Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » অন্ধকারের গান (১৯৯৭) || Humayun Ahmed » Page 9

অন্ধকারের গান (১৯৯৭) || Humayun Ahmed

অন্ধকারের গান (১৯৯৭) – Ondhokarer Gaan – 9

বুলুর পা কিছুতেই সারছে না। আজ পায়ের যন্ত্রণায় তার জ্বর এসে গেল। গ্রিন ফার্মেসির ডাক্তার এক গাদা এন্টিবায়োটিক দিয়ে দিয়েছেন। বলেছেন—ভেতরে কাঁটা রয়ে গেছে। বোধ হয়। কেটে বের করতে হবে। আপনি বরং কোন একটা হাসপাতালে ভর্তি হয়ে যান। বুলু অবাক হয়ে বলল, সামান্য কাঁটা ফুটার জন্য হাসপাতালে ভর্তি হব?

কাঁটাটা বের করা দরকার না? পা নিয়ে এতদিন কষ্ট করছেন। এর কোনো মানে হয়?

কোনোই মানে হয় না তবু কুলু তার অচল পা নিয়েই আদাবরে চলে গেল। আজ বুধবার টিউশ্যানির টাকাটা যদি আদায় হয়। ছাত্রের বাবা বিরক্ত মুখে দেখা দিলেন। শুকনো গলায় বললেন, ও আচ্ছা আপনি? বাসায় অনেক গেস্ট। আপনার সঙ্গে কথা বলতে পারছি না মাস্টার সাহেব। বিয়ের একটা আলাপ চলছে। আপনি এক কাজ করুন, সামনের মাসের প্রথম সপ্তাহে চলে আসুন।

বুলু ভেবেই পেল না বিয়ের আলাপের সঙ্গে তার বেতনের সম্পর্কটা কী? অনেক কষ্টে সে অর্ধেক পথ হেঁটে শেষ পর্যন্ত রিকশাই নিয়ে নিল। পকেটে শেষ সম্বল চারটা টাকা রিকশাওয়ালাকে দিয়ে দিতে হবে এই দুঃখে তার প্রায় কেঁদে ফেলতে ইচ্ছা করছে। তিন বার বি.এ ফেল করা ছেলে হাত খরচের টাকা চাইতে পারে না। চাওয়া সম্ভব নয়।

পায়ের ব্যথা বড়ই বাড়ছে। পা শরীরেরই অংশ অথচ মনে হচ্ছে এটা শরীরের অংশ না। পা বিদ্রোহ করে বসেছে। কে জানে শরীরের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের হয়ত আলাদা জীবন আছে।

ব্যথা ভুলে থাকার জন্যই বুলু রিকশাওয়ালার সঙ্গে গল্প করার চেষ্টা করল। এই রিকশাওয়ালা তেমন আলাপী না। যাই জিজ্ঞেস করা হয় সে এক অক্ষরে জবাব দিতে চেষ্টা করে।

বুলুর মনে হল—রিকশাওয়ালাদের জীবন বোধ হয় তেমন মন্দ না। তাদেরকে তিন-তিন বার বি.এ ফেল করার যন্ত্রণা পেতে হয় না। এই কষ্টের তীব্রতা সম্বন্ধে তাদের কোন ধারণাই নেই। যে কোনো শারীরিক কষ্টই সহনীয়। শরীর নির্দিষ্ট মাত্রা পর্যন্ত কষ্ট সহ্য করবে তার চেয়ে বেশি হলে—অজ্ঞান। নিশ্চিন্ত ঘুমের মতো একটা ব্যাপার। তিনবার বি. এ ফেল করে কেউ অজ্ঞান হয় না। হতে পারলে ভালো হত।

বুলু এখন কী করবে?

আবার পরীক্ষা?

কোনো মানে হয় না।

চাকুরি?

চাকুরি তাকে কে দেবে? পিওনের চাকরির জন্যেও আজকাল এম.এ পাশ ছেলে দরখাস্ত করে বসে। ঐদিন পত্রিকায় দেখছিল স্টোর কিপারের একটা চাকরির জন্যে একুশ জন এম.এ পাশ ছেলে দরখাস্ত করেছে। তিন জনের আছে এম ফিল ডিগ্রি। অথচ চাওয়া হয়েছে ম্যাট্রিক পাশ ছেলে।

সে নিজেও একবার ইন্টার দিয়েছিল। সরকারি চাকরির ইন্টার। ফিল্ম এন্ড পাবলিকেশনে প্রুফ রিডার। তার ইন্টারভ্যুর সিরিয়াল হল ১৪০৩। চার দিন ধরে ইন্টারভ চলছে। সে পঞ্চম দিনে বোর্ডর সামনে ঢুকল। বোর্ডের চার জন মেম্বার। চার জনেরই বিধ্বস্ত অবস্থা। মনে হচ্ছে কিছুক্ষণের মধ্যেই এই চার জন একসঙ্গে পাগল হয়ে যাবে।

বুলু অনেকক্ষণ তাদের সামনে বসে রইল কেউ কোনো প্রশ্ন করে না। বুড়ো এক ভদ্রলোক তার পাশের ভদ্রলোককে বললেন, কিছু জিজ্ঞেস করুন। সে মহাবিরক্ত হয়ে বলল, আপনি করুন না কেন? আপনার অসুবিধাটা কী? অপেক্ষাকৃত কম বয়সের এক জনকে দেখা গেল তার সামনে রাখা প্যাডে কী সব ডিজাইন আঁকছে। এবং মুখ বিকৃত করে চোখের সামনে ধরছে। বড় মায়া লাগল বুলুর। এই লোগুলো দিনের পর দিন ইন্টার নিয়ে যাচ্ছে। আরো কত দিন নেবে কে জানে। তাদের মনে এখন হয়ত কোনো প্রশ্নই আর আসছে না। এরা নিশ্চয়ই রাতেও ইন্টারন্যূর দুঃস্বপ্ন দেখছে।

বুলু বলল, স্যার আমি তাহলে যাই?

এই কথায় বোর্ডের সবার মধ্যেই যেন আনন্দের একটা হিল্লোল বয়ে গেল। বুড়ো ভদ্রলোক বললেন, আচ্ছা বাবা যাও।

ডিজাইন যে করেছিল সেও এই প্রথমবারের মতো প্রসন্ন মুখে তার ডিজাইনের দিকে তাকাল।

আজকাল ব্যবসা কথাটা খুব চালু হয়েছে। পাশ করেই ছেলেরা ব্যবসায় নেমে পড়ছে। ব্যবসা কীভাবে করতে হয় বুলু জানে না, শুধু একটা জিনিস জানে। ব্যবসা করতে টাকা লাগে। আচ্ছা বাংলাদেশে এমন কোনো ব্যবসা কি আছে যেখানে টাকা লাগে না? বুলুদের মতো ছেলেদের জন্যে এই জাতীয় কিছু ব্যবসা থাকলে মন্দ হত না।

রিকশার কিছু একটা গণ্ডগোল হয়েছে। বার-বার চেইন পড়ে যাচ্ছে। রিকশাওয়ালা তিক্ত বিরক্ত হয়ে কোত্থেকে একটা ইট এনে শব্দ করে কিসে যেন খানিকক্ষণ পেটাল। তাতেও লাভ হল না। আবার চেইন পড়ে গেল। রিকশাওয়ালা কর্কশ গলায় বলল, হালার রিকশা। বুলুর ইচ্ছা হল রিকশাওয়ালাকে বলে—ভাই তোমার কোনো দোষ নেই, দোষ আমার। আমাকে রিকশায় তুলেছ বলে এই অবস্থা। আমাকে না তুলে অন্য কাউকে তুললে এতক্ষণ পৌঁছে যেতে। বেচারা রিকশাওয়ালা রিকশার হাতল ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। বুলু বলল, ভাই আমার পায়ের অবস্থা খারাপ নয়ত হেঁটে হেঁটে চলে যেতাম। রিকশাওয়ালা জবাব দিল না। কি যেন বিড় বিড় করে বলল। সম্ভবত সেও তার ভাগ্যকে গালাগালি করছে।

ভাগ্য বেচারার জীবন গেল গালি খেয়ে। এই পৃথিবীতে এমন কেউ কি আছে যে তার ভাগ্যকে গালি দেয় না? সবাই দেয়।

বুলু তার চিন্তার স্রোত বদলাতে চেষ্টা করল। এক খাত থেকে চিন্তাটা অন্য খাতে নিয়ে যাওয়া। ব্যাপারটা খুব সহজ নয়। চিন্তা নদীর স্রোতের মতো। এর গতি বদলানো কঠিন তবে বুল পারে। দীর্ঘ দিনের অভ্যাসে এটা সম্ভব হয়েছে। সে ভাবতে শুরু করল—একটা নতুন ধরনের গ্রহের কথা। যে গ্রহটা অবিকল পৃথিবীর মতো। মানুষগুলোও পৃথিবীর মানুষের মতো। তবে তাদের জীবনে অনেকগুলো ভাগ আছে। সেই গ্রহে সবারই কিছু সময় কাটে দারুণ সুখে, কিছুটা দুঃখে, কিছুটা জেলখানায়, কিছুটা দেশ-বিদেশ ঘুরে। সব রকম অভিজ্ঞতা শেষ হবার পর তাকে জিজ্ঞেস করা হয়, হেমানব সন্তান তোমার জীবনে কোনো অপূর্ণ বাসনা আছে? যদি সে বলে—হ্যাঁ আছে। তাহলে তাকে সেই বাসনা পূর্ণ করার সুযোগ দেয়া হয়। যতদিন না তার সমস্ত বাসনা পূর্ণ হয় ততদিন তার মৃত্যু নেই।

বুলুর কল্পনায় অনেক ধরনের পথিবী আছে। সুন্দর পৃথিবীর মতো কসিত পৃথিবীও আছে। সেই পৃথিবীর সব মানুষই নোংরা ও কদাকার। হৃদয়ে ভালবাসা বা মমতা বলে কিছু নেই। যা আছে তার নাম ঘৃণা। সেখানকার সব মানুষ পঙ্কিল জীবন যাপন করে। সেই পৃথিবীতে কোনো চাঁদ নেই। রাতের স্নিগ্ধতা নেই। সব সময় সেই পৃথিবীর আকাশে দুটি গগনে সূর্য।

স্যার নামেন।

বুলু নামল। রিকশাওয়ালা দরদর করে ঘামছে। শরীরের সমস্ত পানি ঘাম হয়ে বেরিয়ে আসছে। টাকা থাকলে বুলু এই বেচারাকে একটা ঠাণ্ডা পেপসি খাওয়াত। টাকা নেই। আচ্ছা, রিকশাওয়ালাদের গায়ের ঘাম নিয়ে কি কোনো কবিতা আছে? একটা চমৎকার কবিতা কি লেখা যায় না? যেমন রিকশাওয়ালার গায়ের ঘাম শুকিয়ে শরীরে লবণের পর্দা পড়েছে। যা দেখাচ্ছে দুধের সরের মতো।

চার টাকা ভাড়া ঠিক করা হয়েছিল। চার টাকা দিয়ে বুলু রিকশা থেকে নামল। তার বেশ লজ্জা করছে। পকেটে দুটা সিগারেট আছে। দুটা সিগারেটের একটা কি সে দেবে রিকশাওয়ালাকে? ব্যাপারটা খুব নাটকীয় হয়ে যায় না?

বুলু খানিকক্ষণ ইতস্তত করে সিগারেট এগিয়ে দিল। নরম গলায় বলল, নেন ভাই একটা সিগারেট নেন।

রিকশাওয়ালা হাত বাড়িয়ে সিগারেট নিল। লোটা খুশি হয়েছে। খুশি নামের ব্যাপারটাও বেশ মজার। এটা একই সঙ্গে অনেক কিছুর উপর নির্ভর করে। কাজেই কোনো একটি বিশেষ ঘটনায় একটা মানুষ কতটুকু খুশি হবে তা কোনোদিন বলা যাবে না।

এই রিকশাওয়ালা অসম্ভব খুশি হয়েছে। সে সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে হাসি মুখে বলল, কি সিগারেট বানায় আইজ কাইল টেস আর নাই। কী কন ভাইজান? আগে বগলা সিগারেট ছিল একটা টান দিলে জেবনের শান্তি। কী ধাখ! ঠিক কইলাম না। ভাইজান?

জ্বি ঠিকই বলেছেন।

ভাইজানের পায়ে হইল কি?

কাঁটা ফুটছে।

আহা কন কি? আস্তে আস্তে যান।

রাতে বুলু কিছু খেল না।

ক্ষিধে নেই।

এক গ্রাস পানি খেয়ে শুয়ে পড়ল। পায়ের যন্ত্রণা খুব বেড়েছে। মনে হচ্ছে হাসপাতালে শেষ পর্যন্ত ভর্তি হতে হবে। হাসপাতালে কী করে ভর্তি হতে হয় কে জানে। কাউকে গিয়ে নিশ্চয়ই বলতে হবে-ভাই আপনাদের এখানে আমি ভর্তি হতে চাই। দয়া করে একটা ব্যবস্থা করে দিন। কিংবা দরখাস্ত করতে হবে। আজকাল একটা সুবিধা হয়েছে দরখাস্ত বাংলায় করলেই হয়। বুলু শুয়ে-শুয়ে দরখাস্তের খসড়া ভাবতে লাগল–

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ,

সবিনয় নিবেদন আমার পায়ে একটি কাঁটা ফুটিয়াছিল। পরবর্তীতে সেই কাঁটার কারণে কিংবা অন্য কোনো জটিলতার কারণে পা ফুলিয়া কোলবালিশ হইয়া গিয়াছে। অতএব আপনাদের হাসপাতালে যদি অনুগ্রহপূর্বক আমাকে ভর্তি করিয়া আমার পায়ের একটা গতি করেন তাহা হইলে বড়ই আনন্দিত হইব।

অসুখের সময়টা বেশ অদ্ভুত। আজে-বাজে জিনিস নিয়ে ভাবতে ভালো লাগে। বুলু শুয়ে শুয়ে বিভিন্ন কায়দায় হাসপাতালের চিঠি নিয়ে ভাবতে লাগল। চলিত ভাষায়, সাধু ভাষায়, বেশ সিরিয়াস ভঙ্গিতে আবার বেশ রসিকতা করে। রসিকতার চিঠিটা ভালো আসছে না। শারীরিক যন্ত্রণা নিয়ে রস করা বেশ কষ্ট। তবু কুলু প্রাণপণ চেষ্টা করছে,

হাসপাতালের প্রিয় ভাইয়া,

ভাইজান আপনি কেমন আছেন? আমার পায়ে একটা কাঁটা ফুটেছে ভাইজান। সংস্কৃতে যাকে বলে কন্টক। আচ্ছা ভাইজান এই কাঁটাটা কী তোলা যায়? কাঁটা তুলতে হয় কাঁটা দিয়ে। আপনাদের কাছে কি কাঁটা আছে?

বীণা ঘরে ঢুকল। কোমল গলায় বলল, দাদা ঘুমুচ্ছ নাকি?

না।

দুধ এনেছি তোমার জন্যে।

দুধ খাবারে।

বীণা ভাইয়ের মাথায় হাত রাখল। গায়ে অনেক জ্বর তবু সে কোমল গলায় বলল, জ্বর তো নেই।

বুলু বলল, নেই তবে আসব আসব করছে।

বীণা ভাইয়ের পাশে বসল। তার ভাব-ভঙ্গি থেকে মনে হচ্ছে কিছু বলতে চায়।

বুলু বলল, কিছু বলবি?

না।

তাহলে বসে থাকি না। তোকে দেখে বিরক্তি লাগছে।

বীণা বসেই রইল।

বুলু বলল, যদি কিছু বলার থাকে বলে চলে যা বীণা। এরকম পাথরের মতো মুখ। করে বসে থাকবি না। চড় মারতে ইচ্ছা করছে।

তোমার একটা চিঠি আমার কাছে আছে দাদা। কিন্তু চিঠিটা তোমাকে দিতে ইচ্ছা করছে না।

কার চিঠি?

অলিকের চিঠি। ওর মাথার ঠিক নেই, কী লিখেছে সে নিজেও বোধ হয় জানে না।

তুই চিঠি পড়েছিস?

হ্যাঁ। খোলা চিঠি দিয়েছে পড়ব না কেন?

আমাকে সেই চিঠি তোর দিতে ইচ্ছে করছে না?

না।

তাহলে দেয়ার দরকার নেই।

ঐ চিঠি পড়লে মেয়েটা সম্পর্কে তোমার ধারণা খারাপ হতে পারে। আমি সেটা চাই না। ও খুব ভালো মেয়ে।

ঠিক আছে চিঠি দিতে হবে না।

ওর সঙ্গে যদি কোনোদিন তোমার দেখা হয় তাহলে তুমি কিন্তু বলবে চিঠি পেয়েছ।

আচ্ছা বলব। এখন তুই দয়া করে বিদেয় হ।

বাবা তোমাকে ডাকছেন দাদা।

বলিস কি?

সন্ধ্যাবেলা তোমার খোঁজ করেছিলেন—তুমি ছিলে না।

বুলু উঠে বসল। নিচু গলায় বলল, বাবা কী করছেন?

খাতাপত্র নিয়ে বসেছেন।

এখন যাব?

যাও।

ভয় ভয় লাগছে। ফেল করার পর এখন পর্যন্ত সিরিয়াস কিছু বলেন নি। আজ বোধ হয় বলবেন।

বীণা কিছু বলল না। বুলু বলল, আমি কী বলব বল তো?

বীণা বলল, তুমি কিছুই বলবে না। চুপচাপ শুনবে। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে বাবা কিছুই বলবেন না।

মিজান সাহেব তাঁর ঘরে। বিছানায় কাগজপত্র ছড়িয়ে বসেছেন। তাঁর হাতে একটা ক্যালকুলেটর। বুলুকে দেখে মুখ তুলে তাকালেন। বুলু বলল, আমাকে ডেকেছিলেন?

মিজান সাহেব কিছু বললেন না। এমনভাবে তাকিয়ে রইলেন যেন ছেলেকে চিনতে পারছেন না। তারপর চোখ নামিয়ে ক্যালকুলেটরের ফিগার দেখে কাগজে লিখলেন। আবার কয়েকটা সংখ্যা টিপলেন। বুলুর ধারণা হল বাবা তার সঙ্গে কথা বলার ব্যাপারে এখন আর আগ্রহী নন। সে চলে যাবে, না আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করবে বুঝতে পারছে না। তার কাশি আসছে অথচ কাশতে সাহস হচ্ছে না। কাশি চাপতে গিয়েও পুরোপুরি চাপতে পারল না। সামান্য শব্দ হল। মিজান সাহেব চোখ তুলে তাকালেন। ভারী গলায় বললেন, কী করবে কিছু ঠিক করেছ?

বুলু জবাব দিল না।

আবার পরীক্ষা দেবে?

জ্বি।

গাধারাই চারবার বি.এ পরীক্ষা দেয়। তারপর অভ্যাস হয়ে যায়। অভ্যাস হয়ে যাবার পর প্রতিবার একবার করে দেয়।

বুলু চুপ করে রইল।

মিজান সাহেব বললেন, তুমি একটা গাধা। তোমাকে দেখে যে কেউ একটা গাধার রচনা লিখতে পারে। মুখ ভর্তি দাড়ি কেন? গাধার মুখে দাড়ি কখনো দেখেছ?

মিজান সাহেব তুমি তুমি করে বলছেন। প্রচণ্ড রাগের সময় ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে তিনি তুমি তুমি করে বলেন।

কাল সাড়ে বারটার সময় তুমি আমার অফিসে আসবে। মনে থাকবে?

জ্বি।

মুখ পরিষ্কার করে আসবে। বাংলাদেশে নাপিতের এখনো অভাব হয় নি। এখন আমার সামনে থেকে যাও।

বুলু চলে যাবার পর-পর মিজান সাহেব বীণাকে ডেকে পাঠালেন। বীণার সঙ্গে তিনি খানিকটা ভদ্র ব্যবহার করলেন। সহজ স্বরে বললেন, বস। খাওয়া-দাওয়া শেষ করেছ?

বীণা বলল, জ্বি।

সে মনে মনে ঘামতে লাগল। বাবা তার সঙ্গেও তুমি তুমি করে কথা বলছেন।

তুমি কি এম. এ পড়তে চাও?

জ্বি।

কেন চাও?

বীণা জবাব দিল না। মিজান সাহেব বললেন, এম.এ কেন পড়তে চাও সেটা শুনি।

আপনি যদি পড়তে নিষেধ করেন পড়ব না।

মিজান সাহেব বললেন, তোমরা আমাকে কী ভাব বল তো? আমি তোমাকে পড়তে নিষেধ করব কেন?

বীণা দাঁড়িয়ে আছে, কিছু বলছে না।

মিজান সাহেব জবাবের জন্যে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বললেন, তোমাকে একটা ঘড়ি দিয়েছিলাম। প্রথম কিছুদিন সারাক্ষণ হাতে থাকত। এখন একবারও দেখি না। যাও ঘড়িটা নিয়ে আস।

বীণা নড়ল না। আগের জায়গাতেই দাঁড়িয়ে রইল।

ঘড়িটা কী তোমার সঙ্গে নেই?

না।

কি করেছ, হারিয়ে ফেলেছ?

জ্বি।

না, ঘড়ি তুমি হারাও নি। রাগ করে ফেলে দিয়েছ, কি, আমি ঠিক বলছি না?

বীণা উত্তর দিল না।

মিজান সাহেব বললেন, আচ্ছা তুমি যাও।

তিনি মেয়েকে ডেকেছিলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে। বীণার একটা ভালো বিয়ের সম্বন্ধ এসেছে এই নিয়ে আলাপ করতে চেয়েছিলেন করতে পারলেন না। লজ্জা লাগল। ছেলে মেয়েদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক সহজ নয়। বীণার মার সঙ্গে এই নিয়ে আলাপ করা দরকার। আলাপ করতে ইচ্ছা করছে না। মূৰ্খ মেয়েছেলে। এদের সাথে আলাপ করা না করা সমান। কিছু বললে চারদিকে ঢাক পিটাতে থাকবে। তবু তিনি রাতে শোবার সময় বললেন, বীণার একটা বিয়ের প্রস্তাব এসেছে।

ফরিদা সঙ্গে-সঙ্গে বিছানায় উঠে বসলেন। আগ্রহ নিয়ে বললেন, ছেলে কী করে?

ডাক্তার।

ডাক্তার ছেলে? বল কি? ডাক্তার ছেলে তো খুব ভালো। প্রাকটিস কেমন? রুগী পত্তর পায় তো?

মিজান সাহেব ঘুমুবার আয়োজন করলেন। এই প্রসঙ্গে কথা বলতে তার আর ভালো লাগছে না। ফরিদা বললেন, ছেলে দেখেছ তুমি?

হুঁ।

দেখতে কেমন?

তিনি জবাব দিলেন না। ফরিদা আবার ক্ষীণ স্বরে বললেন, ছেলে দেখতে কেমন?

মিজান সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, দেখতে ভালো। এখন বিরক্ত করো না তো, ঘুমাও।

ফরিদা সারা রাত ঘুমুতে পারলেন না। অল্পতেই তাঁর মস্তিষ্ক উত্তেজিত হয়। আজও হয়েছে।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *