Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

মঙ্গলবার ১২ই অক্টোবর রাত দশটায়। এয়ার ইন্ডিয়ার ৩১৬নম্বর ফ্লাইটে আমাদের হংকং যাওয়া। বোইং ৭০৭ আর ৭৩৭-এ ওডার অভিজ্ঞতা ছিল এর আগে, এবার ৭৪৭ জাম্বো-জেটে চড়ে আগের সব ওড়াগুলো ছেলেমানুষি বলে মনে হল।

প্লেনের কাছে পৌঁছে বিশ্বাস হচ্ছিল না যে এত বড় জিনিসটা আকাশে উড়তে পারে। সিড়ি দিয়ে উঠে ভিতরে যাত্রীর ভিড দেখে সেটা আরও বেশি করে মনে হল। লালমোহনবাবু যে বলেছিলেন শুধু ইকনমি ক্লাসের যাত্রীতেই নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়াম ভরে যাবে, সেটা অবিশ্যি বাড়াবাড়ি, কিন্তু একটা মাঝারি সাইজের সিনেমা হলের একতলাটা যে ভরে যাবে তাতে সন্দেহ নেই।

ফেলুদা গতকাল সকালেই পূর্ণেন্দুবাবুকে টেলিগ্রাম করে দিয়েছে। আমরা হংকং পৌঁছাব আগামীকাল সকাল পৌনে আটটা হংকং টাইম—তার মানে ভারতবর্ষের চেয়ে আড়াই ঘণ্টা এগিয়ে।

যেখানে যাচ্ছি সেটা যদি নতুন জায়গা হয় তা হলে সেটা সম্বন্ধে পড়াশুনা করে নেওয়াটা ফেলুদার অভ্যাস, তাই ও গতকালই অক্সফোর্ড বুক অ্যান্ড স্টেশনারি থেকে হংকং সম্বন্ধে একটা বই কিনে নিয়েছে। আমি সেটা উলটে পালটে ছবিগুলো দেখে বুঝেছি হংকং-এর মতো এমন জমজমাট রংদার শহর খুব কমই আছে। লালমোহনবাবু উৎসাহে ফেটে পড়ছেন ঠিকই, কিন্তু যেখানে যাচ্ছেন সে-জায়গা সম্বন্ধে ধারণা এখনও মোটেই স্পষ্টই নয়। একবার জিজ্ঞেস করলেন চিনের প্রাচীরটা দেখে আসার কোনও সুযোগ হবে কি না। তাতে ফেলুদাকে বলতে হল যে চিনের প্রাচীর হচ্ছে পিপলস রিপাবলিক অফ চায়নায়, পিকিং-এর কাছে, আর হংকং হল ব্রিটিশদের শহর। পিকিং হংকং থেকে অন্তত পাঁচশো মাইল।

আবহাওয়া ভাল থাকলে জাম্বো জেটের মতো এমন মোলায়েম ঝাঁকানিশূন্য ওড়া আর কোনও প্লেনে হয় না। মাঝরাত্রে ব্যাঙ্ককে নামে প্লেনটা, কিন্তু যাত্রীদের এয়ারপোর্টে নামতে দেবে না শুনে দিব্যি ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিলাম।

সকালে উঠে জানালা দিয়ে চেয়ে দেখি আমরা সমুদ্রের উপর দিয়ে উড়ে চলেছি। তারপর ক্রমে দেখা গেল জলের উপর উচিয়ে আছে কচ্ছপের খোলার মতো সব ছোট ছাট দ্বীপ। প্লেন নীচে নামছে বলে দ্বীপগুলো ক্ৰমে বড় হয়ে আসছে, আর বুঝতে পারছি তার অনেকগুলোই আসলে জলে-ডুবে-থাকা পাহাড়ের চূড়ো।

সেগুলোর উপর দিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ দেখতে পেলাম পাহাড়ের ঘন সবুজের উপর সাদার ছোপ।

আরও কাছে আসতে সেগুলা হয়ে গেল পাহাড়ের গায়ে থরে থরে সাজানো রোদে-চোখ-ঝলসানো বিশাল বিশাল হাইরাইজ।

হংকং-এ ল্যান্ডিং করতে হলে পাইলটের যথেষ্ট কেরামতির দরকার হয় সেটা আগেই শুনেছি। তিনদিকে সমুদ্রের মাঝখানে এক চিলতে ল্যান্ডিং স্ট্রিপ—হিসেবে একটু গণ্ডগোল হলে জলে ঝপাং, আর বেশি গণ্ডগোল হলে সামনের পাহাড়ের সঙ্গে দড়াম্‌।

কিন্তু এ দুটোর কোনওটাই হল না। মোক্ষম হিসেবে প্লেন গিয়ে নামল ঠিক যেখানে নামবার, থামল যেখানে থামবার, আর তারপর উলটা মুখে গিয়ে টার্মিন্যাল বিল্ডিং-এর পাশে ঠিক এমন জায়গায় দাঁড়াল যে চাকার উপর দাঁড় করানো দুটো চারকোনা মুখ-ওয়ালা সুড়ঙ্গ এসে ইকনমি ক্লাস আর ফাস্ট ক্লাসের দুটো দরজার মুখে বেমালুম ফিট করে গেল। ফলে আমাদের আর সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামতে হল না, সোজা দরজা দিয়ে বেরিয়ে সুড়ঙ্গে ঢুকে টামিনাল বিল্ডিং-এর ভিতরে পৌঁছে গেলাম।

হংকং-এর জবাব নেই বললেন চোখ-ছানাবড়া লালমোহনবাবু।

এটা হংকং-এর একচেটে ব্যাপার নয় লালমোহনবাবু, বলল ফেলুদা।ভারতবর্ষের বাইরে পৃথিবীর সব বড় এয়ারপোর্টেই প্লেন থেকে সোজা টাৰ্মিনাল বিল্ডিং-এ ঢুকে যাবার এই ব্যবস্থা।

হংকং-এ এক মাসের কম থাকলে ভিসা লাগে না, কাস্টমস-এও বিশেষ কড়াকড়ি নেই,–তাই বিশ মিনিটের মধ্যে সব ল্যাঠা চুকে গেল। লাগোজ ছিল সামান্যই, তিন জনের তিনটে ছোট সুটকেস, আর কাঁধে একটা করে ছোট ব্যাগ। সব মাল আমাদের সঙ্গেই ছিল।

ফাস্টমস থেকে বেরিয়ে এসে দেখি একটা জায়গায় লোকের ভিড়, তাদের মধ্যে একজনের হাতে একটা হাতলের মাথায় বোর্ডে লেখা পি. মিটার। বুঝলাম ইনিই হচ্ছেন পূর্ণেন্দু পাল। পরস্পরের মুখ চেনা নেই বলে এই ব্যবস্থা।

ওয়েলকাম টু হংকং, বলে আমাদের অভ্যর্থনা করলেন পাল মশাই। নবকুমারবাবুরই বয়স, অর্থাৎ চল্লিশ-বেয়াল্লিশ-এর মধ্যেই। মাথায় টাক পড়ে গেছে, তবে দিব্যি চকচকে স্মার্ট চেহারা, আর গায়ের খয়েরি সুন্টটাও স্মার্ট আর চকচকে। ভদ্রলোক যে রোজগার ভালই করেন, আর এখানে দিব্যি ফুর্তিতে আছেন, সেটা আর বলে দিতে হয় না।

একটা গাঢ় নীল জামান ওপেল গাড়িতে গিয়ে উঠলাম। আমরা। ভদ্রলোক নিজেই ড্রাইভ করেন। ফেলুদা ওঁর পাশে সামনে বসল, আমরা দুজন পিছনে। আমাদের গাড়ি রওনা দিয়ে দিল!

এয়ারপোর্টটা কাউলূনে, বললেন মিঃ পাল। আমার বাসস্থান এবং দাকান দুটোই হংকং-এ। কাজেই আমাদের বে পেরিয়ে ওপারে যেতে হবে।

আপনার উপর এভাবে ভর করার জন্য সত্যিই লজ্জিত, বলল ফেলুদা।

ভদ্রলোক কথাটা উড়িয়েই দিলেন।

কী বলছেন মশাই। এটুকু করব না? এখানে একজন বাঙালির মুখ দেখতে পেলে কীরকম লাগে তা কী করে বলে বোঝাব? ভারতীয় গিজগিজ করছে। হংকং-এ, তবে বঙ্গসন্তান তো খুব বেশি নেই!

আমাদের হোটেলের কোনও ব্যবস্থা–?

হয়েছে, তবে আগে চলুন তো আমার ফ্ল্যাটে! ইয়ে, আপনি তো ডিটেকটিভ?

অজ্ঞে হ্যাঁ।

কোনও তদন্তের ব্যাপারে এসেছেন তো? হ্যাঁ।

একদিনের মামলা। কাল রাত্রেই আবার এয়ার ইন্ডিয়াতেই ফিরে যাব।

কী ব্যাপার বলুন তো।

নবকুমারবাবুদের বাড়ি থেকে একটি মহামূল্য পেন্টিং, চুরি হয়ে এখানে এসেছে। এনেছে সোমানি বলে এক ভদ্রলোক; হীরালাল সোমানি? সেটা চালান যাবে এক আর্মেনিয়নের হাতে। জিনিসটার দাম বেশ কয়েক লাখ টকা।

বলেন কী?

সেইটোকে উদ্ধার করতে হবে।

ওরে বাবা, এ তো ফিল্মের গপ্পো মশাই। তা এই আমেনিয়ানটি থাকেন কোথায়?

এঁর আপিসের ঠিকানা আছে আমার কাছে।

সোমানি কি কলকাতার লোক?

হ্যাঁ, এবং তিনি এসেছেন গত শনিবারের ফ্লাইটে। সে ছবি ইতিমধ্যে সাহেবের কাছে পৌঁছে গেছে।

সর্বনাশ! তা হলে?

তা হলেও সাহেবের সঙ্গে একবার দেখা করে ব্যাপারটা বলতে হবে। চোরাই মালি ঘরে রাখা তার পক্ষেও নিরাপদ নয়। সেইটে তাকে বুঝিয়ে দিতে হবে।

হুঁ…

পূর্ণেন্দুবাবুকে বেশ চিন্তিত বলে মনে হল।

লালমোহনবাবুকে একটু গম্ভীর দেখে গলা বেশি না তুলে জিজ্ঞেস করলাম, কী ব্যাপার। হংকংকে কি বিলেত-বলা চলে? জিজ্ঞেস করলেন ভদ্রলোক।

বললাম, তা কী করে বলবেন। বিলেত তো পশ্চিমে। এটা তো ফার ইস্ট। তবে বিলেতের যা ছবি দেখেছি তার সঙ্গে এর কোনও তফাত নেই।

ফেলুদার কান খাড়া, কথাগুলো শুনে ফেলেছে। বলল, আপনি চিন্তা করবেন না, লালমোহনবাবু। আপনার গড়পীরের বন্ধুদের বলবেন হংকংকে বলা হয় প্রাচ্যের লন্ডন। তাতেই ওঁরা যথেষ্ট ইমপ্রেস্‌ড হবেন।

প্রাচ্যের লন্ডন! গুড।

ভদ্রলোক প্রাচ্যের লন্ডন বলে বিড়বিড় করছেন, এমন সময় আমাদের গাড়িটা গোঁৎ খেয়ে একটা চওড়া টানেলের ভিতর ঢুকে গেল। সারবাঁধা হলদে বাতিতে সমস্ত টানেলের মধ্যে একটা কমলা আভা ছড়িয়ে দিয়েছে। পূর্ণেন্দুঝাবু বললেন আমরা নাকি জলের তলা দিয়ে চলেছি। আমাদের মাথার উপর হংকং বন্দর। আমরা বেরোব একেবারে হংকং-এর আলোয়।

লালমোহনবাবু বললেন, এমন দুর্দান্ত শহর, তার নামটা এমন হুপিং কাশির মতো হল কেন?

হংকং মানে কী জানেন তো? জিজ্ঞেস করলেন পূর্ণেন্দুবাবু।

সুবাসিত বন্দর, বলল ফেলুদা। বুঝলাম ও খবরটা পেয়েছে ওই বইটা থেকে।

বেশ কিছুক্ষণ এই পথে চলার পর টানেল থেকে বেরিয়ে দেখলাম ছোট বড়-মাঝারি নানারকম জলযান সমেত পুরো বন্দরটা আমাদের পাশে বিছিয়ে রয়েছে, আর তারও পিছনে দূরে দেখা যাচ্ছে ফেলে আসা কাউলুন শহর।

আমাদের বাঁয়ে এখন বিশাল হাইরাইজ। কোনওটা আপিস, কোনওটা হোটেল, প্রত্যেকটারই নীচে লোভনীয় জিনিসে ঠাসা দোকানের সারি। পরে বুঝেছিলাম পুরো হংকং শহরটিা একটা অতিকায় ডিপার্টমেন্ট স্টোরের মতো! এমন কোনও জিনিস নেই। যা হংকং-এ পাওয়া যায় না।

কিছুদূর গিয়ে বাঁয়ে ঘুরে দুটো হাইরাইজের মাঝখান দিয়ে আমরা আরেকটা বড় রাস্তায় গিয়ে পড়লাম।

এমন রাস্তা আমি কখনওই দেখিনি।

ফুটপাথ দিয়ে চলেছে কাতারে কাতারে লোক, আর রাস্তা দিয়ে চলেছে ট্যাক্সি, বাস, প্রাইভেট গাড়ি আর ডবলডেকার-ট্রাম। ট্রামের মাথা থেকে ডাণ্ডা বেরিয়ে তারের সঙ্গে লাগানো, কিন্তু রাস্তায় লাইন বলে কিছু নেই। রাস্তার দুপাশে রয়েছে দোকানের পর দোকান! তাদের সাইনবোর্ডগুলো দোকানের গা থেকে বেরিয়ে আমাদের মাথার উপর এমন ভাবে ভিড় করে আছে যে আকাশ দেখা যায় না। চিনে ভাষা লেখা হয় ওপর থেকে নীচে, তাই সাইনবোর্ডগুলোও ওপর থেকে নীচে, তার একেকটা আট-দশ হাত লম্বা।

ট্র্যাফিক প্রচণ্ড, আমাদের গাড়িও চলেছে। ধীরে, তাই আমরা আশ মিটিয়ে দেখে নিচ্ছি। এই অদ্ভুত শহরের অদ্ভুত রাস্তার চেহারাটা। কলকাতার ধরমতলাতেও ভিড় দেখেছি, কিন্তু সেখানে অনেক লোকের মধ্যেই যেন একটা যাচ্ছি-যাব ভাব, যেন তাদের হাতে অনেক সময়, রাস্তাটা যেন তাদের দাঁড়িয়ে আড়ড়া মারার জায়গা। এখানের লোকেরা কিন্তু সকলেই ব্যস্ত, সকলেই হাঁটছে, সকলেরই তাড়া। বেশির ভাগই চিনে, তাদের কারুর চিনে পোশাক, কারুর বিদেশি পোষাক। এদেরই মধ্যে কিছু সাহেব-মেমও আছে। তাদের হাতে ক্যামেরা, চোখে কীতুহলী দৃষ্টি আর মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে পড়ে এদিক ওদিক ঘাড় ঘোরানো থেকেই বোঝা যায় এরা টুরিস্ট।

অবশেষে এ-রাস্তাও পিছনে ফেলে একটা সরু রাস্তা ধরে একটা অপেক্ষাকৃত নিরিবিলি অঞ্চলে এসে পড়লাম। আমরা। পরে জেনেছিলাম। এটার নাম প্যাটারসন স্ট্রিট। এখানেই একটা বত্ৰিশ তলা বাড়ির সাত তলায় পূর্ণেন্দুবাবুর ফ্ল্যাট।

গাড়ি থেকে যখন নামছি তখন আমাদের পাশ দিয়ে একটা কালো গাডি হঠাৎ স্পিড বাড়িয়ে বেরিয়ে গেল আর ফেলুদা কেমন যেন একটু টান হয়ে গেল। এই গাড়িটাকে আমি আগেও আমাদের পিছনে আসতে দেখেছি। এদিকে পূর্ণেন্দুবাবু নেমেই এগিয়ে গেছেন। কাজেই আমাদেরও তাঁকে অনুসরণ করতে হল।

একটু হাত পা ছড়িয়ে বসুন স্যার, আমাদের নিয়ে তাঁর বৈঠকখানায় ঢুকেই বললেন পূর্ণেন্দুবাবু। দুঃখের বিষয় আমার এক ভাগনের বিয়ে, তাই আমার স্ত্রী ও ছেলেমেয়েকে এই সেদিন রেখে এসেছি কলকাতায়। আশা করি আতিথেয়তার একটু-আধটু ত্রুটি হলে মাইন্ড করবেন না। —কী খাবেন বলুন।

সবচেয়ে ভাল হয় চা হলে, বলল ফেলুদা।

টি-ব্যাগস-এ আপত্তি নেই তো?

মোটেই না।

ঘরের উত্তর দিকে একটা বড় ছড়ানো জানালা দিয়ে হংকং শহরের একটা অংশ দেখা যাচ্ছে। লালমোহনবাবু দৃশ্য দেখছেন, আমি দেখছি সোনি কালার টেলিভিশনের পাশে আরেকটা যন্ত্র, সেটা নিশ্চয়ই ভিডিয়ো। তারই পাশে তিন তাক ভরা ভিডিয়ো ফিল্ম। তার মধ্যে বেশির ভাগই হিন্দি, আর অন্য পাশে টেবিলের উপর ডাই করা ম্যাগাজিন। ফেলুদা তারই খানকতক টেনে নিয়ে পাতা ওলটাতে আরম্ভ করেছে। মিঃ পাল ঘরে নেই। তাই এই ফাঁকে প্রশ্নটা না করে পারলাম না।

গাড়িতে কে ছিল ফেলুদা?

যে না-থাকলে আমাদের আসা বৃথা হত।

বুঝেছি।

হীরালাল সোমানি।

কিন্তু লোকটা কী করে জানল যে আমরা এসেছি?

খুব সহজ, বলল ফেলুদা। আমরা যে ভাবে ওর আসার ব্যাপারটা জেনেছি সেই ভাবেই! প্যাসেঞ্জার লিস্ট চেক করেছে। এয়ারপোর্টে ছিল নিশ্চয়ই। ওখান থেকে পিছু নিয়েছে।

লালমোহনবাবু জানালা থেকে ফিরে এসে বললেন, ছবি যদি পাচার হয়ে গিয়ে থাকে তা হলে আর আমাদের পিছনে লাগার কারণটা কী?

সেটাই তো ভাবছি।

আসুন স্যার!

পূর্ণেন্দুবাবু ট্রে-তে চা নিয়ে এসেছেন, সঙ্গে বিলিতি বিস্কুট। টেবিলের উপর ট্রে-টা রেখে ফেলুদার দিকে ফিরে বললেন, আপনি যে ম্যান্ধাতার আমলের ফিল্মের পত্রিকায় মশগুল হয়ে পডালেন।

ফেলুদা একটা ছবি বেশ মন দিয়ে দেখতে দেখতে বলল, স্ক্রিন ওয়ার্লডের এই সংখ্যান্টা কি আপনার খুব কাজে লাগছে? এটা সেভেনটি-সিক্স-এর।

মোটেই না। আপনি স্বচ্ছন্দে নিতে পারেন। ওগুলো আমি দেখি না মশাই, দেখেন আমার গিন্নি। একেবারে ফিল্মের পোকা।

থ্যাঙ্ক ইউ। তোপ্‌সে, এই পত্রিকাটা আমার ব্যাগের মধ্যে ভরে দে তো। ইয়ে, আপনাদের এখানকার আপিসি-টাপিস খোলে কখন?

আর মিনিট দিশেকের মধ্যেই খুলে যাবে। আপনি সেই সাহেবকে ফোন করবেন তো?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

নম্বর আছে?

আছে।

ফেলুদা নোটবুক বার করল! —এই যে-৫-৩১,১৬৮৬।

হুঁ। হংকং-এর নম্বর। আপিসটা কোথায়?

হেনেসি স্ট্রিট। চোদ্দো নম্বর।

হুঁ। আপনি দশটায় ফোন করলেই পাবেন।

আমাদের হোটেল কোনটা ঠিক করেছেন জানতে পারি কি?

পার্ল হোটেল। এখান থেকে হেঁটে পাঁচ মিনিট। তাড়া কীসের? দুপুরের খাওয়াটা সেরে যাবেন এখন। কাছেই খুব ভাল ক্যান্টনিজ রেস্টোরান্ট আছে। তারপর, আপনাদের মিশন যদি আজ স্যাকসেসফুল হয়, তা হলে কাল নিয়ে যাব কাউলুনের এক রেস্টোরান্টে। এমন একটা জিনিস খাওয়াব যা কখনও খাননি।

কী জিনিস মশাই? লালমোহনবাবু জিজ্ঞেস করলেন।এরা তো আরশোলাটারশোলাও খায় বলে শুনিচি।

শুধু আরশোলা কেন, বলল ফেলুদা, আরশোলা, হাঙরের পাখনা, বাঁদরের ঘিলু, এমন কী সময় সময় কুকুরের মাংস পর্যন্ত।

স-স-স-স্নেক? লালমোহনবাবুর চোখ-নাক সব একসঙ্গে কুঁচকে গেল।

স্নেক।

মানে সাপ? সাপ?

সৰ্প। সাপের সুপ, সাপের মাংস, ফ্রাইড স্নেক-সব পাওয়া যায়।

খেতে ভাল?

অপূর্ব। ব্যাঙের মাংস তো অতি সুস্বাদু জিনিস, জানেন বোধহয়। তা ব্যাঙের ভক্ষক কেন ভাল হবে না খেতে বলুন।

লালমোহনবাবু যদিও বললেন তা বটে, কিন্তু যুক্তি পুরোপুরি মানলেন বলে মনে হল না।

ফেলুদা উঠে পড়েছে।

যদি কিছু মনে না করেন—আপনার টেলিফোনটা….

নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই।

ফেলুদা আর্মেনিয়ান সাহেবের নম্বরটা ডায়াল করল। এ ডায়ালিং আমাদের মতো ঘুরিয়ে ডায়ালিং নয়। এটা বোতাম টিপে ডায়ালিং, টেপার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন নম্বরে বিভিন্ন সুরে একটা পি শব্দ হয়।

আমি একটু ক্রিকোরিয়ান সাহেবের সঙ্গে কথা বলতে চাই।

কোথায় গেছেন?

তাইওয়ান।

কবে।

গত শুক্রবার; আজি সন্ধ্যায়, ফিরবেন।

থ্যাঙ্ক ইউ।

ফেলুদা ফোন রেখে তারপর কী কথা হয়েছে সেটা বলল আমাদের।

তার মানে সে ছবি তো এখনও সোমানির কাছেই আছে, বললেন পূর্ণেন্দুবাবু।

তই তো মনে হচ্ছে বলল, ফেলুদা। তার মানে আমাদের এখানে আসাটা ব্যর্থ হয়নি।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *