অরাটাকিরির বাঘ
০১.
গ্রীষ্মের শেষ। গরমটা অসহ্য হয়েছে। কিন্তু না এসে পারা যায়নি বলেই আমাদের আসা। ঋজুদাকে আসতেই হত। আমরা তাকে একা ছাড়িনি।
যে কোনও সময়েই বৃষ্টি হতে পারে কিন্তু হচ্ছে না। অথচ বৃষ্টি না হলে আর প্রাণ বাঁচে না পশু পাখি তরুলতার। মানও বাঁচে না ঋজু বোস অ্যান্ড কোম্পানির। হাতে সময় আর মাত্র তিনদিন আছে। এর মধ্যে বোধ হয় লণ্ডভণ্ডকারী বাঘকে এ যাত্রা মারতে পারা গেল না। বাঘটার এলাকা অনেকখানি কিন্তু যেহেতু প্রথম মানুষ ধরে সে আড়াই বছর আগে অরাটাকিরি গ্রামে তাই তার নাম হয়ে গেছে অরাটাকিরির বাঘ।
ওড়িশার কালাহান্ডি জেলার এই দুর্গম এবং সাংঘাতিক বনের মানুষেরা অনেক আশা করে ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে দিনের পর দিন ধরনা দিয়ে বসে থেকে রায়গড়ার কাগজকল ঔ-প্রোডাক্টস-এর মালিকদের ধরে ঋজুদাকে এখানে আনিয়েছে অরাটাকিরির মানুষখেকো বাঘটাকে মারবার জন্য। এই পাথুরে জায়গাতে এই সবকিছু ঝাঁঝাঁপোড়া করা গরমে বাঘের থাবার দাগ খুঁজে পাওয়া মুশকিল অথচ বাঘ সমানে তার হরক চালিয়ে যাচ্ছে। গত পরশুই অরাটাকিরি থেকে মাইল পনেরো দূরের একটি গ্রাম থেকে বছর দশেকের একটি ছেলেকে তুলে নিয়ে গিয়ে পাহাড়তলির একটি শুকনো নালাতে বসে পুরোটাই খেয়ে গেছে। শুকনো নালার বালিতে পায়ের দাগ দেখার পরও তার চলে যাওয়ার পথ খোঁজবার চেষ্টা করে বিফল হয়েছি আমরা। বৃষ্টি হলে মাটি নরম হবে। তখন থাবার দাগ দেখা যাবে অনেক সহজে। তবুও আমরা হাল ছাড়িনি।
ঋজুদার গতকাল থেকে একটু জ্বর মতো হয়েছে। হিট ফিভার। তাই আমাকে আর ভটকাইকেই পাঠিয়েছিল ঋজুদা জলের জায়গাতে, যদি বাঘের রাহান-সাহানের কোনও খোঁজ পাই তাই দেখতে। পঞ্চাশ বর্গকিলোমিটারের মধ্যে মাত্র একটি জায়গাতেই জল আছে। জল তো নয়, কাদা-গোলা সেমি-লিকুইড-পাডল। তাতেই বাইসন বা আমাদের গাউর, বুনো মোষ, শম্বর, চিতল হরিণ, কোটরা শুয়োর, শজারু, নানা সাপ, পাখিরা মায় প্রজাপতি পর্যন্ত জল খেতে আসে সকালে-বিকেলে। বিকেলেই বেশি। এই বাঘ এমন সাংঘাতিক ধূর্ত মানুষখেকো না হলে তৃণভোজী জানোয়ারদের ধরবার জন্যই সে এখানে আসত। জল খাওয়াও হত, তার খাবার সংগ্রহও হত এবং এইখানেই আমরা তাকে কবজা করতে পারতাম। কিন্তু এই অরাটাকিরির মানুষখেকো জংলি জানোয়ার খাওয়া ছেড়েই দিয়েছে। সে কেবল ক্রমাগত মানুষই খেয়ে যাচ্ছে গত আড়াই বছর হল। জল অবশ্য তাকে নিশ্চয়ই খেতে হচ্ছে। নইলে সে বেঁচে আছে কেমন করে! কিন্তু জল খেতে সে এই জলে আসছে না। পাহাড়ের ভিতরে কোথাও হয়তো কোনও ঝরনা আছে, হয়তো তার আস্তানা যে গুহাতে সেই গুহারই কাছে, সেখানেই তৃষ্ণা নিবারণ করছে সে।
দিন পাঁচেক আগে এই জলটির কাছেই একটি বাঁশঝাড়ের পাশে একটি বড় চিতল হরিণকে মারে কোনও জানোয়ার। চিতল হরিণটি মস্ত বড় ছিল। জানোয়ারটা তাকে খেয়েও ছিল পিছন দিক থেকে, বাঘেরা যেমন করে খায়। পায়ের চিহ্ন দেখে, ঘাতক যে বাঘই সে বিষয়ে নিশ্চিত না হওয়া গেলেও আমরা কোনও ঝুঁকি না নিয়ে বাঁশঝাড়ের কাছেই একটি মিটবুনিয়া গাছে মাচা করে বসেছিলাম পরদিন বিকেল বিকেলই এসে। আমরা মানে, আমি আর ঋজুদা। মাঝরাতে এসেছিল ঘাতক, তবে সে বাঘ নয় মস্ত এক চিতা। বেচারির অর্জিত এবং স্বাভাবিক খাদ্য থেকে বঞ্চিত কেন করব তাকে আমরা? তাই মাচা থেকে নেমে আমি আর ঋজুদা ফিরে এসেছিলাম কশিপুরে আমাদের বাংলোতে। আগেই বলেছি যে এই ঘটনা পাঁচদিন আগের। পরদিন সকালে সেই জায়গাতে ফিরে গিয়ে তদন্ত করার সময় দেখেছিলাম যে মানুষখেকো বাঘটি মাচা থেকে নামার পরে জিপে গিয়ে পৌঁছোনো অবধি আমাদের অনুসরণ করেছিল। অবশ্য তার থাবার দাগ বহু ব্যবহৃত জানোয়ারের পায়ে চলা পথের ধুলোর উপরে দেখতে পেয়েছিলাম বলেই অমন অনুমান আমরা করতে পেরেছিলাম।
সাতদিন হল আমরা এসে পৌঁছেছি কশিপুরে। ভাইজাগ স্টেশনে নেমেছিলাম মাড্রাস মেলে এসে। তারপর ভাইজাগ সার্কিট হাউসে দুপুরের খাওয়া সেরে চমৎকার উঁচু-নিচু পাহাড় এবং গভীর জঙ্গলের মধ্যের আঁকাবাঁকা পথ দিয়ে সন্ধেবেলা এসে পৌঁছেছিলাম রায়গড়াতে ঔ-প্রোডাক্টস-এর গেস্ট হাউসে। রায়গড়া আসার পথেই শ্রীকাকুলাম বলে একটি জায়গা পড়েছিল। যেখানে একসময়ে অন্ধ্রপ্রদেশের নকশাল আন্দোলনের ঘাঁটি ছিল। ভাইজাগ থেকে রায়গড়া গাড়ি বা বাসেরই মতো ট্রেনেও আসা যায়। আর সেই রেলপথের দু’ধারের দৃশ্যও গাড়ির পথের দৃশ্যরই মতো অপূর্ব সুন্দর।
রাতটা রায়গড়ের কাগজকলের দারুণ গেস্ট হাউসে কাটিয়ে সকালে ওদেরই দেওয়া একটি জিপে করে দুপুরের আগেই আমরা কশিপুর এসে পৌঁছেছিলাম। প্রকাণ্ড কয়েকটি প্রাচীন আমগাছ ছিল ছোট বাংলোটির হাতায়। সামনে চওড়া বারান্দা। মধ্যে খাবার ও বসার ঘর আর দু’পাশে দু’টো শোবার ঘর। ঋজুদা বলছিল, এই বাংলোতেই এসে ছিল নাকি একবার ষাটের দশকে ঋজুদার বন্ধু কেন জনসন আর জিম ক্যালান-এর সঙ্গে। তখন জঙ্গল আরও গভীর ছিল এবং জনবসতিও কম ছিল অনেকই। উন্নতি বিশেষ কিছু হয়নি কিছুরই গত দু-তিন দশকে, শুধু জনসংখ্যা আর দারিদ্র্যই বেড়েছে। তবে তখনও বাঘের অত্যাচার খুবই ছিল। এখনকার চেয়ে হয়তো আরও বেশি ছিল কারণ তখন বাঘের সংখ্যাও ছিল বেশি। সুন্দরবনের বাঘেদেরই মতো কালাহান্ডির এই অঞ্চলের বাঘেরাও কুখ্যাত নরখাদক হিসেবে পরিচিত ছিল। কীভাবে তাদের স্বাভাবিক খাদ্য এমনভাবে কমে গেল যে মানুষকেই খাদ্য করতে হল ওদের, এ নিয়ে গবেষণার প্রয়োজন আছে। কিন্তু এ কথাও সত্যি যে কালাহান্ডি নরখাদক বাঘের জন্য সুন্দরবনেরই মতো পরিচিত বহুদিন থেকে। বিখ্যাত শিকারি এবং ব্যারিস্টার কুমুদ চৌধুরি মশায় কালাহান্ডিতে বাঘ শিকারে এসে বাঘেরই হাতে প্রাণ হারান। তবে সে বাঘ মানুষখেকো ছিল কিনা তা আমার জানা নেই। ঋজুদারও জানা নেই।
জিপ নিয়ে আমি আর ভটকাই বাংলো থেকে বেরিয়েছিলাম চারটে নাগাদ। পৌনে পাঁচটা থেকে সূর্যাস্ত অবধি জলের পাশে একটি মস্ত শিমুলগাছের গুঁড়ির আড়ালে বসে ছিলাম আমরা। অনেক জানোয়ারই জল খেয়ে গেল এসে– মাংসাশী এবং তৃণভোজী–কিন্তু বাঘ এল না। হায়না, শেয়াল, বনবিড়াল এবং একটি ছোট চিতাও সন্ধে লাগার সঙ্গে সঙ্গে এল। কিন্তু না পাওয়া গেল বাঘের দেখা, না গেল তাকে শোনা। বাঘ এলে তাকে চাক্ষুষ দেখা না গেলেও পুরো জঙ্গল জানিয়ে দেয় যে, সে এসেছিল। রবীন্দ্রনাথের এসেছিলে তবু আসো নাই, জানায়ে গেলে’ গানটি বাঘের বেলাতেও প্রযোজ্য। কিন্তু না, আমি আর ভটকাই দু’জনেই নিশ্চিন্ত যে, বাঘ আসেনি।
.
০২.
কালাহান্ডির নামী স্থান যদিও কোরাপুট, জেপুর হল বাণিজ্যিক রাজধানী। কালাহান্ডি, দণ্ডকারণ্যেরই লাগোয়া। আমরা যে পথ দিয়ে এসেছি ভাইজাগ হয়ে। ভাইজাগ বা ওয়ালটেয়ার থেকে রেলপথে জেপুর হয়ে এলে, আসতাম আকুভ্যালি হয়ে। আর্ট মানে লাল। ওখানের মাটি লাল তাই নাম আর্ট। ওয়ালটেয়ার-আকুর পথে পড়ে দশ লক্ষ বছরের পুরনো বোরাগুহালু গুহা। চুনাপাথরের উপরে জল গড়িয়ে গড়িয়ে আশ্চর্য সব স্থাপত্যের সৃষ্টি হয়েছে বোরাগুহালুতে। কিন্তু পড়ে অন্ধ্রপ্রদেশে। আকু ভ্যালিও।
ঋজুদা আগে এদিকে যখন এসেছিল তখন দেখে গেছে। এবারে আমাদের হাতে সময় বড় কম তাই হবে না। তা ছাড়া যে কাজে আসা সেই কাজটিও সম্পন্ন হবে বলে মনে হচ্ছে না।
অরাটাকিরির এই মারাত্মক বাঘ গত আড়াই বছর হল ওড়িশার কালাহান্ডির এই অঞ্চলে যে ত্রাসের সৃষ্টি করেছে তারই সমাধানের জন্য ঋজুদার ডাক পড়েছে কলকাতা থেকে। এই অঞ্চলে নানা আদিবাসীর বাস। খরা আর দারিদ্র্যর জন্য কুখ্যাত এই কালাহান্ডি জেলা। মানুষখেকো বাঘের জন্যও।
সকালে উঠে কশিপুর বাংলোর বারান্দাতে বসে চা খাচ্ছিলাম। ঋজুদাও এসে বসল। শেষ রাতের দিকে খুব ঘাম দিয়ে জ্বরটা নাকি ছেড়েছে। দু’কাপ চা খেয়ে পাইপটাও ধরাল। আমি বুঝলাম যে ঋজুদা ভাল হয়ে গেছে।
ব্রেকফাস্টে কী খাবে?
ভটকাই ঋজুদার আরোগ্যতে উৎসাহিত হয়ে বলল। ঋজুদা অসুস্থ থাকাতে খাওদা-দাওয়া নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে এ দু’দিন ভটকাই-এর বিবেকে সম্ভবত একটু বাধো বাধো ঠেকছিল। এখন সে বাধা সরে গেছে। এবারে খাওয়া-দাওয়া নিয়ে আবার নির্লজ্জ হবে সে।
ঋজুদা জবাব দেওয়ার আগেই সে নিজেই জবাব দিল। গরম গরম ফুলকো লুচি করতে বলি? সঙ্গে আলুভাজা আর বেগুনভাজা কী বল? আর পোড় পিঠা তো আছেই। কালকের পায়েসও আছে। ফ্রিজ থাকলে ভাল হত একটা। নো, মানে আমাদের পাঁচক ঠাকুরের রান্নার হাতটা দারুণ।
তারপর বলল, ব্রেকফাস্টের মেনু তো ঠিক হল। দুপুরে মিষ্টি পোলাও, ছোলার ডাল, বেগুনভাজা, আর কচি পাঁঠার ঝোল করতে বলছি, দই দিয়ে, আর আমের চাটনি। ঠিক আছে তো ঋজুদা?
ঋজুদা আর কী বলবে। ভটকাই একাই প্রশ্নকর্তা একাই উত্তরদাতা। সত্যি! দিনে দিনে ও মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এসেছে মানুষখেকো বাঘ মারতে কিন্তু মনে হচ্ছে জামাই এল বুঝি জামাইষষ্ঠীতে।
ঋজুদা ভটকাইকে দেখেশুনে যেন বাক্যহারা হয়ে গেছে। আজকাল কিছু বলাও ছেড়ে দিয়েছে যেন। তিতিরও আসেনি এবারে যে ওকে একটু শাসনে রাখবে। ইতিমধ্যে দেখা গেল একটা জিপ আসছে লাল ধুলো উড়িয়ে। তখনও ইঞ্জিনের শব্দ শোনা যাচ্ছিল না। একটু পরই ইঞ্জিনের গুনগুনানি শোনা গেল। কাছে এলে, জিপটাকেও চেনা গেল। মাথার উপরে লাল আলো লাগানো। কালাহান্ডির ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট বিয়ান্দকার সাহেবের জিপ। ভবানী-পাটনা অথবা জেপুর থেকে আসছেন। খুব ভোরে বেরিয়েছেন নিশ্চয়ই। নইলে এত সকালে এসে হাজির হবেন কী করে। কী ব্যাপার কে জানে!
বিয়ান্দকার সাহেব মারাঠি। আই এ এস অফিসাররা দেশের সব রাজ্য থেকেই আসেন। তবে উনি ওড়িশা ক্যাডার বেছে নিয়েছেন তাঁর পছন্দসই বলে। সেদিন উনি বলেছিলেন আমাদের যে ওঁর এক মামিমা ওড়িয়া। সেই মামিমার বাপের বাড়ি সম্বলপুরে ছেলেবেলাতে নাকি বেড়াতে আসতেন। মহানদীর পারের সেই সম্বলপুর শহর আর সমলেশ্বরীর মন্দিরের প্রেমে পড়ে গিয়েই এই ওড়িশা-প্রীতি তাঁর। মানুষটা চমৎকার। এখনও বিয়ে-থা করেননি। বয়সও খুবই কম। ৩৪৬
ডি এম সাহেবের জিপ কশিপুর বাংলোর হাতায় ঢুকতে না ঢুকতেই উলটোদিক থেকে একটা সাইকেল তিরের মতো এসে ঢুকল টায়ারে কাঁকড়মাটির কিড়কিড়ানি আওয়াজ তুলে। পিছনের ক্যারিয়ারে একজন রোগা, বেঁটে কালো লোক বসেছিল। তার পরনে গামছা। খালি গা, মাথায় টাক, মুখে বসন্তের দাগ। যে সাইকেল চালাচ্ছিল তার পরনে সাজিমাটিতে কাঁচা গেরুয়া ধুতি আর একটা ওই রঙেরই ফতুয়া। ওই লোকটির স্বাস্থ্য বেশ ভাল। গায়ের রং ফরসা, মুখে পান, মাথায় বাবরি চুল। যাত্রা-টাত্রা করে বোধহয়।
বিয়ান্দকার সাহেব জিপ থেকে নামতেই আমি আর ভটকাই উঠে দাঁড়িয়ে তাঁকে আপ্যায়ন করলাম। সাইকেলের আরোহীরা লাল আলো জ্বালানো ডি এম-এর গাড়ি এবং কোমরে রিভলবার গোঁজা দু’জন উর্দিধারী বডিগার্ডকে দেখা সত্ত্বেও জেলার দণ্ডমুণ্ডের কর্তা ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবকে একটুও পাত্তা না দিয়ে সাইকেলটাকে একটা আমগাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড় করিয়েই তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে বারান্দাতে উঠে এসে ইজিচেয়ারে বসে থাকা ঋজুদার দু পায়ে দু’ হাত ঠেকিয়ে গড় হয়ে প্রণাম করে বলল, নমস্কার আইজ্ঞাঁ। আপনি চঞ্চল চালুস্ত বাবু।
কন, হেল্বা কন?
ঋজুদা জিজ্ঞেস করল।
বিয়ান্দকার সাহেব তাকিয়ে রইলেন ওদের দিকে, চেয়ারে বসতে বসতে।
লোকদুটো যা বলল তার বাংলা করলে এই দাঁড়ায়: শেষ রাতে ওদের গ্রামের একটি মেয়ে দরজা খুলে উঠোনে বেরিয়েছিল। সেই সময়েই বাঘ তাকে তুলে নেয়। মেয়েটির পড়ে যাওয়ার শব্দ শুনে তার স্বামী ফিতে কমিয়ে রাখা লণ্ঠনটাকে হাতে ধরে ফিতে বাড়াতে বাড়াতে বাইরে আসে আর আসতেই দেখে বাঘ তার বউকে টুটি কামড়ে ধরে নিয়ে যাচ্ছে উঠোন পেরিয়ে পিছনদিকে। ওদের বাড়ির পিছনেই পাহাড় উঠে গেছে এবং সেই পাহাড়ে কুচিলা গাছের জঙ্গল আর পাথর বড় বড়। ভয়ে এবং আতঙ্কে মুখ দিয়ে আওয়াজ করতে পারেনি লোকটি। তার সম্বিৎ যখন ফিরেছে তখনই সে চিৎকার করে উঠেছিল। কিন্তু তাদের তিন বছরের শিশুকন্যা ছাড়া আর কেউই ছিল না বাড়িতে। ধারে কাছে অন্য ঘরবাড়িও ছিল না। চিৎকার করার পরেই সে নিজের বিপদের আশঙ্কাতে তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকে দরজা দিয়েছিল। যতক্ষণ অন্ধকার ছিল সে ভয়ে বাইরে বেরোয়নি। ফরসা হলে শিশুকন্যাকে কোলে করে সে সবচেয়ে কাছে যে গ্রাম, সেখানে দৌড়ে গিয়ে খবর দেয়।
ভটকাই বলল, ম্যান-ইটার বাঘ এত মানুষ ধরছে জেনেও বেরোতে গেল কেন রাতে?
আমি বললাম, কেন আবার! ছোট বাইরে করতে। ওদের কি অ্যাটাচড বাথরুম আছে?
ঋজুদা আমাদের থামিয়ে দিয়ে লোকটিকে বলল, তারপর বলো।
লোকটি গড়গড় করে আবার শুরু করল, তারপর আমরা প্রায় জনা-বারো লোক লাঠি বল্লম এবং একটা গাদা বন্দুক নিয়ে গেলাম সেখানে। তারপর মাটিতে মেয়েটিকে টেনে নিয়ে যাওয়ার ঘষটানো দাগ দেখে দেখে পাহাড়ের গায়ে কিছুটা চড়লাম। মেয়েটির শাড়িটার টুকরো-টাকরা নানা চার গাছে এবং কাঁটাতে আটকে ছিল। রক্তের ধারার দাগ তো ছিলই শুকনো বনের ঝোপেঝাড়ে এবং প্রখর গ্রীষ্মের পোড়া মাটিতে।
তারপর? বাঘের হাত থেকে মেয়েটিকে বা তার মৃতদেহকে কী উদ্ধার করতে পারলে তোমরা?
ঋজুদা জিজ্ঞেস করল।
না বাবু। কিছুটা যখন উঠেছি পাহাড়ে তখনই বাঘ একবার হুঙ্কার দিল আর সেই হুঙ্কারে একটা বহু পুরনো জংলি কাঁঠালগাছের ডাল থেকে খসে পড়ল…।
আমি বললাম, কী পড়ল? কাঁঠাল?
না বাবু, কাঁঠাল নয়।
তবে কী?
বাঁদর। কাঁঠালগাছের ডালে বসে কাঁঠাল খাচ্ছিল কোয়া কোয়া আঠা-টাঠা সুদ্ধ, সে ওই হুঙ্কার শুনে, হাত ফসকে সটান নীচে।
তারপর?
ভটকাই বলল।
নীচে পড়েই ভয়ে তো একেবারে কাঠ। কিন্তু বাঘ তাকে কিছুই করল না বা বাঘ হয়তো জানলই না যে সে পড়েছে নীচে…।
ঋজুদা লোকটিকে থামিয়ে দিয়ে বলল, বড় বেশি কথা বল হে তুমি। সংক্ষেপে বলো। মেয়েটিকে বা তার লাশকে তোমরা পেলে কিনা বলো?
লোকটা অপ্রতিভ হয়ে বলল, না বাবু। মেয়েটির কাছ অবধি পৌঁছোবার সাহস হয়নি আমাদের কারওরই। জগা যখন তার বন্দুকে বারুদ গেদে আকাশের দিকে নল করে ঘোড়া টেনে দিল তখন বাঘ আরেক হুঙ্কার দিয়ে পাহাড় থেকে নেমে তেড়ে এল আমাদের দিকে।
আকাশে গুলি করার জন্য তো বন্দুক নিয়ে যাওনি তোমরা।
কী করা যাবে বাবু। ওই বাঘ মারার চেয়ে আকাশ বাতাসকে মারা অনেক সহজ। সে বাঘের কী রূপ। তার বুক, মুখ, গোঁফ, সামনের দু পায়ের উরুর সামনেটা রক্তে লাল। তার ওই চেহারা দেখে আর কি আমরা সেখানে থাকি। পড়ি কি মরি করে দৌড়ে আমরা সকলে পাহাড় থেকে নেমে এলাম।
সেই মেয়েটির স্বামীও?
আমি জিজ্ঞেস করলাম।
হঃ। সে তো এল সকলের আগে। প্রাণের ভয় বলে কথা বাবু। আর তার বউ ৩৪৮
বেঁচে যে নেই সে তো আমাদের মতো সেও বুঝতে পারছিল, তাই খামোখা আত্মহত্যা করতে যাবেই বা কেন। তিন বছরের মেয়েটাকে দেখবে কে?
ঋজুদা বলল, ওই পাহাড়ে জল আছে কি কোথাও?
জল বলতে গেলে যা বোঝায় তা নেই তবে বৃষ্টির জল জমে একটা গুহার নীচে সামান্য জল আছে। তা মানুষের খাওয়ার যোগ্য নয়। তার মধ্যে পচা পাতা পোকা-মাকড়…।
আমি মানুষের খাওয়ার জলের কথা বলছি না, বাঘের খাওয়ার জলের কথাই বলছি।
তা হয়তো হবে। বাঘের তৃষ্ণা হয়তো মিটবে কোনওমতে।
তোমাদের কী মনে হয়? বাঘ কি থাকবে তখনও মড়িতে?
তা কী করে বলব। তবে রাম-এর মতো রোগাপটকা নয় তার বউ। সে খুব তাগড়া মেয়ে ছিল। শরীরে অনেক মাংস।
রামটা কে?
সেই মেয়েটার স্বামী।
ওখানে আমাদের এখুনি যাওয়া দরকার একবার। জায়গাটা কতদূর?
তিন ক্রোশ হবে।
অন্যজন বলল, পাক্কা তিন ক্রোশ।
গ্রামের নাম কী?
ধলাহান্ডি।
আশ্চর্য নাম তো।
ভটকাই বলল।
কেন? আশ্চর্য কেন? কালাহান্ডি হতে পারে আর ধলাহান্ডি হতে পারে না। ওখানের পাহাড়ে সাদা পাথর আছে অনেক, মানে পাথরের চাঁই। পাহাড়ের নীচে একটা নুনী আছে, সেই নুনীটাও সাদা।
নুনী কী জিনিস?
এবারে বিয়ান্দকার সাহেব জিজ্ঞেস করলেন।
ঋজুদা বলল, সল্ট-লিক। বনের মধ্যে নোনাপাথর থাকে। তৃণভোজী জন্তুরা এবং অনেক সময় মাংসাশী জন্তুরাও সেই নুন চাটতে আসে।
ভটকাই বলল, আমরা যেমন লেক-এর পাশে বিকেলের ফুচকা খেতে যাই। কী বল রুদ্র?
ঋজুদা বলল, তোর কোনওদিনও সেন্স হবে না ভটকাই। একটা মেয়েকে খাচ্ছে বাঘটা এখনও আর এসব শুনেও এতটুকু সিরিয়াস হলি না তুই। তোকে নিয়ে আসাই ভুল হয়েছে।
আমি মনে মনে বললাম, সে তো প্রতিবারেই বলে আবার আসার সময়ে ঠিক নিয়েও আসো। কী যে গুণ করেছে ভটকাই তোমাকে!
আমি বললাম, তুমি কিন্তু যাবে না ঋজুদা। তুমি এখনও খুবই দুর্বল আছ। রাতেও জ্বর ছিল।
দুর্বলতার জন্য নয়। আমার মনে হচ্ছে এখন আমার নিজের না গেলেও চলবে। তারপরে হাতঘড়ির দিকে চেয়ে বলল, এতক্ষণে বাঘ মড়ি ছেড়ে চলে গেছে। জল খেয়ে কোনও গুহাতে বা যেখানে বড় গাছের ছায়া আছে সেখানে ঘুমোচ্ছে। কিন্তু তোদের এখুনি যেতে হবে। গিয়ে সব দেখেশুনে আয়। তারপর বেলা চারটে নাগাদ আমি যাব। মড়ির কাছে মাচা বাঁধার মতো কোনও গাছ থাকলে মাচা বাঁধবি৷
সাইকেল আরোহী বলল, লাশটা পাওয়া না গেলে দাহ হবে কী করে? মেয়েটা তো নির্ঘাৎ বাঘডুম্বা হয়ে যাবে।
লাশের আর কতটুকুই বা বাকি আছে? তবে যতটুকু থাকবে কাল সকালে নিয়ে গিয়ে দাহ কোরো। আজকেই নিয়ে চলে গেলে বাঘ আর কীসের জন্য আসবে? কিছু বাকি থাকলে তাই না খেতে আসবে সে সন্ধেবেলা অথবা রাতে!
লোকটা বলল, হঃ। বুঝিলু।
তোরা এখুনি বেরিয়ে যা জিপ নিয়ে। রুদ্র তুই একটা রাইফেল নিয়ে যা। আমার ফোরফিফটি-ফোরহানড্রেডটা নিয়ে যা। মাটিতে দাঁড়িয়ে মানুষখেকো বাঘের মোকাবিলা করতে একটা হেভি রাইফেল সঙ্গে থাকা দরকার। আর ভটকাই একটা শটগান নিয়ে যা। দু’ব্যারেলেই এল জি রাখবি। স্বল্প দূরত্বে এল জির মারের মতো মার নেই। জব্বর থাপ্পড়ের মতো গিয়ে লাগে বড় বড় দানাগুলো। স্টপিং পাওয়ার, শর্ট ডিসট্যান্সে রাইফেলের চেয়ে অনেক বেশি। রাইফেলের গুলি লাগলে মরবেই হয়তো বাঘ কিন্তু মরতে যতটুকু সময় লাগবে তার আগে তোদের মেরে দিয়ে যাবে। বাঘ বলে কথা! নে, যা বেরিয়ে পড়। জলের বোতল আর টর্চও নিয়ে যা।
বিয়ান্দকার সাহেব বললেন, টর্চ কী হবে এই সকালবেলা?
ঋজুদা হেসে বলল, এখন সকাল। শিকারে গেলে, বিশেষ করে মানুষখেকো বাঘ শিকারে গেলে, সকাল রাত হতে সময় নেয় না।
তারপর আমাদের বলল, যা দেরি করিস না। বাঘ যদি ‘কিল’-এর উপরে থাকে তা হলে সে যতই তড়পাক না কেন দু’জনে একসঙ্গে গুলি করে তার তড়পানি শেষ করে দিবি। যদি না থাকে তবে মাচা বাঁধার বন্দোবস্ত করবি। যদি মনে করিস যে বাঘ দিনমানেই ফিরে আসতে পারে তবে মাচা বাঁধতে গিয়ে সময় নষ্ট না করে ঝিলের আশপাশে জায়গা বুঝে দু’জনে দু’টি গাছে উঠে বসবি। পাথরে বসবি না। বিশ্বল সাহেবের কী দশা হয়েছিল তা তো শুনলি সেদিন দণ্ডসেনার কাছ থেকে।
বলেই বলল, দণ্ডসেনাটা থাকলে এখন তাদের সঙ্গে দিয়ে নিশ্চিন্ত হতাম।
কবে ফিরবে সে ভবানী-পাটনা থেকে?
বিয়ান্দকার সাহেব জিজ্ঞেস করলেন।
ঋজুদা বলল, আগামীকাল।
তারপর আমাদের বলল, রাজয়াডুকে বলে দিবি যে তোরা যদি বারোটার মধ্যে জিপে ফিরে না আসিস তাহলে ও জিপ নিয়ে বাংলোতে ফিরে আসবে আমাকে নিয়ে যেতে।
আমরা উঠতে উঠতে বললাম, ঠিক আছে।
ঋজুদা বলল, ননাকে বল, বিয়ান্দকার সাহেবের জন্য চা দেবে আর সাহেবের ড্রাইভার ও বডিগার্ডদেরও নিয়ে গিয়ে চা খাওয়াবে।
ঠিক আছে।
বলল ভটকাই।
আমরা বারান্দা ছেড়ে ঘরে যেতে যেতে শুনলাম ঋজুদা ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করছে বিয়ান্দকার সাহেবকে, এখন আপনি কেন এই সাতসকালে উঠে এতদূর এলেন বলুন।
উনি বললেন, না এসে কী করি বলুন। স্বয়ং চিফ সেক্রেটারি নিজে ভুবনেশ্বর থেকে ফোন করে কাল রাতে আমাকে খুব গালাগালি করলেন। ব্যাপারটা বুঝুন মিস্টার বোস। হোম সেক্রেটারিও নন একেবারে চিফ সেক্রেটারি।
কীসের জন্য?
আবার কীসের জন্য? অরাটাকিরির বাঘকে মারা যাচ্ছে না কেন? গতকাল নাকি অ্যাসেমব্লিতে চিফ মিনিস্টারকে বিরোধীপক্ষরা একেবারে কোণঠাসা করে ফেলেছিলেন। আপনি তো আমাদের সি এম-কে জানেনই। রেগে গেলে থাপ্পড় কষিয়ে দেন। একেবারে অন্য ধাতের মানুষ। বিজু পট্টনায়েকের মতো জবরদস্ত পুরুষ দেশেই কম আছে। কোনও রীতিনীতি বাগ-বিতণ্ডার ধার ধারেন না তিনি। তবে তিনিই বা কী করবেন।
আমরা জামাকাপড় বদলাতে বদলাতে শুনলাম যে উনি বলছেন, কথায় বলে না, স্নেহ নিম্নগামী। স্নেহেরই মতো রাগও নিম্নগামী। সব চোট এসে পড়েছে আমার উপরে।
ঋজুদা বলল, বললেন না কেন চিফ সেক্রেটারিকে, মানুষখেকো বাঘ তো আর সেক্রেটারিয়েটের ফাইল নয় যে ইচ্ছে করলেই বগলদাবা করে এ ঘর থেকে ও ঘরে নিয়ে যাবে চাপরাশি। তা ছাড়া আমি তো এসেইছি মাত্র সাতদিন হল। খবরাখবর নেওয়া, প্ল্যান করা, বাঘের গতিবিধি, কোথায় কোথায় মানুষ মারছে, কীভাবে মারছে, রাতে মারছে না দিনে মারছে এ সব মনিটর করতেই লেগে যায় পনেরোদিন। তার উপরে স্থানীয় শিকারিকে যদি বা ডেপুট করলেন সেও তো শালার বিয়ে দিতে চলে গেল ভবানী-পাটনা।
দন্ডসেনা ভাল শিকারি নয়?
খুবই ভাল শিকারি। সে একাই বাঘকে মারতে পারত।
তাই তো শুনেছি। সে লেসলি জনসনের সময়ে দণ্ডাকারণ্যর অফিসিয়াল শিকারি ছিল।
তা হলে মারল না কেন এতদিন?
বিয়ান্দকার সাহেব বললেন।
মারবে কী করে। সে তো গরিব মানুষ। ইংরেজি জানে না।
বাঘও কি ইংরেজি জানে নাকি?
ঋজুদা হেসে বলল, তা নয়। আমি বলছি, সাধারণ গরিব মানুষকে প্রশাসন কখনওই পাত্তা দেয় না আমাদের দেশে। সব রাজ্যেই। দন্ডসেনার পিছনে অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের পুরো শক্তি যদি আপনারা নিয়োগ করতেন তবে কবেই ও মেরে দিত ওই বাঘকে। ওকে কি আপনারা একটা জিপ দিয়েছেন? ফরেস্ট বা পি-ড-ডি-র বাংলোতে থাকার ব্ল্যানকেট পারমিট দিয়েছেন? আমাকে যেমন দিয়েছেন। ওকে কি ভাল আর্মস এবং গুলি জোগাড় করে দিয়েছেন? আমি না হয় শৌখিন শিকারি–স্পোর্টসম্যান–তার তো টাকার দরকার তাকে কি আপনারা মোটা টাকা অগ্রিম দিয়েছেন? যার নুন আনতে পান্তা ফুরোয়, যার অন্নচিন্তা চমৎকারা তার পক্ষে এমন জবরদস্ত মানুষখেকো মারা অত সোজা নয়। এইসব। অঞ্চলের মানুষ আমাকে যেমন ভয়-ভক্তি করছে এই সাতদিনেই তেমন কি এরা দন্ডসেনাকে করবে সাতবছর এখানে থাকলেও। আসলে সাহেবরা দেশ ছেড়ে চলে গেলে কী হয় অর্ধশতাব্দী আগে, আমরা এখনও নানা হীনম্মন্যতাতে ভুগি। নইলে আমি আপনাকে বিয়ান্দকার সাহেব বা আপনি আমাকে বোস সাহেব বলেন, কেন? ব্যাপারটার অনেক গভীরে গিয়ে আমাদের বুঝতে হবে। মানুষখেকে বাঘটা বা দন্ডসেনা কোনও আলাদা ব্যাপার নয়।
বিয়ান্দকার সাহেব চুপ করে রইলেন কিছুক্ষণ।
তারপর বললেন, সবই তো বুঝলাম কিন্তু আমার তো চাকরি থাকবে না।
ভারতবর্ষে আই এ এস-দের চাকরি খায় কে? গোরু গাধা হলেও কেউ চাকরি খেতে পারে না।
তা পারে না তবে বাজে জায়গায় বদলি করে দিতে পারে। রিটায়ারমেন্টের দিন অবধি কুনজরে দেখতে পারে। যে অফিসার সভাবে ভাল কাজ করতে চায় তার পক্ষে এমন ঘটলে সেটাই কি যথেষ্ট শাস্তি নয়?
ঋজুদা উত্তর না দিয়ে বলল, চা খান। ব্রেকফাস্টও খেয়ে যান। অনেকক্ষণের ড্রাইভ তো এখান থেকে।
তা তো বটেই।
আমরা যখন রাইফেল বন্দুক টুপি টর্চ জলের বোতল সব নিয়ে বেরোচ্ছি, ড্রাইভার রাজয়াড়ু জিপটা নিয়ে এসেছে বাংলোর সামনে তখন ঋজুদা বলল, কী খাবেন ব্রেকফাস্টে? লুচি বেগুনভাজা ওমলেট খাবেন? পোড়-পিঠাও আছে।
তখন ভটকাই একবার করুণ চোখে তাকাল ঋজুদার দিকে।
ঋজুদা বলল, ইন আ ম্যানস লাইফ, ডিউটি কামস ফার্স্ট।
আমি বললাম, ম্যান বোলো না, বলল পার্সন। ম্যান শব্দটাই আধুনিক পৃথিবীতে বাতিল হয়ে গেছে।
বিয়ান্দকার সাহেব বললেন, তাই তো হওয়া উচিত।
.
০৩.
ওড়িশার এই কালাহান্ডি জেলা এক আশ্চর্য জায়গা। কেন জানি না, আফ্রিকার সঙ্গে খুব মিল মনে হয় আমার। প্রকাণ্ড সব কালো ও বাদামি কাছিম-পেঠা পাহাড় মৌন সন্ন্যাসীদের মতো দাঁড়িয়ে। একসময়ে ওইসব পাহাড়ে গাছপালা হয়তো ছিল কিন্তু এখন ন্যাড়া। ইচ্ছে করে ওইসব পাহাড়ে নানা গাছ-গাছালির বীজ এনে তাদের কাছিমের মতো পিঠের ফাঁকফোঁকরে ফেলে দিই। ধীরে ধীরে প্রথমে বাদামি ঘাসে তারপর সবুজ গাছপালাতে ভরে উঠুক সব পাহাড়।
আমি ভূতত্ত্ববিদ নই কিন্তু এখানের এই ন্যাড়া পাহাড়গুলো দেখে কেন যেন মনে হয় যে এদের বুকে অনেক খনিজ পদার্থ আছে। কালাহান্ডি অপেক্ষাকৃত জনবিরল এবং যে সব মানুষ এখানে থাকে তারা বড়ই গরিব। প্রকৃতিও বড় কৃপণ এখানে। বৃষ্টি খুবই কম হয় আর তাই খরা আর দুর্ভিক্ষ নিত্যসঙ্গী এইসব মানুষদের কাছেই আমাদের মিগফাইটার প্লেন-এর কারখানা–অত্যাধুনিক ব্যাপার-স্যাপার অথচ এখানেই মানুষ জলের কষ্ট পায়, না খেয়ে মরে। কালাহান্ডির এইসব পাহাড়ের জন্যই বায়ুপথ এখানে দুর্গম, শত্রুর ফাইটার প্লেনের আক্রমণ এখানে কঠিন তাই অনেক বেছে-টেছে এখানেই ফাইটার প্লেন তৈরির কারখানার জায়গা নির্বাচন করা হয়েছে কোরাপুটে।
কশিপুর ফেলে এসেছি পিছনে। এখন ছাড়া ছাড়া গ্রাম। অল্প কয়েকঘর মানুষের বাস প্রতিটি গ্রামেই। জঙ্গল এই দুর্বিসহ গরমে যেন পুড়ে গেছে। রোদ পোড়া ঘাস, রোদ পোড়া পত্রহীন গাছের বন আর আশ্চর্য এই পত্রহীন বনেই সকালের ঝাঁ ঝাঁ রোদ্দুরে একরকমের বড় বড় ঝিঁঝি একটানা ঝিঁঝিডাকের খঞ্জনি বাজাচ্ছে। প্রকৃতির মধ্যে যে কত রহস্যই আছে! এইসব রহস্যের অনেকই মানুষ সমাধান করেছে বটে তবে বাকিও আছে অনেক।
আমার নিজের মনে হয় প্রকৃতির মধ্যে রহস্য থাকলে সেইসব রহস্যর সমাধান না করাই ভাল। রহস্যময়তা একরকমের সৌন্দর্য দেয়, মানুষকে যেমন দেয়, প্রকৃতিকেও।
একটা নদী পড়ল পথে। জল নেই। শুধু প্রস্তরময় বালিরেখা। বর্ষা ভাল করে নামলে নিশ্চয়ই জলে ভরে যাবে। নদীর উপরে কংক্রিটের একটা কজওয়ে। বর্ষাকালে নদীতে বান এলে এই কজওয়ের উপর দিয়ে জল বয়ে যাবে। তখনকার মতো রাস্তা বন্ধ হয়ে যাবে। দু-এক ঘণ্টার জন্য মাত্র। তারপর নদীর জল কমলে আবার মাথা তুলবে কজওয়ে। পাহাড়ি নদীমাত্ররই স্বভাব এরকম।
জিপের সামনে বসেছি আমি, আর ভটকাই রাজয়াডুর পাশে বন্দুক রাইফেল হাতে ধরে। টর্চ আর জলের বোতল আগন্তুকদের কাছে দিয়েছি। তারা দুজনেই সাইকেলসুষ্ঠু সওয়ার হয়েছে হুড-খোলা জিপের পিছনে।
ভটকাই জিজ্ঞেস করল রাজয়াডুকে, এই নদীটার নাম কী? যেটা পেরিয়ে এলাম?
রাজয়াডু বলল, স্যার। আমি তো এসেছি রায়গড়া থেকে আপনাদের ডিউটি করতে। আমি এ অঞ্চলের বিশেষ কিছু জানি না।
পিছন থেকে যে মেয়েটিকে বাঘে নিয়েছে তার বর বলে উঠল, এরাডি৷
তারপর বলল, এই নদীটা নেমেছে আমার বাড়ির পিছনের পাহাড় থেকে।
তাই? তোমার নাম কী দাদা?
আমার নাম রাম।
মৃত মেয়েটির স্বামী বলল।
ভারতবর্ষে যে কত কোটি রাম আছে, ভারতবর্ষের সব রাজ্যে, তার খোঁজ সম্ভবত পশ্চিমবঙ্গের আঁতেলরা রাখেন না। তাঁরা ভারতবর্ষ সম্বন্ধে কোনও খবর রাখেন না বলেই বোধহয় বলেন রামের কোনও অস্তিত্বই নেই। ওইসব কূপমণ্ডুকদের কাছে পশ্চিমবঙ্গই ভারতবর্ষ।
ভটকাই বলল, আর তোমার নাম? দাদা?
আমার নাম শত্রুঘ্ন। হৃষ্টপুষ্ট ফরসা মানুষটি বলল।
আমি ভাবছিলাম, এই বিরাট গ্রামীণ ভারতবর্ষে রামায়ণ ও মহাভারতের শিক্ষাই এখনও প্রধান শিক্ষা। সেই শিক্ষাতেই শিক্ষিত সাধারণ, গরিব, কোটি কোটি মানুষ। এরা ব্যা ব্যা ব্ল্যাকশিপ হ্যাভ ইউ এনি উল? ইয়েস স্যার। ইয়েস স্যার। থ্রি ব্যাগস ফুল’ শেখা দিয়ে শিক্ষারম্ভ করে না। যেহেতু এরা অন্যরকম সেই হেতুই আমরা বা বিয়ান্দকার সাহেবের মতো প্রশাসকেরা এদের বুঝি না, এদের দুঃখকষ্ট বুঝি না। এরা এরা, আমরা আমরা। যেদিন এদের আমরা আমাদেরই করে নিয়ে ভাবতে শিখব সেদিনই আমাদের হতভাগা দেশ সত্যিকারের উন্নতি করবে। এদের অন্ধকারে রেখে আমরা আলোর কেন্দ্রে বাস করলে দেশ কখনওই এগোবে না।
ভাবছিলাম, এতসব কথা তো আমি জানতাম না–ভটকাই বা তিতিরও জানত না। ঋজুদার সঙ্গে ভারতবর্ষ এবং বিদেশের নানা অংশে গিয়ে গিয়ে, ঋজুদার চোখ দিয়ে স্বদেশ-বিদেশকে দেখে দেখে, স্বদেশ-বিদেশের জঙ্গল-পাহাড়ের সাধারণ মানুষদের কাছ থেকে জেনেই এইসব ভাবনা আমি ভাবতে শিখেছি। ঋজুদা বলে, চোখ থাকলেই দেখা যায় না। দেখতে পাওয়াটাও শিখতে হয়। সময় নিয়ে, ধৈর্য ধরে।
আমার চিন্তার জাল ছিঁড়ে দিয়ে ভটকাই বলল, এতক্ষণে বিয়ান্দকার সাহেব জম্পেশ করে আমারই অর্ডার দেওয়া ফুলকো লুচি আর বেগুনভাজা খাচ্ছেন, সঙ্গে ওমলেট আর পোড়-পিঠা। আর ঋজুদাও। সত্যি! এইজন্যই বলে, কপালে নেই ঘি, ঠকঠকালে হবে কী?
আমি বললাম, বয়স তো কম হল না ভটকাই। এবারে একটু ম্যাচিওরড হ। কথাকটি ইংরেজিতে বললাম, যাতে সঙ্গীরা বুঝতে না পারে। সদ্য স্ত্রী-হারানো এবং এমন রক্তাক্তভাবে হারানো স্বামী এবং তার গ্রামের মানুষ সঙ্গে রয়েছে আমাদের। তাদের মনে কী চিন্তা আর আমরা তাদের ত্রাণকর্তা হয়ে যাচ্ছি যারা তাদের মনে কী চিন্তা। ছিঃ ছিঃ ওরা কী ভাববে তোকে আমাকে?
ভটকাই লজ্জা পেয়ে বলল, স্যরি।
আমাদের সঙ্গীরা বলল, সামনেই একটা বাঁক পড়বে পথে, সেই বাঁকে পৌঁছে একটা মস্ত শিমুলগাছের পাশ দিয়ে আমাদের ডাইনে মোড় নিতে হবে রাস্তা ছেড়ে দিয়ে। ভারপর জিপ যতদূর যাবে ততদূর নিয়ে গিয়ে জিপ ছেড়ে দিয়ে হেঁটে যেতে হবে।
জিজ্ঞেস করলাম, কতটা হবে পথ?
পথ তো নেই বাবু। পথ করে নিয়ে যেতে হবে আমাদের।
বেশিটাই চড়াইয়ে?
না। চড়াই বেশি নয়। বাঘ তো খুব বেশি উপরে ওঠেনি আমার বউকে নিয়ে।
আমি ভাবছিলাম, আর বউ! সে তো এখন একটা রক্তমাংসের পিণ্ড হয়ে গেছে। শরীরের কতটুকু বাকি আছে খেতে, কে জানে!
পথ ছেড়ে দিয়ে ডানদিকে মোড় নিয়ে আমরা প্রায় সাতশো মিটার অবধি গিয়ে জিপ থেকে নামতে বাধ্য হলাম। আর জিপ যাবে না।
এখান থেকে কতটা?
এই শিমুলগাছ থেকে যতটা এলাম ততটা।
কোনও লোকজন দেখছি না তো।
না। কারওকে আসতে বারণ করেই তো আমরা গেলাম কশিপুরে আপনাদের খবর দিতে। লোকজন সকলে ধলাহান্ডি গ্রামে ফিরে গেছে। পাছে বাঘ গোলমাল দেখে সরে যায় তাই এমনই বলে এসেছিলাম আমি।
তা বেশ করেছ। বুদ্ধিমানের কাজই করেছ। কিন্তু নিরিবিলি পেয়ে বাঘ তার শিকারের, মানে মেয়েটির শরীরের পুরোটাই না খেয়ে যায়। তাই যদি যায় তবে তো তার সঙ্গে মোলাকাতই হবে না। তাই কিছু লোকজন বোধহয় এখানে থাকলে ভাল হত।
তাই তো। এটা তো আগে ভেবে দেখিনি।
শত্রুঘ্ন বলল।
জিপ থেকে নেমে যার যার জলের বোতল কাঁধে ঝুলিয়ে টর্চ দুটিকে নিতে বলে আমরা শুধু শত্রুঘ্নকে সঙ্গে নিয়েই এগোলাম। মেয়েটির স্বামী রামের চোখমুখ তখনও আতঙ্কগ্রস্ত ছিল। মনে হচ্ছিল, তার উপর দিয়ে যেন ঝড় বয়ে গেছে। তাই তাকে থাকতে বললাম জিপেই। তারপর ভাবলাম, এই বাঘ তো দিনমানেও অনেক মানুষ ধরেছে। মানুষের ভয় তার একেবারেই লোপ পেয়ে গেছে। রাজয়াড়ু আর মেয়েটির স্বামীকে এই নির্জনে রেখে যাওয়া কী ঠিক কাজ হবে? একথা ভেবেই জিজ্ঞেস করলাম, ধলাহান্ডি গ্রামে জিপ যাবে?
হ্যাঁ।
কতদুর হবে এখান থেকে?
বেশি পথ নয় বাবু। ওই যে পাহাড়ের নীচে মস্ত কুসুমগাছটা দেখা যাচ্ছে ওই গাছটারই পিছনে ধলাহান্ডি।
তবে ঠিক আছে। রাজয়াড়ু তুমি জিপ নিয়ে রামদাদাকে সঙ্গে নিয়ে চলে যাও ধলাহান্ডি গ্রামেই। গ্রামেই থাকবে তুমি।
এখন কটা বাজে? রাজয়াড়ু জিজ্ঞেস করল।
ন-টা। ঘড়ি দেখে বললাম আমি।
তারপর বললাম, আমরা যদি বেলা একটার মধ্যে গ্রামে গিয়ে না পৌঁছেই তবে তুমি জিপ নিয়ে চলে যাবে কশিপুর। ঋজুবাবুকে নিয়ে গ্রামেই ফিরে আসবে। হয় আমরা সবাই গ্রামে নেমে আসব নয়তো আমাদের মধ্যে একজন অন্তত আসবে ঋজুবাবুকে নিয়ে যেতে।
তারপর বললাম, বুঝেছ তো ভাল করে?
রাজয়াডু মাথা নাড়িয়ে বোঝাল যে, বুঝেছি।
জিপটা ধলাহান্ডির দিকে চলে গেলে আমি আর ভটকাই শত্রুঘ্নের সঙ্গে কিছুটা সমতলের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে গিয়ে পাহাড়ে উঠতে লাগলাম।
পাহাড়টাতে সত্যিই অনেক কুচিলাগাছ। যে গাছের ফল দিয়ে নাক্সভমিকা ওষুধ তৈরি হয়। এখন শীতকাল হলে এই কুচিলাগাছে বড় বড় ধনেশ পাখিরা বসে থাকত, যাদের বলে গ্রেট ইন্ডিয়ান হর্নবিলস। তারা হ্যাঁ-হঁহুঁকা আওয়াজ করে উঁচু উঁচু গাছের এ ডাল থেকে ও ডালে সরে সরে বসত কুচিলার ফল খেতে খেতে। ভারী আওয়াজ করে পাখিগুলো। কুচিলাগাছে ফল আসে শীতে। কুচিলা খায় বলে ওদের নামই কুচিলা-খাঁই। এই পাহাড়ে কুচিলা ছাড়াও আরও অনেক গাছ আছে। বহু প্রাচীন আম, জাম, মহানিম, তৈঁতরা, মিটকুনিয়া, রশশি, সেগুন, শাল, সিধা, কুসুম, মহুয়া। এই প্রখর গ্রীষ্মে পর্ণমোচী গাছেদের মধ্যে অনেকেরই পাতা ঝরে গেছে, অনেকের আবার ঝরেওনি। অনেক পর্ণমোচী গাছ আছে যাদের পাতা গ্রীষ্মকালে ঝরে না শীতকালে ঝরে। যেমন আমলকী। সেই জন্যই আমাদের দেশের জঙ্গল বছরের কখনওই একেবারে পত্রশূন্য মনে হয় না।
একটু গিয়েই আমরা রামের বাড়িতে এসে পৌঁছোলাম। শত্রুঘ্ন দূর থেকেই আঙুল দিয়ে দেখাল, ওই যে রামের বাড়ি। নামেই বাড়ি। একটাই মাত্র ঘর। সামনে নিকোনো উঠোন, ভেরেণ্ডা গাছের বেড়া লাগানো। সাপ যাতে না আসে তাই বেড়ার বাইরের দিকে রাঙচিতারও বেড়া ছিল। বাইরে থেকে উঠোনে ঢোকার একটা দরজা মতো আছে বাঁশের বাখারি দিয়ে তৈরি। রাতে সেটা ভোলা ছিল কিনা কে জানে। তবে বাঘ ওই উঠোন থেকে রামের বউকে ঘাড় কামড়ে ধরে এক ধাক্কায় সেই বাখারির বেড়াকে ভেঙে চলে গেছে। উঠোনের এক কোণে তুলসি মঞ্চ। আজ সন্ধেবেলা এবং এর পরেও বহুদিন কেউ এখানে আর প্রদীপ দেবে না। রাম হয়তো বিয়ে করবে আবার। নিছকই প্রয়োজনে। বাড়িতে তি বছরের মেয়েকে কে দেখাশোনা করবে? রাঁধবে বাড়বে কে? কে ফুলের লতা তুলে দেবে বাড়ির বারান্দার খুঁটি থেকে? কে লাউ-কুমড়ো বা সিমের লতা লতাবে? পেটের খিদে মেটাতেই এদের জীবন শেষ হয়ে যায়। কখন যৌবন আসে, কখন প্রৌঢ়ত্ব বা বার্ধক্য তা বুঝতেই ওরা পায় না। একদিন মৃত্যু এসে ওদের সব যন্ত্রণার আর দারিদ্র্যের দুঃখ মোচন করে দেয়। এমন জীবনযাপন করে বলেই আনন্দ বা শোকের অভিঘাত এদের উপর তেমন করে প্রভাব ফেলে না। আনন্দকেও যেমন এক নৈর্ব্যক্তিক চোখে দেখে এরা, দুঃখকেও তাই। নইলে আজ সকালে শত্রুঘর সাইকেলের ক্যারিয়ারে বসে রাম কশিপুরে পৌঁছে অমন নির্বিকার থাকতে পারত না। নিজের স্ত্রীর অমন মর্মান্তিক পরিণতি তাকে ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো করে দিত। কিন্তু এরা যে জীবনের হাতে গুঁড়িয়েই আছে। ওরা নতুন করে গুঁড়ো হবে কী করে।
রামের বাড়ি দেখে, রামের সামনে আজ সকালে ভটকাই-এর লুচি বেগুনভাজা। নিয়ে আদেখলেপনা করাটা যে কতখানি স্কুলরুচির ব্যাপার হয়েছে তা পরে ভটকাইকে বুঝিয়ে বলতে হবে। কোনও কোনও ব্যাপারে ওর মাথাটা মোটা আছে। অনেক ব্যাপারই সে মাথাতে ঢোকে না যদিও তবু ও নিজেকে খুব চালাক বলে মনে করে।
কিছুদূর উঠতেই আমরা মাটিতে রক্তের দাগ পেলাম, ঝোপেঝাড়েও রামের বউকে ঘাড় কামড়ে নিয়ে যাবার সময়ে দু পাশের ঝোপেঝাড়ে রক্ত লেগেছে। আরেকটু গিয়েই তার নীলরঙা শাড়িটা পাওয়া গেল। ছিঁড়ে গেছে সেটা এবং রক্তে লাল হয়ে গেছে জায়গায় জায়গায়। আর কিছু পাওয়া গেল না। ওরা এত গরিব যে শায়া সেমিজ বা ব্লাউজ-টুলাউজ পরে না বাড়িতে। যদি বা এক আধটা থাকে তো হাটের দিনেই পরে যায়, নইলে নয়!
আমরা খুব সাবধানে হাতিয়ার রেডি-পজিশনে ধরে এগোচ্ছি এবারে। এতক্ষণ শত্রুঘ্ন আমাদের পথ দেখাচ্ছিল, এবারে আমরা ওকে পিছনে দিয়েছি। ও নিরস্ত্র। ওর হাতে ধরা আমাদের দুটি টর্চ আর গলাতে-ঝোলানো দুটি জলের বোতল। বাঘের এলাকাতে এসে গেছি আমরা। বাঘ যদি এখানে থেকে থাকে, মানে কিল ছেড়ে চলে গিয়ে না থাকে তবে যে কোনও সময়ে সে দেখা দেবে। কোনওরকম জানান না দিয়ে হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো নিঃশব্দে উড়ে এসে পড়বে আমাদের উপরে নয়তো দুর থেকে হুংকার দিয়ে ভয় দেখাবে, সাবধান করবে আর না এগোতে। তবে এমন করে স্বাভাবিক বাঘ। মানুষখেকোর মতিগতি আগে থাকতে বোঝা যায় না। কোন সময়ে যে সে কেমন ব্যবহার করবে তা আগে থাকতে বোঝা ভারী শক্ত। অধিকাংশ সময়েই মানুষখেকো বাঘ নিজের অবস্থান জানতে দেয় না। চুপ করে থাকে। কখনও বা কিল ছেড়ে ঘুরে শিকারির পিছনে চলে গিয়ে সে কিছু বোঝার আগেই পিছন থেকে তাকে আক্রমণ করে। এই ধলাহান্ডির মানুষখেকো ঠিক কী করবে তা সে নিজেই শুধু জানে।
শত্রুঘ্ন এবারে দাঁড়িয়ে পড়ল। মুখে কথাবার্তা আমরা অনেকক্ষণ ধরেই বলছি না। সামনে একটা পুটকাসিয়া গাছ। যার ছাল দিয়ে ওড়িয়া কবিরাজেরা নানারকম জড়িবুটি বানান। সেই গাছের পিছনে কতগুলো ফিকে সাদাটে পাথরের জটলা। আফ্রিকার সেরেঙ্গেটির কোপি (kopje)-র মতো। আমার মনে পড়ে গেল যে কালো পাথর আর পাহাড়ের রাজত্বে এই অঞ্চলের সাদা পাথরগুলোর জন্যই নীচের গ্রামের নাম হয়েছে ধলাহান্ডি।
এবারে শত্রুঘ্ন আঙুল দিয়ে ওই পাথরগুলোর স্তূপকে আবারও দেখাল। সামনে একটা মস্ত কদমগাছ ছিল। কদমগাছের ডাল শিমুলগাছের ডালের মতো দু’দিকে সমান্তরাল হাতের মতো ছড়ানো থাকে। আমি শত্রুঘ্নকে চোখ দিয়ে ও হাত দিয়ে ইশারা করলাম ওই গাছে উঠে চারদিক দেখে আমাদের ইশারাতে জানাতে। এমনিতে কোনও আওয়াজই ছিল না। একটা ছোট্ট সবুজ পাখির একলা স্বর যেন সেই ভয়াবহ বনের ভয়কে, নৈঃশব্দ্যকে আরও বাড়িয়ে দিল। কোনওরকম আওয়াজ না শুনতে পেয়ে আমি আর ভটকাইও শিমুলগাছের ডালেদের মতো সমান্তরালে ছড়িয়ে গেলাম দু’দিকে। কদমগাছেরা চিরহরিৎ পশ্চিমের দেশের কনিফারাস বনেদের মতো। সবসময়েই পাতা থাকে, ছায়া থাকে বলেই হয়তো শ্রীকৃষ্ণ এত গাছ থাকতে কদমতলাতে দাঁড়িয়ে বাঁশি বাজাতেন আর রাধার আসার অপেক্ষাতে থাকতেন।
শত্রুঘ্ন নিঃশব্দে হাত দশেক উঠে গেল। তার বাহাদুরি আছে বলতে হবে। জলের বোতলগুলো তামার। তার উপরে খাকি ফ্ল্যানেল জড়ানো। বেরোবার সময়ে ফ্ল্যানেল ভিজিয়ে নিয়ে আসতে হয়, তাতে জল অনেকক্ষণ ফ্রিজের জলের মতো ঠাণ্ডা থাকে। এ সব ঋজুদার জেঠুমনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে অ্যামেরিকান আর্মি ডিসপোজালের সেল-এ কিনে রেখেছিলেন। ঋজুদার কাছে আরও যে কত কিছু আছে। তামার বলে বোতলের ওজন অত্যন্ত হালকাজলেরই যা ওজন। তবু তামা তো ধাতুই। দু-দুটো বন্ড-এর পাঁচ ব্যাটারির টর্চ এবং দুটি তামার বোতল থাকা সত্ত্বেও একটুও ধাতব শব্দ না করে ফিট দশেক ওঠা সহজ কর্ম নয়।
সামনে পিছনে এবং দু পাশে নজর রেখেই আমরা উপরে তাকাচ্ছি শত্রুঘর দিকে সে ইশারাতে কিছু বলে কি না তা দেখার জন্য। শত্রুঘ্ন আরও কিছুটা উপরে উঠে গিয়ে ইশারায় আমাদের ওই পাথরগুলোর ওপাশে দেখাল আর হাত নেড়ে জানাল যে বাঘ নেই। তার হাতের ইশারা পড়তে আমাদের ভুলও হতে পারত। শত্রুঘ্ন সম্ভবত বলল যে বাঘ নেই কিন্তু মড়ি আছে। তার মানে বাঘ এখন মড়িতে নেই। হয়তো জল খেতে গেছে বা কোথাও গিয়ে ঘুমোচ্ছে।
আমরা নিরস্ত্র শত্রুঘ্নকে গাছের উপরে থাকতে বলে দু’জনে দু’দিক দিয়ে ওই পাথরগুলোর দিকে এগিয়ে গেলাম। পায়ে পায়ে এবং নিঃশব্দে। আমাদের দু’জনের পায়েই বাটা কোম্পানির জগিং-শু। শুকনো পাতা এড়িয়ে পা ফেলাতে নিঃশব্দেই এগোতে পারছিলাম আমরা। জঙ্গলে নিঃশব্দে চলাফেরা করাও শিখতে হয়। আমি তো ঋজুদার অনেকদিনের সঙ্গী। ভটকাই সেদিক দিয়ে বিচার করলে প্রায় রংরুট। তাও আমার আর তিতিরের কাছ থেকে ট্রেনিং পেয়ে ও শিখে নিয়েছে অনেক কিছু। এসব ব্যাপারে সে খুব ভাল ছাত্র। বলতেই হবে যে অত্যন্ত অল্পদিনেই সে খুব তাড়াতাড়ি শিখেছে অনেক কিছু।
আমি যখন পাথরগুলোর ওপাশে গিয়ে পৌঁছোলাম তখনই আমার হৃৎপিণ্ড বন্ধ হয়ে যাবার জোগাড় হল। পাথরগুলোর একেবারে গোড়াতে থাকাতে ওপাশ থেকে দেখতে পায়নি শত্রুঘ্ন যে বাঘ ওখানেই আছে এবং ঝুঁকে পড়া কদমের ডালের ছায়াতে লম্বা হয়ে ঘুমোচ্ছে। আর তার থেকে একটু দূরে রামের বউ শুয়ে আছে চিত হয়ে। সে এক বীভৎস দৃশ্য। তার বুক দু’টি এবং তলপেটের প্রায় সবটাই খেয়ে নিয়েছে বাঘ নরম মাংস পেয়ে। ডান পা-টাও খেয়েছে হাঁটু অবধি। মেরুদণ্ডটি অক্ষত আছে বলেই শরীর থেকে পা বিচ্ছিন্ন হয়নি। উপরের চন্দ্রাতপের ফাঁক-ফোঁকর দিয়ে রোদের সরু সরু ফালি এসে পড়েছে কিল-এর উপরে। মেয়েটির মুখটি কিন্তু অক্ষত আছে। এলোমেলো চুলের কিছুটা সামনে চলে এসে মুখটিকে অংশত আড়াল করে রেখেছে কিন্তু তারই মধ্যে দিয়ে দুটি ভয়ার্ত বিস্ফারিত খোলা চোখ যেন কী এক আতঙ্কে চেয়ে আছে আকাশের দিকে।
ঘুমন্ত বাঘকে কোনও ভাল শিকারি মারে না। সে বাঘ মানুষখেকো হলেও কি মারে না? এ কথা ভাবতে ভাবতেই আমি রাইফেলটা আস্তে আস্তে তুলতে লাগলাম। কাঁধ আর বাহুর সংযোগস্থলে রাইফেলের রাবারের প্যাড লাগানো বাঁটটিকে লাগাতে যাব এমন সময়ে ভটকাই চেঁচিয়ে উঠল, সাবধান রুদ্র। বাঘ।
ভটকাইকে আমি দেখতে পাচ্ছিলাম না। সে কতদূরে ছিল তাও নয় কিন্তু বাঘ তার অস্তিত্ব অবশ্যই টের পেয়েছিল কিন্তু আমি যে তার পিছনদিকে আছি তা বাঘ জানতেও পায়নি। ভটকাই-এর গলার আওয়াজ পেয়েই বাঘ তাকে আক্রমণ করবে যে এটাই স্বাভাবিক ছিল কিন্তু এই বাঘ অন্য কোনও বাঘের মতনই নয়। আমি রাইফেলের বাঁট আমার বাহু আর কাঁধের সংযোগস্থলে লাগাবার আগেই এক ঝটকায় বাঘ উঠে দাঁড়িয়েই একটি প্রকাণ্ড লাফ দিয়ে সামনের একসার অর্জুনগাছের ঝোপ টপকে মস্ত বড় একটা কুচিলাগাছের আড়ালে চলে গিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল।
ভাগ্যিস ভটকাই গুলি চালায়নি। বাঘের সামনে থেকে এবং মাত্র দশ হাত দূর থেকে গুলি চালালে তার বিষম বিপদ হতে পারত। সে এখনও শিকারি হিসেবে পাকা হয়নি। নিনিকুমারীর বাঘ মারতে গিয়ে সে যা কাণ্ড করেছিল তা বলার নয়। গুলি মিস করলে তো বটেই গুলি লাগলেও তার কপালে দুঃখ ছিল। কারণ, গুলি খেলে বাঘ সবসময়েই তার মুখ যেদিকে থাকে সেদিকে লাফ মারে, সেই লাফ সে মারবেই, যদি না তার হার্ট অথবা লাংস অথবা তার সামনের দুটি পা অকেজো হয়ে যায়। আর তিন সেকেন্ড সময় পেলেই বাঘ তার ঘাড়ে ঋজুদার ফোরফিফটি-ফোরহানড্রেড রাইফেলের গুলি আমার হাত থেকে খেয়ে পঞ্চত্ব পেতে পারত কিন্তু ভবিতব্যং ভবেতব্য। আমাদের কপালে এখন দুঃখ আছে।
মানুষখেকো বাঘেরা কীভাবে শিকারি ও অ-শিকারির মধ্যে তফাত বোঝে তা ঈশ্বরই জানেন। তা না বুঝলে ভটকাইকে আক্রমণ না করে সে অন্যদিকে লাফ দিয়ে আড়ালে চলে যেত না।
ইশারাতে শত্রুঘ্নকে নেমে আসতে বলে সেখান থেকে একটু পিছিয়ে গিয়ে আমাদের স্ট্র্যাটেজি ঠিক করলাম। ঋজুদার শরীর খুবই দুর্বল। তাকে এখানে আসতে দিলে সে কোনও কথাই শুনবে না। তাই আমিই স্বঘোষিত নেতা বনে গিয়ে সিদ্ধান্ত নিলাম যে ভটকাই আর শত্রুঘ্ন কথা বলতে বলতে এখান থেকে চলে যাবে ধলাহান্ডি গ্রামে। এখন সোয়া দশটা বেজেছে। গ্রামে তারা একটা অবধি আমার জন্য অপেক্ষা করবে। একটার মধ্যে আমি না ফিরলে ভটকাই রাজয়াডুকে নিয়ে কশিপুরে ফিরে গিয়ে সব ঘটনা ঋজুদাকে রিপোর্ট করবে। তারপর খাওয়া-দাওয়া করে আবার ফিরে আসবে ধলাহান্ডি গ্রামে। আমার ধারণা বাঘ আবার আসবে। না এলে সে কিল-এর পাশেই ঘুমোত না। সম্ভবত এক কোর্স খানা খেয়ে সে জল খেয়ে আসতে গেছিল। জল খেয়ে ফিরে এসে এখানেই ছায়াতে ঘুমোচ্ছিল। উপরের কদমগাছের চন্দ্রাতপের জন্য আকাশ থেকে শকুনেরা মড়িটাকে দেখতে পাবে না তাই তার আর অন্য কোনও চিন্তা নেই। মড়িটার উপরে চন্দ্রাতপ থাকা সত্ত্বেও বাঘ যে নিশ্চিন্তমনে অন্যত্র যায়নি তার মানেই হচ্ছে বাঘের খিদে এখনও মেটেনি। গত তিনদিনে এ অঞ্চলে কোনও মানুষও মারেনি বাঘ। তার মানে তার খিদেও পেয়েছিল প্রচণ্ড।
ভটকাই বলল, তুই একা থাকবি কেন? আমিও থাকব। ঋজুদা আমাকে কী বলবে তোকে একা রেখে গেলে?
বললাম, বেশি পাকামি করিস না। দু দিনের বৈরাগী ভাতরে কয় অন্ন’। শিকারের তুই কী বুঝিস? ঋজুদার শরীর অসুস্থ বলে তাকে আটকাবার জন্যই তোকে পাঠাচ্ছি আমি।
বাঘ যদি সন্ধের আগেও না আসে?
ভটকাই বলল।
না এলে রাতেও থাকব আমি এখানে। কাল সকালে হয় আমার মৃতদেহ তোরা বয়ে নিয়ে যাবি নয়তো বাঘের লাশ। হয় ইসপার নয় উসপার। আমার মামাতো বোন কাবেরীদির বিয়ে আছে সামনের সপ্তাহে। আজই দিনে-রাতে একটা হেস্তনেস্ত হয়ে গেলে কলকাতায় ফিরে বিয়েটা খেতে পারব। তা ছাড়া বিয়েতে কাজও করতে হবে অনেক। মামিমা বারবার করে বলে দিয়েছেন।
এত সব কথা আমরা ফিসফিস করেই বললাম। ভটকাই বলল, জলের বোতল আর টর্চটা নিয়ে নে। আমি কি ফিরে এসে তোর গুলির শব্দ শুনলে আসব শত্রুঘদাদের নিয়ে? হ্যাঁজাক হারিকেন সব নিয়ে? বাঘকে নিয়ে যাবার জন্য দড়ি-টড়ি সমেত?
আমি বললাম, একটা এমনকী দুটো গুলির শব্দ শুনলেই আসিস না। একটু ব্যবধানে যদি তৃতীয় গুলির শব্দ শুনিস তবেই বুঝবি যে বাঘ মরেছে। আর তুই তোর বন্দুকটা আর এল. জি.-গুলো আমাকে দিয়ে যা। ঋজুদার এই রাইফেলটা নিয়ে যা। গুলি গুনে নে।
কেন রাইফেল দিচ্ছিস?
ওই শর্ট রেঞ্জে বন্দুকই ভাল। তা ছাড়া যদি অন্ধকার হয়ে যায় তাহলে বন্দুকে মারা অনেক সহজ হবে। আলো ধরার যে কেউই থাকবে না।
কেন? শত্রুঘ্নদাকে সঙ্গে রাখ তুই। আমি একাই ফিরে যাচ্ছি ধলাহান্ডিতে।
না। ও তো আর আমাদের সঙ্গে শিকারে গিয়ে অভ্যস্ত নয়। পারফেক্ট আন্ডারস্ট্যান্ডিং ছাড়া সঙ্গী না নেওয়াই ভাল। যাকগে। আজ তুই যে বেঁচে ফিরেছিস এ তোর অনেকই ভাগ্য।
ভটকাই বলল, রাখে কেষ্ট মারে কে?
ঋজুদার কাছে খুব বকা খাবি। যা না তুই।
যো হোগা সো হোগা। চললাম তাহলে আমি। গুড লাক। তবে মাটিতে বসিস না। মিস্টার বিশ্বলেরই মতো তোর মাথাটাও তাহলে বাঘে কইমাছের মাথা শিয়ালে যেমন করে চিবিয়ে দিয়ে ফেলে যায় তেমন করে চিবিয়ে দিয়ে যাবে। যে গাছে শত্রুঘদাদা উঠেছিল সেই কদমগাছটাতেই উঠিস।
বললাম, না সে গাছ থেকে, বাঘ পাথরের এদিকে এসে গেলে আর দেখা যাবে না–যে কারণে শত্রুঘদাদাও দেখতে পায়নি বাঘকে। ওদিকের কোনও গাছে। বসব। তোরা কিন্তু জোরে জোরে কথা বলতে বলতে যাবি।
ঠিক আছে। বলে, ভটকাইও এগোল শত্রুঘ্নকে নিয়ে আর আমিও যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফিরে গিয়ে অন্য পাশে একটা ঝাঁকড়া পছন্দসই তেঁতুলগাছ পেয়ে গিয়ে তাতেই উঠব ঠিক করলাম। জুতো জোড়া খুলে দুটো পাটিরই ফিতেতে গিট দিয়ে গলাতে ঝুলিয়ে নিলাম। মাখন জিনস-এর ঊরুর কাছের প্রকাণ্ড পকেটে পাঁচ ব্যাটারির টর্চটিকে ঢুকিয়ে অন্য পকেটে গুলিগুলো পুরে বন্দুকটা হাতে নিয়ে, গলাতে জলের বোতলও ঝুলিয়ে তেঁতুলগাছে উঠতে লাগলাম। ওই সময় বাঘ আমাকে দেখতে পেলে নির্ঘাৎ কোনও ‘টাগ’ ভেবে এমনিতেই ভয়ে অক্কা পেয়ে যেত। গুলি আর তাকে করতে হত না। কোনও ফোটোগ্রাফারও একটি ফোটো তুলে রাখলে তা নিয়ে পরে অনেক অবকাশের মুহূর্তে হাসতে হাসতে প্রাণ যেত। বারো ফিট মতো উঠে দু’ ডালের একটা মনোমতো সংযোগস্থল পেয়ে গিয়ে আরামে বসলাম সেখানে। পিছনে হেলানও দেওয়া যাবে মোটা কাণ্ডতে। বসাটা ঠিকমতো হতে জলের বোতল থেকে যতখানি কম শব্দ করে একটু জল খেলাম। তারপর একটি ছোট ডালে জুতো ও জলের বোতলকে ঝুলিয়ে দিলাম। গাছের উপরে টর্চ রাখার কোনও জায়গা নেই তাই সেটা ঊরুর পকেটেই রইল। বাঁ ঊরুর পকেটে। বন্দুকের কুঁদোর সঙ্গে টর্চের ধাক্কা লেগে শব্দ হওয়ার কোনও আশঙ্কা যে নেই তা জেনে আশ্বস্ত হওয়া গেল। এখন বাঘ এসে আমাকে ধন্য করে কি করে না তাই দেখার।
গাছে ওঠার পরও ভটকাই আর শত্রুঘর গলার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলাম। মিনিট পাঁচেক পর একটা ময়ূর খুব জোরে ডেকে উঠল আমার ডানদিক থেকে আর একটা হুপি পাখি অতর্কিতে এবং প্রচণ্ড জোরে ডেকে উড়ে গেল পাহাড়তলির দিকে। তার দু’দিকের ডানা এত জোরে আন্দোলিত হচ্ছিল যে মনে হচ্ছিল একটি খয়েরি-সাদা গোলাকৃতি পাখাই বুঝি চলছে তার পিঠের উপর। এই পাখির ডাক শুনলে মাথার মধ্যে চক্কর দিতে থাকে। তারও পরে একটি ইয়ালো-ওয়াটেলড ল্যাপউইঙ্গ টিটিরটি টিটিরটি করে জঙ্গলের বাইরের ফাঁকা জায়গার উপরে উড়ে উড়ে ডাকতে লাগল। ওই ডাক শুনেই ভয়ে আমার হৃৎপিণ্ড স্তব্ধ হয়ে গেল। বাঘ ভটকাইদের পিছনে যায়নি তো? এই বাঘকে কোনওই বিশ্বাস নেই। মেয়েটির মড়ি ফেলে রেখে সে নতুন শিকার করে, শত্রুঘ্ন অথবা ভটকাইকে দিয়ে রাতের ডিনার সারবার মতলব করেছে হয়তো। দেখতে পেলাম, ভটকাই চলেছে আগে আগে রাইফেল কাঁধে নিয়ে। তার মাথায় টুপি। ল্যাপউইঙ্গের ডাক ওরাও শুনেছে। শুনেই ওরা দু’জনে দাঁড়িয়ে পড়ে পিছনদিকে তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে রইল। ভটকাই কাঁধ থেকে নামিয়ে রাইফেলটাকে রেডি-পজিশনে ধরল দেখলাম। ওরা যেহেতু পাহাড়তলিতে প্রায় পৌঁছে গেছিল এবং সেখানে একটা আবাদহীন চষা-খেত ছিল তাই ওদের পাহাড়ের জঙ্গলের ফাঁকফোঁকর দিয়ে দেখতে পাচ্ছিলাম আমি। ওরা দু’তিন মিনিট ভাল করে ওদের পিছনে বাঘের কোনও চিহ্ন যে নেই তা দেখে নিয়ে আবার এগোল। এমনও হতে পারে যে পাখিটা ওদের দেখেই ডাকছিল। জঙ্গলে কোনও কিছুকে চলাফেরা করতে দেখলেই ডাকে ওরা।
ওরা দু’জনে ঝাঁটিজঙ্গল ভরা একটা এলাকা পেরিয়ে পত্রহীন শালবনের মধ্যে ঢুকে যেতেই জঙ্গল স্তব্ধ হয়ে গেল। আমার পিছনে একটি কালো পাথরের গুহা ছিল। সেখানে একজোড়া নীল রক-পিজিয়ন বকবকম করে ডাকছিল। শীতকালে গ্রিন পিজিয়নেরা, যাদের হিন্দিতে বলে হরিয়াল, বট-অশ্বথের ফল খেয়ে বেড়ায় রোদ ঝিলমিল পাতাদের মধ্যে লাফিয়ে লাফিয়ে–কোনটা পাখি আর কোনটা পাতা তা বোঝাই যায় না তখন। আর এই নীলরঙা রক-পিজিয়নরাও শীতের দিনে পাহাড়ের উপরের পাথরে জায়গাতে রোদের মধ্যে ঘুরে ঘুরে খাবার খুঁটে খায়। পাথরে তো ওদের খাবার থাকার কথা নয়। হয়তো মুখে করে নিয়ে আসে কোনও গাছ-টাছ থেকে। গরমটা এদেরও অসহ্য হয়েছে বোধহয়।
এখন চারদিক স্তব্ধ। একটা হাওয়া বইছে রৌদ্রদগ্ধ বনের মধ্যে অস্পষ্ট ফিসফিসানি তুলে। এখন সকাল সাড়ে দশটা। নিজে চুপ করে গাছের উপরে বসে থাকায় সমস্ত জঙ্গল যেন বাত্ময় হল। ছোট বড় পাখি ডাকতে লাগল। একটা দাঁড়াশ সাপ তার চিত্রবিচিত্র শরীর নিয়ে খুব ধীরে ধীরে শুকনো পাতার মধ্যে মধ্যে সরসর আওয়াজ করে ডানদিক থেকে বাঁদিকে যাচ্ছিল। তার সামনে সামনে জংলি ইঁদুরেরা এদিক ওদিক শুকনো পাতার মধ্যে ছিটকে উঠছিল। কোথা থেকে খবর পেয়ে একদল নীল মাছি, যারা জঙ্গলে মরা-জানোয়ারের মড়ির উপরে বসে রক্ত খায় তারা ঝাঁকে ঝাঁকে এসে মেয়েটির শরীরের উপর বসছিল আর উড়ছিল। এক ইঞ্জিন বনাঞ্জা বা টাইগার-মথ প্লেনের ইঞ্জিনের শব্দের মতো সেই নীল মাছিদের সম্মিলিত ডানার শব্দ শোনা যাচ্ছিল। সেই শব্দ জঙ্গলের মধ্যের নানা শব্দর ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের মতো একটানা হয়েই যাচ্ছিল। মাছিরা শবদেহ ঢেকে দিল। ভালই হল। নইলে আমার ভারী সংকোচ হচ্ছিল সেই উলঙ্গ মেয়েটির দিকে তাকাতে। তার পা দুটি ছিল আমারই দিকে। দু’টি নয় একটি পা বলাই ভাল। কারণ ডান পা-টি তো প্রায় খেয়ে শেষ করে দিয়েছে বাঘে। যেখানে বুক ছিল সেখানে দুটি সমান ঘা-এর মতো দগদগে ক্ষত। রক্ত জমে কালো হয়ে গেছে। মাছিরা তার নীল অঙ্গবস্ত্র হয়ে তাকে লজ্জা থেকে বাঁচাল যেন।
বন জানে না যে আমি আছি সেখানে, তাই না জেনে তার সব পশুপাখি সরীসৃপ। পোকামাকড় নিয়ে সে জেগে উঠেছে। শব্দর অর্কেস্ট্রা বাজছে নিচু গ্রামে। তার সঙ্গে গন্ধ উড়ছে নানারকম। আমাদের দেশের বনে বনে দিনে-রাতে শব্দ-গন্ধ এবং দৃশ্যর কোনও বিরাম নেই। একঘেয়েমিও নেই কোনও। প্রত্যেক ঋতুতে এর প্রকৃতি আলাদা আলাদা। এখন জঙ্গলে বারুদের গন্ধ। রোদে ও বৃষ্টিহীনতায় বন বারুদের মতো হয়ে রয়েছে। কেউ দেশলাই কাঠি একটি জ্বেলে দিলেই হল। দাউ-দাউ করে চিতার মতো জ্বলতে থাকবে বন।
.
০৪.
ভটকাই যখন রাজয়াডুকে নিয়ে কশিপুরে পৌঁছোল তখন রীতিমতো লু বইতে শুরু করেছে। চৌকিদার পবন বলল যে ঋজুদার জ্বর এসেছে আবার ভালমতো। ব্রেকফাস্টে যা খেয়েছিলেন, তারপর খাননি কিছুই।
ভটকাই ঘরে গিয়ে দেখল ঋজুদা পাশ ফিরে শুয়ে আছে। ভটকাই-এর ঢোকার শব্দ পেয়েই বলল, কীরে, বাঘ মেরে এলি?
ভটকাই সব বলল ঋজুদাকে।
ঋজুদা বলল, ভালই করেছিস। আমার যাওয়ার মতো অবস্থা নেই, এদিকে তোকে বা রুদ্রকে বাঘে খেলে কলকাতাতে কী করে মুখ দেখাব। যাই হোক, তোরা বড় হয়েছিস, ধীরে ধীরে অনেক কিছু শিখেছিস, রুদ্র তো আমাকেও অনেক ব্যাপারে শেখাতে পারে তাই তোদের উপরে আমার পূর্ণ আস্থা আছে। এই বাঘ না মারা গেলে আমাদেরই যে বেইজ্জৎ তাই নয় বিয়ান্দকার সাহেব এবং তাঁর অনেক উপরওয়ালাও বিপদে পড়বেন। আজ এই ঝুঁকি তোদের না নিলেই নয়। তবে রুদ্র যেমন বলেছে ঠিক তেমনই করবি। শিকারে, সে বাঘ শিকারই হোক কি পাখি শিকার, যুদ্ধেরই মতো একজনকে নেতা মানতে হয়, নইলে অঘটন ঘটে। এখন খেয়ে-দেয়ে রুদ্রর জন্যও কিছু খাবার নিয়ে যা। তোর লুচি বেগুনভাজা আর পোড়-পিঠাই খেয়ে যা এবং তোর সঙ্গী ও রাজয়াডুকেও খাওয়া। তারপর রুদ্রর জন্য টিফিন ক্যারিয়ারে করে নিয়ে যা। জলও নিয়ে যা একটা জেরিক্যানে করে। ফাস্ট-এইড বক্সটাও নিয়ে যা, জিপ যখন ফাঁকাই যাচ্ছে। এই রাইফেলটা রেখে বার্টি-ও-সিক্স ম্যানকিলার শুনারটা নিয়ে যা। দূরে মারতে হলে সুবিধে হবে। রাইফেলটাও ডেড-অ্যাকুরেট। তা ছাড়া এর ব্যারেলের উপরে একটা পেনসিল-টর্চ ফিট করা আছে। অন্ধকারেও মারা যায়। নে, এবারে খেয়ে-দেয়ে নিয়ে বেরিয়ে পড়, দেরি করিস না, রুদ্রর কখন কী দরকার হয় তোকে।
.
০৫.
ঋজুদার কথামতো ভটকাই খেয়ে দেয়ে রাইফেল বদলে যখন কশিপুর থেকে বেরোল তখন দুপুর পৌনে তিনটে। এর চেয়ে তাড়াতাড়ি করতে পারল না ও। পায়েস দিয়ে লুচি ওর বড় প্রিয় জিনিস। একটু বেশি খাওয়া হয়ে যাওয়াতে রুদ্রর জন্য আবার লুচি ভাজতে হল। রাজয়াড়ু আর শত্রুঘ্ন কবজি ডুবিয়ে পাঁঠার মাংসর ঝোল আর ভাত খেল। পাঁঠার মাংস দিয়েও লুচি খেতে বড় ভালবাসে ভটকাই তাই আরও ক-খানা লুচি বেশি খাওয়া হয়ে গেল। রুদ্রর জন্যই দুতিনপিস আলু। আর একটু ঝোল সমেত মাংস নিয়ে নিল আর শত্রুঘ্নকে বলল, ঝোল যদি একটুও চলকে পড়ে তবে তোমার মাথা থেকে আমিও ঘিলু চলকে দেব। ধলাহান্ডির বাঘ দেখেছ তোমরা, ভটকাইচন্দ্রকে তো দেখোনি।
কন চন্দ্র হেলা সেটা বাবু? তাংকু নাম তো কেব্বে শুনি নান্তি।
ভটকাই বলল, কেমিতি শুনিবু দাদা? সে চন্দ্র কি আউ রোজ রোজ দিশিবা? সে যে উঠিছি ধরণী কম্পমান হউচি।
তাংকু নামটা কন কহিলে বাবু? আউ গুট্টেবার কহন্তু আইজ্ঞা।
ভটকাইচন্দ্র।
ভটকাই বলল।
মাত্র ছ-মাইল পথ কিন্তু রোদের যা তেজ আর গরম লু-এর যা হলকা তাতে মনে হল চোখের মণি দু’টো গলে গিয়ে জিপের মধ্যেই পড়ে থাকবে। তবে ভাগ্য ভাল যে সব পথই এক সময়ে শেষ হয়। সুখের পথ কি দুঃখের পথ।
ধলাহান্ডি গ্রামে যখন পৌঁছোল ওরা তখন জানল যে না, কোনও গুলির শব্দ হয়নি।
এই বিসংবাদ শুনে ভটকাইচন্দ্রর ব্লাডপ্রেশার ধীরে ধীরে চড়তে লাগল। এখন বাজে তিনটে। তার অসহায় প্রতীক্ষার এই শুরু।
.
০৬.
গরম হাওয়াটা এই পাহাড়ের আনাচ-কানাচকেও পাঁপড়ভাজার মতো সেঁকে দিয়ে যাচ্ছে। দুপুরে পাখিদেরও শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। মুখ হাঁ করে চোখের মণি ড্যাব ড্যাব করে তারা চাতক পাখির মতো বৃষ্টির কামনাতে ছিল। ধলাহান্ডি গ্রামে বিকেলে বোধহয় কোনও নাচগান হবে। মাঝে মাঝেই মাদলে বা ধামসাতে চাঁটি পড়ছিল। মনে হয় ওরা এই মানুষখেকো বাঘ তাড়াবার এবং বৃষ্টি আনবার জন্য নাচবে সন্ধে নামার আগে। সন্ধে নেমে গেলে তো এখানে অলিখিত কারফিউ। সকলেই যে যার ঘরে দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়বে। এই গরমে বন্ধ ঘরে প্রাণ যায় যাবে কিন্তু বাঘের দাঁতে নখে তা যাওয়ার চেয়ে সেই মৃত্যু অনেক ভাল। খরার সময়ে যে এইরকম নাচগান হয় দেখেছি আমি ওড়িশার অন্যত্র।
এতক্ষণ খিদেটা বোধ করিনি। এখন হঠাৎ সেটা চনমনিয়ে উঠল। খিদে তো ছিলই। সকালে সেই দু’টি ক্রিম-ক্র্যাকার বিস্কিট আর চা খেয়েছিলাম দু’ কাপ তারপরে দু’বার চার ঢোক জল ছাড়া পেটে আর কিছু পড়েনি। আর আধঘণ্টাটাক পরেই হাওয়াতে এই জ্বালাটা আর থাকবে না তবে উষ্ণতা থাকবে রাত দেড়টা দু’টো অবধি। তারপর থেকে হাওয়াটা একটু ঠাণ্ডা হবে।
ভাবলাম, বাঘ তো এতক্ষণেও এল না, যদি দিনমানেও না আসে তবে তো মুশকিল হবে। সারাদিন এই গরমের আর অপেক্ষার ক্লান্তিতে ক্লান্ত হয়ে রাতে যদি খিদে ও ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ি! তাহলে আজ সকালে রাম আর শত্রুঘর বর্ণনার সেই বাঁদরের মতো অবস্থা হবে না তো! গাছ থেকে নীচে পড়লেই চিত্তির। সে বাঁদর রক্ষা পেয়েছিল বলেই যে তার এই অধস্তন পুরুষ রক্ষা পাবে তার কী গ্যারান্টি আছে?
বেলা পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই বন আবার সরব হল। পাখিদের কলকাকলি, কোটরা হরিণের ব্রাক ব্বাক ডাক আর ময়ুরের কেঁয়া কেয়া রবে মধ্য দুপুরের থমথমে নিস্তব্ধতা কেটে গিয়ে কন আবার স্বাভাবিক হল। কোটরা হরিণের আর ময়ুরের এই ডাক ভীতির ডাক নয়। ভয় পেয়ে বা বাঘ দেখে যখন ডাকে তারা তখন তাদের গলার স্বরে এক বিপন্নতা ফুটে ওঠে। সেই ডাক শুনতে পেলে খুশি হতাম আমি।
দেখতে দেখতে দ্রুত আলো কমে আসতে লাগল। এত কমল কী করে কে জানে! আমি বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুমিয়ে যে পড়েছিলাম তাতে কোনওই সন্দেহ নেই, নইলে ঝপ করে সন্ধে হয়ে যেত না।
আমার মন খুঁতখুঁত করছিল। নানা কারণে। প্রথমত ঋজুদা সঙ্গে নেই। দ্বিতীয়ত সারারাত জেগে বসে থাকার মতো অবস্থা আমার নেই। আমি অতিমানব নই–ঋজুদা বা জিম করবেট নই। তৃতীয়ত সারাদিন অভুক্ত আছি। চতুর্থত এই বাঘ, যা শুনেছি, আজ অবধি মড়িতে দ্বিতীয়বার আসেনি। সকালের যে সুবর্ণ সুযোগ নষ্ট করেছি আমরা তা হয়তো আর পাব না।
আমার মন বলছে আলো থাকতে থাকতে গাছ থেকে নেমে গ্রামে চলে যাই। তারপর কশিপুরে ফিরে ঠাণ্ডা জলে চান করে উঠে ভাল করে খেয়ে ঘুম লাগাই। আমার স্নায়ু ও শরীরের যা অবস্থা তাতে সারারাত এখানে একা থাকতে হলে বিপদ হয়ে যাবে আমার। ঋজুদা না থাকলেও রামচন্দ্র দণ্ডসেনা থাকলেও হত। অথচ আশ্চর্য। এর আগে তো আমি কম বনে মানুষখেকো বাঘের মোকাবিলা করিনি! আসল কথাটা হচ্ছে সঙ্গে অথবা হাতের কাছেই ঋজুদা ছিল। সেই ভরসাটা আজ নেই বলেই মন দুর্বল লাগছে। বুঝতে পাচ্ছি যে আমার ভয় ভয়ও করছে একটু।
ওরা বাঘডুম্বার কথা বলছিল। কালাহান্ডির জঙ্গলে যে সব মানুষ মানুষখেকো বাঘের হাতে মরে তারা মরার পরে এক রকমের ভূত হয়ে যায়। তাদের বলে বাঘডুম্বা। রাতে পাখির রূপ ধরে তারা রাতের বেলা গাছের মগডাল থেকে আচমকা ডেকে ওঠে কিরি-কিরি-কিরি-ধূপ-ধূপ-ধুপ-ধ্রুপ। আর সেই ডাক শুনেই কত মানুষে নাকি অক্কা পায়! আসলে নির্জন বনে জঙ্গলে পাহাড়ে নদীতে সমুদ্রে কত কী ঘটে, কত কী সত্যি বলে মনে হয় যা শহরের আলো ঝলমল পরিবেশে বসে কল্পনা পর্যন্ত করা যায় না। ভূতে আমিও বিশ্বাস করি না কিন্তু এই রাজয়াডু, রাম, শত্রু, দণ্ডসেনা এরা করে। কী করব ঠিক করতে পারছিলাম না। এখনও আলো আছে। নির্মেঘ পশ্চিমাকাশে আলো এখনও থাকবে প্রায় কুড়ি-পঁচিশ মিনিট। এখনও মাচা থেকে নেমে ধলাহান্ডি গ্রামে চলে যাবার সময় আছে নিরাপদে। কিন্তু অন্ধকার হয়ে গেলে কৃষ্ণপক্ষের রাতে একা এক হাতে টর্চ আর অন্য হাতে বন্দুক ধরে পাহাড় থেকে নেমে অতখানি পাথরে ভরা জঙ্গলাকীর্ণ পাহাড়তলি দিয়ে ধলাহান্ডিতে হেঁটে যাওয়া এই নৃশংস বাঘের জমিদারিতে আত্মহত্যার শামিল হবে।
কী করব তা ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ দেখলাম অন্ধকার হয়ে গেছে। স্নিগ্ধ সবুজ সন্ধ্যাতারাটা উজ্জ্বল পশ্চিমাকাশে নিঃশব্দে ফুটে উঠেছে। তারা ঠিকই ফুটেছে কিন্তু আমারই নিভু নিভু অবস্থা। সেই বনাঞ্জা বা টাইগার-মথ মোনো-ইঞ্জিন প্লেনের ইঞ্জিনের মতো বুউউউউঁইইই শব্দ করা নীল মাছিগুলো কখন যে অদৃশ্য হয়ে গেছে খেয়ালই করিনি।
প্রকৃতির মধ্যে কত রহস্যই যে থাকে। কত ফুল ফোটে প্রচণ্ড খরার পরে, রাতভর বৃষ্টির পরে রাতারাতি শুকনো গাছে গাছে লক্ষ লক্ষ গুঁড়ি গুঁড়ি সবুজ কিশলয় আসে। শীত পড়লে সাপ ব্যাং নানা পোকামাকড় কোথায় অদৃশ্য হয়ে যায় আবার বসন্ত শেষে সব ফিরে আসে একা একা। বর্ষাতে লক্ষ লক্ষ নীল জোনাকি জ্বলে আর নেভে, নেভে আর জ্বলে, দেওয়ালির সময়ে ছোট ছোট সবুজ শামাপোকা, তারপর সব মরে যায় পরের বছর তাদের পরের প্রজন্ম আবার ফিরে আসবে বলে।
ধ্রুবতারাটার দিকে তাকিয়ে রবীন্দ্রনাথের সেই গানটার কথা মনে পড়ে গেল। ছোটমাসিমা গানটা বড় ভাল গাইতেন। তিনি এখন নিজেই ধ্রুবতারাদের দেশে চলে গেছেন। ‘নিবিড় ঘন আঁধারে জ্বলিছে ধ্রুবতারা/মনরে মোর পাথারে হোসনে দিশাহারা ॥ বিষাদে হয়ে ম্রিয়মাণ বন্ধ না করিয়ো গান, সফল করি তোলে প্রাণ টুটিয়া মোহকারা॥‘
এখন ‘ঘোরান্ধকার’ যাকে বলে তাই। নিজের হাত নিজে দেখতে পাচ্ছি না। তেঁতুলগাছে বসে আরেক ভুল করেছি। ঝাঁকড়া গাছ বলে তার ছায়াও ঝাঁকড়া। তারাদের যে সামান্য আলো তার ছিটেফোঁটাও পৌঁছোচ্ছে না এখানে এসে। তবে সাদা পাথরগুলোই একমাত্র ভরসা। অন্ধকারে তাদের আভাস ফুটে আছে। মেয়েটি সেই পাথরগুলোর নীচে ঠিক কোথায় আছে তার একটা আন্দাজ করা আছে আমার। পাথরের চারদিকেই এত ঝরা পাতা এবং সমস্ত বনতল এমনই মুচমুচে হয়ে আছে যে বাঘের পক্ষে নিঃশব্দে আসা বড় সহজ হবে না যদিও বাঘ মাত্রই অসাধ্য সাধন করতে পারে।
গাছে ওঠার পর থেকেই শটগানের দু’ ব্যারেলেই এল. জি. ভরে নিয়েছিলাম। বন্দুকটাকে ডান উরুর উপরে শুইয়ে রেখেছি প্রয়োজনে বাঁ হাতে ব্যারেলের নীচের লক ধরে ডানহাতে স্মল অফ দ্য বাট ধরে বন্দুক তুলে স্কিট-শ্যটিং-এর মতো বন্দুকের মাছি দেখে নিশানা না নিয়েও গুলি করতে কয়েকমুহূর্ত লাগবে মাত্র। টর্চও লাগবে না। তবে গুলি করার পরক্ষণেই টর্চ জ্বালাতে হবে গুলির ফলাফল কী হল তা দেখার জন্য।
অন্ধকার এখন গভীর। ভাল বাংলায় যাকে বলে ঘোরা রজনি তাই। এমনই অন্ধকার যে নিজের হাত পাও দেখা যাচ্ছে না। এই অন্ধকার বন পাহাড়ের কিন্তু দারুণ এক ব্যক্তিত্ব আছে। পুরুষের ব্যক্তিত্বের মতো। চাঁদনি রাত হচ্ছে নারী আর অন্ধকার রাত পুরুষ।
আমার পিছনে অনেক দূরে এবং পাহাড়ের বেশ উঁচুতে শম্বর ডাকল ঢাংক ঢাংক করে। বাঘ কি আসছে? কে জানে। আমার পিছনে ঘন জঙ্গল। সেখানে দেখার কিছু নেই। শুধুই শোনার। আমিও এখন পুরোপুরি আমার শ্রবণের উপরেই নির্ভর করে আছি।
ডান পাশ থেকে দুরগুম দুরগুম করে বুকের মধ্যে চমকে দিয়ে একটা কালো পেঁচা ডেকে উঠল। বনতলের পাতার উপরে সড়সড় শিরশির করে শব্দ হল। হয়তো কোনও সাপ দৌড়ে যাচ্ছে বা ইঁদুর অথবা একাধিক ইঁদুর। সাপ হয়তো ইঁদুর ধরার চক্করে আছে আর প্যাঁচা খুঁজছে সাপ ধরার সুযোগ। প্রকৃতির মধ্যে প্রত্যেক প্রাণীই হয় খাদ্য নয় খাদক।
আমার ঘড়িটাতে রেডিয়াম নেই। আগামী জন্মদিনে ঋজুদা আমাকে টাইটান-এর একটা ইন্ডিগ্লো ঘড়ি দেবে বলেছে। বোতাম টিপলেই ঘড়ির ডায়ালে হালকা আলো জ্বলে ওঠে। বনেজঙ্গলে অমন ঘড়ি খুব কাজে লাগে, শহরেও কাজে লাগে রাতের বেলা অথবা সন্ধের পরে কোনও হলে অনুষ্ঠান শুনতে গিয়ে।
কতক্ষণ কেটে গেছে বুঝতে পারছি না। এখন আর খিদের বোধটা একেবারেই নেই। পিত্তি পড়ে গেছে। এমন সময়ে হঠাৎ কোনও জানোয়ারের পাহাড় থেকে নেমে আসার আওয়াজ শুনলাম। বেশ শব্দ করেই আসছিল সে রাখ-ঢাক না করে। একটু পরেই শব্দটা এসে সেই সাদা পাথরটার সামনে থেমে গেল এবং থেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ঘোঁৎ-ঘোঁৎ একটা বিতিকিচ্ছিরি আওয়াজ করে এক লাফ মেরে জানোয়ারটা খুব ভয় পেয়ে জোরে দৌড়ে শুকনো মাটিতে খটাখট করে ক্ষুরের আওয়াজ তুলে নীচের দিকে চলে গেল। ধলাহান্ডি গ্রামের দিকে গেল কিনা কে জানে। একটা মস্ত শুয়োর। নিশ্চয়ই বড় ও বাঁকানো দাঁত আছে তার। মূল খুঁড়ে খাবে সে। গ্রামের দিকে কেন গেল কে জানে। এখন তো কোনও ফসল নেই কোথাওই!
শুয়োরটা চলে যাবার পরই পাহাড়তিলতে তীব্র এক আলোর ঝলক দেখলাম। আকাশে তো মেঘ নেই। বিদ্যুৎ চমকাবার কোনও ব্যাপারই নেই। আলোটা কীসের? বৈদ্যুতিক আলোরই মতো তীব্র। বাদাতে যেমন আলেয়ার আলো দেখা যায় বিশেষ করে বর্ষাকালে এ তেমন আলো নয়। তারপর ভটকাই-এর গলা শুনলাম। ও কারও সঙ্গে কথা বলতে বলতে পাহাড়ে উঠে আসছে। ওর সঙ্গী একজন নয়, তিন-চারজন। ভটকাই-এর গলা ছাড়াও আরেকটা চেনা গলা কানে এল। এ যেন দণ্ডসেনার গলা বলে মনে হচ্ছে। সে কি ফিরে এসেছে ভবানী-পাটনা থেকে? কখন এল? আরেকটি গলাও চেনা চেনা লাগল। তারপরে আরও একজনের গলা। সম্ভবত রাম ও শত্রুঘর গলা। কী ব্যাপার কে জানে! এরা হঠাৎ শোভাযাত্রা করে আমার মানুষখেকো বাঘ মারার সব সম্ভাবনাকে বানচাল করার ষড়যন্ত্র কেন করল ঈশ্বরই জানেন।
এমন সময়ে ভটকাই গলা তুলে বলল, যেখানে আছিস সেখানেই থাক রুদ্র। আমরা পৌঁছেলে তারপর।
এদের হই হট্টগোলেই তো বাঘ যদিবা তল্লাটে থেকেও থাকে তবে সে ভেগে পড়বে মনে হল। তারপরই মনে হল এই বাঘও তো সুন্দরবনের বাঘেদেরই মতো। মানুষের গলার স্বরে আকৃষ্ট হয়ে এরা এগিয়েই আসে, পালিয়ে যায় না।
ওরা যখন হল্লাগুল্লা করে পাহাড়ে উঠেই আসছে তখন আমার আর লুকিয়ে থাকার মানে হয় না। আমি টর্চটা বের করে জ্বেলে আলোটা বৃত্তাকারে ঘোরালাম। কিন্তু সাবধানতার মার নেই ভেবে গাছ থেকে তখনও নামলাম না। আমার আলো ফেলাতে ওদের আমার দিকে আসতে সুবিধে হল। দেখতে দেখতে ওরা এসে পড়ল সাদা পাথরগুলোর ওপাশে এবং তারপরই এ পাশে এসে গেল। ভটকাই-এর টর্চের আলো পড়ল মেয়েটির গায়ে, মুখে। আমি পরিষ্কার দেখলাম মেয়েটির মুখের সেই আতঙ্কর ভাবটি নেই, সে যেন হাসছে। জানি না, আমার দেখার ভুলও হতে পারে। দন্ডসেনা ভটকাইকে বলল আলোটা ঘুরিয়ে চারদিকে ভাল করে দেখে নিতে। ভটকাই আলো ফেলতে ফেলতে আমি দন্ডসেনাকে বন্দুকটা ধরতে বলে, কিছুটা নেমে এসে বন্দুকটার কুঁদোটা ওর দিকে এগিয়ে দিলাম। দন্ডসেনার নিজের বন্দুক ছিল ডানহাতে ধরা, সে বাঁ হাত দিয়ে আমার বন্দুকটা ধরল। আমি গাছ থেকে নেমে এলাম।
দন্ডসেনা বলল, আপনি মিছিমিছি কষ্ট করলেন। এই বাঘ এ পর্যন্ত কখনও দু’বার ফিরে আসেনি মড়িতে। সকালে আপনারা যে সুযোগ পেয়েছিলেন তা ছিল সুবর্ণ সুযোগ। তা হারাবার পর আবার কবে দ্বিতীয় সুযোগ পাওয়া যাবে তার ঠিক নেই। এই বাঘকে মাচায় বসে মারা যাবে বলে মনে হয় না। চলুন কাল থেকে আমরা জিপ নিয়ে গ্রাম ও জঙ্গলের পথে পথে সারারাত ঘুরে বেড়াই। বাঘের সঙ্গে দেখা হলেও হয়ে যেতে পারে। সে দূরে থাকলেও, তার চোখ আগুনের ভাটার মতো লাল হয়ে জ্বলবে জিপের হেডলাইট বা স্পটলাইটে এবং যত দূরেই থাকুক আপনাদের কাছে রকমারি রাইফেল আছে তা দিয়ে দূর থেকেও তাকে ধরাশায়ী করতে অসুবিধে হবে না।
তুমি কখন এলে?
আমি বললাম।
এই তো। সন্ধের অনেক আগেই। বাসও তো চলে না আজকাল সন্ধের পরে। কশিপুরে নেমেই তো বাংলোতে গেলাম। গিয়ে সব শুনলাম।
ঋজুদা কেমন আছে?
তাঁর ভারী জ্বর। সে জন্যও আপনাদের তাঁর কাছে থাকা দরকার। চৌকিদার আর ননা কি সেবা করতে পারে? জ্বরে গা একেবারে পুড়ে যাচ্ছে। তাই ঋজুবাবুকে বলে আমার বন্দুকটা কাঁধে ফেলে চৌকিদারের সাইকেলটা নিয়ে পাঁই পাঁই করে চালিয়ে ধলাহান্ডি গ্রামে চলে এলাম। বাঘ যে আসবে না সে সম্বন্ধে আমি একশোভাগ নিশ্চিত। তাই ভটকেবাবুকে আর এদেরও নিয়ে চলে এলাম। ভটকেবাবুর রাইফেল এবং আমার বন্দুক এবং এত ভাল পাঁচ ব্যাটারির টর্চ থাকতে আর চিন্তা কী ছিল!
একটু থেমে বলল, যারে রাম। লুগা তো আনিলু। দাহ করিবা পাঁই তম ওয়াইফের দেহটা নেইকি আসস। যারে শত্রুঘ্ন, চঞ্চল করিবা হেব্ব।
দন্ডসেনা চৌকিদারের সাইকেল নিয়ে এসেছিল। কশিপুর থেকে ধলাহান্ডি। সেই সাইকেলটাকে জিপের পিছনে তুলে নিয়ে আমি আর ভটকাই সামনে বসলাম রাজয়াতুর পাশে আর দন্ডসেনা স্পটলাইটটা বনেটে তুলে ব্যাটারির সঙ্গে ক্ল্যাম্প দিয়ে লাগিয়ে পিছনে দাঁড়িয়ে স্পটলাইটটা ফেলতে ফেলতে যাবে বলল। ভটকাইকে বললাম, আমিও পিছনে দাঁড়াই রড ধরে। সেই সকাল থেকে বসে বসে কোমরে ব্যথা হয়ে গেছে। তুই আরাম করে বোস সামনে।
ভটকাই বলল, তা তো হল। কিন্তু ঋজুদা জানলে খুব রাগ করবে। তুই তো আমার থেকেও ভাল জানিস। জিপ থেকে স্পটলাইট ফেলে শিকার করা শিকারিরাই আজ সারা ভারতবর্ষের বন-পাহাড়কে বন্যপ্রাণীশূন্য করে দিয়েছে।
আমি বললাম, আমরা তো কখনওই এমন করে করিনি শিকার। দু-তিনদিন অন্তর অন্তর মানুষ ধরছে, দেখলি না, ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের চাকরি নিয়ে পর্যন্ত টানাটানি–এই বাঘকে এমনভাবে মারাটা দোষের বলবে মনে হয় না ঋজুদা। তা ছাড়া আমাদের দিনও তো ফুরিয়ে এল। এরই মধ্যে আমাদের এই বাঘকে মারতে হবে, বাই হুক অর বাই কুক। এখানে কোনও চয়েজের ব্যাপার নেই।
তা ঠিক। ভটকাই বলল, নাথিং ইজ আনফেয়ার ইন লাভ অ্যান্ড ওয়ার।
খুবই আস্তে জিপ চালাচ্ছিল রাজয়ডু। যাতে দস্তসেনার আলোতে দু’ পথের দু’ পাশ ভাল করে দেখা যায়। আলোটা একবার ডাইনে আরেকবার বাঁয়ে পড়ছে আর তারই সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মুণ্ডুও ঘুরছে ডাইনে বাঁয়ে। ছ মাইল তো পথ। সেই পথ পেরোতেই আমাদের আধঘণ্টা লাগল। এক ঝাঁক চিতল হরিণ, একটা মস্ত ভাল্লুক, একটা শিয়াল এবং একটা ধাড়ি খরগোশ পড়ল পথে। খরগোশটাই প্রথমে পড়েছিল। রাজয়াড় বিড়বিড় করে বলেছিল–সে বাঘ্ব আউ দিশিবি নাই রাম্ব ভাই, ঈ খরাটা ভেটিল অর্ঘ্যেরে কন হে।
আমরা যখন কশিপুর বাংলোর কাছে চলে এসেছি, বাংলোটা দেখা যাচ্ছে তখন ভটকাইচন্দ্র বলল, ঈ রে। তোর জন্য খাবার নিয়ে এসেছিলাম যে। একেবারে ভুল হয়ে গেছে।
আমি বললাম, নতুন আর কী। নিজেরটা ছাড়া আর কিছুই তো বুঝলি না কোনওদিন। ভুলে গেছিস ভাল হয়েছে। বাংলোতে ফিরে ঋজুদাকে দেখে ভাল করে চান করে তারপরে খাওয়ার কথা ভাবা যাবে।
তারপর বললাম, তুমি খেয়েছ রামভাই?
দন্ডসেনার পুরো নাম রামচন্দ্র দন্ডসেনা।
দন্ডসেনা বলল, আমি জেপুরের হোটেলে ভাল করে খেয়ে নিয়েছি, বাস যখন দাঁড়িয়েছিল। ভবানী-পাটনা থেকে নাস্তা করেই বেরিয়েছিলাম। বিয়ে বাড়ি খাইবা-পীবাকি অভাব সেটি কন? রাত্বির খাইবি।
দন্ডসেনা আমাদের সঙ্গেই আছে। তাতে রাজয়াড়ু, ননা আর চৌকিদারের বুকে একটু বলও হয়েছে। যদিও বাঘ আজ অবধি কোনও বনবাংলো বা পি-ডডি বাংলো থেকে কোনও মানুষ নেয়নি। ভয় নেই কিন্তু ভরসাই বা কোথায়। প্রচণ্ড গরমের জন্য আমরা রাতে অনেকক্ষণ বারান্দায় বসে থাকি যখন বাঘের পিছনে না যাই কিন্তু সবসময়েই হাতের কাছে গুলিভরা বন্দুক এবং রাইফেল থাকে, থাকে টর্চও। তবে বাঘ বাংলোতে এসে আত্মহত্যা করে আমাদের হিরো বানাবে এমন ঘটবে বলে মনে হয় না। তা ছাড়া, চিরদিনই এইসব জংলি জায়গার বনবাংলো এবং পি-ডব্লু-ডি-র বাংলোতে শিকারিরা থেকেছেন বলেই হয়তো বাঘেদের স্পেশাল ব্রাঞ্চ-এর রিপোর্টে এইসব বাংলো ‘আউট অফ বাউন্ডস’ বলে চিহ্নিত আছে।
ঋজুদার ঘরে ঢুকে দেখলাম ঋজুদা ঘুমোচ্ছ। জিপের আওয়াজে এবং আমাদের কথাবার্তাতেও ঘুম যখন ভাঙেনি তখন আমরা আর ঘুম ভাঙালাম না। মনটা খারাপ হয়ে গেল। আমি আর ভটকাই বলাবলি করছিলাম যে এ পর্যন্ত কখনওই এমন হয়নি যে বাইরে কোথাও এসে ঋজুদা অসুস্থ হয়ে পড়েছে। যদি বাড়াবাড়ি কিছু হয় এই মানুষখেকো বাঘের দেশে তো তাকে ফেলে রাখা যাবে না। জেপুর থেকে বা রায়গড়া থেকে কোনও ডাক্তারও হয়তো আসতে চাইবেন না। না হলে বন্দুক রাইফেল দেখিয়ে পাকড়াও করেই আনতে হবে অগত্যা।
দেখা যাক কী হয়!
.
০৭.
ঋজুদা রাতে কিছুই খেতে চাইল না। ননা রান্না ভাল করে কিন্তু সুপ-টুপ বানাতে জানে না। সুপের প্যাকেট আনলে হত কলকাতা থেকে কিন্তু কে জানত যে ঋজুদা এমন কেলো করবে। পেটের কোনও গণ্ডগোল নেই। তাই আমরা যুক্তি করে ঋজুদাকে মুসুরির ডালের পাতলা খিচুড়ি খাইয়ে ক্রোসিন খাইয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়তে বললাম। কলকাতাতে জ্বর হলেও ঋজুদাকে কখনও এমন কাহিল দেখিনি। আমাদের সঙ্গে জ্বরের মধ্যেও স্বাভাবিকভাবে কথাবার্তা বলেছে, রসিকতা করেছে কিন্তু এখানে জ্বরের অন্য রূপ।
আবার ঘুমোবার আগে ঋজুদা বলল, তাড়াতাড়ি শুয়ে পড় তোরা, সারাদিন ধকল গেছে। ভাল করে খা।
ভটকাই বলল, ঠিক আছে। তুমি তাড়াতাড়ি ভাল হয়ে যাও। আর সবই ঠিকই চলবে।
ঋজুদার ঘরের লণ্ঠনের ফিতেটা কমিয়ে দিয়ে দরজাটা ভেজিয়ে দিলাম। রাতে আমি শোব ঋজুদার সঙ্গে। আসার পরে আমি আর ভটকাই দু’জনেই ঋজুদার মাথা পা টিপে দিয়েছি। ঋজুদাও ঋজুদার জেঠুমনিরই মতো জ্বর হলেই ঘোরের মধ্যে বলে, সবচেয়ে আগে চরিত্র। তারপরে পড়াশুনো। তারপর খেলাধুলো। এই চরিত্র শব্দটার উপরে খুব জোর দেয়। চরিত্র বলতে আমরা সাধারণভাবে যা বুঝি এ চরিত্র তা নয়। আরও অন্য অনেককিছু যেন এই চরিত্রের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে। আজকাল ঋজুদা প্রায়ই মির সাহেবের একটি শায়েরি বলে নিজের মনেই: ‘হিয়া সুরত এ আদম বহত হ্যায়, আদম নেহি হ্যায়’। মানে, এখানে মানুষের চেহারার জীব অনেক আছে মানুষই নেই। রবীন্দ্রনাথের ‘পূর্ণ মানুষের কথাও প্রায়ই বলে। আমাদের জ্ঞান দেবার জন্য কিন্তু বলে না, নিজের সঙ্গেই নিজে যেন কথা বলে। এই পূর্ণ মনুষ্যত্বর সঙ্গে ‘আদম’-এর, মানুষের চরিত্রর কোথায় যেন একটা যোগাযোগ আছে, আবছা আবছা বুঝতে পাই কিন্তু পুরোটা বুঝি না। সবই যদি বুঝতাম তবে আর আমাদের সঙ্গে ঋজুদার তফাত কী থাকত!
ঋজুদার ঘরের দরজা ভেজিয়ে দিয়ে বারান্দার একটি থামের একপাশে একটি লণ্ঠন রেখে দিলাম। এমনভাবে, যাতে আলো আমাদের চোখে না লাগে, চোখে লাগলে চোখ বেঁধে যাবে, বাইরে দেখতে পারব না, তাই। আর নিজের হাতিয়ার হাতের কাছে রেখে আমাদের ঘরের সামনের ইজিচেয়ারে বসে ছিলাম আমি আর ভটকাই। রান্নাঘর থেকে নো, রাজয়াড়ু, দন্ডসেনা আর চৌকিদারের পুটুর পুটুর কথা শোনা যাচ্ছে। ওরা গল্প করছে খেতে খেতে। রান্নাঘরের দরজাটাও ওরা ভেজিয়ে রেখেছে। সন্ধের পরে কেউই আর দরজা খোলা রাখে না এই আগুনে এই অসহ্য গরমেও। বাইরেও শোওয়ার সাহস নেই কারওই।
কশিপুর জায়গাটা ছোট। কয়েকঘর মানুষের বাস ওই গ্রামে। জানি না, এখন হয়তো পপুলেশন এক্সপ্লোশনে সে জায়গাতেও বিরাট জনবসতি গড়ে উঠেছে। যখনকার কথা বলছি তখন তাই-ই ছিল।
ভটকাই বলল, বাঘটা মারতে পারলে কেমন হত বল তো?
মেরে তো দিতামই। তুই একটা রিয়্যাল উজবুক হচ্ছিস দিনকে দিন। বাঘ শিকারে গিয়ে, তাও আবার মানুষখেকো বাঘ শিকারে গিয়ে কেউ কথা বলে! তোর গলা না শুনলে বাঘকে দেখে আমরা যতখানি হতভম্ব হয়েছিলাম সেও আমাদের দেখে ঠিক ততখানি হতভম্ব হত আর সেই কয়েক সেকেন্ড সময় পেলেই তাকে ধড়কে দিতাম।
আমি বললাম।
বাজে কথা বলিস না। মাটিতে দাঁড়িয়ে সামনে অত কাছে বাঘ দেখলে আমার পেটের মধ্যে গুড়গুড় করে, মেরুদণ্ড বেয়ে শিরশির করে একটা ঠাণ্ডা সাপ নামতে থাকে। তার উপরে মানুষখেকো বাঘ।
ভটকাই বলল, অপরাধীর মতো।
তাহলে আর মানুষখেকো বাঘ মারতে আসা কেন?
আমি তাচ্ছিল্যর সঙ্গে বললাম, এমনইভাবে, যেন আমার ভয়-টয় করে না।
যাই বলিস, বাঘটা মারতে পারলে এতক্ষণে এই বাংলোর চেহারাটা কেমন হত বল তো। হ্যাঁজাকের আলোতে আলো হয়ে যেত পুরো চত্বর। দূর দূর গ্রাম থেকে মেয়ে পুরুষ শিশু দলবেঁধে আসত আমাদের দেখতে। জেপুর আর ভবানী-পাটনা থেকেও অনেকে আসতেন জিপে, ট্রাকে, বাসে, ট্রেকারে করে। সারারাত গান হত। পানমৌরি আর সলস্ব-রস খেয়ে নাচত ওরা। এবং বহুদিন পরে নির্ভয়ে আজ রাতে দরজা খুলে, বাইরে চৌপাইতে, গাছতলাতে উঠোনে শুত গ্রামবাসীরা গরমের হাত থেকে বাঁচতে। ভাবতেই আমার কীরকম রোমাঞ্চ হচ্ছে।
বাইরেটা নিকষ কালো অন্ধকার। থম মেরে আছে প্রকৃতি। ঝড়ের আগে যেমন হয়। আকাশে তারাগুলো ঝকঝক করছিল। এমন অন্ধকার রাতে আমরা বনবাংলোর বারান্দাতে বসে তারা চিনি, চেনাই একে অন্যকে। ঋজুদাই এই তারা চেনার খেলা খেলতে শিখিয়েছে আমাদের। কালপুরুষ, কোমরে তরোয়াল নিয়ে দাঁড়িয়ে। আরও কত তারামণ্ডল, ক্লাসটারস, আর কী সুন্দর সুন্দর নাম তারাদের। স্বাতী, শতভিষা, অঙ্গিরা, ক্রতু, পুলহ, আরও কত নাম।
তারাগুলো কোথায় গেল বল তো?
ভটকাইকে শুধোলাম আমি।
তাই তো ভাবছি। আকাশটা এতই অন্ধকার যে মেঘ করেছে কি না তাও বোঝা যাচ্ছে না।
মেঘই করেছে। নইলে তারাগুলো হারাবে কী করে।
ভটকাই দাঁড়িয়ে উঠে বারান্দার কোনাতে দাঁড়িয়ে উপরে তাকিয়ে ভাল করে আকাশে নিরীক্ষণ করার চেষ্টা করল। করে বলল, নাঃ, মেঘই করেছে। দারুণ মেঘ। আজ বৃষ্টি হবেই।
আমি বললাম, বাঁচা যাবে। কিন্তু মেঘ জমলটা কখন। বিকেল অবধি তো একটুও মেঘ ছিল না আকাশে।
না, তা ছিল না!
ভটকাই বলল। তারপর পাকা বুড়োর মতো বলল, সবই প্রকৃতির লীলাখেলা!
রান্নাঘর থেকে একটা ধাতব শব্দ হল। কোনও হাঁড়ি বা কড়াই জোরে সিমেন্টের বাঁধানো মেঝেতে রাখলে যেমন হয়। সেই শব্দটা মিলিয়ে যাবার আগেই বাংলোর সামনের কাঁচা পথে একটা নারীকণ্ঠ শোনা গেল। কে যেন গান গাইতে গাইতে আসছে।
আমি আর ভটকাই অবাক হয়ে সেদিকে উৎকর্ণ হয়ে চেয়ে রইলাম। গা ছমছম করে উঠল আমার। যে অঞ্চলে সূর্য ডোবার পরে প্রচণ্ড সাহসী ও শক্তিশালী পুরুষ মায় বন্দুকধারীও দরজা খুলে ঘরের বাইরে আসতে ভয় পায় সেখানে কে এই একলা নারী ঘোরান্ধকার পথে গান গাইতে গাইতে আসছে? গানটা পথের বাঁদিক থেকে আসছে। ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছে আখরগুলো। মেয়েটি চিকন গলাতে সুন্দর সুরে গাইছে
‘মত্বে দয়া করো প্রভু, তমে, দয়া করো মত্বে
এ নরকেরে আউ রহি হেব্বনি।
আউ কিছি চাহিবুনি মু, তম্বে দয়া করো,
টানি নেই যাও মত্বে তম পাদে।’
গানটি ধীরে ধীরে জোর হতে লাগল। সেই জমাট বাঁধা অন্ধকারে, জমাট বাঁধা নৈঃশব্দ্যকে মথিত করে তার পায়ে পায়ে আমাদের এত মানুষের সব ভয়কে তাচ্ছিল্য করে মাড়িয়ে সে এগিয়ে আসছিল অন্ধকারের দেয়াল কুঁড়ে কোনও প্রেতিনীর মতো। পরিষ্কার উচ্চারণে সমর্পণের গান গাইতে গাইতে। ‘আমাকে দয়া করো প্রভু, তুমি আমাকে দয়া করো। এই নরকে আর থাকতে পারি না। আর কিছু চাইব না আমি শুধু দয়া করে তুমি আমাকে টেনে নাও তোমার পায়ে।’
রান্নাঘরের দরজা খুলে ওরা সকলে ততক্ষণে বাইরে এসেছে। ননার হাতে লণ্ঠন, দন্ডসেনার হাতে বন্দুক, লুঙ্গি-পরা রাজয়াডুর হাতে উনুন থেকে টেনে বের করা একটা জ্বলন্ত চেলা কাঠ। তা থেকে রংমশালের মতো নানারকম আগুনের ফুলকি বেরোচ্ছে। কিন্তু ওইসব আলো রাতকে আলোকিত না করে অন্ধকারকে আরও গাঢ় করে তুলেছে।
ননা আতঙ্কিত গলায় বলল, বাঘডুম্বা কী? সেটা কন?
দন্ডসেনা তাকে গাল পেড়ে বলল, তু গুট্টে বেধুয়াটা। সে ঝিও বাইয়ানিটা। আসিলা এ রাত্বিরে মরিবাকু। রাত্বিরে এত্বে পথ চালিকি কেমিতি আসিলা সে ঝিও। বাপ্পালো বাপ্পা! বাঘটা খাইলানি তাংকু? ভয় ডর বলিকী কীছি নাহি কি? সে ঝিও নাই স্ব সে সাক্ষাৎ মা ভবানী।
মানে, তুই একটা যাচ্ছেতাই। এ সেই পাগলি মেয়েটা। মরবার জন্য এসেছে রে। এই রাতে এতখানি পথ এলই বা কী করে ওই মেয়ে। বাঘে তাকে খেল না? ভয়ডর বলে কি কিছু নেই? এ মেয়ে, মেয়ে নয়, এ সাক্ষাৎ মা ভবানী!
তার গান ক্রমশই জোর হচ্ছে। এসে পৌঁছেছে সে বাংলোর গেটের কাছে। গেটের দু-দিকে দুটি পিলারই আছে, গেট নেই। পাঁচিলও নেই, শুধু ছেঁড়াখোঁড়া কাঁটাতারের বেড়া তাতে শিয়ারি আর মুতুরি লতা লতিয়ে ছিল, এখন গ্রীষ্মের তীব্রতায় প্রায় শুকিয়ে গেছে।
মেয়েটির গান শুনে ঋজুদাও দেখি বিছানা ছেড়ে উঠে ভেজানো দরজাটা ঠেলে বারান্দাতে এসে ইজিচেয়ারে বসল।
কেমন লাগছে ঋজুদা?
ভাল ভাল। কিন্তু ব্যাপারটা কী? দন্ডসেনাকে ডাক তো।
দন্ডসেনাকে ডাকল ভটকাই।
দন্ডসেনা বারান্দাতে এসে বলল, এ একটা পাগলি। আঠারো উনিশ বছর বয়স হবে। এর মা-বাবা কেউ নেই। পথপাশের চায়ের দোকানে একে দেখেও থাকবেন আপনারা। চায়ের দোকানে চায়ের কাপ-ডিশ ধুয়ে দেয়, উনুন ধরিয়ে দেয়, খদ্দেরকে চা-বিস্কুট-বিড়ি-দেশলাই এগিয়ে দেয় আর তার বদলে বুড়ো দোকানি তাকে দু-বেলা খেতে দেয়, সকাল বিকেলে চা-বিস্কুটও দেয়। হলে কী হয়। সবাই কি আর বুড়োর মতো দয়ালু বাবু! যৌবন যে ভিখারিকে ক্ষমা করে না। যৌবন পরম বিপদ হয়ে আসেই। এই জায়গা ছোট হলে কী হয় বড় জায়গারই মতো এখানেও খারাপ লোক তো আছেই। বুড়ো দোকান সামলাবে না ওকে সামলাবে। তার উপর পাগলি। কখন কোথায় কার সঙ্গে চলে যায়। দু-তিনদিন পরে ফিরে আসে বিধ্বস্ত হয়ে। ওর বড় কষ্ট ঋজুবাবু। ওকে বাঘে খেলেই ও বেঁচে যেত অথচ দেখুন একা একা হেঁটে এল বাঘ তাকে ছুঁল না। এই বাইয়ানি যমেরও অরুচি।
বাইয়ানি কী ঋজুদা?
ভটকাই জিজ্ঞেস করল।
ঋজুদা বলল, পাগলিকে ওড়িয়াতে বাইয়ানি বলে।
ও। কিন্তু এখন কী হবে?
কী করা যাবে দন্ডসেনা?
ঋজুদা ভটকাই-এর প্রশ্নটাকেই দন্ডসেনার দিকে গড়িয়ে দিল।
তাই তো ভাবছি।
রাতটা ওকে তোমাদের সঙ্গে রেখে দাও।
পাগল বাবু আপনি! চারজন পুরুষ মানুষের সঙ্গে এক ঘরে রাত কাটালে ওর আরও বদনাম হবে।
যার নামই নেই তার আবার বদনাম কী? তা ছাড়া, ওকে তো আর আমরা উপস্থিত থাকতে বাঘ দিয়ে খাওয়ানো যায় না। লোকে বলবে কী? তোমরা যদি ওকে না রাখতে চাও রাতের মতো তবে ও রুদ্রবাবুদের সঙ্গেই থাকবে।
আমি আর ভটকাই চমকে উঠলাম ঋজুদার কথা শুনে। ভাষা জানি না তার উপরে পাগলি, খুব নোংরাও নিশ্চয়ই। আমি দিদির সঙ্গেই এক ঘরে শুতে পারিনি কোনওদিন, এই অজানা অচেনা মেয়ের সঙ্গে শোওয়া অসম্ভব।
ভটকাই দেখলাম আমার চেয়েও নাভাস। সে তুতলে বলল, তার চেয়ে সে-ই ঘরে থাকুক, আমি আর রুদ্র বারান্দায় বসে গল্প করেই রাতটা কাটিয়ে দেব।
দন্ডসেনা বলল, আধ মাইল তো পথ। ও আসুক, ওকে কিছু খাইয়ে-দাইয়ে জিপে করে ওকে নিয়ে গিয়ে মেঘনাদের বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসছি। জিপে করে গেলে এবং রুদ্রবাবুরা সঙ্গে থাকলে ও আপত্তি করবে না। আমাদের কথা শুনবে।
মেঘনাদটা কে?
মেঘনাদ ওর জ্যাঠা।
সে কী? ওর আপন জ্যাঠা?
আইজ্ঞা।
আপন জ্যাঠা থাকতে মেয়েটার এই অবস্থা! সে কী মানুষ না জানোয়ার?
মানুষ-জানোয়ার বাবু। তারা মানুষখেকো বাঘের চেয়েও অনেক খারাপ।
তারপরে দন্ডসেনা বলল, আর আপনি যদি অনুমতি করেন তবে জিপে স্পটলাইট লাগিয়ে নিয়ে ঘণ্টা দুয়েক ধলাহান্ডি আর কশিপুরের পথে আপ-ডাউন করি আমরা। যদি বাইচান্স বাঘের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়, বাঘ যখন সকালেও এ তল্লাটেই ছিল। একটা বাঘের পক্ষে তো এক রাতে পনেরো কুড়ি মাইলের চক্কর মারাটা কিছুই নয় আর আমরা তো মাত্র ছ-সাত মাইলই যাওয়া-আসা করব।
ঋজুদা কী ভাবল একটুক্ষণ। তারপর বলল, ঠিক আছে। তবে রাত দু’টো অবধি ঘুরে ফিরে এসো।
আমি বললাম, তুমি একা থাকবে? জ্বর যদি আবার বাড়ে? তার চেয়ে রাজয়াডুকে রেখে যাই। ও স্মার্ট আছে। ও তোমার দেখাশোনা করবে। বন্দুকও চালাতে পারে। আমার বন্দুকটা ওকে দিয়ে যাব।
ঋজুদা কী ভেবে বলল, ঠিক আছে।
বাইয়ানির নাম নেই। হয়তো ছিল কখনও। সেই নামে ওকে আর কেউই ডাকে না। কী নিষ্ঠুর পৃথিবী।
ওই লোকটা, মেঘনাদ না কী নাম বললে, তার অবস্থা কেমন?
অবস্থা আর কেমন বাবু? এখানে কোটিপতি তো আর নেই কেউ। তবে দু’ বেলার অন্ন জুটে যায়। একটা স্কুটারও কিনেছে। এখানের মাপে বড়লোকই বলা চলে। ধান চালের কারবারি।
ওকে ভয়ও দেখিয়ো। মানুষ যদি অমানুষ হয় তাহলে তাকে ঢিট করতে হয় কী করে, তা আমার জানা আছে। তুমি বলবে মেয়েটাকে সে যদি না দেখাশোনা করে, তার ভার না নেয় তবে ডি এম আর এস-পি-কে আমি বলে যাব।
হঁ আইজ্ঞাঁ।
রামচন্দ্র দন্ডসেনা বলল।
যাকে নিয়ে এত আলোচনা সে ওই কটি পংক্তিই সুরেলা গলাতে গাইতে গাইতে সোজা পথ ধরে ধলাহান্ডির দিকে চলে যাচ্ছিল বাংলো অতিক্রম করে। দন্ডসেনা আর রাজয়াড়ু গিয়ে তার পথরোধ করে তাকে বাংলোর মধ্যে নিয়ে এল। ননা তাকে জিজ্ঞেস করল খাইবা-পিবা হেম্বা কি?
বাইয়ানি গান থামিয়ে হেসে বলল, হইগ্বেলে। কালি রাত্বির।
দন্ডসেনা ননাকে বলল, খাবার তো বেঁচেছে নো, ভাল করে খাওয়াও ওকে।
ইতিমধ্যে বাইয়ানি বারান্দায় বসে থাকা আমাদের দিকে এগিয়ে এসে বলল, নমস্কার আইজ্ঞাঁ।
ভটকাই তার হাতে-ধরা টর্চটার বোম টিপে বাইয়ানির মুখে ফেলতেই আমি চমকে উঠলাম। এ যে সেই বাঘে-খাওয়া রামের বউ-এর মুখ। হুবহু। মুখে ঠিক সেইরকম হাসি। গা ছমছম করে উঠল আমার।
সম্বিৎ ভাঙল ঋজুদার ধমকে। ঋজুদা ধমক দিল ভটকাইকে, কী অসভ্যতা করছিস। এ গরিব, অসহায়, পাগলি বলে কি যা নয় তাই করবি।
ঋজুদা জ্বরে তো কষ্ট পাচ্ছিলই। ভটকাই-এর অসভ্যতায় যেন আরও কষ্ট পেল।
এরকম হয় দেখেছি। ঋজুদার বুকে আমাদের দেশের সাধারণ গরিব অসহায় মানুষদের জন্য যে বোধ আছে, যার প্রমাণ আমি আর তিতির বহু বহুবার পেয়েছি, তা যদি আরও অনেকের বুকে থাকত তবে দেশের মানুষের অনেকই উপকার হত।
বারান্দার সিঁড়ির সামনে এসে দাঁড়াল সে যখন তখন লণ্ঠনের আলোতে দেখলাম যে বাইয়ানির পরনে একটা রং চটে-যাওয়া লাল আর সবুজ হাতি ছাপের সম্বলপুরি সিল্কের শাড়ি। দু-একটা জায়গাতে ভেঁড়াও। কারও ফেলে-দেওয়া শাড়ি হবে। তবে শুধুই শাড়ি। পরনে আর কিছুই নেই। মুখ চোখ কাটা কাটা। কোমর-ছাপানো চুল কিন্তু অযত্নে জট পড়ে গেছে। আর হাসিটা–কী আশ্চর্য! আমার তখনও গা ছমছম করছিল।
ওরা বাইয়ানিকে খাওয়াতে নিয়ে গেল রান্নাঘরে। বাইয়ানি আসাতে কিছুক্ষণের জন্য বাঘ আমাদের মাথা থেকে চলে গেল। ও খিলখিল করে হাসে। হাসতে হাসতে খাচ্ছিল ও আমরা খোলা দরজা দিয়ে দেখতে পাচ্ছিলাম। একটু আগে কাঁদতে কাঁদতে গাইছিল। আশ্চর্য মেয়ে। কিন্তু মুখটা আর হাসিটা। এত মিল হয় কী করে কে জানে। এইসব জঙ্গল পাহাড়ে কত কী গোলমেলে ব্যাপারই না ঘটে। সেইসব জট খোলা হয়তো বাইয়ানির জট-পড়া চুল খোলার চেয়েও কঠিন।
আধঘণ্টাটাক পরে বেরোলাম আমরা। যেমন ঠিক হয়েছিল, রাজয়াডুকে ঋজুদার কাছে রেখেই গেলাম, আমার বন্দুকটা দিয়ে। আমি স্টিয়ারিং-এ বসলাম। আমার পাশে বাইয়ানি। ওর গায়ে কিন্তু কোনও দুর্গন্ধ ছিল না। আমার নাক কুকুরের নাক। আমার মা বলেন ঠাট্টা করে গন্ধগোকুল। আমার নাকও যখন পেল না তখন দুর্গন্ধ সত্যিই নেই অথচ ও কত অযত্নে অবহেলাতে থাকে।
পিছনে ভটকাই ঋজুদার ফোরফিফটি-ফোরহানড্রেড রাইফেল নিয়ে দাঁড়াল রড ধরে আর দন্ডসেনা তার বন্দুকটার কুঁদোটাকে দু’পায়ের পাতার উপরে রেখে নলটাকে দু উরু দিয়ে চেপে রইল। জিপ তো পাঁচ মাইল স্পিডে চালাব। ওর বন্দুক স্থানচ্যুত হবার সম্ভাবনা নেই।
প্রথমে বাইয়ানিকে নামাতে যাব। তারপর ওকে ওর জ্যাঠামশায়ের বাড়ি নামিয়ে আমরা ধলাহান্ডির দিকে যাব এমনই ঠিক করলাম আমি আর দন্ডসেনা। বাঘের সঙ্গে দেখা হওয়ার সম্ভাবনা নেই-ই বলতে গেলে। অত সহজে জিপ থেকে এই বাঘ মারা গেলে জল এতদূর গড়াবার আগে বাঘ একশোবার মরে যেত। তবে শিকারে কোনও কিছুরই স্থিরতা নেই। যেখানে প্রত্যাশা একেবারেই নেই সেখানেই সকলকে বোকা বানিয়ে বাঘ এসে উপস্থিত হয়েছে, এরকম বহুবারই হয়েছে। বাঘ যদি বেরোয় তবে ঋজুদা নয়, আমি নই, কালাহান্ডির অরাটাকিরির এই কুখ্যাত বাঘ মারা যাবে দ্য গ্রেট শিকারি মিস্টার ভটকাই-এর হাতে। সবই কপালের লিখন!
বাংলো থেকে বেরোতে না বেরোতে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল। কোনও তর্জন-গর্জন নেই, বিদ্যুৎ-চমকানি নেই, বৃষ্টির আগে সচরাচর যে একটা হাওয়া বয় তাও নেই আকাশ যেন হঠাৎ বিনা নোটিশে উপুড় হল আমাদের মাথার উপরে। দু মিনিটের মধ্যে ভিজে চুপচুপে হয়ে গেলাম কিন্তু জিপ ঘুরিয়ে বাংলোতে ফিরলাম না। এই অলৌকিক বৃষ্টি হয়তো অলৌকিক কোনও ঘটনা ঘটাবে। পাঁচশো গজও যাইনি এমন সময়ে স্পটলাইটের তারটা ব্যাটারি থেকে খুলে গেল। ক্ল্যাম্পটা বোধহয় ঠিকমতো লাগানো হয়নি। হুডখোলা জিপটা ফুটো হওয়া নৌকো যেমন জলে ভরে যায় তেমনই ভরে উঠল জলে। এত জোরে বৃষ্টি হচ্ছে যে উইন্ডস্ক্রিনের মধ্যে দিয়ে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। হেডলাইটের আলোটার সামনে রুপোর পাতের মতো বৃষ্টির আড়াল। আরও একশো গজ এগোতেই কশিপুর হাটে এসে পৌঁছলাম। আজ হাট ছিল। থাকলে কী হয়, বেলা তিনটের মধ্যে হাট উঠে গেছে বাঘের ভয়ে, নইলে হাট জমত দুপুর থেকে আর হাটুরেরা রাত নটা অবধি হেঁটে ফিরত যার যার গ্রামে। এখন সব নিয়মকানুনই পালটে গেছে। হাটের চালাঘরগুলোর মাঝখান দিয়ে জিপ ঢুকিয়ে দিয়ে হাটের ঠিক মধ্যিখানে যে মস্ত অশ্বত্থাগাছটা আছে তার তলাতে নিয়ে গেলাম জিপটাকে বৃষ্টির তোড় থেকে মাথা বাঁচাতে। স্পটলাইটের তারটাকেও লাগাতে হবে। আমাকেই নামতে হবে কারণ এক হাতে স্পটলাইট ধরে আর দু-পায়ে কসরত করে বন্দুককে আটকে রাখা অবস্থাতে দন্ডসেনার পক্ষে নড়াচড়া করা অসুবিধের।
অশ্বত্থগাছের নীচে আসতে সত্যিই বৃষ্টির দাপট থেকে বাঁচা গেল। তবে একটু পরেই পুরো গাছ জলে ভিজে গেলে পাতা থেকে জল পড়বে টপটপিয়ে। বছরের প্রথম বৃষ্টিতে গরম মাটি থেকে বাষ্প উঠছে–গরম কড়াইয়ের উপরে জল পড়লে যেমন হয়, তেমন।
আঃ কী আরাম! এই বাক্যটি এখন কতশো বর্গমাইল এলাকার ঘরে ঘরে এই মুহূর্তে উচ্চারিত হচ্ছে তা কে জানে!
বাইয়ানি খুব মজা পেয়েছে। সে খিদে পেলেও হাসে, ভরপেট খেলেও হাসে, এখন বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়েও হাসছে। আমার ভয় হচ্ছে সে জিপ থেকে নেমে দৌড় না লাগায়।
জিপের স্টার্ট বন্ধ করলাম না। তবে হেডলাইট নিভিয়ে সাইডলাইট জ্বালিয়ে রাখলাম শুধু। ভটকাইকে বললাম, ভটকাই একবার টর্চটা জ্বেলে চারদিকে ঘোরা। স্পটলাইটের তার লাগাতে হবে। নামব এবারে।
ভটকাই টর্চটা জ্বেলে চারধারে আলো ফেলল, তারপর বলল, নাম। অল ক্লিয়ার। তোর কোনও ভয় নেই। আমি তো আছিই তোর বডিগার্ড।
বললাম, ভয় যেমন নেই, ভরসাও নেই। আলো ছাড়া রাইফেল দিয়ে তুই কী করবি? আমাকে দে রাইফেলটা।
এমনিই বললাম কথাটা। ভটকাইও এমনিই তার হাতে-ধরা ঋজুদার ফোরফিফটি-ফোরহানড্রেড রাইফেলটা এগিয়ে দিল। আমি নেমে বনেটটা খুললাম। বনেটের নীচে একটা আলো ছিল রাতের বেলা ইঞ্জিন দেখার জন্য। সেই আলোর সুইচটা দিতেই দেখলাম যে স্পটলাইটের তারের ক্ল্যাম্পটা খুলে গেছে। ক্ল্যাম্পটা লাগাতে মাথা নিচু করেছি ঠিক সেই সময়ে বনেটের নীচের সেই আলোতে হঠাৎ চোখে পড়ল নিভন্ত লাল আগুনের মতো ভৌতিক দুটো চোখ চালার মধ্যে। চালাটার তিনদিক ঘেরা একদিক খোলা এবং জিপটা যেখানে দাঁড় করিয়েছি সেইখানেই সেই চালার ভোলা দিকটা। একটা নিচু বারান্দাও ছিল মাটির। ঘরটাও মাটির কিন্তু উপরে খড় আর তিনপাশে বাখারি।
আমার হৃৎপিণ্ড স্তব্ধ হয়ে গেল। কোনও আওয়াজ করা সম্ভব ছিল না। তার প্রয়োজনও ছিল না। আমি যেন বাঘকে দেখতেই পাইনি এমনভাবে মাথা নিচু করা অবস্থাতেই বনেটের নীচের ফ্রেমে-রাখা রাইফেলটা বাঁ হাতে তুলে নিয়ে এক ঝটকাতে ঘুরেই ডানহাত দিয়ে রাইফেলের স্মল অফ দ্য বাট এবং ট্রিগার-গার্ডকে একইসঙ্গে ধরে ট্রিগার টানলাম চালার দিকে রাইফেলের নল ঘুরিয়ে। প্রথম গুলিটি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এবার দু হাতে রাইফেল হোন্ড করে দ্বিতীয় গুলিটিও যেখানে চোখ দেখেছিলাম সেইখানে করলাম। জিপের মধ্যে দাঁড়িয়ে-বসে-থাকা ওরা বোমা পড়ার মতো হেভি রাইফেলের জোড়া-গুলির শব্দে চমকে উঠে একই সঙ্গে বলল, কী হল? কী হল?
ওরা ভেবেছিল, লোডেড রাইফেলের গুলি আমারই গায়ে লেগেছে অসাবধানতায়। ওরা কী ভাবল তা তো আন্দাজ করতে পারলাম কিন্তু অরাটাকিরির বাঘ যে কী ভাবল বা কিছু ভাবার সময় আদৌ পেল কিনা, তা জানতে পেলাম না। পাঁচ হাত দূর থেকে মাথাতে এবং বুকে লাগা জেফরির ফোরফিফটি-ফোরহানড্রেড রাইফেলের সফট-নোজড গুলি বাঘকে জীবন ও মৃত্যুর তফাত পর্যন্ত বুঝতে দিল না। বেচারি। এতদিন জলের কষ্ট সকলেরই মতো তারও ছিল। তবে ক্যাট ফ্যামিলির কেউই উপর থেকে গায়ে জল পড়া পছন্দ করে না যদিও গরমের দুপুরে জলে গা ডুবিয়ে বসে থাকতে দেখা যায় বাঘকে শরীরের জ্বালা জুড়োবার জন্য।
রাইফেলের অতর্কিত আওয়াজ হবার সঙ্গে সঙ্গেই বাইয়ানি ভয়ে চিৎকার করে উঠেছিল। ভটকাই এবং দণ্ডসেনা বন্দুক বাগিয়ে জিপের পিছন দিয়ে হুড়দাড় করে লাফিয়ে নেমে আমার কাছে চলে এল। ওরা ভেবেছিল আমাকে রক্তাক্ত অবস্থাতে দেখবে। কোন অভিমানে আমি হঠাৎ আত্মহত্যা করলাম বা কোন অসতর্কতাতে এমন অ্যাকসিডেন্ট হল তা ওরা ভেবে পাচ্ছিল না।
আমি স্পটলাইটের ক্ল্যাম্পটা খুলে ফেলে দন্ডসেনাকে দিয়ে বললাম, এর আর দরকার নেই।
ভটকাই মুখ হাঁ করে বলল, ব্যা ব্যা ব্যা ব্যাপারটা কী?
আমি বললাম, টর্চটা কই?
এই তো।
দে আমাকে।
টর্চটা আমাকে দিতেই আমি টর্চটার সুইচ টিপে চালার ভিতরে আলো ফেললাম। বাঘটা সামনের দু’ থাবার উপরে মাথা রেখে শুয়েছিল। রক্তে ভেসে যাচ্ছিল চালাঘর।
কিছুক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে থেকে দণ্ডসেনা আর ভটকাই মহা চেঁচামেচি শুরু করে দিল।
আমি বললাম, বাইয়ানির কপালগুণেই এই মানুষখেকোটা মারা গেল।
ভটকাই বলল, চিন্তা কর একবার। এই হাটের পাশ দিয়েই তো বাইয়ানি ঘণ্টাখানেক ঘণ্টাদেড়েক আগে একা একা গান গাইতে গাইতে হেঁটে গেছে।
বাঘ তখন এখানে হয়তো ছিল না, আবার থাকতেও পারে।
তারপর বললাম, বৎস, কী করিয়া বা কোন কারণে যে কী ঘটে তাহা কি পূর্বে জানা যায়?
তুই নিশ্চয়ই বাঘটাকে দেখেছিলি জিপ থেকে নামার আগে। পাছে আমি মেরে দিই তাই কিছু বলিসনি, না?
ভটকাই বলল, অভিমানভরে।
আমি বললাম, বিশ্বাস কর। আমি তো বনেটের আলোতেই দেখলাম। তাও একজোড়া লাল চোখের আভাস। রাইফেলটাকেও যে কেন চাইলাম তোর কাছে সেও এক রহস্য। আর বাঘও যে কেন এক লাফে বাইরে বেরিয়ে দৌড়ে চলে গেল না সেও আরেক রহস্য, আমাকে বা জিপের সামনে-বসা বাইয়ানিকেও সে দুই থাপ্পড়ে ফদাফাঁই করে মেরে দিল না কেন, তাও রহস্য।
দন্ডসেনা বলল, রুদ্রবাবু, চলুন বাংলোতে যাই আগে। ঋজুবাবু গুলির আওয়াজ নিশ্চয়ই শুনেছেন এবং শুনে চিন্তা করছেন।
বাঘ? এখানেই থাকবে?
নিশ্চয়ই। দশ গ্রামের লোক আসবে বাঘ দেখতে। তবে রাজয়াডুকে এখানে পাঠাতে হবে জিপ নিয়ে, নইলে গাঁয়ের মানুষে বাঘের গোঁফগুলো সব হাতিয়ে নেবে। বলেই, তার বন্দুকটা শূন্যে তুলে দু’টি ব্যারেলই ফায়ার করে দিল। তারপর আরও দুটি গুলি ভরে সে দুটিও ফায়ার করল।
কেন করছ এরকম?
ভটকাই শুধোল।
কশিপুরের ঘরে ঘরে এই গুলির শব্দ অরাটাকিরির বাঘ যে মারা পড়েছে এই সুখবরই পৌঁছে দেবে। রাতারাতিই কত মানুষে এসে জমায়েত হবে এখানে দেখুন না। পানমৌরি আর হাঁড়িয়ার আর পানবিড়ির দোকান খুলে যাবে। নাচগান চলবে। গত আড়াইবছর হল এখানের এবং এই পুরো অঞ্চলের মানুষ বন্দি-জীবনযাপন করছে। মুক্তি পাবে ওরা। ডাবল আনন্দ হবে ওদের। একে বাঘ মারা পড়ল তায় বৃষ্টিও নামল।
আমি বললাম, বাইয়ানির কপালেই কিন্তু এটা ঘটল। বাইয়ানির একটা পাকাঁপোক্ত বন্দোবস্ত করে যেতে বলতে হবে ঋজুদাকে। সেই মেঘনাদের বাড়ি যাবে না এখন? কি দস্তসেনা?
না না, এখন রাবণ অথবা মেঘনাদ কারও কাছেই যাব না রুদ্রবাবু। এখন ঋজুবাবুর কাছে যাব। বাইয়ানিও আমাদের সঙ্গেই যাবে।
দন্ডসেনা বলল।