Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » ছিন্নমস্তার অভিশাপ (১৯৭৮) – ফেলুদা || Satyajit Ray » Page 9

ছিন্নমস্তার অভিশাপ (১৯৭৮) – ফেলুদা || Satyajit Ray

ফেলুদার ঘরেই চা এনে দিল বুলাকিপ্ৰসাদ। আমরা আসার আগেই বাঘের হাতে চন্দ্রনের জখম হবার খবরটা ফেলুদা বুলকিপ্রসাদের কাছে পেয়ে গিয়েছিল; ফেলুদার ধারণা কারান্ডিকার ছাড়া এই বাঘ জ্যান্ত ধরার সাধ্যি কারুর নেই।

লালমোহনবাবু। গরম চায়ে একটা সশব্দ চুমুক দিয়ে বললেন, কিছু পেলেন ও ডায়রিতে? নাকি অরুণবাবুর কথাই ঠিক?

আপনিই বলুন না।

ফেলুদা একটা ডায়ারি খুলে লালমোহনবাবুর দিকে এগিয়ে দিল।

লালমোহনবাবু পড়লেন ‘Self elected President of club–meeting on 8.4.46—তারপর আরেকটা পাতা খুলে পড়লেন–Tea Party at Brig. Sudarshan’s আর তার পরের পাতায়–Trial for new suit at Shakurs-4 P.M…কী মশাই, এসব খুব তাৎপর্যপূর্ণ বুঝি?

তোপ্‌সে, তোর কী মনে হয়?

আমি লালমোহনবাবুর পিছন দিয়ে বুকে পড়ে দেখছিলাম, এবার ডায়রিটা হাতে নিয়ে নিলাম। আলোর কাছে আন, বলল ফেলুদা।

টেবিল ল্যাম্পের নীচে ডায়রিটা ধরে চোখটা কাছে নিতেই একটা শিহরন খেলে গেল। আমার শিরদাঁড়ায়।

বেশ বড় সাইজের ডায়রি, তার পাতার মাঝখানে ফাউনটেন পেনে ইংরেজিতে লেখা ছাড়াও অন্য লেখা রয়েছে। যেটা প্ৰায় চোখে দেখা যায় না। পাতার একেবারে উপর দিকে ছাপা তারিখেরও উপরে, খুব সরু করে কাটা হার্ড পেনসিল দিয়ে খুদে খুদে অক্ষরে হালকা লেখা।

কী দেখলি?

বাংলা লেখা।

কী লেখা?

এই পাতাটায় লেখা–পাঁচের বশে বাহন ধ্বংস।

সর্বনাশ, বললেন লালমোহনবাবু, এ যে আবার হেঁয়ালি দেখছি মশাই।

তা তো বটেই, বলল ফেলুদা, এবার এটা দেখুন। এটা ১৯৩৮ অর্থাৎ প্রথম বছরের ডায়রি, আর এটাই পেনসিালে প্রথম সাংকেতিক লেখা।

১৯৩৮-এর ডায়রির প্রথম পাতাতেই লিখেছেন ভদ্রলোক শাস্তু দুই-পাঁচের বশ।

শঙ্কুটি কে? লালমোহনবাবু প্রশ্ন করলেন।

ফেলুদা বলল, ভদ্রলোক নিজের বিষয় বলতে গেলে সব সময়ই শিবের কোনও না কোনও নাম ব্যবহার করেছেন।

শিবের নাম তো হল, কিন্তু দুই-পাঁচের বশ তো বোঝা গেল না।

রিপু বোঝেন? জিজ্ঞেস করল ফেলুদা।

মানে ছেঁড়া কাপড় সেলাই-টেলাই করা বলছেন?

আপনি ফারসি-সংস্কৃত গুলিয়ে ফেলছেন, লালমোহনবাবু! আপনি যেটা বলছেন সেটা হল রিফু। আমি বলছি রিপু।

ওহো–ষড়রিপু? মানে শত্রু?

শত্রু। এবার মানুষের এই ছটি শত্রুর নাম করুন তো।

ভেরি ইজি। কাম ক্ৰোধ লোভ মদ মোহ মাৎসর্য।

হল না। অর্ডারে ভুল। কাম ক্ৰোধ লোভ মোহ মদ মাৎসর্য। অর্থাৎ দুই আর পাঁচ হল ক্ৰোধ আর মদ।

ওয়ান্ডারফুল? বললেন লালমোহনবাবু, এ তে মিলে যাচ্ছে মশাই।

এবার তা হলে প্রথমটা আর-একবার দেখুন, এটাও মিলে যাবে।

এবারে আমার কাছেও ব্যাপারটা সহজ হয়ে গেছে। বললাম, বুঝেছি, দুইয়ের বশে বাহন ধ্বংস হচ্ছে, রাগের মাথায় গাড়ি ভাঙা।

ভেরি গুড, বলল ফেলুদা, তবে দুই-পাঁচ নিয়ে একটা সংকেতের এখনও সমাধান হয়নি।

যে ডায়রিগুলো দেখা হয়ে গেছে, সেগুলোর বিশেষ বিশেষ জায়গায় কাগজ গুঁজে রেখেছে ফেলুদা। তারই একটা জায়গা খুলে আমাদের দেখাল। লেখাটা হচ্ছে——২+৫=X ।

লালমোহনবাবু বললেন, এক্স তো মশাই আননোন কোয়ান্টিটি। ওটা বাদ দিন। আর, সব সংকেতেরই যে একটা গুরুত্বপূর্ণ মানে থাকবে সেটাই বা ভাবছেন কেন?

ফেলুদা বলল, যেখানে একটা লোক বছরে তিনশো পঁয়ষট্টি দিনে মাত্র পনেরো-বিশ দিন সংকেতের আশ্রয় নিয়েছে, সেখানে কারণটা যে জরুরি তা তো বোঝাই যাচ্ছে। কাজেই X-এর রহস্য আমাকে উদঘাটন করতেই হবে।

ওই তারিখের কাছাকাছি কোনও লেখা থেকে কোনও হেলপ পাচ্ছেন না?

ওর দশদিন পরে আর-একটা সংকেত আছে। দেখুন—

এটাও আমার কাছে অসম্ভব কঠিন বলে মনে হল। লেখাটা হচ্ছে-অনর্গল-ঘৃতকুমারী।

ফেলুদা বলল, লোকটা যে কথা নিয়ে কী না করেছে তাই ভাবছি।

আপনি ধরে ফেলেছেন?

আপনিও পারবেন-একটু হেলপ করলে।

ঘৃতকুমারী তো কবরেজির ব্যাপার মশাই, বললেন লালমোহনবাবু।

হ্যাঁ, বলল ফেলুদা, ঘৃতকুমারী তেল মাথায় মাখলে মাথা ঠাণ্ডা রাখে। অৰ্থাৎ রাগ কমায়।

কিন্তু তেল অনর্গল মাখতে হয় এ তো জানতুম না মশাই।

ফেলুদা হেসে বলল, আপনি ড্যাশটা অগ্রাহ্য করছেন কেন? ওটারও একটা মানে আছে। আর অর্গল মানে জানেন তো?

কপট। খিল।

এবার ওই দ্বিতীয় মানেটার সঙ্গে একটা নেগেটিভ জুড়ে দিন।

অখিল। আমি চেঁচিয়ে উঠলাম। তার মানে অখিলবাবু ওঁকে ঘৃতকুমারী ব্যবহার করতে বলেছিলেন।

সাবাশ। এবার পরেরটা দ্যাখ।

তিন পাতা পরে পড়ে দেখলাম-আজ থেকে পাঁচ বাদ। তার মানে মহেশবাবু মদ ছেড়ে দিলেন। কিন্তু তার এক মাস বাদেই মহেশবাবু লিখছেন–ভোলানাথ ভোলে না। আবার পাঁচ। পাঁচেই বিস্মৃতি।

ফেলুদা বলল, কিছু একটা ভুলে থাকার জন্য মহেশবাবু আবার মদের আশ্রয় নিয়েছেন। প্রশ্ন হচ্ছে–কী ভুলতে চাইছেন?

লালমোহনবাবু আর আমি মাথা চুলকোলাম! মহেশবাবু বলেছিলেন তাঁর জীবনে অনেক রহস্য। এখন মনে হচ্ছে কথাটা ঠাট্টা করে বলেননি।

ফেলুদা আর-একটা জায়গায় ডায়রিটা খুলে বলল, এটা খুব মন দিয়ে পড়ে দেখুন। কথা নিয়ে খেলার একটা আশ্চর্য উদাহরণ। অনেক তথ্য, অনেক জটিল মনের ভাব এই কয়েকটি কথার মধ্যে পুরে দেওয়া হয়েছে।

আমরা পড়লাম—আমি আজ থেকে পালক। পালক=feathere-হালকা। পালক-পালনকৰ্তর্গ। আজ থেকে শমির ভার আমার। শমি আমার মুক্তি।

শমি যে শঙ্করলাল মিশ্র সেটা আমি বুঝতে পারলাম। ফেলুদা বলল, শঙ্করলালকে মানুষ করার ভার বহন করতে পেরে মহেশবাবুর মন থেকে একটা ভার নেমে গেছে। এই ভারটা কীসের ভার সেইটে জানা দরকার।

ফেলুদা খাট থেকে উঠে কিছুক্ষণ চিন্তিত ভাবে পায়চারি করল। আমি ডায়রিগুলোর দিকে দেখছিলাম। কী অদ্ভুত লোক ছিলেন এই মহেশ চৌধুরী। বেঁচে থাকলে ফেলুদার সঙ্গে নিশ্চয়ই ভাব জমে যেত, কারণ ফেলুদারও। হেঁয়ালির দিকে ঝোঁক আর হেঁয়ালির সমাধানও করতে পারে আশ্চর্য চটপট।

লালমোহনবাবু খাটের এক কোনায় ভুরু কুঁচকে বসেছিলেন। বললেন, অখিলবাবু ভদ্রলোকের এত বন্ধু ছিলেন, ওঁকে কবরেজি ওষুধ দিয়েছেন, ওঁর কুষ্ঠি ঘেঁটেছেন, তাঁর তো মহেশবাবুর নাড়ীনক্ষত্র জানা উচিত। আপনি ডায়রি না ঘেঁটে তাঁকেই জেরা করুন না।

ফেলুদা পায়চারি থামিয়ে একটা চারমিনার ধরিয়ে বলল, এই ডায়ারিগুলোর মধ্যে দিয়ে আমি আসল মানুষটার সঙ্গে যোগ স্থাপন করার চেষ্টা করছি। ওই পেনসিলের লেখাগুলোতে আমার কাছে মহেশ চৌধুরী এখনও বেঁচে আছেন।

ওঁর ছেলেদের সম্বন্ধে কিছু পেলেন না ডায়রিতে?

প্রথম পনেরো বছরে বিশেষ কিছু নেই, তবে পরে—

একটা গাড়ি থামাল আমাদের গেটের বাইরে। ফিয়াটের হর্ন। চেনা শব্দ।

আমরা তিনজনে বারান্দায় এসে দেখলাম অরুণবাবু হাতে একটা প্যাকেট নিয়ে গাড়ি থেকে নামলেন।

মিঃ সিং-এর ওখানে যাচ্ছিলাম-এখানকার ফরেস্ট অফিসার, বললেন অরুণবাবু, তাই ভাবলাম বীরেনের চিঠিগুলো দিয়ে যাই। চিঠি অবিশ্যি নামেই। তাও আপনি যখন চেয়েছেন…

আপনাকে এই অবস্থায় এত ঝামেলার মধ্যে ফেললাম বলে আমি অত্যন্ত লজ্জিত।

দ্যাট্‌স অল রাইট, বললেন অরুণবাবু বাবা যে কী বলতে চাইছিলেন সেটা আমার কাছে রহস্য। দেখুন। যদি আপনি বুদ্ধি খাটিয়ে কিছু বার করতে পারেন। সত্যি বলতে কী, আমি বাবার সঙ্গ খুব বেশি পাইনি। হাজারিবাগে আসি মাঝে মাঝে আমার কাজের ব্যাপারে। এককালে প্রায়ই আসতাম। শিকারের জন্য। তা, বড় শিকার তো এরা বন্ধই করে দিয়েছে। কাল একটা সুযোগ পাওয়া গেছে।-দেখি!…

কী সুযোগ?

যে কারণে সিং-এর কাছে যাচ্ছি। খবর এসেছে রামগড়ের রাস্তায় আজ বিকেলেই নাকি বাঘাটা দেখা গেছে। এদিকে একটি ট্রেনার তো হাসপাতালে, অন্যটি মালিকের সঙ্গে ঝগড়াটিগড়া করে নিখোঁজ। আমি সিংকে বলেছি যে বাঘটাকে যদি মারতেই হয়, তো আমাকে মারতে দাও। অলরেডি তো তার দিকে গুলি চলেছে; যদি জখম হয়ে থাকে। তা হলে তো হি ইজ এ ডেঞ্জারাস বীস্ট।

আমার বলার ইচ্ছে ছিল বাঘটাকে দেখে তো জখম বলে মনে হয়নি, কিন্তু ফেলুদার ইশারাতে সেটা আর বললাম না।

আমি তো সঙ্গে থ্রি ওয়ান ফাইভটা নিচ্ছি, বললেন অরুণবাবু, কারণ এমনিতেই চারিদিকে প্যানিক। গোরু, ছাগলও গেছে এক আধটা। সকাসের খাঁচায় বন্দি অবস্থায় বুড়ো হয়ে মরার চেয়ে জঙ্গলে গুলি খেয়ে মারাটা খারাপ কীসে?…যাই হোক, আপনার ইন্টারেস্ট থাকলে আপনিও আসতে পারেন। কাল সকলে বেরোধ আমরা।

দেখি… বলল ফেলুদা।আমার এই কাজটা কতদূর এগোয় তার উপর নির্ভর করছে। ভাল কথা–

অরুণবাবু যাবার জন্য পা বাড়িয়েছিলেন, ফেলুদার কথায় খামলেন। ফেলুদা বলল, সেদিন পিকনিকে আপনিই তো বন্দুক ছুঁড়েছিলেন, তাই না?

ভদ্রলোক হেসে উঠলেন। আপনি বোধহয় ভাবছিলেন—বন্দুক চলল, অথচ শিকার নেই কেন? গোয়েন্দার মন তো! ওয়েল, আই মিসূড ইট। একটা বটের। সেরা শিকারিরও লক্ষ্য কি সব সময় অব্যৰ্থ হয়, মিঃ মিত্তির?

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress