অমৃতা (Amtrita) – ২৫
—খুকি, শম্পা ডাকছে। টুটুলকে কোল থেকে নামিয়ে সে ফোন ধরল।
—শম্পা, বল? অনেক দিন তোর কোনও খবর পাই না।
—আমিও তো তোর…তুই আমাকে ভুলেই গেছিস।
—কে যে কাকে ভুলে গেছে সে কথা এখন মুলতুবি থাক। কেমন আছিস?
—ওই একরকম। অমৃতা, একদিন আমাকে একটু সময় দিতে পারবি?
—বেশ তো! চলে আয় না। সারাদিন খাব-দাব, গল্প করব।
—না বাড়িতে না। একটু প্রাইভেট কথা আছে।
—তবে কোথায়? তুই-ই বল।
—ধর, ধর ওয়লডর্ফ? আমি তোকে খাওয়াব কিন্তু।
—টুটুলকে ছেড়ে বেশিক্ষণ থাকা যাবে না।
—ঠিক আছে। ধর ঘণ্টাতিনেক। তোকে পৌঁছে দেব।
ওয়লডর্ফের ড্রাগনের তলায় বহুদিন পর শম্পা অমৃতা। এখন দুজনেরই শাড়ি, দুজনেরই এক বিনুনি।
প্রাথমিক দু চারটে কথাবার্তার পর শম্পা বলল—তোর কাছ থেকে একটা পরামর্শ চাইব?
অমৃতা হেসে ফেলল, বলল—এখনও? দোলার কথাই মনে পড়ল তার। গম্ভীর হয়ে বলল—তোর তো এখন পরামর্শ দেবার লোকই হয়েছে।
শম্পা হাসল না। বলল—সমস্যাটা তো তাকে নিয়েই।
—সে আবার কী? অমৃতার বুক ঢিপঢিপ করছে।
—জানিস, কিছুতেই আমার মাকে মেনে নেবে না। আমি দ্যাখ, নতুন সংসার করছি, ও-ও তো তাই। মা কিছু সাজেশান দিলেই গম্ভীর হয়ে যাবে, বলবে—বড্ড ইনটারফিয়ার করেন তোমার মা।
মা বেচারি ভাল মনেই আমাদের হেল্প করতে আসে। ও বলে—আমরা সাবালক হয়ে গেছি দুজনেই। আমাদের সমস্যা আমরাই সামলাব।
মা একদিন বলেছিল—তোমাদের থেকে অনেক আগে পৃথিবীতে এসেছি, এটা তো অন্তত মানো? হয়তো তোমাদের মতো শিক্ষা নেই, বুদ্ধিও নেই, কিন্তু কত দেখলাম, শুনলাম, এ সবের থেকে একটা সমাধান করবার ক্ষমতা আপনা থেকে এসে যায়।
—ও বলল, আপনাদের অভিজ্ঞতা আর আমাদের অভিজ্ঞতা এক নয়। দুটো আলাদা জেনারেশনের। প্লিজ মা, ডোন্ট ইন্টারফিয়ার…
মা সেদিন অপমানিত হয়ে কাঁদতে কাঁদতে চলে গেছে।
অমৃতা বলল—তোর হাজব্যান্ড কিন্তু কথাগুলো মোটামুটি ঠিকই বলেছেন। যদিও বড্ড রূঢ়। অন্তত তেমনই শোনাল।
—সেটাই। আর মায়ের ইন্টারফিয়ারেন্স-এর নমুনা শুনবি? একদিন আমি অফিস থেকে খুব ক্লান্ত হয়ে ফেরায়, আর লোক না আসায়, মা রান্না করে দিয়েছিল। ওর জন্মদিনে পায়েস-টায়েস গুচ্ছের রেঁধে এনেছিল, তো আমার মাইগ্রেন আছে, সে সময়টা ঘর অন্ধকার করে মাথায় বাম লাগিয়ে ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়তে বলেছিল। এর কোনটা ইন্টারফিয়ারেন্স বল তো? মা অভিমান করে আর আমাদের বাড়ি আসে না। অথচ আমাকে না-দেখে মা’র থাকা বা আমার মাকে না দেখে থাকা, একেবারে অসম্ভব। আমার বুক ফেটে যায়।
ওয়েটার ওদের জন্যে চিকেন উইথ ডাম্পলিংস নিয়ে এসেছিল।
অমৃতা ন্যাপকিন বিছোতে বিছোতে বলল—খাই?
—নিশ্চয়ই।
—তুই হাত গুটিয়ে রয়েছিস কেন? এই নে আমি দিলাম, খা।
—বলবি তো কিছু?
—ইট ইজ সো অব্ভিয়াস!
—কী অব্ভিয়াস?
—তুই মায়ের মতো আর কাউকে ভালবাসিস না, এটা তো ঠিক শম্পা?
শম্পা একটু ভাবল, বলল—মায়ের প্রতি টানটা এক জাতের, সৌমিত্রর ওপর টানটা অন্য জাতের। তুই তো জানিস মা আমার কী? একাধারে মা, বাবা, বন্ধু, স-ব।
—খালি স্বামীটা না।
—ধ্যার!
—শম্পা তুই তোর মায়া-মমতা, তোর গভীর ভাবনা-চিন্তার, আদরের সবটা দিস মাসিকে। মাসিও তোকে তাই দেন, তাতে তুই ভীষণ রকম পরিতৃপ্ত হোস। হোস না?
—ইয়েস, অফ কোর্স।
—আর সৌমিত্রকে তুই দিস কেজো কথা, ছেঁদো গল্প, আর…আর… রাতটা।
—অমৃতা! ছিঃ।
—ছিঃ কেন? তুই তো পরামর্শ চেয়েছিলি। আমি জানি, আমি বুঝি রে শম্পা। ওই…ওই বাজে লোকটাও আমাকে ঠিক এই দিয়েছিল। আমি মানিয়ে নিয়েছিলাম। তোর সৌমিত্র মানতে পারছে না।
—তুই আমাকে অরিসূদনের মতো স্কাউন্ড্রেলের সঙ্গে তুলনা করলি?
—শোন, তুই স্কাউন্ড্রেল নোস, তোর কোনও মতলব নেই, তুই নিষ্ঠুর নোস। কিন্তু শম্পা বিশ্বাস কর, দেওয়া দেওয়ির এই ব্যাপারটা একই। এখন তোর সৌমিত্র ইজ গেটিং জেলাস অফ ইয়োর মাদার, জেলাস অফ হার হোল্ড অন য়ু।
কিছুক্ষণ চুপ করে খাবারগুলোর দিকে চেয়ে রইল শম্পা। শূন্য চোখে। শেষে জলভরা চোখে তার দিকে তাকিয়ে বলল—তাহলে কি আমাকে বেছে নিতে হবে একজনকে? অমৃতা!
—দূর পাগলি!
—তা হলে?
—তোকে আরও অনেক কঠিন কিন্তু অনেক সহজ একটা কাজ করতে হবে।
—কী সেটা? কঠিন আবার সহজ?
—তোকে অভিনয় করতে হবে, দ্বিচারিতা করতে হবে রে শম্পা। মায়ের কাছে বলবি সৌমিত্র মায়ের সম্পর্কে কত ভাল-ভাল কথা বলে, সারাজীবন অনে-ক করেছেন তো! তাই ও মনে করে মায়ের আর তোদের জন্য দুর্ভাবনা, তোদের সেবা এসব করার দরকার নেই। সে মাকে মুক্তি দিতে চায়। ও খুব স্ট্রেইট-কাট। সোজা সরল হিসেব ওর। মায়ের যে করতে ভাল লাগে এ সেন্টিমেন্ট বোঝবার মতো মনই ওর নয়। কোনওদিন ফ্যামিলিতে থাকেনি তো!
—আর সৌমিত্র?
—সৌমিত্রকে প্রত্যেকটি ব্যাপারে জিজ্ঞেস করবি। কী রান্না হবে থেকে, কী পরবি, কার সঙ্গে মিশবি, কে ভাল, কে মন্দ, আর…আর… নিজেকে অনেক অনে-ক বেশি করে দিবি!
—এত সব কথা তুই কী করে জানলি, অমৃতা? মোটে তিন বছর তো…
—শম্পা ওই তিন বছর আমাকে তিরিশ বছরের অভিজ্ঞতা দিয়ে গেছে। বুঝিয়ে দিয়ে গেছে, মানব-চরিত্রের অনে-ক খুঁটিনাটি। জানিস, তবু, সমস্ত সয়ে, অত খেটে, ওদের সংসারটাকে মাথায় করে রাখবার পরও কেন আমায় প্রকারান্তরে খুন করে চেয়েছিল—এটা আমি এখনও বুঝি না। ধর, আরেকটা বিয়ে করত, ডাউরি পেত—শুধু সেইটুকু? সেইটুকু? বাইরে থেকে শ্বশুর-শাশুড়িকে আনকালচার্ড, পজেসিভ টাইপ মনে হত, আর ওই লোকটাকে খুব প্র্যাক্টিক্যাল আনসেন্টিমেন্টাল টাইপ লাগত, কিন্তু ওর যে তিন-তিনটে বছরেও আমার ওপর এতটুকু মমতা জন্মায়নি, ও যে একটা শয়তান-স্বভাবের মানুষ এ আমি বুঝতে পারিনি। কাজেই শম্পা মনে করিস না আমার বোঝাটা, আমার পরামর্শটাই চূড়ান্ত। আমি আমার বোঝাটুকু বললাম। এরপর তুই নিজে ভাব, নিজে লক্ষ কর, কার কোন ব্যবহারে অন্য জনের কী প্রতিক্রিয়া হয়। তার থেকে তুই তোর আচরণের ক্লু পেয়ে যাবি।
—তার মানে, সরল মনে আর বাঁচতে পারব না? শম্পার যেন দম বন্ধ হয়ে আসছে।
—শম্পা, প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড, সরল মনে আমরা কোনওদিন বেঁচে ছিলাম না। জটিলতাটা তখন আসত ভেতর থেকে, আমাদের অজ্ঞাতসারে, এখন জেনেবুঝে জটিল হতে হবে, কপট হতে হবে—এই।
শম্পার চোখ দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা জল পড়ছে।
অমৃতা বলল—কাঁদছিস কেন? তুই এভাবে ভাব না—লোকে অপরের ক্ষতি করবার জন্য কপটতা করে, তুই কপটতা করছিস নিজের এবং আরও দুটি প্রিয়জনের জন্যে। দুটো সম্পর্ককে বাঁচাবার জন্যে।
—জানিস, ও এত জেলাস যে বাচ্চা চায় না।
—এই দ্যাখ, আমি তো তবে ঠিকই বুঝেছি।
—কিন্তু আমি যে চাই অমৃতা।
—কী বাহানা দেয় তোকে?
—বলবে, দুজনেই চাকরি করি, কী করে বাচ্চা মানুষ হবে? আমার অ্যাটেনশন তখন নাকি পুরোপুরি চলে যাবে বাচ্চার দিকে। নিজের কথা বলে না, বলে আমার কাজের কেরিয়ারের ক্ষতি হবে।
—তুই যতদূর পারিস অসাবধান হয়ে যা, বুঝলি? বাচ্চাটা যখন সত্যি-সত্যিই এসে পড়বে, তখন দেখবি সৌমিত্র বদলে গেছে। ভালবাসার আরেকটা মানুষ পেয়ে বেঁচে গেছে। আর মাসিরও সম্ভবত তাই-ই হবে। আফটার অল সৌমিত্র তো অরিসূদন নয়!
তার অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল অমৃতার।
শম্পা সন্তর্পণে বলল—তোর এখনও অরিসূদনের কথা মনে পড়ে? মানে…
দূর… অমৃতা বলল—আমার দুঃখ হয় ভেবে যে জীবনের তিন তিনটে বছর আমার বাজে খরচ হয়ে গেছে। অরিসূদনকে আমি মন থেকে কোনওদিনই ভালবাসিনি। এখন ওটাকে শরীর থেকেও মুছে ফেলেছি। শম্পা, আমার ওর সঙ্গে সহবাসেরও কোনও স্মৃতি নেই। সেটাই তো জানতে চাইছিস?
—সেটা কি সম্ভব? অ্যাট অল সম্ভব অমৃতা? একটা দাগ, একটা স্কার থেকে যায় না।
অমৃতা বলল—নেই। নেই। আমি এখন কুমারী। মনে মনে এত বেশি যে শরীরেও তাই হয়ে গেছি।
—তোর যে একটা ছেলে রয়েছে রে!
—তাতে কী! ও তো আমার, আমার মায়ের। ও সীমান্ত। সত্যি বলছি শম্পা, আমার কুমারী অনুভব হয়। সেই মহাভারতে পড়েছি না সূর্যর ঔরসে কুন্তীর কোলে কর্ণ এলেন। তারপর তিনি আবার আগের মতো, অক্ষতযোনি কুমারী হয়ে গেলেন! সেই রকম!
—তুই আবার বিয়ে কর অমৃতা!
উত্তরে অমৃতা হাসল, বলল—ন্যাড়া বেলতলায় এর মধ্যেই? তা ছাড়া বিয়ে কি হাতের মোয়া? সবৎসা গাভীর যে দাম, সবৎসা মেয়ের কি সেই দাম?
অমৃতা-শম্পা এবার দুজনে দুদিকে যাবে। শম্পা যাবে দক্ষিণে—মেঘনাদ সাহা সরণি, অমৃতা যাবে পুবে, সল্টলেক, করুণাময়ী।
সল্টলেকে মা-বাবার কাছেই এখন থাকে অমৃতা। ছেলে সাড়ে পাঁচ মাসের মতো হয়েছে। মা বাবার কাছে থাকাটাই তার স্বাভাবিক। কিন্তু সেই স্বাভাবিকটা কিছুতেই ঘটছিল না। তার গাফিলতিতে, মাসির আন্তরিক অনিচ্ছায়। সে প্রায়ই বলত—মাসি, আর কেন? এবার আমাকে যেতে দাও।’ মাসির চোখ ভারী হয়ে আসত—‘আমাকে’ বলিসনি, বল ‘আমাদের’। তোকে আটকে রাখি এমন কী অধিকার আমার আছে?
—অমন কথা বোলো না মাসি, মা না হয়েও তুমি আমার মা-ই।
—বলছিস?
—বলছি। আরও বলছি, খুব কষ্ট হচ্ছে তবু বলছি, তুমি আমার মায়েরও বাড়া, বাবারও বাড়া। প্রোটেকশন, সন্তানের যে প্রোটেকশন দরকার হয়, তা আমার মা বাবা কোনওদিন আমাকে দিতে পারেনি। বেচারি। এ কথায় তুমি কিছু মনে কোরো না মাসি, কিন্তু আমার মনে হয় ওঁরাই যেন আমার কাছ থেকে নিরাপত্তা চেয়ে এসেছেন বরাবর। সত্যিকার প্রোটেকশন—বাচ্চাকে বুক দিয়ে আগলানো, এ আমি পেলাম তোমার কাছে। এটা কী জিনিস জানতামই না।
শিবানী বললেন—তাহলেই বোঝ তুই চলে গেলে, টুটুল চলে গেলে আমার কেমন দিন কাটবে।
এই কথার উত্তরস্বরূপই যেন সম্পদ এল। অমৃতার দুর্ঘটনা থেকে শুরু করে, তার সন্তান জন্মানো, পরীক্ষা—সব কিছুই তাকে জানাতেন শিবানী। আর কে-ই বা আছে তাঁর, জানাবার? সম্পদ আসবার সুযোগ পায়নি, বিশেষ করে অমৃতা রয়েছে বলেই সে যেন আরও নিশ্চিত হয়ে ছিল। তার প্রণয়পর্ব কতটা এগোল, এসব নিয়েও সে অমৃতাকে লম্বা লম্বা চিঠি লিখত পরামর্শ চেয়ে। যেন তাদের লিঙ্গ আলাদা হলেও এক।
“তোরা মেয়েরা কি যাকে ভালবাসিস তাকে ঠোনা মারিস?
তটিনী আমাকে যখন-তখন ঠোনা মারে, ঠাট্টা-তামাশা করে একেবারে নাস্তানাবুদ করে দেয়। এটা ন্যাচারাল না কি রে?”
কিংবা,
“কী ধরনের উপহার তোরা পছন্দ করিস রে? ফুল না আইসক্রিম?
শাড়ি-ফাড়ি দেওয়া আমার আসবে না। আমার দ্বারা অতটা গেরস্ত হওয়া সম্ভব না।”
জানুয়ারি নাগাদ সম্পদ ক্যাম্পাস-ইন্টারভিউতে চাকরি পেয়ে গেল। তার মা এম.টেক, করবার জন্য পীড়াপীড়ি করলেও সে কান দিল না একদম।
চাকরি বম্বেতে। কিছুদিন কলকাতায় থেকে বম্বে চলে যাবে। সম্পদ একা এল না। তটিনীও এল। ওয়াই.ডাবলু.সি.এ-তে উঠল, তবে বেশিরভাগ সময়টাই কাটাত ডোভার লেনে। সম্পদের সঙ্গে সিনেমা যাচ্ছে, সম্পদের সঙ্গে বাইরে খেতে যাচ্ছে, সম্পদের সঙ্গে কোনও বন্ধুর বাড়ি যাচ্ছে। এক-আধবার অমৃতাকেও সম্পদ অনুরোধ করেছিল। শিবানীকেও, বিশেষ করে বাইরে খেতে যাবার সময়ে। দুজনেই এড়িয়ে গেছেন। শিবানী বাড়িতে রান্না করে খাইয়েছেনও মেয়েটিকে। খুব ভদ্র, কিন্তু একটু যেন দূরে দূরে থাকতেই ভালবাসে তটিনী। অমৃতা যে তার সমবয়সী আরেকটি মেয়ে আছে বাড়িতে, তার সঙ্গে বন্ধুতা হওয়াটাই স্বাভাবিক, এটা তটিনীকে দেখলে মনে হয় না। যখন সকলে একসঙ্গে বসে, তটিনী শুধু সপদের সঙ্গেই কথা বলে, অমৃতাকে যেটুকু গুরুত্ব দেবার সেটুকু দেয় সম্পদই।
—আরে, অমৃতা, সেদিনের খুকি তুই, তোর আবার একটা টুটুল। ভাবতেও পারছি না!
—তোর কি মনে হয় অমৃতা, তটিনী যদি অন্য জায়গায় চাকরি পায়, তাহলে কেরিয়ারে স্যাক্রিফাইসটা কে করবে? আমি না ও?
তটিনী বলে—উই’ল ক্রস দা ব্রিজ হোয়েন উই কাম টু ইট।
একদিন অমৃতা টুটুলকে সবে ঘুম পাড়িয়েছে, ঘড়িতে আন্দাজ রাত দশটা, তার ঘরে ভারী পর্দা টানা। সে শুনতে পেল তটিনী নিচু গলায় জিজ্ঞেস করছে—বাট হু ইজ দিস অমৃতা? —ও হয়তো মনে করেছে অমৃতা ঘুমিয়ে পড়েছে। রাত দশটা বেজে গেছে তো!
সম্পদ বলল—ইটস আ লং হিস্ট্রি তটিনী, বাট শী ইজ লাইক মাই সিস্টার।
তটিনী বলল—লাইক, বাট নট রিয়্যালি, আই থিংক আই ক্যান স্মেল কাফ-লাভ।
সম্পদ খুব হালকা হেসে বলল—দা কোয়েশ্চেন ডাজন’ট অ্যারাইজ। এনি ওয়ে হোয়াট ডাজ কাফ-লাভ মীন হোয়েন য়ু হ্যাভ রিয়্যাল, গ্রোন-আপ লাভ?
তটিনী বলতে বলতে গেল—ওয়ান নেভার নোজ। ইয়োর মাদার সিমস টু হ্যাভ আ ফিক্সেশন অন হার। আই ডোন্ট ফীল কম্ফ…
বাকিটা আর শুনতে পেল না সে।
সে ঠিক করল, আর না, কিছুতেই না, আরও অপ্রিয় কিছু ঘটবার আগে তাকে সল্টলেকে চলে যেতে হবেই।
শিবানী বললেন—এই সময়টাই যে তোকে আমার দরকার ছিল। বিয়ের বাজার-টাজার করতে হবে।
—আমার কথা যদি শোনো মাসি, বাজারটা তটিনীর পছন্দমতো করো। বাকিগুলোর ব্যাপারে আমি তো আছিই। আসা-যাওয়া করব। কী আছে?
সম্পদের বিয়ে হল হায়দ্রাবাদে, রিসেপশন হল কলকাতায়, হনিমুন কেরালায় এবং বসবাস বম্বে। তটিনীও একই ফার্মে কাজ পেয়ে গেল। কয়েকদিনের উৎসব, হইচই, লোকজনের ভিড় থিতিয়ে গেলে শিবানী যে একা সেই একা।
অমৃতা আসে, থাকেও হয়তো একটা দিনরাত। কিন্তু সে এখন সল্টলেকেরই বাসিন্দা। শিবানী মনে মনে জানেন, অমৃতা ঠিকই করেছে, কিন্তু তাতে সান্ত্বনা পান না।
ওয়ালডর্ফের গেট দিয়ে বেরোচ্ছে অমৃতা আর শম্পা, ঢুকছেন ডক্টর কার্লেকর। সঙ্গে একজন মহিলা।
আরে! অমৃতা যে! রম্ভা এই মেয়েটি আমার পেশেন্ট। আর তুমি তো বুঝতেই পারছ ইনি আমার ধর্মপত্নী।
অমৃতা শম্পার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল ডক্টর কার্লেকরের। পরে বেরিয়ে বলল— কী করে সৌমিত্রকে ফাঁকি দিয়ে একটা বাচ্চা বানিয়ে নিবি, সে বিষয়ে ডক্টর কার্লেকরের পরামর্শ নিতে পারিস।
শম্পা বলল—ধ্যাঃ, তোর মুখে আজকাল কিছু আটকায় না।
রঞ্জন কার্লেকরের রগের কাছটা শাদা হতে আরম্ভ করেছে। কিন্তু খুবই ফিট ভদ্রলোক। পঁয়তাল্লিশ-ছেচল্লিশের বেশি বয়স হবে কী? চলাফেরা করেন একেবারে যুবকের মতো।
শম্পা বলল—এই ডাক্তারই তোর জন্যে এত করলেন। কী ভাল না?
হ্যাঁ খুব—অন্যমনস্কভাবে বলল অমৃতা। সে আসলে মনে মনে দেখছিল ভাবছিল রম্ভাকে। ভদ্রমহিলা লম্বায় কার্লেকরের কাছ পর্যন্ত চলে যান। ম্যাজেস্টিক, যেন কুঁদে তৈরি করেছে কেউ গ্র্যানাইট থেকে। মাথার চুলগুলো কোঁকড়া, গাঢ় হেনারঙ, খুব একটা কায়দাদুরস্ত ছাঁট, ঘাড় ঢেকে ছোট্ট ছোট্ট থলোতে নেমেছে, চকচকে শ্যাম গাত্রবর্ণের সঙ্গে অদ্ভূত দেখাচ্ছে। যেন বিষাদপ্রতিমা, অথচ রানির মতো। কোথায় যেন এমন রানির কথা পড়েছে, ক্লিওপেট্রা? কুইন ক্রিস্টিনা? জাহাঙ্গিরের মৃত্যুর পরের নূরজাহান? সে ঠিক মনে করতে পারছে না।
আজকাল সে সল্টলেকে থাকে বলে ডক্টর কার্লেকরের গাড়িটা প্রায়ই দেখতে পায়। উনি তাদের বাড়ির রাস্তায় ঢুকে বাঁদিকে চলে গেলেন, কিংবা ডানদিকের গলিতে। হয়তো তাদের বাড়িই আসছেন মনে করে সে জানলায় গিয়ে দাঁড়াল। নাঃ, উনি চলে যাচ্ছেন। তবে টুটুলকে দেখতে উনি প্রায়ই আসেন। কিন্তু ওঁর মিসেসকে কখনও দেখা হয়নি তার। যেন ডক্টর রঞ্জন কার্লেকর সবসময়েই একজন ডাক্তার। একজন দেবদূত। তাঁর অন্য কোনও পরিচয় নেই। বা থাকলেও অবান্তর। আজ মিসেস রম্ভা কার্লেকরকে দেখে সে যেন হঠাৎই বুঝতে পারল ডক্টর কার্লেকরের একটা অন্য জীবন, অন্য পরিচয় আছে। খুব শক্তিশালী সেই অন্য জীবনের প্রভাব তাঁর ওপরে। রম্ভা যেন চুম্বক-টানে অমৃতার সমস্ত মনোযোগ টেনে নিচ্ছেন। এমন ঋজু অথচ অমন বিষণ্ণ কেন? শক্তি যেন ওঁর সমস্ত আকৃতিতে স্তব্ধ হয়ে রয়েছে। তবে? ওই ডাক্তারের মতো সফল, সুপুরুষ রসিক স্বামী যাঁর …? সে সিসটার মাধুরীর কাছে শুনেছে ওঁদের দুই ছেলেমেয়েই বাইরে পড়ে। সেইজন্য কী? আশ্চর্য লোক তো এঁরা! টাকা রোজগার করে মানুষ কী জন্য? সুখে, শান্তিতে, সপরিবারে থাকবে বলে তো? তা সেই পরিবারের সবচেয়ে চমৎকার সদস্যদের বাইরে রাখতে হলে আর পরিবারেই বা কাজ কী! অত রোজগারই বা কেন? তবে, ধনী লোকেদের আদত এরকমটাই! তার টুটুলকে ছয় কি সাত বছর বয়স হলে সে কি বোর্ডিং-এ পাঠিয়ে দিতে পারবে? অথচ তাকে তো চাকরি করতে হবেই। হয়তো সর্বক্ষণ টুটুলকে সঙ্গ দেওয়া যাবে না। তাতে কী? তার সমাধান তাকে তার মায়ের সঙ্গ থেকে এইভাবে বিচ্ছিন্ন করা? হস্টেলে রেখে মানুষ করলেই ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত, চমৎকার চরিত্রের জোর এ সব লাভ হয়, ফলে সফল হওয়ার স্বাবলম্বী হওয়ার সুযোগ পাওয়া যায়। মানল। কিন্তু তাহলে একজন মানুষীর গর্ভে একজন মানুষের ঔরসে কেন সন্তান আসে! কেন আসে অত প্রাণ গলা স্নেহ-মমতা? না, ডক্টর কার্লেকর এটা ঠিক করেননি। অত হাসিখুশি, আত্মবিশ্বাসী, মানুষ হিসেবে অত চমৎকার ডাক্তারের স্ত্রী নইলে অমন অসুখী হবেন কেন? সে শুনেছে ডক্টর রম্ভা কার্লেকর ডাক্তারি করেন না, তবে ওঁর অনেক অন্য কাজকর্ম আছে, হেল্থ ক্লাব-টাব। এগুলো কি দু দুটো টুটুলের চেয়েও জরুরি?