সার্কাসের বাঘ পালানো
আমি ভেবেছিলাম যে সার্কাসের বাঘ পালানোটাই বুঝি হাজারিবাগের আসল ঘটনা হবে; কিন্তু তা ছাড়াও যে আরও কিছু ঘটবে, আর ফেলুদা যে সেই ঘটনার জালে জড়িয়ে পড়বে, সেটা কে জানত? ২৩শে নভেম্বর মহেশ চৌধুরীর বার্থডে পিকনিকের কথাটা অনেক’দিন মনে থাকবে, আর সেই সঙ্গে মনে থাকবে রাজরাল্পীর আশ্চর্য সুন্দর রুক্ষ পরিবেশে ছিন্নমস্তার মন্দির।
কাল রাত্ৰে বাঘের ডাক শোনার পথ থেকেই লালমোহনবাবুর মুখটা জানি কেমন হয়ে গিয়েছিল, ভাবছিলাম বলি উনি আমাদের ঘরে আমার সঙ্গে শোন, আর ফেলুদা পশ্চিমের ঘরটা নিক, কিন্তু সেদিকে আবার ভদ্রলোকের গোঁ আছে। চৌকিদারের কাছে টাঙি আছে। জেনে, আর লোকটা বেঁটে হলেও সাহসী জেনে ভদ্রলোক খানিকটা আশ্বাস পেয়ে নিজের তিন সেলের টর্চের বদলে আমাদের পাঁচ সেলটা নিয়ে দশটা নাগাত নিজের ঘরে চলে গেলেন। বড় টর্চ নেওয়ার কারণ এই যে, ফেলুদা বলেছে। তীব্র আলো চোখে ফেললে বাঘ নাকি অনেক সময় আপনা থেকেই সয়ে পড়ে। –অবিশ্যি জানালার বাইরে যদি গর্জন শোনেন, তখন টর্চ জ্বালানোর কথা, আর সেই টর্চ জানালার বাইরে বাঘের চোখে ফেলার কথা, মনে থাকবে কি না সেটা জানি না।
যাই হাক, রাত্রে বাঘ এসে থাকলেও সে গর্জন করেনি, তাই টর্চ ফেলারও কোনও দরকার হয়নি।
আমরা প্রীতীনবাবুর নির্দেশ অনুযায়ী ঠিক সাড়ে আটটার সময় কৈলাসের লাল ফটকের সামনে গিয়ে হাজির হলাম। বাইরে থেকে বাড়িটা দেখে লালমোহনবাবু মন্তব্য করলেন যে বোঝাই যাচ্ছে। এ শিব হল সাহেব শিব। সত্যিই, বছর দশেক আগে তৈরি হলেও বাড়ির চেহারাটা সেই পঞ্চাশ বছর আগের ব্রিটিশ আমলের বাড়ির মতো।
দারোয়ান গেট খুলে দিতে আমরা গাড়িটা বাইরে রেখে কাঁকর বিছানো রাস্তা দিয়ে বাড়ির দিকে এগিয়ে গেলাম। আরও তিনটে গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে কম্পাউন্ডের এক পাশে একটা কালকের দেখা প্রীতীনবাবুর কালো অ্যামবাসাডর, একটা সাদা ফিয়াট, আর একটা পুরনো হলদে পানটিয়াক।
একটা কু পাওয়া গেছে মশাই।
লালমোহনবাবু বাগান আর রাস্তার মাঝখানে সাদা রং করা ইটের বেড়ার পাশ থেকে একটা কাগজ কুড়িয়ে নিয়ে ফেলুদাকে দিলেন। ফেলুদা বলল, আপনি রহস্যের অবর্তমানেই কু-য়ের সন্ধান পাচ্ছেন?
জিনিসটা কীরকম মিস্টিরিয়াস মনে হচ্ছে না?
একটা রুলটানা খাতার পাতা, তাতে সবুজ কালিতে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা কিছু, অর্থহীন ইংরিজি কথা। মিস্ট্রির কিছুই নেই; বাঝাই যাচ্ছে সেটা বাচ্চার হাতের লেখা, আর সেই কারণেই কথাগুলোর কোনও মানে নেই। যেমন–OKAHA, RKAHA, LOKC
ওকাহা যে জাপানি নাম সে তো বোঝাই যাচ্ছে বললেন লালমোহনবাবু।
বাংলা নামটা না চিনে জাপানি নামটা চিনে ফেললেন?—বলে ফেলুদা কাগজটা পকেটে পুরে নিল।
একজন ভীষণ বুড়ো মুসলমান বেয়ারা দাঁড়িয়েছিল গাড়িবারান্দার নীচে, সে আমাদের সেলাম করে আইয়ে বলে ভিতরে নিয়ে গেল। একটা চেনা গলা আগে থেকেই পাচ্ছিলাম, বৈঠকখানার চৌকাঠ পেরোতেই প্রীতীনবাবু আমাদের দিকে এগিয়ে এলেন।
আসুন, আসুন—সো কাইন্ড অফ ইউ টু কাম।
ঘরে ঢুকে প্রথমেই চোখ চলে যায় দেয়ালের দিকে। তিন দেয়াল জুড়ে ছবির বদলে টাঙানো রয়েছে ফ্রেমে বাঁধানো মহেশ চৌধুরীর সংগ্ৰহ করা পিনে আটা সার সার ডানা মেলা প্রজাপতি। প্রতি ফ্রেমে আটটা, সব মিলিয়ে চৌষট্টি, আর তাদের রঙের বাহারে পুরো ঘরটা যেন হাসছে।
যাঁর সংগ্ৰহ, তিনি সোফায় বসে ছিলেন, আমাদের দেখে হাসিমুখে উঠে দাঁড়ালেন। বুঝলাম এককালে ভদ্রলোক বেশ শক্ত সুপুরুষ ছিলেন। টকটকে রং, দাড়িগোঁফ পরিষ্কার করে কামানো, চোখে রিমালেস চশমা, পরনে ফিনফিনে ধুতি, গরদের পাঞ্জাবি আর ঘন কাজ করা কাশ্মীরি শাল। বুঝলাম এটা মহেশ চৌধুরীর সত্তর বছরের জন্মদিন উপলক্ষে স্পেশাল পোশাক।
প্রীতীনবাবু শুধু ফেলুদার নামটাই জানেন, তাই বাকি দুজনের পরিচয় ফেলুদাকেই দিতে হল। ভদ্রলোক কিছু বলার আগেই লালমোহনবাবু আমাদের অবাক করে দিয়ে বললেন, হ্যাপি বার্থডে টু ইউ স্যার!
ভদ্রলোক হো হো করে হেসে উঠলেন। —থ্যাঙ্ক ইউ, থ্যাঙ্ক ইউ! বুড়োমানুষের আবার জন্মদিন। এসব আমার বৌমার কাণ্ড। —যাক আপনারা এসে গিয়ে খুব ভালই হল। হায়ার ইজ দ্য ডেড বডি খুঁজে বার করতে অসুবিধা হয়নি তো?
প্রশ্নটা শুনে আমার আর লালমোহনবাবুর মুখ একসঙ্গে হাঁ হয়ে গেছে। ফেলুদা কিন্তু ভুরুটা একটু তুলেই নামিয়ে নিল।আজ্ঞে না, অসুবিধা হয়নি।
ভেরি গুড। আমি বুঝেছিলাম। আপনি যখন গোয়েন্দা তখন হয়তো আমার সাংকেতিক ভাষা বুঝতে পারবেন। তবে আপনার দুই বন্ধু মনে হচ্ছে বোঝেননি।
ফেলুদা বুঝিয়ে দিল। কৈলাস হচ্ছে কই লাশ?
এবারে লক্ষ করলাম। ঘরের ঠিক মাঝখানে একটা চিতাবাঘের ছালের উপর বসে একটি বছর পাঁচেকের মেয়ে ডান হাতে একটা চিমটের মতো জিনিস নিয়ে বাঁ হাতে ধরা একটি বিলিতি ডলের ভুরুর জায়গায় এক মনে চিমটি কাটছে। বোধহয় পুতুলের ভুরু প্লক করা হচ্ছে। আমি ওর দিকে চেয়ে আছি বলেই বোধহয় মহেশবাবু বললেন, ওটি আমার নাতনি; ওর নাম জোড়া মৌমাছি।
আর তুমি জোড়া কাটারি, বলল মেয়েটি।
বুঝলেন তো, মিঃ মিত্তির?
ফেলুদা বলল, বুঝলাম, আপনার নাতনি হলেন বিবি, আর আপনি তার দাদু। লালমোহনবাবু আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছেন দেখে বুঝিয়ে দিলাম। বিবি হচ্ছে Bee-Bee, আর দাদুর দা হল কাটারি। আর দু হল দুই। ফেলুদা আর আমি অনেক সময়ই বাড়িতে বসে কথার খেলা তৈরি করে খেলি, তাই এগুলো বুঝতে অসুবিধা হল না।
প্রীতীনবাবু দাদাকে ডাকি বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন; আমরা তিনজনে সোফায় বসিলাম। মহেশবাবুর ঠোঁটের কোণে হাসি, তিনি এক দৃষ্টে চেয়ে রয়েছেন ফেলুদার দিকে। ফেলুদার তাতে কোনও উসখুসে ভাব নেই, সেও দিব্যি উলটে চেয়ে আছে ভদ্রলোকের দিকে।
ওয়েল, ওয়েল, ওয়েল, অবশেষে বললেন মহেশ চৌধুরী, সহায় আপনার খুব সুখ্যাতি করছিল, তাই আপনি এসেছেন শুনে তিরিকে বললুম, ভদ্রলোককে ডাক, তাকে একবার দেখি। আমার জীবনেও তো অনেক রহস্য, দেখুন। যদি তার দু-একটাও সমাধান করে দিতে পারেন।
তিরি মানে আপনার তৃতীয় পুত্র কি? ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।
রাইট এগেন, বললেন ভদ্রলোক। আমি যে কথা নিয়ে খেলতে ভালবাসি সেটা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন।
ও বাতিকটা আমারও আছে।
সে তো খুব ভাল কথা। আমার নিজের ছেলেদের মধ্যে টেক্কা তবু একটু আধটু বোঝে, তিরির মাথা এদিকে একেবারেই খেলে না। তা যাক গে–আপনি গোয়েন্দাগিরি করছেন কদ্দিন?
বছর আষ্টেক।
আর উনি কী করেন? মিঃ গাঙ্গুলী?
উনি লেখেন। রহস্য উপন্যাস। জটায়ু ছদ্মনামে।
বাঃ! আপনাদের কম্বিনেশনটি বেশ ভাল। একজন রহস্য-প্লট পাকান, আরেকজন রহস্যের জট ছাড়ান। ভেরি গুড।
ফেলুদা বলল, আপনার প্রজাপতি আর পাথরের সংগ্ৰহ তো দেখতেই পাচ্ছি; এ ছাড়া আরও কিছু জমিয়েছেন কি কোনওদিন?
পাথরগুলো রাখা ছিল ঘরের একপাশে একটা বড় কাচের আলমারির ভিতর। এত রকম রঙের পাথর যে হয় আমার ধারণাই ছিল না। কিন্তু ফেলুদা হঠাৎ এ প্রশ্ন করল কেন? ভদ্রলোকও বেশ অবাক হয়ে বললেন, অন্য সংগ্রহের কথা হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন কেন?
আপনার নাতনির হাতের চিমটেটাকে পুরনো টুইজারস বলে মনে হচ্ছে তাই—
ব্রিলিয়ান্ট! ব্রিলিয়ান্ট!–ভদ্রলোক ফেলুদার কথার উপর তারিফ চাপিয়ে দিলেন। —আপনার অদ্ভুত চোখ। আপনি ঠিক ধরেছেন, ওটা স্ট্যাম্প কালেকটরের চিমটেই বটে। ডাকটিকিট এককালে জমিয়েছি বইকী, আর বেশ যত্ন নিয়ে সিরিয়াসলি জমিয়েছি। এখনও মাঝে মাঝে গিবনসের ক্যাটালগের পাতা উলটাই। ওটাই আমার প্রথম হবি। যখন ওকালতি করি তখন আমার এক মক্কেল, নাম দোরাবজী, আমার উপর কৃতজ্ঞতাবশে তার একটি আস্ত পুরনো অ্যালবাম আমাকে দিয়ে দেয়। তার নিজের অবিশি। শেখ মিটে গিয়েছিল, কিন্তু এ জিনিস সহজে কেউ দেয় না। বেশ কিছু দুষ্পাপ্য টিকিট ছিল সেই অ্যালবামে।
আমি নিজে স্ট্যাম্প জমাই, আর ফেলুদারও এক সময় ডাকটিকিটের নেশা হয়েছিল। ও বলল, সে অ্যালবাম দেখা যায়?
আজ্ঞে?–ভদ্রলোক যেন একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলেন—অ্যালবাম? অ্যালবাম তো নেই ভাই। সেটা খোয়া গেছে।
খোয়া গেছে?
বলছি না–আমার জীবনে অনেক রহস্য। রহস্যও বলতে পারেন, ট্র্যাজিডিও বলতে পারেন। তবে আজকের দিনটায় সেসব আলোচনা থাক। –এসে টেক্কা, তোমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই।
টেক্কা মানে বোঝাই যাচ্ছে ভদ্রলোকের বড় ছেলে। প্রীতীনবাবুর সঙ্গে এসে ঘরে ঢুকলেন। বয়সে প্রীতীনবাবুর চেয়ে বেশ কিছুটা বড়। ইনিও সুপুরুষ, যদিও মোটার দিকে, আর প্রীতীনবাবুর মতো ছট্ফটে নন; বেশ একটা ভারভার্তিক ভাব।
তিরিকে মাইক সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করলে আপনি ভাল জবাব পাবেন, বললেন মহেশ চৌধুরী, আর ইনি মাইকার কারবারি। অরুণেন্দ্র। কলকাতায় অফিস, হাজারিবাগ যাতায়াত আছে কর্মসূত্রে।
আর দুরি বুঝি উনি? ফেলুদা রুপোর ফ্রেমে বাঁধানো একটা ছবির দিকে দেখাল। ফ্যামিলি গ্রুপ। মহেশবাবু, তাঁর স্ত্রী, আর তিন ছেলে। অন্তত বছর পচিশ আগে তোলা, কারণ বাপের দুপাশে দাঁড়ানো দুজন ছেলেই। হাফ প্যান্ট পরা, আর তৃতীয়টি মায়ের কোলে। দাঁড়ানো ছেলে দুটির মধ্যে যে ছোট সেই নিশ্চয়ই মহেশবাবুর দ্বিতীয় ছেলে।
ঠিকই বলেছেন আপনি বললেন মহেশবাবু, তবে দুরির সঙ্গে আলাপের সৌভাগ্য আপনার হবে কি না জানি না, কারণ সে ভাগলওয়া।
অরুণবাবু ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিলেন। বীরেন বিলেত চলে যায়। উনিশ বছর বয়সে; তারপর আর ফেরেনি।
ফেরেনি কি?—মহেশবাবুর প্রশ্নে কোথায় যেন একটা খটকার সুর।
ফিরলে কি আর তুমি জানতে না, বাবা?
কী জানি!–সেই একই সুরে বললেন মহেশ চৌধুরী। গত দশ বছর তো সে আমাকে চিঠিও লেখেনি।
ঘরে কেমন একটা থমথমে ভাব এসে গেছিল বলেই বোধহয় সেটা দূর করার জন্য মহেশবাবু হঠাৎ চাঙা হয়ে সোফা ছেড়ে উঠে পড়লেন। —চলুন, আপনাদের আমার বাড়িটা একটু ঘুরিয়ে দেখাই। অখিল আর ইয়ে যখন এখনও এল না, তখন হাতে কিছুটা সময় আছে।
তুমি উঠছ কেন বাবা, বললেন অরুণবাবু, আমিই দেখিয়ে আনছি।
নো স্যার, আমার প্ল্যান করা আমার বাড়ি, আমিই দেখাব | আসুন, মিঃ মিত্তির।
দোতলায় উত্তরে রাস্তার দিকে একটা চমৎকার চওড়া বারান্দা, সেখান থেকে কানারি হিল দেখা যায়। বেডরুম তিনটে, তিনটোতেই এখন লোক রয়েছে। মাঝেরটায় থাকেন। মহেশবাবু নিজে, এক পাশে বড় ছেলে, অন্য পাশে স্ত্রী আর মেয়েকে নিয়ে প্রীতীনবাবু। নীচে একটা গোস্টরুম আছে, তাতে এখন রয়েছেন মহেশবাবুর বন্ধু অখিল চক্রবর্তী। অরুণবাবুর দুই সন্তানের মধ্যে বড়টি ছেলে, সে এখন বিলেতে, আর মেয়েটির সামনে মাধ্যমিক পরীক্ষা বলে সে মায়ের সঙ্গে কলকাতায় রয়ে গেছে।
মহেশবাবুর বেডরুমেও দেখলাম কিছু পাথর আর প্রজাপতি রয়েছে। একটা বুকসেলফে পাশাপাশি রাখা অনেকগুলো একরকম দেখতে বইয়ের দিকে ফেলুদার দৃষ্টি গিয়েছিল, ভদ্রলোক বললেন। ওগুলো ওঁর ডায়ারি। চল্লিশ বছর একটানা ডায়রি লিখেছেন। উনি। খাটের পাশে টেবিলে ছোট্ট বাঁধানো ছবি দেখে লালমোহনবাবু বলে উঠলেন, আরে, এ যে দেখছি মুক্তানন্দের ছবি।
মহেশবাবু হেসে বললেন, আমার বন্ধু অখিল দিয়েছে। ওটা। তারপর ফেলুদার দিকে ফিরে বললেন, তিনটে মহাদেশের শক্তি এঁর পিছনে।
কারেক্ট। বললেন লালমোহনবাবু, বিরাট তান্ত্রিক সাধু। ইন্ডিয়া, ইউরোপ, আমেরিকা-সর্বত্র এঁর শিষ্য।
আপনি তো অনেক খবর রাখেন দেখছি, বললেন মহেশ চৌধুরী, আপনিও এঁর শিষ্য নাকি?
আজ্ঞে না, তবে আমার পাড়ায় আছেন একজন।
দোতলায় থাকতেই একটা গাড়ির শব্দ পেয়েছিলাম, নীচে এসে দেখি, যে-দুজনের কথা মহেশবাবু বলছিলেন, তাঁরা এসে গেছেন। একজন মহেশবাবুরই বয়সী, সাধারণ ধূতি পাঞ্জাবি আর গাঢ় খয়েরি রঙের আলোয়ান গায়ে। ইনি যে উকিল-টুকিল ছিলেন না কোনওদিন সেটা বলে দিতে হয় না, আর সাহেবিয়াও কোনও গন্ধ নেই। এর মধ্যে; অন্য ভদ্রলোককে মনে হল চল্লিশের নীচে বয়স, বেশ হাসিখুশি সপ্রতিভা ভাব, মহেশবাবু আসতেই তাঁকে টিপ করে প্রণাম করলেন। বৃদ্ধ ভদ্রলোকটির হাতে মিষ্টির হাঁড়ি ছিল, সেটা তিনি প্রীতীনবাবুর হাতে চালান দিয়ে মহেশবাবুর দিকে ফিরে বললেনগআমার কথা যদি শোনো তো পিকনিকের পরিকল্পনাটা বাদ দাও। একে যাত্রা অশুভ, তার উপর বাঘ পালিয়েছে। শার্দুলবাবাজী যদি মুক্তানন্দের শিষ্যটিষ্য হন তা হলে একবার ছিন্নমস্তায় হাজিরা দেওয়াটা কিছুই আশ্চর্য নয়।
মহেশবাবু আমাদের দিকে ফিরে বললেন, “আলাপ করিয়ে দিই—এই কুন্ডাকড়াকা ভদ্রলোকটি হলেন আমার অনেকদিনের বন্ধু শ্ৰীঅখিলবন্ধু চক্রবর্ত, এক্স-স্কুলমাস্টার, জ্যোতিষচৰ্চা আর আয়ুৰ্বেদ হচ্ছে এনার হবি; আর ইনি হলেন শ্ৰীমান শঙ্করলাল মিশ্র, আমার অত্যন্ত স্নেহের পত্র, বলতে পারেন আমার মিসিং পুত্রের স্থান অনেকটা অধিকার করে আছেন।
সবাই যাবার জন্য তৈরি হচ্ছে দেখে অখিলবাবু আরেকবার বললেন, তা হলে আমার নিষেধ কেউ মানছে না?
না ভাই, বললেন মহেশ চৌধুরী, ‘আমি খবর পেয়েছি বাঘের নাম সুলতান, কাজেই সে মুসলমান, তান্ত্রিক নয়। — ভাল কথা, মিঃ মিত্তির যদি সময় পান তো সাকৰ্ণসটা একবার দেখে নেবেন। আমাদের ইনভাইট করেছিল। পরশু! বীেমা আর বিবিদিদিমণিকে নিয়ে আমি দেখে এসেছি। দিশি সার্কাস যে এত উন্নত করেছে জানতাম না। আর বাঘের খেলার তো তুলনাই নেই।
কিন্তু পরশু নাকি বাঘের খেলায় গোলমাল হয়েছিল? প্রশ্ন করলেন লালমোহনবাবু।
সেটা খেলোয়াড়ের কোনও গণ্ডগোলে নয়। জানোয়ারেরও তো মুড বলে একটি জিনিস আছে। সে-তো আর কলের পুতুল না যে চাবি টিপলেই লক্ষ-ঝম্প করবে।
কিন্তু সেই মুড়ের ঠেলা তো এখন সামলানো দায়, বললেন অরুণবাবু। শহরে তো প্যানিক। ওটাকে এক্ষুনি মেরে ফেলা উচিত। বিলিক্তি সাকর্স হলে এ জিনিস কক্ষনও হত না।
মহেশবাবু একটা শুকনো হাসি হেসে বললেন, হ্যাঁ,-তুমি তো আবার বন্যপশু-সংহার সমিতির সভাপতি কি না, তোমার হাত তো নিশপিশ করবেই।
রাজরাপ্লা রওনা হবার আগে আর একজনের সঙ্গে আলাপ হল। উনি হলেন প্রীতীনবাবুর স্ত্রী নীলিমা দেবী। এঁকে দেখে বুঝলাম যে চৌধুরী পরিবারের সকলেই বেশ ভাল দেখতে।