চোখ যখন প্রায় বুজে এসেছে
চোখ যখন প্রায় বুজে এসেছে, তখন হঠাৎ ফেলুদার মুখে ইংরিজি কথা শুনে অবাক হয়ে এক ধাক্কায় ঘুম ছুটে গেল। স্পষ্ট শুনলাম ফেলুদা বলল–
দেয়ার ওয়াজ এ ব্ৰাউন ক্ৰো।
আমি কনুইয়ের ভর করে উঠে বসলাম, ব্রাউন ক্ৰো? কাক আবার ব্রাউন হয় নাকি? এ সব কী আবোল-তাবোল বকছ ফেলুদা?
গ্যাবোরিওর বইগুলো বোধহয় পেয়ে গেলাম রে তোপ্সে।
সে কী? সমাধান হয়ে গেল?
খুব সহজ।…এদেশে এসে সাহেবরা যখন গোড়ার দিকে হিন্দি শিখত, তখন উচ্চারণের সুবিধের জন্য কতগুলো কায়দা বার করেছিল! দেয়ার ওয়জ এ ব্ৰাউন ক্রো-এই কথাটার সঙ্গে কিন্তু বাদামি কাকের কোনও সম্পর্ক নেই। এটা আসলে সাহেব তার বেয়ারাকে দরজা বন্ধ করতে বলছে।–দরওয়াজা বনধ করো। এই ত্রিনয়নের ব্যাপারটাও কতকটা সেই রকম! গোড়ায় ত্রিনয়নকে তিন ভেবে বার বার হোঁচট খাচ্ছিলাম।
সে কী? ওটা তিন নয় বুঝি? আমিও তো। ওটা তিন ভাবছিলাম।
উঁহু। তিন নয়। ত্রিনয়নের ত্রি-টা হল তিন। আর নয়ন হল নাইন। দুইয়ে মিলে থ্রি-নাইন। ত্রিনয়ন ও ত্ৰিনয়ন হল ত্রি-নাইন-ও-থ্রি-নাইন। এখানে ও মানে জিরো অর্থাৎ শূন্য।
আমি লাফিয়ে উঠলাম।
তা হলে একটু জিরো মানে—
এইট-টু-জিরো। জলের মতো সোজা। —সুতরাং পুরো সংখ্যা হচ্ছে–থ্রি-নাইন-জিরো-থ্রি-নাইন-এইট-টু-জিরো। কেমন, ঢুকাল মাথায়? এবার ঘুমো।
মনে মনে ফেলুদার বুদ্ধির তারিফ করে আবার বালিশে মাথা দিয়ে চোখ বুজতে যাব, এমন সময় আবার বারান্দায় পায়ের অওয়াজ।
রাজেনবাবু।
এত রাত্রে ভদ্রলোকের কী দরকার?
আবার ফেলুদাকে জিজ্ঞেস করতে হল, কিছু বলবেন রাজেনবাবু?
ছোটবাবু জিজ্ঞেস করলেন। আপনাদের আর কিছু দরকার লাগবে কি না।
না না, কিছু না। সব ঠিক আছে।
ভদ্রলোক যেভাবে এসেছিলেন সেইভাবেই আবার চলে গেলেন।
চোখ বন্ধ করার আগে বুঝতে পারলাম জানালার খড়খড়ি দিয়ে আসা চাঁদের আলোটা হঠাৎ ফিকে হয়ে গেল আর সেই সঙ্গে শোনা গেল দূর থেকে ভেসে আসা মেঘের গর্জন। তারপর বেড়ালটা কেথেকে জানি দুবার ম্যাও ম্যাও করে উঠল। তারপর আর কিছু মনে নেই।
সকালে উঠে দেখি ফেলুদা ঘরের জানালাগুলো খুলছে। বলল, রাত্তিরে বৃষ্টি হয়েছিল টের পাসনি?
রাত্রে যাই হোক, এখন যে মেঘ কেটে গিয়ে ঝলমলে রোদ বেরিয়েছে সেটা খাটে শোয়া অবস্থাতেও বাইরের গাছের পাতা দেখে বুঝতে পারছি।
আমরা ওঠার আধা ঘণ্টার মধ্যে চা এনে দিল বুড়ো গোকুল। দিনের আলোতে ভাল করে। ওর মুখ দেখে মনে হল গোকুল যে শুধু বুড়ো হয়েছে তা নয়; তার মতো এমন ভেঙে পড়া দুঃখী ভাব আমি খুব কম মানুষের মধ্যেই দেখেছি।
কালীকিঙ্করবাবু উঠেছেন? ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।
গোকুল কানে কম শোনে কি না জানি না; সে প্রশ্নটা শুনে কেমন যেন ফ্যাল-ফ্যাল মুখ করে ফেলুদার দিকে দেখল; তারপর দ্বিতীয়বার জিজ্ঞেস করতে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
সাড়ে সাতটা নাগাত আমরা কালীকিঙ্করবাবুর ঘরে গিয়ে হাজির হলাম।
ভদ্রলোক ঠিক কালকেরই মতো বিছানায় শুয়ে আছেন। কম্বলের তলায়! তাঁর পাশের জানালাটা দিয়ে রোদ আসে বলেই বোধহয় উনি সেটাকে বন্ধ করে রেখেছেন; ঘরটা তাই সকাল বেলাতেও বেশ অন্ধকার। যেটুকু আলো আছে সেটা আসছে বরাদ্দার দরজাটা দিয়ে। আজ প্রথম লক্ষ করলাম। ঘরের দেয়ালে কালীকিঙ্করবাবুর একটা বাঁধানো ফোটোগ্রাফ রয়েছে। ছবিটা বেশ কিছুদিন আগে তোলা, কারণ তখনও ভদ্রলোকের গোঁফ-দাড়ি পাকতে শুরু করেনি।
ভদ্রলোক বললেন, গ্যাবোরিওর বইগুলো আগে থেকেই বার করে রেখেছি, কারণ আমি জানি তুমি সফল হবেই।
ফেলুদা বলল, হয়েছি কি না সেটা আপনি বলবেন। খ্রি-নাইন-জিরো-থ্রি-নাইন-এইট-টু-জিরো। —ঠিক আছে?
সাবাশ গোয়েন্দা! হেসে বলে উঠলেন কালীকিঙ্কর মজুমদার। নাও, বইগুলো নিয়ে তোমার থলির মধ্যে পুরে ফেলো। আর দিনের আলোতে একবার সিন্দুকের গায়ের দাগগুলো দেখো দেখি। আমার তো দেখে মনে হচ্ছে না। ওটা নিয়ে চিন্তা করার কোনও কারণ আছে।
ফেলুদা বলল, ঠিক আছে। আপনি নিশ্চিন্তু থাকলেই হল।
ফেলুদা আরেকবার ধন্যবাদ দিয়ে প্রথম ডিটেকটিভ ঔপন্যাসিকের লেখা বই চারখানা তার ঝোলার মধ্যে পুরে নিল।
তোমরা চা খেয়েছ তো? কালীকিঙ্করবাবু জিজ্ঞেস করলেন।
আজ্ঞে হ্যাঁ
ড্রাইভারকে বলা আছে। গাড়ি ঝর করেই রেখেছে। তামাদের স্টেশনে পৌঁছে দেবে। বিশ্বনাথ খুব ভোরে বেরিয়ে গেছে। বলল ওর দশটার মধ্যে কলকাতায় পৌঁছতে পারলে সুবিধে হয়। রাজেন গেছে বাজারে। গোকুল তোমাদের জিনিসপত্র গাড়িতে তুলে দেবে।..তোমরা কি স্টেশনে যাবার আগে একটু আশেপাশে ঘুরে দেখতে চাও?
ফেলুদা বলল, আমি ভাবছিলাম সাড়ে দশটার ট্রেনটার জন্য অপেক্ষা না করে এখনই বেরিয়ে পড়লে হয়তো ৩৭২ ডাউনটা ধরতে পারব।
তা বেশ তো, তোমাদের মতো শহুরে লোকেদের পল্লীগ্রামে বন্দি করে রাখতে চাই না আমি। তবে তুমি আসাতে আমি যে খুবই খুশি হয়েছি—সেটা আমার একেবারে অন্তরের কথা।