গুরুদক্ষিণা
জীবিকার তাগিদে জীবনে শিক্ষকতাকে বেছে নেওয়ার পর নানারকম বিচিত্র ধরণের অভিজ্ঞতা হয়েছে আমার । তারই একটি অভিজ্ঞতা এখানে আপনাদের সাথে শেয়ার করছি।
চাকরীসূত্রে পাঁচ সাত বছর পরপর একটি স্কুল থেকে আর এক স্কুলে আমাকে বদলী হতে হয়েছে। এটা রুটিন মাফিক ট্রান্সফার। সকলকেই হতে হয় এডুকেশন ডিপার্টমেন্টের প্রয়োজন মতো।
সেবার তিলজলায়, হতদরিদ্র ছেলেমেয়েদের এক প্রাথমিক স্কুলে পড়াতে গেছি। সেখানে পড়াশুনার চেয়ে স্কুলে এসে গুলতানি করাটাই ছেলেমেয়েদের মূখ্য কাজ। বাবা মা সকালে লোকের বাড়ি কাজে বেরিয়ে যায়। তা’রা ছেলেমেয়েদের এই ভেবে স্কুলে পাঠায় যে সারাদিন পথে পথে ঘুরে বেড়াবার চেয়ে স্কুলে গিয়ে খানিকটা নিরাপদে থাকবে, পড়াশুনা হোক বা না হোক।
আমি একদিন টিফিনের পর ক্লাস নিতে গিয়ে শুনি, সকলেরই কিছু না কিছু চুরি গেছে ব্যাগ থেকে। কারও খাতা, কারও বই, কারও পেন্সিল, কারও রাবার, কারও বা টিফিনবাক্স থেকে খাবার। কে চুরি করতে পারে সকলেই জানে, কিন্তু হাতেনাতে কোনদিন তাকে ধরতে পারেনি কেউ। শুধু আজ নয়, প্রায় দিনই এ’ধরণের চুরি হয়।
ক্লাস শেষ হলে, আমি গোপনে ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে নামটা জেনে নিই। নামটা ধরুন তার গোপাল দাস ।
পরদিন আমি তাকে ডেকে ক্লাসের মণিটার করে দিই। আর বলি, কেউ যদি ক্লাসে দুষ্টুমি করে, তাহলে তার নাম বোর্ডে লিখে রাখবি। আর বলি, এখন থেকে ক্লাসে কারও কোন জিনিষ চুরি না হয়, সে’সব দেখার দায়িত্বও তোর। কারও কিছু চুরি হলে আমি তোকে ধরব। এই দায়িত্ব পেয়ে সে যেমন একদিকে গর্বিত হয়, অন্যদিকে পড়ে যায় ফাঁপরে। গর্বিত হওয়ার কারণ, এতটা মূল্য তাকে আর কেউ কোনদিন দেয়নি, সবার উপরে সর্দারী করার। আর ফাঁপরে পড়ার কারণ, নাম লিখবে কি করে সে, তার যে একেবারে অক্ষর জ্ঞান নেই। ‘ক অক্ষর গো- মাংস’ বলে প্রবাদে যাকে, সে একেবারে তাই।
আমি তাকে সাহস দিয়ে বলি, এ আর, কঠিন কী কাজ। শিখে নিবি, তোর যা বুদ্ধি তা’তে শিখতে বেশী দিন লাগবে না।
সত্যি সত্যিই কিছুদিনের মধ্যে সে ক্লাসের চল্লিশ জনের নাম লেখা শিখে ফেলে। ধীরে ধীরে পড়াশুনায়ও তার উন্নতি দেখা যায়। তারচেয়েও বড় কথা ক্লাস থেকে চুরি বন্ধ হয়ে যায় চিরতরে। তারপর সে সাফল্যের সাথে ক্লাস ফোর পাশ করে, অন্য স্কুলে গিয়ে ভর্তি হয়।
এ’সব দশ বার বছর আগেকার কথা।
একদিন ধর্মতলা থেকে ৩৯ নম্বর বাসে করে তিলজলার স্কুলে ফিরছি, বাসের টিকিট কাটতে গিয়ে দেখি, পকেটের পঞ্চাশ টাকার নোটটি হাওয়া, পকেটমার মেরে দিয়েছে। বারবার পকেটে খুঁজি, আমার চারপাশে খুঁজি, পায়ের কাছে দেখি নীচু হয়ে। এদিক সেদিক খুঁজে না পেয়ে হতাশ হয়ে পড়ি। নিজেকে কেমন অসহায় লাগে। ঠিক সে সময়ই একটি লম্বা চওড়া ছেলে, আমার দিকে এগিয়ে এসে বলে, কেমন আছেন স্যার? আমায় চিনতে পারছেন না? আমি গোপাল, আমার কথা আপনার মনে নেই?
মনে পড়ে যায় তার কথা। বলি, ,হ্যাঁ পারছি, মনে আছে। কেমন আছ তুমি? ভাল আছি স্যার, বলেই অতো লোকের মধ্যে নীচু হয়ে বাসের মধ্যে ঢিপ করে আমাকে একটা প্রণাম করে, আমি তাকে তুলে ধরে বলি, এ কী করছ? সে অমায়িক হেসে বলে, তাতে কি হয়েছে স্যার? আপনাকে এমন উৎভ্রান্ত দেখাচ্ছে কেন? আমি তাকে বলি, পকেট থেকে পঞ্চাশ টাকার নোটটি গায়েব হয়ে যাওয়ার কথা।
সে বলে, সে কী !
স্যার আপনার পায়ের কাছে ওটা কি পড়ে আছে, দেখুন তো?
আমি নীচু হয়ে ঝুঁকে দেখি, হ্যাঁ পঞ্চাশ টাকার নোটটিই পড়ে আছে। প্রাণে জল আসে আমার । আমি টাকাটি তুলে নিয়ে কন্ডাকটারের কাছ থেকে পাঁচ টাকার একটা টিকিট কাটি। আমি গোপালকে খুশি হয়ে বলি,একদিন স্কুলে এসে দেখা কোরো আমার সঙ্গে। সময় পেলে যাব স্যার। সারা মুখে হাসি ছড়িয়ে পড়ে তার, বলে, আপনি ভাল থাকবেন স্যার। আচ্ছা, বলে আমি বাস থেকে নেমে পড়ি তিলজলা স্টপেজে।
স্কুলে এসে সবাইকে ঘটনাটা বলতেই, সকলেই বলে ওঠে, আপনি জানেন না স্যার?
– কি?
– পড়াশুনা ছেড়ে দিয়ে, গোপাল তো এখন পকেটমারের লিডার হয়েছে?
– তাই নাকি? আমি আকাশ থেকে পড়ি। মনটা খারাপ হয়ে যায়। টাকা হারানোর চেয়েও আরও বেশী খারাপ।
তবে কি সে আমাকে গুরুদক্ষিণা দিয়ে গেল?