Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

দ্বিতীয় খণ্ড

প্রথম পরিচ্ছেদ
পাঁচে পাঁচে দশ বৎসর অতীত হইয়া গেল। যে দিন প্রফুল্লকে বাগদীর মেয়ে বলিয়া হরবল্লভ তাড়াইয়া দিয়াছিলেন, সে দিন হইতে দশ বৎসর হইয়া গিয়াছে। এই দশ বৎসর হরবল্লভ রায়ের পক্ষে বড় ভাল গেল না। দেশের দুর্দ্দশার কথা পূর্বেই বলিয়াছি। ইজারাদার দেবী সিংহের অত্যাচার, তার উপরে ডাকাইতের অত্যাচার। একবার হরবল্লভের তালুক হইতে টাকা চালান আসিতেছিল, ডাকাইতে তাহা লুঠিয়া লইল। সে বার দেবী সিংহের খাজনা দেওয়া হইল না। দেবী সিংহ একখানা তালুক বেচিয়া লইল। দেবী সিংহের বেচিয়া লওয়ার প্রথা মন্দ ছিল না। হেষ্টিংস সাহেব ও গঙ্গাগোবিন্দ সিংহের কৃপায় সকল সরকারী কর্মচারী দেবী সিংহের আজ্ঞাবহ; বেচা কেনা সম্বন্ধে সে যাহা মনে করিত, তাহাই করিত। হরবল্লভের দশ হাজার টাকার মূল্যের তালুকখানা আড়াই শত টাকায় দেবী সিংহ নিজে কিনিয়া লইলেন। তাহাতে বাকী খাজানা কিছুই পরিশোধ হইল না, দেনার জের চলিল। দেবী সিংহের পীড়াপীড়িতে, কয়েদের আশঙ্কায়, হরবল্লভ আর একটা সম্পত্তি বন্ধক দিয়া ঋণ পরিশোধ করিলেন। এই সকল কারণে আয় বড় কমিয়া আসিল। কিন্তু ব্যয় কিছুই কমিল না–বুনিয়াদি চাল খাটো করা যায় না। সকল লোকেরই প্রায় এমন না এমন এক দিন উপস্থিত হয়, যখন লক্ষ্মী আসিয়া বলেন, “হয় সাবেক চাল ছাড়, নয় আমায় ছাড়।” অনেকেই উত্তর দেন, “মা! তোমায় ছাড়িলাম, চাল ছাড়িতে পারি না।” হরবল্লভ তাহারই একজন। দোল-দুর্গোৎসব, ক্রিয়া-কর্ম, দান-ধ্যান, লাঠালাঠি পূর্বমতই হইতে লাগিল–বরং ডাকাইতে চালান লুঠিয়া লওয়া অবধি লাঠিয়ালের খরচটা কিছু বাড়িয়াছিল। খরচ আর কুলায় না। কিস্তি কিস্তি সরকারী খাজানা বাকি পড়িতে লাগিল। বিষয় আশয় যাহা কিছু অবশিষ্ট ছিল, তাহাও বিক্রয় হইয়া যায়, আর থাকে না। দেনার উপর দেনা হইল, সুদে আসল ছাপাইয়া উঠিল–টাকা আর ধার পাওয়া যায় না।

এদিকে দেবী সিংহের পাওনা প্রায় পঞ্চাশ হাজার টাকা বাকি পড়িল। হরবল্লভ কিছুতেই টাকা দিতে পারেন না–শেষ হরবল্লভ রায়কে গ্রেপ্তার করিবার জন্য পরওয়ানা বাহির হইল। তখনকার গ্রেপ্তারি পরওয়ানার জন্য বড় আইন-কানুন খুঁজিতে হইত না, তখন ইংরেজের আইন হয় নাই। সব তখন বে-আইন।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

বড় ধুম পড়িয়াছে। ব্রজেশ্বর শ্বশুরবাড়ী আসিয়াছেন। কোন্ শ্বশুরবাড়ী, তাহা বলা বাহুল্য। সাগরের বাপের বাড়ী। তখনকার দিনে একটা জামাই আসা বড় সহজ ব্যাপার ছিল না। তাতে আবার ব্রজেশ্বর শ্বশুরবাড়ী সচরাচর আসে না। পুকুরে পুকুরে, মাছমহলে ভারি হুটাহুটি, ছুটাছুটি পড়িয়া গেল। জেলের দৌরাত্ম্যে প্রাণ আর রক্ষা হয় না। জেলে-মাগীদের হাঁটাহাঁটিতে পুকুরের জল কালী হইয়া যাইতে লাগিল। মাছ চুরির আশায় ছেলেরা পাঠশালা ছাড়িয়া দিল। দই, দুধ, ননী, ছানা, সর, মাখনের ফরমাইসের জ্বালায় গোয়ালার মাথা বেঠিক হইয়া উঠিল; সে কখনও এক সের জল মিশাইতে তিন সের মিশাইয়া ফেলে, তিন সের মিশাইতে এক সের মিশাইয়া বসে। কাপড়ের ব্যাপারীর কাপড়ের মোট লইয়া যাতায়াত করিতে করিতে পায় ব্যথা হইয়া গেল; কাহারও পছন্দ হয় না, কোন্ ধুতি চাদর কে জামাইকে দিবে। পাড়ার মেয়েমহলে বড় হাঙ্গামা পড়িল। যাহার যাহার গহনা আছে, তারা সে সকল সারাইতে, মাজিতে, ঘষিতে, নূতন করিয়া গাঁথাইতে লাগিল। যাহাদের গহনা নাই, তাহারা চুড়ি কিনিয়া, শাঁখা কিনিয়া, সোণা-রূপা চাহিয়া চিন্তিয়া এক রকম বেশভূষার যোগাড় করিয়া রাখিল–নহিলে জামাই দেখিতে যাওয়া হয় না। যাঁহাদের রসিকতার জন্য পসার আছে–তাঁহারা দুই চারিটা প্রাচীন তামাশা মনে মনে ঝালাইয়া রাখিলেন; যাহাদের পসার নাই, তাহারা চোরাই মাল পাচার করিবার চেষ্টায় রহিল। কথার তামাশা পরে হবে–খাবার তামাশা আগে। তাহার জন্য ঘরে ঘরে কমিটি বসিয়া গেল। বহুতর কৃত্রিম আহার্য, পানীয়, ফল-মূল প্রস্তুত হইতে লাগিল। মধুর অধরগুলি মধুর হাসিতে ও সাধের মিশিতে ভরিয়া যাইতে লাগিল।

কিন্তু যার জন্য এত উদ্যোগ, তার মনে সুখ নাই। ব্রজেশ্বর আমোদ-আহ্লাদের জন্য শ্বশুরালয়ে আসেন নাই। বাপের গ্রেপ্তারির জন্য পরওয়ানা বাহির হইয়াছে–রক্ষার উপায় নাই। কেহ টাকা ধার দেয় না। শ্বশুরের টাকা আছে–শ্বশুর ধার দিলে দিতে পারে, তাই ব্রজেশ্বর শ্বশুরের কাছে আসিয়াছেন।

শ্বশুর বলিলেন, “বাপু হে, আমার যে টাকা, সে তোমারই জন্য আছে–আমার আর কে আছে, বল? কিন্তু টাকাগুলি যত দিন আমার হাতে আছে, তত দিন আছে,-তোমার বাপকে দিলে কি আর থাকবেব? মহাজনে খাইবে। অতএব কেন আপনার ধন আপনি নষ্ট করিতে চাও?”

ব্রজেশ্বর বলিল, “হৌক–আমি ধনের প্রত্যাশী নই–আমার বাপকে বাঁচান আমার প্রথম কাজ।”

শ্বশুর রুক্ষভাবে বলিলেন, “তোমার বাপ বাঁচিলে আমার মেয়ের কি? আমার মেয়ের টাকা থাকিলে দুঃখ ঘুচিবে–শ্বশুর বাঁচিলে দুঃখ ঘুচিবে না।”

কড়া কথায় ব্রজেশ্বরের বড় রাগ হইল। ব্রজেশ্বর বলিলেন, “তবে আপনার মেয়ে টাকা লইয়া থাকুক। বুঝিয়াছি, জামাইয়ে আপনার কোন প্রয়োজন নাই। আমি জন্মের মত বিদায় হইলাম।”

তখন সাগরের পিতা দুই চক্ষু রক্তবর্ণ করিয়া ব্রজেশ্বরকে বিস্তর তিরস্কার করিলেন। ব্রজেশ্বর কড়া কড়া উত্তর দিল। কাজেই ব্রজেশ্বর তল্পিতল্পা বাঁধিতে লাগিল। শুনিয়া, সাগরের মাথায় বজ্রাঘাত হইল।

সাগরের মা জামাইকে ডাকিয়া পাঠাইলেন। জামাইকে অনেক বুঝাইলেন। জামাইয়ের রাগ পড়িল না। তার পর সাগরের পালা।

বধূ শ্বশুরবাড়ী আসিলে দিবসে স্বামীর সাক্ষাৎ পাওয়া সেকালে যতটা দুরূহ ছিল, পিত্রালয়ে ততটা নয়। সাগরের সঙ্গে নিভৃতে ব্রজেশ্বরের সাক্ষাৎ হইল। সাগর ব্রজেশ্বরের পায় পড়িল, বলিল, “আর এক দিন থাক–আমি ত কোন অপরাধ করি নাই?”
ব্রজেশ্বরের তখন বড় রাগ ছিল–রাগে পা টানিয়া লইলেন। রাগের সময় শারীরিক ক্রিয়া সকল বড় জোরে জোরে হয়, আর হাত-পায়ের গতিও ঠিক অভিমতরূপ হয় না। একটা করিতে বিকৃতি জন্য আর একটা হইয়া পড়ে। সেই কারণে, আর কতকটা সাগরের ব্যস্ততার কারণ, পা সরাইয়া লইতে প্রমাদ ঘটিল। পা একটু জোরে সাগরের গায়ে লাগিল। সাগর মনে করিল, স্বামী রাগ করিয়া আমাকে লাথি মারিলেন। সাগর স্বামীর পা ছাড়িয়া দিয়া কুপিত ফণিনীর ন্যায় দাঁড়াইয়া উঠিল। বলিল, “কি? আমায় লাথি মারিলে?”

বাস্তবিক ব্রজেশ্বরের লাথি মারিবার ইচ্ছা ছিল না, –তাই বলিলেই মিটিয়া যাইত। কিন্তু একে রাগের সময়, আবার সাগর চোখ-মুখ ঘুরাইয়া দাঁড়াইল, –ব্রজেশ্বরের রাগ বাড়িয়া গেল। বলিলেন, “যদি মারিয়াই থাকি? তুমি না হয় বড়মানুষের মেয়ে, কিন্তু পা আমার–তোমার বড়মানুষ বাপও এ পা একদিন পূজা করিয়াছিলেন।”

সাগর রাগে জ্ঞান হারাইল। বলিল, “ঝক্মায়রি করিয়াছিলেন। আমি তার প্রায়শ্চিত্ত করিব।”

ব্র। পালটে লাথি মারবে না কি?

সা। আমি তত অধম নহি। কিন্তু আমি যদি ব্রাহ্মণের মেয়ে হই, তবে তুমি আমার পা–সাগরের কথা ফুরাইতে না ফুরাইতে পিছনের জানালা হইতে কে বলিল, “আমার পা কোলে লইয়া চাকরের মত টিপিয়া দিবে।”

সাগরের মুখে সেই রকম কি কথা আসিতেছিল। সাগর না ভাবিয়া চিন্তিয়া, পিছন ফিরিয়া না দেখিয়া রাগের মাথায় সেই কথাই বলিল, “আমার পা কোলে লইয়া চাকরের মত টিপিয়া দিবে।”

ব্রজেশ্বরও রাগে সপ্তমে চড়িয়া কোন দিকে না চাহিয়া বলিল, “আমারও সেই কথা। যত দিন আমি তোমার পা টিপিয়া দিই, তত দিন আমিও তোমার মুখ দেখিব না। যদি আমার এই প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ হয়, তবে আমি অব্রাহ্মণ।”

তখন রাগে রাগে তিনটা হইয়া ফুলিয়া ব্রজেশ্বর চলিয়া গেল। সাগর পা ছড়াইয়া কাঁদিতে বসিল। এমন সময়ে সাগর যে ঘরে বসিয়া কাঁদিতেছিল, সেই ঘরে একজন পরিচারিকা, ব্রজেশ্বর গেলে পর সাগরের কি অবস্থা হইয়াছে, ইহা দেখিবার অভিপ্রায়ে ভিতরে প্রবেশ করিল, ছুতানাতা করিয়া দুই একটা কাজ করিতে লাগিল। তখন সাগরের মনে পড়িল যে, জানালা হইতে কে কথা কহিয়াছিল। সাগর তাহাকে জিজ্ঞাসা করিল, “তুই জানেলা হইতে কথা কহিয়াছিলি?”

সে বলিল, “কই না?”

সাগর বলিল, “তবে কে জানেলায় দেখ্ ত।”

তখন সাক্ষাৎ ভগবতীর মত রূপবতী ও তেজস্বিনী একজন স্ত্রীলোক ঘরের ভিতর প্রবেশ করিল। সে বলিল, “জানালায় আমি ছিলাম।”

সাগর জিজ্ঞাসা করিল, “তুমি কে গা?”

তখন সে স্ত্রীলোক বলিল, “তোমরা কি কেউ আমায় চেন না?”

সাগর বলিল, “না–কে তুমি?” তখন সেই স্ত্রীলোক উত্তর করিল, “আমি দেবী চৌধুরাণী।”

পরিচারিকার হাতে পানের বাটা ছিল, ঝন্ ঝন্ করিয়া পড়িয়া গেল। সেও কাঁপিতে কাঁপিতে আঁ–আঁ–আঁ–আঁ শব্দ করিতে করিতে বসিয়া পড়িল। কাঁকালের কাপড় খসিয়া পড়িল।

দেবী চৌধুরাণী তাহার দিকে ফিরিয়া বলিল, “চুপ রহো, হারামজাদি! খাড়া রহো।”

পরিচারিকা কাঁদিতে কাঁদিতে উঠিয়া স্তম্ভিতের ন্যায় দাঁড়াইয়া রহিল। সাগরেরও গায়ে ঘাম দিতেছিল। সাগরের মুখেও কথা ফুটিল না। যে নাম তাহাদের কাণে প্রবেশ করিয়াছিল, তাহা ছেলে বুড়ো কে না শুনিয়াছিল? সে নাম অতি ভয়ানক।

কিন্তু সাগর আবার ক্ষণেক পরে হাসিয়া উঠিল। তখন দেবী চৌধুরাণীও হাসিল।

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

বর্ষাকাল। রাত্রি জ্যোৎস্না। জ্যোৎস্না এমন বড় উজ্জ্বল নয়, বড় মধুর, একটু অন্ধকারমাখা–পৃথিবীর স্বপ্নময় আবরণের মত। ত্রিস্রোতা নদী জলপ্লাবনে কূলে কূলে পরিপূর্ণ। চন্দ্রের কিরণে সেই তীব্রগতি নদীজলের স্রোতের উপর–স্রোতে, আবর্তে, কদাচিৎ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র তরঙ্গে জ্বলিতেছে। কোথাও জল একটু ফুটিয়া উঠিতেছে–সেখানে একটু চিকিমিকি; কোথাও চরে ঠেকিয়া ক্ষুদ্র বীচিভঙ্গ হইতেছে, সেখানে একটু ঝিকিমিকি। তীরে, গাছের গোড়ায় জল আসিয়া লাগিয়াছে–গাছের ছায়া পড়িয়া সেখানে জল বড় অন্ধকার; অন্ধকারে গাছের ফুল, ফল, পাতা বাহিয়া তীব্র স্রোত চলিতেছে; তীরে ঠেকিয়া জল একটু তর-তর কল-কল পত-পত শব্দ করিতেছে–কিন্তু সে আঁধারে আঁধারে। আঁধারে, আঁধারে, সে বিশাল জলধারা সমুদ্রানুসন্ধানে পক্ষিণীর বেগে ছুটিয়াছে। কূলে কূলে অসংখ্য কল-কল শব্দ, আবর্তের ঘোর গর্জন, প্রতিহত স্রোতের তেমনি গর্জন; সর্বশুদ্ধ একটা গম্ভীর গগনব্যাপী শব্দ উঠিতেছে।

সেই ত্রিস্রোতার উপরে, কূলের অনতিদূরে একখানি বজরা বাঁধা আছে। বজরার অনতিদূরে একটা বড় তেঁতুলগাছের ছায়ায়, অন্ধকারে আর একখানি নৌকা আছে–তাহার কথা পরে বলিব, আগে বজরার কথা বলি। বজরাখানি নানাবর্ণে চিত্রিত; তাহাতে কত রকম মুরদ আঁকা আছে। তাহার পিতলের হাতল ডাণ্ডা প্রভৃতিতে রূপার গিলটিি। গলুইয়ে একটা হাঙ্গরের মুখ–সেটাও গিলটি করা। সর্বত্র পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, উজ্জ্বল, আবার নিস্তব্ধ। নাবিকেরা এক পাশে বাঁশের উপর পাল ঢাকা দিয়া শুইয়া আছে; কেহ জাগিয়া থাকার চিহ্ন নাই। কেবল বজরার ছাদের উপর–একজন মানুষ। অপূর্ব দৃশ্য!

ছাদের উপর একখানি ছোট গালিচা পাতা। গালিচাখানি দুই আঙ্গুল পুরু–বড় কোমল, নানাবিধ চিত্রে চিত্রিত। গালিচার উপর বসিয়া একজন স্ত্রীলোক। তাহার বয়স অনুমান করা ভার–পঁচিশ বৎসরের নীচে তেমন পূর্ণায়ত দেহ দেখা যায় না; পঁচিশ বৎসরের উপর তেমন যৌবনের লাবণ্য কোথাও পাওয়া যায় না। বয়স যাই হউক–সে স্ত্রীলোক পরম সুন্দরী, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। এ সুন্দরী কৃশাঙ্গী নহে–অথচ স্থূলাঙ্গী বলিলেই ইহার নিন্দা হইবে। বস্তুতঃ ইহার অবয়ব সর্বত্র ষোল কলা সম্পূর্ণ–আজি ত্রিস্রোতা যেমন কূলে কূলে পুরিয়াছে, ইহারও শরীর তেমনই কূলে কূলে পুরিয়াছে। তার উপর বিলক্ষণ উন্নত দেহ। দেহ তেমন উন্নত বলিয়াই স্থূলাঙ্গী বলিতে পারিলাম না। যৌবন-বর্ষার চারি পোয়া বন্যার জল, সে কমনীয় আধারে ধরিয়াছে–ছাপায় নাই। কিন্তু জল কূলে কূলে পুরিয়া টল-টল করিতেছে–অস্থির হইয়াছে। জল অস্থির, কিন্তু নদী অস্থির নহে; নিস্তরঙ্গ। লাবণ্য চঞ্চল, কিন্তু সে লাবণ্যময়ী চঞ্চলা নহে–নির্বিকার। সে শান্ত, গম্ভীর, মধুর অথচ আনন্দময়ী; সেই জ্যোৎস্নাময়ী নদীর অনুষঙ্গিনী। সেই নদীর মত, সেই সুন্দরীও বড় সুসজ্জিতা। এখন ঢাকাই কাপড়ের তত মর্যাদা নাই–কিন্তু এক শত বৎসর আগে কাপড়ও ভাল হইত, উপযুক্ত মর্যাদাও ছিল। ইহার পরিধানে একখানি পরিষ্কার মিহি ঢাকাই, তাতে জরির ফুল। তাহার ভিতর হীরা-মুক্তা-খচিত কাঁচলি ঝক্মনক করিতেছে। নদীর জলে যেমন চিকিমিকি–এই শরীরেও তাই। জ্যোৎস্নাপুলকিত স্থির নদীজলের মত–সেই শুভ্র বসন; আর জলে মাঝে মাঝে যেমন জ্যোৎস্নার চিকিমিকি চিকিমিকি–শুভ্র বসনের মাঝে মাঝে যেমন হীরা, মুক্তা, মতির চিকিমিকি। আবার নদীর যেমন তীরবর্তী বনচ্ছায়া, ইহারও তেমনি অন্ধকার কেশরাশি আলুলায়িত হইয়া অঙ্গের উপর পড়িয়াছে। কোঁকড়াইয়া, ঘুরিয়া ঘুরিয়া, ফিরিয়া ফিরিয়া গোছায় গোছায় খেলা করিতেছে; তাহার সুগন্ধি-চূর্ণ-গন্ধে গগন পরিপূরিত হইয়াছে। এক ছড়া যূঁই ফুলের গড়ে সেই কেশরাজি সংবেষ্টন করিতেছে।
ছাদের উপর গালিচা পাতিয়া, সেই বহুরত্নমণ্ডিতা রূপবতী মূর্তিমতী সরস্বতীর ন্যায় বীণাবাদনে নিযুক্তা। চন্দ্রের আলোয় জ্যোৎস্নার মত বর্ণ মিশিয়াছে; তাহার সঙ্গে সেই মৃদুমধুর বীণার ধ্বনিও মিশিতেছে– যেমন জলে জলে চন্দ্রের কিরণ খেলিতেছে যেমন এ সুন্দরীর অলঙ্কারে চাঁদের আলো খেলিতেছে, এ বন্যকুসুম-সুগন্ধি কৌমুদীস্নাত বায়ুস্তরসকলে সেই বীণার শব্দ তেমনি খেলিতেছিল। ঝম্ ঝম্ ছন্ ছন্ ঝনন্ ঝনন্ ছনন্ ছনন্ দম্ দম্ দ্রিম্ দ্রিম্ বলিয়া বীণে কত কি বাজিতেছিল, তাহা আমি বলিতে পারি না। বীণা কখন কাঁদে, কখন রাগিয়া উঠে, কখন নাচে, কখন আদর করে, কখন গর্জ্জিয়া উঠে,-বাজিয়ে টিপি টিপি হাসে। ঝিঁঝিট, খাম্বাজ, সিন্ধু–কত মিঠে রাগীণী বাজিল– কেদার, হাম্বীর, বেহাগ– কত গম্ভীর রাগিণী বাজিল– কানাড়া, সাহানা বাগীশ্বরী–কত জাঁকাল রাগিণী বাজিল–নাদ, কুসুমের মালার মত নদীকল্লোল-স্রোতে ভাসিয়া গেল। তার পর দুই একটা পরদা উঠাইয়া নামাইয়া লইয়া, সহসা নূতন উৎসাহে উন্মুখী হইয়া সে বিদ্যাবতী ঝন্-ঝন্ করিয়া বীণের তারে বড় বড় ঘা দিল। কাণের পিপুলপাত দুলিয়া উঠিল–মাথায় সাপের মত চুলের গোছা সব নড়িয়া উঠিল–বীণে নটরাগিণী বাজিতে লাগিল। তখন যাহারা পাল মুড়ি দিয়া এক প্রান্তে নিঃশব্দে নিদ্রিতবৎ শুইয়াছিল, তাহার মধ্যে একজন উঠিয়া আসিয়া নিঃশব্দে সুন্দরীর নিকট দাঁড়াইল।

এ ব্যক্তি পুরুষ। সে দীর্ঘদায় ও বলিষ্ঠগঠন; ভারি রকমের এক জোড়া চৌগোঁপ্পা আছে। গলায় যজ্ঞোপবীত। সে নিকটে আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “কি হইয়াছে?”

সেই স্ত্রীলোক বলিল, “দেখিতে পাইতেছ না?”

পুরুষ বলিল, “কিছু না। আসিতেছে কি?”

গালিচার উপর একটা ছোট দূরবীন পড়িয়াছিল। দূরবীন তখন ভারবর্ষে নূতন আমদানি হইতেছিল। দূরবীন লইয়া সুন্দরী ঐ ব্যক্তির হাতে দিল–কিছু বলিল না। সে দূরবীন চক্ষে দিয়া নদীর সকল দিক নিরীক্ষণ করিল। শেষে এক স্থানে আর একখানি বজরা দেখিতে পাইয়া বলিল, “দেখিয়াছি–টেঁকের মাথায়–ঐ কি?”

উ। এ নদীতে আজকাল আর কোন বজরা আসিবার কথা নাই।

পুরুষ পুনর্বার দূরবীন দিয়া নিরীক্ষণ করিতে লাগিল।

যুবতী বীণা বাজাইতে বাজাইতে বলিল, “রঙ্গরাজ!”

রঙ্গরাজ উত্তর করিল, “আজ্ঞা?”

“দেখ কি?”

“কয় জন লোক আছে, তাই দেখি।”

“কয় জন?”

“ঠিক ঠাওর পাই না। বেশী নয়। খুলিব?”

“খোল–ছিপ। আঁধারে আঁধারে নিঃশব্দে উজাইয়া যাও।” তখন রঙ্গরাজ ডাকিয়া বলিল, “ছিপ খোল।”

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

পূর্বে বলিয়াছি, বজরার কাছে তেঁতুলগাছের ছায়ায় আর একখানি নৌকা অন্ধকারে লুকাইয়াছিল। সেখানি ছিপ–ষাট হাত লম্বা, তিন হাতের বেশী চৌড়া নয়। তাহাতে প্রায় পঞ্চাশ জন মানুষ গাদাগাদি হইয়া শুইয়াছিল। রঙ্গরাজের সঙ্কেত শুনিবামাত্র সেই পঞ্চাশ জন একেবারে উঠিয়া বসিল। বাঁশের চেলা তুলিয়া সকলেই এক একগাছা সড়কি ও এক একখানা ছোট ঢাল বাহির করিল। হাতিয়ার কেহ হাতে রাখিল না–সবাই আপনার নিকট চেলার উপরে সাজাইয়া রাখিল। রাখিয়া সকলেই এক একখানা “বোটে” হাতে করিয়া বসিল।

নিঃশব্দে ছিপ খুলিয়া, তাহারা বজরায় আসিয়া লাগাইল। রঙ্গরাজ তখন নিজে পঞ্চ হাতিয়ার বাঁধিয়া উহার উপর উঠিল। সেই সময়ে যুবতী তাহাকে ডাকিয়া বলিল, “রঙ্গরাজ, আগে যাহা বলিয়া দিয়াছি, মনে থাকে যেন।”

“মনে আছে” বলিয়া রঙ্গরাজ ছিপে উঠিল। ছিপ নিঃশব্দে তীরে তীরে উজাইয়া চলিল। এদিকে যে বজরা রঙ্গরাজ দূরবীনে দেখিয়াছিল, তাহা নদী বাহিয়া খরস্রোতে তীব্রবেগে আসিতেছিল। ছিপকে বড় বেশী উজাইতে হইল না। বজরা নিকট হইলে, ছিপ তীর ছাড়িয়া বজরার দিকে ধাবমান হইল। পঞ্চাশখানা বোটে, কিন্তু শব্দ নাই।

এখন, সেই বজরার ছাদের উপরে আট জন হিন্দুস্থানী রক্ষক ছিল। এত লোক সঙ্গে না করিয়া তখনকার দিনে কেহ রাত্রিকালে নৌকা খুলিতে সাহস করিত না। আট জনের মধ্যে, দুই জন হাতিয়ারবন্ধ হইয়া, মাথায় লাল পাগড়ি বাঁধিয়া ছাদের উপর বসিয়াছিল–আর ছয় জন মধুর দক্ষিণ বাতাসে চাঁদের আলোতে কালো দাড়ি ছড়াইয়া, সুনিদ্রায় অভিভূত ছিল। যাহারা পাহারায় ছিল, তাহাদের মধ্যে একজন দেখিল–ছিপ বজরার দিকে আসিতেছে। সে দস্তুরমত হাঁকিল, “ছিপ তফাৎ!”

রঙ্গরাজ উত্তর করিল, “তোর দরকার হয়, তুই তফাৎ যা।”

প্রহরী দেখিল, বেগোছ। ভয় দেখাইবার জন্য বন্দুকে একটা ফাঁকা আওয়াজ করিল। রঙ্গরাজ বুঝিল, ফাঁকা আওয়াজ। হাসিয়া বলিল, “কি পাঁড়ে ঠাকুর! একটা ছর্ক‍রাও নাই? ধার দিব?”

এই বলিয়া রঙ্গরাজ সেই প্রহরীর মাথা লক্ষ্য করিয়া বন্দুক উঠাইল। তার পর বন্দুক নামাইয়া বলিল, “তোমায় এবার মারিব না। এবার তোমার লাল পাগড়ি উড়াইব।” এই কথা বলিতে বলিতে রঙ্গরাজ বন্দুক রাখিয়া, তীর ধনু লইয়া সজোরে তীর ত্যাগ করিল। প্রহরীর মাথার লাল পাগড়ি উড়িয়া গেল। প্রহরী “রাম রাম!” শব্দ করিতে লাগিল।

বলিতে বলিতে ছিপ আসিয়া বজরার পিছনে লাগিল। অমনি দশ বার জন লোক ছিপ হইতে হাতিয়ার সমেত বজরার উপর উঠিয়া পড়িল। যে ছয় জন হিন্দুস্থানী নিদ্রিত ছিল, তাহারা বন্দুকের আওয়াজে জাগরিত হইয়াছিল বটে, কিন্তু ঘুমের ঘোরে হাতিয়ার হাতড়াইতে তাহাদের দিন গেল। ক্ষিপ্রহস্তে আক্রমণকারীরা তাহাদিগকে নিমেষমধ্যে বাঁধিয়া ফেলিল। যে দুই জন আগে হইতে জাগ্রত ছিল, তাহারা লড়াই করিল, কিন্তু সে অল্পক্ষণ মাত্র। আক্রমণকারীরা সংখ্যায় অধিক, শীঘ্র তাহাদিগকে পরাস্ত ও নিরস্ত্র করিয়া বাঁধিয়া ফেলিল। তখন ছিপের লোক বজরার ভিতর প্রবেশ করিতে উদ্যত হইল। বজরার দ্বার বন্ধ।

ভিতরের ব্রজেশ্বর। তিনি শ্বশুরবাড়ী হইতে বাড়ী যাইতেছিলেন। পথে এই বিপদ। এ কেবল তাঁহার সাহসের ফল। অন্য কেহ সাহস করিয়া রাত্রে বজরা খুলিত না।

রঙ্গরাজ কপাটে করাঘাত করিয়া বলিল, “মহাশয়! দ্বার খুলুন।”

ভিতর হইতে সদ্যোনিদ্রোত্থিত ব্রজেশ্বর উত্তর করিল, “কে? এত গোল কিসের?”
রঙ্গরাজ বলিল, “গোল কিছুই না–বজরায় ডাকাইত পড়িয়াছে।”

ব্রজেশ্বর কিছুক্ষণ স্তব্ধ হইয়া, পরে ডাকিতে লাগিল, “পাঁড়ে! তেওয়ারি! রামসিং!”

রামসিং ছাদের উপর হইতে বলিল, “ধর্মাবতার! শালা লোক সব্ কোইকো বাঁধ্প‍কে রাক্খাা।”

ব্রজেশ্বর ঈষৎ হাসিয়া বলিল, “শুনিয়া বড় দুঃখিত হইলাম। তোমাদের মত বীরপুরুষদের ডালরুটি খাইতে না দিয়া বাঁধিয়া ফেলিয়াছে! ডাকাইতের এ বড় ভ্রম। ভাবনা করিও না–কাল ডালরুটির বরাদ্দ বাড়াইয়া দিব।”

শুনিয়া রঙ্গরাজও ঈষৎ হাসিল। বলিল, “আমারও সেই মত; এখন দ্বার খুলিবেন বোধ হয়।”

ব্রজেশ্বর জিজ্ঞাসা করিল, “তুমি কে?”

র। আমি একজন ডাকাইত মাত্র। দ্বার খোলেন এই ভিক্ষা।

“কেন দ্বার খুলিব?”

র। আপনার সর্বস্ব লুটপাট করিব।

ব্রজেশ্বর বলিল, “কেন? আমাকে কি হিন্দুস্থানী ভেড়ীওয়ালা পাইলে? আমার হাতে দোনলা বন্দুক আছে–তৈয়ার, যে প্রথম কামরায় প্রবেশ করিবে, নিশ্চয় তাহার প্রাণ লইব।”

র। একজন প্রবেশ করিব না–কয় জনকে মারিবেন? আপনিও ব্রাহ্মণ–আমিও ব্রাহ্মণ। এক তরফ ব্রহ্মহত্যা হইবে। মিছামিছি ব্রহ্মহত্যায় কাজ কি?

ব্রজেশ্বর বলিল, “সে পাপটা না হয় আমিই স্বীকার করিব।”

এই কথা ফুরাইতে ফুরাইতে মড়্ মড়্ শব্দ হইল। বজরার পাশের দিকের একখানা কপাট ভাঙ্গিয়া, একজন ডাকাইত কামরার ভিতর প্রবেশ করিল দেখিয়া, ব্রজেশ্বর হাতের বন্দুক ফিরাইয়া তাহার মাথায় মারিল। দস্যু মূর্চ্ছিত হইয়া পড়িল। এই সময়ে রঙ্গরাজ বাহিরের কপাটে জোরে দুই বার পদাঘাত করিল। কপাট ভাঙ্গিয়া গেল। রঙ্গরাজ কামরার ভিতর প্রবেশ করিল। ব্রজেশ্বর আবার বন্দুক ফিরাইয়া ধরিয়া, রঙ্গরাজকে লক্ষ্য করিতেছিলেন, এমন সময়ে রঙ্গরাজ তাঁহার বন্দুক কাড়িয়া লইল। দুই জনেই তুল্য বলশালী, তবে রঙ্গরাজ অধিকতর ক্ষিপ্রহস্ত। ব্রজেশ্বর ভাল করিয়া ধরিতে না ধরিতে, রঙ্গরাজ বন্দুক কাড়িয়া লইল। ব্রজেশ্বর তখন দৃঢ়তর মুষ্টিবদ্ধ করিয়া সমুদয় বলের সহিত রঙ্গরাজের মাথায় এক ঘুষি তুলিল । রঙ্গরাজ ঘুষিটা হাতে ধরিয়া ফেলিল। বজরার একদিকে অনেক অস্ত্র ঝুলান ছিল। এই সময়ে ব্রজেশ্বর ক্ষিপ্রহস্তে তাহার মধ্য হইতে একখানা তীক্ষ্ণধার তরবারি লইয়া হাসিয়া বলিল, “দেখ ঠাকুর, ব্রহ্মহত্যায় আমার ভয় নাই।” এই বলিয়া রঙ্গরাজকে কাটিতে ব্রজেশ্বর তরবারি উঠাইল। সেই সময়ে আর চারি পাঁচ জন দস্যু মুক্তদ্বারে কামরার ভিতর প্রবেশ করিয়া, তাহার উপর পড়িল। উত্থিত তরবারি হাত হইতে কাড়িয়া লইল। দুই জনে দুই হাত চাপিয়া ধরিল–একজন দড়ি লইয়া ব্রজেশ্বরকে বলিল, “বাঁধিতে হইবে কি?” তখন ব্রজেশ্বর বলিল, “বাঁধিও না। আমি পরাজয় স্বীকার করিলাম। কি চাও বল–আমি দিতেছি।”

রঙ্গরাজ বলিল, “আপনার যাহা কিছু আছে, সব লইয়া যাইব। কিছু ছাড়িয়া দিতে পারিতাম–কিন্তু যে কিল তুলিয়াছিলেন–আমার মাথায় লাগিলে মাথা ভাঙ্গিয়া যাইত–এক পয়সাও ছাড়িব না।”

ব্রজেশ্বর বলিল, “যাহা বজরায় আছে–সব লইয়া যাও, এখন আর আপত্তি করিব না।”

ব্রজেশ্বর এ কথা বলিবার পূর্বেই দস্যুরা জিনিসপত্র বজরা হইতে ছিপে তুলিতে আরম্ভ করিয়াছিল। এখন প্রায় পঁচিশ জন লোক বজরায় উঠিয়াছিল। জিনিসপত্র বজরায় বিশেষ কিছু ছিল না, কেবল পরিধেয় বস্ত্রাদি, পূজার সামগ্রী, এইরূপ মাত্র। মুহূর্তমধ্যে তাহারা সেই সকল দ্রব্য ছিপে তুলিয়া ফেলিল। তখন আরোহী রঙ্গরাজকে বলিল, “সব জিনিস লইয়াছ–আর কেন দিক কর, এখন স্বস্থানে যাও।”
রঙ্গরাজ উত্তর করিল, “যাইতেছি। কিন্তু আপনাকেও আমাদের সঙ্গে যাইতে হইবে।”

ব্র। সে কি? আমি কোথায় যাইব?

র। আমাদের রাণীর আছে।

ব্র। তোমাদের আবার রাণী কে?

র। আমাদের রাজরাণী।

ব্র। তিনি আবার কে? ডাকাইতের রাজরাণী ত কখন শুনি নাই।

র। দেবী রাণীর নাম কখনও শুনেন নাই?

ব্র। ও হো! তোমরা দেবী চৌধুরাণীর দল?

র। দলাদলি আবার কি? আমরা রাণীজির কার্পলর্‌দাজ।

ব্র। যেমন রাণী, তেমন কার্পকর্‌দাজ! তা, আমাকে রাণী দর্শনে যাইতে হইবে কেন? আমাকে কয়েদ রাখিয়া কিছু আদায় করিবে, এই অভিপ্রায়?

র। কাজেই বজরায় ত কিছু পাইলাম না। আপনাকে আটক করিলে যদি কিছু পাওয়া যায়।

ব্র। আমারও যাইবার ইচ্ছা হইতেছে–তোমাদের রাজরাণী একটা দেখবার জিনিস শুনিয়াছি। তিনি না কি যুবতী?

র। তিনি আমাদের মা–সন্তানে মার বয়সের হিসাব রাখে না।

ব্র। শুনিয়াছি বড় রূপবতী।

র। আমাদের মা ভগবতীর তুল্য।

ব্র। চল, তবে ভগবতী-দর্শনে যাই।

এই বলিয়া, ব্রজেশ্বর রঙ্গরাজের সঙ্গে কামরার বাহিরে আসিলেন। দেখিলেন যে, বজরার মাঝিমাল্লা সকলে ভয়ে জলে পড়িয়া কাছি ধরিয়া ভাসিয়া আছে। ব্রজেশ্বর তাহাদিগকে বলিলেন, “এখন তোমরা বজরায় উঠিতে পার–ভয় নাই। উঠিয়া আল্লার নাম নাও। তোমাদের জান ও মান ও দৌলত ও ইজ্জৎ সব বজায় আছে! তোমরা বড় হুঁশিয়ার!”

মাঝিরা তখন একে একে বজরায় উঠিতে লাগিল। ব্রজেশ্বর রঙ্গরাজকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “এখন আমার দ্বারবান্ ‍দের বাঁধন খুলিয়া দিতে পারি কি?”

রঙ্গরাজ বলিল, “আপত্তি নাই। উহারা যদি হাত খোলা পাইয়া আমাদের উপর আক্রমণ করে, তখনই আমরা আপনার মাথা কাটিয়া ফেলিব। ইহা উহাদের বুঝাইয়া দিন।”

ব্রজেশ্বর দ্বারবান্ ‍দিগকে সেইরূপ বুঝাইয়া দিলেন। আর ভরসা দিলেন যে, তাহারা যেরূপ বীরত্ব প্রকাশ করিয়াছে, তাহাতে শীঘ্রই তাহাদের ডালরুটির বরাদ্দ বাড়িবে। তখন ব্রজেশ্বর ভৃত্যবর্গকে আদেশ করিলেন যে, “তোমরা নিঃশঙ্কচিত্তে এইখানে বজরা লইয়া থাক। কোথাও যাইও না বা কিছু করিও না। আমি শীঘ্র ফিরিয়া আসিতেছি।” এই বলিয়া তিনি রঙ্গরাজের সঙ্গে ছিপে উঠিলেন। ছিপের নাবিকেরা “দেবী রাণী-কি জয়” হাঁকিল–ছিপ বাহিয়া চলিল।

পঞ্চম পরিচ্ছেদ

ব্রজেশ্বর যাইতে যাইতে রঙ্গরাজকে জিজ্ঞাসা করিল, “আমাকে কত দূর লইয়া যাইবে–তোমার রাণীজি কোথায় থাকেন?”

র। ঐ বজরা দেখিতেছ না? ঐ বজরা তাঁর।

ব্র। ও বজরা? আমি মনে করিয়াছিলাম, ওখানা ইংরেজের জাহাজ–রঙ্গপুর লুটিতে আসিয়াছে। তা এত বড় বজরা কেন?

র। রাণীকে রাণীর মত থাকিতে হয়। উহাতে সাতটা কামরা আছে।

ব্র। এত কামরায় কে থাকে?

র। একটায় দরবার। একটায় রাণীর শয়নঘর। একটায় চাকরাণীরা থাকে। একটায় স্নান হয় একটায় পাক হয়। একটা ফাটক। বোধ হয়, আপনাকে আজ সেই কামরায় থাকিতে হইবে।

এই কথোপকথন হইতে হইতে ছিপ আসিয়া বজরার পাশে ভিড়িল। দেবী রাণী ওরফে দেবী চৌধুরাণী তখন আর ছাদের উপর নাই। যতক্ষণ তাহার লোকে ডাকাইতি করিতেছিল, দেবী ততক্ষণ ছাদের উপর বসিয়া জ্যোৎস্নালোকে বীণা বাজাইতেছিল। তখন বাজনাটা বড় ভাল হইতেছিল না–বেসুর, বেতাল, কি বাজিতে কি বাজে–দেবী অন্যমনা হইতেছিল। তার পরে যে ছিপ ফিরিল, দেবী অমনি নামিয়া কামরার ভিতরে প্রবেশ করিয়াছিল। এদিকে রঙ্গরাজ ছিপ হইতে কামরার দ্বারে আসিয়া দাঁড়াইয়া, “রাণীজি-কি জয়” বলিল। দ্বারে রেশমী পর্দা ফেলা আছে–ভিতরে দেখা যায় না। ভিতর হইতে দেবী জিজ্ঞাসা করিল, “কি সংবাদ?”

র। সব মঙ্গল।

দেবী। তোমাদের কেহ জখম হইয়াছে?

র। কেহ না।

দেবী। তাহাদের কেহ খুন হইয়াছে?

র। কেহ না–আপনার আজ্ঞামত কাজ হইয়াছে।

দেবী। তাহাদের কেহ জখম হইয়াছে?

র। দুইটা হিন্দুস্থানী দুই একটা আঁচড় খেয়েছে। কাঁটা ফোটার মত।

দেবী। মাল?

র। সব আনিয়াছি। মাল এমন কিছু ছিল না।

দেবী। বাবু?

র। বাবুকে ধরিয়া আনিয়াছি।

দেবী। হাজির কর।

রঙ্গরাজ তখন ব্রজেশ্বরকে ইঙ্গিত করিল। ব্রজেশ্বর ছিপ হইতে উঠিয়া আসিয়া দ্বারে দাঁড়াইল।

দেবী জিজ্ঞাসা করিল, “আপনি কে?” দেবীর যেন বিষম লাগিয়াছে–গলার আওয়াজটা বড় সাফ নয়।

ব্রজেশ্বর যেরূপ লোক, পাঠক এতক্ষণে বুঝিয়াছেন বোধ হয়। ভয় কাহাকে বলে, তাহা তিনি বালককাল হইতে জানেন না। যে দেবী চৌধুরাণীর নামে উত্তর-বাঙ্গালা কাঁপিত, তাহার কাছে আসিয়া ব্রজেশ্বরের হাসি পাইল। মনে ভাবিলেন, “মেয়েমানুষকে পুরুষে ভয় করে, এ ত কখনও শুনি নাই। মেয়েমানুষ ত পুরুষের বাঁদী।” হাসিয়া ব্রজেশ্বর দেবীর কথায় উত্তর দিলেন, “পরিচয় লইয়া কি হইবে? আমার ধনের সঙ্গে আপনাদিগের সম্বন্ধ, তাহা পাইয়াছেন–নামে ত টাকা হইবে না।”

দেবী। হইবে বৈ কি? আপনি কি দরের লোক, তাহা জানিলে টাকার ঠিকানা হইবে। (তবু গলাটা ধরা ধরা।)

ব্র। সেইজন্যই কি আমাকে ধরিয়া আনিয়াছেন?

দেবী। নহিলে আপনাকে আনিতাম না।
দেবী পর্দার আড়ালে, কেহ দেখিল না যে, দেবী এই কথা বলিবার সময় চোখ মুছিল।

ব্র। আমি যদি বলি, আমার নাম দুঃখিরাম চক্রবর্তী, আপনি বিশ্বাস করিবেন কি?

দেবী। না।

ব্র। আপনি বলেন কি না, দেখিবার জন্য।

ব্র। আমার নাম কৃষ্ণগোবিন্দ ঘোষাল।

দেবী। না।

ব্র। দয়ারাম বক্সী।

দেবী। তাও না।

ব্র। ব্রজেশ্বর রায়।

দেবী। হইতে পারে।

এই সময়ে দেবীর কাছে আর একজন স্ত্রীলোক নিঃশব্দে আসিয়া বসিল। বলিল, “গলাটা ধরে গেছে যে?”

দেবীর চক্ষের জল আর থাকিল না–বর্ষাকালে ফুটন্ত ফুলের ভিতর যেমন বৃষ্টির জল পোরা থাকে, ডাল নাড়া দিলেই ছড়্ ছড়্ করিয়া পড়িয়া যায়, দেবীর চোখে তেমনি জল পোরা ছিল, ডাল নাড়া দিতেই ঝর্ ঝর্ করিয়া পড়িয়া গেল। দেবী তখন ঐ স্ত্রীলোককে কাণে কাণে বলিল, “আমি আর এ রঙ্গ করিতে পারি না। তুই কথা ক। সব জানিস ত?”

এই বলিয়া দেবী সে কামরা হইতে উঠিয়া অন্য কামরায় গেল। ঐ স্ত্রীলোকটি দেবীর আসন গ্রহণ করিয়া, ব্রজেশ্বরের সহিত কথা কহিতে লাগিল। এই স্ত্রীলোকের সঙ্গে পাঠকের পরিচয় আছে–ইনি সেই বামনশূন্য বামনী–নিশি ঠাকুরাণী।

নিশি বলিল, “এইবার ঠিক বলেছ–তোমার নাম ব্রজেশ্বর রায়।”

ব্রজেশ্বরের একটু গোল বাধিল। পর্দার আড়ালে কিছুই দেখিতে পাইতেছিলেন না–কিন্তু কথার আওয়াজে সন্দেহ হইল যে, যে কথা কহিতেছিল, এ সে বুঝি নয়। তার আওয়াজটা বড় মিঠে লাগিতেছিল–এ বুঝি তত মিঠে নয়। যাই হউক, কথার উত্তরে ব্রজেশ্বর বলিলেন, “যদি আমার পরিচয় জানেন, তবে এই বেলা দরটা চুকাইয়া লউন–আমি স্বস্থানে চলিয়া যাই। কি দরে আমাকে ছাড়িবেন?”

নি। এক কড়া কাণা কড়ি। সঙ্গে আছে কি? থাকে যদি, দিয়া চলিয়া যান।

ব্র। আপাততঃ সঙ্গে নাই।

নি। বজরা হইতে আনিয়া দেন।

ব্র। বজরাতে যাহা ছিল, তাহা আপনার অনুচরেরা লইয়া আসিয়াছে। আর এক কড়া কাণা কড়িও নাই।

নি। মাঝিদের কাছে ধার করিয়া আনুন।

ব্র। মাঝিরাও কাণা কড়ি রাখে না।

নি। তবে যত দিন না আপনার উপযুক্ত মূল্য আনাইয়া দিতে পারেন, ততদিন কয়েদ থাকুন।

ব্রজেশ্বর তার পর শুনিলেন, কামররার ভিতরে আর একজন কে–কণ্ঠে সেও বোধহয় স্ত্রীলোক–দেবীকে বলিতেছে, “রাণীজি! যদি এক কড়া কাণা কড়িই এই মানুষটার দর হয়, তবে আমি এক কড়া কাণা কড়ি দিতেছি। আমার কাছে উহাকে বিক্রি করুন।”

ব্রজেশ্বর শুনিলেন, রাণী উত্তর করিল, “ক্ষতি কি? কিন্তু মানুষটা নিয়ে তুমি কি করিবে? ব্রাহ্মণ, জল তুলিতে, কাঠ কাটিতে পারিবে না।”

ব্রজেশ্বর প্রত্যুত্তরও শুনিলেন,–রমণী বলিল, “আমার রাঁধিবার ব্রাহ্মণ নাই। আমাকে রাঁধিয়া দিবে।”

তখন নিশি ব্রজেশ্বরকে সম্বোধন করিয়া বলিল, “শুনিলেন, –আপনি বিক্রি হইলেন–আমি কাণা কড়ি পাইয়াছি। যে আপনাকে কিনিল, আপনি তাহার সঙ্গে যান, রাঁধিতে হইবে।”

ব্রজেশ্বর বলিল, “কই তিনি?”

নি। স্ত্রীলোক–বাহিরে যাইবে না, আপনি ভিতরে আসুন।

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

ব্রজেশ্বর অনুমতি পাইয়া, পর্দা তুলিয়া কামরার ভিতরে প্রবেশ করিল। প্রবেশ করিয়া যাহা দেখিল, ব্রজেশ্বর তাহাতে বিস্মিত হইল। কামরার কাষ্ঠের দেওয়াল, বিচিত্র চারুচিত্রিত। যেমন আশ্বিন মাসে ভক্ত জনে দশভুজা প্রতিমা পূজা করিবার মানসে প্রতিমার চাল চিত্রিত করায় –এ তেমনি চিত্র। শুম্ভনিশুম্ভের যুদ্ধ; মহিষাসুরের যুদ্ধ; দশ অবতার; অষ্ট নায়িকা; সপ্ত মাতৃকা; দশ মহাবিদ্যা; কৈলাস; বৃন্দাবন; লঙ্কা; ইন্দ্রালয়; নবানারী-কুঞ্জর; বস্ত্রহরণ; সকলই চিত্রিত। সেই কামরায় চারি আঙ্গুল পুরু গালিচা পাতা তাহাতেও কত চিত্র। তার উপর কত উচ্চ মসনদ–মখমলের কামদার বিছানা, তিন দিকে সেইরূপ বালিশ; সোণার আতরদান, তারই গোলাব-পাশ, সোণার বাটা, সোনার পুষ্পপাত্র–তাহাতে রাশীকৃত সুগন্ধি ফুল; সোণার আলবোলা; পোরজরেরট‍ সটকা–সোণার মুখনলে মতির থোপ দুলিতেছে–তাহাতে মৃগনাভি-সুগন্ধি তামাকু সাজা আছে। দুই পাশে দুই রূপার ঝাড়, তাহাতে বহুসংখ্যক সুগন্ধি দীপ রূপার পরীর মাথার উপর জ্বলিতেছে; উপরের ছাদ হইতে একটি ছোট দীপ সোণার শিকলে লটকােন আছে। চারি কোণে চারিটি রূপার পুতুল, চারিটি বাতি হাতে করিয়া ধরিয়া আছে।–মসনদের উপর একজন স্ত্রীলোক শুইয়া আছে–তাহার মুখের উপর একখানা বড় মিহি জরির বুটাদার ঢাকাইরুমাল ফেলা আছে। মুখ ভাল দেখা যাইতেছে না–কিন্তু তপ্তকাঞ্চন-গৌরবর্ণ–আর কৃষ্ণ কুঞ্চিত কেশ অনুভূত হইতেছে; কাণের গহনা কাপড়ের ভিতর হইতে জ্বলিতেছে–তার অপেক্ষা বিস্তৃত চক্ষের তীব্র কটাক্ষ আরও ঝলসিতেছে। স্ত্রীলোকটি শুইয়া আছে–ঘুমায় নাই।

ব্রজেশ্বর দরবার-কামরায় প্রবেশ করিয়া শয়ানা সুন্দরীকে দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “রাণীজিকে কি বলিয়া আশীর্বাদ করিব?”

সুন্দরী উত্তর করিল, “আমি রাণীজি নই।”

ব্রজেশ্বর দেখিল, এতক্ষণ ব্রজেশ্বর যাহার সঙ্গে কথা কহিতেছিল, এ তাহার গলার আওয়াজ নহে। অথচ তার আওয়াজ হইতে পারে; কেন না বেশ স্পষ্ট বুঝা যাইতেছে যে, স্ত্রীলোক কণ্ঠ বিকৃত করিয়া কথা কহিতেছে। মনে করিল, বুঝি দেবী চৌধুরাণী হরবোলা, মায়াবিনী–এত কুহক না জানিলে মেয়েমানুষ হইয়া ডাকাইতি করে? প্রকাশ্যে জিজ্ঞাসা করিল, “এই যে তাঁহার সঙ্গে কথা কহিতেছিলাম–তিনি কোথায়?”

সুন্দরী বলিল, “তোমাকে আসিতে অনুমতি দিয়া, তিনি শুইতে গিয়াছেন। রাণীতে তোমার কি প্রয়োজন?”

ব্র। তুমি কে?

সুন্দরী। তোমার মুনিব।

ব্র। আমার মুনিব?

সুন্দরী। জান না, এই মাত্র তোমাকে এক কড়া কাণা কড়ি দিয়া কিনিয়াছি?

ব্র। সত্য বটে। তা তোমাকেই কি বলিয়া আশীর্বাদ করিব?

সুন্দরী। আশীর্বাদের রকম আছে না কি?

ব্র। স্ত্রীলোকের পক্ষে আছে। সধবাকে এক রকম আশীর্বাদ করিতে হয়, –বিধবাকে অন্যরূপ। পুত্রবতীকে–

সুন্দরী। আমাকে “শিগ্া‍গির মর” বলিয়া আশীর্বাদ কর।

ব্র। সে আশীর্বাদ আমি কাহাকেও করি না–তোমার একশ তিন বছর পরমায়ু হৌক।

সুন্দরী। আমার বয়স পঁচিশ বৎসর। আটাত্তর বৎসর ধরিয়া তুমি আমার ভাত রাঁধিবে?

ব্র। আগে একদিন ত রাঁধি। খেতে পার ত, না হয় আটাত্তর বৎসর রাঁধিব।
সুন্দরী। তবে বসো–কেমন রাঁধিতে জান, পরিচয় দাও।

ব্রজেশ্বর তখন সেই কোমল গালিচার উপর বসিল। সুন্দরী জিজ্ঞাসা করিল, “তোমার নাম কি?”

ব্র। তা ত তোমরা সকলেই জান, দেখিতেছি। আমার নাম ব্রজেশ্বর। তোমার নাম কি? গলা অত মোটা করিয়া কথা কহিতেছ কেন? তুমি কি চেনা মানুষ?

সুন্দরী। আমি তোমার মুনিব–আমাকে ‘আপুনি’ ‘মশাই’ আর ‘আজ্ঞে’ বলিবে।

ব্র। আজ্ঞে, তাই হইবে। আপনার নাম?

সুন্দরী। আমার নাম পাঁচকড়ি। কিন্তু তুমি আমার ভৃত্য, আমার নাম ধরিতে পারিবে না। বরং বল ত আমিও তোমার নাম ধরিব না।

ব্র। তবে কি বলিয়া ডাকিলে আমি ‘আজ্ঞা’ বলিব?

পাঁচ। আমি ‘রামধন’ বলিয়া তোমাকে ডাকিব। তুমি আমাকে ‘মুনিব ঠাকুরুণ’ বলিও। এখন তোমার পরিচয় দাও–বাড়ী কোথায়?

ব্র। এক কড়ায় কিনিয়াছ–অত পরিচয়ের প্রয়োজন কি?

পাঁচ। ভাল, সে কথা নাই বলিলে। রঙ্গরাজকে জিজ্ঞাসা করিলে জানিতে পারিব। রাঢ়ী, না বারেন্দ্র, না বৈদিক?

ব্র। হাতের ভাত ত খাইবেন–যাই হই না।

পাঁচ। তুমি যদি আমার স্বশ্রেণী না হও–তাহা হইলে তোমাকে অন্য কাজ দিব।

ব্র। অন্য কি কাজ?

পাঁচ। জল তুলিবে, কাঠ কাটিবে–কাজের অভাব কি!

ব্র। আমি রাঢ়ী।

পাঁচ। তবে তোমায় জল তুলিতে, কাঠ কাটিতে হইবে–আমি বারেন্দ্র। তুমি রাঢ়ী–কুলীন, না বংশজ?

ব্র। এ কথা ত বিবাহের সম্বন্ধের জন্যই প্রয়োজন হয়। সম্বন্ধ জুটিবে কি? আমি কৃতদার।

পাঁচ। কৃতদার? কয় সংসার করিয়াছেন?

ব্র। জল তুলিতে হয়–জল তুলিব–অত পরিচয় দিব না।

তখন পাঁচকড়ি দেবী রাণীকে ডাকিয়া বলিল, “রাণীজি! বামুন ঠাকুর বড় অবাধ্য। কথার উত্তর দেয় না।”

নিশি অপর কক্ষ হইতে উত্তর করিল, “বেত লাগাও।”

তখন দেবীর একজন পরিচারিকা সপাং করিয়া একগাছা লিকলিকে সরু বেত পাঁচকড়ির বিছানায় ফেলিয়া দিয়া চলিয়া গেল। পাঁচকড়ি বেত পাইয়া ঢাকাই রুমালের ভিতর মধুর অধর চারু দন্তে টিপিয়া বিছানায় বার দুই বেতগাছা আছড়াইল। ব্রজেশ্বরকে বলিল, “দেখিয়াছ?”

ব্রজেশ্বর হাসিল। বলিল, “আপনারা সব পারেন। কি বলিতে হইবে বলিতেছি।”

পাঁচ। তোমার পরিচয় চাই না–পরিচয় লইয়া কি হইবে? তোমার রান্না ত খাইব না। তুমি আর কি কাজ করিতে পার, বল?

ব্র। হুকুম করুন।

পাঁচ। জল তুলিতে জান?
ব্র। না।

পাঁচ। কাঠ কাটিতে জান?

ব্র। না।

পাঁচ। বাজার করিতে জান?

ব্র। মোটামুটি রকম।

পাঁচ। মোটামুটিতে চলিবে না। বাতাস করিতে জান?

ব্র। পারি।

পাঁচ। আচ্ছা, এই চামর নাও, বাতাস কর।

ব্রজেশ্বর চামর লইয়া বাতাস করিতে লাগিল। পাঁচকড়ি বলিল, “আচ্ছা, একটা কাজ জান? পা টিপিতে জান?”

ব্রজেশ্বরের দুরদৃষ্ট, তিনি পাঁচকড়িকে মুখরা দেখিয়া, একটি ছোট রকমের রসিকতা করিতে গেলেন। এই দস্যুনেত্রীদিগের কোন রকমে খুসি করিয়া মুক্তিলাভ করেন, সে অভিপ্রায়ও ছিল। অতএব পাঁচকড়ির কথার উত্তরে বলিলেন, “তোমাদের মত সুন্দরীর পা টিপিব, সে ত ভাগ্য_”

“তবে একবার টেপ না” বলিয়া অমনি পাঁচকড়ি আলতাদপরা রাঙ্গা পাখানি ব্রজেশ্বরের ঊরুর উপর তুলিয়া দিল।

ব্রজেশ্বর নাচার–আপনি পা টেপার নিমন্ত্রণ লইয়াছেন, কি করেন। ব্রজেশ্বর কাজেই দুই হাতে পা টিপিতে আরম্ভ করিলেন। মনে করিলেন, “এ কাজটা ভাল হইতেছে না, ইহার প্রায়শ্চিত্ত করিতে হইবে। এখন উদ্ধার পেলে বাঁচি।”

তখন দুষ্টা পাঁচকড়ি ডাকিল “রাণীজি! একবার এদিকে আসুন।”

দেবী আসিতেছে, ব্রজেশ্বর পায়ের শব্দ পাইল। পা নামাইয়া দিল। পাঁচকড়ি হাসিয়া বলিল, “সে কি? পিছাও কেন?” পাঁচকড়ি সহজ গলায় কথা কহিয়াছিল। ব্রজেশ্বর বড় বিস্মিত হইলেন–“সে কি? এ গলা ত চেনা গলাই বটে।” সাহস করিয়া ব্রজেশ্বর পাঁচকড়ির মুখঢাকা রুমালখানা খুলিয়া লইলেন। পাঁচকড়ি খিল্ খিল্ করিয়া হাসিয়া উঠিল।

ব্রজেশ্বর বিস্মিত হইয়া বলিল, “সে কি? এ কি? তুমি–তুমি সাগর?”

পাঁচকড়ি বলিল, “আমি সাগর। গঙ্গা নই–যমুনা নই–বিল নই–খাল নই–সাক্ষাৎ সাগর। তোমার বড় অভাগ্য–না? যখন পরের স্ত্রী মনে করিয়াছিলে, তখন বড় আহ্লাদ করিয়া পা টিপিতেছিলে, আর যখন ঘরের স্ত্রী হইয়া পা টিপিতে বলিয়াছিলাম, তখন রাগে গর্গহর্ করিয়া চলিয়া গেলে। যাক, এখন আমার প্রতিজ্ঞা রক্ষা হইয়াছে। তুমি আমার পা টিপিয়াছ। এখন আমার মুখপানে চাহিয়া দেখিতে পার, আমায় ত্যাগ কর, আর পায়ে রাখ–এখন জানিলে, আমি যথার্থ ব্রাহ্মণের মেয়ে।”

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress