Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

ভবেশ ভট্টাচার্যের সঙ্গে পোস্টকার্ডে অ্যাপায়েন্টমেন্ট করা ছিল, তাই তাঁর দর্শন পেতে দেরি হল, না! ইস্কুল মাস্টার টাইপের চেহারা, চোখে মোটা চশমা, গায়ে ফতুয়ার উপর একটা এন্ডির চাদর, বসেছেন তক্তপোশে, সামনে ডেস্কের উপর গোটা পাঁচেক ছুচোলো করে কাটা পেনসিল, আর একটা খোলা খেরোর খাতা।

লালমোহন গঙ্গোপাধ্যায়?-পোস্টকার্ডে নামটা পড়ে জিজ্ঞেস করলেন ভদ্রলোক। লালমোহনবাবু মাথা নাড়লেন।বয়স কত হল? লালমোহনবাবু বয়স বললেন।

জন্মতারিখ?

উনত্রিশে শ্রাবণ।

হুঁ…সিংহ রাশি। তা আপনার জিজ্ঞাসাটা কী?

আজ্ঞে আমি রহস্য রোমাঞ্চ সিরিজে উপন্যাস লিখি। আমার আগামী উপন্যাসের তিনটি নাম ঠিক করা আছে। কোনটা ব্যবহার করব যদি বলে দেন।

কী কী নাম?

‘কারাকোরামে রক্ত কার?’, ‘কারাকোরামের মরণ কামড়’, আর ‘নরকের নাম কারাকোরাম’।

হুঁ। দাড়ান।

ভদ্রলোক নামগুলো খাতায় লিখে নিয়ে কী সব যেন হিসেব করলেন, তার মধ্যে যোগ বিয়োগ গুণ ভাগ সবই আছে। তারপর বললেন, আপনার নাম থেকে সংখ্যা পাচ্ছি একুশ, আর জন্ম-মাস এবং জন্মতারিখ মিলিয়ে পাচ্ছি। ছয়। তিন সাতে একুশ, তিন দুগুণে ছয়। অর্থাৎ তিনের গুণণীয়ক না হলে ফল ভাল হবে না। আপনি তৃতীয় নামটাই ব্যবহার করুন। তিন আঠারং চুয়ান্ন। কবে বেরোচ্ছে বই?

আজ্ঞে পয়লা জানুয়ারি।

উঁহু। তেসরা করলে ভাল হবে, অথবা তিনের গুণণীয়ক যে-কোনও তারিখ।

আর, ইয়ে–বিক্রিটা–?

বই ধরবে।

একশোটি টাকা খামে পুরে দিয়ে আসতে হল। ভদ্রলোককে। লালমোহনবাবুর তাতে বিন্দুমাত্ৰ আক্ষেপ নেই। উনি ষোল আনা শিওর যে বই হিট হবেই। বললেন, মনের ভার নেমে গিয়ে অনেকটা হালকা লাগছে মশাই।

তার মানে এবার থেকে কি প্রত্যেক বই বেরোবার আগেই মেচেদা–?

বছরে দুটি তো! সাক্সেসের গ্যারান্টি যেখানে পাচ্ছি…

ভট্টাচার্য মশাইয়ের কাছে বিদায় নিয়ে একটা চায়ের দোকানে চা খেয়ে আমরা বৈকুণ্ঠপুর রওনা দিলাম। নবকুমারবাবুর নির্দেশ অনুযায়ী পেট্রল পাম্পে জিজ্ঞেস করে নিয়োগী প্যালেসে পৌঁছাতে লাগল বিশ মিনিট।

বাড়ির বয়স যে দুশো সেটা আর বলে দিতে হয় না। খানিকটা অংশ মেরামত করে রং করা হয়েছে সম্প্রতি, বাড়ির লোকজন বোধহয় সেই অংশটাতেই থাকে। দুদিকে পাম গাছের সারিওয়ালা রাস্তা পেরিয়ে বিরাট পোর্টিকের নীচে এসে আমাদের গাড়ি থামল। নবকুমারবাবু গাড়ির আওয়াজ পেয়েই নীচে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। একগাল হেসে আসুন আসুন বলে আমাদের ভিতরে নিয়ে গেলেন। আমরা কথা রাখব কি না। এ বিষয়ে তাঁর খানিকটা সংশয় ছিল এটাও বললেন।

বাবাকে আপনার কথা বলেছি, সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠতে উঠতে বললেন ভদ্রলোক। আপনারা আসছেন শুনে উনি খুব খুশি হলেন।

আর কে থাকেন এ বাড়িতে গ্ল জিজ্ঞেস করল ফেলুদা।

সব সময় থাকার মধ্যে বাবা আর মা! মা-র জন্যেই থাকা। ওঁর শ্বাসের কষ্ট। কলকাতার ক্লাইমেট সহ্য হয় না। তা ছাড়া বঙ্কিমবাবু আছেন। বাবার সেক্রেটারি ছিলেন। এখন ম্যানেজার বলতে পারেন। আর চাকর-বাকার; আমি মাঝে মধ্যে আসি; এমনিতেওঁ আমি ফ্যামিলি নিয়ে আর ক’দিন পরেই আসতাম। এ বাড়িতে পুজো হয়, তাই প্রতিবারই আসি। এবারে একটু আগে এলাম। কারণ শুনলাম বাড়িতে অতিথি আছে-আমার কাকা, চন্দ্ৰশেখরের ছেলে, রোম থেকে এসেছেন। ক’দিন হল–তই মনে হল বাবা হয়তো একা ম্যানেজ করতে পারছেন না।

আপনার কাকার সঙ্গে আপনাদের যোগাযোগ আছে বুঝি?

একেবারেই না। এই প্রথম এলেন। বোধহয় দাদুর সম্পত্তির ব্যাপারে।

আপনার দাদু কি মারা গেছেন?

খবরাখবর নেই বহুদিন। বোধহয় মৃত বলেই ধরে নিতে হবে।

উনি রোম থেকে ফিরে এসে এখানেই থাকতেন?

হ্যাঁ।

কলকাতায় না থেকে এখানে কেন?

কারণ উনি যাদের ছবি আঁকতেন তারা সারা ভারতবর্ষে ছড়ানো। নেটিভ স্টেটের রাজা মহারাজা। কাজেই ওঁর পক্ষে কলকাতায় থাকার কোনও বিশেষ সুবিধে ছিল না।

আপনি আপনার দাদুকে দেখেছেন?

উনি যখন বাড়ি ছেড়ে চলে যান। তখন আমার বয়স ছয়। আমায় ভালবাসতেন। খুব এইটুকু মনে আছে।

বৈঠকখানায় আসবাবের চেহারা দেখে চোখ টেরিয়ে গেল। মাথার উপরে ঘরের দুদিকে দুটো ঝাড়লণ্ঠন রয়েছে যেমন আর আমি কখনও দেখিনি। একদিকের দেয়ালে প্রায় আসল মানুষের মতো বড় একটা পোট্রেট রয়েছে। একজন বৃদ্ধেরু-গায়ে জোব্বা, কোমরে তলোয়ার, মাথায় মণিমুক্ত বসানো পাগড়ি। নবকুমার বললেন। ওটা ওঁর প্রপিতামহ অনন্তনাথ নিয়োগীর ছবি। চন্দ্ৰশেখর ইন্টালি থেকে ফিরে এসেই ছবিটা এঁকেছিলেন। — ছেলে ইটালিয়ান মেয়ে বিয়ে করেছে শুনে অনন্তনাথ বেজায় বিরক্ত হয়েছিলেন। বলেছিলেন। আর কোনওদিন ছেলের মুখ দেখবেন না। কিন্তু শেষ বয়সে ওঁর মনটা অনেক নরম হয়ে যায়। দাদু বিপত্নীক অবস্থায় ফিরলে উনি দাদুকে ক্ষমা করেন, এবং উনিই দাদুর প্রথম সিটার।

আমি একটা কথা না জিজ্ঞেস করে পারলাম না।

এস, নিয়োগী লেখা দেখছি কেন? ওঁর নাম তো ছিল চন্দ্ৰশেখর।

রোমে গিয়ে ওঁর নাম হয়। সানড্রো। সেই থেকে ওই নামই লিখতেন নিজের ছবিতে।

পোস্ট্রেট ছাড়া ঘরে আরও ছবি ছিল এস, নিয়োগীয় আঁকা। আর্টের বইয়ে যে সব বিখ্যাত বিলিতি পেস্টারের ছবি দেখা যায়, তার সঙ্গে প্রায় কোনও তফাত নেই। বোঝাই যায় দুর্দান্ত শিল্পী ছিলেন সানড্রো নিয়োগী।

একজন চাকর শরবত নিয়ে এল। ষ্ট্রে থেকে একটা গেলাস তুলে নিয়ে ফেলুদা প্রশ্ন করল।

ওই প্ৰবন্ধটাতে ভদ্রলোক লিখেছেন চন্দ্ৰশেখরের ব্যক্তিগত সংগ্রহে নাকি কোনও বিখ্যাত বিদেশি শিল্পীর আঁকা একটি পেন্টিং ছিল। অবিশ্যি ভদ্রলোক শিল্পীর নাম বলেননি, কারণ চন্দ্ৰশেখরই নাকি ওঁকে বলতে বারণ করেছিলেন–বলেছিলেন বললে কেউ বিশ্বাস করবে: না। আপনি কিছু জানেন এই পেন্টিং সম্বন্ধে?

নবকুমারবাবু বললেন, দেখুন, মিস্টার মিত্ৰ-পেন্টিং একটা আছে। এটা আমাদের পরিবারের সকলেই জানে। বেশি বড় না। এক হাত বাই দেড় হাত হবে। একটা ক্রাইস্টের ছবি। সেটা কোনও বিখ্যাত শিল্পীর আঁকা কি না বলতে পারব না। ছবিটা দাদু নিজের স্টুডিয়োর দেয়ালেই টাঙিয়ে রাখতেন, অন্য কোনও ঘরে টাঙানো দেখিনি কখনও।

অবিশ্যি যিনি প্রবন্ধটা লিখেছেন তিনি জানেন নিশ্চয়ই।

তা তো জানবেনই, কারণ ভগওয়ানগড়ের এই রাজার সঙ্গে দাদুর খুবই বন্ধুত্ব ছিল।

আপনার কাকা জানতেন না? যিনি এসেছেন?

নবকুমার মাথা নাড়লেন।

আমার বিশ্বাস বাপ আর ছেলের মধ্যে বিশেষ সম্ভাব ছিল না। তা ছাড়া কাকা বোধহয় আর্টের দিকে যাননি।

তার মানে ওই ছবির সঠিক মূল্যায়ণ এ বাড়িএ কেউ করতে পারবে না?

কাকা না পারলে আর কে পারবে বলুন। বাবা হলেন গানবাজনার লোক! বাতদিন ওই নিয়েই পড়ে থাকতেন। আর্টের ব্যাপারে আমার যা জ্ঞান, ওঁরাও সেই জ্ঞান; আর আমার ছোটভাই নন্দকুমার সম্বন্ধেও ওই একই কথা।

তিনিও গানবাজনা নিয়ে থাকেন বুঝি?

না। ওর হল অ্যাকটিং-এর নেশা। আমাদের একটা ট্র্যাভেল এজেন্সি আছে কলকাতায়। বাবাই করেছিলেন, আমরা দুজনেই পার্টনার ছিলাম তাতে। নন্দ সেভেস্টি-ফাইভে হঠাৎ সব ছেড়ে ছুড়ে বম্বে চলে যায়। ওর এক চেনা লোক ছিল ওখানকার ফিল্ম লাইনে। তাকে ধরে হিন্দি ছবিতে একটা অভিনয়ের সুযোগ করে নেয়। তারপর থেকে ওখানেই আছে।

সাকসেসফুল?

মনে তো হয় না। ফিল্ম পত্রিকায় গোড়ার দিকের পরে তো আর বিশেষ ছবিটবি দেখিনি ওর।

আপনার সঙ্গে যোগাযোগ আছে?

মোটেই না। শুধু জানি নেপিয়ান সি রোডে একটা ফ্ল্যাটে থাকে। বাড়ির নাম বোধহয় সি-ভিউ; মাঝে মাঝে ওর নামে চিঠি আসে। সেগুলো রিডাইরেক্ট করতে হয়। ব্যাস।

সরবত শেষ করে আমরা নবকুমারবাবুর বাবার সঙ্গে দেখা করতে গেলাম।

দক্ষিণের একটা চওড়া ঝরান্দায় একটা ইংরেজি পেপারব্যাক চোখের খুব কাছে নিয়ে আরাম কেদারায় বসে আছেন ভদ্রলোক।

আমাদের সঙ্গে পরিচয়ের পর ভদ্রলোক ছেলেকে বললেন, টুমরীর কথা বলেছিস এঁকে?

নবকুমারবাবু একটু অপ্রস্তুত ভাব করে বললেন, তা বলেছি। তবে ইনি এমনি বেড়াতে এসেছেন, বাবা।

ভদ্রলোকের ভুরু কুঁচকে গেল।

কুকুর বলে তোরা ব্যাপারটাকে সিরিয়াসলি নিচ্ছিস না, এটা আমার মোটে ভাল লাগছে। না। একটা অবোলা জীবকে যে-লোকে এভাবে হত্যা করে তার কি শাস্তি হওয়া উচিত নয়? শুধু কুকুরুকে মেরেছে তা নয়, আমার চাকরকে শাসিয়েছে। তাকে মোটা ঘুষ দিয়েছে। নইলে সে পালাত না। ব্যাপারটা অনেক গণ্ডগোল। আমার তো মনে হয় যে-কোনও ডিটেকটিভের পক্ষে এটা একটা চ্যালেঞ্জিং ব্যাপার। মিস্টার মিত্তির কী মনে করেন জানি না।

আমি আপনার সঙ্গে একমত, বলল ফেলুদা!

যাক! আমি শুনে খুশি হলুম। এবং সে লোককে যদি ধরতে পারেন তো আরও খুশি হব। ভাল কথা–সৌম্যশেখরবাবু ছেলের দিকে ফিরলেন—তোর সঙ্গে রবীনবাবুর দেখা হয়েছে?

রবীনবাবু? নবকুমারবাবু বেশ অবাক। তিনি আবার কে?

একটি জানালিস্ট ভদ্রলোক। বয়স বেশি না। আমায় লিখেছিল আসবে বলে। চন্দ্ৰশেখরের জীবনী লিখবে। একটা ফেলোশিপ না গ্রন্ট কী জানি পেয়েছে। সে দু দিন হল এসে রয়েছে। অনেক তথ্য সংগ্রহ করেছে। ইটালিও যাবে বলে বলছে। বেশ চৌকস ছেলে; আমার সঙ্গে কথা বলে সকলে ঘণ্টাখানেক ধরে। টেপ করে নেয়।

তিনি কোথায় এখন?

বোধহয় তার ঘরেই আছে। এক তলায় উত্তরের বেডরুমটীয় রয়েছে। আরও দিন দশোক থাকবে। রাতদিন কাজ করে।

সামলানোর আর কী আছে; রোম থেকে আসা খুড়তুতো ভাইটিকে তো সারাদিন প্ৰায় চাখেই দেখি না। আর যখন দেখিও, দুচারটের বেশি কথা হয় না। এমন মুখচোরা লোক দুটি দেখিনি।

যখন কথা বলেন কী ভাষায় বলেন? ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।

ইংরিজি বাংলা মেশানো। বললে চন্দ্ৰশেখর নাকি ওর সঙ্গে বাংলাই বলত। তবে সেও তো আজ প্ৰায় চল্লিশ বছর হয়ে গেছে। চন্দ্ৰশেখর যখন দেশে ফেরে তখন ছেলের বয়স আঠারো-উনিশ। বাপের সঙ্গে বোধহয় বিশেষ বনত না। পাছে কিছু জিজ্ঞেস-টিজ্ঞেস করি তাই বোধহয় কথা বলাটা অ্যাভয়োড় করে। ভেবে দেখুন-আমার নিজের খুড়তুতো ভাই, তাকে পাসপোর্ট দেখিয়ে বোঝাতে হল। সে কে!

ইন্ডিয়ান পাসপোর্ট কি? ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।

তই তো দেখলাম।

নবকুমার বললে, তুমি ভাল করে দেখেছিলে তো?

ভাল করে দেখার দরকার হয় না। সে যে নিয়োগী পরিবারের ছেলে সে আর বলে দিতে হয় না।

উনি সম্পত্তির ব্যাপারেই এসেছেন তো? জিজ্ঞেস কবল ফেলুদা।

হ্যাঁ; এবং পেয়েও যাবে। সে নিজে তার বাবার কোনও খবরই জানত না। তাই রোম থেকে চিঠি লিখেছিল আমায়। আমিই তাকে জানাই যে দশ বছর হল তার বাপের কোনও খোঁজ নেই। তার পরেই সে এসে উপস্থিত হয়।

ফেলুদা বলল, চন্দ্ৰশেখরের সংগ্রহে যে বিখ্যাত পেন্টিংটা আছে সেটা সম্বন্ধে উনি কিছু জানেন? কিছু বলেছেন?

না। ইনি নাকি ইঞ্জিনিয়ারিং-এর লোক। আর্টে কোনও ইন্টারেস্ট নেই!..তবে ছবিটার খোঁজ করতে লোক এসেছিল।

কে? জিজ্ঞেস করলেন নবকুমারবাবু।

সোমানি না। কী যেন নাম। বঙ্কিমের কাছে তার নাম ঠিকানা আছে। বললে এক সাহেব কালেক্টর নাকি ইন্টারেস্টেড। এক লাখ টাকা অফার করলে। প্রথমে পঁচিশ হাজার দেবে, তারপর সাহেব দেখে জেনুইন বললে বাকি টাকা; দিন পনেরো আগের ঘটনা। তখনও রুদ্রশেখর আসেনি, তবে আসবে বলে লিখেছে। সোমানিকে বললাম এ হল আর্টিস্টের ছেলের প্রপার্টি। সে ছেলে আসছে। যদি বিক্রি করে তো সেই করবে! আমার কোনও অধিকার নেই।

সে লোক কি আর এসেছিল? ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।

এসেছিল বই কী। সে নাছোড়বান্দা। এবার রুদ্রশেখরের সঙ্গে কথা বলেছে।

কী কথা হয়েছিল জানেন?

না। আর রুদ্র যদি বিক্রিও করতে চায়, আমাদের তো কিছু বলার নেই। তার নিজের ছবি সে যা ইচ্ছে করতে পারে।

কিন্তু সেটা সম্পত্তি পাবার আগে তো নয়, বলল ফেলুদা।

না, তা তো নয়ই।

খাবার সময় দুজন ভদ্রলোকের সঙ্গেই দেখা হল। রবীনবাবু সাংবাদিককে দেখে হঠাৎ কেন জানি চেনা-চেনা মনে হয়েছিল। হয়তো কোনও কাগজে ছবি-টবি বেরিয়েছে। কখনও। দাড়ি-গোঁফ কামানো, মাঝারি রং, চোখ দুটো বেশ উজ্জ্বল। বয়স ত্রিশ-পয়ত্ৰিশের বেশি না। বললেন অদ্ভুত সব তথ্য ধার করেছেন চন্দ্ৰশেখর নিয়োগী সম্বন্ধে। স্টুডিয়োতে একটা কাঠের বাক্সে নাকি অনেক মূল্যবান কাগজপত্র আছে।

রুদ্রশেখরবাবু থাকতে আপনার খুব সুবিধে হয়েছে বোধহয়? বলল ফেলুদা, ইটালির অনেক খবর তো আপনি এঁর কাছেই পাবেন।

ওঁকে আমি এখনও বিরক্ত করিনি, বললেন রবীনবাবু, উনি নিজে ব্যস্ত রয়েছেন। আপাতত আমি চন্দ্ৰশেখরের ভারতবর্ষে ফিরে আসার পরের অংশটা নিয়ে রিসার্চ করছি।

রুদ্রশেখরের মুখ দিয়ে একটা হুঁ ছাড়া আর কোনও শব্দ বেরোল না।

বিকেলে নবকুমারবাবুর সঙ্গে একটু বেড়াতে বেরিয়েছিলাম, কাছেই পোড়া ইটের কাজ করা দুটো প্রাচীর মন্দির আছে সেগুলো নাকি খুবই সুন্দর। ফটক দিয়ে বেরিয়ে গ্রামের রাস্তায় পড়তেই একটা কাণ্ড হল। পশ্চিম দিক থেকে ঘন কালো মেঘ এসে আকাশ ছেয়ে ফেলল, আর দশ মিনিটের মধ্যেই বজ্ৰপাতের সঙ্গে নামল তুমুল বৃষ্টি। লালমোহনবাবু বললেন এরকম ড্রামাটিক বৃষ্টি তিনি কখনও দেখেননি। সেটার একটা কারণ অবশ্য এই যে এ রকম খোলা প্রান্তরে বৃষ্টি দেখার সুযোগ শহরবাসীদের হয় না।

দৌড় দেওয়া সত্ত্বেও বৃষ্টির ফোঁটা এড়ানো গেল না। তারপর বুঝতে পারলাম যে এ বৃষ্টি সহজে ধরার নয়। আর আমাদের পক্ষে এই দুৰ্য্যেগের সন্ধ্যায় কলকাতায় ফেরাও সম্ভব নয়।

নবকুমারবাবু অবিশ্যি তাতে বিন্দুমাত্র বিচলিত হলেন না। বললেন বাড়তি শোবার ঘর কম করে দশখানা আছে। এ বাড়িতে। খাট বালিশ তোশক চাদর মশারি সবই আছে; কাজেই রাত্তিরে থাকার ব্যবস্থা করতে কোনওই হাঙ্গামা নেই। পরার জন্য লুঙ্গি দিয়ে দেবেন। উনি, এমনকী গায়ের আলোয়ান, ধোপে কাচা পাঞ্জাবি, সবই আছে। -আমাকে এখানে মাঝে মাঝে আসতে হয় বলে কয়েক সেট কাপড় রাখাই থাকে। আপনারা কোনও চিন্তা করবেন না।

উত্তরের দিকে পাশাপাশি দুটো পোল্লায় ঘরে আমাদের বন্দাবস্ত হল। লালমোহনবাবু একা একটি জাঁদরেল খাট পেয়েছেন, বললেন, এক’দিন-কা সুলতানের গপ্লের কথা মনে পড়ছে মশাই।

তা খুব ভুল বলেননি। দুপুরে শ্বেত পাথরের থালাবাটি গোলাসে খাবার সময় আমারও সে কথা মনে হয়েছিল। স্নাত্তিরে দেখি সেই সব জিনিসই রুপোর হয়ে গেছে।

আপনার দাদুর স্টুডিয়োটা কিন্তু দেখা হল না, খেতে খেতে বলল ফেলুদা।

সেটা কাল সকালে দেখাব, বললেন নবকুমারব্বাবু।আপনারা যে দুটো ঘরে শুচ্ছেন, ওটা ঠিক তারই উপরে।

যখন শোবার বন্দোবস্ত করছি, তখন বৃষ্টিটা ধরে গেল। জানালায় দাঁড়িয়ে দেখলাম ধ্রুবতারা দেখা যাচ্ছে। চারিদিকে অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। রাজবাড়ির পিছনে বাগান, সামনে মাঠ। আমাদের ঘর থেকে বাগানটাই দেখা যাচ্ছে, তার গাছে গাছে জোনাকি জ্বলছে। অন্য কোনও বাড়ির শব্দ এখানে পৌঁছায় না, যদিও পুবে বাজারের দিক থেকে ট্রানজিস্টারের গানের একটা ক্ষীণ শব্দ পাচ্ছি।

সাড়ে দশটা নগাত লালমোহনবাবু গুডনাইট করে তাঁর নিজের ঘরে চলে গেলেন। দুই ঘরের মাঝখানে একটা দরজা আছে। ভদ্রলোক বললেন সেটা বেশ কনভিনিয়েন্ট।

এই দরজা দিয়েই ভদ্রলোক মাঝরাত্তিরে ঢুকে এসে চাপা গলায় ডাক দিয়ে ফেলুদার ঘুম ভাঙলেন। সঙ্গে সঙ্গে অবিশ্যি আমারও ঘুম ভেঙে গেল।

কী ব্যাপার মশাই? এত রাত্তিরে?

শ্‌ শ্‌ শ্‌ শ্‌! কান পেতে শুনুন।

কোন পাতলাম। আর শুনলাম।

খচ্‌ খচ্‌ খচ্‌ খচু…

মাথার উপর থেকে শব্দটা আসছে। একবার একটা খুঁট শব্দও পেলাম! কেউ হাঁটাচলা করছে।

মিনিট তিনেক পরে শব্দ থেমে গেল।

উপরেই সানড্রো নিয়োগীর স্টুডিয়ো।

ফেলুদা ফিসফিস করে বলল, তোরা থাক, আমি একটু ঘুরে আসছি।

ফেলুদা খালি পায়ে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল।

লালমোহনবাবু আর আমি আমাদের খাটে বসে রইলাম। প্রচণ্ড সাসপেন্স, ফেলুদা না-আসা পর্যন্ত হৃৎপিণ্ডটা ঠিক আলজিভের পিছনে আটকে রইল। প্রাসাদের কোথায় যেন ঘড়িতে ঢং ঢেং করে দুটো বাজল। তারপর আরও দুটো ঘড়িতে।

মিনিট পাঁচেকের মধ্যে আবার ঠিক তেমনি নিঃশব্দে এসে ঘরে ঢুকল ফেলুদা।

দেখলেন কাউকে? চাপা গলায় ঘড়ঘড়ে গলায় লালমোহনবাবুর প্রশ্ন।

ইয়েস।

কাকে?

।সিঁড়ি দিয়ে এক তলায় নেমে গেল।

কে?

সাংবাদিক রবীন চৌধুরী।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress