নীল পলাশের আহ্বানে
বই মেলার নয় নম্বর গেট দিয়ে ভেতরে ঢোকার মুখেই দেখা হয়ে গেল নীলাশা আর পলাশের সাথে । ইউনিভার্সিটিতে ওরা আমার সহপাঠী ছিল ; তখন বই পাড়ায় ঘোরা আর কফি হাউজে আড্ডা দেওয়া নিয়মিত ছিল। বছর ছয় সাতেক ওদের সাথে যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছিল। হঠাৎই ওদের সাথে দেখা হতেই সবাই উচ্ছসিত হয়ে উঠলাম। বইমেলার ভেতরেই একটা কপিশপে তিনজনের তুমুল আড্ডা জমে উঠলো। ইউনিভার্সিটিতে থাকার সময়েই নীলাশা আর পলাশের প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে; মাস্টার্স কমপ্লিট করার পর দুই পরিবারের সম্মতিতেই ওদের বিয়ে হয় । বিহারের মধুপুরে কেন্দ্রীয় বন বিভাগের করনিক হিসেবে কাজে যোগ দেয় পলাশ তারপর নীলাশাকে নিয়ে সংসার পাতে বন বিভাগের এক বাংলোয়। কয়েক মাসের মধ্যে নীলাশাও মধুপুরে এক বেসরকারি স্কুলে চাকরি পেয়ে যায়। এখন ওরা ভীষণ খুশি সুখী দম্পতি । ছোট ছোট টিলা ঝর্ণা নদী জঙ্গলে ভরা মধুপুরে ওদের পাঁচটা বছর কেটে গেছে ; প্রকৃতি যেন নিজের হাতেই সাজিয়ে দিয়েছে এলাকাটা ।
এক সময় পশ্চিমে বলতে বাঙালির কাছে এই অঞ্চলটাকেই বোঝাত; বাঙালির স্বাস্থোদ্ধারের জায়গাও ছিল এখানেই। এখানে বড় বড় বাড়িগুলো সব অভিজাত বাঙালিদের। উপজাতি জনজাতি অধ্যুষিত এই এলাকায় কিভাবে বাঙালিদের এত প্রভাব প্রতিপত্তি সে এক অন্য গল্প। যে কারণে এক মাসের ব্যবধানে আমি মধুপুরে ছুটে এলাম তা ওদের একটা কথা শুনে। কফি খেতে খেতে নীলাশা আর পলাশ বললো চলে আয় মধুপুরে তোকে একটা রেয়ার জিনিস দেখাবো। জিজ্ঞাসু চোখে তাকাতেই নীলাশা বললো সাসপেক্ট থাক দোলের দিন আয় নিজের চোখে দেখতে পারবি। আমি নাছোড়বান্দা আগে বল একমাস এই টেনশন নিতে পারবো না। অবশেষে ভবি ভুলল নীলাশা বললো তুই লাল গোলাপী কমলা সাদা রঙের পলাশ দেখেছিস কিন্তু নীল পলাশ? খুবই রেয়ার দেখা যায় কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে এই নীল পলাশের একটা গাছ ওদের বাংলোর কাছের জঙ্গলে আছে। ফাল্গুন চৈত্রে ফুলে ফুলে ভরে যায় গাছটি। শুধু নীল পলাশ দেখার জন্য বাইরে থেকে অনেক মানুষ আসে। পলাশ বললো; আয় নীল পলাশ দেখার জন্য তোর আমন্ত্রণ রইল ••••
এক মাস পর দোলের আগের দিন নীলাশাদের অবাক করে দেব এই ভেবে কলকাতা থেকে রওনা দিলাম পূর্বা এক্সপ্রেসে। মধুপুরে নেমে একটা রিক্সা নিয়ে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে বন বাংলোয় গিয়ে হাজির হলাম । রিক্সাওয়ালা কেমন যেন অবাক চোখে আমাকে দেখে ভাড়া নিয়ে চলে গেল।
বাংলোটা খুব সাজানো গোছানো অনেকটা জায়গা নিয়ে তৈরি রাস্তা থেকে নুড়ি বিছানো পথ সোজা চলে গেছে বাংলোর সদর দড়জা পর্যন্ত। হরেক প্রজাতির গাছ রকমারি ফল আর নানান ধরনের ফুলের গাছে সাজানো বাংলোর চতুর্দিক। গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকে বাংলোর দড়জার সামনে দাঁড়াতেই ভেতর থেকে পলাশের উচ্ছসিত গলা ভেসে এলো; আমরা জানি তুই আজ আসবি নীল পলাশের টান অমোঘ তোকে আসতেই হবে বলতে বলতে পলাশ আর নীলাশা সামনে এসে দাঁড়ালো। আদর করে ঘরের ভেতরে ডেকে নিয়ে সাজানো ড্রয়িংরুমে বসতে বললো। পাশের একটা ঘর দেখিয়ে নীলাশা বলল এটা তোর রুম ; খেয়ে দেয়ে একটু রেস্ট নে রাত গভীর হলে পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় দেখতে যাব নীল পলাশ গাছ ; জ্যোৎস্না রাতের আলোয় খুব মায়াবী দেখাবে নীল পলাশ ফুল । রাতে খাওয়ার টেবিলে তিনজন একসাথে বসে খেলাম রুটি আর বনমোরগের কষা মাংস। রাত গভীর হতেই পলাশ বললো চল এবার বেরোই; গভীর রাতে তিন জন চলেছি নীল পলাশ দেখার জন্য। এবড়ো থেবড়ো পথ জঙ্গলে পরিপূর্ণ নিশাচর প্রাণী ও সাপ খোপের ভয় অস্বাভাবিক নয়; তবু চলেছি পুরনো দিনের নানান কথা বলতে বলতে। প্রায় ঘন্টা খানেক চলার পর একটা টিলার সামনে এসে দাঁড়ালাম আমরা। পলাশ একটা গাছের দিকে আঙ্গুল তুলে দেখালো ঐ দেখ নীল পলাশ! আমি অবাক বিস্ময়ে দেখছি চাঁদের আলোয় কি মোহময় দেখাচ্ছে গাছটিকে ; রাতের অন্ধকারে জোনাকির মতো জ্বলছে গাছটি। গভীর রাতে জঙ্গলের এক নিজস্ব ভাষা আছে; এরকম অভিজ্ঞতা আমার জীবনে কখনো হয়নি। সীমাহীন মুগ্ধতা বাকরুদ্ধ করে দেয় ; হারিয়ে যায় পারিপার্শ্বিক পরিবেশের কথা। কতক্ষণ জানিনা পূবের আকাশে দেখা দিচ্ছে সোনালী আলো জঙ্গল জেগে উঠছে ; পাখিদের কলকাকলিতে একটা ঘোরের থেকে জেগে উঠলাম আমি; নীল পলাশের উপর ভোরের আলো খেলা করছে কিন্তু আশেপাশে নীলাশাদের দেখছি না; ওরা কোথায়? আমি প্রাণপণে চিৎকার করছি ওদের নাম ধরে কিন্তু ওদের কোন সাড়া শব্দ নেই কোন। মুগ্ধতা ছেড়ে এবার ভয় গ্রাস করছে আমাকে ; উদভ্রান্তের মতো ছুটছি জঙ্গল থেকে বের হয়ে আসার জন্য ;
বাবুজি এখানে শুয়ে আছেন কেন? ভাঙা হিন্দিতে যে লোকটা জিজ্ঞেস করল সে বনবিভাগের চৌকিদার গতকাল আমাকে দেখেছিল রিক্সায় আসতে। আমার মুখে সব কথা শোনার পর শিউরে উঠল সে তারপর বললো গত পরশু রাতে মেম সাহেব আর সাহেবের আঁচড়ানো কামড়ানো ডেডবডি পাওয়া গেছে নীল পলাশ গাছের কাছে; মনে হয় ভালুক আক্রমণ করেছিল গতকাল সকালে পুলিশ ওনাদের বডি থানায় নিয়ে যায় এখন হাসপাতালের মর্গে আছে; চলুন ঘটনাটা থানায় জানাতে হবে। সব শুনে থানার অফিসার ইনচার্জ বললেন চলুন মর্গটা একবার ঘুরে আসি; মর্গের দড়জা খুলে সাদা চাদরে ঢাকা দুটো ডেডবডি দেখিয়ে বললেন দেখুন তো এরাই কিনা? সনাক্তকরণের জন্য ওদের বাড়িতে খবর পাঠানো হয়েছে ওনারা এলে ডেডবডি হ্যান্ডওভার করা হবে; বলতে বলতে উনি মুখ থেকে চাদরটা সরিয়ে দিলেন। আমার শরীর শিউরে উঠল দ্বিতীয় বারের জন্য জ্ঞান হারানোর আগে আমার মনে হলো একি দেখছি আমি চাদরের নিচে যে দুটি নিথর দেহ শুয়ে আছে তা নীলাশা আর পলাশের।