অথঃ জনৈক বিপ্লবী কথা
এক্ষুনি চক্ষুদান পর্ব শেষ হলো । ঘন্টা দুয়েক দেরি হয়ে গেল , শুধু ডেথ সার্টিফিকেটের ফর্মে , ধর্মের পর শূন্যস্থান ফাঁকা রাখার কারণে । আসলে উনি নিজেকে মানুষ হিসেবেই পরিচয় দিতেন । কিন্তু নিয়মনীতি বজায় রাখতেই হয় । তাই শেষ অবধি অনেক বাকবিতন্ডা সেরে ” ধর্মহীন ” লিখিয়ে তবেই শবদেহ ছাড়া পেল । এবারে দেহদানের উদ্দেশ্যে যাত্রা । সময় বেশি নেই । বিকেল চারটেয় মর্গের দরজা বন্ধ হয়ে যাবে । সেটাই নাকি নিয়ম সাধারণের জন্য ।
শববাহী শকট এগিয়ে চলুক । ততক্ষণে যে মানুষ আজ রবিবার, শব হলেন, তাঁর কিছু স্মৃতিচারণা করা যাক ।
নাম — সুবিমল । পদবী উনি পছন্দ করতেন না । অবিবাহিত । মৃত্যুকালীন বয়স — বিরাশি । আদি বাড়ি — খুলনা জেলার দৌলতপুর ।
অধুনা – কলকাতার নিউটাউন ( ছিল ) ! দাদা, সমবয়সী মাতৃসমা বৌদি আর পুত্র – কন্যার মতো ভাইপো – ভাইঝি
ম্যাট্রিক পরীক্ষার আগে কুটিল রিউমাটয়েড আথ্রারাইটিসের শিকার । ফলে দুহাতের কয়েকটি আঙুল বাঁকা । স্বাধীনতার ছুরি ছিন্নমূল জীবন – পথকে ফালাফালা করে কেটে দেয় ।
তাই নিরন্তর লড়াই । অবশেষে দাদার চাকরি । দিদি ও বোনদের বিয়ে । পরবর্তীতে নিজেরও চাকরি ।
বিলিতি কোম্পানি । তখনকার সময়ে তুলনামূলক ভাবে বেশি মাইনে এবং নিরাপদ আশ্রয় ।
————————————-
এরপরেই এলো সেই উত্তাল সত্তর দশকের বসন্তের বজ্র নির্ঘোষ। গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরার ডাক ।
নিরপদ সুখী জীবনের টান ছিঁড়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন তীক্ষ্ণ শায়কের মতো বিপ্লবের ডাকে । সকল মানুষের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা করার কল্পনায় বিভোর এক স্বপ্নে – পাওয়া বিপ্লবী সুবিমল ।
গোপন ডেরায় রাত্রি যাপন , পুলিশের হাতে ধরা পড়তে পড়তে বেঁচে- যাওয়া , বাড়িতে খানাতল্লাসী । ক্রমে ক্রমে সরোজ দত্ত , সুশীতল রায়চৌধুরী , চারু মজুমদারের হত্যা কিংবা মৃত্যু ! বিপ্লবের জ্বলন্ত দাঔ দাঔ শিখা ক্রমশ নিভে নিভে তুষের ধিকিধিকি আগুন হয়ে শেষ , নব্বইয়ের দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন !
পরমপ্রিয় বন্ধু নবারুণ , তিন বছর জেল খেটে পুনর্বার বহাল হয়েছেন চাকরিতে ।
সুবিমল আর চাকরি পান নি ।
টিউশন করে , দোরে দোরে বই বিক্রি করে যৎসামান্য আয় বৌদির হাতে তুলে দিয়ে রাত্রে ফুটপাতের পথ শিশুদের শিক্ষা দানে সততই রত এক প্রাণ সুবিমল ।
শববাহী শকট ঢুকে পড়েছে হাসপাতালে । নিয়ম মেনে পুলিশ ঘুষ চাইলো । শবদেহ হাজির করা হলো মর্গের সামনের গেটে । গেটের দারোয়ান ঘুস চাইলো । এই সবের আগেই প্রথম বকশিশ চেয়েছিল হাসপাতালের কর্মী- শববাহক ।
জীবনভর অকৃতদার সুবিমল , যে জটিল ব্যাপারটা জানতেন না , কয়েক ঘন্টার মধ্যে সেগুলো বোঝা গেলো, শবদানের ফর্ম পূরণ করতে গিয়ে । অবিবাহিত সুতরাং নিঃসন্তান । নিঃসন্তান অতএব সাক্ষীর সাক্ষরের জটিলতা ।
এইসবের মধ্যেই চারিদিকে মাছি ভন ভন , ভ্যাপসা চাপা দুর্গন্ধে স্যাঁতসেঁতে আসন্ন এক নিঃসঙ্গ রাত্রি যেন নেমে এলো নিশ্চুপ শুয়ে- থাকা সুবিমলের স্ট্রেচারের চারপাশে ।
আজন্ম সৎ , উদার , মহান বিপ্লবী আজ জনতাহীন একা শুয়ে আছেন এই এক অদ্ভুত আঁধারে ।
উনি কোনও নেতা বা বিধায়ক , মন্ত্রী কিংবা সাংসদ ছিলেন না । শুধুমাত্র সাধারণ একজন মনে প্রাণে বিশ্বাসী জনৈক বিপ্লবী ।
সঙ্গে ছিলেন সেই চির – বন্ধু নবারুণ কাকু । হঠাৎই গুমড়ে – থাকা আবেগ এসে ঝাঁকুনি দিলো আমার মস্তিষ্ক কোষের গভীরে । বোধকরি চেঁচিয়েই উঠলাম —- নবারুণ কাকু , কমরেডকে রেড স্যালুট দেবেন না ?