জঙ্গল অথচ ঠিক জঙ্গলের মতন নয়
জঙ্গল অথচ ঠিক জঙ্গলের মতন নয়। যতদূর দেখা যায়, ঘন গাছের সারি, কোথাও কোথাও ঘন পাতায় আড়ালে নিবিড় ছায়া, কিন্তু যে-জঙ্গলে হিংস্র-জন্তুজানোয়ার নেই, সেটাকে তো অরণ্য নী স্বলে বাগান বললেও চলে; লখাকে সঙ্গে নিয়ে বিকেলে ওরা বেড়াতে বেরিয়েছিল, লখার মুখেই শুনলো, না, বাঘ-টাঘের কোনো ভয় নেই এখানে। মাঝে মাঝে দুএকটা নেকড়ের দেখা পাওয়া যায়, সেও খুব কম। বছর তিনেক আগে নাকি এক জোড়া ভালুকের দেখা পাওয়া গিয়েছিল, কিন্তু ইদানীং তাদের আর সন্ধান নেই। রাত্তিরেও এ জঙ্গল দিয়ে অনেকে চলাফেরা করে, হাতে একটা লাঠি থাকলেই যথেষ্ট।
কিছু কিছু শাল গাছ বেশ কচি, মনে হয় সরকারী অ্যাফরেস্টেশন প্ল্যানে বছর কয়েক আগে লাগানো, নবীন যুবার মতন তাদের ছিপছিপে দেহি! মোটকথা, বনটা বেশ ঝকঝকে পরিষ্কার, ৰূপসি ভালপালা কিংবা লতা-ঝোঁপের বিশেষ বাধা নেই, খুব সহজভাবে হাঁটা যায়।
প্রথম প্রথম জঙ্গল সম্বন্ধে ওরা চারজন নানারকম কৌত্বহল জানাচ্ছিল, একটু পরে সে-সব নিবৃত্ত হলে অরণ্যের আচ্ছন্নতা ওদের অধিকার করলো! ওরা চুপচাপ হাঁটতে লাগলো, শুকনো পাতায় ওদের ভারী পায়ের আওয়াজ শুধু। সরু সরু পায়ে চলা পথ পেরিয়ে পেরিয়ে ওরা এলো বড় রাস্তায়, জঙ্গল কেটে সেই রাস্তা বেরিয়ে গেছে, চওড়া ফাঁকা রাস্তা, তার একপ্রান্তে খুব আড়ম্বর ও জাঁকজমকের সঙ্গে সূর্যস্ত হচ্ছে! পাতলা পাতলা মেঘ ফাটিয়ে সূর্য ছড়াচ্ছে তার রাশি রাশি গাঢ় লাল রং, গাছের চূড়ায় সেগুলো পৌঁছাতে পৌঁছাতে হয়ে যাবে সোনালি, খুব একটা শেষ রঙের খেলা চলছে! এ ধরনের জমকালো সূর্যস্ত তো আজকাল মানুষ সচরাচর দেখে না, এসব এখন শুধু দেখা যায় সিনেমায়, সুতরাং ওদের পশ্চিমী সিনেমার কথাই মনে পড়লো, রবি বললো, মনে আছে, গার্ডেন অব ইভুল-এ বার্ট ল্যাঙ্কাস্টার।
অসীম বললো, ভাগ, ও বইতে বার্ট ল্যাঙ্কাস্টার ছিল না, গ্যারি কুপার আর রিচার্ড উইডমার্ক, আর সেই পাছা দোলানো মেয়েটা যেন কে ছিল?
সিনেমার খবর সঞ্জয়ই বেশি রাখে, সে হেসে জানালো-মেয়েটা ছিল আভা গার্ডনার, বুক আর পাছ একসঙ্গে দোলায়, কিন্তু গ্যারি কুপার ছিল না, গ্রেগরি পেক।
রবি বললে, ছবি তুললে অনেক কিছুই ভালো দেখায়। এখানে এই সান—সেট্টার ছবি তুললে—হলিউডের এইসব সিনের থেকে কিছু এমন খারাপ হতো না। ক্যামেরাটা আনলেই হতো। শেখর শুধু শুধু বারণ করলি—
শেখর বললো, না, না ওসব দামি জিনিস সঙ্গে নিয়ে এরকমভাবে বেড়াতে বেরুনো যায় সব সময় ভয় থাকে—এই বুঝি হারালো। সঙ্গে ওসব না থাকলে কিছু হাঝাবারও ভয় থাকে না।
একটা বেশ প্রশস্ত সিমেন্টের কালভার্ট। ওরা বসলো তার ওপর। লখা একটু দূরে দাঁড়িয়ে রইলো। আস্তে আস্তে আলো কমে এসে, প্রথমে জঙ্গলের মধ্যে অন্ধকার নামলো, তারপর রাস্তার ওপরেও পড়লো কালো ছায়া।
শেখর সিগারেটটা ছুঁড়ে ফেললো, বললে, এখন কী করা যায় বল তো?
রবি বললো, তাস এনেছিস?
–না, তাস-ফাস নয়। জঙ্গলে তাস খেলার জন্য আসি নি।
–তা হলে কি কারবি? সময় কাটাতে হবে তো?
অসীম বললে, ভাবতে হবে না, দেখিম, আপনিই সময় কেটে যাবে; আমি তো ঠিক করেছি, যে কদিন এখানে থাকবো জঙ্গল থেকে বেরুবো না; শহর ছেড়ে এখানেই কাটাবো। তা ছাড়া ঐ তো নোংরা শহর, ওখানে গিয়েই বা লাভ কি?
শেখর নিচু হয়ে দুটো পাথরের টুকরো কুড়িয়ে নিলো, একটা শূন্যে সামনে ছুঁড়ে দিয়ে বললো, আমিও তাই ভাবছি। দ্বিতীয় পাথরটা পড়লো ডান দিকের জঙ্গলে, হঠাৎ সেখানে কাচ ডাঙার ঝনঝন শব্দ হলো। ওরা চমকে সবাই ঘুরে তাকালো।
টাৰ্চ ছিল বুঝির হাতে। সেই দিকে আলো ফেললো। দেখা গেল। জঙ্গলের মধ্যে কয়েকটা নির্জন বাড়ির আভাস। পায়ে পায়ে সেদিকে এগিয়ে গেল! কয়েকটা ভাঙচুরো বাড়ি, কোনোটারই দরজা-জানলা নেই, ভিতরে আবর্জনা, ভাঙা কাচ, ছোড়া বিছানা, সাপের খোলসা-দেখলেই বোঝা যায়, এক কালে মিলিটারির আস্তানা ছিল। লখাও সেই কথা জানালো। তার মনে আছে, ছেলেবেলায় এখানে গোরা সাহেবেরা থাকতো, তার মা সেইসব সাহেবদের গল্প এখনো বলে। কি দরাজ দিল ছিল সাহেবদের।। সাহেবরা চলে যাবার পর বাড়িগুলো এমনিই পড়ে আছে! দুএকটা ঘর একটু পরিষ্কার, মনে হয়, কিছুদিনের মধ্যেও লোক ছিল এখানে। অরণ্যে কে কোন প্রয়োজনে ভাঙা বাড়ি ব্যবহার করে কেউ জানে না।
বাড়িগুলো দেখে খুশি হয়ে শেখর বললো, বাঃ, আমরা তো এখানেও থাকতে পারভূম। ডাকবাংলোয় জায়গা না পেলেও এমন কিছু অসুবিধে হতো না!
–যাঃ, ছাদ ভাঙা।
–তাতে কি হয়েছে, এখন মার্চ মাসে বৃষ্টি পড়বে না, শীতও কমে গেছে। যাক, বাড়িটা দেখা রইলো, পরে কাজে লাগতে পারে।
–অমন চমৎকার বাংলো পেয়ে গেছি, এটা আর কি কাজে লাগবে? অসীম বললো।
–দেখা যাক।
—একটা বন্দুক আনলে হতো, পাখি-টাখি মারা যেতো।
অসীম তোদের তো রাইফেল ছিল একটা, আনলি না কেন?
—কোথায় রাইফেল, গত যুদ্ধের সময় বাবা তো হুজুগে পড়ে ওটা ডিফেন্স ফান্ডে দান করে দিলেন। মাত্র দুদিনের জন্য–
অসীমের গলায় আফসোসফুটে উঠলো। কেননা, যুদ্ধের হুজুগে বেহালায়, অসীমদের পাড়ায় যখন মুখ্যমন্ত্রী ডিফেন্স ফান্ডের জন্য মিটিং করেছিলেন, তখন পাড়ার গণ্যমান্য ব্যক্তি হিসেবে অসীমের বাবাও উপস্থিত ছিলেন এবং পাঁচজনের কথা শুনে ঝোঁকের মাথায় তিনি নিজের বন্দুকটাই দান করে ফেললেন। বন্দুকের বাঁটে ওর বাবার নাম খোদাই করা, সেই দশ বছরের পুরোনো রাইফেল কোন যুদ্ধে কাজে লাগাবে কে জানে, অসীমরা সবাই আপত্তি করেছিল, কিন্তু ওর বাবা শোনেন নি। মুখ্যমন্ত্রীর কাঁধ-বেঁকানো হাসি ও জনতার হাততালির লোভ সামলাতে পারেননি; এবং তার ঠিক দুদিন পরেই অসীমের বাবা বাথরুমে পা পিছলে পড়ে যান এবং সেই রাত্রেই শেষ নিঃশ্বাস ফেলেন। পিতার মৃত্যুর জন্য দুঃখিত অসীমের আফসোস শুনলে স্পষ্ট বোঝা যায়, সেই মরলেনই যখন বাবা আর দুদিন আগে মরলেই রাইফেলটা বাঁচতো।
শেখর বললো, রাইফেল আনলেও আমি শিকার করতে দিতুম না। পাখি মারা আমি দুচক্ষে দেখতে পারি না।
রবি হেসে উঠলো। সকলের দিকে তাকিয়ে বললো, একটা জিনিস লক্ষ করেছিস? শেখর কি রকম নিজে নিজেই লিডার হয়ে গেছে? সবকিছু ওর ইচ্ছে-অনিচ্ছে অনুযায়ী চলবে। ভাগ!
শেখর বললো, না, লিডার কেউ নয়। কিন্তু একটা জিনিস মানতে হবে। কোনো একটা জিনিস আমাদের একজনের খারাপ লাগালে, বাকিদের সেটা করা চলবে না। না হলে সব মাটি হয়ে যাধে!
–তা হয় না। বরং, এইটা ঠিক কর, কেউ কারুর কাজে বাধা দেবে না। আমি কখন কি করবো, তার কোনো ঠিক নেই। বাইরে এসেছিই একটু প্রাণ খুলে যা-খুশি করতে।
শেখর এবার যথার্থ দলপতির মতনই ভাবী গলায় বললো, রবি আজ বাংলোয় তোর ছুরিটা আমাকে দিয়ে দিবি।
–কেন?
–আমার দরকার আছে।
অনেকক্ষণ থেকেই একটা মৃদু গন্ধ আসছিল, আর কিছুক্ষণ পথ পেরিয়ে এসে এবার কিছু লোকের কথার আওয়াজ ও দুএক বিন্দু আলো দেখা গেল। আর একটু এগিয়ে চোখে পড়লো, নিম গাছের তলায় কয়েকটি চালাঘর, এখানে জঙ্গল ফাঁকা, ঝাঁপ তোলা এক দোকানে আলুর দম আর ছোলা সেদ্ধ বিক্রি হচ্ছে, পাশের দোকানটির সরু ব্লকে ও মাটিতে বহু মেয়ে-পুরুষ বসে আছে, হাতে লাল রঙের বোতল ও পাতার ঠোঙা। জায়গাটার নির্ভুল চেহারা, তবু অসীম জিজ্ঞেস করলো লখা এখানে, কি হচ্ছে?
–উসব ছোটলোকের জায়গা বাবু, মহুল খাচ্ছে সব।
–মহুয়া? তাই গন্ধটা পাচ্ছিলুম। শেখর, একটু চেখে দেখবি নাকি?
–নিশ্চয়ই।
ররি সব কিছু জানে, সে বললো, জানভূম এখানে মহুয়া পাওয়া যাবেই। এসব ট্রাইব্বাল পকেটে মহুয়া ছাড়া।
পুরো দলটির ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব যেন তারই, ববি এগিয়ে গেল এবং দেখে আশ্চর্য হলো, জঙ্গলের মধ্যে দোকান, কিন্তু পুরোদস্তুর লাইসেন্সড্। সামনে সরকারি বিজ্ঞপ্তি টাঙানো, তাতে বিভিন্ন বোতলের দাম ও দোকান খোলা-বন্ধের সময় জানানো। কাউন্টারে দাঁড়িয়ে রবি দরাজ গম্ভীর গলায় এক নম্বরের দুবোতলের অর্ডার দিলো।
লোকজনরা ওদের দেখে কিছুটা তটস্থ হয়ে উঠেছে। সারা জায়গাটা জুড়ে একটা অস্পষ্ট গুঞ্জন ছিল—হঠাৎ সেটা থেমে গেল। অনেকগুলো চোখ এসে পড়লো ওদের ওপরে। একসঙ্গে একরকম চারজন বাবুকে এখানে কখনো দেখতে পাওয়া যায় না। ভদ্রলোকদের কাছে এসব জিনিস অস্পৃশ্য দুএকজল খেলেও চাকরকে দিয়ে কিনতে পাঠায়, কিন্তু এরা একেবারে সশরীরে; একটা বুড়ো সাঁওতাল মাতলামি করছিল, সে পর্যন্ত মাতলামি থামিয়ে ঘোলাটে চোখ মেলে তাকিয়ে রইলো। মেয়েরা অনেকে পেছন ফিরে বসলে, একটি যুবতী মেয়ে তার অচৈতন্য মরদকে টেনে তোলার চেষ্টা করছিল, সে শুধু ফচকে গলায় বলে উঠলো চল মুংরা, পুলিশ আ গেলল, আভি তুহাররে পাকড় লে যাই-ই–।
রক থেকে কয়েকজন নেমে গিয়ে ওদের জায়গা করে দিয়েছিল, রবি গোলাসে ঢেলে এক চুমুকে সবটা শেষ করে বললো, বেশ জিনিসটা তো। স্ট্রং আছে। অসীম, তুই একটু কম কম খাস।
অসীম বললো, আমার এসবে কিছু হয় না।
কিন্তু অসীমের গেলাস ধরার কায়দা দেখেই বোঝা যায়—সে জিনিসটাকে সন্দেহের চোখে দেখেছে। গায়ে চুমুক দেবার মতন আস্তে আস্তে চুমুক দিচ্ছে; কষা স্বাদে মুখে একটুখানি বিকৃত হয়ে এলেও বন্ধুবান্ধবের সামনে প্রকাশ করতে চাইছে না।
রবি তো সব জানে, অসীমকে উপদেশ দেবারও অধিকার তার আছে। বললো, মহুহা জিনিসটা দেখতে এ রকম সাদা জলের মতন-কিন্তু হঠাৎ কিক্ করবে। জিনের বাবা।
শেখর চারদিক চেয়ে লোকগুলোকে দেখছে। সবাই তখনো ঝিকি চোখে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে, কেউ কথা বলছে না। শুধু সেই মাতাল মেয়েটা সব কিছু অগ্রাহ্য করা গলায় তীক্ষ্ণভাবে বলতে লাগলো, এ মুংরা, পুলিশ আভি তুহারকে পাকড় লে যাই-ই, এ মুংরা…।
রবি এক পলক তাকিয়ে দেখলে ওদের দিকে। তারপর গলা চড়িয়ে মেয়েটাকে বললো, ওকে একা কেন, তোদের দুজনকেই ধরে নিয়ে যাবো।
মেয়েটা খিলখিল করে হাসতে হাসতে বললো, যাবি তো চল না। আমি নাচ দেখাবো। আর সালে থানায় গিয়ে সারা রাত নাচ দেখাইছি। বড়বাবু পাঁনচে রুপিয়া দিলো, হি-হি-হি?
সঞ্জয় বললে, একটা জিনিস দেখেছিস, এরা বাংলা-হিন্দি দুটোই বেশ জানে। বাংলা তো সব বুঝতেই পারে
রবি বললো, এসব সিং ভুম জেলার জায়গা তো, আগে বাংলাদেশেই ছিল, আগে তো এখানে বাংলাই বলতো!
মেয়েটির নেশা প্রচুর, নিজের মরদের জ্ঞান ফেরাবার চেষ্টা ছেড়ে সে দুলতে দুলতে ওদের কাছে এগিয়ে এসে বললে, এ বাবু, আমাকে একটু খাওয়াবি? এই টুকুনি, আধ পোয়া?
রবি প্রচণ্ড ধমকে উঠলো, ভাগ! যা এখান থেকে!
দুতিনটে মাতাল নিজেদের মধ্যে বলাবলি করলো, হাঁটা, গলার জোর আছে, পুলিশই বটে।
রবি শুনতে পেয়েছিল সে কথা, উত্তর দিলো, হাঁ, ঠিকই মনে লয়-বেশি গোলমাল করো না।
শেখর নিম্নস্বরে রবিকে বললো, ওরকম ধমকে কথা বলিস নি! এদের সঙ্গে বরং বন্ধুত্ব করার চেষ্টা করা ভালো।
–ধমকে কথা না বললে এর লাই পেয়ে মাথায় উঠবে।
তা বলে ওরকম ভয় দেখাস নি; এদের সঙ্গে বসে। এদের সঙ্গে এরকমভাবে মিশে যাওয়াই ভালো। তাতেই বেশি মজা। শুধু শুধু বাবু সেজে আলাদা হয়ে থাকার মানে হয় না।
শেখর পাশের একটি লোককে জিজ্ঞেস করলো, তোমার নাম কি ভাই।
লোকটি কোনো কথা বললো না। আস্তে আস্তে নিজের বোতলটি সঙ্গে নিয়ে উঠে গিয়ে দূরে এক জায়গায় বসলো! ববি অট্টহাসি করে উঠলো ভাই? শেখরটা একটা ড্যাম রোমাণ্টিক। ভাই বলে তুই এদের সঙ্গে মিশবি? তুই কোত্যারি না শুনলেই ওরা ভয় পায়। দেখবি কি করে এদের সঙ্গে কথা বলতে হয়?
রবি আরেকটি লোকের দিকে চেয়ে বললো, এ মাঝি, তোর গাঁও কোথায় রে?
লোকটি উত্তর দিলো ঠিকই, কিন্তু একটু উদাসীনভাবে, বললো সেই সেদিকে, লতাডিহি।
—কতদূর এখান থেকে?
–দুক্রোশ হবে।
–তোমার গ্রামে মুর্গী পাওয়া যায়?
—মুর্গী তো হাল দুনিয়ায় সব জায়গাতেই পাওয়া যায়।
বোঝা গেল, লোকটা কথা চালাতে বিশেষ উৎসাহিত নয়। কেননা, সেও এবার উঠে বোতল জমা দিয়ে, লাঠিটা কাঁধে নিয়ে অন্ধকার জঙ্গলের পথে রওনা দিলো। সঞ্জয় বললো, এদের সঙ্গে ভাব করা সহজ নয়? জোর করে চেষ্টা করেই বর কি লাভ?
রবি জিজ্ঞেস করলো, সঞ্জয়, তুই খাচ্ছিস না?
–না। আমার বেশ করতে ভয় করে।
–ঠিক আছে। আমাদের বেশি নেশা হয়ে গেলে কিন্তু তুই দেখবি।
লখা এবার লজ্জিত ও বিনীতভাবে জানালো, আমাকে একটু বাবু!
রবি কিছু বলার আগেই শেখর বললে, হ্যাঁ হ্যাঁ, ওকে একটু দাও; অনিচ্ছা সত্ত্বেও রবি হাতের বোতল থেকে লখাকে পাতার ঠোঙায় ঢেলে দিলো, তারপর ইংরাজিতে বললো, যাক, তবু শেখর এদের মধ্যে একজন অন্তত বন্ধু পেয়েছে। কিন্তু লখা, তুই দুপুর বেলা মুগীর বড় বেশি দাম নিয়েছিল। বেশি চিটিং করার চেষ্টা করলে কিন্তু তার ঠ্যাং ভাঙবো। ভেবেছিস কলকাতার বাবু—মাল চেনো নি এখনো!
রবি কাছ থেকে আকস্মিক বকুনি খেয়ে লিখা হতচকিত হয়ে যায়। কিন্তু বাবুর হাতে মদের গ্লাস থাকলে সেই সময় তর্ক করতে নেই-এ কথা সে ভালোভাবে জানে, তাই কোনো উত্তর না দিয়ে সে অপরাধীর মতন মাথা নিচু করলো।
বুদ্ধিৰ্ব্বই প্রথম নেশা হয়। তার তেজী শক্তিমান শরীরটা ছটফট করে। সে উঠে দল ছেড়ে ঘুরে বেড়ায়, একে-ওকে বকুনি দেয়। দোকানের মালিককে তার লাভ-লোকসান বিষয়ে প্রশ্ন করে। শেখর বেশি কথা বলে না, চুপ করে বসে থাকে, জঙ্গলের মাথায় দল বেঁধে অন্ধকার নামা দেখে। তার মনে পড়ে, গতকাল এই সময় সে অফিস থেকে বাড়ি ফিরছে। জিনিসপত্র গোছাবার সময় সে টেক্স পেয়েছিল তার ছাড়া শার্টের পকেটে চিঠি ছিল–ঝাড়ির লোক সেই চিঠি সমেতই শার্টটা কািচতে পাঠিয়ে দিয়েছে। অত্যন্ত প্রয়োজনীয় চিঠি! তাই নিয়ে রাগারগি, মাকে সে বলেছিল… হঠাৎ শেখরের খেয়াল হলো, এখানে এই কদিন সে কলকাতার কথা একবারও মনে করবে না। ঠিক করেছে!
সাড়ে সাতটায় দোকান বন্ধ, আস্তে আস্তে ভিড় ফাঁকা হয়ে এলো। সেই মেয়েটা এর-ওর কাছে মদ ভিক্ষে চেয়ে তাড়া খাচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত সে একটা অদ্ভুক্ত কাপ্ত করলো। সে নিজে নেশায় টলছিল, কিন্তু একটু পরেই সে তার অজ্ঞান মরূদকে কাঁধে নিয়ে অবলীলাক্রমে বনের অন্ধকারে মিশে গেল।।
সঞ্জয় অল্প হেসে বললো, এদের সঙ্গে সাহেবদের খুব মিল কিন্তু!
অসীম বললো, হ্যাঁ, এরা বেশিরভাগই ক্রিশ্চান।
না, সেজন্য নয়। দেখছিস না-সাহেবদের মতই——মেয়েদের কোনো আব্রু নেই, মেয়ে-পুরুষে একসঙ্গে বসে মদ খাচ্ছে, সামান্য ছোট-খাটো উৎসব হলেই এরা মেয়ে-পুরুষে হাত-ধরাধরি করে নাচে, মেয়ে-পুরুষের সমান অধিকার—ঠিক ওয়েস্টার্ন সোসাইটি।
রবি হেসে উঠে বললো, তুই খেলি না তো, তাই তোর এসব ভালো ভালো কথা মনে পড়েছে। খা না একটু!
–না। সঙ্গে নিয়ে চল, বাংলোয় বসে খেয়ে দেখবো।
—এখানে খাবি না কেন?
–জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে ফিরতে হবে তো–সকলের নেশা হলে মুশকিল!
—তাও হিসেব করে রেখেছিস! হিসেবগুলো একটু ভুলে যা না একদিন। জঙ্গলের মধ্যে ফিরলে কি হবে? রবি চৌধুরী সঙ্গে আছে, কোনো ভয় নেই।
ফেরা-পথের দৃশ্য অন্যরকম। জ্যোৎস্নায় সমস্ত বন ধুয়ে যাচ্ছে, পৃথিবীর এক প্রান্তে এখন সত্যকার নিস্তব্ধতা! বুবির বেশি নেশা হয়েছে, সে স্তব্ধতাকে টুকরো টুকরো করে ভেঙে ইংরিজি গান গাইছে দীর্ঘ গলায়; হঠাৎ গান থামিয়ে উৎফুল্লাভাবে দাবি জানালো, আয় সঞ্জয়, তোতে আমাতে নাচি।
–দেখবি, নাচবো দেখবি?
ফাঁকা রাস্তায় অসীম খানিকটা ছুটে এগিয়ে গেল, তারপর ওদের দিকে ফিরে টুইষ্ট নাচতে লাগলো। সেই জ্যোৎস্নায়, দুপাশে নীরব বৃক্ষ দর্শক, চওড়া রাস্তায় অসীমের আবছা মূর্তিটা খানিকটা অলৌকিক দেখাতে লাগলো, রবি ওর নাচে সুর দিচ্ছে।
শেখর হাততালি দিয়ে তাল দিতে দিতে বললো, আঃ, খুব ভালো লাগছে রে; তুই ঠিক বলেছিল অসীম, এই জঙ্গল থেকে আর বাইরে যাবো না! এখানে যে কদিন আছি, জঙ্গলের মধ্যেই থাকবো, আর মহুয়া খাবো।