নগ্ন ঈশ্বর – এক
শেষ রাতে তুষারঝড়ে পড়ে জাহাজ বন্দর ধরছে।
প্রায় মাসখানেক পর জাহাজ এবং জাহাজিরা লেগুনের মুখে বন্দরের আলো দেখতে পেল।
আর তুষারঝড়ের জন্য জাহাজিরা রেনকোট গায়ে ডেকের উপর ছুটোছুটি করছে, ওরা দড়িদড়া ফেলে দিচ্ছে নিচে। জেটিবয় সেই সব দড়িদড়া অথবা হাসিলের সাহায্যে জাহাজ বন্দরে বাঁধছে। মেজ মালোমকে ক্লান্ত মনে হচ্ছে না—তিনি দু’হাত তুলে বিচিত্র এক ভঙ্গিতে ডেক—জাহাজিদের দড়িদড়া হাপিজ অথবা হাড়িয়া করতে নির্দেশ দিচ্ছিলেন।
তখন জাহাজের পাঁচ নম্বর সাব অবনীভূষণ পোর্টহোলে উঁকি দিল। শেষরাতে জাহাজ বন্দর ধরছে, জাহাজ সেই কবে পূর্ব আফ্রিকার উপকূল থেকে নোঙর তুলে সমুদ্রে ভেসেছিল, কবে কোন এক দীর্ঘ অতীতে যেন। তারা বন্দর ফেলে শুধু সমুদ্র এবং সমুদ্রে ভাসমান দ্বীপ—বালির অথবা পাথরের জনমানবহীন দ্বীপ দেখেছে। তারা সেই দ্বীপের ঝাউগাছ এবং অপরিচিত গাছগাছালি দেখে চিৎকার করার সময় মনে করত—জাহাজ বুঝি আর কোনোদিনও বন্দর ধরবে না। শুধু সমুদ্র, এবং নীল জল, নীল আকাশ আর হয়তো ক্বচিৎ কোথাও সমুদ্রের চিড়িয়াপাখি—দূরে কখনও ডলফিনের ঝাঁক….। পাঁচ নম্বর সাবের মনে হত জাহাজ ওদের নিয়ে অন্তহীন এক সমুদ্রে যাত্রা করেছে। ওরা বন্দরে কোনোদিন পৌঁছাতে পারবে না, জাহাজ ওদের সঙ্গে তঞ্চকতা করছে।
সুতরাং এই তুষারঝড়ের ভিতরও জাহাজিদের প্রাণে উল্লাসের অন্ত ছিল না। মেজ মালোম প্রায় ছুটে ছুটে কাজ করতে জাহাজিদের উৎসাহ দিচ্ছিলেন। সামনে পাহাড়, আলো, মাটি এবং মানুষের বসতি। ওখানে কোথাও রমণীদের গৃহ আছে। মেজ মালোম উত্তেজনায় রা রা করে গান গাইতে থাকলেন। তুষারঝড়ের জন্য ওঁর কণ্ঠ ভয়ংকর কঠিন মনে হচ্ছিল আর তুষারঝড়ের জন্য সব পোর্টহোল বন্ধ। কাচের ভিতর থেকে এখন অন্যান্য জাহাজিরা বন্দর দেখছে। বন্দরটা ছোট অথচ খুব সুন্দর মনে হচ্ছিল। ক্রমশ আলো ফুটছে, ক্রমশ তুষারঝড় কমে আসছিল। আর এক এক করে সব আলো পথের এবং জেটির এক সময় নিবে যেতে থাকল। দূরের গির্জায় তখন ঘণ্টা বাজছে, জাহাজিরা সকলে ডেকের উপর উঠে এল এবং সকলে রেলিঙে ঝুঁকে পড়ছে। আবেগে উত্তেজনায় জাহাজিরা বন্দরের সকল ঘাস মাটি ফুলকে ভালোবাসার কথা জানাল।
বন্দরের প্রথম দিন এবং রবিবার। জাহাজিদের ছুটির দিন। ওরা হইহই করে আকাশ পরিষ্কার হলেই বন্দরে নেমে যাবে। শুধু তুষারঝড়ের জন্য ওরা বিরক্ত। জাহাজের পাঁচ নম্বর সাব অবনীভূষণ পোর্টহোলে বারংবার হাত রেখে ঝড়ের সঙ্গে তুষারকণা পরখ করছিল। মনে হচ্ছিল সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সমুদ্র থেকে উঠে আসা ঠান্ডা বাতাস ক্রমশ কমে যাবে, যেন ওর ইচ্ছা এই ঠান্ডা বাতাস থেমে গেলেই সে তার প্রিয় তামাকের পাইপটি মুখে পুরে যুবতীর সন্ধানে বন্দরে বের হয়ে পড়বে। এইটুকু ভেবে অবনীভূষণ আয়নায় মুখ দেখল। ভয়ংকর মুখ অবনীভূষণের, কালো নিগ্রো—সুলভ চেহারা। চুল কোঁকড়ানো, ঠোঁট পুরু—জাহাজে অবনীভূষণকে বাঙালি বলে চেনাই যায় না। অবনীভূষণ শক্ত ধাতের মানুষ। অবনীভূষণ লম্বা আর অবনীভূষণের জন্ম দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের প্রথম দিকে। অবনীভূষণ মাকে দেখেছে, বাবাকে দেখেনি। ‘অবনীভূষণ জারজ’—আয়নায় মুখ দেখার সময় পাঁচ নম্বর সাব কথাটা উচ্চারণ করল। এত দীর্ঘ ঋজু চেহারা অবনীভূষণের, আর এতবড় চোখ এবং মুখ অবনীভূষণের আর এত লম্বা থাবা অবনীভূষণের যে যুবতীরা কোনো বন্দরেই অবনীভূষণকে পছন্দ করে না।
ডেকে সামান্য কাজ অবনীভূষণের। ফরোয়ার্ড ডেকে দু’নম্বর মাস্টের নিচে উইনচ মেসিনের লিভার প্লেট আলগা হয়ে গেছে—ওটা সারাতে হবে। রবিবার তবু ওকে এই সামান্য কাজটুকু করতে হবে। বয়লার স্যুট পরে অবনীভূষণ ডেকে বের হয়ে গেল। চারিদিকে পাহাড়। তুষারঝড় কমে গেছে বলে আকাশ পরিচ্ছন্ন, লেগুনের জল সামান্য সবুজ রঙের; আর দূরে দূরে সব পাহাড় ক্রমশ উপরে উঠে গেছে। পাহাড়ের কোলে সব পরিচ্ছন্ন লাল নীল কাঠের রঙবেরঙের বাড়ি, ইতস্তত বড় বড় প্রাসাদ এবং ঠিক সেতুর অন্য পাড়ে বড় বড় কিছু স্কাইস্ক্র্যাপার। লেগুনের দু’পারেই শহর। ঠিক লৌহ আকরিকের গুদামখানার বিপরীত দিকের সেতুর ব্যালকনিতে অবনীভূষণ মানুষের ভিড় দেখল। সূর্য আলো দিচ্ছে সামান্য—খুব নিষ্প্রভ এই আলো, কোনো উত্তাপ সৃষ্টি করতে পারছে না। অবনীভূষণ লেদার জ্যাকেটের ভিতরেও হু হু করে শীতে কাঁপছিল—সামান্য উত্তাপের জন্য পাঁচ নম্বরকে খুব দুঃখিত মনে হচ্ছে।
অবনীভূষণ হাতের কাজ খুব তাড়াতাড়ি সেরে ফেলল। তাড়াতাড়ি মধ্যাহ্নের আহার শেষ করে নিজের বাংকে শুয়ে প্রতিদিনের অভ্যাসমতো কিছু নগ্ন ছবির উপর চোখ রাখতেই শুনতে পেল এলওয়েতে কে বা কারা যেন পায়চারি করছে। মেজ মালোমের গলার স্বর পাওয়া যাচ্ছে। তিনি খুব দ্রুত এবং জোরে হাসছেন। বোধহয় খুব সকাল সকাল তিনি যুবতী—সন্ধানের জন্য বের হয়ে পড়ছেন। অবনীভূষণেরও ইচ্ছা হচ্ছিল ঠিক সেই সময়ে, যখন পোর্টহোল দিয়ে অন্য তীরে তিমি শিকারের জাহাজ ভিড়তে দেখা যাচ্ছে, যখন দূরে কোথাও এক তৈলবাহী জাহাজ বাঁধা হচ্ছিল, যখন আর কিছু হাতের সামনে করণীয় নেই অথবা ‘ট্যানি টরেন্টো’ ‘ট্যানি টরেন্টো’ এক বিশ্রী শব্দ কানের কাছে ক্রমাগত বেজে যাচ্ছে তখন মেজ মালোমের মতো টিউলিপ গাছের নিচে যুবতীর সন্ধানে বের হয়ে পড়াই ভালো। এত ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও অবনীভূষণ জাহাজ থেকে সকাল সকাল নেমে পড়তে পারল না। সে রাতের জন্য অপেক্ষা করল। কারণ দিনের বেলা এই চেহারা বড় ভয়ংকর। রাতের বেলায় অস্পষ্ট অন্ধকারে অথবা নিয়ন আলোর ভিতর, ফেল্ট ক্যাপের ভিতর আর বৃহৎ ওভারকোটের জন্য মানুষের মতো মনে হয় ওকে। সুতরাং হাত—পা শক্ত করে সে বাংকেই পড়ে থাকল। শরীরের ভিতর ভয়ংকর কষ্ট এবং উত্তেজনা। বন্দরে এলেই কষ্টটা বাড়ে। বন্দর ধরলেই এই সব জাহাজিরা অমানুষের মতো চোখ—মুখ করে ঘোরাফেরা করতে থাকে—কী যেন এক সোনার আপেল ওদের হারিয়ে গেছে—সেই আপেলের জন্য, সেই সোনার হরিণের জন্য ওরা সবসময় মাটি পেলেই দ্রুত ছুটতে চায়। অবনীভূষণ দ্রুত ছুটতে চাইল।
সন্ধ্যার সময় জাহাজের স্টারবোর্ড—সাইডের কেবিনগুলোর দিকে হেঁটে গেল সে। সেখানে প্রিয় বন্ধু ডেক—অ্যাপ্রেন্টিস উইলিয়াম উড থাকেন। সে দরজায় কড়া নেড়ে ভিতরে ঢুকে বলল, এ কি, তুমি এখনও চুপচাপ বসে রয়েছ! বের হবে না?
উড বলল, ভয়ংকর ঠান্ডা।
অবনীভূষণ বলল, অন্তত সিম্যান মিশানে চল। সেখানে জুটে যেতে পারে।
সুতরাং ওরা উভয়ে সাজগোজ করে বের হয়ে পড়ল। সেই লম্বা ওভারকোট গায়ে অবনীভূষণ, লম্বা তামাকের পাইপ মুখে এবং ভয়ংকর বড় বেঢপ জুতো পায়ে অবনীভূষণ গ্যাঙওয়ে ধরে নেমে গেল। আর নেমে যাবার মুখেই দেখল মেজ মালোম বন্দর থেকে ফিরছে। মেজ মালোম বেশ সুন্দরী এক যুবতীকে (বয়সে চল্লিশের মুখোমুখি) নিয়ে এসেছেন। যুবতীর পাতলা গড়ন, ছিমছাম চেহারা আর কালো গাউন, সোনালি ব্লাউজের উপর ফারের লম্বা মতো কোট গায়ে…। ওর কোমরে মেজ মালোমের হাত। যেন চুরি করে তিনি এক যুবতীকে জাহাজে নিয়ে যাচ্ছেন। সমুদ্র থেকে তেমনি ঠান্ডা বাতাস উঠে আসছে। তীক্ষ্ন শীতের ভিতর এই সামান্য উত্তাপটুকু অবনীভূষণকে অস্থির করে তুলল। মেজ মালোমকে সে ‘গুড—ইভনিং সেকেন্ড’ বলতে পর্যন্ত ভুলে গেল। সে অন্যমনস্কভাবে হাঁটছে।
তুষারপাতে গাছের সব পাতা ঝরে গেছে, আর কিছু দিন গেলে এখানে হয়তো বরফের পাহাড় জমে যাবে। বাগানের আপেল গাছগুলোকে খুব নিঃসঙ্গ মনে হচ্ছিল, চেরিফলের গাছগুলো মৃতবৎ দাঁড়িয়ে আছে। ওরা সব অপরিচিত গাছগাছালির ভিতর ঢুকে যাচ্ছে। গাছগুলোর পাতা ঝরে গেছে বলে কোনো গাছই চেনা যাচ্ছে না, ওরা বৃদ্ধ পপলার হতে পারে, পাইন হতে পারে, এমনকি বার্চ গাছও হতে পারে। এই শীতে পথের দু’পাশে কাঠের বাড়ি এবং লাল নীল রঙের শার্সির জানালা এবং বড় বড় কাচের জানালার ভিতর পরিবারের যুবক—যুবতীদের মুখ। অ্যাকর্ডিয়ানের সুর, গ্রাম্য কোনো লোকসংগীত অবনীভূষণকে ক্রমশ উত্তেজিত করছে। ইতস্তত দু’পাশে বার এবং বার পার হলেই সেই কার্নিভাল। সদর দরজার উপর একটা লোক হাঙরের মুখোশ পরে বসে নানাভাবে জাহাজিদের প্রলুব্ধ করতে চাইছে। ওরা কার্নিভালে ঢুকল না। ওরা ক্রমশ পাহাড়ের উতরাইয়ে নেমে যাচ্ছে। আর ওরা দেখল, হরেক রকমের রমণীরা মুখে ফুঁ দিতে দিতে চলে যাচ্ছে—স্থানীয় কোনো উৎসব হবে হয়তো—মেয়েরা মাথায় রুমাল বেঁধে শহরের বড় কবরখানার দিকে হাঁটছে। অবনীভূষণের এ—সময় ইচ্ছা হচ্ছিল ওর বড় থাবা দিয়ে ঠিক ছোট পাখি ধরার মতো কোনো যুবতীকে ওভারকোটের পকেটে লুকিয়ে ফেলতে।
তুষারঝড়ের চিহ্ন এখনও এই সব পাহাড়ে এবং ছবির মতো বাড়িগুলোর মাথায় লেগে আছে। কোথাও দেখল, কাচের ঘরে সুন্দরী যুবতী পিয়ানো বাজাচ্ছে, আর দু’পাশে হরেক রকমের দৃশ্য এবং অবনীভূষণ এখন উন্মাদ—সে হন্যে হয়ে যুবতীর সন্ধান করছে। এইসব জাহাজিদের আনন্দ দানের জন্য ভিন্ন ভিন্ন অশালীন পোশাকে নানা বয়সের যুবতীরা ঘোরাফেরা করছে। ওরা এক এক করে সকলে নাচের আসরে নেমে পড়ছে। স্টেজের উপর একদল লোক কালো পোশাক পরে ব্যান্ড বাজাচ্ছে। ঈগল পাখির মতো মুখওয়ালা বাঁশির শব্দ বীভৎস এবং উৎকট মনে হচ্ছিল। পাশের কাউন্টার কাচ দিয়ে মোড়া। সেখানে মেয়েরা মদ বিক্রি করছে। জাহাজিরা কিউ দিয়ে মদ গিলছিল। অবনীভূষণ এবং উড উভয়ে মদ খেল এক গেলাস করে। ওদের পার্টনার নেই, বিশেষ করে অবনীভূষণ এইসব নাচ এতদিনেও রপ্ত করতে পারেনি। সুতরাং অবনীভূষণ আর এক গেলাস মদ নিয়ে পাশের সোফাতে বসে মাংসের পুরের সঙ্গে মদটুকু খেয়ে ফেলল। বাকি মাংসের পুরটুকু সে চেখে চেখে চেটে চেটে খাচ্ছিল আর রমণীরা এই যে নেচে চলেছে, এই যে সুন্দর শরীর এবং উটের মতো মুখটি তুলে নেচে বেড়াচ্ছে, এই যে রমণীরা ঘোড়ার মতো পা ফেলে এক দুই করে সামনে পিছনে পিছনে সামনে—যাচ্ছে আসছে—তা দেখে অস্থির হয়ে পড়ছিল। ফলে অবনীভূষণ ল্যালা ফ্যালার মতো চারিদিকে তাকাচ্ছিল। তারপর সে সহসা আবিষ্কারের মতো দেখে ফেলল দুই সুন্দরী যুবতী যেখানে মদের কাউন্টার, ঠিক তার বিপরীত দিকের টেবলে বসে উল বুনছে। অবনীভূষণ মুখ নীচু করে চুপি চুপি উডের হাত ধরে ওদের দিকে গিয়ে বসল। তারপর চোখ—মুখ টান টান করে বলল, গুড ইভনিং ম্যাডাম এবং পাশে বসে পরিচিত হবার ভঙ্গিতে বলল, এম ভি সিটি অফ গ্লাসগো। সে তার জাহাজের নাম বলল ওদের।
মেয়ে দুজন ওকে স্বাগত জানালে সে কাউন্টারে আবার মদের অর্ডার দিয়ে বলল, ছবির মতো এই শহর। মেয়ে দুজনকে ভিন্ন অলীক স্বপ্নের কথা বলে অথবা সমুদ্রের গল্প বলে ভেজাতে চাইল।
অবনীভূষণ দামি সিগারেট বের করে ওদের একটি করে দিতেই ওরা এসে ওর ঘাড়ের উপর পড়ার মতো ভান করল—সো নাইস। কোনো অলৌকিক ঘটনার মতো অবনীভূষণের সিগার কেস, সিগারেট কেসটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখল ওরা।
অবনীভূষণ চুল—সোনা মেয়েটিকে বলল, ইউ লাইক ইট? বলে সে ওর সম্মতির অপেক্ষা করল না; সে চুল—সোনা মেয়ের হাতে যৌতুকের মতো সিগারেট কেস তুলে ধরার সময়ই কাচের জানালায় মুখ বার করে পাহাড়ের উতরাইয়ের ভিন্ন ভিন্ন আলো দেখল। আকাশ পরিচ্ছন্ন বলে, পথঘাট শুকনো বলে পার্কের বেঞ্চে এখন সব যুবক—যুবতীরা বসে নিশ্চয়ই গল্প করছে। অবনীভূষণ এবার উডের দিকে তাকাল, উড তন্ময় হয়ে নাচ দেখছে। সে, অবনীভূষণ অথবা চুল—সোনা মেয়েকে লক্ষ্য করছে না। সুতরাং অবনীভূষণ উডকে কনুই দিয়ে ঠেলা দিয়ে বলল, চল এবার উঠি। প্রায় ঠিক করে এনেছি।
এবার অবনীভূষণ যুবতী দুজনকে উদ্দেশ্য করে বলল, চলুন অন্য কোথাও।
যুবতী দুজন পরস্পর মুখ দেখল। তখন ব্যান্ড বাজছে উঁচু পর্দায়, তখন সার্কাসের ঘোড়ার মতো পা ফেলে এই নাচের ভিতরই কেউ কেউ বেলেল্লাপনা করছিল। নাচতে নাচতে কোনো এক ফাঁকে দেয়ালের পাশে অথবা সামান্য অন্ধকারে পরস্পর পরস্পরকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। তারপর সব ভিন্ন ভিন্ন ভঙ্গির ছবি। অবনীভূষণ কিছুতেই আর স্থির থাকতে পারছে না। যুবতীরা সব উটের মতো মুখ তুলে কেবল চুমু খাচ্ছে, কেবল সার্কাসের ঘোড়ার মতো পা মুড়ে বসে পড়তে চাইছে। অবনীভূষণ আবার বলল, চলুন কোথাও। অবনীভূষণ চুল—সোনা মেয়ের হাতে নরম চাপ দিল।
ব্যান্ড বাজছে, হরদম বাজছে। সামনের কাউন্টারে ফের দু—একজন করে ভিন্ন ভিন্ন দেশের নাবিক এসে ভিড় করছে। ওরা কেউ কেউ মাথার টুপি খুলে তিমি শিকারের গল্প আরম্ভ করল। উত্তর সাগরে ওরা গর্ভিণী তিমি শিকার করতে গিয়ে দুজন নাবিককে হারিয়েছে, এমন গল্প করল। ওরা গল্প করার সময় পাশের হিটার থেকে উত্তাপ নিচ্ছিল এবং গর্ভিণী তিমির প্রসব সম্পর্কে রসিকতা করছিল।
ভিড় কাচঘরে ক্রমশ বাড়ছে। মিশনের ডানদিকে মসৃণ ঘাসের চত্বর এবং মৃত বৃক্ষের মতো কিছু পাইন গাছ—তার নিচে বড় বড় টেবিল আর ফাঁকা মাঠে হেই উঁচু লম্বা এক হারপুনার হেঁটে হেঁটে এদিকে আসছে। হারপুনার কাচঘর অতিক্রম করে কাউন্টারের সামনের লোকটির সঙ্গে ফিস ফিস করে কী বলছে। অবনীভূষণ সব লক্ষ্য করছিল। আগের দলটা এতক্ষণ হইচই করছিল মদ খেতে খেতে, কিন্তু হেই উঁচু লম্বা হারপুনারকে দেখে ওরা সব যিশু হয়ে গেল। আর তখন কে বা কারা যেন সেই যুবতী দুটিকে উদ্দেশ্য করে লম্বা গলায় বড় রাস্তায় হেঁকে হেঁকে বলে যাচ্ছে—ট্যানি টরেন্টো… ট্যানি টরেন্টো… আমাদের বন্ধুবর হারপুনার এবার উত্তর সাগর থেকে গর্ভিণী তিমি শিকার করে ফিরেছে।
উঁচু লম্বা লোকটার টেবিলে সকলে এক এক করে গোল হয়ে বসে গেল। সেই যুবতীরাও ছুটে যেতে চাইল। অবনীভূষণ কিছুতেই আর স্থির থাকতে পারছে না। সে এবার বিদ্রুপ করে বলতে চাইল হ্যাঁগো সতীর দল… তোমরা আমাদের ফেলে যাচ্ছ! সে বিরক্ত হয়ে এবার উডকে বলল, উড, তুমি তো বলতে পারো বুঝিয়ে। তোমাদের সুন্দর মুখ দেখে ….।
উডের কথা যুবতী দুজন তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে শুনল। ওরা চুল ঘাড়ে ফেলে উলের কাঁটা ব্যাগের ভিতর ভরে সেই চৌকোমুখ এবং গামবুট—পরা ভদ্রলোক—যে গর্ভিণী তিমি শিকার করে এইমাত্র উত্তর সাগর থেকে ফিরেছে—তার টেবিলের দিকে হাঁটতে থাকল। অবনীভূষণ প্রচুর মদ গিলেছে। ওর শরীর নেশায় টলছিল। অবনীভূষণের ভিতরে ভিতরে এক অপরিসীমা তৃষ্ণা—সে পাগলের মতো চুল—সোনা মেয়ের হাত ধরে ফেলল। কারণ সে যেন সেই চৌকোমুখ হারপুনার, মাথায় যার হাঙরের হাড়ের টুপি, যে বিশ্রী এবং যে ওখানে বসে কটু গন্ধের তামাক টানছে, যার চেহারা দেখলে মনে হয় মেয়েমানুষ সামান্য বস্তু—তার দৃষ্টি একেবারেই সহ্য করতে পারছিল না। সে রাগে—দুঃখে চুল—সোনা মেয়েকে টেনে হিঁচড়ে ঘর থেকে বের করে নিয়ে যেতে চাইলে—হারপুনার ব্যক্তিটি ও তার দলবল লম্বা লম্বা পা ফেলে দরজার সামনে পথ আগলে দিলে। অবনীভূষণ ক্ষিপ্ত এক জানোয়ারের মতো গর গর করে উঠল। হারপুনারের দলবল তখন অবনীভূষণকে এলোপাথাড়ি মুখে মাথায় ঘুষি চালাচ্ছে।
বাইরে সাদা আলোর ভিতর নাক মুছতে গিয়ে অবনীভূষণ দেখল সামান্য রক্ত নাকের ডগায় জমাট বেঁধে আছে। ভিতরে তখন সেই যুবতী হারপুনারের সঙ্গে রসিকতা করছিল এবং হাসছিল।—কাচের ভিতরে সব স্পষ্ট। সুতরাং অবনীভূষণ আর সহ্য করতে পারছে না। সে ফের দরজা অতিক্রম করে ভিতরে ঢোকবার চেষ্টা করলে উড হাত চেপে ধরে বলল, অবনী, তুমি বেশ জোরে হারপুনারকে মেরেছ। লোকটা পেটে লাথি খেয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গল গল করে মদ বমি করছে।
অবনীভূষণের ঝুট—ঝামেলা করার আর ইচ্ছা থাকল না। এবং এখানে আর যুবতী অনুসন্ধান করা নিরর্থক ভেবে ওরা পাহাড়ের গায়ে গায়ে অথবা সেতুর দুই পাশে, লোহালক্কড়ের কারখানার দেওয়ালের ছায়ায় এবং যেখানে সব তিমি মাছের চর্বি সংরক্ষণ করার জন্য বড় বড় পিপের সারি সেইসব অঞ্চলে ঘুরতে ঘুরতে একসময় শহরের মাঝামাঝি অঞ্চলে এসে গেল।
অবনীভূষণ চড়াই—উতরাইয়ে হাঁটতে হাঁটতে একসময় উডকে উদ্দেশ্য করে বলল, আজ এই শীতে সতীর দল গেল কোথায়?
তখন উড সহসা আবিষ্কারের ভঙ্গিতে বলল, ঐ দেখ অবনী, লাইটপোস্টের নিচে যেন দুজন মেয়ে শিস দিচ্ছে। বলে উড দূরের লাইটপোস্টের দিকে হাত তুলে নির্দেশ করল।
অবনীভূষণ বলল, চল তবে।
শীতের রাত। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অবনীভূষণের মনে হল ওরা শীতে জমে যাবে ক্রমশ। মনে হল ওরা যুবতী দুজনে বেশিদূর আর অনুসরণ করতে পারবে না। অথবা মেয়ে দুজন এই শীতের রাতে ওদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলছে। পথের ভিড় ক্রমশ পাতলা হয়ে আসছে, দূরে দূরে সব পুলিশের বুটের শব্দ এবং ট্রলি বাসের আলো আর পথে পড়ছে না, শহর ক্রমশ যেন নির্জন নিঃসঙ্গ হয়ে আসছে। উড পর্যন্ত আর জোরে হাঁটতে পারছিল না।
একসময় ওরা এবং যুবতী দুজন শোকেসের সামনে মুখোমুখি পড়ে যেতেই উড ঝুঁকে বলল, আস্তানা কত দূর?
দুজন বলল, সরি। বোধহয় অবনীভূষণের লম্বা চেহারা এবং হাতের বড় বড় থাবা, ওদের আতঙ্কিত করেছে।
অবনীভূষণ বলল, সামান্য সময়।
যুবতী শক্ত হয়ে গেল। বলল, না। ওরা বরং উডকে সঙ্গে নিতে চাইল।
উড বলল, আমরা দুজন, একা যেতে পারি না।
অবনীভূষণ এবার মরীয়া হয়ে বলল, মেয়ে, এই লম্বা কোটের পকেটে করে নিয়ে যাব তবে—কেউ টেরটি পাবে না। তারপর অবনীভূষণ চারিদিকে তাকাল যেন যথার্থই সে এই দুই যুবতীকে পকেটে পুরে শহর ত্যাগ করে চলে যাবে।
এবার যথার্থই ভয় পেয়ে গেল ওরা। তাড়াতাড়ি বড় রাস্তায় পড়ার জন্য ছোট সরু গলি অতিক্রম করে নেমে যেতে চাইল। পথ আগলে অবনীভূষণ তার দুই হাতের বড় থাবা দেখাল। সে হাত দুটো অঞ্জলির মতো করে রাখল—তৃষ্ণার জল আর কে দেবে? সে যেন বলতে চাইল কথাটা। এবং সে এই নিঃসঙ্গ রাতের আঁধারে উচ্চস্বরে সেই ট্যানি টরেন্টো, ট্যানি টরেন্টো শব্দের মতো চিৎকার করে নগরীর দুর্ভেদ্য অন্ধকারকে বলতে চাইল, হায় অবনীভূষণ, এই তৃষ্ণার জল তোমাকে আর কে দেবে!
তারপর অবনীভূষণ সেই যুবতী দুজনকে উদ্দেশ্য করে যেন বলল, আমি তোমাদের সব দেব, তোমরা আমাকে স্পর্শ দাও। সামান্য উত্তাপ দাও।
ওরা উত্তর করল না। বড় রাস্তার উজ্জ্বল আলোর নীচ দিয়ে হেঁটে হেঁটে চলে যাচ্ছে। আর অবনীভূষণ শুনতে পেল সেই আগের মতো দূরে কারা যেন হেঁকে যাচ্ছে—ট্যানি টরেন্টো… ট্যানি টরেন্টো ….. উত্তর সাগর থেকে এক হারপুনার এক গর্ভিণী তিমি শিকার করে ফিরেছে। অবনীভূষণ দুর্গের পাশে পাশে হেঁটে গেল। সর্বত্র যেন সেই একই ট্যানি টরেন্টো ট্যানি টরেন্টো শব্দ। সে দু’কান চেপে শীতের ঠান্ডায় ট্যাক্সির ভিতর হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকে গেল এবং ট্যাক্সিওয়ালাকে নিজের জাহাজের নাম, ডকের নাম বলে শরীর এলিয়ে দিল। মনে হচ্ছিল হাত পায়ে বড় ব্যথা, সে ঘাড় নাড়তে পারছে না—পরাজিত এক সৈনিকের মতো আত্মগ্লানিতে ডুবে গেল।
গ্যাঙওয়েতে কোয়ার্টার মাস্টার পাহারা দিচ্ছিলেন। তিনি দেখলেন পাঁচ নম্বর সাব এবং ডেক—অ্যাপ্রেন্টিস উড হামাগুড়ি দিতে দিতে সিঁড়ি ভাঙছে। ওরা ফেরার পথে প্রচুর মদ গিলেছে; ওরা সিঁড়ি ধরে সোজা হেঁটে আসতে সাহস পাচ্ছে না। সুতরাং মাস্টার ওদের দুজনকে উঠে আসতে সাহায্য করলেন।
উড স্টারবোর্ড, সাইডের কেবিনগুলোর দিকে হেঁটে হেঁটে চলে গেল।
অবনীভূষণ বালকেডে ভর করে নিজের কেবিনের দিকে হাঁটতে থাকল। স্তিমিত আলো এলওয়েতে। সে বড় মিস্ত্রি এবং মেজ মিস্ত্রির কেবিন পিছনে ফেলে যেতেই মনে হল পায়ের সঙ্গে কী যেন জড়িয়ে যাচ্ছে। সে যত পা আলগা করতে চাইছে ততই পায়ের সঙ্গে পা জড়িয়ে যাচ্ছিল। সে এবার নুয়ে পায়ের নিচে হাত দিয়ে দেখল একটা কালো রঙের গাউন। সে আলোর ভিতর নাকের কাছে সেটাকে নিয়ে কিছুক্ষণ আলগা করে ঘ্রাণ নেবার সময় দেখল সামনে মেজ মালোমের কেবিন, কেবিনের দরজা খোলা, মেজ মালাম বাংকে উপুড় হয়ে মৃতবৎ পড়ে আছেন। ঘরে সেই বিকেলে ধরে আনা যুবতী নেই। মেজ মালোম এক হাতে কোনোরকমে প্যান্টটা কোমর পর্যন্ত তুলে রেখে লজ্জা নিবারণের চেষ্টা করছেন। অবনীভূষণ বলল, শালা মদ খেয়েছে। বলে, গাউনটা দরজা দিয়ে মেজ মালোমের মুখের ওপর ফেলে দিল। মেজ মালোমের এখন মুখ ঢাকা এবং শরীর প্রায় উলঙ্গ। সে দরজা টেনে বন্ধ করে দিল মালোমের কেবিন। তারপর এনজিন ঘরের সিঁড়ির মুখে নিজের কেবিনের দরজা খুলতে গিয়ে মনে হল ভিতর থেকে কে যেন বন্ধ করে রেখেছে। সে রাগে দুঃখে অপমানে দরজার উপর ভীষণ জোরে লাথি মারল। দরজা খুলছে না। সে তার অবসন্ন শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে এবার দরজার উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল। সে বলল, বাস্টার্ড, সে গাল দিল, সোয়াইন! সে তারপর বাংলা ভাষায় খিস্তি করে ভিতরে ঢুকে বিস্মিত—সে চোখ গোল গোল করে দেখল, সেই বিকেলের যুবতী ওর বাংকে আশ্রয় নিয়েছে। এবং অসহায় বালিকার মতো চোখ। যুবতীকে এখন বুনো কাকের মতো শীর্ণ মনে হচ্ছে অথবা গর্ভিণী শালিখের মতো রোঁয়া ওঠা। প্রথমে সে কী করবে, ভেবে পেল না। তারপর বিস্ময়ের ঘোর কেটে গেলে সে বলল, কি গো, একেবারে বাঘের মুখে!
যুবতী কিছু বলল না। চোখে মুখে ভয়ের এতটুকু চিহ্ন নেই। যেন এক্ষেত্রে কিছু করণীয় নেই, সব হয়ে গেছে, হয়ে যাবে ভাব। ঝড় এবং জীবনের আর্তনাদ কোথাও থেমে থাকছে না। যুবতী তবু ধীরে ধীরে বাংক ছেড়ে ওঠার চেষ্টা করল। বলল, সরি মিস্টার। সে তার শীর্ণ হাত বালিশের উপর রেখে ওঠার চেষ্টা করতে গিয়ে পড়ে গেল।
অবনীভূষণ যুবতীটিকে পড়ে যেতে দেখেই বুঝল—সেই বিকেল থেকে বাঁদরের হাড় চুষে চুষে যুবতীর এক কঠিন অসুখ, এক কঠিন স্থবির অসুখ—যা এতক্ষণ অবনীভূষণকে এই শহরময়, নগরময় এবং দুর্ভেদ্য অন্ধকারে বারংবার ঘুরিয়ে মারছে।—অবনীভূষণ তাড়াতাড়ি যুবতীকে ধরে ফেলল। না হলে বাংক থেকে যেন পড়ে যেত মেয়েটি, হাত—পা কেটে মাথায় আঘাত লাগতে পারত। যুবতীর পড়ে যাবার মুখে কম্বলটা শরীর থেকে সরে গিয়েছিল। অবনীভূষণ দেখল আঁচড়ে কামড়ে যুবতীর শরীর মেজ মালোম ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছে। লজ্জা নিবারণের জন্য অবনীভূষণ তাড়াতাড়ি ফের কম্বলটা শরীরে তুলে দিল এবং শুয়ে পড়তে বলে ঘড়িতে সময় দেখল—একটা বেজে গেছে, এখন ওকে সামান্য শুশ্রূষা করলে সামান্য সময়ের জন্য এই বন্দর শুভ—বার্তা বহন করবে। এইটুকু ভেবে অবনীভূষণ দরজা ভেজিয়ে চিফ কুকের গ্যালি পর্যন্ত হেঁটে গেল। নেশার ঘোর কী করে যেন একেবারে কেটে গেছে এবং ভিতরের সব দুঃখ ক্রমশ নিরাময় হচ্ছিল। সমুদ্র থেকে তেমনি ঠান্ডা বাতাস উঠে আসছে। সে গরম জল করে যুবতীর শরীর ভালো করে ধুয়ে সামান্য শুশ্রূষার পর বলল, আমার জন্য সামান্য খাবার আছে। ইচ্ছা করলে আমরা দুজনে ভাগ করে খেতে পারি।
যুবতী কষ্ট করে হাসল,—আপনি আমাকে বরং একটু সাহায্য করুন।
অবনীভূষণ বলল, কী করতে হবে?
সেকেন্ড অফিসারের ঘর থেকে দয়া করে আমার পোশাকটা এনে দিন।
অবনীভূষণ মেজ মালোমের ঘর থেকে পোশাকটা এনে দিলে মেয়েটি বলল, আমাকে দয়া করে বন্দরে নামিয়ে দিন। একটা ট্যাক্সি ডেকে দিলে আমি ঘরে চলে যেতে পারব।
বেশ চলুন। বলে তুলে ধরতেই মনে হল যুবতীর মাথা ঘুরে গেছে। সে বসে পড়ল।
আপনি বন্দরের রাস্তাটুকু হেঁটে পার হতে পারবেন না। বরং এখানেই রাতটা কাটিয়ে দিন।
আমার ভয় করছে মিস্টার, সে আবার আসতে পারে। অত্যন্ত কাতর চোখে অবনীভূষণের দিকে তাকিয়ে থাকল সে।
আপনি ঘুমোন, আমি বরং দরজায় পাহারা দিচ্ছি।
যুবতী আর কথা বলতে পারল না। চোখ জলে ভার হয়ে গেছে।
আর অবনীভূষণের মনে হল দীর্ঘদিন পর সে এক অসামান্য কাজ করে ফেলেছে। সে বলল, আমি বাইরে বসে থাকছি, আপনি নির্ভয়ে ঘুমোন—বলে অবনীভূষণ দরজা বাইরে থেকে টেনে বন্ধ করে দিল এবং ঠিক দরজার সামনে ভয়ংকর ঠান্ডার ভিতর পা মুড়ে বসে থাকল এবং জেগে জেগে এক বিস্ময়কর স্বপ্ন দেখল—দ্বীপের স্বপ্ন, বড় এক বাতিঘর দ্বীপে—সব বড় বড় জাহাজ সমুদ্রগামী। অবনীভূষণ নিঃশব্দে হাঁটু মুড়ে মাথা গুঁজে বসে থাকল—তার এতটুকু নড়তে ইচ্ছা হচ্ছিল না, যেন জীবনের সাত রাজার ধন এক মাণিক, খুবই হাতের কাছে রয়েছে। তাকে গলা টিপে মারতে নেই। সুতরাং সে উঠল না এবং এই নিদারুণ রাত্রি জীবনের প্রথম আলোর পথ বলে মনে হল অবনীভূষণের।