প্ৰথম খণ্ড
প্রথম পরিচ্ছেদ : স্বামী ও স্ত্রী
দেবেন্দ্রবিজয়ের সুসজ্জিত শয়ন-প্রকোষ্ঠে তাঁহার স্ত্রী রেবতী ও অন্য একটি অবগুণ্ঠন- ভারাক্রান্তা নবীনা আসীন।
কয়েক মুহূর্ত নীরবে কাটিলে কৃতাবগুণ্ঠনা, রেবতীকে মৃদুস্বরে জিজ্ঞাসা করিল, “তিনি কখন আসবেন?”
রেবতী বলিল, “এখনই এসে পড়বেন; আজ আর কোথাও কোন কাজে বার হন্ নি; এই পাড়ার মধ্যেই আছেন। বোধ হয়, কোন বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে গেছেন।”
“তাই ত!” বলিয়া অবগুণ্ঠনবতী দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিল।
রেবতী জিজ্ঞাসিল, “তাঁকে এত দরকার কে’ন? কি হয়েছে তোমার?”
নবীনা বলিল, “কি হয়েছে আমার? আমি বড়ই বিপদে পড়েছি; তিনি ভিন্ন আর আমার উপায় নাই!”
রেবতী বলিল, “বেশ, তিনি আসুন। আমাকে তোমার লজ্জা কি? ঘোমটা খোল—একে এই প্রচণ্ড গরম, তাতে আবার তোমার ওই প্রকাণ্ড আনাভি ঘোমটা, মারা যাবে কি?”
নবীনা বলিল, “ক্ষমা করুন।” নীরবে রহিল।
এমন সময়ে বাহিরে কাহার পদশব্দ হইল।
“তিনি আছেন,” বলিয়া রেবতী ‘যেদিকে পদশব্দ হইতেছিল, সেইদিকে ধাবিত হইল।
সোপানাতিক্রম করিয়া যেমন দেবেন্দ্রবিজয় দালানে পাদক্ষেপ করিয়াছেন মাত্র—রেবতী সম্মুখে উপস্থিত। সহাস্যে রেবতী বলিল, “আজ তোমার একজন মক্কেল এসেছে।”
দেবেন্দ্রবিজয় ললাট কুঞ্চিত করিয়া বলিলেন, “বটে! কোথায়?”
রে। এখানে—অন্দরমহলে— তোমার শোবার ঘরে।
দে। অন্দরমহলে। শোবার ঘরে—মক্কেল! পরিহাস করছ?
রে। পরিহাস নয়, সত্যসত্যই একজন বড় চমৎকার মক্কেল এসেছে; তোমার শোবার ঘরে ব’সে আছে, দেখগে যাও। দেখো, সাবধান! মক্কেলকে দেখে যেন আক্কেল হারিয়ে ব’সো না— আমাকে মন থেকে যেন তাড়িয়ো না। শীঘ্র যাও, অনেকক্ষণ এসেছে।
রেবতী প্রস্থান করিল। দেবেন্দ্রবিজয় শয়ন-গৃহে প্রবেশ করিলেন।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – ঘটনা-প্রসঙ্গ : পূৰ্ব্বাংশ
দেবেন্দ্রবিজয়কে দেখিয়া সেই উপবিষ্টা অবগুণ্ঠনবতী নবীনা তাড়াতাড়ি উঠিয়া দাঁড়াইল। তেমনি তাড়াতাড়ি জিজ্ঞাসা করিল, “আপনি কি গোয়েন্দা? আপনার নাম কি দেবেন্দ্রবিজয় মিত্র?”
দেবে। হাঁ, আমারই নাম—ব’সো তুমি।
অব। আমি বড়ই বিপদে পড়েছি। তেমন বিপদ্—তেমন ঘটনা সচরাচর কারও ঘটে না। সে সব কাণ্ড বড়ই রহস্যপূর্ণ—বড়ই জটিল!
দে। সে সকল কথা শোবার আগে—যিনি আমাকে কাজে নিযুক্ত করতে ইচ্ছুক, তাঁকে জানতে চাই।
অ। কেন? আমিই আপনার সাহায্য ভিক্ষা করছি।
দে। ওঃ তুমি। তোমার নাম?
অ। আমার নাম মনোরমা।
দে। বিবাহ হয়েছে কি?
অ। না।
দে। ভাল, যার হ’য়ে এখন থেকে আমাকে কাজ করতে হবে, তাকে আগে চিনে রাখা আমার কর্তব্য; তার পর তোমার কাজের বিষয় শুনব। মা লক্ষ্মি! আমার কাছে ঘোমটা খুলতে তোমার কোন বাধা নাই।
তৎক্ষণাৎ বাহিরে স্ত্রীকণ্ঠোত্থিত হাস্যধ্বনি শুনা গেল। বুদ্ধিমান পাঠক, আর আপনি পাঠিকা সহজেই বুঝিতে পারিয়াছেন, সে হাসি রেবতীর। রেবতী এতক্ষণ আড়ি পাতিয়াছিল। স্ত্রীলোকের মন এমনই অবিশ্বাস-প্ৰবণ!
মনোরমা পূর্ব্বে কিছু ইতস্ততঃ করিল, তৎপরে অবগুণ্ঠন উন্মোচন করিল। মরি, মরি! কী সুন্দর মুখমণ্ডল! প্রচুরায়ত কৃষ্ণতার লোচনদ্বয়, সর্পালাঙ্গুলাকার কৃষ্ণভূযুগ এবং আবেণীবদ্ধ সুকৃষ্ণ অলকদাম সেই আননমণ্ডলের সমধিক শোভাবর্দ্ধন করিতেছে।
পাঠক! আপনি একদিন সৌন্দর্য্য-জগতের বনবিহারিণী—সংসারের কেউ নহে, সেই কপালকুণ্ডলার আগুল্ফবিলম্বিতকেশজালসমন্বিত, সুচারু বদন দেখিয়াছেন; সেই জগচ্চাঞ্চল্য- বিধায়িনী সুন্দরী মতিবিবিকে (পদ্মাবতী) পাঠক দেখিয়াছেন; লোলাপাঙ্গে বিলোলকটাক্ষ- বিক্ষেপকারিণী, সুবেশা, সুচতুরা, ব্রীড়াবিহীনা বিমলাকে নির্জ্জন প্রকোষ্ঠে গ্রীবা বাঁকাইয়া চমৎকার বেণীবন্ধন করিতে দেখিয়াছেন; রম্য কারাগারে নিরীহা, জগদ্বিমোহিনী নবাব-নন্দিনী আয়েসাকে রোগী-পার্শ্বে-উপবিষ্টা থাকিতে দেখিয়াছেন—আরও দেখিয়াছেন, তাঁহার সেই কর্ণালঙ্কারের মৃদু দোলানি; জগৎসিংহের পার্শ্বস্থিতা প্রেমপীড়িতা তিলোত্তমার ন্যায় তিলোত্তমাকে দেখিয়াছেন ভ্রমরের ভ্রমরকৃষ্ণকেশতরঙ্গমালাবিশোভিত সুচারু বদন দেখিয়াছেন; প্রফুল্লের ভুবন-আলোকরা প্রফুল্ল পূর্ণচন্দ্রপ্রভাপূর্ণ মুখমণ্ডল অবগুণ্ঠনোন্মুক্ত হইতে দেখিয়াছেন; সূর্য্যমুখীর বালসূর্য্যের ন্যায় প্রসন্নকিরণপূর্ণ বিমল মুখকান্তি দেখিয়াছেন; প্রতাপের বাসায় নিদ্রিতা শৈবালিনীর বাতায়ন-প্রবিষ্ট- চন্দ্রকর-প্রকটিত ঘুমন্ত মুখশ্রী দেখিয়াছেন; তবে এরূপস্থলে কি বলিয়া মনোরমার রূপকে এ সকলের অপেক্ষা অধিক সুন্দর বলি? কাজেই কিছু বলা হইল না। তবে এইমাত্র বলিতে পারি, সৌন্দর্য্যের ঐ সকলই ত মনোরমাতে আছে, তা’ ছাড়া আরও এমন একটা কিছু আছে, একবার চাহিলে নয়ন আর সহজে ফিরাইয়া লওয়া যায় না; একবার দেখিলে চেষ্টা করিয়া আর ভুলিতে পারা যায় না।
দেবেন্দ্রবিজয় সেই মুখ দেখিয়া চমকিত হইলেন। মনে পড়িল, যেন এই মুখ তিনি বহুদিন পূর্ব্বে আর একবার কোথায় দেখিয়াছেন। এ মুখ সেই জুমেলিয়ার মত—সেই নরহন্ত্রী তাঁহার একমাত্র নারী-শত্রু জুমেলিয়ার* মুখের মত না? তাহাই ত বটে, কী সৰ্ব্বনাশ! দেবেন্দ্রবিজয় মুখে সে বিস্ময়ভাব কিছুমাত্র প্রকাশ না করিয়া নীরবে রহিলেন।
[* মনোরমা’র পূর্ব্বে “মায়াবী” পাঠ করিলে ভাল হয়। ইহা “মায়াবী” পুস্তকের পরবর্তী ঘটনা। লেখক]
মনোরমা বলিল, “মহাশয়, আজ এই তিন বছর পরে এই প্রথম আমি একজন অপরিচিতের কাছে নিজের পোড়ারমুখ বার করলেম।”
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, “নিজেকে এভাবে তিন বছর গোপন রাখবার কারণ কি?”
ম। কারণ, আর একটি মেয়ে আছে, সে সকল রকমে ঠিক আমার মত দেখতে।
দে। সে কে? তার নাম কি?
ম। তা’র নামও মনোরমা।
দে। বটে! বড়ই আশ্চর্য্য ব্যাপার! দেখছি, শুধু রূপ একরূপ নয়, নামও একরূপ! এ বড় চমৎকার ঘটনা!
ম। ঘটনা নয়—ষড়যন্ত্র। অন্য যে মেয়েটি ঠিক আমার মত দেখতে, তার নিজের নাম সে গোপন করেছে; আর আমার নামে নিজেকে বহাল্ ক’রে আমার অতুল সম্পত্তি ভোগ-দখল করছে। আমার সেই বিষয়-ঐশ্বর্য্য আমাকে উদ্ধার করে দিবেন, এই আশায় আমি আপনার শরণাপন্ন হ’তে এসেছি।
দে। সে মনোরমার প্রকৃত নাম কি?
ম। আমি ঠিক বলতে পারি না—তবে—
দে। সে কি তোমার আত্মীয়?
ম। তাও আমি ঠিক বলতে পারলেম না।
দে। এ বড় সহজ ব্যাপার নয়। মনোরমা, তুমি যা কিছু জান, সমস্তই আমাকে এক-একটি ক’রে বল দেখি?
সাশ্রনয়নে দেবেন্দ্রবিজয়ের মুখ-প্রতি চাহিয়া ধীরে ধীরে মনোরমা জিজ্ঞাসা করিল, “মহাশয় দুই জনের আকৃতি ও মুখশ্রীর সৌসাদৃশ্য এক যমজ ছাড়া আপনি কখন দেখেছেন কি?”
“না, তা’ দেখি নি।”
“সেই ঘটনাই এখন আমার উপর ঘটেছে; তাই আপনাকে বলতে এসেছি। আমরা তিনজনেই ঠিক এক রকম দেখতে—কোন প্রভেদ নাই।”
“একজনকে দেখে কি আর একজন ব’লে ভ্রম ঘটতে পারে?”
“নিশ্চয়ই, সেই ভ্রমই ত তিন জনকে নিয়ে যখন-তখন ঘত; কিন্তু এখন সে তিনটির একটি মারা গেছে।”
“তিনটির মধ্যে কোটি মারা গে’ছে, তা কি তুমি জান?”
“না, তা’ আমি ঠিক বলতে পারি না।”
“তাদের মধ্যে কেউ কোন সম্পর্কে তোমার আত্মীয় হয় কি না?”
“হাঁ, একজন আমার মাস্তুত ভগিনী। অপরটি আত্মীয় নয়—পরম শত্রু।”
“সেই তিনটির মধ্যে তুমি একটি। আচ্ছা, তিনজনের বয়স কি সমান?“
“আমার ভগিনী আর আমি একদিনে একক্ষণে ভূমিষ্ঠ হই। আমার ভগিনীর জন্মস্থান চেলা— গোপালনগর। আর আমার জন্মস্থান খিদিরপুরে আমাদের নিজ-বাড়ি আনন্দকুটীরে। অন্যের বয়স কি জন্মস্থান সম্বন্ধে আমি কিছু জানি না।”
“সেই তবে সকল রহস্যের মূল। যাক্, তোমার মাস্তুত ভগিনীর নাম কি?“
“তার নাম কুমুদিনী।”
“তুমি বেশ জান, কুমুদিনী তোমার আপন মাসীর মেয়ে?”
“হাঁ, কুমুদিনীর মা আর আমার মা যমজ বোন্।”
“যাক্, এখন তোমাকে কতকগুলি কথা জিজ্ঞাসা করা আবশ্যক দেখছি। পাছে ব্যাপারটা বুঝতে কোন গোলমাল ঘটে, এজন্য তোমাদের তিনটির এক-একটা নম্বর স্থির করা দরকার। তুমি ১ নং, তোমার ভগিনী কুমুদিনী ২ নং, আর সেই অজ্ঞাত-কুলশীলা, অপরিচিতা ৩ নং। তুমি ৩ নং মেয়েটির বিষয় কতদিন জানতে পেরেছ?”
“আজ চার বছর—কি কিছু বেশি হবে। ভূকৈলাসে আমাদের এক ঘর কুটুম্ব ছিল; কোন দরকারে একদিন আমি তাদের বাড়ীতে যাই—সেখানে ঐ ৩ নং মেয়েটিকে দেখতে পাই।”
‘এরূপ দেখা-সাক্ষাতে কিছু পরিচয় ঘটাই সম্ভব।”
“পরিচয়? জাল—জাল! সে পরিচয় বড়ই ভয়ানক! ৩ নং মেয়েটি আমাকে দেখেই ‘দিদি’ বলে কাছে এসে দাঁড়াল। এমন ভাব দেখলে, সে যেন নিজে ২ নং—আমার ভগিনী কুমুদিনী।”
“যদি তোমাদের আকৃতির কোন পার্থক্য ছিল না; তবে কেমন ক’রে তখন জানলে যে, সে তোমার ভগিনী নয়? “
“তখন আমার ভগিনী কুমুদিনী শয্যাগত—তখন তার খুব ব্যারাম—উঠে বার শক্তি ছিল না।”
“তুমি ঠিক জানতে যে, তার উঠে বসার শক্তিমাত্রও তখন ছিল না? তারপর তুমি তোমার ভগিনীকে দেখতে গৃহে ফিরেছিলে কি?”
“না, আমার সঙ্গে যে চাকর ছিল, তাকেই পাঠিয়েছিলেম। সে বড় বিশ্বাসী ছিল। তেমন বিশ্বাসী বড় একটা দেখতে পাওয়া যায় না।”
“এখন সে কোথায়?”
“প্রায় তিন বছর তার মৃত্যু হয়েছে। আমার বিশ্বাস, বিষপানে তার মৃত্যু হয়েছে।”
“এ বিশ্বাসের কারণ কি?”
“কারণ? হঠাৎ তার মৃত্যু হয়—সে মৃত্যু বড়ই রহস্যপুর্ণ।”
“তুমি তার এই হঠাৎ মৃত্যুর কোন খোঁজ-খবর রাখ নি?”
“তখন সে আমার কাছে ছিল না; তাই কিছু করতে পারি নি। ২ নং কিংবা ৩ নং মেয়েটির সঙ্গে ছিল।”
‘কেমন ক’রে তা’ হতে পারে? সে ত তোমারই চাকর।”
“হাঁ, সে তখন ভ্রমে পড়েছিল; সে মনে করেছিল, সে আমার সঙ্গেই আছে।”
“মন্দ নয়, দেখছি! সে কি তোমাদের পুরানো চাকর—নিশ্চয় বৃদ্ধ —বরাবরই কি তোমাদের পরিবারভুক্ত ছিল?”
“হাঁ।”
“যদি তাই হবে, সে যদি তোমার জন্মাবধি নিত্য তোমায় দেখে আছিল, তবে কি ক’রে সে এমন প্রবঞ্চিত হ’ল—এমন ভ্রম তার ঘট্ট্ল?”
“এই ভ্রম তার প্রথম—এই ভ্রমই তার শেষ ভ্ৰম!”
“কেন, এ কথা বল্ছ কেন?”
“কেন? এমন ভ্রম তার আর একদিনও ঘটে নি। মৃত্যুর পূর্ব্বে সে সকলই বুঝতে পারে; নিজে যে জঘন্যরূপে প্রবঞ্চিত হয়েছে, সে তা’ জানতে পারে; তাকে এরূপে কেন প্রবঞ্চিত করা হয়েছিল—সে রহস্য সে তখন উদ্ভেদ করে—আমার জীবনের উপর লক্ষ্য রেখে কেউ তাকে বিনষ্ট করেছে।”
“সে যে রহস্য উদ্ভেদ করে, তা’ তুমি অবগত আছ?”
“আছি, সে মৃত্যুপূর্ব্বে একখানি পত্র আমার নামে লিখেছিল— সে পত্র আমি পেয়েছি।”
“ডাকে সে পত্র আসে?”
“না, একটা লোক দিয়ে যায়; সেখানি আমি যত্নে রেখেছি—আমার সঙ্গেই আছে, এই দেখুন।” দেবেন্দ্রবিজয় মনোরমার হাত হইতে সেই পত্রখানি লইয়া তখনই পড়িতে লাগিলেন।
শ্রীশ্রীকালীমাতা
সহায়।
“দিদিমণি!
আমি বড়ই প্রবঞ্চিত হইয়াছি। তুমিই আমার যথার্থ মনিব। এখন আমি বুঝিতে পারিয়াছি কে আমার প্রকৃত মনিব। আমি সেজন্য অনেক প্রমাণ সংগ্রহ করিয়া রাখিয়াছি। পাছে হারাইয়া যায়, সেই ভয়ে পাঠাইতে পারিলাম না। সুবিধা পাইলে—সুযোগ বুঝিলে—অবসর মতে সে সকল প্রমাণ আমি তোমার হস্তগত করাইব। কাল আমার জ্বর হইয়াছে; পূৰ্ব্বদিন অপেক্ষা আজ জ্বর একটু বেশি। আগামী কল্য যদি আমি ভাল না থাকি, কি জ্বর আরও বেশি হয়, তাহা হইলে আমি কালই সে সকল প্রমাণ-পত্র লোক মারফৎ তোমাকে পাঠাইয়া দিব। পরে আমার একান্ত প্রার্থনা— তোমাকে না চিনতে পারিয়া আমি যে গুরুতর অপরাধ করিয়াছি, তা মার্জ্জনা করিবে।
সেবক
রামগোলাম।”
“পুঃ—আমার নিকট হইতে সে সকল প্রমাণ-পত্র চুরি যাইবার কোন আশঙ্কা নাই— সে ভয় করিও না। আমি সে প্রমাণ-পত্রের পুলিন্দা এমন স্থানে রাখিয়াছি, কাহারও সাধ্য নহে যে খুঁজিয়া বাহির করে। সেই পুলিন্দা পরে ঠিক চিনিতে পারিব বলিয়া তাহার উপরে “১৭–ক” লিখিয়া চিহ্ন দিয়া রাখিয়াছি।”
পত্রখানি শেষ করিয়া দেবেন্দ্রবিজয় মনোরমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন “এরপর রামগোলামের আর কোন পত্র তুমি পাও নি?”
মনো। না, সেই রাত্রেই তার মৃত্যু হয়।
দেবেন্দ্র। মৃত্যু! একদিনের জ্বরে মৃত্যু? সে কি! কি ব্যারামে তার মৃত্যু হয়?
ম। মৃগীরোগ ব’লেই এখন সাব্যস্ত করা হয়েছে।
দে। তোমার মনে বিশ্বাস, তাকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলা হয়েছে। ভাল, তারপর ‘১৭–ক’ পুলিন্দার কোন সন্ধান করেছিলে?
ম। পারি নি, সে পথ বন্ধ হ’য়ে গিয়েছিল। তার পরেই আমি মিথ্যা অভিযোগে বন্দিনী হই। যদি আমি সে কথা আপনাকে বলি–হয়ত এ যাবৎ যেমন আন্যান্য লোক আমার সে কথায় বিশ্বাস করে নি—তেমন আপনিও করবেন না।
দে। যদি তুমি নিজে সে কথা আমার কাছে প্রকাশ না কর আমি অন্য উপায়ে সে সংবাদ সন্ধান ক’রে নেব। তুমি সে কথা আমার কাছে প্রকাশ কর বা না কর, সে তোমার ইচ্ছা; তবে নিশ্চয় জেন, আমার কাছে এর পর বিন্দুবিসর্গ কিছুই গোপন থাকবে না।
ম। যে এখন আমার অতুল ঐশ্বর্য্য ভোগদখল করছে, সেই জাল মনোরমা আমাকে পাগল ব’লে এক কবিরাজের বাড়িতে বন্দিনী ক’রে রেখে দেয়।
দে। কতদিন সে তোমার বিষয়ের দখলীকার হ’য়ে আছে?
ম। আজ তিন বছর।
দে। কতদিন তুমি কবিরাজের হাত থেকে মুক্তি পেয়েছ?
ম। আজ দুই দিন।
দে। বটে, সে কবিরাজের বাড়ি কোথায়? তার নাম কি?
ম। বাড়ি শিবপুর—নাম গোবিন্দপ্রসাদ সেন।
দ। জান তুমি—তুমি পাগল—পালিয়ে এসেছ ব’লে এখনি আবার আমি তোমায় ধরিয়ে দিতে পারি? তারই হাতে—সেই কবিরাজেরই হাতে আবার আমি তোমাকে ফেলতে পারি?
ম। (কাতরভাবে) অ্যাঁ! হা ভগবান্! মহাশয়, বলেন কি! আমি যে আপনার শরণাপন্না। আপনার আর যা’ ইচ্ছা হয়, তাই করুন, ধরিয়ে দেবেন না—তার হাতে যাওয়া অপেক্ষা যমের হাতে—
দে। পাগল তুমি, তোমাকে ধরিয়ে দেওয়াই এখন আমি কৰ্ত্তব্য মনে করি।
তৃতীয় পরিচ্ছেদ : ঘটনা-প্রসঙ্গ : মধ্যাংশ
মনোরমাকে দেবেন্দ্রবিজয় এমন কর্কশকণ্ঠে, অত্যুচ্চস্বরে স্থিরপ্রতিজ্ঞ ভাব দেখাইয়া উক্ত কথাগুলি বলিলেন যে, তাহাতে কিয়ৎকাল কোন কথা কহিতে মনোরমারও সাহস হইল না; নিস্পন্দ, নিৰ্ব্বাক হইয়া রুদ্ধশ্বাসে সে মস্তক অবনত করিয়া রহিল। এরূপ বলিবার দেবেন্দ্রবিজয়ের একটা উদ্দেশ্য ছিল সেই অপরিচিতার হৃদয়ের ভাবটি হৃদয়ঙ্গম করা ভিন্ন তাহা আর কিছুই নহে।
অনেকক্ষণ পরে জলভারাক্রান্ত, নীলালক্তকপ্রভাসম্পন্ন চক্ষুদ্বয় উন্মীলন করিয়া, ধীরে ধীরে অবনতমস্তক তুলিয়া সভয়ে কাতরকণ্ঠে মনোরমা বলিল, “আমি যে সকল কথা বললেম, তা কি আপনি বিশ্বাস করেন, না আমাকে পাগল বলে আপনার বিশ্বাস হয়?”
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, “মনোরমা, যতক্ষণ না আমি ‘১৭–ক’ চিহ্নিত পুলিন্দার কোন সন্ধান ক’রে উঠতে পারি, ততক্ষণ আমি কিছুতেই তোমাকে বিশ্বাস করতে পারি না! মনে ঠিক দিয়ে রেখো, আমার নাম দেবেন্দ্রবিজয়।”
নবীনা সানয়নে নিতান্ত বিনীত বচনে বলিল, “মহাশয়কে আমার এ কাজের ভার দেবার আগে আর একটি কথা জানাতে চাই। প্রথমত—আমি এখন খুবই নিঃস্ব; আমার কাছে বেশি টাকা নাই—জোর এক শো কি আর দুই চারি টাকা বেশি হবে। আমি আপনাকে সত্যকথা বলছি, তাতে আমার কাজে যত্ন নিতে আপনার যে পরিশ্রম হবে, সেজন্য যথোপযুক্ত পারিশ্রমিক দিতে আমি একান্ত অক্ষম, যদি না—’
“যদি না কি?”
“যদি না আপনি ‘১৭–ক’ চিহ্নিত পুলিন্দা বের করতে পারেন?“
“কেন?”
“সেই পুলিন্দায় আমার বিষয় আমি ফিরে পাব—আমার বাবা মৃত্যুকালে—সে প্রায় আজ চার বছর হ’ল, আমার জন্য দুই-তিন লাখ টাকার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি রেখে গেছেন।”
“বটে? বোধ করি, তোমার মা’ও জীবিত নাই।”
“আজ দশ বছর হ’ল আমার মা মারা গেছেন; এখন আমার বয়স পঁচিশ বছর হবে।”
“তোমার এতদিন বিবাহ হয় নি কেন?”
“আমার. পিতা ব্রাহ্মধর্ম্মাবলম্বী; তাই তিনি বাল্যবিবাহের বড়ই বিরোধী ছিলেন। যখন তিনি মারা যান, তখন আমার বয়স একুশ বছর। তার পরেই আমি এই ষড়যন্ত্রে পড়ি। এ পৰ্য্যন্ত কবিরাজের বাড়িতে বন্দিনী হয়েছিলেম।”
“তোমার এই অতুল সম্পত্তিতে এখন তোমার মাস্তুত ভগিনী কুমুদিনী দখলীকার আছে, না সেই অজ্ঞাতকুলশীলা’ ৩ নং মেয়েটি দখলীকার আছে,—সে সম্বন্ধে কিছু আন্দাজ ক’রে বলতে পার?”
“না, তা’ আমি জানি না; আন্দাজ ক’রে বলার কোন উপায়ও নাই; তবে এইমাত্র বলতে পারি সেই দুইজনের একজন মরেছে, আর একজন আমার বিষয় ভোগ করছে।”
“বড়ই জটিল সমস্যা! তোমাদের বাড়ি কোথায়?”
“খিদিরপুরে—গঙ্গার ধারে— প্রাসাদতুল্য প্রকাণ্ড অট্টালিকা। চারিদিকে ফলফুলের বড় বড় বাগান; বাগানের চারিদিক পাঁচিলে ঘেরা। পাঁচিলের ধারে ধারে দেবদারু আর ঝাউগাছের শ্রেণি। বাবা সাধ করে বাড়িখানির নাম রেখেছিলেন, ‘আনন্দ-কুটীর’।”
“তোমাদের তিনটির মধ্যে যেটি ম’রে গেছে, সে বোধ হয়, তোমার ঐ ভগিনী কুমুদিনী; এখন এইরূপ অনুমানেই আমাকে কাজ চালাতে হবে। ভাল, তোমার ভগিনীর কতদিন মৃত্যু হয়েছে?”
“আমাকে পাগল ব’লে কবিরাজের হাতে দিবার দুই সপ্তাহ আগে।”
“কোথায় তার মৃত্যু হয়?”
“আনন্দ-কুটীরে।”
“কি ব্যারামে?”
“যে ব্যারামে রামগোলাম মরে।”
“একদিনের জ্বরে?”
“বিষে। যখন আমার ভগিনীর মৃত্যু হয়, তখন আমি খিদিরপুরে আমার বিষয়-সম্পত্তি উদ্ধারের চেষ্টা করছিলেম। আমাদের একজন উকিল আছেন; তিনি বাবার সমস্ত মামলা-মোকদ্দমা দেখতেন—আমি তাঁকে আমার বিষয়-সম্পত্তি উদ্ধারের জন্য সমস্ত কথাই বলি। তিনিও আমার কথায় দুঃখিত ভাব দেখান। আমাকে আশ্বস্ত ক’রে বলেন, তিনি আমার জন্য প্রাণপনে চেষ্টা দেখবেন। এমন কি তিনি যেন আমার জন্য স্বর্গ, মর্ত্য রসাতল এক করবেন—এমন ভাব প্রকাশ করেন। তারপর তিনিই আবার আমায় পাগল ব’লে কবিরাজকে দিয়ে কয়েদ করালেন।
“ওঃ! বুঝেছি, সেই উকিল তখন তোমার বিপক্ষের হাতগত। যাক্, ভাল, তার নামটি কি?”
“তুলসীদাস বসু।”
“তারও আমি সন্ধান করব; তোমাকে পাগল বলার বিশেষ কারণটা কি?”
“সে বিষয়ে বিশেষ কিছু আমি বলতে পারি না। জানি না, উকিল বাবু খানিকটা কাগজে ইংরাজীতে কি লিখে, সেগুলি আমার হাতে দিয়ে আমাকে আনন্দ-কুটীরে নিয়ে যেতে বলেন। বলেন, সেই সকল কাগজে আমার বিষয়-সম্পত্তির প্রমাণ সম্বন্ধে অনেক কথা আছে। আমি তাঁর কথামতই কাজ করি। সেই কাগজগুলি নিয়ে আনন্দ-কুটীরে দেখাতে সেখানকার সকলেই উপহাসের অট্টহাসি হেসে ওঠে।”
“তারপর?”
“তারপর আমার এ বিষয়ের বিচার হবে, এইরূপ স্থির হয়।”
“বিচার কোথায় হ’ল?”
“আনন্দ-কুটীরেই বিচারপতিকে আনা হয়েছিল।”
“মন্দ নয়, তোমার উকিলই তোমাকে এইরূপ বুঝিয়ে থাকবেন। লোকটা বড়ই প্রবঞ্চক প্রথম হ’তেই সে তোমার সঙ্গে বঞ্চনা আরম্ভ করেছিল—এখনও; তার পর বিচারে কি ফল হ’ল? ইতিমধ্যেই তোমাদের তিনটির একটির মৃত্যু হয়—সম্ভবতঃ সেটি তোমার ভগিনী কুমুদিনী?”
“হাঁ।”
“ভাল, তার পর?”
‘সেখানে দুই জন ভদ্রব্যক্তি ব’সে ছিলেন। আমি মনে করেছিলেম, তাঁরাই বিচারপতি; আমি তখন তাঁদিগকে আমার কথা বল্লেম। আমার উকিল সেখানে উপস্থিত ছিলেন, তিনি সেই অপরিচিত লোকদুটির কানে চুপি-চুপি কি বলেন। প্রথমে আমি ভেবেছিলেম, আমার অনুকূলে তিনি তাঁদিগকে কিছু বুঝিয়ে দিচ্ছেন। তখনই কিন্তু আমার সে-ভ্রম ঘুচ্ল; উকিলের শেষ কথাটি আমার কানে গেল— সে কথাটি হচ্ছে ‘বদ্ধ পাগল’। তাই শুনে আমার অন্তরাত্মা অবধি কেঁপে উঠল। তাই শুনে তাঁরা বললেন, ‘হাঁ পাগলই বটে।’ তখনই দুজনে দু’খানা কাগজে আমি যে পাগল এই কথা লিখে, নিজেদের নাম স্বাক্ষর ক’রে উকিলের হাতে দিলেন। এতক্ষণ আমি যাঁদিকে বিচারপতি মনে করেছিলেম, তাঁরা ত তা’ নন্—তারা দু’জন নামজাদা ডাক্তার—আমাকে পাগল সাব্যস্ত ক’রে গেলেন। আমার উকিলই আমার সবর্বনাশের মাত্রা বাড়িয়ে দিলেন।”
“তখন তোমাকে পাগল ব’লেই সাব্যস্ত করা হয়েছিল। ভাল, তার পর?”
“আমি কবিরাজের হাতে কয়েদ হলেম। যাকে আপনি আপাততঃ অপরিচিতা ব’লে ঠিক করেছেন, সেই হবে—সেই ৩ নং মেয়েটি আমারই বেশভূষায় সেজে আমারই নামে নিজেকে জাহির ক’রে যেন সে-ই নিজে আমিই হ’য়ে দেখা দিলে। নিতান্ত দয়াবতীর ন্যায় সে কবিরাজকে আমার ভরণপোষণ ও চিকিৎসার যা ব্যয় হবে, তা দিতে সম্মত হ’ল। আরও সে কবিরাজকে ব’লে দিলে, যেন আমাকে বিশেষ যত্ন ও সাবধানে রাখতে কোন প্রকার ত্রুটি না হয়। আমার অবস্থা দেখে সে বড়ই দুঃখ প্রকাশ করতে লাগল; আমার প্রকৃত নাম-ধাম অবগত হতে না পেরে সে যেন যথেষ্ট ব্যথিত হ’ল। এই প্রকারে যেন তার স্বভাবে কোন কলঙ্ক নাই—স্বভাবে সে যেন স্বর্গের দেবী, এমন ভাব দেখাতে লাগ্ল। তাতে তখন তথাকার সকলেই তার এই স্বার্থত্যাগে তাকে যথার্থই স্বর্গের দেবী বোধ ক’রেই হবে—স্তম্ভিত হ’য়ে গে’ল। তার ভাব দেখে, তার এই উদারতায় সেখানকার সকলেই তখন আমার উপর রাগান্বিত হ’য়ে উঠল। সকলেই একবাক্যে স্বীকার করলে আমি পাগল নই, জালিয়াৎ—জাল নাম নিয়ে বিষয় আত্মসাৎ করতে এসেছি; আমাকে চিকিৎসাধীনে রাখা অপেক্ষা জেলখানায় পাঠানো ভাল। তখন সেই অপরিচিতা ৩ নং মেয়েটি—কি ২ নং আমার ভগিনী কুমুদিনী—তা’ আমি ঠিক বলতে পারি না—বল্লে আমি যথার্থই পাগল; নতুবা আমার স্বভাব কখনই এত জঘন্য কিংবা কুচক্ৰময় হতে পারে না যে, এমনভাবে নাম জাল ক’রে তার বিষয় আত্মসাৎ করতে যাব; আমাকে চিকিৎসাধীনে রাখা কর্তব্য।”
“তখন তুমি তোমাদের সেই আনন্দ-কুটীরে তোমার আজন্ম-অবস্থিতির কোন প্রমাণ দেখাতে পার নি?”
“অনেক প্রমাণ আছে—দেখাতে পারতেম। তারা সে-কথা শুনলে না। এমন কি আমি তাদের এ কথাও বললেম যে, এ বাড়ির মধ্যে এমন একটা গুপ্তগৃহ আছে, তা’ কেউ জানে না—এমন কি ৩ নং মেয়েটি সেই অপরিচিতা—সেই গুপ্তগৃহে কোন্ পথে যেতে হয়, তাও জানে না। আমি সে ঘর জানি—দেখাতে পারি।”
“তাতে তারা সম্মত হয় নি? তোমাকে পাগল বলেই তখন স্থির করা হ’ল?”
“হাঁ, তখন নিজেকে পাগল ব’লে আমারও মনে হ’তে লাগল; সত্যই যেন লজ্জায় ঘৃণায় দুঃখে আমি পাগল হয়ে গেলেম—হতাশ হলেম না; অপরে—কোথাকার কে— আমার বাবার কষ্টোপার্জিত অতুল সম্পত্তি নিৰ্ব্বিবাদে, নির্ব্বিঘ্নে ভোগ করবে, এ কি আমার সহ্য হয়? যে কোন উপায়ে কখন-না-কখন প্রতিকার করতে হবে, এই প্রতিহিংসা মনে গেঁথে রেখে দিলেম। তার পর কবিরাজের হাত থেকে কোন সুযোগে পালিয়ে এসে আপনার শরণাপন্ন হয়েছি। আমি অনেকদিন থেকে আপনার নাম শুনে আছি, অনেক লোকের কাছে আপনার সুখ্যাতি শুনেছি; বাঙ্গার গোয়েন্দার মধ্যে আপনিই শ্রেষ্ঠ—আপনার নাম-যশ যথেষ্ট; আপনি ভিন্ন এ দুর্ঘটনায় আমাকে সাহায্য করতে পারে, এমন লোক দেখি না।”
“আমি তোমার কার্য্যেদ্ধারে প্রাণপণে চেষ্টা করব।”
(সানন্দে) “মহাশয়! আপনার এই আশ্বাসে আমার হৃদয় আশ্বস্ত হ’ল; কি ব’লে আমি আপনাকে আমার হৃদয়ের কৃতজ্ঞতা জানাব, জানি না।”
“পার—কিন্তু।”
“বলুন, কি উপায়ে আমার প্রাণের কৃতজ্ঞতা আপনাকে জানাতে পারি?”
“আমি যা’ আদেশ করব, ভাল-মন্দ কিছু বিবেচনা না করে তখনই তাতে সম্মত হবে।”
“এই মুহূৰ্ত্ত হ’তেই।”
“উত্তম, এখন আর কতকগুলি আমার প্রশ্ন আছে। ৩ নং মেয়েটি কি অবিবাহিতা?”
“তিন বৎসর আগে তাই ছিল। এখন কি হয়েছে, বলতে পারি না।”
“তোমার মাস্তুত ভগিনী?”
“তার বিবাহ হয় নি।”
“তোমার বাপ-মার সঙ্গে তোমার মাসী ও মেসো মহাশয়ের কখনও কোন সময়ে কোন বিবাদ- বিসংবাদ ঘটে?”
“সে সকল কথা আমি আপনাকে সংক্ষেপে এখন জানাতে পারি?”
“হাঁ, সে বিষয়টাও এখন থেকে শুনে রাখা আবশ্যক।”
“আমার বাবা খুব ধনী ছিলেন; কিন্তু কুমুদিনীর বাবা নিতান্ত গরীব ছিলেন। কুমুদিনীর মা, আর আমার মা উভয়ে যমজ বোন। যতদিন আমার মা বেঁচে ছিলেন, ততদিন কুমুদিনীর মা–যিনি আমার মাসীমা,—আমাদের বাড়িতেই থাকতেন। তখন আমার আর কুমুদিনীর বয়স বড় বেশি নয়—আট-নয় বৎসর হবে।”
“তখনও তোমাদের চেহারার কোন পার্থক্য ছিল না?”
“কিছুমাত্র না—মাসীমা আমাদের দুজনকে কিছুমাত্র ঠিক ক’রে চিনে উঠতে পারতেন না- সেজন্য আমার কপালে রোজ একটি ক’রে চন্দনের ফোঁটা দিয়ে দিতেন। যখন আমরা একই রকম বেশ-ভূষা করতেম, তখন বাড়ির চাকর-বাকরেরাও বিষম ফাঁপরে পড়ত।”
“একই প্রকার বেশ-ভূষা করবার কার বেশি ইচ্ছা ছিল—তোমার না কুমুদিনীর?”
“কুমুদিনীর। সে সদাসর্বদা আমার কাপড়-জামা পরত; কখন কখন আমার বেশ-ভূষার অনুরূপ বেশ-ভূষা তৈরি করাত।”
‘এরূক করবার কি কারণ ছিল?”
“কুমুদ ভারি আমুদে ছিল—আমোদ ছাড়া সে একদণ্ডও থাকত না; এমন কি চাকর-বাকরদের সঙ্গেও ফষ্টিনষ্টি করত; আমার বেশ-ভূষায় সেজে সদাসৰ্ব্বদা তাদের কাছে গিয়ে তাদের চমক্ লাগিয়ে দিত—কত হুকুমজারী করত!”
“এর ভিতরেও অনেক রহস্য আছে। থাক্, এখন আমি অনুমানে বুঝতে পারছি, সেই অপরিচিতা ৩ নং মেয়েটির মৃত্যু হয়েছে। আর যে তোমার এখন বিষয়-সম্পত্তি ভোগ দখল করছে, সে আর কেউ নয়, তোমার ভগিনী ২ নং মেয়েটি।”
চতুর্থ পরিচ্ছেদ – ঘটনা-প্রসঙ্গ : শেষাংশ
মনোরমা বলিতে লাগিল, “আমার বাবা আমাদের ঠিক চিনতে পারতেন—তাঁর একদিনও ভুল হয় নি। তিনি বলতেন, আমাদের আকৃতির পার্থক্য তিনি স্পষ্ট দেখতে পেতেন।”
এই বলিয়া মনোরমা কিয়ৎক্ষণ নীরবে রহিল। কি ভাবিল; একটু ইতস্ততঃ করিয়া বলিল, “একদিন বাবা আমাকে নিৰ্জ্জনে ডেকে বললেন, ‘কুমুদিনীর এ রকম আমোদ বড় ভাল বোধ হয় না। আমি একটা বন্দোবস্ত করেছি, তাতে তোমাদের মধ্যে আর কোন ভুল হবার সম্ভাবনা থাকবে না। আমি বাড়ির ঝি-চাকর সকলকে ব’লে দিয়েছি, তুমি যখন তাদের কোন হুকুম করতে যাবে, তখন তুমি তা’দিগকে এই আংটিটি দেখাবে। এটি তোমার ডান হাতে সর্ব্বদা রাখবে।’ এই কথা ব’লে তিনি আমার হাতে একটি সুন্দর সোনার আংটি পরিয়ে দিলেন; তাতে নানা প্রকার ফুললতা- মোড়ের কারুকাজ ছিল। সেই আংটিটির জন্যই আবার আমাদের একান্ত অনুগত রামগোলাম প্রবঞ্চিত হয়েছিল।”
দেবেন্দ্রবিজয় জিজ্ঞাসিলেন, “ওঃ! তবে তুমি আংটিটি হারিয়েছ না কি?”
মনোরমা কহিল, “হ্যাঁ।”
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, “কিরূপে হারালে?”
মনোরমা বলিল, “তা’ জানি না—বড়ই আশ্চর্য্যরূপে সেটি চুরি গিয়েছে। আমার বিশ্বাস, আমি ঘুমা’লে আমাদের ঝি আমার হাত থেকে খুলে নিয়েছিল।”
দেবেন্দ্রবিজয় একটু ভাবিয়া কহিলেন, “নিঃসন্দেহ। আংটিটি কি প্রকার, বল দেখি?”
মনোরমা বলিল, “আংটিটি সোনার, তাতে যে লতা-পাতা ও মোড়ের কাজ ছিল—তা ও সোনার; কেবল মধ্যে মধ্যে রূপার ছোট ছোট তারাফুল, সেই তারাফুলের মাঝে মাঝে এক-একটি হীরা বসানো, মাঝখানে একখানি কী পাথর ছিল, তার উপরে “ওঁ” লেখা ছিল। বাবা যখন সেটি আমার হাতে পরিয়ে দিচ্ছিলেন, তখন বললেন, সেই আংটির একটি অদ্ভুত গুণ আছে; যার অধিকারে সেটা থাকবে, সে অতুল ঐশ্বর্য্যের অধিপতি হবে—যে একবার হাতে ধারণ ক’রে তা পরিত্যাগ করবে, তার দুর্দ্দশা ও দারিদ্র্যের সীমা থাকবে না। বাবা আমাকে আজীবন সেই আংটিটি বিশেষ সাবধানে ও সযত্নে রাখতে বলেন।”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “তোমার অবস্থার পরিবর্ত্তন দেখে তোমার বাবার সেই কথা এখন সত্য বলেই মনে হচ্ছে।”
মনোরমা বলিল, “তিনি অনেকদিন আগে একবার অযোধ্যায় গিয়েছিলেন। সেখানকার একজন জ্যোতিষী তাঁকে সেই আংটির মাঝের পাথরটি দিয়েছিেেলন। আমি বাবাকে কতবার সেই আংটির সম্বন্ধে অনেক কথা জিজ্ঞাসা করেছি—তিনি আমাকে কিছু বলেন নাই। তারপর আমার ভগিনী কুমুদিনী বুঝতে পারে, তাতে-আমাতে কোন বিষয়ে কিছু পার্থক্য ঘটেছে। আর সে কোন রকমে ভৃত্যদের চমক লাগাতে পারত না। এই পরিবর্তনের রহস্য সে উদ্ভেদ করবার জন্য অনেক চেষ্টা পেয়েছিল, কিছুতেই পেরে উঠে নি। আমার মায়ের মৃত্যুর পর বাবা আমাকে সঙ্গে নিয়ে দিল্লিতে যান; তখন আমার মাসী কুমুদিনীকে নিয়ে আমাদের আনন্দ-কুটীরেই ছিলেন। আমরা প্রায় দু’বছর দিল্লিতে ছিলাম। বোধ করি, আমাদের এই দীর্ঘকাল বিদেশে থাকার মধ্যে কুমুদিনী আমার সেই দৈব অঙ্গুরীর রহস্যোদ্ভেদ ক’রে থাকবে। আমাদের পারিবারিক কোন বিবাদ-বিসংবাদের কোন কারণ আমি জানতেম না। দিল্লি থেকে ফিরে আসবার এক বছর পরে আমার বাবা মেসো মহাশয়কে আমাদের আনন্দ-কুটীর পরিত্যাগ করতে আদেশ করেন। আমার বাবা বড় কড়া- মেজাজের লোক ছিলেন, কারও কথা শুনতেন না; মুখ থেকে একবার যে-কথা বার করতেন, সে কথার তিলাংশ ব্যতিক্রম করবার শক্তি কারও ছিল না। তার পর কুমুদিনীর বাবা যখন সপরিবারে আমাদের আনন্দ-কুটীর ত্যাগ ক’রে যান, তখন আমি বড় ব্যথিত হলেম। কি করব, উপায় নাই— সেইদিন থেকে কুমুদিনীর সঙ্গে আমার বড় দেখা-শুনা ঘটত না। তারপর দুই বছর পরে কুমুদিনীর বাবার মৃত্যু হয়, আমার বাবার মৃত্যুর কয়েকমাস আগে আমার মাসীমার মৃত্যু হয়।”
ক্ষণকাল চিন্তার পর দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “মনোরমা, তোমার বিষয় পরহস্তগত হবার প্রথম ঘটনা কি এখন বল দেখি; তা’ ত তুমি জান—বিষয়াধিকার সম্বন্ধে আইনের বিশেষ বাঁধাবাঁধি বিশেষত সম্পত্তি বড় অল্প নয়—দুই তিন লক্ষ টাকার; তাতে তুমি কি প্রকারে বঞ্চিত হলে?”
ম। বড়ই সহজে—সে কথা বড়ই বিস্ময়জনক। সাহানগরে আমাদের একজন কুটুম্বের বাড়িতে বিবাহোপলক্ষে আমি একদিন নিমন্ত্রণ-রক্ষা করতে যাই।
দে। থাম একটু—একটা কথা জিজ্ঞাসা করবার আছে। তখন তোমার ভগিনী কুমুদিনী কোথায় ছিল?
ম। তা’ জানি না। তাদের বাড়ি চেলায়—গোপাল-নগরে। তাদিগে নিমন্ত্রণ করা হয়েছিল কি না, তা’ জানি না।
দে। যে কুটুম্বের বাড়িতে তুমি নিমন্ত্রণ রাখতে যাও, তাদের অবস্থা কেমন?
ম। খুব বড়লোক—সেখানে আমি তিন দিন থাকি। যেদিন তাদের বাড়িতে ফুলশয্যার হাঙ্গাম, সেইদিন একটি লোক আমার কাছে একখানা পত্র নিয়ে আসে। সেই পত্রে লেখা ছিল, আমার বাবার পুরানো একজন চাকরের বড় ব্যারাম, জীবনের আশা নাই; মৃত্যুর পূর্ব্বে সে একবার আমার সঙ্গে দেখা করতে চায়—তার বাড়ি বকুল বাগানে। আমি সেইদিন ফিরব স্থির ক’রে তখনই তার সঙ্গে দেখা করতে যাই।
দে। সেইদিনে কি ফিরতে পার নি?
ম। না, আমি দেখলেম, লোকটার অবস্থা অতিশয় শোচনীয়। সেদিন আমি সেখানে তার অন্তিম অনুরোধে থেকে গেলেম। পরদিন সাহানগরে আমি সেই কুটুম্বের বাড়িতে উপস্থিত হলেম।
দে। তুমি একাকী গিয়েছিলে?
ম। হাঁ।
দে। কাজটা বড়ই অন্যায় হয়েছে।
ম। তা ঠিক্, সেইজন্যই আমি আজ পথের ভিখারিণী। যখন আমি সেই কুটুম্বের বাড়িতে ফিরে আসি, তখন বেলা তিনটা হবে, কারও সঙ্গে কোন কথা না ক’য়ে, যে ঘর আমার জন্য নির্দ্দিষ্ট ছিল, সেই ঘরে তাড়াতাড়ি আমাদের ঝিয়ের সঙ্গে দেখা করতে গেলেম।
দে। দেখা হয় নি কেমন?
ম। না, যা’ দেখলেম, বড়ই আশ্চর্য্য ব্যাপার; সেই ঘরে অন্য একজন ভদ্রমহিলাকে ব’সে থাকতে দেখলেম। পূর্ব্বে তাঁকে আমি কখন দেখি নি। বুঝলেম, আমারই ভ্রম হয়েছে; যা’ই হ’ক, তখন আমি তাড়াতাড়ি সেই ঘর থেকে বাহিরে এলেম। কিন্তু আমার ভ্রম হয় নি, আমাদের ঘরের বাহিরে দরজার উপরে একখানা রাধাকৃষ্ণের ‘যুগল মিলন’ ছবি ছিল; ঘরের বাহিরে আসামাত্র সেই ছবিখানা দেখতে পেলেম—সন্দেহ ঘুচল। কয়েক মুহূর্তের জন্য আমি একেবারে হতভম্ব হয়ে সেখানে দাঁড়ালেম। মনে ভাবলেম, হয় ত ঝি আমাদের জিনিষ-পত্র নিয়ে বাড়ি চ’লে গেছে; আমাকে ফুলশয্যার দিনে না ফিরতে দেখে মনে ক’রে থাকবে, যে আমি বকুল-বাগান থেকে বরাবর খিদিরপুরে নিজেদের বাড়িতে চ’লে গেছি। বাড়ির কর্তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেম। তাঁকে সব কথা বললেম; তিনি আমাকে চিনতে পারলেন না। আমার কথা ভাল রকমে বুঝতে পারলেন না—আশ্চর্যান্বিত হলেম; বললেন, আমি নাকি ফুলশয্যার দিনেই বকুল-বাগান থেকে ফিরেছিলেম; আমার প্রয়োজনীয় সামগ্রীপত্র নিয়ে ঝিয়ের সঙ্গে সেই রাত্রেই পাল্কী ক’রে খিদিরপুরে চ’লে গিয়েছি।
দে। এ কথা শুনে তখন তুমি নিতান্ত বিস্মিত হয়েছিলে?
ম। যতদূর হ’তে হয় হয়েছিলেম। আরও বুঝলেম, এটা আর কিছু নয়, আমাকে বিপদে ফোর একটা আয়োজন হচ্ছে। মনে মনে অত্যন্ত ভয় হ’ল—রাগও হ’ল।
দে। তখন তুমি কি করলে?
ম। খিদিরপুরে আমাদের আনন্দ-কুটীরে উপস্থিত হলেম।
দে। সেখানে উপস্থিত হয়েও দেখলে যে, কুমুদিনী তোমার অজ্ঞাতে মনোরমা হয়েছে? আর তুমিই তোমার মাসতুতু ভগিনী মাতৃপিতৃহীনা অনাথা কুমুদিনী?
ম। আপনি ঠিক বলেছেন।
দে। তোমাকে আনন্দ-কুটীরে প্রবেশ করতে দিয়েছিল? কার সঙ্গে আগে দেখা হ’ল?
ম। রামগোলামের সঙ্গে। কুমুদিনী যখন ছোট—তখন থেকে রামগোলাম তাকে ঘৃণা করত; তখন সে আমাকেই কুমুদিনী ব’লে স্থির করলে—কুমুদিনী ব’লে আমাকে ডাকতে লাগল। তখন আমি তাকে আমার সেই আংটি দেখাতে গেলেম; সর্ব্বনাশ! দেখলেম, আমার হাতে সেটি নাই—চুরি গে’ছে।
দে। আর কখনও তুমি সে আংটি হারাও নি?
ম। না।
দে। তখন তুমি তোমার ভগিনী কুমুদিনীকে ডাকিয়ে পাঠিয়েছিলে?
ম। না, আমি নিজেই তখন তার সঙ্গে দেখা করবার জন্য অন্দরমহলের দিকে এগিয়ে গেলেম; রামগোলাম আমাকে বাধা দিল। আমাকে বাহির-বাড়িতে রেখে অন্দরমহলের দরজা বন্ধ করল। সে অম্লানবদনে বলল, আমাকে বাড়ির মধ্যে যেতে দিবে না, তখন আমি ঘৃণায়, দুঃখে জ্ঞানশূন্য হ’য়ে পড়লেম।
দে। তখন তোমার ভগিনী কুমুদিনী তোমার সঙ্গে দেখা করেছিল?
ম। না, রামগোলাম কিছু পরে ফিরে এসে বললে, সে তখন আমার সঙ্গে দেখা করতে রাজী নয়।
দে। তার পর তুমি কি করলে?
ম। রামগোলামের সঙ্গে অনর্থক অনেক বাদানুবাদ করতে লাগলেম।
দে। তুমি যে নিজে মনোরমা—তার মনিব, এ কথা তাকে কোন প্রকারে বুঝাতে পার নি? ম। কোন প্রকারেই না!
দে। তখন রামগোলাম তোমাকে কি বললে?
ম। সে আগে শান্তভাবে আমার সকল কথা শুনতে লাগল; তার পর সে বিষম রেগে উঠল; রেগে-রেগেই বললে, ‘কুমুদ, তুমি আমার কাছে চালাকি ক’রে উড়ে যেতে পারবে না; আমার নাম রামগোলাম, আমার কাছে জারিজুরি খাবে না। মনোরমা দিদিমণির কাছে শুনেছি—বার বার তুমি অনেক জায়গায়—অনেক লোকের কাছে নিজেকে মনোরমা দিদি ব’লে বড় চালাকি ক’রে বেড়াও; আমার কাছে কিছুতে তা’ পারবে না। স’রে পড়—পথ দেখ—তোমাকে বাড়ির ভিতরে যেতে দিতে দিদিমণির হুকুম নাই। তার কথা শুনে আমি বড়ই ব্যাকুল হলেম—হতবুদ্ধি হ’য়ে পড়লেম। কি করব—উপায় কি, সেই অপরিচিতা ৩ নং মেয়েটাকেই হ’ক্—কি আমার ভগিনী কুমদিনীকে হ’ক্—আমার রাজত্ব ভোগদখল করতে দিয়ে, রাজ-সিংহাসনে বসিয়ে আমি সেখান থেকে চ’লে এলেম।
দে। এ ঘটনার কতদিন আগে তুমি ভূকৈলাসে অপরিচিতা সেই ৩ নং মেয়েটিকে দেখ?
ম। মাস-কতক হবে।
দে। সে কি তখন তোমাকে তোমার ভগিনী কুমুদিনী ব’লে নিজের পরিচয় দিয়েছিল? ম। হাঁ।
দে। সে তোমার ভগিনী কি না, তাই পরীক্ষা করবার জন্যই পীড়িতা কুমুদিনী বাড়িতে আছে কি না, দেখতে রামগোলামকে সেখানে পাঠাও?
ম। হাঁ।
দে। সে ফিরে এসে কুমুদিনী যে বাড়িতে আছে, এ কথা স্বীকার করে? সেই বাড়িতে গিয়ে কুমুদিনীকে তুমি স্বচক্ষে দেখে এসেছিলে?
ম। স্বচক্ষে।
দে। রামগোলামের প্রভুভক্তি সম্বন্ধে তোমার কখনও কোন সন্দেহ হয়েছিল?
ম। না, কখনই না—তার প্রভুভক্তিতেই শেষে সে নিজের প্রাণ পর্য্যন্ত হারিয়েছে।
দে। যখন রামগোলাম তোমাদের বাড়ি থেকে খিদিরপুরে ফিরে আসে, তখন যে তোমাকে তোমার ভগিনী ব’লে পরিচয় দেয়, আর সেই ৩ নং মেয়েটিকে জাল বলে, তখন কি তুমি তা বেশ বুঝতে পেরেছিলে? তখন তুমি কি করলে?
ম। আমি সেই জাল মেয়েটিকে নিজের কাছে ডাকিয়ে পাঠাই; কিন্তু সে বড় শক্ত মেয়ে। সে যে জালিয়াৎ, তখন আমি তার মুখের উপরে বললেম; তাতে সে আমার মুখের দিকে চেয়ে কেবল একবার হাসলে মাত্র। আমি রামগোলামকে ডেকে সে কথা প্রমাণ করলেম, তাতে তার দিকেও চেয়ে সে হেসে উঠল।
দে। এই হাসিই বুঝি তার উত্তর?
ম। হাঁ, শুধু হাসি।
দে। সে হাসি এখন বড় ভয়ানক হয়ে দাঁড়াচ্ছে, দেখছি।
ম। হাঁ, সাংঘাতিক।
দে। তার পর ব্যাপার কি প্রকার দাঁড়াল? সে কোন কথার কিছু উত্তর করে নি?
ম। করেছিল; বললে, ‘দিদি তুমি আজ আমায় এমন কথা বললে, আমি জালিয়াৎ! বটে! রামগোলামের কথায় তুমি আমায় এখন জালিয়াৎ স্থির করেছ। আজ তুমি রাজরাণী—অদৃষ্টের দোষে আজ আমি ভিখারিণী; আবার আমাদের সদ্ভাব থাকবে কেন? ছেলেবেলার সে খেলাধূলা তুমি যে তা ভুলে যাবে, তার আর আশ্চর্য্য কি! তবে এই দুঃখ, তুমিই এ জগতে আমার একমাত্র আপনার লোক আছ—তাই ভেবে মনে যে সুখটুকু ছিল, আজ সে সুখও ঘুল
দে। তোমাদের তিনজনের রূপের এরূপ সাদৃশ্য বড়ই চমৎকার। ভাল, তার কথা শুনে রামগোলাম কি বললে?
ম। প্রথমত সে বড়ই রেগে উঠেছিল। যতক্ষণ না সেই জালিয়াৎ মেয়েটা চ’লে গে’ল, ততক্ষণ আমার কথায় রামগোলাম চুপ করেছিল। তারপর আমাকে বললে, “দিদিমণি, যদি তুমি আমায় সেই রাগের মাথায় আমাকে কোন কথা কইতে মানা না করতে, ঐ জালিয়াৎ বেটিকে আচ্ছা রকম মজা দেখিয়ে দিতেম—এইখানে নিকেশ করতেম, তারপর ফাঁসী যেতে হয় যেতেম—দুঃখ ছিল না।’ আমি তাকে বললেম, ‘এত রাগ কেন?’ সে বললে ‘কে’ন? তুমি কী জান, দিদিমণি! আমি ঠিক বুঝেছি, তোমাকেই লক্ষ্য ক’রে সেই মেয়েটা আর সেই কুমি দুজনে মিলে একটা ষড়যন্ত্র করছে।
দে। রামগোলাম বুদ্ধিমান ছিল বটে।
ম। তারপর আমি রামগোলামকে তখনকার মত সে কথা একেবারে ছেড়ে দিতে বললেম।
দে। যাদের বাড়িতে এ কাণ্ড হয়, তাদের কাউকেও তুমি একথা জানিয়েছিলে?
ম। না, এ বিষয়ের বিন্দুবিসর্গও আমি কারও কাছে তখন প্রকাশ করি নি।
দে। মনোরমা, তোমার উপর লক্ষ্য ক’রে যে একটা ভীষণ ষড়যন্ত্র চলছে, এইটিই তার উপক্রমণিকা—এখন তাদের সে ষড়যন্ত্র সফল হয়েছে। তাদের দুটির মধ্যে একটির মৃগীরোগে মৃত্যু হয়েছে। তোমার ভগিনী কুমুদিনী আর সেই ৩ নং মেয়েটি এক সঙ্গে মিলে তোমার বিরুদ্ধে এই সকল মন্ত্রণা ক’রে থাকবে। তাদের এই মন্ত্রণার ফল দুজনে ভোগ করতে স্বীকৃত হয়; কিন্তু তাদের দুজনের মধ্যে একজন নিশ্চয় কিছু বেশি সাহসী, চতুর; সেই নিজেই সমস্ত নিজের অধিকারে নেবার জন্য বোধ হয়, একটিকে হত্যা করেছে। তারা ইতিপূর্ব্বে বুঝতে পারে যে, রামগোলাম তাদের চাতুরী বুঝতে পেরেছে; সেইজন্য তাকেও তারা খুন করে।
ম। হাঁ, আমারও তাই মনে হয়।
দে। পাপ পাপের অনুসরণ করে। একটা পাপ করলে পাপীকে সে পাপ গোপন করবার জন্য তার চেয়ে ভীষণ পাপকার্য্যে প্রবৃত্ত হ’তে হয়; সেই পাপের মাত্রা বয়সের সঙ্গে ক্রমশঃ বৃদ্ধি পায়। এখন বেশ বুঝতে পারছি, যে হাত রামগোলামের লোকান্তর ঘটিয়েছে, সেই হাতই কুমুদিনী প্রকাশে যে মেয়েটি মারা গেছে—সেই কুমুদিনীকে হ’ক, কিংবা সেই অপরিচিতা ৩ নং মেয়েটিকেই হ’ক, চিতার বুকে তুলে দিয়েছে। সেই নরনারীহন্ত্রী তার কুমন্ত্রণার অংশভাগিনীকে লোকান্তরে পাঠিয়ে নিজের সুখসম্ভোগের পথ পরিষ্কার করেছে। আমি অনেকবার অনেক লোকের অনেক রহস্যময় ঘটনা হাতে নিয়েছি; ঘটনার রহস্যোদ্ভেদেও সক্ষম হয়েছি; কিন্তু তোমার এ ঘটনা আজ আমার কাছে সম্পূর্ণরূপে নূতন ব’লে বোধ হচ্ছে। এরূপ ঘটনা এ পর্যন্ত শোনা দূরে থাক, আমার কল্পনায়ও কখনও প্রকাশ পায় নি। তোমার মুখে যেরূপ শুনলেম, তাতে আমাকে স্তম্ভিত হ’তে হয়েছে।
ম। হাঁ, বড়ই আশ্চর্য্য ব্যাপার, বড়ই রহস্যপূর্ণ।
দে। এখন সেই সকল রহস্যোদ্ভেদ আমাকে করতে হবে।
ম। হাঁ, আমিও আপনার কাছে সেই আশা ক’রেই এসেছি।
দে। সফল হ’ব, আমি কৃতকাৰ্য্য হ’ব—যদি আমার নাম দেবেন্দ্রবিজয় মিত্র হয়, কখনই আমি অকৃতকাৰ্য্য হ’ব না।
ম। আপনার কথায় আমার মনে আশার সঞ্চার হচ্ছে।
দে। এখন আমাদের আর একটি বিষয়ে লক্ষ্য রাখতে হবে।
ম। কি বিষয়ে বলুন?
দে। তোমার বিপদ এখন পদে পদে—আসন্ন, জানো তুমি?
ম। যা’ বিপদ ঘটবার তা’ ঘটেছে; আবার কি ঘটবে?
দে। শোন, তুমি যে পালিয়ে এসেছ, এ কথা এখন প্রকাশ পেয়েছে; তোমাকে আবার আটক করবার জন্য তারা সকল স্থানেই তোমার সন্ধান করছে—কি শীঘ্রই করবে। যদি আবার তারা তোমার সন্ধান পায়, তখন তোমার যে কী বিপদ ঘটবে—বুঝতে পারছ কি?
ম। না, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
দে। আমি তা’ বুঝেছি; তোমার জন্য যে ফাঁদ পাতা হয়েছে, সে ফাঁদে যদি আবার কোনক্রমে পড়, এবার তোমার আর নিস্তারের আশামাত্র থাকবে না। তুমি এখন নিজেকে নিরাপদ রাখতে কোন উপায় স্থির করেছ কি?
ম। কিছুই না—উপায় আর কি? মনে করেছি, এখন এমনিভাবে বাইরে বাইরে থাকব।
দে। এ কোন কাজের কথা নয়; তোমার সমর্থ বয়স, সুন্দরী তুমি; তাতে তোমার বিপদ আছে, সে বিপদ ভয়ানক, তুমি যে তা’ না জান, তা নয়; বিশেষত তুমি শীঘ্রই ধরা পড়বে, হয় কবিরাজের হাতে পড়বে—নয় যমের হাতে যাবে।
ম। যমের হাতে যাওয়াই এখন আমার পক্ষে সদুপায়।
দে। কারও হাতে যেতে হবে না। এক উপায় আছে, স্মরণ ক’রে দে’খ, তুমি এই অল্পক্ষণ পূর্ব্বে আমার কাছে স্বীকার করেছ, তোমার এই বিপদুদ্ধারে আমি নিযুক্ত হ’লে তুমি আমার সকল আদেশ পালন করবে। বেশ, এখন আমার প্রথম অনুমতি—আমার বিনানুমতিতে তুমি আমার বাড়ি ত্যাগ ক’রে যেতে পারবে না।
ম। এ ত আমার সৌভাগ্যের কথা; আমি সানন্দে সম্মত হলেম।
দে। হাঁ, আমার স্ত্রীর কাছে থাকবে; তিনি তোমাকে যত্নেই রাখবেন—আত্মীয়-জ্ঞানে স্নেহ করবেন। তুমি সঙ্গে কোন জিনিষ-পত্র এনেছ?
ম। হাঁ, একটা কাপড়ের বুচকী!
দে কোথায় সেটা?
ম। কালীঘাটে এক পূজারীর বাড়িতে রেখে এসেছি; দু-তিন দিন আমি অনাহারে ছিলাম। এখানে আমার আত্মীয় কেউই নাই—কার কাছেই বা যাব? সেইখানেই আজ সকালে আহার করি।
দে। সেই বুচকীতে কোন মূল্যবান সামগ্রী আছে?
ম। না, কিছুই না।
দে। তবে সেটাকে আর আনবার দরকার নাই, সেইখানেই থাক। তোমার প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি আমাদের এখানেই পাবে। যতদিন তুমি তোমার নিজের কার্য্যোদ্ধার করতে না পার, ততদিন তোমার যা’তে এখানে কোন অভাব না ঘটে, আমরা সে বন্দোবস্ত করব। এখন বুচকী না নিয়ে আসা মঙ্গল। তোমার শত্রুরা বোধ করি, তোমার সন্ধানে চারিদিকে গোপনে ঘুরছে। হয় ত তাদের কেউ তোমার সে কুঁচকীর সন্ধান এতক্ষণ পেয়ে থাকবে। বুচকী সেখানে পড়ে থাকবে, অথচ যদি তুমি সেখানে আর না যাও, তা’ হ’লে তোমার শত্রুদের মনে এমন ধারণা হ’তে পারে যে, হয় ত তোমার প্রাণের উপরে কোন বিপদ ঘটেছে। বুঝেছ—আমার অভিপ্রায় কি বুঝেছ? আরও একটা কথা হচ্ছে; সেই কথাটি শেষ হ’লে, আমার স্ত্রীকে ডেকে তোমায় যত্নে রাখতে বলে দেবো। ১৭–ক নং পুলিন্দার কি রকম প্রমাণাদি সংগ্রহ আছে, তা’ তুমি কিছু আন্দাজ ক’রে বলতে পার?
ম। না—কিছুই না।
দেবেন্দ্রবিজয় পত্নীকে গৃহ-মধ্যে ডাকিলেন। সে আসিয়া উপস্থিত হইলে বলিলেন, “এই মেয়েটিকে তুমি নিজের ভগিনী-বোধে যত্ন করে রাখবে।”
পরিহাসপ্রিয়া রেবতী সহাস্যে বলিল, “আপনি তা’ হলে এ মেয়েটিকে কি বোধে যত্ন করবেন?”
দেবেন্দ্রবিজয় ঈষদ্ধাস্যে বলিলেন, “কেবল তোমার তামাসা! যত বয়স বাড়ছে—ততই তুমি ছেলেমানুষ হচ্ছ। না হয়, আমারই ভগিনী বোধে তুমি একে যত্ন করো।”
রে। যে আজ্ঞা, মহারাজ! — থুড়ি ওঁ—শ্রীবিষ্ণু—শিব—গোয়েন্দা-রাজ!
দে। এখন পরিহাস ছাড় দেখি—শচীন্দ্র কোথায়?
রে। এতক্ষণ সে ত আমার কাছেই দাঁড়িয়ে বিশেষ মনোযোগে আপনাদের কথাবার্তা শুনছিল, এইমাত্র বা’র-বাড়িতে গে’ল।
পঞ্চম পরিচ্ছেদ : পরামর্শ
শচীন্দ্র দেবেন্দ্রবিজয়ের ভাগিনেয়—কার্য্যে সহকারী; বয়স উনিশ বৎসর মাত্র। বহির্ব্বাটীতে আসিয়া দেবেন্দ্রবিজয় তাহার সহিত দেখা করিলেন। জিজ্ঞাসিলেন, “শচীন্দ্র, ব্যাপার কি বুঝেছ? সকল কথা শুনেছ?”
শ। শুনেছি—অনেকটাও বুঝেছি।
দে। কি বুঝলে বল দেখি?
শ। বড়ই আশ্চৰ্য্য ব্যাপার!
দে। সত্য; কিন্তু মনোরমাকে কি পাগল ব’লে তোমার বিশ্বাস হয়?
শ। হাঁ—আমার মত পাগল।
দে। আচ্ছা, খিদিরপুরে আনন্দ-কুটীরে কে এখন রাজত্ব করছে? মনোরমার ভগিনী কুমুদিনী— না সেই অপরিচিতা—কি বোধ কর?
শ। সেই ত বিষম সমস্যা।
দে। সমস্যা হতে পারে, আমার কাছেও তাই বটে। ভাল, আমি প্রকারান্তরে তোমায় একটি কথা জিজ্ঞাসা করব।
শ। করুন?
দে। তিনজনের মধ্যে যার মৃত্যু হয়েছে— সে কি কুমুদিনী, না সেই অপরিচিতা?
শ। সেই ত বিষম সমস্যা।
দে। বিষয়-প্রয়োগ-সম্বন্ধে কি বোধ কর?
শ। মনোরমা ঠিক বিবেচনা করেছে।
দে। আমিও তাই মনে করেছিলাম— তোমার আমার মতে এটা একই রকম ঠিক দাঁড়াচ্ছে। যাই হ’ক, কোন্ ডাক্তার রামগোলামের আর সেই মেয়েটির চিকিৎসা করেছিল, এখন সেই সন্ধান নিতে হবে।
শ। সেই ভাল।
দে। এখন আমি তোমাকেই সেই ভার দিলেম, চেষ্টা করো—কাল সন্ধ্যার পরে আনন্দ- কুটীরে আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ ক’রো।
শ। আচ্ছা।
অল্পক্ষণ পরে শচীন্দ্র একখানি অতি মলিন, ছিন্নবস্ত্র পরিধান করিয়া পশ্চিমদেশবাসীর রূপ ধারণ করিল। নিজে নিজের নাম গ্রহণ করিল, “বোলাকীলাল”—কার্য্যে বাহির হইল।
দেবেন্দ্রবিজয় অর্দ্ধ-বৃদ্ধ চাষার ছদ্মবেশে সাজিলেন; এবং উকিল তুলসীদাস বসুর গৃহাভিমুখে চলিলেন।