ইন্দ্রনারায়ণের কথা (Indranarayaner Kotha)
সম্রাট অশোক আর দুদিনে শেষ হয়ে যাবে। সেদিক দিয়ে ইন্দ্রনারায়ণের চিন্তা করার কিছু নেই। সত্যি বলতে কী, নাটক আরও চারখানা আগেই তৈরি হয়ে আছে, যদিও সে কথা ইন্দ্রনারায়ণ তাঁর যাত্রা দলের মালিককে এখনও বলেননি। সব নাটক সব সময় চলে না; দর্শকের রুচি আশ্চর্যরকম বদলায় বছরে বছরে। হাওয়া বুঝে নাটক লিখতে হয়, না হলে ভাল নাটকও অনেক সময় মার খেয়ে যায়। সে বিচারে সম্রাট অশোক এখন খুবই যুগোপযোগী নাটক।
আসলে দুশ্চিন্তার কারণ অন্য। এখন বেজেছে রাত দশটা। আর কিছুক্ষণ পরেই বীণাপাণি অপেরার ম্যানেজার অশ্বিনী ভিড় আসবেন ইন্দ্রনারায়ণের কাছে। এই নিয়ে পাঁচবার হবে তাঁর আসা। এ ছাড়া নব নাট্ট কোম্পানির লোকও এসেছে তাঁর কাছে; কিন্তু বীণাপাণির মতো জোর তাদের নেই। আসার কারণ একটাই, ভারত অপেরা থেকে ভাঙিয়ে নিতে চায় তারা ইন্দ্রনারায়ণকে। সতেরো বছর যাত্রার সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন ইন্দ্রনারায়ণ। এখন তাঁর বয়স বেয়াল্লিশ। এই খাওয়া-খাওয়ির ব্যাপারটা সম্পর্কে এতদিন তিনি ওয়াকিবহাল ছিলেন না; এখন হয়েছেন। অবিশ্যি এর জন্য তাঁর খ্যাতিই দায়ী। ঈশ্বরদত্ত ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছিলেন ইন্দ্রনারায়ণ। তাই আজি সব দল তাঁকে হাত করতে চায়। বিশেষ করে বীণাপাণি অপেরা।
সেদিনের আক্রমণটা অবিশ্যি এই রেষারেষির সঙ্গে যুক্ত নাও হতে পারে। প্রদোষিবাবু ঠিকই বলেছিলেন। এটা খুব সম্ভবত চার-ছাঁচড়ের ব্যাপার। মাথায় বাড়ি মারতে চাইলে কি মারতে পারত না? আসলে সে উদ্দেশ্য ছিল না; ছিল অজ্ঞান করে পকেট থেকে মানিব্যাগটি নিয়ে পালানো। সেদিন সঙ্গে টাকাও ছিল দেড়শোর উপর। ভাগ্যিস মলয় আর ইন্দ্ৰজিৎ এসে পড়ল! খুব বাঁচন বেঁচেছেন ইন্দ্রনারায়ণ।
সন্তোষ বেয়ারা এসে স্লিপ দিল। অশ্বিনী ভড়।
যাও, ডেকে আনো, বললেন ইন্দ্রনারাণ আচার্য।
অশ্বিনী ভড় এসে চেয়ার টেনে নিয়ে পাশেই বসে বললেন, বলুন।
আপনি বলুন, বললেন ইন্দ্রনারায়ণ।
আমি আর নতুন কথা কী বলব। ইন্দ্রবাবু। আমি তো এই নিয়ে পাঁচবার এলুম। এবার তো একটা এসপার ওসপার না করলেই নয়।
সে তো বুঝতেই পারছি। কিন্তু আমি যে মনস্থির করে উঠতে পারছি না। অশ্বিনীবাবু। এতদিনের একটা সম্পর্ক চুকিয়ে দেওয়া তো মুখের কথা নয়।
সবই বুঝলুম, কিন্তু আর্টিস্টরা তো ঘর বদল করছে। নিউ অপেরায় দশ বছর থাকার পর ভারতে চলে গেলেন সঞ্জয়কুমার। এ তো হামেশাই হচ্ছে। আর টাকার অঙ্কটা অগ্রাহ্য করছেন কী করে? আপনি কত পাচ্ছেন ভারত অপেরায় সে তো আমরা জানি। পনেরো হাজার। আমরা সেখানে বলছি বিশ। এক বছরে আপনার ইনকাম হবে। আড়াই লাখ। আর খাতির যত্ন আপনাকে আমরা ওদের চেয়ে কিছু কম করব না। গুণের কদর আমরাও করি। বিজ্ঞাপনে আপনার নাম থাকবে মোটা হরফে। আপনি যা বলবেন তাই আমরা মেনে নেব।–নেহাত যদি সাধ্যের বাইরে না হয়?
শুনুন অশ্বিনীবাবু! আমার আর দু-তিনদিন লাগবে এই নাটকটা শেষ করতে। আমি এখন আর কিছু ভাবতে পারছি না। আপনি সামনের সপ্তাহে আর একটিবার আসুন।
ভরসা দিচ্ছেন কিছুটা?
একেবারে নিরাশ করার ইচ্ছে থাকলে আর আপনাকে আসতে বলব কেন? তবে আমার দিকটাও আপনার চিন্তা করে দেখতে হবে। টাকাটাই যে সব সময় সব থেকে বড় জিনিস তা তো নয়। ভারত অপেরা যদি জানে যে আপনারা আমাকে বিশ অফার করছেন, তা হলে আমার বিশ্বাস তারাও আমাকে ওই টাকাই দিতে চাইবে। আর সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে—এত বছরের সম্পর্ক কি চট করে ভোলা যায়?
ঠিক আছে। তা হলে তো এখন আর কথা বলে লাভ নেই। দিন সাতেক পরে এলে আশা করি ফল হবে। এভাবে ঝুলিয়ে রাখাটাও কোনও কাজের কথা নয়, ইন্দ্ৰবাবু! আসি। নমস্কার।
নমস্কার।
ইন্দ্রনারায়ণ ঘর থেকে বেরিয়ে সামনের দরজার দিকে কিছুদূর এগিয়ে দিলেন। অশ্বিনীবাবুকে। তারপর নিজের কাজের ঘরে ফিরে এসে আবার চেয়ারে বসলেন। শেষ দৃশ্যটা ভালই যাচ্ছে। এভাবে একেবারে শেষ পর্যন্ত গেলে এ নাটককে কেউ রুখতে পারবে না। এটা হবে ইন্দ্রনারায়ণ আচার্যের জীবনের শ্রেষ্ঠ কাজ।
ইন্দ্রনারায়ণ এক মনে কাজ করে চলেছেন। মাঝে মাঝে দু-একটা শ্যামা পোকা আসছে। সামনে পুজে। এই পোকাই তাঁর কাজে সবচেয়ে বেশি ব্যাঘাতের সৃষ্টি করে। আর লোডশেডিং। তবে আজ ক’দিন থেকে লোডশেডিং হচ্ছে না!! আশা করি সামনের দুটো দিনও হবে না।
ইন্দ্রনারায়ণ তাঁর পুরো মনোযোগটা লেখায় দিলেন। তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ নাটক। সম্রাট অশোক।
কিন্তু কাজ বেশি দূর এগোতে পারল না। ইন্দ্রনারায়ণ টেরও পেলেন না যে একটি লোক ঘরে ঢুকে অতি সন্তৰ্পণে তাঁর পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে।
তারপর হামানদিস্তার একটি মোক্ষম বাড়ি। আর ইন্দ্রনারায়ণের চোখের সামনে সব কিছু চিরতরে অন্ধকার হয়ে গেল!