Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

শিবপুরের ট্রাফিক আর ঘন বসতি পেরিয়ে ন্যাশনাল হাইওয়ে নাম্বার সিকস-এ আমাদের গাড়িটা পড়তেই যেন একটা নতুন জগতে এসে পড়লাম। আমাদের গাড়ি মানে রহস্য রোমাঞ্চ ঔপন্যাসিক লালমোহন গাঙ্গুলী ওরফে জটায়ুর সবুজ অ্যাম্বাসাডার। গাড়ি কেনার পয়সা ফেলুদার নিজের কোনও দিন হবে বলে মনে হয় না। এ দেশের প্রাইভেট ইনভেসটিগেটরের রোজগারে গাড়ি বাড়ি হয় না। আমাদের রজনী সেন রোডের ফ্ল্যাট ছেড়ে ফেলুদা কিছুদিন থেকেই একটা নিজের ফ্ল্যাটে যাবার চিন্তা করছিল, বাবা সেটা জানতে পেরে এক ধমকে ফেলুদাকে ঠাণ্ডা করেছেন।সুখে থাকতে ভূতে কিলোয়, বললেন বাবা। যেই একটু রোজগার বেড়েছে আমনি নিজের ফ্ল্যাটের ধান্দা। পরে পসার কমলে যদি আবার সুড়সুড়ি করে এই কাকার ফ্ল্যাটেই ফিরে আসতে হয়? সেটার কথা ভেবেছিস কি? তারপর থেকে ফেলুদা চুপ।

আর গাড়ির ব্যাপারে জটায়ুর তো আগে থেকেই বলা আছে।ধরে নিন আমার গাড়ি ইজ ইকুয়াল টু আপনার গাড়ি। আপনি আমার এত উপকার করেছেন, এই সামান্য প্রিভিলেজটুকু তো আপনার ন্যায্য পাওনা মশাই।

উপকারের ব্যাপারটা লালমোহনবাবুর ভাষাতেই বলা ভাল! ওঁর জীবনের অনেকগুলো বন্ধ দরজা নাকি ফেলুদা এসে খুলে দিয়েছে। তাতে নাকি উনি শরীরে নতুন বল মনে নতুন সাহস আর চোখে নতুন দৃষ্টি পেয়েছেন। আর, কত জায়গায় ঘোরা হল বলুন তো আপনার দৌলতে-দিল্লি, বোম্বাই, কাশী, সিমলা, রাজস্থান, সিকিম, নেপাল-ওঃ! ট্র্যাভেল ব্ৰডনস দি মাইন্ড—এটা শুনে এসেছি সেই ছেলেবেলা থেকে। এটার সত্যতা উপলব্ধি করলুম তো আপনি আসার পর।

এবারের ট্রাভেলটায় মনের প্রসার কতটা বাড়বে জানি না। ক্যালকাটা টু মেচেদা ভ্ৰমণ বলতে তেমন কিছুই নয়। তবে লালমোহনবাবুরাই ভাষায় আজকাল কলকাতায় বাস করা আর ব্ল্যাক হোলে বাস করা নাকি একই জিনিস। সেই ব্ল্যাক হাল থেকে একটি দিনের জন্যও যদি বাইরে বেরিয়ে আসা যায় তা হলে খাঁটি অক্সিজেন পেয়ে মানুষের আয়ু নাকি কমপক্ষে তিন মাস বেড়ে যায়।

অনেকেই হয়তো ভাবছে। এত জায়গা থাকতে মেচেদা কেন। তার কারণ সংখ্যাতাত্ত্বিক ভবেশচন্দ্ৰ ভট্টাচার্য। মাস তিনেক হল এর কথা কাগজে পড়ার পর থেকেই লালমোহনবাবুর রোখি চেপেছে এর সঙ্গে দেখা করার।

এই ভবেশ ভট্টাচার্য নাকি সংখ্যাতত্ত্বের সাহায্যে লোকেদের নানা রকম অ্যাডভাইস দিয়ে তাঁদের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিচ্ছেন। বড় বড় ব্যবসাদার, বড় বড় কোম্পানির মালিক, খবরের কাগজের মালিক, ফিল্মের প্রযোজক, বইয়ের প্রকাশক, উপম্যাসের লেখক, উকিল, ব্যারিস্টার, ফিল্মস্টার-সব রকম লোক নাকি এখন তাঁর মেচেদার বাড়ির দরজায় কিউ দিচ্ছে। জটায়ুর শেষ উপন্যাসের কাটতি আগের তুলনায় কম—এক মাসে তিনটে এডিশনের বদলে দুটো এডিশন হয়েছে। জটায়ুর বিশ্বাস উপন্যাসের নামে গণ্ডগোল ছিল, তাই এবার ভটচার্য মশাইয়ের অ্যাডভাইস নিয়ে নতুন বইয়ের নামকরণ হবে, তারপর সেটা বাজারে বেরুবে 1 ফেলুদার মত অবিশ্যি আলাদা! গত উপন্যাসটা পড়েই ফেলুদা বলেছিল রংটা বেশি চড়ে গেছে। —সাত-সাতটা গুলি খাওয়া সত্ত্বেও আপনার হিরোকে বাঁচিয়ে রাখাটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না, লালমোহনবাবু?

কী বলছেন মশাই! একি যেমন–তেমন হিরো? প্রখর রুদ্র ইজ এ সুপার-সুপারসুপারম্যান ইত্যাদি। এবারের গল্পটা ফেলুদার মতে বেশ জমেছে, নামের রদবদলে বিক্রির এদিক ওদিক হবার সম্ভাবনা কম। কিন্তু তাও লালমোহনবাবু একবার সংখ্যাতাত্ত্বিকের মত না নিয়ে ছাড়বেন না। তাই মেচেদা।

ন্যাশনাল হাইওয়ে সিকস। খুব বেশি দিন হল তৈরি হয়নি। এই রাস্তাই সোজা চলে গেছে বম্বে! গ্র্যান্ড ট্যাঙ্ক রোডের ধারে ধারে যেমন সব প্রাচীন গাছ দেখা যায়, এখানে তা একেবারেই নেই। বাড়ি-ঘরও বেশি নেই, চারিদিক খোলা, আশ্বিন মাসের প্রকৃতির চেহারাটা পুরোপুরি পাওয়া যায়। ড্রাইভার হরিপদবাবু স্পিডোমিটারের কাঁটা আশি কিলোমিটারে রেখে দিয়ে দিব্যি চালাচ্ছেন গাড়ি। কলকাতা থেকে মেচেদ যেতে লাগবে দু ঘণ্টা। আমরা বেরিয়েছি। সকাল সাড়ে সাতটায়; কাজ সেরে দেড়টা-দুটোর মধ্যে স্বচ্ছন্দে ফিরে আসতে পারব।

কোলাঘাট পেরিয়ে মিনিট তিনেক যাবার পরেই একটা উদ্ভট গাড়ির দেখা পেলাম যেটা রাস্তার একপাশে অকেজো হয়ে পড়ে আছে। মালিক করুণ মুখ করে দাঁড়িয়ে আছেন গাড়ির পাশেই। আমাদের আসতে দেখে ভদ্রলোক হাত নাড়লেন, আর হরিপদবাবু ব্রেক কষলেন। একটা বিশ্ৰী গোলমালে পড়েছি মশাই, রুমালে ঘাম মুছতে মুছতে বললেন ভদ্রলোক। টায়ারটা গেছে, কিন্তু জ্যাকটা বোধ হয়। অন্য গাড়িতে রয়ে গেছে, হেঁ হেঁ..

আপনি চিন্তা করবেন না, বললেন লালমোহনবাবু।দেখো তো হরিপদ।

হরিপদবাবু জ্যাক বার করে নিজেই ভদ্রলোকের গাড়ির নীচে লাগিয়ে সেটাকে তুলতে আরম্ভ করে দিলেন।

আপনার এ গাড়ি কোন ইয়ারের? প্রশ্ন করল ফেলুদা।

থার্টি-সিক্স, বললেন ভদ্রলোক, আৰ্মষ্ট্রং সিড্‌লি।

লং রানে কোনও অসুবিধা হয় না?

দিব্যি চলে। আমার আরও দুটো পুরনো গাড়ি আছে। ভিনটেজ কারু-র‍্যালিতে প্রতিবারই যোগ দিই। আমি। ইয়ে, আপনারা চললেন কতদূর?

মেচেদায় একটু কাজ ছিল।

কতক্ষণের কাজ?

আধা ঘণ্টাখানেক।

তা হলে একটা কাজ করুন না। ওখান থেকে আমাদের বাড়িতে চলে আসুন। মেচেদা থেকে বাঁয়ে রাস্তা ধরবেন-মাত্র আট কিলোমিটার। বৈকুণ্ঠপুর।

বৈকুণ্ঠপুর?

ওখানেই পৈতৃক বাড়ি আমাদের। আমি অবিশ্যি থাকি কলকাতায়। তবে মা-বাবা ওখানেই থাকেন। দুশো বছরের পুরনো বাড়ি। আপনাদের খুব ভাল লাগবে। দুপুরে আমাদের ওখানেই খাওয়া-দাওয়া করে বিকেলের দিকে চলে আসবেন। আপনারা আমার যা উপকার করলেন। কতক্ষণ যে এইভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে হত। জানি না।

ফেলুদা একটু যেন অন্যমনস্ক। বলল, বৈকুণ্ঠপুর নামটা কোথায় যেন দেখেছি রিসেন্টলি?

ভূদেব সিং-এর লেখাতে কি? ইলাস্ট্রেটেড উইকলিতে?

হাঁ হ্যাঁ। মাস দেড়েক আগে বেরিয়েছিল।

আমি শুনেছি লেখািটর কথা, কিন্তু পড়া হয়নি।

ইলাস্ট্রেটেড উইকলি আমাদের বাড়িতে আসে না! ফেলুদা কোথায় gछलछ एोंनेि। হেয়ার কাটিং সেলুনে। একটা বিশেষ সেলুনে ও যায়। আর ইয়াসিন নাপিত ছাড়া কাউকে দিয়ে চুল কাটায় না। ইয়াসিন যতক্ষণ ব্যস্ত থাকে ফেলুদা ততক্ষণ ম্যাগাজিন পড়ে।

বৈকুণ্ঠপুরের নিয়োগী পরিবারের একজনকে নিয়ে লেখা, বলল ফেলুদা, ভদ্রলোক ছবি আঁকতেন। রোমে গিয়ে আঁকা শিখেছিলেন।

আমার দাদু চন্দ্ৰশেখর, হেসে বললেন ভদ্রলোক। আমি ওই পরিবারেরই ছেলে। আমার নাম নবকুমার নিয়োগী।

আই সি। আমার নাম প্রদোষ মিত্ৰ। ইনি লালমোহন গাঙ্গুলী, আর ইনি আমার খুড়তুতো ভাই তপেশ।

প্রদোষ মিত্র শুনে ভদ্রলোকের ভুরু কুঁচকে গেল।

গোয়েন্দা প্রদোষ মিত্ৰ?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

তা হলে তো আপনাদের আসতেই হবে। আপনি তো বিখ্যাত লোক মশাই। সত্যি বলতে কী, এর মধ্যে আপনার কথা মনেও হয়েছিল একবার।

কেন বলুন তো?

একটা খুনের ব্যাপারে। আপনি শুনলে হাসবেন, কারণ ভিকটিম মানুষ নয়, কুকুর।

বলেন কী? কবে হল এ খুন?

গত মঙ্গলবার। আমাদের একটা ফক্স টেরিয়ার। বাবার খুবই প্রিয় কুকুর ছিল।

খুন মানে?

চাকরের সঙ্গে বেড়াতে বেরিয়েছিল। আর ফেরেনি। চাকরও ফেরেনি। কুকুরের লাশ পাওয়া যায় বাড়ি থেকে মাইল খানেক দূরে, একটা বাঁশবনে। মনে হয় বিষাক্ত কিছু খাওয়ানো হয়েছিল। বিস্কিটের গুঁড়ো পড়ে ছিল আশেপাশে।

এ তো অদ্ভুত ব্যাপার। এর কোনও কিনারা হয়নি?

উহুঁ। কুকুরের বয়স হয়েছিল এগারো। এমনিতেই আর বেশিদিন বাঁচত না। আমার কাছে ব্যাপারটা তাই আরও বেশি মিস্টিরিয়াস বলে মনে হয়। যাই হাক, আপনাকে অবিশ্যি এ নিয়ে তদন্ত করতে হবে না, কিন্তু আপনারা এলে সত্যিই খুশি হব। দাদুর স্টুডিয়ো এখনও রয়েছে, দেখিয়ে দেব।

ঠিক আছে বলল ফেলুদা। আমারও লেখাটা পড়ে যথেষ্ট কৌতুহল হয়েছিল নিয়াগী পরিবার সম্বন্ধে। আমরা কাজ সেরে সাড়ে দশটা নাগাত গিয়ে পড়ব।

মেচেদার মোড় থেকে দু-কিলোমিটার গেলে একটা পেট্রল পাম্প পড়ে। সেখানে জিজ্ঞেস করলেই বৈকুণ্ঠপুরের রাস্তা বাতলে দেবে।

টায়ার লাগানো হয়ে গিয়েছিল। আমাদের গাড়ি আরও স্পিড়ে যাবে বলে ভদ্রলোক আমাদেরই আগে যেতে দিলেন। গাড়ি রওনা হবার পর ফেলুদা বলল, কত যে ইন্টারেস্টিং বাঙালি চরিত্র আছে যাদের নামও আমরা জানি না। এই চন্দ্ৰশেখর নিয়োগী বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে চব্বিশ বছর বয়সে রোমে চলে যান ওখানকার বিখ্যাত অ্যাকাডেমিতে পেন্টিং শিখতে। ছাত্র থাকতেই একটি ইটালিয়ান মহিলাকে বিয়ে করেন। স্ত্রীর মৃত্যুর পর দেশে ফিরে আসেন। এখানে পেট্রেট আঁকিয়ে হিসেবে খুব নাম হয়। নেটিভ স্টেটের রাজ-রাজড়াদের ছবি আঁকতেন। একটি রাজার সঙ্গে খুব বন্ধুত্ব হয়। তিনিই লিখেছেন প্ৰবন্ধটা। প্রৌঢ় বয়সে আঁকাটাকা সব ছেড়ে দিয়ে সন্ন্যাসী হয়ে চলে যান।

আপনি বলছেন চন্দ্ৰশেখরের কথা। আর আমি ভাবছি কুকুর খুন, বললেন লালমোহনবাবু। এ জিনিস শুনেছেন কখনও?

ফেলুদা স্বীকার করল সে শোনেনি।লেগে পড়ুন মশাই বললেন লালমোহনবাবু শাঁসালে মক্কেল। তিন তিনখানা ভিনটেজ গাড়ি। হাতের ঘড়িটা দেখলেন? কমপক্ষে ফাইভ থাউজ্যান্ড চিপস। এ দাঁও ছাড়বেন না।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *