উদ্ধারে প্রেম
বেশীদিন আগের কথা নয়। নিরিবিলি এক গ্ৰাম সুধন্যপুরের কথা বলছি। এখানে কয়েক ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁচেছে। অধিকাংশ ঘরেই নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। তেমনি এক পরিবারে নিধি, সুদান আর শালিনীর বসবাস। নিধি ত্রয়োদশী এক কিশোরী। মাধ্যমিকের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। এমনিতে খুব মেধাবী। বইয়ে মুখ গুঁজে থাকে।
সুদানের একটা আনাজপাতির দোকান আছে। সংসারের রোজগার মূলতঃ সেখান থেকেই।
সে বলে, নিধি, তোর কোনো অসুবিধা হচ্ছে না তো!
-কেন? আমাকে স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারা যথেষ্ট সাহায্য করে।
-খুব ভালো ব্যাপার।
শালিনী শুধোয়, তোর কি কি বই প্রয়োজন? আমাকে নির্বিবাদে জানাতে পারিস।
নিধি মাথা নীচু করে থাকে। আসলে তার সমস্যা অন্যত্র। সেটা খুব গোপনীয়।
মেয়ের মুখের রঙ বদলে গেছে। সুদান আঁচ করে।
তারপর শুধোয়, আমাদের অকপটে বলতে পারিস, তোর কি সমস্যা?
তবুও নিস্তব্ধতা চারপাশে বিরাজমান। টূঁ শব্দটি নেই নিধির ঠৌঁটে।
শালিনী খুব অন্তরঙ্গভাবে মেয়েকে লক্ষ্য করে। সে আরো গম্ভীর হয়ে যায়।
আসলে এক রোমিওর উপস্থিত ঘটেছে তার জীবনে।এই ব্যাপারটা কি বাবা-মাকে প্রাণ খুলে বলা যায়?
কক্ষণো নয়! কক্ষণো নয়! কক্ষণো নয়! নিধির মধ্যে এক ছটফটানি ভাব জেগে ওঠে।
এরপর আরো বেশ কিছুদিন কেটে গেল। মিস্টার অর্পণের উৎসাহ অনেকটাই বেড়ে গেছে। নিধিকে যদি সম্পর্কের জালে আষ্টেপৃষ্টে জড়াতে পারে।
একদিন স্কুল না গিয়ে নিধি পার্কে গিয়ে অপেক্ষা করে। অজানা অচেনা এক পুরুষের জন্য। রঙের ছোঁয়ায় তার মনটাও রঙিন। সেই বাহারী দুনিয়ায় অর্পণ এসে হাজির কিছুক্ষণের মধ্যে।
নিধি- এত দেরী করলে কেন?
অর্পণ – এমনি এমনি হয় নি নিধি। ভালো কিছু পেতে গেলে অনেক কষ্ট সহ্য করতে হয়।
নিধি- ভালো কিছু মানে?
অর্পণ কিছু না বলে মুচকি মুচকি হাসে। খুব স্বাভাবিকভাবেই স্বল্প সুন্দরীর মুখ লজ্জায় রাঙা হয়। অর্পণ শিহরিত হয়।
কথাবার্তা অনেক দূর এগিয়েছে। ঐ পার্কের পাশ দিয়ে সুদান বাড়ি ফিরছিল। মেয়েকে সে একটা যুবকের সাথে দেখে কিঞ্চিত বিস্মিত। কি বলবে বিনা মেঘে বজ্রপাত?
না, না, সন্দেহের মেঘ অনেকদিন ধরেই মাথার ওপর উড়ছিল। আজ নিশ্চিত হওয়া গেল। সে রাগান্বিতও। মেয়ে বাড়ি ফিরলে সব জানতে হবে।
এদিকে সন্ধের মুখে নিধি বাড়িতে এলে শালিনী সব শুধোয়, ঐ ছেলেটি কে রে?
চমকে ওঠে নিধি। ভয়ে মুখ শুকিয়ে যায়। প্রথমে কিছু বলতে চায় না। তবে সুদানের ধমক খেয়ে অস্ফুট স্বরে বলে, অর্পণ।
-কোথায় বাড়ি? কি করে ছেলেটা?
-আমাদের পাশের পাড়ার রাঘব চ্যাটার্জীর ছেলে। উনি বড় ব্যবসায়ী।
-তার মানে এক পয়সাওয়ালার ব্যাটাকে ধরেছিস।
নিধি একেবারেই কোণঠাসা। ভালো-মন্দ কিছু ভাবার মতন অবস্থা তার নেই। তবে তাদের মতন গরিবের সাথে একেবারেই মানানসই নয়।
সুদান-শালিনীর অজানা আতঙ্কে বুক দুরুদুরু। পয়সার জোরে বড়লোকের নন্দন গরিব-নন্দিনীদের ভোগের পুতুল বানায়। এমন সাত-পাঁচ ভাবনায় ওরা রাতে দু চোখের পাতা এক করতে পারে না।
ওদের মেলামেশা উত্তরোত্তর বর্তমান। সুদান একদিন হুঙ্কার দিয়ে বলে, তুমি স্কুল ছাড়া কোথাও যাবে না। আর কোনদিন ওর সাথে তোমায় দেখলে দূরে কোথাও বোর্ডিংয়ে পাঠিয়ে দেব। ভেবে দেখো একবার।
এভাবে বাদানুবাদের ভেতর দিনগুলো অতিক্রান্ত হতে থাকে।
এদিকে বিদ্যুতের বিল দীর্ঘদিন বকেয়া থাকায় রাজ্য বিদ্যুৎ পর্ষদের লোকেরা ওদের ঘরের লাইন বিচ্ছিন্ন করে দেয়। একেই বলে বিষম ঠ্যালা। মোমের আলোই বিষম ভরসা। নিধিকে এবার অনেক কষ্ট সয়েই পড়তে হবে। নিরুপায় বাবা-মা শুধুই পরমেশ্বরকে স্মরণ করে।
এই ভয়ানক সমস্যার কথা অর্পণের কানেও একদিন যায়।
সব ধরণের ভয়কে তুচ্ছজ্ঞান করে সে সরাসরি সুদানের কাছে আসে। বলে, আমি বিদ্যুতের বকেয়া বিল শোধ করে দেব। শুধু তাই নয়, নিধির পড়াশোনা ব্যাপারে যথাসাধ্য সাহায্য করব।
শালিনীর ভেতর এক অদ্ভূত আনন্দ খেলতে থাকে। শঙ্কাও কিছু কম নয়। এমন সহায়তার পেছনে কোনো অশুভ হাতছানি নেই তো! ভাবনায় পরতে পরতে সে ক্লান্ত হয়ে পড়ে।
সুদানকে শুধোয়, কি করবে?
-ছেলেটা যখন সাহায্য করতে চাইছে, তখন এড়াই কি করে?
শালিনী এবার তেড়েমেড়ে বলে, ঐ ছেলেটাকে তো তুমি একদিন খুব অপমান করেছিলে।
সুদান নিশ্চুপ। তবু অর্পণের এই অযাচিত সহায়তা গ্রহণ না করে পারা যাবে না।
অতএব আবার বিদ্যুৎ ফিরে আসে নিধির পরিবারে।
তার বাবা-মাও এবার হয়তো নিশ্চিন্ত থাকবে।
সে মনে মনে ভাবে, ভবিষ্যতে চার হাত এক হতে কোনো অসুবিধা হবে না।
এরপর অর্পণের খাতির খুব বেড়ে যায় হবু শ্বশুর-শ্বাশুড়ির কাছে। ঘনঘন তার যাতায়াতাও চোখে পড়ার মতন। তবে অনাগত কালের জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।