তিন মহাদেশের শক্তি
তিন মহাদেশের শক্তি যাঁর পিছনে, সেই মুক্তানন্দের ফ্রেমে বাঁধানো পাসপোর্ট সাইজের ছবি এখন আমাদের ঘরে। আমরা চলে আসার ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই মহেশবাবু মারা যান। যাবার আগে ফেলুদার উপর যে তিনি কী দায়িত্ব দিয়ে গেছেন সেটা ফেলুদা বুঝলেও, আমি বুঝিনি। আর লালমোহনবাবুও নিশ্চয়ই বোঝেননি, কারণ উনি বললেন মহেশঝাবু নাকি ফেলুদাকে মুক্তানন্দের শিষ্য হতে বলে গেছেন। ফেলুদা যখন জিজ্ঞেস করল যে ছবিটা দেবার পরে দুটো আঙুল দেখানোর মানে কী, তখন লালমোহনবাবু বললেন মুক্তানন্দের শিষ্য হলে ফেলুদার শক্তি ডবল হয়ে যাবে এটাই বাঝাতে চেয়েছিলেন ভদ্রলোক। অবিশ্যি কাঁচকলা দেখালেন কেন সেটা বোঝা গেল না। স্বীকার করলেন। লালমোহনবাবু।
পরদিন সকালে অখিলবাবুর টেলিফোনে আমরা মৃত্যুসংবাদটা পেলাম।
এগারোটা নাগাদ শ্মশান থেকে ফেরার পথে লালমোহনবাবু জিজ্ঞেস করলেন, কৈলাসে যাবেন, না বাড়ি যাবেন? ফেলুদা বলল, এবেলা ওদিকটা না মাড়ানোই ভাল; অনেকে সমবেদনা জানাতে আসবে, কাজ হবে না কিছুই।
কী কাজের কথা বলছেন?
তথ্য সংগ্ৰহ।
দুপুরে খাবার পর বরাদ্দায় বসে ফেলুদা ওর সবুজ খাতায় কিছু নোিট লিখল। সেটা শেষ হলে এইরকম দাঁড়াল–
১। মহেশ চৌধুরী-জন্ম ২৩শে নভেম্বর ১৯০৭, মৃত্যু ২৪শে নভেম্বর ১৯৭৭ (স্বাভাবিক হার্ট অ্যাটাক? শক?)। হেঁয়ালিপ্রিয়। ডাকটিকিট, প্রজাপতি, পাথর। দোরাবাজীর দেওয়া মূল্যরান স্ট্যাম্প অ্যালবাম লোপাট (How?) মেজো ছেলের প্রতি টান। অন্য দুটির প্রতি মনোভাব কেমন? শঙ্করলালের প্রতি অপত্য স্নেহ। সুন্নবারি ছিল না। অতীতে মেজাজী, মদ্যপ। শেষ বয়সে সাত্ত্বিক, সদাশয়। অভিশাপ কেন? )
২। ঐ স্ত্রী-মৃত। কবে?
৩। ঐ বড় ছেলে অরুণেন্দ্র-জন্ম (আন্দাজ) ১৯৩৬। অভ্রব্যবসায়ী। কলকাতা-হাজারিবাগ যাতায়াত। মৃগয়াপ্রিয়! স্বল্পভাষী।
৪। ঐ মেজো ছেলে বীরেন্দ্র-জন্ম (আন্দাজ) ১৯৩৯। অগ্নিস্ফুলিঙ্গ। ১৯ বছর বয়সে দেশ-ছাড়া। কর্নেল সুরেশ বিশ্বাসের ভক্ত। বাপকে বিদেশ থেকে চিঠি লিখিত ৬৭ পর্যন্ত। জীবিত? মৃত? বাপের ধারণা সে ফিরে এসেছে?
৫। ছোট ছেলে প্রীতীন্দ্র-অরুণের সঙ্গে ব্যবধান অন্তত ৯-১০ বছর (ভিত্তি : ফ্যামিলি গ্রুপ)। অৰ্থাৎ জন্ম (আন্দাজ) ১৯৪৫। ইলেকট্রনিকস। পাখির গান। মিশুকে নয়। কথা বললে বেশি বলে, নিজের বিষয়; টেপ রেকড়ার ফেলে এসেছিল। রাজরাগ্লায়।
৬। প্রীতীনের স্ত্রী নীলিমা-বয়স ২৫-২৬। সহজ, সংপ্ৰতিভ।
৭। অখিল চক্রবর্তী–বয়স আন্দাজ ৭০। এক্স-স্কুলমাস্টার। মহেশের বন্ধু। ভাগ্য গণনা, আয়ুৰ্বেদ।
৮। শঙ্করদয়াল মিশ্র–জন্ম (আন্দাজ) ১৯৩৯ )। বীরেনের সমবয়সী! মহেশের দারোয়ান দীনদয়ালের ছেলে। দীনদয়ালের মৃত্যু ১৯৪৩। প্রশ্ন-জঙ্গলে গিয়েছিল কেন? শঙ্করকে মানুষ করেন। মহেশ। বর্তমানে বইয়ের দোকানের মালিক। মহেশের মৃত্যুতে মুহ্যমান।
৯। নূর মহম্মদ-বয়স ৭০-৮০। চল্লিশ বছরের উপর মহেশের বেয়ারা।
ফেলুদা ঠিকই আন্দাজ করেছিল। দুপুরে খাওয়ার পর কৈলাসে গিয়ে শুনলাম সকলে অনেকেই এসেছিলেন, কিন্তু একটা নাগাদ সবাই চলে গেছেন। বৈঠকখানায় মহেশবাবুর দুই ছেলে আর অখিলবাবু ছিলেন, আমরা সেখানেই বসলাম। প্রীতীনবাবুর অস্থির ভাবটা যেন আরও বেড়ে গেছে; একটা আলাদা সোফার এক কোণে বসে খালি হাত কচলাচ্ছেন। অখিলবাবু মাঝে মাঝে দীর্ঘশ্বাস ফেলছেন আর মাথা নাড়ছেন। অরুণবাবু যথারীতি গভীর ও শান্ত 1 ফেলুদা তাঁকেই প্রশ্নটি করল।
আপনারা কি কিছুদিন আছেন?
কেন বলুন তো?
আপনাদের একটু সাহায্যের দরকার। মহেশবাবু একটা কাজের ভার দিয়ে গেছেন আমাকে, কী কাজ সেটা অবিশিষ্ট স্পষ্ট করে বলার ক্ষমতা ছিল না। তাঁর। আমি প্ৰথমে জানতে চাই-উনি কী বলতে চেয়েছিলেন সেটা আপনারা কেউ বুঝেছেন কি না।
অরুণবাবু একটু হেসে বললেন, বাবার সুস্থ অবস্থাতেই তাঁর অনেক সংকেত আমাদের বুঝতে বেশ অসুবিধা হত। রাশভারি লোক হলেও ওঁর মধ্যে একটা ছেলেমানুষ দিক ছিল সেটার কিছুটা আভাস হয়তো আপনিও পেয়েছেন। আমার মনে হয় ঝাবা শেষ অবস্থায় যে কথাগুলো বললেন সেটার উপর বেশি গুরুত্ব না দেওয়াই ভাল।
ফেলুদা বলল, আমার কাছে নির্দেশগুলো কিন্তু সম্পূর্ণ অর্থহীন বলে মনে হয়নি।
তাই বুঝি?
হ্যাঁ। তবে সব সংকেত ধরতে পেরেছি। এটা বলতে পারব না। যেমন ধরুন, মুক্তানন্দের ছবি। ফেলুদা অখিলবাবুর দিকে ফিরল।আপনি ওটা সম্বন্ধে নিশ্চয়ই কিছু বলতে পারেন। ছবিটা তো বোধহয় আপনারই দেওয়া।
অখিলবাবু বিষণ্ণ হাসি হেসে বললেন, হ্যাঁ, আমারই দেওয়া। মুক্তানন্দ রাঁচিতে এসেছিলেন একবার। আমার তো এসবের দিকে একটু ঝোঁক আছেই চিরকাল। বেশ জেনুইন লোক বলে মনে হয়েছিল। আমি মহেশকে ঠাট্টা করে বলেছিলাম–তুমি তো কোনওদিন সাধু-সন্ন্যাসীতে বিশ্বাস-টিশ্বাস করলে না, শেষ বয়সে একটু এদিকে মন দাও না। তোমাকে একটা ছবি এনে দেব; ঘরে রেখে দিয়ো। মুক্তানন্দের প্রভাব খারাপ হবে না। তিনটি মহাদেশে এর প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছে, না হয় তোমার উপরেও একটু পড়ল। –তা সে ছবি যে সে তার খাটের পাশে রেখে দিয়েছে সেটা কালই প্রথম দেখলাম। অসুখের আগে তো। ওর শোবার ঘরে যাইনি কখনও।
আপনি ওটা সম্বন্ধে জানেন কিছু? ফেলুদা অরুণবাবুকে প্রশ্ন করল।
অরুণবাবু মাথা নাড়লেন।ও জিনিসটা যে বাবার কাছে ছিল সেটাই জানতাম না। বাবার শেবার ঘরে আমিও কালই প্রথম গোলাম।
আমিও জানতাম না।–প্রীতীনবাবুকে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই তিনি বলে উঠলেন।
ফেলুদা বলল, দুটো জিনিস পেলে আমার কাজের একটু সুবিধা হতে পারে।
কী জিনিস? অরুণবাবু জিজ্ঞেস করলেন।
প্রথমটা হল—মহেশবাবুকে লেখা তাঁর দ্বিতীয় পুত্রের চিঠি।
বীরেনের চিঠি? অরুণবাবু অবাক। ‘বীরেনের চিঠি দিয়ে কী হবে?
আমার বিশ্বাস ওই ছবিটা মহেশবাবু বীরেনকে দেবার জন্য দিয়েছিলেন আমাকে।
হাউ ষ্ট্রেঞ্জ। এ ধারণা কী করে হল আপনার?
ফেলুদা বলল, ছবিটা আমাকে দিয়ে মহেশবাবু দুটো আঙুল দেখিয়েছিলেন সেটা আপনারাও দেখেছিলেন ; একটা সম্ভাবনা আছে যে দুই আঙুল মানে দুরি। আমার ভুল হতে পারে, কিন্তু আপাতত এই বিশ্বাসেই আমাকে কাজ চালিয়ে যেতে হবে।
কিন্তু বীরেনকে আপনি পাচ্ছেন কোথায়?
ধরুন মহেশবাবু যদি ঠিকই দেখে থাকেন ; যদি সে এখানে এসে থাকে।
অরুণবাবু তাঁর বাপের মৃত্যুর কথা ভুলে গিয়ে হো হো করে হেসে উঠলেন।
বাবা গত পাঁচ বছরে কতবার বীরেনকে দেখেছেন তা আপনি জানেন? বিশ বছর যে ছেলে বিদেশে, বাবা তাঁর দুর্বল দৃষ্টি দিয়ে তাকে এক ঝলক দেখেই চিনে ফেলবেন এটা আপনি ভাবছেন কী করে?
আপনি ভুল করছেন অরুণবাবু, আমি নিজে একবারও ভাবছি না যে বীরেনবাবু ফিরে এসেছেন। কিন্তু তিনি যদি দেশের বাইরেও কোথাও থেকে থাকেন, তা হলেও আমার দায়িত্ব দায়িত্বই থেকে যায়। তিনি কোথায় আছেন জেনে জিনিসটা তাঁর হাতে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে হবে আমাকে।
অরুণবাবু একটু নরম হয়ে বললেন, বেশ। আপনি দেখবেন বীরেনের চিঠি। বাবা সব চিঠি এক জায়গায় রাখতেন। বীরেনের চিঠিগুলো আলাদা করে বেছে রাখব।
ধন্যবাদ, বলল ফেলুদা, ‘আর দ্বিতীয় জিনিস হচ্ছে—মহেশবাবুর ডায়রি। সম্ভব হলে সেগুলোও একবার দেখব।
আমি ভেবেছিলাম অরুণবাবু এতে আপত্তি করবেন, কিন্তু করলেন না। বললেন, দেখতে চান দেখতে পাবেন। বাবা তাঁর ডায়রির ব্যাপারে কোনও গোপনতা অবলম্বন করতেন না। তবে আপনি হতাশ হবেন, মিঃ মিত্তির।
কেন?
বাবার মতো ও রকম নীরস ডায়রি আর কেউ লিখেছে কি না জানি না। অত্যন্ত মামুলি তথ্য ছাড়া আর কিছু নেই।
হতাশ হবার ঝুঁকি নিতে আমার আপত্তি নেই।
চিঠির ব্যাপারে ঠিক হল অরুণবাবু আর গ্ৰীতীনবাবু ভাইয়েরগুলো বেছে আলাদা করে রাখবেন, সেগুলো কাল সকালে ফেলুদাকে দেওয়া হবে। ডায়রিগুলো আজই নিয়ে যাব আমরা, আর কালই ফেরত দিয়ে দেব। বুঝলাম ফেলুদাকে আজ রাত জগতে হবে, কারণ ডায়রির সংখ্যা চল্লিশ।
তিনজনে ভাগাভাগি করে খবরের কাগজে মোড়া মহেশ চৌধুরীর ডায়রির সাতটা প্যাকেট নিয়ে কৈলাসের কাঁকর-বিছানো পথ দিয়ে যখন ফটকের দিকে যাচ্ছি, তখন দেখলাম জোড়া-মৌমাছি তার বিলিতি ডিল হাতে নিয়ে বাগানে ঘোরাফেরা করছে। পায়ের শব্দে সে হাঁটা থামিয়ে আমাদের দিকে ঘুরে দেখল। তারপর বলল, দাদু আমাকে বলেনি।
হঠাৎ এমন একটা কথায় আমরা তিনজনেই থেমে গোলাম।
কী বলেনি দাদু? ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।
কী খুঁজছিল বলেনি।
কবে?
পরশু, তরাশু নরশু।
তিনদিন?
একদিন।
কী হয়েছিল বলে তো।
বিবি দূরে দাঁড়িয়েই চেঁচিয়ে কথা বলছে, যদিও তার মন পুতুলের দিকে। সে পুতুলের মাথায় গোঁজার জন্য বাগান থেকে ফুল নিতে এসেছে। ফেলুদার প্রশ্নের উত্তরে বলল, দাদুর যে ঘর আছে দোতলায়, যেখানে টেবিল আছে, বই আছে আর সব জিনিস-টিনিস আছে, সেইখানে খুঁজছিল দাদু!
কী খুঁজছিলেন?
আমি তো জিজ্ঞেস করলাম। দাদু বলল কী পাচ্ছি না, কী খুঁজছি।
আবোল তাবোল বকছে, মশাই চাপা গলায় বললেন লালমোহনবাবু।
আর কিছু বলেননি দাদু? ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।
দাদু বলল এটা হেঁয়ালি, পরে মানে বলে দেব, এখন খুঁজতে দাও। তার পর আর বলল না দাদু। দাদু মরে গেল।
ইতিমধ্যে ডালের মাথায় ফুল গোঁজা হয়ে গেছে, বিবি বাড়ির দিকে চলে গেল, আর আমরাও হলাম বাড়িমুখো।।