বীরসিংহের সিংহশিশু! বিদ্যাসাগর! বীর!
উদ্বেলিত দয়ার সাগর, –বীর্য্যে সুগম্ভীর!
সাগরে যে অগ্নি থাকে কল্পনা সে নয়,
তোমায় দেখে অবিশ্বাসীর হয়েছে প্রত্যয়।
নিঃস্ব হয়ে বিশ্বে এলে, দয়ার অবতার!
কোথাও তবু নোয়াও নি শির জীবনে একবার!
দয়ায় স্নেহে ক্ষুদ্র দেহে বিশাল পারাবার,
সৌম্য মূর্ত্তি তেজের স্ফূর্ত্তি চিত্ত চমৎকার !
নামলে একা মাথায় নিয়ে মায়ের আশীর্ব্বাদ,
করলে পূরণ অনাথ আতুর অকিঞ্চনের সাধ;
অভাজনে অন্ন দিয়ে—বিদ্যা দিয়ে আর –-
অদৃষ্টেরে ব্যর্থ তুমি করলে বারম্বার।
বিশ বছরে তোমার অভাব পুরলো নাকো, হায়,
বিশ বছরের পুরাণো শোক নূতন আজো প্রায়;
তাইতো আজি অশ্রুধারা ঝরে নিরন্তর!
কীর্ত্তি-ঘন মূর্ত্তি তোমার জাগে প্রাণের ‘পর ।
স্মরণ-চিহ্ন রাখতে পারি শক্তি তেমন নাই,
প্রাণ-প্রতিষ্ঠা নাই যাতে সে মূরৎ নাহি চাই;
মানুষ খুঁজি তোমার মতো, –একটি তেমন লোক, —
স্মরণ চিহ্ন মূর্ত্ত ! –যে জন ভুলিয়ে দেবে শোক।
রিক্ত হাতে করবে যে জন যজ্ঞ বিশ্বজিৎ, —
রাত্রে স্বপন চিন্তা দিনে দেশের দশের হিত, —
বিঘ্ন বাধা তুচ্ছ ক’রে লক্ষ্য রেখে স্থির,
তোমার মতন ধন্য হ’বে, –চাই সে এমন বীর।
তেমন মানুষ না পাই যদি খুঁজব তবে, হায়,
ধূলায় ধূসর বাঁকা চটি ছিল যা ঐ পায়;
সেই যে চটি উচ্চে যাহা উঠত এক একবার
শিক্ষা দিতে অহঙ্কৃতে শিষ্ঠ ব্যবহার।
সেই যে চটি—দেশী চটি—বুটের বাড়া ধন,
খুজব তারে, আনব তারে, এই আমাদের পণ;
সোনার পিঁড়েয় রাখবো তারে, থাকবো প্রতীক্ষায়
আনন্দহীন বঙ্গভূমির বিপুল নন্দীগাঁয়।
রাখব তারে স্বদেশপ্রীতির নূতন ভিতের ‘পর,
নজর কারো লাগবে নাকো, অটুট হ’বে ঘর !
উঁচিয়ে মোরা রাখব তারে উচ্চে সবাকার,—
বিদ্যাসাগর বিমুখ হ’ত—অমর্য্যাদায় যার।
শাস্ত্রে যারা শস্ত্র গড়ে হৃদয় বিদারণ,
তর্ক যাদের অর্কফলার তূমুল আন্দোলন;
বিচার যাদের যুক্তিবিহীন অক্ষরে নির্ভর, —
সাগরের এই চটি তারা দেখুক নিরন্তর ।
দেখুক এবং স্মরণ করুক সব্যসাচীর রণ, —
স্মরণ করুক বিধবাদের দুঃখ-মোচন পণ;
স্মরণ করুক পান্ডারূপী গুন্ডাদিগের হার,
বাপ্ মা বিনা দেবতা সাগর মানেই নাকো আর ।
অদ্বিতীয় বিদ্যাসাগর! মৃত্যু-বিজয় নাম,
ঐ নামে হায় লোভ করেছে অনেক ব্যর্থকাম;
নামের সঙ্গে যুক্ত আছে জীবন-ব্যাপী কাজ,
কাজ দেবে না? নামটি নেবে? –একি বিষম লাজ!
বাংলা দেশের দেশী মানুষ! বিদ্যাসাগর ! বীর!
বীরসিংহের সিংহশিশু! বীর্য্যে সুগম্ভীর!
সাগরে যে অগ্নি থাকে কল্পনা সে নয়,
চক্ষ দেখে অবিশ্বাসীর হয়েছে প্রত্যয়।