Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

বেশ জমিয়ে লাঞ্চ খাওয়া হচ্ছে করোমণ্ডলের মোগলাই ডাইনিং রুম মাইসোরে। অবিশ্বাস্য ব্যাপার হল-আজকের খানার পুরো ভার নিয়েছেন লালমোহনবাবু। আসলে তরফদার যে সম্মোহনের জোরে ওঁর প্রাণ বাঁচিয়েছিল, তাতে-ওঁরই ভাষায়—উনি সবিশেষ কৃতজ্ঞ।

খেতে খেতে ফেলুদার দিকে ফিরে বললেন, অনেক খ্রিলিং ঘটনার মধ্যে পড়িচি মশাই–থ্যাঙ্কস টু ইউ-কিন্তু আজকেরটা একেবারে ফাইভ-স্টার অভিজ্ঞতা।

দানবের বগলবন্দি হওয়াটা কীভাবে ঘটল, সেটা ফেলুদা আগেই জিজ্ঞেস করেছিল। আর লালমোহনবাবু সেটা বলেওছিলেন। তাঁর ভাষাতেই ঘটনার বর্ণনাটা এখানে দিচ্ছি।

আর বলবেন না, মশাই-আমি তো খোকাকে গপ্পো শোনাতে মশগুল, গুহায় ঢুকছি। আর বেরোচ্ছি, পল্লব-টল্লব মাথা থেকে হাওয়া হয়ে গেছে। একটা গুহায় ঢুকে দেখলুম সামনেই মহিষাসুর। বেরিয়ে আসব, এমন সময় দেখলুম-আরেকটা মূর্তি রয়েছে যেটা বিশাল, বীভৎস। এটার চোখ বোজা, আর মিশকালো রঙের উপর লাল-সাদা ডোরা। মনে মনে ভাবছি—এই ব্যতিক্রমের কারণটা কী?—এও ভাবছি—একি ঘটাৎকচের মূর্তি নাকি?–কারণ মহাভারতের অনেক কিছুই তো এখানে দেখছি। এমন সময় মূর্তিটা চোখ খুলল। ভাবতে পারেন?—ধূমসোটা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘুমোচ্ছিল!

চোখ খুলেই অবশ্য আর এক মুহূর্ত দেরি করল না। আমি আর নয়ন দুজনেই ব্যোমকে গেছি, সেই অবস্থাতেই আমাদের দুজনকে বগলদাবা করে নিয়ে দে ছুট!

ফেলুদা মন্তব্য করেছিল যে বোঝাই যাচ্ছে গাওয়াঙ্গির মনটা খুব সরল। এমনকী এও হতে পারে যে, তার বুদ্ধি বলে কিছু নেই; যা আছে সে শুধু শারীরিক বল। না হলে সুনীল তাকে হিপনোটাইজ করতে পারত না।

তরফদার আর শঙ্করবাবু কোথায় গিয়েছিলেন জিজ্ঞেস করাতে তরফদার বললেন, শঙ্করের হবি হচ্ছে আয়ুৰ্বেদ। ও শুনেছিল যে, মহাবলীপুরমে সর্পগন্ধা গাছ পাওয়া যায়, তাই আমরা দুজনে খুঁজতে গিয়েছিলাম। গাছ পেয়ে ফিরতি পথে দেখি এই কাণ্ড। সৰ্পগন্ধা তো ব্লাড প্রেশারে কাজ দেয়, তাই না? বলল ফেলুদা! হ্যাঁ বললেন শঙ্করবাবু! এই সুনীলের প্রেশার মাঝে মাঝে চড়ে যায়। ওর জন্যই এই গাছ আনা।

এর পরেই জটায়ু প্রস্তাব করেন যে তিনি সকলকে খাওয়াবেন। মোগলাই খানার কথাও উনিই বলেন, আর তাতে সকলেই রাজি হয়।

এখন একটুকরো চিকেন টিক্কা কাবাব মুখে পুরে চিবোতে চিবোতে ভদ্রলোক ফেলুদার দিকে মুচুকি হেসে বললেন, আপনার প্রয়োজনীয়তা যে ফুরিয়ে গেছে, সেটা আজ প্রমাণ হল।

ফেলুদা ঠাট্টাটাকে খুব একটা আমল না দিয়ে বলল, তার চেয়েও বড় কথা হলি-গাওয়াঙ্গি বাতিল হয়ে গেল।

ইয়েস, বললেন জটায়ু। এখন বাকি শুধু মিস্টার ব্যাস্যাক।

আমাদের সঙ্গে আজ মিঃ রেডিও খাচ্ছেন-অবিশ্যি নিরামিষ। পরশু বড়দিনে তাঁর রোহিণী থিয়েটারে তরফদারের শো শুরু। বিজ্ঞাপনের ব্যাপারে রেডি যে কোনও কার্পণ্য করেননি, সেটা ফেরার পথে রাস্তার দু পাশে তামিল আর ইংরেজি পোস্টার দেখেই বুঝেছি। প্রত্যেকটাতেই জাদুকরের পোশাক পরে তরফদারের ছবি আর সেই সঙ্গে জ্যোতিষ্কম্‌–ওয়ান্ডার বয়-এর নাম। রেড্ডি জানালেন যে, এর মধ্যেই প্রথম দু দিন হাউসফুল হয়ে গেছে।

আমি বলছি আজ আর কোথাও বেরোবেন না, বললেন মিঃ রেডি। আর কালকের দিনটাও রেস্ট করুন। আপনাদের আজকের এক্সপিরিয়েন্স তো শুনলাম; ওই ছেলেকে নিয়ে আর কোনও রিস্ক নেবেন না। ওর কিছু হলে যারা টিকিট কেটেছে, তারা সবাই টাকা ফেরত চাইবে। তখন কী দশা হবে ভেবে দেখুন। –আমারও, আপনারও। থিয়েটারে অবিশ্যি আমি পুলিশ রাখছি, কাজেই শো-এর সময় কোনও গণ্ডগোল হবে না।

গাওয়াঙ্গির ঘটনার ফলে তরফদার আর শঙ্করবাবু দুজনেই বুঝেছেন যে, নয়নকে সামলানোর ব্যাপারে কোনও গাফিলতি চলবে না। ফেলুদা ওদের কাছে ক্ষমা চেয়ে বলল, মহাবলীপুরম দেখে ওর মাথা ঘুরে গিয়েছিল—না হলে আমি কখনওই মিস্টার গাঙ্গুলীর হাতে নয়নকে ছাড়াতাম না। এখন শিক্ষা হয়েছে, এবার থেকে আর কোনও গণ্ডগোল হবে না।

জটায়ুর গল্প শেষ। তাই নয়ন আজ খাবার পরে তরফদারের সঙ্গে ঘরে চলে গেল।

এখনও যে চমকের শেষ সীমায় পৌঁছইনি, সেটা ঘরে ফেরার মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই-অর্থাৎ আড়াইটে নাগাত–প্রমাণ হল।

ফেলুদা আজ রগড়ের মুডে ছিল। জটায়ুকে বলেছিল—এবার থেকে আপনিই সামাল দিন, আমার দিন তো ফুরিয়ে এল-ইত্যাদি। লালমোহনবাবু ব্যাপারটা রীতিমতো উপভোগ করছিলেন, এমন সময় টেলিফোনটা বেজে উঠল। ফেলুদা মিনিটখানেক ইংরেজিতে কথা বলে ফোনটা রেখে বলল, চিনলাম না। কিছুক্ষণের জন্য আসতে চায়।

আসতে বললে? আমি জিজ্ঞেস করলাম।

হ্যাঁ, বলল ফেলুদা। হোটেলে এসেছে, নীচ থেকে ফোন করল। জটায়ু–প্লিজ টেক ওভার।

মানে? লালমোহনবাবুর মুখ হ্যাঁ।

আমার প্রয়োজনীয়তা তো ফুরিয়েই গেছে। দেখাই যাক না আপনাকে দিয়ে চলে কি না।

লালমোহনবাবু কিছু বলার আগেই দরজার বেল বেজে উঠল।

আমি দরজা খুলতে একজন মাঝারি হাইটের বছর-পঞ্চাশের ভদ্রলোক ঘরে ঢুকলেন। মাথার চুল পাতলা এবং সাদা হয়ে এসেছে, তবে গোঁফটা কালো এবং ঘন। ভদ্রলোক এক বার জটায়ু আর এক বার ফেলুদার দিকে চেয়ে ইংরিজিতে বললেন, আপনার নামের সঙ্গে আমি পরিচিত, মিঃ মিটার, কিন্তু আপনার চেহারার সঙ্গে নয়। হুইচ ওয়ান অফ ইউ ইজ–?

ফেলুদা সরাসরি লালমোহনবাবুর দিকে দেখিয়ে বলল, দিস ইজ মিস্টার মিটার।

ভদ্রলোক হাত বাড়িয়ে দিলেন লালমোহনবাবুর দিকে। জটায়ু দেখলাম নিজেকে সামলে নিয়েছেন, আর বেশ ভাটের সঙ্গেই হ্যান্ডশেকটা করলেন। মনে পড়ল ফেলুদাই একবার জটায়ুকে বলেছিল—হ্যান্ডশেকটা পুরোপুরি সাহেবি ব্যাপার, তাই ওটা করতে হলে সাহেবি মেজাজেই করবেন, মিনমিনে বাঙালি মেজাজে নয়; মনে রাখবেন-গোরুখোরের গ্রিপ আর মাছখোরের গ্রিপ এক জিনিস নয়।

মনে হয় সেটা মনে রেখেই জটায়ু বেশ শক্ত করে আগস্তুকের হাতটা ধরে দু বার সারা শরীর দুলিয়ে ঝাঁকুনি দিয়ে হাতটা টেনে নিয়ে বললেন, সিট ডাউন, মিস্টার–

ভদ্রলোক একটা সোফায় বসে বললেন, আমার নাম বললে আপনারা চিনবেন না? আমি এসেছি মিঃ তেওয়ারির কাছ থেকে। ওঁর সঙ্গে আমার বহু দিনের আলাপ! এ ছাড়া আমার আর একটা পরিচয় আছে। –আমিও আপনারই মতো একজন প্রাইভেট ডিটেকটিভ। আমার কোম্পানির নাম ছিল ডিটেকনিক। সাতাশ বছর আগে কলকাতায় এই কোম্পানি স্টার্ট করে। নাইনটিন সিক্সটি এইটে—আজি থেকে বাইশ বছর আগে-আমি বম্বে চলে যাই আমার কোম্পানি নিয়ে। তাই আপনার নাম শুনলেও আপনার চেহারার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়নি। আই অ্যাম সারপ্রাইজড়—কারণ আপনার চেহারা দেখে গোয়েন্দা বলে মনেই হয় না। কিছু মনে করবেন না, মিস্টার মিটার, বাট ইউ লুক ভেরি অর্ডিনারি। বরং এঁকে–

আগন্তুক ফেলুদার দিকে দৃষ্টি ঘোরালেন। জটায়ু গলাটা রীতিমতো চড়িয়ে বললেন, হি ইজ মাই ফ্রেন্ড মিস্টার লালমোহান গ্যাঙ্গুলী, পাওয়ারফুলি আউটস্ট্যান্ডিং রাইটার।

আই, সি।

আপনি কোথাকার লোক?

ভদ্রলোক যা বললেন, তাতে ছাগলের গলায় খাঁড়ার কোপ পড়ার মতো শব্দ হল।

কচ্‌।

কচ্ছ?

ইয়েস.যাই হোক, যে কারণে আসা…

ভদ্রলোক কোটের পকেট থেকে একটা পোস্টকার্ড সাইজের ফোটা বার করে জটায়ুর দিকে এগিয়ে দিলেন। আমি খুব যে কাছে ছিলাম, তা নয়, কিন্তু তাও বুঝতে পারলাম সেটা হিঙ্গোয়ানির ছবি। ।

এই লোকের হয়ে আপনি কাজ করছেন প্রোফেশনালি, তাই না?

ফেলুদা নির্বিকার। জটায়ুর চোখ এক মুহূর্তের জন্য কপালে উঠে নেমে এল। আমাদের ধারণা ফেলুদা যে হিঙ্গোয়ানির হয়ে কাজ করছে সেটা বাইরের কেউ জানে না। ইনি জানলেন কী করে?

তাই যদি হয়, বললেন আগন্তুক, তা হলে আমি আপনার প্রতিদ্বন্দ্বী। কারণ, আমি তেওয়ারির দিকটা দেখছি। ওর ব্যাপারটা আমি কাগজে পড়ে ওর সঙ্গে যোগাযোগ করি। বাইশ বছর পরে আমার হদিস পেয়ে সে আনন্দে লাফিয়ে ওঠে। কলকাতায় থাকতে আমি ওকে অনেক ব্যাপারে হেলপ করি, সেটা ও ভোলেনি। বলল—আই নিড় ইওর হেল্প এগেন। –আমি রাজি হই, আর তক্ষুনি কাজে লেগে যাই। প্রথমেই হিঙ্গোয়ানির বাড়িতে ফোন করে জানতে পারি, ও কলকাতায় নেই। ওর এক ভাইপো ফোন ধরেছিল; বলল-আঙ্কল কোথায় যাচ্ছেন তা বলে যাননি। –আমি এয়ারলাইনসে খোঁজ করে ম্যাড্রাসের প্যাসেঞ্জার লিস্টে ওর নাম পাই। বুঝতে পারি, তেওয়ারির শাসনির ফলে সে ভয়ে চম্পট দিয়েছে। এর পর আমি ওর বাড়িতে যাই। ওর বেয়ারার কাছে জানতে পারি যে ক’দিন আগে তিনজন বাঙালি হিঙ্গোয়ানির সঙ্গে দেখা করতে আসেন, তাদের একজনের নাম মিত্তর। আমার সন্দেহ হয়। আমি ডাইরেক্টরি থেকে আপনার নম্বর বার করে ফোন করি। একজন সার্ভেন্ট ফোন ধরে বলে যে, আপনি ম্যাড্রাস গেছেন। আমি দুয়ে দুয়ে চার হিসেব করে ম্যাড্রাস যাওয়া স্থির করি। কাল এখানে এসেই ফোনে সব হোটেলে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, হিঙ্গোয়ানি করোমণ্ডলে আছেন। আমি জিজ্ঞেস করি। -মিটার বলে আছেন। কেউ?–উত্তর পাই, হ্যাঁ আছেন; পি. মিটার। তখনই স্থির করি, আপনার সঙ্গে দেখা করে লেটেস্ট সিচুয়েশনটা জানাব। এটা আপনি স্বীকার করছেন তো যে, হিঙ্গোয়ানি আপনাকে অ্যাপিয়েন্ট করেছে তাকে প্রোটেক্ট করার জন্য?

এনি। অবজেকশন?

মোনি।

আমরা তিনজনেই চুপ। ফেলুদা কিন্তু মাঝে মাঝে সিগারেটে টান দিয়ে ধোঁয়ার রিং ছাড়ছে, দেখে বোঝার কোনও উপায় নেই তার মনে কী আছে।

তেওয়ারির সিন্দুকের ঘটনা এখন কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে, জানেন? বললেন আগন্তুক।

কলকাতার কাগজে বেরিয়েছে কি? জটায়ুর প্রশ্ন।

ইয়েস। সম্পূর্ণ নতুন তথ্য। এতে কেসটার চেহারাটাই পালটে যায়। কাগজ পড়েই আমি তেওয়ারির সঙ্গে যোগাযোগ করি। আপনি যাঁর প্রাণরক্ষার ভার নিয়েছেন তিনি কেমন লোক জানেন? হি ইজ এ থিফ, স্কাউণ্ডেল অ্যান্ড নাম্বার ওয়ান লায়ার।

ভদ্রলোক শেষের কথাগুলো বললেন ঘর কাঁপিয়ে। জটায়ু প্ৰাণপণ চেষ্টা করেও তাঁর কথায় আতঙ্কের রেশ ঢাকতে পারলেন না।

হা-হাউ ঢু ইউ নোহে?

তার অকাট্য প্রমাণ পাওয়া গেছে। হিঙ্গোয়ানি তেওয়ারির সিন্দুক থেকে পাঁচ লক্ষের উপর টাকা চুরি করেছে। সিন্দুকের তলা থেকে হিঙ্গোয়ানির আংটি পাওয়া গেছে-পালা বসানো সোনার আংটি। ওর আপিসের প্রত্যেকে ওই আংটি চিনেছে। আংটিটিা গড়িয়ে একেবারে পিছন দিকে চলে গিয়েছিল। তাই এতদিন বেরোয়নি। পরশু বেয়ার মেঝে সাফ করতে গিয়ে পায়। এটাই হচ্ছে আমার রঙের তুরুপ। দিস উইল ফিনিশ হিঙ্গোয়ানি।

কিন্তু যখন চুরিটা হয় তখন তো হিঙ্গেরাজ-থুড়ি, হিঙ্গোয়ানি-আপিসে ছিলেন না।

ননসেন্স গৰ্জিয়ে উঠলেন ডিটেকটিভ। হিঙ্গোয়ানি চুরিটা করে মাঝরাত্তিরে, আপিস টাইমে নয়। গোয়েঙ্কা বিল্ডিং-এ টি এইচ সিন্ডিকেটের আপিস। সেই বিল্ডিং-এর দারোয়ানকে পাঁচশো টাকা ঘুষ দিয়ে হিঙ্গোয়ানি আপিসে ঢেকে রাত দুটোয়। এ কথা দারোয়ান পুলিশের দাবিড়ানিতে স্বীকার করেছে। সিন্দুকের কম্বিনেশন তেওয়ারি হিঙ্গোয়ানিকে বলেছিল, সেটা তেওয়ারির এখন পরিষ্কার মনে পড়েছে। প্ৰায় বছর পনেরো আগে তেওয়ারির জনডিস হয়, হাসপাতালে ছিল, খুব খারাপ অবস্থা। হিঙ্গোয়ানি তখন তার পার্টনার আর ঘনিষ্ঠ বন্ধু! বন্ধুকে ডেকে তেওয়ারি বলে, আমি মরে গেলে আমার সিন্দুক কী করে খোলা হবে? হিঙ্গোয়নি ব্যাপারটা হেসে উড়িয়ে দেয়। কিন্তু তেওয়ারি জোর করে তাকে নম্বরটা নোট করে নিতে বলে। হিঙ্গোয়ানি সে অনুরোধ রাখে।

কিন্তু হিঙ্গোয়ানি হঠাৎ টাকা চুরি করবে। কেন?

কারণ ওর পকেট ফাঁক হয়ে আসছিল, গলা সপ্তমে তুলে বললেন আগন্তুক। শেষ বয়সে জুয়ার নেশা ধরেছিল! প্রতি মাসে একবার করে কাঠমাণ্ডু যেত। ওখানে জুয়ার আড়ত ক্যাসিনো আছে জানেন তো? সেই ক্যাসিনোতে গিয়ে হাজার হাজার টাকা খুইয়েছে রুলেটে। তেওয়ারি ব্যাপারটা জেনে যায়। হিঙ্গোয়ানিকে অ্যাডভাইস দিতে যায়। হিঙ্গোয়ানি খেপে ওঠে। এমন দশা হয়েছিল। লোকটার যে, বাড়ির দামি জিনিসপত্র বেচিতে শুরু করে। শেষে মরিয়া হয়ে পার্টনারের সিন্দুকের দিকে চোখ দেয়।

আপনি কী করবেন স্থির করেছেন।

তোমাদের এখান থেকে আমি তার ঘরেই যাব। আমার বিশ্বাস, চুরির টাকা তার সঙ্গেই আছে। তেওয়ারি কেমন মানুষ, জানেন?–সে বলেছে, তার টাকা ফেরত পেলে সে তার পুরনো পার্টনারের বিরুদ্ধে কোনও স্টেপ নেবে না। এই খবরটা আমি হিঙ্গোয়ানিকে জানাব-তাতে যদি তার চেতনা হয়।

আর যদি না হয়?

ভদ্রলোক সিগারেটে একটা লম্বা টান দিয়ে সেটাকে অ্যাশট্রেতে পিষে ফেলে একটা ক্রুর

হাসি হেসে বললেন, সে ক্ষেত্রে অন্য ব্যবস্থা নিতে হবে।

আপনি গোয়েন্দা হয়ে আ-আইন-বিরুদ্ধ কাজ—?

ইয়েস, মিস্টার মিটার! গোয়েন্দা শুধু এক রকমই হয় না, নানা রকম হয়। আমি অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করি। এটা কি আপনি জানেন না যে, গোয়েন্দা আর ক্রিমিন্যালে প্রভেদ সামান্যই?

ভদ্রলোক উঠে পড়লেন। আবার জটায়ুর সঙ্গে জবরদস্ত হ্যান্ডশেক করে—গ্ল্যান্ড ঢুঁ মিট ইউ, মিস্টার মিটার। গুড ডে। বলে গাটগটিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

আমরা তিনজন কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলাম। ফেলুদাই প্রথম কথা বলল।

থ্যাঙ্ক ইউ, লালমোহনবাবু। মীন থাকার সুবিধে হচ্ছে যে, চিন্তার আরও বেশি সময় পাওয়া যায়। কোনও একটা ব্যারামে—হয়তো ডায়াবেটিস—হিঙ্গোয়ানি রোগ হয়ে যাচ্ছিলেন। তাই সেদিন বারবার কবজি থেকে ঘড়ি নেমে যাওয়া, আর চুরির সময় আঙুল থেকে আংটি খুলে যাওয়া।

আপনি কি তা হলে ওই গোয়েন্দার কথা বিশ্বাস করছেন?

করছি, লালমোহনবাবু, করছি। অনেক ব্যাপার, যা ধোঁয়াটে লাগছিল, তা ওর কথায় স্পষ্ট হয়ে গেছে। তবে হিঙ্গোয়ানি টাকা চুরি করে অর্থাভাব মেটানোর জন্য নয়; সে কাঠমাণ্ডুতে জুয়া খেলে যতই টাকা খুইয়ে থাকুক, নয়নকে পেয়ে সে বোঝে, তার সব সমস্যা মিটে যাবে। সে টাকা চুরি করে মিরাকলস আনলিমিটেড কোম্পানিকে দাঁড় করানোর জন্য, তরফদারকে ব্যাক করার জন্য।

তা হলে এখন আপনি হিঙ্গোয়ানির সঙ্গে দেখা করবেন না?

তার তো কোনও প্রয়োজন নেই! যিনি দেখা করবেন। তিনি হলেন ডিটেকনিকের এই গোয়েন্দা। হিঙ্গোয়ানিকে তেওয়ারির টাকা বাধ্য হয়েই এই গোয়েন্দার হাতে তুলে দিতে হবে-প্রাণের ভয়ে। কাজেই তরফদারের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে তার আর কোনও ভবিষ্যৎ নেই।

তা হলে এখন…?

এইখানেই দাঁড়ি দিন, লালমোহনবাবু। এর পরে যে কী, তা আমি নিজেই জানি না।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *