Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » সাবির হাকার কবিতা || Sankar Brahma

সাবির হাকার কবিতা || Sankar Brahma

১৯৮৬ সালে ইরাণের পশ্চিম প্রান্তে কার্মানশা প্রভিন্সে তাঁর জন্ম হয় সাবির হাকার। এখন তিনি থাকেন ইরাণের তেহরানে। নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে সেখানে কর্মরত। যে নির্মান সংস্থার হয়ে কাজ করেন, সেখানে তাদের প্রয়োজনে তাকে মাথায় করে ইঁট বালি সিমেন্ট বইতে হয়। নির্মাণ শ্রমিক হলেও তিনি কবিতা লেখেন মনের তাগিদে। তাঁর কবিতা আমাদের বিবেককে ঝাঁকুনি দেয়। হৃদয়ে আলোড়ন তোলে।

অন্য এক ধূসর জগতের ছবি ফুটে ওঠে সাবিরের কবিতায়। দেশের শোষিত নিপীড়িত শ্রমিক জীবনের ব্যথা-বেদনা অন্য মাত্রায়, অনন্য ভাবনার গভীরতায়, ভাষায় প্রকাশ পায়। তিনি রবার্ট ফ্রস্টের মতো, তাঁর হাতে কলম নিলেই ফুটে ওঠে নানা রঙের কাব্যকলি, আর কাস্তে হাতে নিলেই মাটি ফুঁড়ে বের হয় নানা ধরনের সবুজ শাক-সবজি। সাবির হাকা অভিজাত জাতের না বলেই তাঁর মননে-বুননে, আমেজে-মেজাজে শ্রমজীবী মানুষের প্রতিনিধিত্ব ফুটে ওঠে। অসম কিংবা ভারসাম্যহীন সমাজে তিনি এক আশ্চর্য প্রতিভা। তিনি যেন এল সালভাদোরের কবি রোকে ডাল্টন, কিংবা পুয়ের্তোরিকোর কবি হুলিও দি বুর্হোস, অথবা গুয়াতেমালার সেই লড়াকু কবি ওতো রেনে কাস্তিও মতো, প্রবাদে না হলেও প্রতিবাদে তো বটেই।
তিনি কবি হলধর নাগের যোগ্য উত্তরসূরী। বাংলাদেশের ঝিনাইদহের গরিব কবি গুলজার হোসেনের সঙ্গে তার তুলনা চলে।

সাবির বলেছেন, তেহরানে ঘুমোবার মত তাঁর কোন জায়গা নেই। কখনো সারা রাত হেঁটে হেঁটে ঘুরে বেড়ান। যেন পথে পথে জীবন খুঁজতে থাকেন। ফলে তিনি একটি উপন্যাস লেখা শুরু করেও শেষ করতে পারছেন না, তাঁর থাকার মতো কোন জায়গা নেই বলে। অনেকের মতো তাঁরও কোন সামাজিক সুরক্ষা নেই। দারিদ্রকে আলাদা করে তাঁকে চিনতে হয় নি। জীবনের গোড়া থেকেই দারিদ্রের বিরুদ্ধে কঠোর সংগ্রাম ছিল তার, আজও তা অব্যাহত।
তাঁর কষ্টের সুরে সুর মিলিয়ে গুলজার হোসেন গেয়ে ওঠেন ‘সাবির হাকা সাড়া দাও/এখানে অনেক শ্রমিক বন্ধু আছে তোমার’।

ইতিমধ্যে তাঁর দুটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু কাব্যদেবী আশীর্বাদে তাঁর দুটো ডাল-ভাতের ব্যবস্থা হয়নি আজও। একটি প্রতিযোগিতায় ২০১৩ সালে ইরানের শ্রমিক-কবি হিসাবে তিনি প্রথম স্থান অধিকার করেন।

একটি সাক্ষাৎকারে সাবির বলেছিলেন, “আমি ক্লান্ত। বড়ই ক্লান্ত। আমার এই ক্লান্তি আমার জন্মের আগে থেকেই ছিল। আমার মা আমাকে পেটে ধরার সময়ে লাগাতার মজদুরী করেছিলেন, সেই তখন থেকেই আমি মজদুর ব’নে গেছি। আমি আমার মায়ের ক্লান্তি অনুভব করি। মা’র ক্লান্তি যেন এখনো আমার শরীরে লেগে আছে।”

২০১৮ সালে সাবিরের কিছু কবিতা ‘আয়নানগর’ বইমেলা সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। ‘আয়নানগর’ ও অন্যান্য স্থান থেকে সংগৃহীত সাবির হাকার কুড়িটি কবিতা।

১).
ভরসা
—————————–

আমার বাবা ছিলেন একজন
আস্থাবান, নিষ্ঠাবান শ্রমিক
যখনই উনি নামাজ পড়তে বসতেন
(আল্লাহ) ওঁর হাতদুটো দেখে
লজ্জায় লাল হয়ে যেতেন।

২).
তুঁতফল
—————————–

আপনি কি কখনো তুঁতফল দেখেছেন?
যেখানে পড়ে, সেইটুকু মাটির ওপর
ওর লাল রসের দাগ হয়ে যায়
পড়ে যাবার মতো যন্ত্রণাদায়ক আর কিছু নেই
আমি কত মজদুরকে দেখেছি
বড় বড় ইমারত থেকে পড়ে যেতে…
আর পড়ে গিয়ে,
ঠিক তুঁতফল হয়ে মরে যেতো।

৩).
ঈশ্বর
—————————–

ঈশ্বরও নিশ্চয় একজন মজদুর!
ঈশ্বর যেন সর্বশ্রেষ্ঠ ঝালাই মিস্ত্রী
গোধূলি-আলোতে ঈশ্বরের চোখ লাল হয়ে ওঠে,
যেন জ্বলন্ত কয়লা
আর রাত্রি পর্যন্ত শতছিদ্র হয়ে যায় তাঁর জোব্বা!

৪).
মৃত্যু
—————————–

একরাতে মা বলল
সে নাকি জানে মৃত্যুকে কেমন দেখতে
তার নাকি ইয়াব্বড় ঘন গোঁফ
আর চওড়া সুগঠিত কাঁধ, যেন কোন বডিবিল্ডার
সেই রাত থেকে আমার নিষ্পাপ নিরীহ মা’কে
আমি সন্দেহের চোখে দেখি।

৫).
বন্দুক
—————————–

ওরা যদি বন্দুক আবিষ্কার না করতো
কত মানুষ বেঁচে থাকতো আজ!
যাদেরকে দূর থেকেই মেরে ফেলতে পারলো ওরা!
শুধু তাই নয়, আমার মনে হয়,
আরও অনেককিছুই অনেক সহজ হতো।
মজদুরের যে আসলে কতটা শক্তি,
তাও ওদেরকে বোঝানো সহজ হতো!
যদি বন্দুকের আবিষ্কার না হতো…….

৬).
সরকার
—————————–

পুলিশ আমাকে খুঁজছে
আমি কাউকে খুন করিনি
এমনকি সরকারবিরোধী কোনো লেখাও লিখিনি!
শুধু তুমি জানো আমার প্রিয়তমা
জনতার পক্ষে কি ভয়ঙ্কর ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে,
যদি সরকার শুধু এই জন্যে ভয় পায় আমাকে
যে আমি একজন মজদুর!
যদি আমি বিপ্লবী বা বিদ্রোহী হতাম, তাহলে?
কি করতো ওরা তাহলে?
তবুও বলি, সেই বাচ্চাটার জন্যে
পৃথিবীটা আজও খুব একটা বদলায়নি
যে স্কুলের প্রত্যেকটা বই এর প্রচ্ছদে
নিজের ছবি দেখতে চেয়েছিল…

৭).
পেশা নির্বাচন
—————————–

ব্যাঙ্কের সাধারণ একজন কর্মচারি হওয়া আমার দ্বারা হত না
খাবার দাবার ফেরি করা সেলসম্যানও না
কোন পার্টির নেতা হওয়াও আমার কম্ম নয়
ট্যাক্সি ড্রাইভার তো নয়ই
প্রচারে লেগে থাকা মার্কেটিং এর বান্দাও আমি নই
আমি শুধু চাইতাম
শহরের সবথেকে উঁচু জায়গাটায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখব
নিচের ঝলমলে বাড়িগুলোর মধ্যে কেমন দেখায় ওই মেয়ের ঘর
যাকে আমি ভালবেসেছি
তাই শেষমেশ ঢালাইয়ের মজদুর হয়ে গেলাম…

৮).
ঘর
—————————–

তোমরা যদি বলো, সারা দুনিয়াকে আমি ওই নামে ডাকতে পারি!
দুনিয়ার সব দেশ, সব গ্রামকেও ডাকতে পারি ওই নামে।
আর আকাশ? হ্যাঁ তাকেও দিতে পারি ওই নাম!
সারা ব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত কিছুকে ওই নাম মুহূর্তও দ্বিধা করবো না আমি!
কিন্তু দোহাই তোমাদের!
তেহরান এর ভাড়া করা জানলাবিহীন এই কালকুঠরীকে
তোমরা ওই নামে ডাকতে বোলো না !
আমি একে ঘর বলে কিছুতেই ডাকতে পারবো না!

৯).
আমার বাবা
—————————–

বাবার ব্যাপারে কিছু বলার সাহস যদি করে উঠতে পারি
তাহলে বিশ্বাস করুন,
বাবার জীবনে আনন্দ বলে কখনোই তেমন কিছু ছিল না
এই লোকের জীবন নিজের পরিবারের জন্য নিবেদিত ছিল
পরিবারের ঘাটতি যাতে লোকচক্ষুর আড়ালে থাকে
সেজন্য নিজের জীবনকে কঠিন, বন্ধুর বানাতে দ্বিধা করেননি তিনি
আর আজ
যখন আমার কবিতা ছাপা হয়ে বেরোয়
শুধু একটা কথা ভাবলেই মাথা হেঁট হয়ে যায় লজ্জায়
বাবা আমার লেখা পড়তে পারেন না।

১০).
বন্ধুত্ব
—————————–

আমার সাথে (ঈশ্বরের) বন্ধুত্ব হয়ে ওঠেনি
তার কারণ একটাই
বহুদিন আগে ঘটা একটা ঘটনা;
তখন আমাদের ছয় জনের পরিবার
একটা ছোট্ট কামরায় কোনমতে চাপাচাপি করে থাকতাম
অথচ (ঈশ্বর) থাকতেন একটা বিশাল বাড়িতে
একেবারে একা।

১১).
বর্ডার
—————————–

কাফন যেমন লাশকে ঢেকে রাখে
বরফও অনেক কিছুকে ঢেকে দেয়।
ইট কাঠের কংকাল বেরিয়ে পড়া বাড়ি,
গাছ, কবর সবকিছুকেই সাদা চাদরে ঢেকে দেয় বরফ
শুধু বরফই পারে
দুনিয়ার সকল বর্ডারকে সাদা রঙে ঢেকে দিতে।

১২).
তিক্ততা
—————————–

যাপিত জীবনে
আমি মোটেও পারব না
বাবার মতো সহ্য করতে।
বাবা ছিলেন ধর্মভীরু,
কান্নাকাটি করতেন
যেন হয় পাপ মোচন।

কিন্তু আমি
এই ঈশ্বরকেই খুন করতে চেয়েছি।
যেহেতু আমি টের পেয়েছি
মায়ের অনুপস্থিতি
আর জীবন থেকে শিখেছি
জন্ম-মৃত্যু দুটোই তার হাতে নেই
আর মৃত্যুর জন্য বাহাদুরি লাগে না
শুধু একটি কারণই যথেষ্ট।

১৩).
একমাত্র ভয়
—————————–

যখন আমি মারা যাবো,
সঙ্গে নিজের সব প্রিয় বই নিয়ে যাবো আমি!
আমার কবর-বাড়ি ভরে দেব তাদের ছবি দিয়ে,
যাদের আমি সীমাহীন ভালোবাসি।
ভবিষ্যতের কোনো দুশ্চিন্তাই আমার সেই নতুন বাড়িতে থাকতে পারবে না!
আমি শুয়ে থাকবো বে-ফিকির,
সিগারেটের পর সিগারেট জ্বালাবো
আর ফুঁপিয়ে উঠবো তাদের কথা ভেবে,
যে সব মেয়েদের আমি কখনও ভালোবেসেছিলাম,
আর যাদের জড়িয়ে ধরে বাঁচতে চেয়েছিলাম!
এই সমস্ত সুন্দর ভাবনার ভেতরেও শুধু একটা মাত্র ভয় থেকে যাবে কোথাও!
যদি কোনো এক দিন, ভোর না হতেই,
কেউ আমার কাঁধে ধাক্কা দিয়ে উঠিয়ে আমায় আবার বলে,
“চল রে সাবির! কাজে বেরোতে হবে!”

১৪).
শ্রমিক
—————————–

সাদাসিধে জীবন
আর আছে
সুন্দরী জীবনসঙ্গী।

কাজ শেষে
যখন ঘরে ফেরে
গগনচুম্বী সব ভবন থেকে
বাড়ি নিয়ে যায়
তুলতুলে
সাদা মেঘ।

১৫).
আমিও শ্রমিক
—————————–

আমার গলায় যেন অনেক ভারি বেদনা চেপে আছে
পিচের উপর দিয়ে রোলার গেলে যেমন হয়।
রোলার চলতে থাকে
রোলার চলতে থাকে স্বপ্নের মধ্যেও
নিঃশব্দ ঘুমে
কাজ পাগল শ্রমিকরা
শরীরের হাড়গোড়ের ওপরও কাজ করতে থাকে
আমিও শ্রমিক।

১৬).
বড় হওয়া
—————————–

আমি বড় না হলেই ভালো হতো
আর আমি আজও বুঝিনি
বাবা কেন এই মিথ্যাটা বলেছিল যে
কোনো কিছু মাটিতে পুঁতে দিলেই
তা সবুজ হয়ে উঠে আসবে
আর এটা নাকি খোদার রহমত!
কিন্তু এটা কেউ কেন বোঝে না যে
আমি অনেক বছর অপেক্ষা করছি
তবুও তো মা উঠে এলো না।

১৭).
ভয় পাওয়া
—————————–

সারা জীবন আমি একটা নীতি অনুসরণ আসছি :
মিথ্যা বলব না,
কারও মন ভাঙব না
এবং
যে কোনও ক্ষতিকে জীবনের অংশ হিসেবেই মেনে নেব।
এরপরও আমি মরতে খুব ভয় পাই।
মরে যদি আবার শ্রমিক হই!

১৮).
ফাঁকি দেওয়া
—————————–

কাজ ফাঁকি দেওয়ার জন্য
আমি টয়লেটে গিয়ে বসে থাকি
কিংবা নিজেকে আহত করি ইচ্ছাকৃত
আর সব সময় নিজেকে এমনভাবে ফাঁকি দেই
যেন বাড়ির কথা মনেই পড়ে না
কাজ শেষে যখন আসমান ছুঁই ছুঁই ইমারতে
বসে থাকি
দেখতে থাকি কেমন করে
আস্তে আস্তে চিমনি থেকে বের হতে থাকে
নীরব রাত্রি।

১৯).
যাওয়া
—————————–

মধ্যাহ্ন বিরতি
এখনও অর্ধেক দিন বাকি
আমি ও মৃত্যু চোখাচোখি,
পাশ কাটিয়ে চলে গেলাম
সে যাচ্ছে শহরে
আমি যাচ্ছি কবরে।

২০).
অভাগা
—————————–

তুমি যদি আমাকে ছেড়ে যাও
আমিও হয়ে যাব সেই অভাগা শ্রমিকের মতো
যার এইমাত্র চাকরি গেছে।

—————————————————————-
[ সংগৃহীত ও সম্পাদিত ]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *