। তবে কোনও অসত্য যদি আমাকে বিব্রত করে, তা হলে আমি আপনাদের সাহায্য চাইব সত্যিটাকে সামনে আনতে। অর্জুন হেসেছিল।
গুড। আমাদের সাহায্য চাইবেন। কারণ, আপনি আমাদের দেশে যাচ্ছেন টুরিস্ট হিসেবে?
ভিসা পেয়ে গিয়েছিল। এই ভিসা পাওয়ার পিছনে যে মেজরের বড় ভূমিকা ছিল তা বুঝতে অসুবিধে হয়নি।
দুবাই এয়ারপোর্টের ট্রানজিট লাউঞ্জে বসে অর্জুন এইসব ভাবছিল। দীর্ঘসময় ওখানে থাকতে হবে তাকে। অরূপ লাহিড়ি বলেছিলেন, আগে সাত ঘণ্টার বেশি হলে এয়ারলাইন্স যাত্রীদের হোটেলে নিয়ে যেত। এখন খরচ কমাতে সেটা বন্ধ করেছে। তবে লাউঞ্জগুলো ভাল। ঘুমোতে পারেন। যে জায়গায় সে বসে আছে তা নিশ্চয়ই আরামদায়ক। কিন্তু তা বসার জন্যে, এতে ঘুমোনো যাবে না। অর্জুন দেখল, বাঁ দিকের শেষপ্রান্তে রেস্টুরেন্টের মতো চেয়ার-টেবিল সাজানো আছে। একটি বিশাল চেহারার মহিলা এদিকে পিছন ফিরে চেয়ারে বসে খাচ্ছেন। চেয়ারের দু’পাশ থেকে তাঁর শরীর উপচে পড়েছে।
অর্জুন ভাবল একবার পাক দিয়ে এলে হয়। সিকি মাইল জায়গা জুড়ে ডিউটি শপগুলো ঝলমল করছে। ঘুরে ঘুরে দেখতেই অনেক সময় কেটে যাবে। না, কোনও কোনাকাটা করার ইচ্ছে তার নেই। আর হলেও, তার সাধ্য নেই। এখন ডলারের দাম কমেছে। বছরখানেক আগে সাতচল্লিশ টাকায় এক ডলার পাওয়া যেত। এখন সাঁইত্রিশ টাকা লাগছে। সে মাত্র একশো ডলার কিনে এনেছে। কাউকে বলা যাবে না অঙ্কটা, কিন্তু ভারতীয় মুদ্রায় টাকাটা তার কাছে কম নয়। বিলাসদ্রব্য কিনে সেটা কমিয়ে ফেলা বোকামি।
এই সময় একটি ছিপছিপে মধ্যবয়সি মহিলা ভিতরে ঢুকলেন। দরজার পাশে বসা মহিলাকে কাগজ দিয়ে সোজা চলে এলেন অর্জুনের সামনে, আমার খুব খিদে পেয়েছে। কোথায় খাব?
কথাগুলো ইংরেজিতে কিন্তু বলার ভঙ্গি এত জড়ানো যে, মর্ম উদ্ধার করতে সময় লাগল অর্জুনের। সে মাথা নাড়ল, আমি জানি না।
কেমন লোক আপনি? একজন মহিলার খিদে পেয়েছে শুনেও চুপচাপ বসে আছেন, খুঁজে দেখবেন না? এখানে তো খাবার থাকার কথা!
ওই মহিলাকে জিজ্ঞেস করলে নিশ্চয়ই জানতে পারবেন।
মাই গড। ওর মুখ দেখলে মনে হবে সমাধির পাশে বসে আছে।
অতএব উঠতে হল। বাঁ দিকের চেয়ার-টেবিলের কাছে যেতেই থামের আড়ালে থাকা সেলফগুলো চোখে পড়ল। থরেথরে নানান ধরনের খাবার সাজানো রয়েছে। স্যান্ডউইচ থেকে হটডগ, প্যাটিস, পেস্ট্রি। কেক, ডিমসেদ্ধ, পাউরুটি, কী নেই! ওপাশে চা-কফির সরঞ্জাম। ডান দিকে নানা পানীয়। কিন্তু কোনও সেলসম্যান নেই। সে পিছু হেঁটে মহিলাকে মাথা নেড়ে ইশারা করতেই তিনি চলে এলেন। খাবারের চেহারা দেখে বিরক্ত হয়ে বললেন, উঃ, এরা বাঁধাধরা খাবারের বাইরে কিছু ভাবতে পারে না। বিনেপয়সায় খাওয়াচ্ছে বলে একটু চিন্তাভাবনা করবে না?
অর্জুন দেখল, মহিলা দুটো হটডগ, একটা বিয়ারের ক্যান নিয়ে টেবিলে রেখে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি খাবেন না? খেয়ে নিন। বাইরে এগুলোরই অনেক দাম।
মহিলা চেয়ার টেনে বসে পড়লেন খেতে।
অরূপ লাহিড়ি বলেননি লাউঞ্জে বিনেপয়সায় খাবার পাওয়া যায়। প্লেটে কিছু খাবার আর জল নিয়ে অর্জুন টেবিল খুঁজতেই মহিলা বললেন, এখানে বসে পড়ুন।
অতএব ওঁর উলটো দিকে বসল অর্জুন। খাওয়া শুরু করতেই মহিলা বললেন, আপনি কি স্প্যানিশ?
চমকে উঠল অর্জুন। ঠিক শুনছে তো? সে বলল, পার্ডন!
ওঃ। আপনি কি স্প্যানিশ? শেষ তিনটে শব্দ কেটে কেটে উচ্চারণ : করলেন মহিলা।
নো। আমি ভারতীয়।
ভারতীয়? ও নো, ইম্পসিবল?
ভারত অনেক বড় দেশ। আমি যেখানে থাকি সেই অংশের নাম পশ্চিমবঙ্গ।
কিন্তু চেহারায় স্প্যানিশ ছাপ আছে।
আপনি কোন দেশ থেকে এসেছেন?
আমি মেক্সিকান। কিন্তু নিউ ইয়র্কে থাকি। ও কে! আমি এবার ঘুমোতে যাব। বলে মহিলা খাবারের শূন্য প্লেট, খালি ক্যান গারবেজ ব্যাগে ফেলে দিয়ে চলে গেলেন।
স্প্যানিশ! নিজের গালে বাঁ হাত বোলাল অর্জুন। আজ পর্যন্ত কেউ বলেনি যে, তাকে স্প্যানিশদের মতো দেখতে। কোথায় স্পেন আর কোথায় জলপাইগুড়ি। স্প্যানিশরা কি ইংরেজদের মতো সাদা চেহারার মানুষ নয়?
খাওয়া শেষ করে বাইরের করিডরে চলে এল সে। এখানে সূর্যের আলো ঢোকে না। কিন্তু বিদ্যুৎ এখানে সূর্যের আলোকে হার মানিয়েছে। অর্জুন দেখল, দেওয়ালে ঠেস দিয়ে প্রচুর ছেলেমেয়ে বসে আছে। সম্ভবত ওদের কাছে লাউঞ্জে ঢোকার কাগজ নেই। অথচ পরের প্লেন ধরার জন্যে অনেকটা সময় কাটাতে হবে।
দুটো রেস্টুরেন্ট পেরোতেই ডান দিকের কাঁচের দেওয়ালের ওপাশে অদ্ভুত দৃশ্য দেখতে পেল সে। পরপর লম্বা ডিভান পাতা রয়েছে। ডিভানের একটা দিক ঈষৎ উঁচু। সেগুলোর বেশির ভাগই ভরতি। লোকজন ঘুমোচ্ছে এখানে। ওই মহিলা নিশ্চয়ই এখানে ঘুমোতে এসেছেন। দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকল অর্জুন। কিন্তু কেউ এগিয়ে এসে প্রশ্ন করল না। কিছুটা হেঁটে একটা খালি ডিভান পেয়ে শরীর এলিয়ে দিল সে। আঃ, কী আরাম!
এই বিশাল হলঘরে কোনও শব্দ নেই। যেন ঘুমে কাদা হয়ে আছে মানুষজন। অর্জুনেরও ঘুম আসছিল। হঠাৎ একটা মেয়েলি গলা কানে এল। ফিসফিস করে কিছু বলছে। তারপর হাসির শব্দ। উঠে বসে চারপাশে তাকাল সে। কোথাও কেউ বসে বা দাঁড়িয়ে কথা বলছে না। অথচ গলার স্বর কানে আসছে।
অর্জুন দু’পাশের শায়িত শরীরগুলোর দিকে তাকাল। সবাই ঘুমোচ্ছে। একজন আপাদমস্তক মুড়ে। তার দিকে এগিয়ে গেল সে। কথাগুলো স্পষ্ট হল। মোবাইলে কথা বলছেন মহিলা। ইংরেজি উচ্চারণ জড়ানো হলেও কথাগুলো বুঝতে পারল অর্জুন। ওই বুড়ি বেঁচে থাকা পর্যন্ত তুমি একটা পয়সাও পাবে না। ও একটা ডাইনি। তারপর একটু চুপ করে থেকে আবার কথা, তুমি একটি নির্বোধ! ও কখনওই অসুস্থ হবে না। আরও কত বছর বেঁচে থাকবে তা ঈশ্বরও জানেন না। আমি তোমাকে বলছি না ওকে মেরে ফেলতে, কিন্তু ও যাতে বেঁচে না থাকে তার ব্যবস্থা তো করতে পারো। আবার চুপচাপ। অর্জুন কান খাড়া করল। মহিলা হাসলেন, হ্যাঁ, একটা অ্যাক্সিডেন্টের আয়োজন করতে হবে। মারা যাওয়ার পর পুলিশ যেন সন্দেহ না করে!’ আবার চুপচাপ। তারপর, ওয়েল, আমি তোমাকে কয়েকটি প্ল্যান দিতে পারি। বেস্ট যেটা সেটা কাজে লাগাও। আর হ্যাঁ, এটা ঘটাতে তোমাকে আমি দু’মাস সময় দিলাম। তার মধ্যে যদি বুড়ি না মরে তা হলে তোমার সঙ্গে কোনও সম্পর্ক রাখব না। বাই! এবার একটু ঘুমোতে যাই।
অবাক হয়ে দেখল অর্জুন। পা থেকে মাথার চুল চাদরের আড়ালে ঢাকা, একটুও না নড়ে মহিলা যে কথাগুলো বললেন তা রীতিমত ভয়ংকর। যাকে ফোন করে বৃদ্ধাকে মেরে ফেলতে বলছেন, না মারলে একটা পয়সাও পাওয়া যাবে না, সে নিশ্চয়ই পুরুষ। বৃদ্ধা নিশ্চয়ই লোকটার আত্মীয় হন। এই মহিলার মুখ দেখতে ইচ্ছে করছিল খুব। এই মুহূর্তে পৃথিবীর কত মানুষ তো খুনের পরিকল্পনা করছে, সে কী করতে পারে! কিন্তু অ্যাক্সিডেন্ট মনে হবে অথচ মারা যাবে এমন প্ল্যান যে দিতে পারে, তার মুখ দেখতে খুব ইচ্ছে। করছিল। চাদর সরিয়ে মুখ দেখা যাবে না। মহিলা চিৎকার করলে পুলিশ তাকে জেলে পুরবে। কেন চাদর তুলেছিল তা বললেও পুলিশকে প্রমাণ দিতে না পারায় বিশ্বাস করাতে পারবে না। অবশ্য ধৈর্য ধরে জেগে থাকলে মহিলা যখন ঘুম থেকে উঠবেন তখন দেখা যেতে পারে। কিন্তু ততক্ষণ ধৈর্য ধরে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। অর্জুন লক্ষ করল, ওই ডিভানের পাশে একটা ট্রলির উপর সুটকেস চাপানো আছে। হ্যান্ডব্যাগ হিসেবে ওটা নিয়ে প্লেনে ওঠা যায়। সে পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ট্রলিটাকে একটু ঘুরিয়ে বেশ জোরে ঠেলে দিয়ে নিজের ডিভানে শুয়ে পড়ল।
শোওয়ামাত্র ট্রলিটা ধাক্কা খেল দেওয়ালে। শব্দ হল বেশ জোরে। অর্জুন চোখ অর্ধেক খুলে দেখল, চাদর সরিয়ে যে মেয়েটি উঠে বসেছেন তাঁর চুল সোনালি। ডিভান থেকে নেমে মেয়েটি ছুটে গিয়ে ট্রলিটা ধরে চারপাশে তাকালেন। চারপাশের মানুষ যেভাবে ঘুমোচ্ছে তাতে কাউকে সন্দেহ করার সুযোগ তিনি পাচ্ছেন না। চাপা গলায় মেয়েটি বললেন, হু ডিড ইট?
ততক্ষণে ওর মুখ দেখা হয়ে গিয়েছে। লাবণ্য নেই এক ফোঁটাও, মুখের গড়ন বেশ কাটকাট, অসুন্দরী বলা যাবে না। যে পাশে ট্রলি ছিল তার ওপাশের ঘুমন্ত লোকটির কাছে গিয়ে মেয়েটি কিছু বলতে গিয়ে ইতস্তত করলেন। তারপর ট্রলিটাকে নিজের ডিভানের গায়ে এনে একটা পা তার উপর তুলে দিয়ে আবার ঘুমোবার চেষ্টা করলেন।
যে মুখে লাবণ্য নেই, ঠিকঠাক মুখের গড়নের উপর টানটান চামড়া থাকে, সেই মহিলারা নিজের স্বার্থ ছাড়া কিছু বোঝে না। সেই বৃদ্ধার জন্যে কষ্ট হল অর্জুনের। তিনি কোন দেশে আছেন তা জানা নেই। কিন্তু একটা অ্যাক্সিডেন্টের পরিকল্পনা হচ্ছে তার জন্যে, সেটা ঠিকঠাক হলে তিনি আর পৃথিবীতে থাকবেন না।
লম্বা একটা ঘুম দিয়ে অর্জুন দেখল, পাশের ডিভানে একটা মোটাসোটা আফ্রিকান ভদ্রলোক শুয়ে আছেন। সেই মেয়েটি নেই। সে যখন ঢুকেছিল তখন যারা ঘুমিয়েছিল তাদের অনেকেই এখন প্লেনের পেটে বসে আছে।
সে টয়লেট থেকে বেরিয়ে পা বাড়াতেই শুনতে পেল, এই যে, একটা বুদ্ধি দিন তো!
মুখ ফিরিয়ে রেস্টুরেন্টে খাবার নেওয়া মহিলাকে দেখতে পেল অর্জুন। মহিলা বললেন, এরকম বদখত মহিলা আমি জীবনে দেখিনি। এখানে একটু ঘুমোতে এসেছিলাম। ঘুমিয়ে আবার ওই লাউঞ্জে ফিরে যেতে মহিলা বললেন নতুন ভাউচার লাগবে। তখন যেটা দিয়েছিলাম তাতে আট ঘণ্টা থাকা যেত। কিন্তু একবার বেরিয়ে বাইরে এক ঘণ্টা কাটালে পুরনো ভাউচার অকেজো হয়ে যাবে। অথচ আট ঘণ্টা শেষ হতে এখনও অনেক দেরি আছে।
যদি এটাই নিয়ম হয়ে থাকে তা হলে মানতেই হবে।
মানতেই হবে? নিয়মটা অমানবিক হলেও মানতে হবে? তা ছাড়া নিয়মটা করেছে কে? আপনার কি প্রতিবাদ করার ইচ্ছে হচ্ছে না? মহিলা ঝাঁঝিয়ে উঠলেন।
প্রতিবাদ করলেও কোনও কাজ হবে বলে মনে হয় না?
কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে ভদ্রমহিলা বললেন, ঠিক। আমি একটা ভুল ভেবেছি।
মানে?
আপনাকে আমি স্প্যানিশ ভেবেছিলাম। আপনি মোটেই তা নন। আপনি একশো ভাগ ভারতীয়? ভদ্রমহিলা আর দাঁড়ালেন না।
হকচকিয়ে গিয়েছিল অর্জুন। ভদ্রমহিলা তাকে ঘুরিয়ে গালিগালাজ দিয়ে গেলেন। এঁরা নিশ্চয়ই মনে করেন ভারতীয় মানে খুব দুর্বল, প্রতিবাদ করতে চায় না। অন্যায় মেনে নেয়। এরকম ধারণা কী করে হল কে জানে!
ডিউটি ফ্রি শপগুলোর সামনে দিয়ে হাঁটা একটা বিরল অভিজ্ঞতা। পারফিউমের দোকানে গিয়ে তার চোখ ছানাবড়া। পঞ্চাশ থেকে পাঁচশো ডলারের পারফিউম লোকে কিনছে। কর ছাড়া বিক্রি হচ্ছে বলে বাইরের চেয়ে এখানে বেশ সস্তায় পাওয়া যাচ্ছে।
মাত্র একশো ডলার যার পকেটে তার উচিত শুধু দেখে যাওয়া। দোকানের সামনে একটি সুদৃশ্য গাড়ি দাঁড়িয়ে। দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যায়। এরকম চারটে দোকান থেকে জিনিস কিনলে যে রসিদ পাওয়া যাবে তার নাম্বার নিয়ে মাসে একবার লটারি হবে। লটারিতে রসিদের নাম্বার উঠলে এই গাড়ি পুরস্কার হিসেবে পাওয়া যাবে। অর্থাৎ একটা পঞ্চাশ ডলারের পারফিউম কিনলে এক লক্ষ ডলারের গাড়িটার চাবি পকেটে আসতে পারে। কিন্তু অসম্ভব, পঞ্চাশ ডলার সে ইচ্ছে করলেও খরচ করতে পারবে না। অর্জুন দেখল, জিনিস। কিনে লোকেরা লাইন দিয়ে পাসপোর্ট বোর্ডিং কার্ড দেখিয়ে পেমেন্ট দিচ্ছে। তারপর যে যার গন্তব্যে উড়ে যাবে। ধরা যাক, লটারি হবে দিন দশেক পরে। যার নাম্বার সেই লটারিতে উঠবে সে হয়তো থাকে কুচবিহারে। পাসপোর্টের নাম্বার দেখে এরা কি তার সঙ্গে যোগাযোগ করবে? না করলে তো সেই ভদ্রলোক কোনও দিন জানতেও পারবেন না। সে লক্ষ করল, পাসপোর্টের নাম্বারটাই ওরা রসিদে লিখছে, কোথা থেকে ইস্যু হয়েছিল, কোন তারিখে, তা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না। শুধু ওই নাম্বার দেখে তোক কী করে খুঁজে পাবে কে জানে!
ঘুরতে ঘুরতে আবার অর্জুন ফিরে এল সেই জায়গায় যেখানে সে শুয়ে ছিল। এখনও প্রায় ঘণ্টাখানেক বাকি আছে প্লেন ছাড়তে। ভিতরে তাকিয়ে সে দেখল, ডিভানগুলো আবার ভরতি হয়ে গিয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ দুবাইতে নেমে ডিভানগুলোতে কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে আবার বিভিন্ন প্রান্তে উড়ে যাচ্ছে।
এই সময় হন্তদন্ত হয়ে সেই সোনালি চুলের মেয়েটি কাঁচের দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে গিয়ে যে ডিভানে শুয়ে ছিলেন তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। সেখানে সেই আফ্রিকান ভদ্রলোক নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছেন। মেয়েটি ডিভানের আশপাশ দেখলেন, ঝুঁকে নীচের দিকে তাকালেন। শেষ পর্যন্ত মরিয়া হয়ে লোকটির কাঁধে টোকা দিয়ে কিছু বললেন। খুব বিরক্ত মুখে লোকটি মাথা নেড়ে আবার চোখ বন্ধ করল। সোনালি চুলের মেয়েটি যে খুব হতাশ হয়েছেন তা বোঝা যাচ্ছিল। কাঁচের দরজা ঠেলে বেরিয়ে এসে তিনি অর্জুনের দিকে তাকালেন। কপালে ভাঁজ পড়ল। তারপর বললেন, এক্সকিউজ মি! আপনি আমার পাশের ডিভানে শুয়ে ছিলেন? নীরবে মাথা নাড়ল অর্জুন, হ্যাঁ।
আমি আমার সেলফোনটা হারিয়ে ফেলেছি। অথবা আমি যখন ঘুমোচ্ছিলাম তখন কেউ ওটা তুলে নিয়েছে। বাই এনি চান্স, আপনি কি ওটা দেখেছেন?
না। খুব দামি সেট বোধহয়?
নট দ্যাট। আজ এখানে এসে আমি একজনের সঙ্গে যে কথা বলেছিলাম তা রেকর্ড করে রেখেছিলাম। সেটা এক বৃদ্ধা মহিলাকে শোনানো খুব দরকার। সেই অর্থে ওই সেলফোনটার অনেক দাম। কী যে করি! সোনালিচুল ঠোঁট কামড়ালেন।
কমপ্লেন করুন।
করেছি। ওরা পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেমে অ্যানাউন্স করেছে। লাভ হয়নি। স্লান মুখে বললেন মেয়েটি।
কিছু মনে করবেন না। আপনি বলছেন, একজনের সঙ্গে যা কথা বলেছেন তা রেকর্ড করেছেন একজন বৃদ্ধাকে শোনাবেন বলে। এটা পরে আবার করতে পারেন না?
না। ও নেশার ঘোরে যা বলেছে তা স্বাভাবিক অবস্থায় বলবে না। উলটে সন্দেহ করবে।
ও। উনি নিশ্চয়ই এই বৃদ্ধার বিরুদ্ধে কিছু কথা বলেছেন?
হঠাৎ সোনালিচুল ঘুরে দাঁড়ালেন, আপনার এত কৌতূহল কেন?
আমার মনে হচ্ছে আপনি বৃদ্ধাকে সতর্ক করে দিতে চান।
হ্যাঁ। কিন্তু আপনার এটা মনে হচ্ছে কেন?
সেলফোনটা আপনি খুঁজছেন, না পেয়ে আপসেট হচ্ছেন সেই কারণে। আপনি ওই বৃদ্ধাকে সতর্ক করবেন কেন? নিশ্চয়ই তাঁর বিপদ হতে পারে। কেউ তাঁকে খুন করতে পারে অথবা একটা অ্যাক্সিডেন্টের বাহানা তৈরি করে মেরে ফেলতে পারে। অতএব ওই বৃদ্ধা যেন লোকটিকে বিশ্বাস না করেন। সেটা করবেন না ওঁর নিজের গলায় বলা কথাগুলো শুনলে। ভুল বলছি?
আপনি কে?
আমি একজন টুরিস্ট।
হঠাৎ চোখ বড় হল সোনালিচুলের, বুঝতে পেরেছি। আমি কাল সেলফোনে যা বলেছি তা পাশের ডিভানে শুয়ে আপনি শুনতে পেয়েছেন?
অত জোরে কথা বললে কান বন্ধ রাখব কী করে?
তা হলে বুঝতেই পারছেন ওই সেলফোনটা পাওয়া কত জরুরি।
নিশ্চয়ই। সেটা যখন পাচ্ছেন না তখন এখনই ওই বৃদ্ধাকে ফোনে সব কথা খুলে বলুন। বেশি দেরি করবেন না।
কেন?
ভদ্রলোকের মুখ থেকে কথা বের করতে গিয়ে আপনিও তো কম কিছু বলেননি। শুধু ওই কথাগুলো বলার জন্যে আপনার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। আপনি যেমন রেকর্ড করে রেখেছেন, তেমনই উনিও আপনার কথা রেকর্ড করে রাখতে পারেন। বৃদ্ধাকে শুনিয়ে তার কাছের লোক হয়ে যেতে পারেন, যা আপনি হতে চাইছেন। উনি বৃদ্ধার কাছে পৌঁছোবার আগেই ফোনটা করে ফেলুন।
অর্জুনের কথা শেষ হতেই থ্যাঙ্ক ইউ, বলে সোনালিচুল ছুটে গেলেন দেওয়ালের গায়ে ঝোলানো ফোনগুলোর দিকে। তখনই আকাশবাণী হল, নিউ ইয়র্কগামী এমিরেটসের প্লেন আঠাশ নাম্বার গেট থেকে উড়বে। প্যাসেঞ্জারদের সিকিউরিটি চেকিং-এর জন্যে যেতে বলা হচ্ছে।
অনেকটা পথ হেঁটে আঠাশ নাম্বার গেটে পৌঁছোতেই পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেমে ঘোষণা শোনা গেল, মিস লিজা ক্লিন্টন, দয়া করে এনকোয়ারিতে চলে আসুন। আপনার সেলফোন লেডিস টয়লেটে পাওয়া গিয়েছে।
অর্জুন সোনালিচুলের মুখ অনুমান করল। যদি এর মধ্যে বৃদ্ধার সঙ্গে তাঁর কথা হয়ে গিয়ে থাকে তা হলে এখন ছুটছেন সেলফোন ফিরিয়ে নিতে। বৃদ্ধার মৃত্যুর জন্যে যিনি দু’মাসের বেশি অপেক্ষা করবেন না বলেছিলেন, তিনিই আজ বৃদ্ধাকে সতর্ক করছেন। এরকম অভিজ্ঞতা অর্জুনের আগে হয়নি।
দুবাই থেকে নিউ ইয়র্ক যাওয়ার পথে কোথাও নামছে না প্লেন। যত উড়ছে তত সময় পিছিয়ে যাচ্ছে। এতক্ষণে কলকাতায় রাত নেমে যাওয়ার কথা, কিন্তু এখানে এখনও দুপুর। সারা আকাশ জুড়ে সূর্য। সাদা মেঘ নীচে থাকায় পৃথিবীটা দেখা যাচ্ছে না। নিউ ইয়র্কে এখন বোধহয় রাত শেষ হয়নি। চোখ বন্ধ করলেও ঘুম আসছিল না। অথচ আশপাশের মানুষগুলো নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। পৃথিবীর আকাশের অন্তত পঁয়ত্রিশ হাজার ফুট উঁচুতে এই প্লেনটা যেন একটা ছোটখাটো পৃথিবী হয়ে আছে। চিনে ভদ্রলোকের পাশে আফ্রিকান, জাপানির পাশে আরবের, আমেরিকানের পাশে বাংলাদেশের মানুষ।
টয়লেটে যাওয়ার জন্যে প্যাসেজে পা রাখল অর্জুন! দুটো দরজাতেই ‘অকুপায়েড’ শব্দটা জ্বলছে। একটা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সে দু’পাশে তাকাল। একমাত্র প্লেনের নম্র গর্জন ছাড়া কোনও শব্দ নেই। সামনের দরজাটা খুলে যেতে সে একটু সরে দাঁড়াল, যাতে বেরিয়ে আসা মানুষটি স্বচ্ছন্দে যেতে পারে।
আরে! আপনি এখানে?
অর্জুন তাকাল। অবাক হয়ে প্রশ্ন করছেন দুবাই এয়ারপোর্টের সোনালিচুল।
এমিরেটসে নিউ ইয়র্ক যেতে হলে এই ফ্লাইটে যেতে হবে।
আপনি নিউ ইয়র্কেই যাচ্ছেন?
হ্যাঁ।
নিশ্চয়ই আপনি আমাকে অনুসরণ করবেন না?
কোন দুঃখে! মেয়েটি বেরিয়ে আসায় চটপট ভিতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল অর্জুন। টয়লেটের ভিতরটা বেশ ছোট কিন্তু তার মধ্যেই সব বন্দোবস্ত রয়েছে। মিনিট আড়াই পর সে বেরিয়ে আসতেই দেখল, সোনালিচুল নিজের সিটে না ফিরে গিয়ে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছেন।
আপনি কোথায় বসেছেন?
ওই ওপাশে।
আপনার সঙ্গে তো হ্যান্ডব্যাগ ছিল না?
না।
আমার পাশের সিট খালি আছে। আপনি যদি এসে বসেন তা হলে আমরা কথা বলতে পারি। আমার আর টিভি দেখতে ভাল লাগছে না।
এক মুহূর্ত ভেবে অর্জুন মাথা নাড়ল, তারপর মেয়েটিকে অনুসরণ করল। এই ফ্লাইটের প্রত্যেক আসনের সামনে একটা ছোট টিভি মনিটর রয়েছে, যেটা সামনের সিটের পিছনে লাগানো। হেডফোন ব্যবহার করে তার সংলাপ শুনতে হয়।
পাশাপাশি তিনটে সিটের দুটোই খালি। সোনালিচুল জানলার পাশে বসলে অর্জুন মাঝখানের সিট ছেড়ে তৃতীয়টিতে বসল।
আপনি কেন আমেরিকা যাচ্ছেন?
বেড়াতে।
ও। আমি লিজা ক্লিন্টন।
একটু আগে আপনার নাম দুবাই এয়ারপোর্টের সবাই শুনেছে। আপনি আপনার সেলফোন ফিরে পেয়েছেন। আমি অর্জুন।
অ-র-জু-ন?
অর্জুন হাসল, ও কে!
কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে লিজা বলল, ফোনটা ফিরে পেয়ে কোনও লাভ হল না।
কেন? আপনি তো সেই বৃদ্ধাকে শোনাতে পারবেন!
জানি না পারব কিনা! উনি এখন হাসপাতালে!
হাসপাতালে? চমকে তাকাল অর্জুন।
আপনার পরামর্শ যদি কয়েক ঘণ্টা আগে পেতাম তা হলে ভদ্রমহিলাকে দুর্ঘটনায় পড়তে হত না। সাবধান করে দিতাম। বিষণ্ণ মুখে বললেন লিজা।
দুর্ঘটনা কীভাবে ঘটল?
জানি না। কেউ একজন ফোন ধরেছিল। বলল, আধ ঘন্টা আগে ওঁর একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে, হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এইটুকু বলে লাইন কেটে দিল। এখন কী হবে?
অর্জুন মাথা নাড়ল, আপনি এখন বিপদে পড়েছেন।
কেন?
দুর্ঘটনা ঘটার আগেই যদি আপনি বৃদ্ধাকে সব জানিয়ে সতর্ক করে দিতেন, তা হলে আপনার দিকটা পরিষ্কার হয়ে যেত। কিন্তু তা যখন পারেননি, মানে, সুযোগ পাননি, তাই এই দুর্ঘটনা ঘটিয়ে বৃদ্ধাকে খুন করার জন্যে পরামর্শ দেওয়ার অভিযোগে পুলিশ আপনাকে গ্রেপ্তার করতে পারে। অর্জুন বলল।
ও মাই গড। দু’হাতে মুখ ঢাকলেন লিজা, আমি ওই সব বলে ওকে তাতাচ্ছিলাম যাতে ও মনের কথা বলে ফেলে এবং বৃদ্ধা ওর আসল চেহারাটা বুঝতে পারেন।
এই লোকটির সঙ্গে আপনার কীরকম সম্পর্ক?
ও ওই বৃদ্ধার ভাইয়ের ছেলে। আমাকে বিয়ে করতে চায়। কিন্তু ওর রোজগার খুব কম। অথচ বৃদ্ধা খুব ধনী। তার মৃত্যুর পরে ওই সব পেয়ে যাবে। কিন্তু আমার একটুও পছন্দ নয় ওকে। অনেক বলেছি কিন্তু শুনতে চায়নি। শেষে আমি বললাম, বৃদ্ধার মৃত্যু কবে হবে আর তারপর সে । সম্পত্তি পাবে। আমি এর মধ্যে নেই। তখন সে চাইল বৃদ্ধাকে সরিয়ে দিতে। আমি অবাক হয়ে গেলাম। ওর চেহারাটা চিনলাম। মুখে বললে বৃদ্ধা বিশ্বাস করবেন না, ওর কথাগুলো তাই সেলফোনে রেকর্ড করে রাখলাম। কিন্তু ও যে এত তাড়াতাড়ি কাজে নেমে পড়বে ভাবিনি। চোখ মুছলেন লিজা।
প্রার্থনা করুন যাতে বৃদ্ধা সুস্থ হয়ে ওঠেন। অর্জুন বলল, আর এমনও তো হতে পারে, ওই লোকটি এই দুর্ঘটনা তৈরি করেনি? বৃদ্ধার দুর্ঘটনার পিছনে কারও কোনও পরিকল্পনা ছিল না। এটা নিছকই দুর্ঘটনা?
লিজা দুটো হাত বুকের উপর জড়ো করে চোখ বন্ধ করলেন। ওঁর ওই প্রার্থনার ভঙ্গি দেখে ধীরে ধীরে উঠে নিজের জায়গায় ফিরে এল অর্জুন। এয়ারহোস্টেস এগিয়ে এল, আপনি কি হিন্দু মিল নেবেন?
অর্জুন মাথা নেড়ে বলল, যা ইচ্ছে দিন।
.
০২.
জন এফ কেনেডি এয়ারপোর্টে নেমে অন্য যাত্রীদের পিছন পিছন হেঁটে এসে ইমিগ্রেশনের লাইনে দাঁড়াল অর্জুন। বেশ বড় লাইন। এই সময় অন্য দেশ থেকে যেসব প্লেন এসেছে তাদের যাত্রীরাও লাইনে রয়েছে। প্রায় একঘণ্টা দাঁড়াবার পর সে অফিসারের সামনে পৌঁছে পাসপোর্ট বাড়িয়ে দিল। ভদ্রলোক তার পাতা উলটে ভিসা দেখে একটা যন্ত্রের নীচে রেখে পরীক্ষা করে জিজ্ঞেস করলেন, দ্বিতীয়বার কেন আসা হচ্ছে?
অর্জুন এবার মেজরের চিঠি এগিয়ে দিল, এই ভদ্রলোক খুব অসুস্থ, আমাকে দেখতে চেয়েছেন। আমার টিকিট, ভিসার খরচ উনিই দিয়েছেন।
আপনার পেশা কী?
আমি সত্য-সন্ধান করি।
কোন সত্যের সন্ধান এখানে করবেন?
আমার কাজের জায়গা ভারতবর্ষ। এখানে আমি একজন অসুস্থ মানুষকে দেখতে এসেছি। আপনাদের কলকাতার কনসুলেট এসব কথা জানে।
সত্যি কথা বলার জন্যে ধন্যবাদ। দয়া করে তেমন কোনও পরিস্থিতি হলে নিজে কিছু করবেন না। পুলিশকে খবরটা দিলেই আপনার কর্তব্য শেষ। ছাপ মেরে পাসপোর্ট ফিরিয়ে দিয়ে অফিসার বললেন, আপনার দিনগুলো ভাল কাটুক।
ঘুরন্ত বেল্ট থেকে সুটকেসটা খুঁজতে গলদঘর্ম হল অর্জুন। কয়েকশো সুটকেস পরপর সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছে। প্রত্যেকটাকেই তার নিজের বলে মনে হচ্ছিল। দু’বার হাত বাড়িয়েও গুটিয়ে নিয়েছে সে। তৃতীয়বার ঘোরার পর সে লক্ষ স্থির রাখতে পারল। চাকা লাগানো বলে ট্রলির দরকার হল না। কাস্টমের গ্রিন চ্যানেলের মধ্যে দিয়ে হেঁটে বাইরে বেরিয়ে আসতেই দেখল, প্রচুর মানুষ দাঁড়িয়ে আছেন পরিচিত যাত্রীর জন্যে। কারও কারও হাতে নাম লেখা প্ল্যাকার্ড। মেজরের পক্ষে নিশ্চয়ই এয়ারপোর্টে তাকে নিতে আসা সম্ভব নয়। ম্যানহাটনে যে ফ্ল্যাটে মেজর থাকতেন সেই জায়গাটা অর্জুনের চেনা। কিন্তু এই সুটকেস নিয়ে যেতে হলে ট্যাক্সি করতে হবে। হয়তো তার পকেটের অর্ধেক ডলার বেরিয়ে যাবে ভাড়া দিতে। কিন্তু মেজর নাকি সেই ফ্ল্যাট ছেড়ে চলে এসেছেন কুইন্সে। জায়গাটা নাকি এয়ারপোর্ট থেকে বেশি দূরে নয়। ট্যাক্সির ভাড়া নিশ্চয়ই ম্যানহাটনের চেয়ে কম হবে।
আর ইউ অর্জুন?
প্রশ্নটা শুনে তাকাল সে। একটি অল্পবয়সি কালো ছেলে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ছেলেটির মুখে বেশ মিষ্টি সারল্য রয়েছে। অর্জুন মাথা নাড়ল, হ্যাঁ।
সঙ্গে সঙ্গে হাত বাড়াল ছেলেটি, মাই নেম ইজ মার্টিন। মিস্টার মেজর আমাকে পাঠিয়েছেন আপনাকে নিয়ে যাওয়ার জন্যে।
হাতে হাত মিলিয়ে অর্জুন জিজ্ঞেস করল, আপনি আমাকে চিনলেন কী করে?
পকেট থেকে একটা ফোটো বের করল মার্টিন, মিস্টার মেজর এটা আমাকে দিয়েছিলেন। বলেছেন, আপনার মুখ বোধহয় পালটায়নি। এটা তো বেশ কয়েক বছর আগের ফোটো। আপনি যখন এখানে এসেছিলেন। মিস্টার মেজর ভুল বলেননি।
কোনও কোনও মানুষকে প্রথমবার দেখলেই ভাল লেগে যায়। মার্টিনকেও ভারী পছন্দ হল অর্জুনের। মার্টিন বলল, আপনার সুটকেসটা তেমন ভারী নয়, তলায় চাকাও আছে। আপনি যদি খুব টায়ার্ড না হন তা হলে আমরা বাসেই যেতে পারি। ট্যাক্সির ভাড়া বেঁচে যাবে।
বাস কোথায় পাওয়া যাবে?
সুটকেসের স্ট্র্যাপটা অর্জুনের হাত থেকে নিয়ে মার্টিন ওটাকে টেনে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল। তখনই একটা বাস সেখানে পৌঁছোতে মার্টিন তাকে ইশারা করে সুটকেস সমেত উপরে উঠে গেল। অর্জুন দেখল, মার্টিন ড্রাইভারকে ভাড়া দিচ্ছে। টিকিট নিয়ে বাসের ভিতরে ঢুকে মার্টিন হাসল। একদম ফাঁকা বাস। মনে হচ্ছে এই বাসটার মালিক আমরা।
পাশে বসে অর্জুন জিজ্ঞেস করল, কত ভাড়া দিলেন?
যা-ই দিয়ে থাকি, আমার পকেট থেকে দিইনি। মিস্টার মেজর আমাকে আপনার ট্যাক্সি ভাড়াও দিয়েছিলেন। ওঁকে অনেক ডলার ফেরত দিতে পারব।
বাস চলতে শুরু করেছে। অর্জুন জানলার বাইরে তাকাল। প্রথমবারের আসার স্মৃতি এখন মেলাতে পারছে না। এয়ারপোর্ট সাধারণত শহরের বাইরে হয়। অতএব শূন্য মাঠ, চমৎকার রাস্তা ছাড়া দেখার কিছু নেই। আকাশের দিকে তাকাল অর্জুন। জলপাইগুড়ির আকাশের সঙ্গে কোনও পার্থক্য নেই। হঠাৎ মাথায় ভাবনাটা এল। কোথায় ভারতবর্ষ আর কোথায় আমেরিকা। মাঝখানে কয়েকটি সমুদ্র। সূর্য থেকে ছিটকে আসা এই গ্রহ শীতল হয়ে যাওয়ার পর সহস্র বছর লেগেছিল অ্যামিবা থেকে মানুষে পৌঁছোতে। প্রায় কাছাকাছি সময়ে ভারতবর্ষের বনমানুষদের বংশধর যেমন মানুষ হয়েছে তেমনই এই আমেরিকায়ও একই প্রক্রিয়া কাজ করেছে। অথচ আমেরিকা আবিষ্কার করার আগে বাকি পৃথিবীর মানুষ এখানকার কথা জানতই না। আর এখন অতলান্তিক পেরিয়ে চলে আসতে আট ঘণ্টা খরচ হয়। প্রশ্ন হল, বনমানুষ থেকে মানুষ হয়ে ভৌগোলিক পরিমণ্ডল অনুযায়ী চেহারা, আচরণ এবং পরবর্তীকালে নিজস্ব ভাষা তৈরি হলেও এই আলাদা আলাদা দ্বিপদ জীবনের মধ্যে অনেক ব্যাপারে মিল থেকে গেল কী করে?
বাস থেকে নেমে অর্জুনের চোখ জুড়িয়ে গেল। ছবির মতো বাড়ি, রাস্তা। ম্যানহাটনের মতো আকাশছোঁয়া বাড়ি এখানে নেই। চওড়া পরিষ্কার রাস্তায় গাড়ি চলছে খুব কম। মিনিট পাঁচেক হেঁটে একটা তিনতলা বাড়ির সামনে পৌঁছে মার্টিন বলল, এই বাড়িটা মিস্টার মেজরের।
অর্জুন দেখল সুন্দর বাড়ির সামনে ফুটপাতে একটা লম্বা ইউক্যালিপটাস গাছ দাঁড়িয়ে আছে। মার্টিন ডোরবেল বাজাল। কয়েক সেকেন্ড পর স্পিকারে। গলা ভেসে এল, ইয়েস!
মার্টিন বলল, মিস্টার মেজর, উই আর হিয়ার।
বলমাত্র দরজায় শব্দ হল। মার্টিন হাতল ঘোরাতেই সেটা খুলে গেল। অর্জুনের মনে হল এই ব্যাপারটা দেশে চালু করলে খুব ভাল হয়। তা হলে দরজা খোলার জন্যে বারবার উপর-নীচ করতে হয় না।
সুটকেসটা মার্টিনই টেনে তুলল। দোতলার দরজা খুলে দাঁড়িয়ে ছিলেন মেজর। দু’হাত বাড়িয়ে তিনি অর্জুনকে তার বুকে টেনে নিলেন। অর্জুন বুঝতে পারল মেজর আরও মোটা হয়েছেন।
আলিঙ্গনের পর অর্জুনের দু’কাধ ধরে মেজর বললেন, আমি খুব খুশি আমার অনুরোধ রেখেছ বলে। এখন বলো, কেমন আছ?
আমি ভাল আছি। আপনার শরীর কেমন?
সব ছেড়ে বসে আছি, কোনও পিছুটান নেই, যেই ডাক আসবে চলে যাব।
কোথায়?
মেজর হাত তুলে উপরের দিকটা দেখালেন।
অর্জুন হাসল, আপনি কী করে জানলেন উপরেই যাবেন। ওটা নীচে বা পাশেও হতে পারে। অথবা কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই, মৃত্যুর পর মানুষের সব অস্তিত্ব মিলিয়ে যায় বাতাসে।
ভাল বলেছ। কিন্তু আর নয়। চলো, তোমাকে তোমার ঘর দেখিয়ে দিই। স্নান করে পেট ভরে খেয়ে নিয়ে একটা লম্বা ঘুম দাও। অনেকটা পথ এসেছ, জেট ল্যাগ হয়ে গেলে কষ্ট পাবে। মেজর ওর হাত ধরে ওপাশের যে ঘরে নিয়ে গেলেন সেটি চমৎকার সাজানো। মেজর বললেন, দ্যাখো, পছন্দ হয়েছে?
চমৎকার। এই বাড়িটা কবে কিনেছেন?
বছরখানেক হল। ম্যানহাটনের আকাশছোঁয়া বাড়ির ফ্ল্যাটে থেকে হাঁপিয়ে উঠছিলাম। মাটিতে হাটাহাটি করা ওখানে সম্ভব নয়। ম্যানহাটনে জীবন চব্বিশ ঘণ্টা এত জোরে ছোটে যে, তার সঙ্গে তাল রাখার বয়স আমার চলে গিয়েছে। তাই চলে এলাম এখানে। ওই দ্যাখো, ওটা একটা চাপাগাছ। আমাদের দেশের চাপা নয়, চাপার মতো দেখতে বলে আমি নাম দিয়েছি চাপাগাছ। তার পাশে দেবদারু। এই দুটো গাছে থাকতে খুব ভালবাসে কাঠবিড়ালিরা। এর মধ্যেই ওরা আমার বন্ধু হয়ে গিয়েছে। রোজ ভোরে আর বিকেলবেলায় ওদের চিনেবাদাম খাওয়াতে হয়। আর এই পাড়াটা দ্যাখো। একদম ছবির মতো, কোনও বাড়িই চারতলা নয়। মেজরকে খুব তৃপ্ত দেখাচ্ছিল।
এই সময় মার্টিন কাছে এল। হেসে বলল, আপনি বলছিলেন অর্জুন খুব টায়ার্ড?
ও হো! নিশ্চয়ই। যাও অর্জুন, চেঞ্জ করে একটা শাওয়ার নিয়ে নাও। তারপর কিছু খেয়ে লম্বা ঘুম দাও। পরে গল্প করব। অর্জুনের পিঠ চাপড়ালেন মেজর।
স্নান সেরে পোশাক বদলাতে বদলাতে অর্জুনের মনে হল, মেজরের স্বভাবের অনেক পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে। আগের মতো কথায় কথায় রেগে যাওয়া, সেই ডোন্ট কেয়ার ভাবটা একদম নেই। পাকা দাড়ি, টাক পড়ে যাওয়া মাথায় এখন ওঁকে বেশ স্নেহশীল দাদু ছাড়া অন্য কিছু ভাবা যায় না।
.
০৩.
অর্জুনের ঘুম ভাঙল বিকেল চারটে নাগাদ। মুখ ধুয়ে পোশাক পালটে সে ব্যালকনিতে দাঁড়াতেই দৃশ্যটা দেখতে পেল। মূল দরজার বাইরে মোড়া পেতে বসে আছেন মেজর। দুটো হাত সামনে বাড়ানো। তাতে প্রচুর চিনেবাদাম। আর, অর্জুন গুনল, ন’টা কাঠবিড়ালি তার কাধ থেকে হাতে নেমে এগিয়ে গিয়ে এক-একটা বাদাম তুলে নিয়ে লাফিয়ে নেমে খাচ্ছে। ওদের খাওয়ার ধরনটা চমৎকার। দুটো পায়ের উপর ভর করে দাঁড়িয়ে উপরের দুটো পা। হাতের মতো ব্যবহার করে বাদাম খাচ্ছে। অজুর্ন নীচে নেমে আসতেই সব ক’টা কাঠবিড়ালি দুদ্দাড় করে সামনের গাছ দুটোয় উঠে গেল। অর্জুন বলল, সরি!
তোমাকে কখনও দ্যাখেনি তো! দেখলেই হবে না, তোমার গায়ের গন্ধ যতক্ষণ ওদের পছন্দ না হবে ততক্ষণ তোমাকে ওরা বন্ধু বলে ভাববে না। মার্টিনকে তো রোজ দেখছে, কিন্তু ওই কারণে ওকে পছন্দ করে না। হাসলেন মেজর।
মার্টিন কোথায়?
ও কাজে গিয়েছে। তোমাকে আনতে হবে বলে ও ডিউটি বিকেলের শিটে করে নিয়েছিল। কেন? চা খাবে? চলো, করে দিচ্ছি।
না না, আপনি বসুন। আমি চা করছি।
তুমি করবে? লাস্ট কবে চা বানিয়েছ?
এটা তো সুক্তো রান্না নয়! আমি করছি, খেয়ে বলবেন।
অর্জুন উপরে উঠে গেল। কিচেনে ঢুকে সে বেশ ঘাবড়ে গেল। গ্যাস আছে, পাশে জলের ব্যবস্থা। ওপাশে সিঙ্ক। কিন্তু উপরে দুটো তাকে অন্তত গোটা তিরিশেক কৌটো পরপর সাজানো আছে। প্রথমটা খুলতেই পাঁচফোড়ন দেখা গেল। কোনওটায় চা আছে, কোনওটায় চিনি। তা বের করতে হলে তো সব ক’টাই খুলে দেখতে হবে। দ্বিতীয় তাকে হাত না দিয়ে গ্যাসের সামনের কৌটো খুলতেই টি-ব্যাগ পেয়ে গেল অর্জুন। পাশেরটায় চিনি। তার পরেরটায় লবণ। জিভে স্বাদ নিয়ে ও দুটোকে আলাদা করতে হল।
অর্জুন ব্যালকনিতে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, আপনি কি চায়ে চিনি খান?
কথা না বলে মাথা নেড়ে ‘না’ বললেন মেজর। কারণ, এখন তাঁর শরীর জুড়ে কাঠবিড়ালিরা খেলা করছে। অর্জুনের মনে হল, কাঠবিড়ালিরা মেজরকে একটা ছোট্ট গাছ বলে ভেবে নিয়েছে। ম্যানহাটনের আকাশচুম্বী বাড়ির ফ্ল্যাট ছেড়ে এখানে চলে এসে মেজর বেশ ভাল আছেন।
চায়ের ডাক পেয়ে মেজর উপরে চলে এলেন। চুমুক দিয়ে বললেন, বাঃ!
গুছিয়ে বসে অর্জুন জিজ্ঞেস করল, এবার বলুন, জরুরি তলব কেন?
কৈফিয়ত চাইছ নাকি? মেজরের চোখ ছোট হল।
না না। স্রেফ কৌতূহল।
তোমাকে অনেক দিন দেখিনি। মন টানছিল। আরে বয়স হয়েছে তো! তাই তোমাকে দেখতে ইচ্ছে হল। ও হ্যাঁ, আগামীকাল আমি শ্রাদ্ধ করব।
শ্রাদ্ধ? কার?
মেজর হাসলেন, আত্মীয়স্বজন যখন নেই, তখন নিজের শ্রাদ্ধ নিজেকেই করতে হবে। প্রায় পঁয়তাল্লিশ বছর পরে এই দাড়ির মায়া কাটাতে হবে।
তার মানে আপনি কাল দাড়ি কামাবেন, ন্যাড়া হবেন? হকচকিয়ে গেল অর্জুন। দাড়ি ছাড়া মেজরকে ভাবাই যায় না। না জানলে দেখে চিনতে পারবে না।
মেজর হাসলেন, আমি চলে গেলে আমার শ্রাদ্ধ করার জন্যে কেউ থাকবে না। হিন্দু বাবা-মায়ের সন্তান যখন, তখন কাজটা নিজেই করে যাই। কেন করছি জানো? একটু-একটু করে মায়া কাটাতে চাই। আয়নায় দাড়ি গোঁফহীন মুখ দেখে ভাবব, এটা আমি নই। ব্যস, মায়া কমে যাবে।
অর্জুন বলল, কিছু মনে করবেন না, এটা একদম ছেলেমানুষি।
ঠিক তখনই ডোরবেল বাজল। মেজর উঠে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়িয়ে নীচের দিকে তাকিয়ে খুশি-গলায় বললেন, হাই জিম! চাবিটা নাও।
দড়িতে বাঁধা চাবি উপর থেকে নীচে ফেলে দিলেন মেজর। নীচের দরজাটা খুলে গেল। দড়ি উপরে তুলে রেখে অর্জুনের সামনে চলে এলেন, তোমার সঙ্গে খুব ইন্টারেস্টিং একজন মানুষের আলাপ করিয়ে দিচ্ছি! ওর নাম জিম ব্রাউন।
ততক্ষণে জিম উপরে উঠে এসেছেন। অর্জুন দেখল ভদ্রলোককে। মেজরের সমবয়সি।
অর্জুনের দিকে তাকিয়ে জিম জিজ্ঞেস করলেন, এর কথা তুমি বলেছিলে?
মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে মেজর তাকে ইঙ্গিতে বসতে বললেন। জিমকে খুব হতাশ দেখাল। ধপ করে সোফায় বসে রুমাল বের করে মুখ মুছলেন তিনি। তারপর বললেন, লুক মেজর, তুমি ব্যাপারটাকে যে এত হালকাভাবে দেখবে তা আমি ভাবিনি।
কী থেকে এখন ওটা ভাবছ জিম?
তুমি এতদিন আমাকে ভরসা দিচ্ছিলে ইন্ডিয়া থেকে তোমার কাছে এমন একজন আসছেন যিনি আমার সমস্যার সমাধান করে দেবেনই। একজন ইন্ডিয়ান টুথ-ইনভেস্টিগেটর কী করে আমেরিকায় এসে প্রবলেম সলভ করবেন তা নিয়ে আমার সন্দেহ ছিল। তবু ভেবেছিলাম, মানুষটি নিশ্চয়ই অনেক অভিজ্ঞ। লাইক জেমস বন্ড। বন্ড নিজে ব্রিটিশ হলেও হংকং-এ গিয়ে প্রবলেম সল্ভ করেছিলেন। জিম হাত নাড়লেন, কিন্তু এ তো কমবয়সি ছেলে! মাস্ট ইন মিডটোয়েন্টিস। এ কী করবে?
জিম, তুমি আলেকজান্ডারের নাম শুনেছ?
তুমি ওকে চিনলে কী করে? আমার সহকর্মী ছিল কিন্তু!
আমি গ্রিক সেনাপতি আলেকজান্ডারের কথা বলছি। ও হো, তোমাদের এখানে তো ইতিহাস ভাল করে পড়ায় না। গ্রিস থেকে সেনাবাহিনী নিয়ে ভারতবর্ষে গিয়ে অনেকটা জায়গা জয় করেছিলেন সেই ভদ্রলোক। আর তাঁর বয়স তিরিশও হয়নি। এত তাড়াতাড়ি মানুষের উপর বিশ্বাস হারিয়ো না জিম। অবশ্য তুমি যদি না চাও তা হলে অর্জুনকে আমি অনুরোধ করব না। শান্ত গলায় বললেন মেজর।
চশমা খুললেন জিম, ওয়েল, আমি জিম, জিম ব্রাউন। অর্জুনের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন ভদ্রলোক।
করমর্দন করে অর্জুন বলল, আমি অর্জুন।
অ-র-জুন!
হেসে ফেলল অর্জুন, বেশ কাছাকাছি।
এই ভদ্রলোক কী তোমাকে আমার সমস্যার কথা বলেছেন? হাত তুলে মেজরকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলেন জিম।
অর্জুন কিছু বলার আগেই মেজর মুখ খুললেন, না বলিনি। তোমার সমস্যার কথা তুমি যেভাবে বলবে আমি তা পারব না।
থ্যাঙ্ক ইউ। অনেক দিন পরে তুমি বিচক্ষণতা দেখালে। কিন্তু অ-র-জুন, তুমি এই নিউ ইয়র্ক শহরটাকে ভাল করে জানো কি?।
একবার এসেছিলাম। কয়েকটা দ্রষ্টব্য জায়গার কথা মনে আছে। অর্জুন বলল।
তা হলে? তোমার পক্ষে এখানে কী করে কাজ করা সম্ভব? জিম মাথা নাড়লেন।
আপনি একটু আগে জেমস বন্ডের কথা বললেন। সমস্যার সমাধান করতে হংকং-এ পা দেওয়ার আগে ওঁর কাছে একটা ছাপানো ম্যাপ ছাড়া কোনও ধারণা ছিল না। আমি তো ম্যানহাটন শহরটা মোটামুটি চিনি। অর্জুন হাসল।
হুম। জিম মেজরের দিকে তাকালেন, এটা ঠিক, বয়স কম বলে বুদ্ধি কম হবে এমন কোনও নিয়ম নেই।
বেটার লেট দ্যান নেভার। বুঝতে পারার জন্যে ধন্যবাদ। মেজর উঠে দাঁড়ালেন, এখন নিশ্চয়ই চা খেতে তোমার আপত্তি হবে না?
বিন্দুমাত্র না। কিন্তু আমার একটা প্রস্তাব আছে। জিম বললেন।
মেজর ঘুরে দাঁড়ালেন। জিম বললেন, চলো, আমরা তিনজন একটা চমৎকার রেস্তরাঁয় বসে ডিনার করে ফেলি।
প্রস্তাবটা যখন তুমি দিচ্ছ তখন বলব, নট এ ব্যাড আইডিয়া। মেজর হাসলেন, চলো হে অর্জুন।