Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » মানুষের হাহাকার || Atin Bandyopadhyay

মানুষের হাহাকার || Atin Bandyopadhyay

রোজকার মতো আজও সে দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শুনতে পেল। প্রথমে আস্তে, পরে বেশ জোরে। কেউ ডাকছে, কীরে ঘুম ভাঙল না। কত ঘুমোবি। কিন্তু কোনো সাড়া শব্দ না পেলে কেমন ভীতু গলা হয়ে যায় দাদুর। তখন আরও জোরে—নানু ও নানু, ঘুমোচ্ছিস না জেগে আছিস? এত বেলায় কেউ ঘুমোয়! ওঠ, আর কত ঘুমোবি? কথা বলছিস না কেন?

সে সকালে ঘুম থেকে উঠে একদিন চুপচাপ বসেছিল, ইচ্ছে করেই সাড়া দেয়নি। ইচ্ছে করেই ঘুম থেকে উঠে দরজা খোলেনি, জানালা খোলেনি—কেমন আর্ত গলা তখন দাদুর, ‘নানু দরজা খোল ওঠ ভাই।’ নিচ থেকে ছোট মাসি, দিদিমা পর্যন্ত ছুটে এসে দরজায় হামলে পড়েছিল। ‘নানু নানু!’ সারা বাড়িটা তটস্থ হয়ে উঠেছিল। ভারি মজা। এরা সবাই ভেবেছে, সেও একটা কিছু তার বাবার মতো করে বসবে।

নানু বিছানায় পাশ ফিরে অত্যন্ত সহিষ্ণু গলায় সাড়া দিল—’কী হচ্ছে!’ এই একটা কথাই যথেষ্ট। সে ঘরেই আছে, সে জেগে আছে, কিছু একটা করে বসেনি, তার সাড়া পেলেই দাদু এটা বেশ বোঝে। তারপর বীণাদি আসবে—’তোমার চা দাদাবাবু’। চা নিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে ওই একটি কথাই বলবে, আর কিছু বলবে না। ওরা কি জানে, চা—এর কথা শুনলে নানু আর বিছানায় শুয়ে থাকতে পারবে না। দরজা খুলে দেবে।

নানু উঠে পাজামা পরল। একটা গেঞ্জি গায়ে দিয়ে দরজা খুলে দিল। বীণাদির যা স্বভাব, ‘খুউব! চা রাখার সময় ওই আর একটি কথা। তারপর টেবিলে চা রেখে আর কথা না বলে দরজাটা ভেজিয়ে চলে যায়। এটাও নিয়মে দাঁড়িয়ে গেছে। আগে নানুকে বলতে হত, দরজাটা যাবার সময় ভেজিয়ে দিয়ে যেয়ো। কখনও কখনও ভুলে যেত বাণীদি। এখন অভ্যাস হয়ে গেছে। এই সংসারে সব কিছুই অভ্যাস—এবং মনে হয় নানুর বেঁচে থাকাটাও একটা অভ্যাসের ব্যাপার। এবং দাদুর বিশ্বাস এই অভ্যাসটা নানুর ঠিক গড়ে ওঠেনি। অথবা বাবার মতো সে অভ্যাসটার প্রতি বিরক্ত হয়ে যদি কিছু করে ফেলে। বাবা, তার বাবা। নানুর এ—কথাটাও চায়ে চুমুক দেবার সময় মনে হল। ভারি সুন্দর ছিল তার বাবা দেখতে। খুব উঁচু লম্বা নয়, মাঝারি সাইজের। তার বাবাটির চোখ মুখ ছিল ভীষণ মায়াবী। বাবার কথা মনে হলে, তার চোখ এখনও ঝাপসা হয়ে আসে। সে গোপনে কাঁদে।

শহরের এদিকটায় এখন অনেক নতুন ঘরবাড়ি উঠে যাচ্ছে। সে জানালায় বসে দেখল ক’টা পাখি উড়ে যাচ্ছে ঘরবাড়ি পার হয়ে। বাড়িটা পুবমুখো বলে, সূর্য উঠলেই রোদ এসে যায়। সামনে অনেকটা জমি। সেখানে কিছু ফুলের গাছ। এই যেমন কিছুদিন আগে একটা কলকে ফুলের গাছ ছিল।

সে এখানে আসার পরই দাদু একদিন কলকে ফুলের গাছটা কেটে ফেলল। বাড়ির কাজের লোকটাকে বেশ সতর্ক গলায় ডেকেছিল সেদিন, ‘নিধু গাছটা বুড়ো হয়ে গেল। ফুল হয় না। রেখে লাভ নেই। বরং এখানে একটা শ্বেতজবার গাছ লাগিয়ে দিবি।’ নানু বলেছিল, ‘দাদু এমন সুন্দর গাছটা তুমি কাটছ!’ দাদু হেসেছিল ‘গাছ সুন্দর হয় না। ফুল না হলে গাছ দিয়ে কী হবে।’

—তা ঠিক। সে চলে এসেছিল এবং জানালা থেকে সে দেখতে পেয়েছিল কলকের গোটাগুলি খুব সতর্ক চোখে তুলে নিচ্ছে দাদু। তার ভারি হাসি পেয়েছিল।

চা শেষ হতে না হতেই সে জানে দাদু আবার উঠে আসবে। খবর দেবে, নানু কাগজ এসে গেল। আয়।

সকালে এটাও অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে। সেই শৈশবে সে যখন স্কুলে পড়ত, বাবা বেঁচে থাকতে, বাবা ও জ্যাঠামণি তখনও একসঙ্গে এক বাড়িতে, জ্যাঠামণির জন্য ইংরেজি কাগজ—আর বাড়ির সবার জন্য একটা বাংলা কাগজ—সে খেলার পাতাটা প্রথম দেখত, তারপর সিনেমার পাতা, এবং পরে সব কাগজটাই পড়ার অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল।

সে চা খাবার সময় দেখল একটা রেলগাড়ি যাচ্ছে। এই জানালাটা দিয়ে অনেক কিছু দেখা যায়। সামনে বড় একটা পুকুর, কিছু গাছপালা, বাড়িঘর, এবং বড় রাস্তা থেকে একটা পথ বেঁকে বাজারের দিকে গেছে। সেখানে চায়ের দোকান, লোহা লক্করের দোকান, একটা ম্যাচ কারখানা, ক্লাব ঘর, ছোট্ট খেলার মাঠ, গোটা দুয়েক তিনতলা বাড়ি, বাড়ির জানালা, একজন বুড়ো মতো মানুষ ব্যালকনিতে বসে থাকে। এবং সব পার হয়ে রেল—লাইন।

এ—ঘরে দুটো জানালা, সামনে পুবমুখী দরজা, তারপর রেলিং ঘেরা বারান্দা। এখানে আসার পর এ—ঘরটাই থাকার মতো মনে হয়েছিল তার। দোতলার এক প্রান্তে আলগা এই ঘরটায় সে কিছু বই আমদানি করেছে। গোপনে সে বইগুলি পড়ে। বইগুলি পড়লেই কেন জানি পৃথিবীটাকে তার বদলে দিতে ইচ্ছে করে। এবং একতলার কোনো শব্দই এখান থেকে শোনা যায় না। ঘরের মধ্যে আছে একটা আলনা। ওটায় সে তার জামাকাপড় রাখে। একটা টেবিল, কিছু বি—কম পার্ট ওয়ানের বই এবং চেয়ার একটা। এক পাশে লম্বা খাট, দুটো মোড়া। সুটকেসটা খাটের নীচে। ওতে টুথ ব্রাস, পেস্ট, দাড়ি কামাবার সাজসরঞ্জাম সব থাকে। যেন কোথাও যাবার কথা থাকে তার সব সময়—সে সেজন্য কাজ হয়ে গেলে আবার স্যুটকেসের ভিতর পুরে রাখে। একটা তাক রয়েছে। ওটা খালি।

মানুষ যেখানেই থাকে সেটা এক সময় বড় নিজস্ব হয়ে যায়। অথচ তার মনে হয়, সে কিছুদিন এখানে থাকবে, তারপর আবার কোথাও চলে যাবে।

বাসা বাড়িতে সে বড় হয়েছে। সে শুনেছে বাড়ি বদলের স্বভাব তার বাবার যেমন বাতিক ছিল, জ্যাঠামণিরও। এক বাড়িতে দু—তিন বছরও কাটত না, সে তার দশ—বারো বছরের জীবনে এটাই দেখে এসেছে। বাবা মরে যাবার পর মার সঙ্গে সে তার দাদুর বাড়িতে চলে এসেছিল। একতলার একটা ঘরে তখন সে তার মায়ের সঙ্গে থাকত। তারপর মেসো খবর পেয়ে পাটনা থেকে চলে এলেন—মাকে বললেন, তুমি আমার ওখানে চল, কিছুদিন বেড়িয়ে আসবে। ওরা চলে গেল সেখানে—তখন অন্য একটা বড় শহরে মেসোর বদলি হবার কথা। বড় মাসি ওদের নিয়ে গাড়ি করে কখনও রাঁচি, কখনও হাজারিবাগ গেছে। কেবল ঘুরে বেড়িয়েছে। সে বোঝে এত বড় একটা শোক সামলে উঠতে মার সময় লেগেছিল। তারপর সংসারে যে কী হয়, সে বুঝতে পারত না। মা একদিন বলল, আমরা একটা বড় শহরে চলে যাব নানু তোমার মেসো আমার জন্য একটা চাকরি ঠিক করেছে। তুমি ওখানেই পড়বে।

বাবার মৃত্যুর জন্য তার এক বছর পড়া হয়নি। পৃথিবীটা ছিল তখন হাহাকারে ভরা। সর্বত্র সে দেখত, তার পাশে পাশে কেউ হেঁটে যাচ্ছে। আর যেন বলছে, নানু ভয় পাবি না। আমি আছি। মানুষ মরে শেষ হয়ে যায় না। সে তার মাকে বলত, মা বাবা এমন কেন বলে? তখন যা হয়ে থাকে, দাদু এবং মা তাকে গয়াতে নিয়ে গিয়ে পিণ্ডদান করাল। প্রয়াগে সে এবং দাদু ত্রিবেণীর জলে ডুব দিল। পৃথিবী থেকে তার বাবার স্মৃতি মুছে দেবার জন্য সংসারে তখন আপ্রাণ চেষ্টা। কেউ ভুলেও বাবার কথা তার সামনে উচ্চারণ করত না। মাও না। কিছুদিন মা পাথর হয়েছিল—তারপর মেসো সেই যে ‘বেড়াতে চল’ বলে নিয়ে গেল সেই শেষ, শোকের শেষ। মার মুখে হাসি ফুটে উঠল। গাড়িতে মা জানালায় মুখ বাড়িয়ে বলেছিল, মনীষদা ওই দেখো চা—ওলা যাচ্ছে। ডাকো, চা খাব।

মেসো বলেছিলেন, গাড়িটা এখানে অনেকক্ষণ থামবে। চলো নীচে নেমে খাই। নানু নামক বালকের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, তুমি বসো। আমরা এক্ষুণি আসছি।

কত আগেকার কথা অথচ মনে হচ্ছে তার, এই সেদিন যেন সব ঘটে গেল। মা নেমে গেল মেসোর সঙ্গে। মেসো কী একটা ঠাট্টা করল মাকে। মা মেসোকে সামান্য ঠেলা দিয়ে কী একটা রসিকতা করল এবং যেন জীবনে কিছুই থেমে থাকে না—সে দেখল তার মা যখন উঠে আসছে, তখন জোর হাসছে মেসোর কথায়।

নানু মাথা নীচু করে বসেছিল তখন। মার এমন হাসি তার একদম ভালো লাগেনি। সে তখনও মাথা নীচু করে চা খাচ্ছে। সে যখন কথা বলে কারও সঙ্গে, মাথা নীচু করে কথা বলে—কীভাবে যেন তার মাথাটা কারা ষড়যন্ত্র করে হেঁট করে দিচ্ছে। প্রথম ষড়যন্ত্রকারী কে? এই প্রশ্নটা অনেকদিন থেকে তার মাথায় ঘুরছে। বিশেষ করে এখানে আসার পরই মনে হয়েছে সব ষড়যন্ত্রকারীদের সে খুঁজে বার করবে। সব আত্মীয়দের বাসায় যাবে—এবং খোলাখুলি সবার সঙ্গে সে বাবার মৃত্যু সম্পর্কিত বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করবে।

এখানে আসার পর বছর পার হয়ে গেল। দাদু সব সময় ভয়ে ভয়ে থাকে। কোথাও বের হতে দেয় না। যেখানে সে যাবে সঙ্গে দাদু যেতে চাইবেন। মানুষটাকে এক এক সময় তার দারুণ ভালো লাগে, এক এক সময় মনে হয় এই মানুষটার প্রতি তার করুণা হবারই কথা। আবার কখনও কী যে ঘৃণা! সে তখন চিৎকার করে ওঠে, ‘তুমি যাও, দাদু আমার সামনে তুমি এসো না। তুমি তো পি ডবল্যু ডির হেড ক্লার্ক ছিলে। একজন কেরানি কত আয় করে। এই আয়ে এত পয়সা কখনও হয়, মেয়েদের তুমিই নষ্ট করেছ—তোমার মেয়েরা কে কী আমার জানতে বাকি নেই। তখন মনে হয়, ছিঃ ছিঃ দাদুর সম্পর্কে এত সব খারাপ চিন্তা তার মাথায় আসে কী করে!

সকালে উঠে ঘুম ঘুম চোখে চা ভাবা যায় না! চা খেলেই যেন শরীরের সব জড়তা নষ্ট হয়ে যায়। সে টান টান হয়ে ওঠে। রক্ত মাংসে মজ্জায় অস্থিরতা জাগে। সে দাঁড়ায়। জানালা খুলে দিয়ে মুক্ত হাওয়া নেয় বুক ভরে। তারপর নীচে ছোটমাসির দরজায় গিয়ে দেখল, মাসি ঘরে নেই। তার জামা প্যান্ট মাসি জোর করে ঘর থেকে তুলে আনে। ধুয়ে ইস্ত্রি করে আবার রেখে দেয় তার ঘরে। তা রাখেনি। কোথায় রাখল তার জামা প্যান্ট! দাদুর ঘরে ঢুকেই অবাক। মাসি আজ সকাল সকাল দাদুর ঘরে ঢুকে গেছে। দাদু পঞ্জিকার পাতা ওলটাচ্ছে। ওকে দেখেই বলল, বোসো। সে বসল না। মাসির দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার কি কিছু হয়েছে ছোটমাসি?

মিতা সামান্য চোখ কুঁচকে বলল, আমার আবার কী হবে?

না এই বলছিলাম, কেমন দেখাচ্ছে তোমাকে, এত সকাল সকাল এখানে।

দাদু তখন বলল, পাঁচটা আঠারো গতে একাদশী।

নানু বলল, দাদু ছোটমাসি আজ একাদশী করবে!

দাদু জানে, নানুর মাথার মধ্যে কেউ গুণ টেনে নিয়ে যায়। একদিন নানু বলেও ছিল কথাটা। আমার মাথার মধ্যে কেউ গুণ টানে—’গুণ টানে’ এইরকম কথা নানুই বলতে পারে। বরং বলতে পারত, ধুনুরি তুলো ধোনে। তার বন বন ডবকা শব্দ মাথার মধ্যে বাজে। কিন্তু তা না বলে গুণ টানে—ভারি আজগুবি কথাবার্তা নানুর। সুতরাং বুড়ো রাসবিহারী সামান্য তামাকের পাতা মুখে ফেলে দিয়ে বললেন, তোমাকে আজ ছোটমাসির সঙ্গে একটু বেলঘরে যেতে হবে।

নানু বলল, আমার কাজ আছে। বুড়ো রাসবিহারী আবার চোখ তুলে দেখলেন নাতিকে তারপর কিঞ্চিৎ অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে বললেন, তোমার এত কী কাজ!

আমার কলেজ আছে। সময় হবে না। মাসি আমার জামা প্যান্ট কোথায়!

মিতা লম্বা ম্যাকসি পরে আছে। চুল ঘাড় পর্যন্ত বর করা। চোখে বাসি আই ল্যাস। রাতে ভালো ঘুম হয়নি। চোখের নীচে রাজ্যের অন্ধকার। দিদিমা কলতলায় কাউকে বকছে। ঠিক এই সময়ে সহসা ছোটমাসির মুখটা বুড়ি হলে কী রকম দেখাবে—এই দিদিমার বয়সে, এবং ভেবেই সে বুঝতে পারল, আগামী ২০২০ সালের ২২ এপ্রিল ছোটমাসি দেখতে হুবহু দিদিমা—যতই চামড়া টান করার বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি বের হক—ছোটমাসিকে কেউ আর ছোটমাসি রাখতে পারবে না। বুড়ি দিদিমা, গালে মাংস নেই, ফলস দাঁতে যখন হাঁ করবে—তখন শরীরের সবকিছু জারিজুরি ধরা পড়ে যাবে। সে বলল, মাসি তুমি হাঁ কর তো?

মাসি বলল, হাঁ করে কী হবে?

হাঁ করই না, দেখব।

কী দেখবি?

কোথাকার জল কতদূর গড়াবে ভেবে মিতা বলল, দেখে কী হবে?

কটা দাঁত আছে গুণে রাখব।

দাদু সহসা উঠে দাঁড়ালেন। না, পারা যাচ্ছে না। নানু আমার সঙ্গে এসো।

কোথায়।

চল বসার ঘরে। আমার কিছু বই আছে ওগুলো তুমি গুণবে। তখন নানু ভাবল এক সময় একটা লাইব্রেরি গড়ে তুলেছিলেন দাদু। কপালকুণ্ডলা উপন্যাস মা প্রথম দাদুর লাইব্রেরি থেকে পায়। দাদুর চিন্তাশক্তি, কিংবা বলা যায় বুদ্ধিমত্তা অত্যন্ত প্রখর। দাঁত না গুণে বই গুণতে বলছে। বুড়োটা বড় বেশি চালাক। সে বলল, দাঁত গোনা আর বই গোনা এক কাজ দাদু? তুমি বল, এক কাজ কী না?

রাসবিহারীর কপাল ঘামছিল। ছটি জীবিত কন্যার জনক তিনি। মরে গেলে জামাতারাই তার এই সম্পত্তির মালিক হবে। তিনি এখন তা চান না। কারণ নানু কেন জানি বুকের মধ্যে একটা জায়গা নিয়ে বসে যাচ্ছে। সেই জামাইয়ের মৃত্যু দিন থেকেই—তখন নানুর বয়স আর কত। একটা জাবদা খাতায় তাঁর সব কিছু লিখে রাখার অভ্যাস। তিনি লিখেও রেখেছিলেন। ওটা খুলে আর একবার দেখা দরকার। বেঁচে থাকতে থাকতে আর দুটি কাজ তাঁকে সম্পূর্ণ করে যেতে হবে। এক নম্বর মিতার বিয়ে, দুই নম্বর নানুর জন্য ভালো একটা কাজ এবং সুন্দর টুকটুকে নাত—বউ। তাহলে মোটামুটি লাইফ—সারকল সম্পূর্ণ। একজন মানুষের পৃথিবীতে আর কী লাগে!

মিতার বিয়ের জন্য ভালো একটা ছেলে পেয়েছেন। খোঁজখবর নিতে হবে পাত্রপক্ষ যা চায় মিতার সে—সব গুণ ষোলো আনা আছে। দাবি দাওয়া যথেষ্ট। পাত্র দেখা হয়নি। সেজ—জামাইয়ের অফিসের ক্যালকাটা ব্রাঞ্চে ছেলেটা কাজ করে। এই সব কথাগুলিও রাসবিহারীর মাথায় টরে টক্কা বাজিয়ে গেল। তবু কপাল খুবই ঘামছে। এক বয়সে ভাবতেন, দুটো ডাল ভাতের সংস্থান করতে পারলেই জীবন ধন্য। তারপরের কালে ভাবতেন, সন্তানগুলি বড় হলেই সব কষ্ট দূর হয়ে যাবে। এবং মেয়েরা বড় হতে থাকলে ভাবলেন, বিয়ে দিতে পারলেই লেটা চুকে গেল। কিন্তু এখন দেখছেন, নানুর কিছু একটা না হলে তিনি মরেও স্বস্তি পাবেন না। অথচ এই নানু দিনকে কী হয়ে যাচ্ছে! তিনি বললেন, কাল রাতে এত দেরি হল কেন তোমার ফিরতে?

আচ্ছা দাদু তুমি সত্যি করে বলত, তোমার ছোট মেয়ের দাঁত কটা?

আমি কী করে জানব?

বাবা হবে, অথচ খবর রাখবে না কটা দাঁত মেয়ের?

তুই যখন বাবা হবি, তখন খবর রাখিস সব কিছুর।

কী বললে!

রাসবিহারী প্রমাদ গুনলেন। নানুর চোখ ভীষণ টকটকে লাল। নানুর মাথায় রক্ত উঠে যাচ্ছে। তিনি বললেন, নানু দাদুভাই, আমার শরীর কেমন করছে।

নানু বলল, ডাক্তার ডাকব! ও ছোট মাসি!

না, না, তুই ওপরে যা! আমার শরীর এমনিতেই ঠিক হয়ে যাবে। তারপর মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি হাঁ করে ওকে দেখাতে পার না। তোমার এত গুমর।

নানু দাদুর দুরবস্থা দেখলে খুব স্বাভাবিক হয়ে যায়। তার চোখ দুটো আর লাল থাকল না এবং সে পাশে বসে বলল, দাদু তোমার বয়স হয়েছে। এখনও এত ভাব কেন বল তো। এ—বয়সে মানুষের ঠাকুর দেবতা ছাড়া আর কী থাকে!

নানু মাঝে মাঝে কত ভালো কথা বলে। মনেই হয় না তখন, এই শেষ বয়সের নাতিটা আত্মঘাতী হতে পারে। বরং বিবেচক, বুদ্ধিমান—নানু বড় কর্তব্যপরায়ণ। তিনি বললেন, নানু তোমার জ্যাঠামণি আজ বিকেলে আসবে। বাড়ি থেকো।

সে বলল, বাবার বড় ভাইয়ের কথা বলছ?

এই মুশকিল। কোনো কথা নানু কী ভাবে নেবে বুঝতে পারেন না রাসবিহারী। এখন যা কথাবার্তা নানুর,—তাতে মনে হয় জ্যেঠুর সম্পর্কে তার আর তিলমাত্র শ্রদ্ধা নেই। তিনি নানুর দিকে একবার ভালো করে তাকালেন। মিতা ঘরে নেই। সে কোন ফাঁকে ঘর থেকে বের হয়ে গেছে। কখন আবার নানুর মনে পড়ে যাবে ছোট মাসি দাঁত না দেখিয়েই চলে গেল! সুতরাং রাসবিহারী নানুকে কিছুটা অন্যমনস্ক করে রাখতে চাইছেন। নানুর জ্যাঠামণি অবনীশ এবং তার বউ দুজনেই আসবে। নানুর খোঁজখবর নিতে আসে। কারণ আফটার অল নানু অবনীশের ছোট ভাইয়ের ছেলে। আত্মীয়—স্বজন এমনিতেই প্রীতিশের মৃত্যু নিয়ে নানারকম কথাবার্তা বলে থাকে। আড়ালে এও শোনা যায় অবনীশের বউর স্বার্থপরতা প্রীতিশকে ভীষণভাবে মর্মাহত করেছিল। অবনীশ বিয়ে করেছিল বেশি বয়সে। ওদের এখন একটি মেয়ে। মেয়েটির বয়স আট। বউ শিক্ষকতা করে। ভালো ইস্কুলে মাস্টারি এবং কোচিং—এর আয় থেকে বেশ বাড়িঘর বানিয়ে আদর্শ স্বামী—স্ত্রী এখন তারা। অবনীশ একটা অফিসে আছে।

নানুর দিকে তাকিয়ে এতগুলি কথা রাসবিহারী মনে মনে ভেবে ফেললেন। অবনীশের কথাবার্তায় সব সময়ে খুব বিপ্লবী মেজাজ। রাজনীতি থেকে হাল আমলের সাহিত্য সম্পর্কে অগাধ পাণ্ডিত্য এবং পৃথিবীতে কোথাও কিছু হচ্ছে না, একমাত্র চীন দেশটি সম্পর্কে তার এখনও আস্থা আছে—না হলে যেন সে আর বেঁচে থাকতেও রাজি ছিল না। অবনীশ কথাবার্তা হাফ বাংলা হাফ ইংরেজি ঢং—এ বলতে অভ্যস্ত।

নানু কিন্তু বংশের কোনো কৌলীন্যই পায়নি। নানু দেখতে তার মার মতো কিন্তু ভীষণ লম্বা এবং অল্প বয়সেই দাড়ি গোঁফ উঠে যাওয়ায়, তাকে এই আঠারো উনিশ বছরে একজন পঁচিশ ছাব্বিশ বছরের যুবকের মতো লাগে। সে কখনও দাড়ি কামায়, কখনও কামায় না। কলেজে যায়, তবে কলেজ করে না। এবং যা খবর, তাতে দুশ্চিন্তা একমাত্র সার করে রাসবিহারীকে বেঁচে থাকতে হবে। নানু তার ইচ্ছা অনিচ্ছার কথা একমাত্র তার ছোট মাসিকেই বলে। এবং কখনও কখনও এমন সব সাংঘাতিক কথাবার্তা কানে আসে যে রাসবিহারী নিজের মৃত্যু কামনা করতে বাধ্য হন।

এই যেমন এখন নানু একটা চেক কাটা লম্বা পাজামা পরে স্যান্ডো গেঞ্জি গায়ে বসে কাগজ পড়ছে। চশমা চোখে—খুব অল্প বয়সেই চোখ খারাপ হয়ে যাওয়ায় বাবা তাকে চশমা পরিয়ে গেছে। এখনও সেই চশমাটাই চোখে। চশমার পাওয়ার বদলানো দরকার—কিন্তু মানুষের মনে কী যে থাকে—নানু বাবার দেওয়া চশমা কিছুতেই চোখ ছাড়া করবে না। রাসবিহারী জানে নানুর ইচ্ছা না হলে এই পাওয়ার বদলানোর কম্ম তার কেন, তার প্রপিতামহেরও সাধ্য নেই। ওর মার স্বভাব ঠিক উলটো। যখন যেমন, অর্থাৎ নেই বলে বসে থেকে লাভ নেই, সময়ের সঙ্গে শরীরের সঙ্গে তাল দিয়ে চলার স্বভাব। হাহাকারের মধ্যে একজন মানুষ কতক্ষণই বা থাকতে পারে। তুই ছেলে হয়ে মার দুঃখটা বুঝবি না। অবুঝের মতো মাথা খারাপ করবি। আজকাল তোর মার বয়সে কত মেয়ের বিয়ে হয়—আকছার এ—বয়সটা আজকালকার মেয়েদের প্রায় বিয়ের বয়স। পঁয়ত্রিশ—ছত্রিশ একটা বয়স!

তখনও দুম করে নানু বলে ফেলল, আচ্ছা দাদু তোমার তো বয়েস হয়েছে।

রাসবিহারী বললেন, বয়েস ত হবেই।

এ বয়সে মানুষ কিছু সত্য কথা বলে থাকে।

মানুষ সব সময়ই সত্য কথা বলে।

তুমিও বলেছ?

যখন যেমন দরকার। মানুষের সত্যাসত্য সঠিক কি, মানুষ কখনও বলতে পারে না।

নানু তর্কে যেতে চাইল না। এখানে আসার পর থেকেই ভাবছে, কেবল ভাবছে—কাকে দিয়ে সে আরম্ভ করবে, মাকে দিয়ে, দাদুকে দিয়ে, জ্যাঠামণিকে দিয়ে, না অন্য কাউকে দিয়ে? কিন্তু আজ সকালে মনে হল, দাদুকে দিয়েই শুরু করা যাক। বলল, দাদু, তুমি অনেক বেশি জানো। কিন্তু এটা কি জানো বাবা কেন আত্মহত্যা করলেন?

রাসবিহারী চিৎকার করে উঠলেন, নানু কে বলেছে তোমার বাবা আত্মহত্যা করেছেন?

আমি জানি দাদু, তোমরা যতই গোপন রাখো সব জানি। বাবা কুড়িটা ঘুমের ট্যাবলেট খেয়েছিলেন। বাবা লিখে রেখে গেছিলেন, আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়। তার আগের রাতে মা আমাকে নিয়ে তোমার কাছে চলে এসেছিল। ঠিক বলিনি? আমার সব মনে আছে। আমার বাবা, প্রিয় বাবা, আমাকে নিয়ে কত স্বপ্ন দেখতেন। তিনি দুম করে মরে যাবেন কেন, তাঁকে তোমরা সবাই মিলে কিছু একটা করেছ—আমার কাজ সেই কিছুটা কী বের করা।

রাসবিহারী উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর হাত পা কাঁপছিল। তিনি ধীরে ধীরে ঘর থেকে বের হয়ে যাচ্ছেন। নানু চোখ তুলে দেখল, মানুষটা অনেক নুয়ে পড়েছে।

সে বলল, চলে যাচ্ছ কেন দাদু। আমার কথার জবাব দাও। এই আত্মহত্যায় কার হাত ছিল বলে যাও? তাদের সবাইকে আমি ফাঁসিকাঠে ঝোলাব।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26
Pages ( 1 of 26 ): 1 23 ... 26পরবর্তী »

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *