দারোগা মণিলাল পোদ্দারের ফোন
রবিবার সকালে দারোগা মণিলাল পোদ্দারের ফোন এল। বললেন, কিছু এগোলেন? ফেলুদা বলল, আগে মানুষগুলোকে চেনার চেষ্টা করছি, নইলে এগোতে পারব না। বেশ জটিল কেস বলে মনে হচ্ছে।
মণিলালবাবুর কথা থেকে জানা গেল যে আরেকবার আচার্য বাড়িতে ডাকাত পড়লে উনি আশ্চর্য হবেন না। প্রথমবার তো খুনই করেছে, কোনও জিনিস তো নেয়নি; ওঁর ধারণা যাত্রার যে দলটা খুন করিয়েছে তারা ইন্দ্রনারায়ণবাবুর অন্য নাটক আর গানগুলোও হাতাবার চেষ্টা করবে। বোসপুকুরের কাছেই একটা গলি আছে, রাম পরামানিক লেন, সেটা নাকি নটোরিয়াস গুণ্ডাদের আড্ডা। তা ছাড়া এটাও মণিলালবাবু সন্দেহ করছেন যে আচার্য বাড়ির বেয়ারা সস্তোষের সঙ্গে হয়তো এই গুণ্ডদলের যোগসাজশ আছে।
ফেলুদা প্রশ্ন করল, আপনারা কি বাড়ির পিছনের যদু নস্করের গলিতে পুলিশ পাহারা রাখছেন?
তা রাখা হচ্ছে বইকী, বললেন পোদ্দারমশাই।
তেমন দরকার হলে একবার অন্তত একরাতের জন্য তুলে নেওয়া যেতে পারে কি?
আপনি কি গুণ্ডাদের প্রলোভন দেখাতে চান?
ঠিক তাই।
তা বেশ। আপনার প্রয়োজন হলে বলবেন, আমরা পাহারা সরিয়ে নেব।
পোদ্দার মশাই-এর ফোনটা এসেছিল সাড়ে সাতটার সময়। তার পনেরো মিনিট পরেই ফোন করলেন প্ৰদ্যুন্নবাবু, বললেন আধা ঘণ্টা থেকে নাকি চেষ্টা করছেন। ব্যাপার গুরুতর। গতকাল রাত্রে বারোটার সময় নাকি চোর এসেছিল আচাৰ্যবাড়িতে। ইন্দ্রনারায়ণবাবুর ঘরে ঢুকেছিল নিশ্চয়ই কোনও চাকরের সাহায্যে, কারণ পিছনের গলিতে পুলিশ পাহারা আছে। একটা শব্দ পেয়ে প্ৰদ্যুন্নবাবু নাকি তাঁর কাজের ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন বারান্দায়। তাতে চোরটা পালায়। প্ৰদ্যুম্নবাবু দৌড়ে গিয়ে লোকটাকে ধরবার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু সে ধাক্কা দিয়ে প্ৰদ্যুম্নবাবুকে মাটিতে ফেলে দেয়। ফলে ভদ্রলোকের হাঁটুতে চাট লেগেছে, উনি নাকি খুঁড়িয়ে হাঁটছেন।
ফোন রাখার পর ফেলুদা বলল, এখন সত্যিই মনে হচ্ছে ওঁর কাগজপত্র সরাবার উদ্দেশ্যেই ইন্দ্রনারায়ণবাবুকে খুন করা হয়েছিল। যে লেখকের নাটক আর গানের এত চাহিদা, সে পাঁচপাঁচ খানা নাটক আর পনের-বিশ খানা গান লিখে রেখে যাবে, আর তার উপরে চোখ পড়বে না। অন্য যাত্ৰা দলের? অবিশ্যি নিয়মমতে এই সব গান আর নাটক ভারত অপেরারই প্ৰাপ্য। তারা যাতে না পায় সেইজন্যেই এগুলো হাতবার এত উদ্যোগ।
আমি বললাম, অন্য যাত্রার দল যদি ইন্দ্রনারায়ণের এই সব গান আর নাটকের কথা জেনে থাকে, তা হলে সে কথা নিশ্চয়ই ইন্দ্রনারায়ণ নিজেই বলেছেন। তার মানে তিনি ভারত অপেরার প্রতি যতটা লয়েল ছিলেন ভাবছিলাম, আসলে হয়তো ততটা ছিলেন না। সত্যিই হয়তো তিনি অন্য দলে যাবার কথা ভাবছিলেন।
কিন্তু তা হলে খুনটা করল কে এবং কেন?
হয়তো বীণাপাণি অপেরাকে ইন্দ্রনারায়ণ কথা দিয়েছিলেন, তাই আরেকটা দল সে পথ বন্ধ করেছে।
ফেলুদা গম্ভীরভাবে মাথা নেড়ে আমার কথায় সায় দিল। সত্যি, এখনও পর্যন্ত রহস্যের কোনওই কিনারা হল না।
ফেলুদা তার বিখ্যাত সবুজ খাতা খুলে কী যেন লিখতে শুরু করল। আজ সকাল থেকেই তাকে ভীষণ সিরিয়াস দেখছি। কী যেন একটা নতুন চিন্তা তার মাথায় এসেছে সেটা বুঝতে পারছি না।
নটার সময় যথারীতি লালমোহনবাবু এসে হাজির হলেন। ফেলুদা বলল, আপনার মিউজিক এনসাইক্লোপিডিয়াটা আরও দু-চার দিন রাখছি।
দু-চার দিন কেন, দু-চার মাস রাখলেও কোনও আপত্তি নেই।
অনেক কিছু নতুন জ্ঞান অর্জন করছি বইটা থেকে। মেলডি, হারমনি, পলিফনি, কাউন্টারপয়েন্ট—অনেক কিছু জানা গেল। মিউজিকের ইতিহাসেও দেখছি রহস্য রয়েছে—পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কম্পোজার মোৎসার্টকে নাকি আরেক কম্পোজার সালিয়েরি বিষ খাইয়ে হত্যা করেন। অথচ এই ক্রাইমের কোনও কিনারা হয়নি।
সে তো বুঝলাম, কিন্তু আজ আমাদের প্ল্যানটা কী?
আচার্য বাড়িতে নাকি কাল আবার ডাকাত পড়েছিল, কিন্তু প্ৰদ্যুন্নবাবুর তৎপরতার জন্য কিছু করতে পারেনি। আমার বিশ্বাস রাত্তিরে ও বাড়িটাকে একটু চোখে চোখে রাখা ভাল।
রাত্তিরে?
হ্যাঁ। এই ধরুন সাড়ে এগারোটা থেকে শুরু করে একটা দেড়টা পর্যন্ত।
সেটা কী করে সম্ভব হচ্ছে?
বাড়ির উত্তর গা ঘেঁষে গলি গেছে। উত্তর দিকেই পিছনের দরজা। ধরুন যদি সেই গলির ফুটপাথে বসে থাকা যায় বাড়ির দিকে চোখ রেখে।
ফুটপাথে বসে থাকা? তিনজন ভদ্রলোক ফুটপাথে বসে থাকবেন আর রাস্তার লোক সন্দেহ করবে না?
তা করবে না। যদি তাদের আর ভদ্রলোক বলে না মনে হয়।
ফেলুদার প্ল্যানটা শুনে মাথা ঘুরে গেল। বোঝাই যাচ্ছে ও আবার ছদ্মবেশের কথা বলছে। কিন্তু কী ছদ্মবেশ? উত্তরটা ফেলুদাই দিল।
আপনি কি তাস একেবারেই খেলেননি? লালমোহনবাবুকে জিজ্ঞেস করল ফেলুদা।
স্ক্রু খেলতুম এক কালে, আর গোলাম চোর…।
যাই হাক, তাস চেনেন তো গোলাম দেখলে সাহেব বলে ভুল হবে না তো, আর চিড়িতন দেখলে ইস্কাপন?
পাগল!
তা হলে তিনজন প্লাস হরিপদবাবু মিলে টোয়েন্টি-নাইন খেলব। উৎকলাবাসী চারজন চাকর হয়ে যাব আমরা। মেক-আপের ভর অবিশ্যি আমার উপর। নেহাতই কথা বলার দরকার হলে বলা হবে, আর তখন অকারান্ত শব্দ হসন্ত দিয়ে শেষ করা চলবে না। অর্থাৎ তাস হবে তাসঅ, সাহেব হবেসাহেবঅ। বুঝেছেন?
বুঝেছি মিস্টারআ মিত্তিরঅ।
লালমোহনবাবুর চোখে একটা ভাসা ভাসা চাহনি দেখে বুঝতে পারলাম। তিনি বেশ একটা অ্যাডভেঞ্চারের গন্ধ পাচ্ছেন। আমি অবাক ভাবটা এখনও কাটিয়ে উঠতে পারিনি, তবে এটা বুঝেছি যে তদন্তটা বেশ জমে উঠেছে।
লালমোহনবাবু বারোটা নাগাত যাবার সময় বলে গেলেন আবার সন্ধ্যা সাতটায় আসবেন, আমাদের বাড়িতেই খাবেন। তারপর আমরা এখান থেকেই মেক-আপ নিয়ে এগারোটা নাগাত চলে যাব যদু নস্কর লেনে। গলিটা দেখে নিরিবিলি বলেই মনে হয়েছে, একটা ল্যাম্প পোস্ট দেখে তার নীচে চাদর বিছিয়ে বসে খেললেই চলবে। হরিপদবাবু তাঁর বাড়ি থেকে এক প্যাকেট পুরনো তাস। এনে দেবেন বলেছেন। খেলাটা সন্ধ্যাবেলাই লালমোহনবাবুকে মোটামুটি শিখিয়ে নেওয়া হবে।
ফেলুদার উত্তেজনা থাকলেও বোঝার উপায় নেই; সে সারাদিন মিউজিক এনসাইক্লোপিডিয়া পড়েছে। আর আমি পত্রিকার পাতা উলটেছি।
এই মেক-আপটা সহজ ছিল, তাই আমরা অনায়াসেই সাড়ে দশটার মধ্যে তৈরি হয়ে নিলাম। ধুতিগুলোকে চায়ের জলে ভিজিয়ে একটু ময়লা করে নিয়েছিলাম, চাদর আর তাস—দুটোই মেক্ষম এনেছিলেন, হরিপদবাবু। লালমোহনবাবুকে টােয়েন্টি-নাইন শিখিয়ে দুহাত খেলে নেওয়া হয়েছে, ভদ্রলোক খালি মনে মনে বিড়বিড় করে চলেছেন-গোলাম নহলা টেক্কা দশ সাহেব বিবি আট সাত।
গাড়িটাকে বড় রাস্তায় অন্ধকারে একটা জায়গায় পার্ক করে আমরা চারজন চাদর বগলে নিয়ে যদু নস্করের লেনে গিয়ে হাজির হলাম। অন্যদিন এ রাস্তায় পুলিশ থাকে, আজ ফেলুদার অনুরোধে নেই। রাস্তার এক পাশে একটা বিরাট জায়গা জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে আচার্যদের বাড়ি। উত্তর দিকের ঘরগুলোর পিছন দিকটা রাস্তার উপর পড়েছে, তার মধ্যে বা দিকে, অর্থাৎ উত্তরপূর্ব কোণে, প্রথম হল লাইব্রেরি, আর তার পরেই হল প্ৰদ্যুন্নবাবুর শোবার ঘর। ঘরের সারির শেষে হল বাড়ির পিছনের দরজা, সেটা এখন বন্ধ। লাইব্রেরি। আর প্রদ্যুম্নবাবুর ঘর দুটোতেই বাতি জ্বলছে, তবে ভদ্রলোক যে কোন ঘরে রয়েছেন সেটা রাস্তা থেকে বোঝার কোনও উপায়। নেই।
আমরা চারজনে ল্যাম্প পোস্টের তলায় চাদর পেতে বসে গেলাম। ফেলুদা তার গায়ের চাদরের তলা থেকে একটা পানের ডিবে বার করে তার থেকে চারজনকে চারটে পান দিয়ে লালমোহনবাবুকে বলল, ‘গালে গুজে রেখে দিন; আর বার বার পিক ফেলবেন না।
আচাৰ্য বাড়ি থেকে বোধহয় গ্র্যান্ডফাদার ক্লকে এগারোটা বাজতে শোনা গেল।
উনিশঅ।
লালমোহনবাবু ফেলুদার পার্টনার হয়েছেন, এখন ডাকাডাকি চলছে। ফেলুদা সঙ্গে এক প্যাকেট বিড়ি এনেছে। তার থেকে একটা হরিপদবাবুকে দিয়ে নিজে একটা ধরিয়ে নিল। বিশ ফুটের বেশি চওড়া গলি নয়, আর তাতে লোক চলাচল প্রায় নেই বললেই চলে! ওপাশে কিছু দূরে একটা রিকশা দাঁড় করানো রয়েছে, তার চালিকটা ঘুমিয়ে কাদা। আজ বোধ হয় অমাবস্যা, কারণ আকাশে মেঘ না থাকলেও বেশ ঘুটফুটে। মাথার উপর কালপুরুষ দেখা যাচ্ছে।
তুরুপআ মারুচি কাঁই?
লালমোহনবাবু উড়িয়া ভাষা বলতে চেষ্টা করে একটু বাড়াবাড়ি করছেন, তাই ফেলুদা একটা ‘উঃ’ শব্দ করে ওঁকে সতর্ক করে দিল। আশ্চর্য এই যে যদিও আমাদের প্রধান উদ্দেশ্য সময়কাটানো, টোয়েন্টি-নাইন খেলাটা এমনই যে এরই মধ্যে বেশ জমে উঠেছে। সময় কোথা দিয়ে চলে যাচ্ছে টেরই পাচ্ছি না। আচাৰ্য বাড়িতে একটা ঢং শব্দ পেয়ে সাড়ে এগারোটা বেজেছে বুঝে বেশ অবাক লাগল। ইতিমধ্যে লালমোহনবাবু একবার একটা বিড়ি ধরাবার চেষ্টা করে বিশেষ জুৎ করতে না পেরে সেটা আবার ফেলে দিয়েছেন।
একটা কুকুরের ডাকে আরেকটা সাড়া দিয়েছে এমন সময় ফেলুদা হঠাৎ আমার হাঁটুতে একটা হাত রাখল।
একটা লোক আসছে গলির পশ্চিম দিক থেকে। পরনে ধুতি পাঞ্জাবি, তার উপর একটা ছেয়ে রঙের চাদর জড়ানো। চাদর আমাদের গায়েও আছে, কারণ অক্টোবর মাসের রাত্তিরে বেশ চিনচিনে ঠাণ্ডা।
লোকটা আমাদের ছাড়িয়ে চলে গেল অন্য ফুটপাথ দিয়ে। সে হাঁটছে আচার্য বাড়ির গা ঘেঁষে।
এবার সে দরজার কাছাকাছি পৌঁছে হাঁটার গতি কামাল।
তারপর দরজার সামনে এসে থামল।
ঠক্ ঠক্ ঠক্…
তিনটে মৃদু টোকা দরজার উপর। কান পেতেছিলাম বলে শব্দটা শুনতে পেলাম। দরজা খুলে গেল। অল্প ফাঁক, ঠিক যাতে একটা মানুষ ঢুকতে পারে। মানুষটা ঢুকে গেল। যে ঢুকাল তাকে আমরা তিনজনেই চিনি।
ইনি হলেন বীণাপাণি অপেরার ম্যানেজার অশ্বিনী ভড়।
ঘড়িতে ঢং ঢেং করে বারোটা বাজল।
অর্থাৎ অশ্বিনীবাবু ঢোকার পর পনেরো মিনিট হয়ে গেছে।
এবার ভদ্রলোক বেরোলেন। তাঁর সঙ্গে যদি কিছু থেকে থাকে তো সেটা বোঝার কোনও উপায় নেই, কারণ হাত দুটো চাদরের নীচে।
ভদ্রলোক যেদিক দিয়ে এসেছিলেন সেদিক দিয়েই আবার চলে গেলেন।
আমাদের পাহারা সার্থক এবং শেষ। এই দানটা খেলে উঠব, ফেলুদা ফিসফিস করে বলল। পরদিন সকালে ফেলুদা বাসপুকুরে ফোন করল প্ৰদ্যুম্নবাবুকে। আমি বসবার ঘরে মেন টেলিফোনে কান লাগিয়ে কথা শুনলাম।
কে, মিস্টার মল্লিক?
হ্যাঁ, কী খবর?
কাল রাত্রে কিছু হয়নি তো?
কই, না তো।
এক কাজ করুন; আমি ফোনটা ধরছি, আপনি একবার ইন্দ্রনারায়ণবাবুর কাজের ঘরে গিয়ে দেখে আসুন তো সব ঠিক আছে কিনা।
আধ মিনিটের বেশি ধরতে হল না। এবারে প্রদ্যুম্নবাবুর গলার স্বর একেবারে বদলে গেছে।
ও মশাই, সর্বনাশ হয়ে গেছে!
কী হল?
সব নতুন নাটক আর গান হাওয়া!
আমি আন্দাজ করেছিলাম বলেই ফোন করলাম।
এর মানেটা কী?
অন্য রহস্যগুলোর সঙ্গে আরেকটা যোগ হল।
আপনি কি আজ একবার আসছেন?
প্ৰয়োজন হলে যাব। তার আগে দারোগা সাহেবের সঙ্গে একবার কথা বলতে হবে।
ফোনটা রেখে ফেলুদা মণিলাল পোদারের নম্বর ডায়াল করল।
শুনুন মিঃ পোদ্দার, গলি থেকে আপনার লোক সরিয়ে নেবার জন্য ধন্যবাদ। কাল সত্যিই কাজ হয়েছে। আপনি অশ্বিনীবাবুর দিকে দৃষ্টি রাখছেন তো? উনি কিন্তু কাল রাত বারোটায় আচার্য বাড়িতে গিয়ে ইন্দ্রনারায়ণবাবুর বহুমূল্য সব কাগজপত্র সরিয়ে নিয়ে গেছেন।
লোকটা খুব গোলমেলে, বললেন মিঃ পোদ্দার।খুনের টাইমের জন্য। ওর কোনও অ্যালিবাই নেই। সেদিন রাত্রে আচার্য বাড়ি থেকে নিজের বাড়িতে ফেরেনি। বলছে পথে ট্যাক্সি বিগড়ে যায় বলে আটকে পড়েছিল, কিন্তু সেটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। আপনার প্রোগ্রেস কেমন?
মোটামুটি ভালই। অবিশ্যি আমরা তো ঠিক এক রাস্তায় চলছি না, তাই আমার সিদ্ধান্তগুলো আপনার সঙ্গে মিলবে না।
তা না মিলুক। যে কোনও রকমে রহস্যের সমাধান হলেই হল।
ফেলুদা কোন রাস্তায় চলছে সেটা জানতে চাইলে উত্তর পাওয়া যাবে না, তাই আর আমি ওদিকে গেলাম না। ফেলুদা ফোন রেখে বলল, আমি একটু বেরোচ্ছি। স্টেটসম্যানের পার্সেনাল কলামে একটা জরুরি বিজ্ঞাপন দিতে হবে। একটা ভাল বেহালার দরকার।
স্টেটসম্যানে পরদিনই বেরোল যে একটা উৎকৃষ্ট বিদেশি বেহালার প্রয়োজন, অমুক বক্স নাম্বারে লিখে খবর জানানো হোক।
এই বিজ্ঞাপনের উত্তর এসে গেল দুদিনের মধ্যে। চিঠিটা পড়ে ফেলুদা বলল, আমাকে একটু লাউডন স্ট্রিটে যেতে হচ্ছে, বিশেষ দরকার।
আধা ঘণ্টার মধ্যেই ফিরে এসে ফেলুদা বলল, বেজায় দাম চাইছে।
আমি বললাম, এনসাইক্লোপিডিয়া পড়ে তোমার কি এই বয়সে বেহালা শেখার শখ হল?
ফেলুদা গম্ভীরভাবে বলল, ইট ইজ নেভার টু লেট টু লার্ন।
অর্থাৎ আরও রহস্য।
এদিকে লালমোহনবাবুও ঘন ঘন আসছেন আর ছটফট করছেন। একবার আমায় একা পেয়ে বললেন, তোমার দাদার সব ভাল শুধু এক এক সময় চুপ মেরে যাওয়ার ব্যাপারটা মোটে করদাস্ত করা যায় না।
বুধবার পার্সেনাল কলামে বিজ্ঞাপন বেরিয়েছিল, শুক্রবার উত্তর পেয়ে ফেলুদা লাউড়ন স্ট্রিটে গিয়েছিল, শনিবার সকালে দেখি ওর চেহারা একদম পালটে গেছে। গুন গুন করে গান গাইতে গাইতে বলল, আজি আচার্য বাড়ি যেতে হবে, কীর্ত্যিনারায়ণকে এখুনি ফোন করা দরকার।
কীৰ্তিনারায়ণ ফোন পেয়ে বললেন, আপনার কাজ কি মিটে গেছে!
তই তো মনে হচ্ছে, বলল ফেলুদা, তবে সেটা সম্পূর্ণ মিটবে একটা মিটিং করে পুরো ব্যাপারটা পরিষ্কার করে বললে পরে। আর সেই বলাটা বলতে হবে সকলের সামনে। অন্তত আপনি, আপনার দুই ছেলে, আর প্রদ্যুন্নবাবুকে সেখানে উপস্থিত থাকতে হবে।
সেটা আর এমন কঠিন কী? এরা তো সবাই বাড়িতেই আছে। সে ব্যবস্থা আমি করছি; আপনি চিন্তা করবেন না। কটায় আসছেন?
এই ধরুন দশটা।
কীর্তিনারায়ণের পর মণিলাল পোদ্দারকে ফোন করে ফেলুদা দশটায় বোসপুকুরে আসতে বলল।
লালমোহনবাবু এলেন নটায়, আমরা সাড়ে নটায় চা খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম।
আচাৰ্য বাড়িতে পৌঁছে দেখি দারোগ সাহেব এসে গেছেন। ফেলুদা বলল, আজই ঘটনার ক্লাইম্যাক্স, অতএব আপনার থাকার প্রয়োজন।
দোতলায় যে বৈঠকখানায় প্রথম দিন কীর্তিনারায়ণের সঙ্গে কথা হয়েছিল, আজও সেখানেই ব্যবস্থা হয়েছে।
আমরা আসার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই কীর্তিনারায়ণ এসে গেলেন।
কই, এদের সব ডাকো, প্ৰদ্যুম্ন।
প্ৰদ্যুন্নবাবু বেরিয়ে গেলেন দুই ছেলেকে ডাকতে।
প্রথমে এলেন দেবনারায়ণবাবু, আর এসেই বললেন, পুলিশ তো অনেক দূর এগিয়েছে বলে শুনেছি, তা হলে আবার এই ভদ্রলোকের বক্তৃতা শুনতে হচ্ছে কেন?
ফেলুদা বলল, পুলিশের সঙ্গে সঙ্গে আমিও এগিয়েছি, কিন্তু সেটা একটু অন্য পথে। আর মার্ডার ইজ নট দ্য ওনলি ক্রাইম কমিটেড ইন দিস কেস–সেটাও আপনাকে জানানো দরকার। আমি পুরো ব্যাপারটাই পরিষ্কার করে বলতে চেষ্টা করব।
ইংরেজিতে যাকে বলে গ্রন্ট, সেইরকম একটা শব্দ করে দেবনারায়ণবাবু চুপ করে গেলেন। আসলে ভদ্রলোকের মুখে অষ্টপ্রহর পাইপ থাকে, বাপের সামনে সেটা সম্ভব হচ্ছে না বলে বোধ হয়। উনি আরও খাপ্পা হয়েছেন।
হরিনারায়ণবাবু এসে কোনও তম্বি করলেন না, কিন্তু তাঁর ভ্রূকুটি দেখে বুঝলাম যে তিনিও ব্যাপারটা পছন্দ করছেন না।
সকলে উপস্থিত দেখে ফেলুদা আরম্ভ করল।
তাঁকে খুন করে কী লাভ হতে পারে। এইটে বিচার করার সময় আমরা জানতে পারি যে তিনি ছিলেন তাঁর বাপের প্রিয় পুত্র। অনুমান করা যায় যে কীর্তিনারায়ণের উইলে তাঁর ছেলের প্রতি এই পক্ষপাতিত্ব প্রকাশ পাবে, এবং সেই ছেলে না থাকায় সে উইল বদল হবে। এই বদলানো উইলে তাঁর অন্য দুই ছেলের প্রাপ্তি বেড়ে গেলেও, যতদিন কীর্তিনারায়ণ বেঁচে আছেন। ততদিন তাঁরা এই টাকা পাচ্ছেন না। অর্থাৎ ভাইকে খুন করে তাঁদের ইমিডিয়েট কোনও লাভ নেই।
আরেকটা তথ্য আমরা জানতে পারি সেটা এই যে বীণাপাণি অপেরা ইন্দ্রনারায়ণকে ভারত অপেরা ছেড়ে তাদের দলে যোগ দেবার জন্য প্রলোভন দেখাচ্ছিল, কিন্তু ইন্দ্রনারায়ণ তাতে রাজি হননি। এই অবস্থায় ভারত অপেরাকে পঙ্গু করার জন্য ইন্দ্রনারায়ণকে খুন করার একটা কারণ থাকতে পারে। এ কাজটা বীণাপাণি অপেরা গুণ্ডা লাগিয়ে করতে পারে। খুনের দিন রাত এগারোটা পৰ্যন্ত ইন্দ্রনারায়ণের সঙ্গে কথা বলেন বীণাপাণি অস্পোরার ম্যানেজার অশ্বিনী ভড়। তিনি চলে যাবার ঘণ্টাখানেক পরে খুনটা হয়।
এখানে আরেকটা তথ্য আমাদের খুব কাজে লাগে। আমরা লীনার কাছ থেকে জানতে পারি যে, ইন্দ্রনারায়ণের কাছে তাঁর লেখা পাঁচটি নতুন নাটক ও খান কুড়ি গান ছিল। যাত্রার বাজারে যে এ জিনিসের দাম অনেক সেটা আর বলে দিতে হবে না। আমরা জানি যিনি ইন্দ্রনারায়ণকে খুন করেছিলেন তিনি ইন্দ্রনারায়ণের কাগজপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করেছিলেন, কিন্তু সময়ের অভাবেই হোক বা অন্য কোনও কারণেই হাক, তার কিছুই সরাতে পারেননি। গত কাল রাত্রে বীণাপাণি অপেরার ম্যানেজার এসে নাটক আর গানগুলো নিয়ে গেছেন।
তা হলে অনুমান করা যায় যে খুনের একটা উদ্দেশ্য হতে পারে এই নাটক আর গানগুলি হাত করা। এ কাজ কিন্তু বাইরের লোকের পক্ষে সহজ নয়। কারণ ইন্দ্ৰনারায়ণের কাগজপত্রের সঙ্গে তাদের পরিচয় থাকার সম্ভাবনা কম। ঘরের লোকের পক্ষে এ খবর জানা অনেক বেশি। স্বাভাবিক। ঘরের লোক যদি খুনের সঙ্গে সঙ্গে কাগজগুলো নাও নিতে পারেন, তার জন্য পরে সময় পেতে কোনও অসুবিধা নেই, কারণ কাগজগুলো থেকেই যাচ্ছে। এখানে আমাদের দেখা দরকার বাড়ির কোনও লোকের টাকার টানাটানি যাচ্ছিল। কিনা।
এ-ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি যে হরিনারায়ণবাবু সম্প্রতি তাঁর ক্লাবে বেশি টাকায় জুয়া খেলে অনেক লোকসান দিয়েছেন। কিন্তু তা হলেও হরিনারায়ণবাবুর পক্ষে ইন্দ্রনারায়ণের নাটক আর গান চুরি করে সেগুলো অন্য যাত্রা দলে বিক্রি করাটা আমার কাছে বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হচ্ছিল না। তা হলে আর কে অভাবী ব্যক্তি আছেন বাড়িতে?
এখানে অকস্মাৎ একটি তথ্য আবিষ্কার করার ঘটনা আমি আপনাদের কাছে বলতে চাই।
প্ৰদ্যুম্ববাবু যেদিন আমার বাড়িতে আসেন সেদিন তাঁর পকেট থেকে এক টুকরো কাগজ আমাদের সোফাতে পড়ে যায়। এই কাগজে ডট পেন দিয়ে দুলাইন কথা লেখা ছিল—হ্যাপি বাৰ্থডে আর হুকুম চাঁদ। প্ৰদ্যুম্নবাবুকে জিজ্ঞেস করাতে উনি বলেন। কাগজটা ওঁর না। এর কিছুদিন পরে হঠাৎ শনিবারের কাগজের শেষ পাতায় একটি নামের তালিকা থেকে জানতে পারি যে হ্যাপি বার্থডে আর হুকুম চাঁদ দুটোই হল রেসের ঘোড়ার নাম। তখন আমার ধারণা হয় যে, প্ৰদ্যুম্নবাবু রেস খেলেন, কিন্তু সে তথ্য আমাদের কাছে গোপন রাখতে চান। আমরা সেদিনই রেসের মাঠে যাই। সেখানে আমি প্ৰদ্যুম্নবাবুকে দেখি ভিড়ের মধ্যে জানালার সামনে দাঁড়িয়ে বেটিং করতে। অর্থাৎ প্ৰদ্যুন্নবাবু যে জুয়াড়ি সেটা প্রমাণ হয়ে যায়। আমার ধারণা যারা নিয়মিত রেস খেলে এবং যাদের রোজগার খুব বেশি নয়, তাদের সব সময়ই টাকার টানাটানি হয়। সুতরাং রেসে যদি বড় রকম হার হয়ে থাকে তা হলে খুনের মোটিভ প্ৰদ্যুম্নবাবুর ছিল, এবং সেই সঙ্গে সুযোগও ছিল। সত্যি বলতে কী, তার চেয়ে বেশি সুযোগ এ বাড়ির কারুর ছিল না। খুনের সময় প্রদ্যুম্নবাবু কাজ করছিলেন, তাঁর পখে নাটমন্দিরের বারান্দা দিয়ে এসে ইন্দ্রনারায়ণের মাথায় বাড়ি মেরে কাজটা করা ছিল অত্যন্ত সহজ ব্যাপার।
প্ৰদ্যুম্ন মল্লিকের অবস্থাটা আরও টিলে হয়ে যায়। এই কারণেই যে তিনি হলেন মিথ্যেবাদী। তিনি শুধু রেসের ব্যাপারেই মিথ্যে বলেননি; তাঁর মতে ক’দিন আগে এ বাড়িতে আবার চোর আসে এবং সে চোরকে বাধা দিতে গিয়ে তিনি ধাক্কা খেয়ে মাটিতে পড়ে হাঁটুতে চোট পান—যার ফলে তাঁকে নাকি খোঁড়াতে হচ্ছে। কিন্তু আজ সকালে তিনি অন্তত দুবার হাঁটার সময় খোঁড়াতে ভুলে গেছেন সেটা বোধহয় তিনি নিজে খেয়াল করেননি।
গত রবিবার রাত্তিরে ইন্দ্রনারায়ণের ঘর থেকে নাটক ও গানগুলি চুরি যায়। সেগুলো কার হাতে গেছে আমরা জানি, কারণ আমরা তখন বাড়ির পিছনের গলিতে ল্যাম্প পোস্টের আলোয় বসে তাস খেলছিলাম। বীণাপাণি অপেরার ম্যানেজার আসেন পৌনে বারোটায়। তাঁকে বাড়ির পিছনের দরজা খুলে দেওয়া হয়। প্ৰদ্যুম্নবাবুর ঘরের বাতি জ্বলছিল। আমাদের ধারণা তাঁর সঙ্গেই হয় লেনদেনটা। অশ্বিনী ভিড় টাকা দেন, প্ৰদ্যুন্নবাবু তার বিনিময়ে তাঁকে নাটক ও গানগুলো দেন। যদি আমি ভুল বলে থাকি তা হলে প্ৰদ্যুন্নবাবু আমাকে শুধরে দিতে পারেন।
প্রদ্যুম্নবাবুর মুখ ফ্যাকাসে, মাথা হেঁট, শরীরে কাঁপুনি। দারোগা সাহেব এগিয়ে গিয়ে তাঁর ঠিক পিছনেই দাঁড়িয়েছেন, ঘরে রয়েছে আরও দুজন কনস্টেবল।
এই হল ইন্দ্রনারায়ণ আচার্য খুনের ইতিহাস, বলল ফেলুদা। কিন্তু এখানেই অপরাধের শেষ নয়। এবার আমি দ্বিতীয় অপরাধে আসছি।
আমি প্রথম দিন যখন এ বাড়িতে আসি তখন একটা ব্যাপার দেখে আমার একটু খটকা লেগেছিল। সেটা হল ইন্দ্রনারায়ণবাবুর বেহালা। একশো বছরের পুরনো বেহালা এত ঝকঝকে হয় কী করে? অবিশ্যি আমার বেহালার অভিজ্ঞতা কম, কত বছরে তার কীরকম চেহারা হয়। সেটা আমার জানা নেই, তাই ব্যাপারটা নিয়ে তখন আর মাথা ঘামাইনি। সেদিনই অবিশ্যি শুনেছিলাম যে কন্দৰ্পনারায়ণ রসিকতা করে তাঁর বেহালাকে বলতেন আম আঁটির ভেঁপু। সম্প্রতি দুটো জিনিস পড়ার সুযোগ হয়েছে আমার। এক হল পাশ্চাত্য সংগীত সম্পর্কে এক এনসাইক্লোপিডিয়া আর দুই হল কন্দৰ্পনারায়ণের বিলেতের ডায়রি। প্রথম বই থেকে আমি জেনেছি যে ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীতে বেহালা বা যন্ত্রের সংস্কার হয় ইতালিতে। তখন থেকে বেহালার চেহারা এবং আওয়াজ পালটে আরও সুন্দর ও আরও জোরালো হয়। ইতালির বেহালা প্রস্তুতকারকদের মধ্যে তিনজনের নাম সবচেয়ে বিখ্যাত। এরা তিনজনেই সপ্তদশ শতাব্দীর লোক। প্রথম হল আনন্টন স্ট্রাডিভারি, দ্বিতীয় আন্দ্ৰেয়াস গুয়ারনেরি, আর তৃতীয় নিকোলে আমাটি। এর মধ্যে আমাটিই প্রথম বেহালার সংস্কার করেন ইতালির ক্রেমোনা শহরে।
তখনও আমার মাথায় আসেনি যে এই আমাটি আর কন্দৰ্পনারায়ণের আম আঁটি একই জিনিস। এটা পরিষ্কার হয় কন্দৰ্পনারায়ণের ডায়রি পড়ে। তাতে এক জায়গায় তিনি লিখেছেন, ফেলুদা পকেট থেকে একটা কাগজ বার করে পড়ল—আই বঁট অ্যান আমাটি টুডে ফ্রম এ মিউজিশিয়ান হু ওয়জ স্যাঙ্ক ইন ডেট অ্যান্ড সোল্ড ইট টু মি ফর টু থাউজ্যান্ড পাউন্ডস। ইট হ্যাঁজ এ গ্লোরিয়াস টোন। অর্থাৎ আমি আজ একটি দেনায় জর্জরিত বাজিয়ের কাছ থেকে একটি আমাটি বেহালা কিমলাম দুহাজার পাউন্ডে। যন্ত্রটির আওয়াজ আশ্চর্য সুন্দর।–তখনকার দিনে দুহাজার পাউন্ড মানে বিশ হাজার টাকা! আজকে একটি আমাটি বেহালার দাম দেড়-দুলাখ টাকা।
এমন একটি বেহালা এই বাড়িতে এতকাল পড়েছিল, আর এই বেহালা যাত্রার কনসার্টে বাজাতেন। ইন্দ্রনারায়ণ আচাৰ্য। বেহালার আসল খবর কেউ জানতেন কি? আমার মনে হয় না। কীৰ্ত্তিনারায়ণবাবু বা দেবনারায়ণবাবু জানতেন, কিন্তু দুজনের জানার কথা। এক হুল প্ৰদ্যুম্ন। মল্লিক, যিনি দর্পনারায়ণের ডায়রি পড়েছিলেন, আরেক হল হরিনারায়ণবাবু। তিনি বিদেশি সংগীত সম্বন্ধে জানেন, ভাল বেহালার দাম জানেন, এবং এটাও নিশ্চয়ই জানেন যে বেহালার গায়ে দুদিকে যে ইংরিজি এস-এর মতো ফাঁক থাকে, তার একটায় চোখ লাগালে ভিতরে বেহালা প্ৰস্তুতকারকের নাম সমেত লেবেল দেখা যায়।
এই আমাটির কথা জানার পরেই আমার সন্দেহ বদ্ধমূল হয় যে ইন্দ্রনারায়ণের খুনের পর তাঁর বেহালাটি সরানো হয়েছে এবং তার জায়গায় একটি সস্তা নতুন বেহালা কিনে এনে রাখা হয়েছে। কিন্তু এই বেহালা সরিয়েছে, কে, এবং যে সরিয়েছে। সে তো টাকার জন্যই সরিয়েছে?
আমার সন্দেহটা স্বভাবতই হরিনারায়ণবাবুর উপর পড়ে এবং এটাও বুঝতে পারি যে বেহালা পাচার হয়ে ঘরে টাকা এসে গেছে। তখন আমি ভাল বিদেশি বেহালা কিনতে চাই বলে কাগজে একটা বিজ্ঞাপন দিই। তার উত্তরে আমায় চিঠি লেখেন জনৈক মিঃ রেবেলো। এই রেবেলোর বাড়ি গিয়ে দেখি তিনি একজন বিরাট প্রাচীন দ্রব্য বিক্রেতা—যাকে বলে অ্যানটিক ডিলার। তিনি বলেন তাঁর কাছে একটি আমাটি বেহালা আছে যেটা তিনি দেড় লাখ টাকায় বিক্রি করতে রাজি আছেন। আমি ওঁকে জিজ্ঞেস করি বেহালটা তিনি মিঃ আচাৰ্যর কাছ থেকে কিনেছেন কিনা। তাতে তিনি হ্যাঁ বলেন এবং বলেন ইট ইজ দ্য ওনলি আমাটি ইন ইন্ডিয়া।
এই হল হরিনারায়ণবাবুর অপরাধের কাহিনী, এবং আমার বক্তৃতারও এখানেই শেষ।
আশ্চর্য এই যে ফেলুদার একটা কথাতেও কোনও প্রতিবাদ শোনা গেল না! প্ৰদ্যুন্নবাবু এখন মিঃ পোদারের জিম্মায়। হরিনারায়ণবাবু রাগ টিপে বসে আছেন মাথা হেঁট করে। দেবনারায়ণবাবু লজ্জায় লাল হয়ে ঘর থেকে চলে গেছেন। কীর্তিনারায়ণ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, হরি যদি আমার বলত তা হলে আমি ওকে জুয়োর দেনা শোধ করার টাকা দিয়ে দিতাম। মিছিমিছি। আমাদের পরিবারের একটা আশ্চৰ্য সম্পত্তি সে বেহাত করল। কিন্তু প্ৰদ্যুম্ন যে এত অসৎ তা আমি ভাবতে পারিনি। তাকে এইটুকুই বলতে পারি যে সে আমার পূর্বপুরুষের জীবনী লেখার পক্ষে সম্পূর্ণ অযোগ্য। তার উপযুক্ত শাস্তি হলে আমি সবচেয়ে বেশি খুশি হব।
কীর্তিনারায়ণের বোধহয় খুবই শখ ছিল যে কন্দৰ্পনারায়ণের একটা জীবনী লেখা হোক। না হলে আর লালমোহনবাবুকে তিনি অফারটা করেন?
আপনি তো লিখিয়ে মানুষ–রহস্য রোমাঞ্চ ঔপন্যাসিক-তা কন্দৰ্পনরায়ণের চেয়ে বড় রহস্য আর রোমাঞ্চ একই লোকের জীবনে কিন্তু আর পাবেন না।
লালমোহনবাবু অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে ঘাড় কাত করে বললেন, আমাকে আর লজ্জা দেবেন। না, আমি অতি নগণ্য ব্যক্তি, আমার লেখার কোনও মূল্যই নেই।
পরে অবিশ্যি উনি ফেলুদাকে বলেছিলেন, রূক্ষে করুন মশাই-ওই খুন হওয়া বাড়িতে বসে। আমি কন্দৰ্পনারায়ণের জীবনী নিয়ে রিসার্চ করব!—বেঁচে থাকুক আমার রহস্য-রোমাঞ্চ, বেঁচে থাকুক প্রখর রুদ্র-অ্যান্ড লং লিভ দ্য থ্রি মাস্কেটিয়ারস!