Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » স্পোকেন ইংলিশ মার্ডার মিস্ট্রি || Sujan Dasgupta

স্পোকেন ইংলিশ মার্ডার মিস্ট্রি || Sujan Dasgupta

ডিসেম্বর মাস শেষ হবার মুখে। অন্যান্য বছরের তুলনায় কলকাতায় শীত নাকি একটু বেশি পড়েছে। রাস্তায় দেখছি শাল সোয়েটার কোট আর মাফলারের ছড়াছড়ি। কান-ঢাকা মাঙ্কি ক্যাপও চোখে পড়ছে, বিশেষ করে ভোরবেলায় আর সন্ধ্যার পরে। আমার শীত তেমন লাগছে না, বোধহয় নিউ ইয়র্কে ঠান্ডায় অভ্যস্ত বলে। গেঞ্জির ওপর ফুল হাতার সার্ট পরেই ঘোরাঘুরি করছি। এই বাহাদুরির ফলে না শ্রেফ পলুশনের জন্যে খুক-খুকে একটা কাশি হয়েছে যা কিছুতেই যাচ্ছে না! প্রমথর দেখছি কিছুই হয়নি, হালকা একটা সোয়েট সার্ট চাপিয়ে দিব্বি ঘুরে বেড়াচ্ছে!

ওই যাঃ, যেটা বলতে ভুলে গেছি –এবার আমি, প্রমথ আর একেনবাবু সবাই একসঙ্গে কলকাতায় এসেছি। নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটিতে এই সময় চার সপ্তাহের ছুটি। একেনবাবু অবশ্য আমার বা প্রমথর মতো নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটিতে পড়ান না। ক্রিমিনোলজি নিয়ে হাবিজাবি কী রিসার্চ করছেন জানি না, কিন্তু সাইডে গোয়েন্দাগিরি করে টু-পাইস কামাচ্ছেন। একেনবাবু ইচ্ছে করলে কলকাতায় বেশিদিন থাকতে পারতেন, কিন্তু থাকছেন না। প্রমথ জিজ্ঞেস করেছিল, এত তাড়াতাড়ি ফিরছেন কেন? বউদির সঙ্গে কিছুদিন কাটিয়ে তারপর আসুন! ঘোড়ার ডিম রিসার্চ যা করেন তা তো কলকাতায় বসেও করতে পারেন! ওঁর উত্তর, “কী যে বলেন স্যার, এক যাত্রায় পৃথক ফল কেন! তাছাড়া ফ্যামিলি তো নেক্সট ইয়ারে আসছেই।

‘ফ্যামিলি’ মানে একেনবউদি। তবে একেনবাবুর নেক্সট ইয়ারের ডেফিনেশনটা আমি আর প্রমথ এখনও বুঝে উঠতে পারিনি। গত তিন বছর ধরে উনি এই ‘নেক্সট ইয়ার’ কথাটা বলে আসছেন। এবার এসে বুঝতে পারছি সমস্যাটা একেনবউদির দিক থেকে। নিউ ইয়র্কে গিয়ে থাকতে উনি রাজি নন। উলটে একেনবাবুকে চাপ দিচ্ছেন ওখানকার পাততাড়ি গুটিয়ে কলকাতায় ফিরে আসার। একদিন তো আমাদের সামনে বলেই ফেললেন, “ব্যোমকেশবাবু ফেলুদারা যদি কলকাতায় ডিটেকটিভগিরি করে সংসার চালাতে পারেন, তাহলে উনিই বা পারবেন না কেন!”

একেনবাবু আমাদের সাক্ষী মানলেন, “শুনছেন স্যার ফ্যামিলির কথা, কাদের সঙ্গে কার তুলনা! ওঁরা হলেন লেজেন্ডারি ফিগার। ওঁদের ব্রেন-ক্যাপাসিটির দশ পার্সেন্টও যদি আমার থাকত গর্ব বোধ করতুম!”

স্বামী-স্ত্রীর এইসব কথাবার্তার মধ্যে নাক না গলানোই ভালো। আমি চুপ করে ছিলাম। কিন্তু প্রমথকে চুপ করায় কার সাধ্যি! একেনবাবুকে বলল, “নিজেকে এত ছোটো ভাবছেন কেন, নাই-বা হল দশ পার্সেন্ট, সাত-আট পার্সেন্ট তো আছে।”

এই কথাতে যে বউদিকেও কষ্ট দেওয়া হল, সে বোধটাও ব্যাটার নেই! পরে বোধহয় বুঝল। একেনবউদিকে বলল, “ঠাট্টা করছিলাম বউদি, ম্যানহাটনে একেনবাবুর খুব নামডাক হয়েছে। দশ পার্সেন্টটা ওঁর বিনয়। কিন্তু সামনে বেশি প্রশংসা করতে চাই না, ল্যাজ মোটা হয়ে যাবে।”

ওই এক কথাতেই কাজ, আরেক প্রস্থ চা চলে এল।

কলকাতায় এসে আমরা তিন জায়গায় থাকলেও আড্ডাটা বেশ ভালোই চলছে। বিকেলে প্রায়ই একেনবাবুর বাড়িতে গিয়ে হাজির হই। একেনবউদির বানানো লুচি, আলুর দম, ঘুঘনি, পেঁয়াজি –নিত্যনতুন নানান স্ন্যাকস আর বেশ কয়েক কাপ চা খেয়ে কলকাতার প্রত্যেকটি সমস্যারই সহজ সমাধান আবিষ্কার করে ফেলি। মুশকিল হল, সেগুলো শোনানোর মতো তেমন লোক পাই না। একেনবাবুর এক পরিচিত, নাম মনোজ রায়, তিনি একদিন গল্প করতে এসেছিলেন। ভদ্রলোক আমাদের থেকে বয়সে একটু বড়োই হবেন, কলকাতা কর্পোরেশনে কাজ করেন। সেটা জানতে পেরে মনোজবাবুকে কলকাতার জঞ্জাল পরিষ্কার করার একটা স্কিম বললাম। আমার নিজের বানানো নয়, ব্রেজিলের কুরিচিবা শহরে এটা চালু করা হয়েছিল। ওখানেও জঞ্জাল পরিষ্কার করার লোকেরা ছিল ফাঁকিবাজ। তাদের দিয়ে হবে না বুঝে মেয়র বড়ো বড়ো প্লাস্টিক-ব্যাগ গরিবদের বিলি করলেন। যারা জঞ্জাল-ভর্তি ব্যাগ পিক-আপ সেন্টারে জমা দেবে, তারা এক দিনের খাবার আর পয়সা দুই-ই পাবে। অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই কুরিচিবা শহর পরিচ্ছন্ন হয়ে গেল!

মনোজবাবু দেখলাম সব কিছুতেই খুব নেগেটিভ। আমার কথা শেষ হতে না হতেই বললেন, “ওসব এদেশে চলবে না। পয়সা খরচা হবে ঠিকই কিন্তু জঞ্জাল পরিস্কার হবে না।”

“কেন?”

“সুপারভাইসার বিলি করবে একশোটা ব্যাগ, বলবে হাজার। বাকি নয়শোটা ব্যাগ দোকানে বেচবে। হাজার ব্যাগ জঞ্জাল জমা পড়েছে বলে খরচার হিসেব দেবে, যদিও জমা পড়বে মেরে কেটে একশো। বাকি টাকাটা কার পকেটে যাবে গেস করুন?”

“সেটা কি করে হয়, সুপারভাইজারদেরও তো সুপারভাইজার আছে!”

“ক্ষেপেছেন, অফিসাররা কি নোংরা ব্যাগ গুনতে যাবেন? আর অফিসাররাও তো ধোয়া তুলসীপাতা নন, কাট তো সবারই থাকে!”

এসব ব্যাপারে আমাদের দেশের লোকদের মাথা অতি পরিষ্কার সন্দেহ নেই। আমেরিকায় আট বছর কাটিয়ে আমিই ভোঁতা হয়ে গেছি!

“কিচ্ছু হবে না মশাই এদেশে। টপ-টু-বটম করাপশন, ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় হবে! আগে শুধু পুলিশ আর ট্যাক্সের লোকেদের ঘুষ দিতে হত, এখন ঘুষ-সংস্কৃতি শিক্ষা, স্বাস্থ্য থেকে শুরু করে পাড়ার ক্লাব পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। ব্লিক ফিউচার মশাই, অতি ক্লিক ফিউচার। আমেরিকায় আছেন ভালো আছেন, এসব নিয়ে মাথা ঘামাবেন না।”

মনোজবাবু এত উত্তেজিত হয়ে কথাগুলো বললেন যে আমি আর উচ্চবাচ্য করলাম না। প্রমথ শুধু ফাজলামি করে একেনবাবুকে জিজ্ঞেস করল, “কী ব্যাপার, আপনি এত চুপচাপ বসে অপমানটা হজম করছেন?”

“কী অপমান স্যার?”

“এই যে উনি বললেন পুলিশরা ঘুষখোর, আপনিও তো এখানকার পুলিশে ছিলেন?”

মনোজবাবু এবার লজ্জিত হলেন। “আরে না, না, একেনবাবু একজন এক্সেপশন। ওঁর মতো লোক এখনও কয়েকজন আছেন বলে দেশটা উচ্ছন্নে যায়নি।” তারপর একেনবাবুকে বললেন, “যাই বলুন, আপনার অ্যাবসেন্স এবার আমরা খুব মিস করেছি।”

“কেন স্যার?”

“আমার ডিপার্টমেন্টে কাজ করত একটি ছেলে, তার পিসতুতো বোন ছ’মাস আগে খুন হল। ব্রুটালি মার্ডারড। কল সেন্টারে কাজ করত মেয়েটা, বিধবা মা’র একমাত্র সন্তান। ওর টাকাতেই সংসার চলত। এতদিন হয়ে গেল পুলিশ কোনো কিনারাই করতে পারল না!”

“সে কি স্যার!”

“আর এটা তো শুধু একটা কেসের কথা। তারও মাস তিনেক আগে আরেকটা মেয়ে খুন হল প্রায় একইভাবে। ট্র্যাভেল এজেন্সিতে কাজ করত। একা থাকত গোলপার্কের কাছে। সেটাতেও কেউ ধরা পড়েনি। কী ভয়ানক ব্যাপার বলুন তো! এই যে চাকরির জন্যে এত মেয়ে কলকাতায় একা থাকে, তাদের মানসিক অবস্থাটা চিন্তা করুন? কোনো নিরাপত্তা যদি পুলিশ না দিতে পারে, তাহলে চলে কী করে!”

আমরা সবাই একেনবাবুর দিকে তাকালাম। বেচারা একেনবাবু, কলকাতা পুলিশের এই অকর্মণ্যতার দায় যেন ওঁর!

“পুলিশ কি হাল ছেড়ে বসে আছে, না এখনও ইনভেস্টিগেট করছে?” আমি জিজ্ঞেস করলাম মনোজবাবুকে।

“কে জানে! আমাদের দেশের পত্রিকাগুলোও তো সেরকম। প্রথম ক’দিন একেবারে প্রথম পাতার খবর, সেই নিয়ে চর্বিতচর্বণ। তারপর অন্য কিছু এলেই আগেরটা আউট অফ ফোকাস। ২৪ ঘন্টার নিউজ চ্যানেলগুলোও তাই। কেউ ধরা পড়লে হয়তো শুনতে পাওয়া যেত। এনিওয়ে একেনবাবু যখন এসেছেন, আমি শুভেন্দুকে বলব এসে দেখা করতে।”

“শুভেন্দু কে স্যার?”

“ওই যে-ছেলেটা আমার ডিপার্টমেন্টে ছিল, যার বোন খুন হয়েছে। মেয়েটার মা একেবারে ডিভাস্টেটেড। খালি নাকি কাঁদেন আর বলেন আমার ফুলের মতো মেয়েটাকে যে মারল, সে এখনও পাড়ায় বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে –আর আমায় তা শুনতে হচ্ছে!”

“তার মানে? মহিলা কি কাউকে সাসপেক্ট করেন?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

“নিশ্চয় করেন। কিন্তু এখানে তো অনেক পার্টির ব্যাপার আছে। রুলিং পার্টির লোক হলে ফরগেট ইট!”

বুঝলাম ভদ্রলোক দেশকে নিয়ে একেবারে তিতিবিরক্ত, কোনো ভালো ওঁর চোখে পড়ে! এমন কি বউদির চমৎকার চা খেয়েও মন্তব্য করলেন, “বুঝলেন, আজকাল ভালো চা-ও পাওয়া যায় না এদেশে, সব এক্সপোর্ট হচ্ছে।”

মনোজবাবু চলে যাবার পর আমি একেনবাবুকে জিজ্ঞেস করলাম, “ভদ্রলোক কর্পোরেশনে করেন-টা কি, মনে তো হচ্ছে অপজিশন পার্টির লোক!”

“ঠিক জানি না স্যার, তবে খুব রিসোর্সফুল। একবার মিউটেশনের ব্যাপারে খুব সাহায্য করেছিলেন।”

“আপনার সঙ্গে ওঁর পরিচয় হল কী করে?”

“সে এক কাহিনি স্যার। ওঁর দাদা মৃত্যুঞ্জয়বাবুর একটা রেস্টুরেন্ট আছে। সেখানে একবার ডাকাতি হয়েছিল।..”

“রেস্টুরেন্টে ডাকাতি! গয়নার দোকানে হয় শুনি।” কথার মাঝখানেই প্রমথ ফোড়ন কাটল।

“ব্যাপারটা স্যার একটু স্ট্রেঞ্জ ঠিকই। দু’জন ড্রাগ ডিলার রেস্টুরেন্টে বসে টাকার লেনদেন করছিল। ডাকাতরা ঢুকেছিল সেই টাকা লুট করতে। গোলাগুলি চলে। শেষে অবশ্য সবাই ধরা পড়ে। মধ্যে থেকে গুলি লেগে মৃত্যুঞ্জয়বাবু জখম হন। সেটা বার করতে হাসপাতালে সার্জারি করতে হয়! যাচ্ছেতাই ব্যাপার স্যার! মৃত্যুঞ্জয়বাবু খুব ভয় পাচ্ছিলেন এই নিয়ে পুলিশ বোধ হয় ওঁকে হ্যারাস করবে। উনি স্যার নির্দোষ, হ্যারাস করার প্রশ্ন উঠছে কেন? আমি ওঁকে ভরসা দিয়ে বলেছিলাম কেউ ঝামেলা করার চেষ্টা করলে আমায় খবর দিতে। সেই সময় মনোজবাবুকে নিয়ে মৃত্যুঞ্জয়বাবু কয়েকবার আমার কাছে এসেছিলেন।”

“কতদিন আগের ব্যাপার এটা?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

“তা স্যার প্রায় বছর ছয়েক হল। আপনারা হয়তো ওঁর দাদার রেস্টুরেন্টটা দেখেও থাকবেন। মেনকা সিনেমা থেকে হাঁটা পথ, মিলনী কাফে।”

“দেখে থাকব মানে!” প্রমথ একটু উত্তেজিত হয়েই বলল, “কতবার ওখানে খেয়েছি! কিরে বাপি, তুইও তো খেয়েছিস?”

“বহুবার খেয়েছি,” আমি বললাম। “দারুণ মোগলাই করে! মালিকের নামটা জানতাম না, খুব গপ্পে লোক। হ্যাঁ ঠিকই, মনোজবাবুর সঙ্গে খানিকটা মিল আছে।”

“এক কাজ করুন না,” প্রমথ প্রস্তাব দিল। “চলুন, বউদিকে নিয়ে সবাই মিলে একদিন ওখানে মোগলাই খেয়ে আসি।”

একেনবাবু ইতস্তত করছেন দেখে প্রমথ যোগ করল, “আর কিপটেমি করে ‘না’ বলবেন না। আপনার একটা পয়সাও খরচা হবে না, আমরা খাওয়াব বউদিকে।”

একেনবাবু লজ্জিত হয়ে বললেন, “কী যে বলেন স্যার, কলকাতায় আপনাদের আমি একদিন খাওয়াতে পারব না!”

“খাঁটি কথা, এটা তো ম্যানহাটান নয়, অনেক সস্তায় ব্যাপারটা সারতে পারবেন!” প্রমথ খোঁচা দিল। সামনে একেনবউদি বসে, প্রমথটার স্থান-কাল-পাত্র জ্ঞান নেই!

“চুপ কর তো! উনি যেন আমাদের নিউ ইয়র্কে খাওয়ান না!”

Pages: 1 2 3 4 5 6 7
Pages ( 1 of 7 ): 1 23 ... 7পরবর্তী »

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *