Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » মনের মতো বউ (ভূতনাথের ডায়েরি) || Anish Deb

মনের মতো বউ (ভূতনাথের ডায়েরি) || Anish Deb

ভূতনাথের ডায়েরি : মনের মতো বউ

‘পাওয়া ভারী দুষ্কর।’ পান চিবোতে-চিবোতে মন্তব্য করলেন বরেন মল্লিক।

‘কেন, মনের মতো বউ পাওয়া দুষ্কর কেন?’ চায়ের কাপে লম্বা চুমুক দিয়ে জানতে চাইলেন প্রিয়নাথ।

সুপ্রকাশ পালিতের বৈঠকখানায় বসে কথা হচ্ছিল। সময়টা চৈত্র মাস। সামনের বৈশাখে বরেন মল্লিক তাঁর বড় ছেলের বিয়ে দেওয়ার কথা ভাবছেন। তাই রোজই আনন্দবাজারের পাত্র-পাত্রীর বিজ্ঞাপনের পাতায় হুমড়ি খেয়ে পাত্রী খুঁজছেন। আর চেনা-জানা লোকজনকেও একটি ‘ফরসা, সুন্দরী, গ্র্যাজুয়েট, গৃহকর্মে নিপুণা, বছর তেইশ-চব্বিশের সম্পন্ন ঘরের’ সুপাত্রী খোঁজ করার জন্য বলেছেন।

বরেন মল্লিক আড়মোড়া ভেঙে হাতের পিঠ দিয়ে গলার ঘাম মুছে বললেন, ‘এই তো একমাস ধরে হন্যে হয়ে খুঁজছি। মনের মতো বউ পেলাম কই!’

বৃদ্ধ জগৎ শ্রীমানী খিকখিক করে হেসে উঠলেন, বললেন, ‘বাবা বরেন, তুমি বউ খুঁজছ, না বউমা খুঁজছ?’

এ-কথায় গম্ভীর প্রকৃতির সুপ্রকাশ পালিতও হেসে ফেললেন : ‘না, না, জগৎবাবু, বরেনবাবু বউমা খুঁজছেন—বউ নয়। তাই তো, বরেনবাবু?’

প্রশ্নটার ভেতরে একটা চাপা ঠাট্টা ছিল। বরেন মল্লিক সেটা সহজেই টের পেলেন। খানিকটা উত্তেজিত হয়ে হাত নেড়ে জবাব দিলেন, ‘আমি রাজা নবকৃষ্ণ স্ট্রিটে থাকি, রাজা নবকেষ্ট নই। দুটো বউ খোঁজার আমার মুরোদ কোথায়! আমি বলছি, ইন জেনারেল, মনের মতো বউ খুঁজে পাওয়া খুব দুষ্কর। সে নিজের বউই হোক, বা ছেলের বউই হোক।’

ভূতনাথ বললেন, ‘আপনার যা চাহিদা তাতে হয়তো সুপাত্রী খুঁজে পেতে আপনাকে অনেক কাঠ-খড় পোড়াতে হবে। তবে এটা জেনে রাখুন, কেউই নিখুঁত নয়। সংসার করার সময় খুঁতগুলোকে মানিয়ে নিতে হয়।’

‘আপনি নিজে সংসারী না হয়েও সংসারের অনেক সিক্রেট খবর রাখেন দেখছি!’

ভূতনাথ খোঁচাটা গায়ে না-মেখে বললেন, ‘একটা কথা আপনাকে জানিয়ে দিই, মল্লিকমশাই। মনে-মনে কারও যদি নিখুঁত মনের মতো বউয়ের চাহিদা থাকে, তা হলে তার কপালে অনেক দুঃখ আছে।’

‘কেন, হঠাৎ এ-কথা বলছেন কেন?’ সুপ্রকাশ পালিতের চোখে কৌতূহল ফুটে উঠল।

চায়ের পালা শেষ করে একটা সিগারেট ধরালেন প্রিয়নাথ। একটু সময় নিয়ে ধীরে-ধীরে বললেন, ‘আপনাদের বিয়ের ব্যাপার নিয়ে কথা হচ্ছিল…শুভ ব্যাপার। আর আমি যা বলব সেটা ঠিক শুভ নয়। এমনিতেই তো আমার বদনাম আছে, যে-কোনও আলোচনাতেই আমি ভূত-প্রেত-অলৌকিক এসব ব্যাপার টেনে আনি। আসলে আমি যা নিয়ে পড়াশোনা করেছি সেই সিলেবাসে শুধু এগুলোই ছিল। আর যে-ঘটনার কথা বলব বলে ভাবছি তার মধ্যেও আপনাদের অপছন্দের ওইসব ব্যাপার রয়েছে…।’

ভূতনাথের কথায় সবাই কেমন চুপচাপ হয়ে গেলেন। মাথার ওপরে কাঠের ব্লেডওয়ালা একটা সিলিং পাখা যথাসাধ্য জোরে ঘুরছিল। শুধু তারই ক্যাঁচকোঁচ শব্দ শোনা যেতে লাগল।

প্রিয়নাথের সিগারেটের ধোঁয়া পাখার বাতাসের ঘূর্ণিপাকে এলোমেলো ছুট লাগিয়ে মিলিয়ে গেল।

জগৎ শ্রীমানী শব্দ করে শ্বাস টানলেন। বরেন মল্লিক পান চিবোনো আপাতত বন্ধ করলেন। আর সুপ্রকাশ পালিত অপেক্ষা করছিলেন। ভূতনাথের কাহিনি তাঁর কাছে মদের নেশার মতো।

বরেন মল্লিক ইতস্তত করে জানতে চাইলেন, ‘ব্যাপারটা কি বউ নিয়ে?’

‘বউ নিয়ে নয়—মনের মতো বউ নিয়ে।’ আবার সিগারেটে টান দিলেন প্রিয়নাথ।

জগৎ শ্রীমানীর মুখ থেকে মজা মিলিয়ে গিয়েছিল। বেশ সিরিয়াস গলায় তিনি বললেন, ‘ব্যাপারটা কি আমরা শুনতে পারি? বরেন, তোমার নিশ্চয়ই গল্প শোনার ব্যাপারে কোন ছুচিবাই নেই?’

অন্য সবাই যখন চাইছেন তখন অ-রাজি হওয়ার কোনও মানে হয় না। মুখে অনেকটা এইরকম ভাব ফুটিয়ে বরেন মল্লিক বললেন, ‘না, না, আপত্তির কী আছে!’

প্রিয়নাথ সিগারেটে শেষ টান দিয়ে টুকরোটা অ্যাশট্রেতে গুঁজে দিলেন। তারপর চোখের চশমাটা সামান্য ঠিক করে, ছোট্ট করে কাশলেন। এবং বলতে শুরু করলেন।

‘ভদ্রলোকের নাম, ধরা যাক, বিধানপতিবাবু। পদবি নিয়ে আর মাথা ঘামাচ্ছি না। ওঁর সঙ্গে যখন আমার দেখা হয় তখন একটা অদ্ভুত ব্যাপার আমার নজরে পড়ে। ওঁর চোখের পাতা দুটো একসঙ্গে ওঠা-নামা করে না। নিজের খুশিমতো চোখের পাতা দুটো পড়ে। অর্থাৎ, আমাদের চোখের পাতাজোড়া যেমন সবসময় একসঙ্গে একই ছন্দে পড়ে, ওঁরটা একেবারেই তেমন নয়। আমাদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা সিনক্রোনাস—আর, ওঁর বেলায় অ্যাসিনক্রোনাস। ওঁর জীবনে একটা বাজে দুর্ঘটনা ঘটেছিল। তারপর থেকেই ওঁর চোখের ব্যাপারটা ওরকম হয়ে গেছে। প্রথম-প্রথম ডাক্তার-টাক্তার দেখিয়ে চেষ্টাচরিত্র করেছেন। পরে শরীরের এই খুঁতটুকু মেনে নিয়েছেন।’ একটু থেমে ভূতনাথ বললেন, ‘অবশ্য…মানতে ওঁর বেশ কষ্ট হয়েছে। কারণ, বিধানপতিবাবু এমনিতে আগাপাস্তালা নিখুঁত মানুষ। অন্তত উনি তাই মনে করতেন। উনিও মনের মতো বউ চেয়েছিলেন…।’

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন প্রিয়নাথ জোয়ারদার।

বিধানপতিবাবু চায়ের কাপে চুমুক দিয়েই মুখটা বিকৃত করে ফেললেন। বিরক্তির একটা শব্দ করে বিচ্ছিরিভাবে চেঁচিয়ে বললেন, ‘চায়ে কেউ এত চিনি দেয়! চিনি তো বাজে খরচ হলই, চা-টাও মুখে দেওয়া গেল না। এরপর আবার ডায়াবেটিস হলে খরচের ফর্দ আরও লম্বা হবে। এত বছর ধরে চা করছ, চিনির আন্দাজটাও ঠিক করতে পারোনি!’

কথাগুলো এতটা চেঁচিয়ে না বললেও চলত। কারণ, বিধানবাবুর স্ত্রী শ্রীরাধা ডাইনিং স্পেসের লাগোয়া রান্নাঘরে তখন রান্না চাপিয়েছেন।

শ্রীরাধা কোনও জবাব দিলেন না। গত সাত বছরের অভিজ্ঞতায় শ্রীরাধা জেনে গেছেন স্বামীর এই ধরনের অভিযোগের সাফাই দিতে গেলে ওঁর বিরক্তি বেড়ে যায়—ব্যাপারটা আরও খারাপ দিকে গড়ায়। তাই ছোট্ট করে জবাব দিলেন—’অখেয়ালে ভুল হয়ে গেছে।’

বিধানবাবু আরও কিছুক্ষণ চাপা গলায় গজর-গজর করলেন। মনে হল, ব্যাপারটা আরও খানিক গড়ালে তিনি তৃপ্তি পেতেন।

চা খেতে খেতে টিভি দেখছিলেন বিধানপতি। এমন সময় টেলিফোন বেজে উঠল। চায়ের কাপে লম্বা চুমুক দিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লেন। টিভির দিকে চোখ রেখেই হাত বাড়ালেন কর্ডলেস ফোনের কালো হাতলটার দিকে।

এবং সঙ্গে-সঙ্গেই থমকে গেলেন।

‘এ কী! টেলিফোনের কভারটা এরকম উলটোপালটা করে কে রাখল!’

শ্রীরাধা রান্না ছেড়ে ব্যস্ত পায়ে চলে এলেন ডাইনিং স্পেসে : ‘কেন, কী হয়েছে?’

‘কী আবার হবে!’ ঝাঁঝিয়ে উঠলেন বিধানপতি, ‘কভারটা কীভাবে রাখা আছে দেখেছ?’

ফোন তখনও একনাগাড়ে বেজে চলেছে।

শ্রীরাধা নরম গলায় বললেন, ‘এখুনি ওটা ঠিক করে দিচ্ছি। তুমি আগে ফোনটা ধরো…।’

বিধানবাবু ফোন তুলে ‘হ্যালো’ বললেন। ওঁর অফিসের বন্ধু সুজন ফোন করেছে। তিনি টেলিফোনে হেসে-হেসে কথা বলতে লাগলেন। অসুবিধে হওয়াতে টিভির রিমোটটা ডাইনিং টেবিল থেকে তুলে নিয়ে টিভির ভলিউম কমিয়ে দিলেন। তারপর কর্ডলেস ফোনের হাতল নিয়ে চেয়ারে এসে বসলেন। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে টেলিফোনে কথা চালিয়ে গেলেন।

শ্রীরাধা রান্নাঘরে ঢুকে পড়েছিলেন আবার। রান্না করতে-করতে নিজের কপালের কথা ভাবছিলেন।

শ্রীরাধার স্বামীকে দেখে অনেকেই ওঁকে হিংসে করে। কারণ, বিধানপতির চেহারা সত্যিই পুরুষের মতো। টকটকে ফরসা গায়ের রং, সুঠাম স্বাস্থ্য, সুন্দর নাক-মুখ-চোখ। বয়েস বিয়াল্লিশ হলেও দেখে মনে হয় পঁয়তিরিশ ছোঁননি।

বিধানবাবু কোনও কাজের ভার নিলে সেটা নিখুঁতভাবে শেষ করেন। কথা দিয়ে কথা রাখতে ভালোবাসেন। সময় ও নিয়ম মেনে চলাফেরা করা ওঁর আদর্শ।

বিয়ের সময় বিধানপতির সবকিছুই ভালো লেগেছিল শ্রীরাধার। কিন্তু তারপর ধীরে-ধীরে জানতে পেরেছেন ওঁর চব্বিশ ঘণ্টা অভিযোগের স্বভাব, আর খুঁটিয়ে জরিপ করে দেখতে পেয়েছেন ওঁর ফরসা কপালে তিনটে বিরক্তির ভাঁজ।

এমনিতে দোষটা হয়তো খুব মারাত্মক নয়, কিন্তু শ্রীরাধা যেন মাঝে মাঝে হাঁফিয়ে ওঠেন। ওঁর দম বন্ধ হয়ে আসে। শরীরটা হাঁসফাঁস করতে থাকে।

ইদানীং শ্রীরাধার ব্লাড প্রেসারও খুব মাথাচাড়া দিয়েছে। প্রথমবার স্বামীকে যখন হাই প্রেসারের ব্যাপারটা আঁচ করার কথা বলেন, তখন যথেষ্ট যত্ন করে তাঁর মেডিকেল চেক-আপের জন্য নিয়ে গিয়েছিলেন বিধানপতি। তবে পথে যেতে যেতে ওঁকে আলতো গলায় বলেছেন, ‘তোমাদের ফ্যামিলিতে নিশ্চয়ই হাই প্রেসারের ধাত আছে। তোমারটাও হয়তো বিয়ের আগে থেকেই ছিল।’

মাথায় আগুন জ্বলে গিয়েছিল, কিন্তু শ্রীরাধা কোনও জবাব দেননি। রাস্তার মাঝে বিশ্রী তর্কে ঢুকে পড়তে ওঁর মন চাইছিল না।

এরকম ছোট-ছোট ঘটনার চাপে শ্রীরাধা দিনকে-দিন যেন কাহিল হয়ে পড়েছেন। মাথাটা সবসময় কেমন পাগল-পাগল লাগে।

এই তো, একটু আগেই যে-মানুষটা চায়ের চিনি আর টেলিফোনের কভার নিয়ে অমন বিচ্ছিরিভাবে অভিযোগ করল এখন সেই মানুষটাই টেলিফোনে দিব্যি হেসে-হেসে কথা বলছে!

মানসিক চাপে অবসন্ন হয়ে কখনও কখনও আত্মহত্যার কথাও ভেবেছেন শ্রীরাধা। কিন্তু তখনই ওঁর মায়ের মুখটা ভেসে উঠেছে চোখের সামনে, তার পাশে অসহায় ছোট বোনের মুখ। শ্রীরাধা আর এগোতে পারেননি।

একদিন রাতে তর্ক অনেকটা এগিয়েছিল। কারণ শ্রীরাধা ওঁর মা-হতে না-পারা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। এই একটা ব্যাপারে বিধানপতি কখনও কোনও অভিযোগ করেননি। শ্রীরাধার ডাক্তারি পরীক্ষার জন্য জেদও ধরেননি। কারণ, তিনি বোধহয় ভেতরে-ভেতরে জানতেন গোলমালটা কোথায় হতে পারে। তাই তীব্র কোণঠাসা হয়ে পড়লে শ্রীরাধা কখনও-কখনও এই অস্বস্তিকর প্রসঙ্গ তুলে বিধানপতিকে খোঁটা দিতে চাইতেন।

এইরকম টালমাটাল দিনযাপনের মাঝে একদিন দেওয়ালে মাথা ঠুকে কাঁদতে-কাঁদতে শ্রীরাধা বলেছেন, ‘তোমার এই নিত্য অভিযোগের ঠেলায় কোনদিন অফিস থেকে ফিরে দেখবে আমি গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে আছি।’

উত্তরে বিধানপতি ঠান্ডা গলায় বলেছেন, ‘আলমারির ওপরে রাখা আমার ওই নাইলনের দড়ির বান্ডিলে যেন হাত দিয়ো না! আর সিলিং ফ্যানের সঙ্গে দড়ি বেঁধে ঝুলে পোড়ো না—পাখার ব্লেড ড্যামেজ হয়ে যেতে পারে। তারপর তো আবার থানা-পুলিশের ঝঞ্ঝাটে দু-চারদিন অফিস কামাই হয়ে যাবে।’

স্বামীর এই নির্লিপ্ত উত্তরে শ্রীরাধা খুব ধাক্কা খেয়েছিলেন। তর্ক থামিয়ে একেবারে চুপ করে গিয়েছিলেন।

বিধানপতির অভিযোগের স্রোত অবিরাম চলতে থাকল। সোয়েটারটা তিনদিন ধরে কাচা হচ্ছে না কেন? জুতোর কালি জায়গা মতো নেই কেন? বাথরুমের কল ঠিকমতো বন্ধ করা হয়নি কেন? সরষের তেল তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে গেল কেন? ইস্তিরির তারটা ঠিকমতো গুছিয়ে রাখা হয়নি কেন? ফ্রিজের গায়ে এই দাগ কোথা থেকে…। ওঁর খুঁত ধরার আর শেষ নেই!

একদিন শ্রীরাধা মাথা গরম করে বলে বসলেন, ‘খুঁত তো তোমারও আছে! আমি বললেই তুমি সেটা সারিয়ে ফেলতে পারবে? আমারগুলো আমি কিন্তু চেষ্টা করলেই সারাতে পারি। হুঁঃ…।’ শেষের শব্দটার মধ্যে এমন তীব্র এক তাচ্ছিল্য আর ঘৃণা মেশানো ছিল যে, বিধানপতি স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। কয়েক সেকেন্ড কোনও জবাব দিতে পারলেন না।

তারপর কোনওরকমে থতিয়ে থতিয়ে বললেন, ‘আমার ডিফেক্টের ব্যাপারটা তো এখনও মেডিক্যাল কনফার্মড হয়নি। তা ছাড়া এই ডিফেক্ট কি বাইরে থেকে দেখা যায়!’

শ্রীরাধা উত্তরে বিধানপতির কানে গরম সীসে ঢেলে দিলেন। মুখে আনা যায় না এমন নোংরা ভাষায় জবাব দিলেন স্বামীকে। তারপর হাঁফাতে হাঁফাতে বললেন, ‘গোপন খুঁত হলেই তার সাত খুন মাপ!’

বিধানপতি এ-অপমান ভুললেন না। তাই পরদিন থেকে স্ত্রীকে কথায়-কথায় অভিযোগ আর অপমানে ক্ষতবিক্ষত করতে লাগলেন। শ্রীরাধার মনে হল, ওঁর শরীরের দগদগে ঘায়ের ভেতরে গরম লোহার শিক গুঁজে দিয়ে কেউ যেন খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে কিছু খুঁজছে। যন্ত্রণায়-যন্ত্রণায় তিনি পাগল হয়ে গেলেন। যা-নয়-তাই করতে মন চাইল বারবার। মায়ের মুখ, ছোট বোনের মুখ মুছে যেতে চাইল চোখের সামনে থেকে।

একদিন সন্ধের আগে অফিস থেকে ফিরে বারবার কলিং বেল বাজিয়েও বিধানপতি শ্রীরাধার কোনও সাড়া পেলেন না। তখন পকেট থেকে চাবি বের করে সদর দরজার নাইটল্যাচে গুঁজে মোচড় দিলেন। দরজা তাও খুলল না।

বিধানবাবু বেশ অবাক হয়ে গেলেন। কারণ, শ্রীরাধা এ-সময়ে কখনও বাইরে যায় না।

দরজায় আবার ধাক্কা দিলেন। তবুও কেউ দরজা খুলল না।

যখন বিধানবাবু ভাবছেন দরজা ভাঙার জন্য লোকজন ডাকবেন কি না, ঠিক তখনই ভেতর থেকে কেউ দরজা খুলে দিল।

শ্রীরাধাকে দেখতে পেলেন বিধানপতি। কিন্তু শ্রীরাধা কোনও কথা না বলে ঘুরে চলে গেল বাড়ির ভেতর দিকে।

ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে ছিটকিনি এঁটে দিলেন বিধানবাবু। তারপর শ্রীরাধার ওপরে বিরক্ত হয়ে শোওয়ার ঘরে চলে গেলেন। অফিসের জামাকাপড় ছাড়তে শুরু করলেন।

সেখান থেকেই রান্নার আওয়াজ শুনতে পেলেন তিনি। শুনে একটু অবাক হলেন। এত তাড়াতাড়ি তো রান্না শুরু করেন না শ্রীরাধা!

ডাইনিং স্পেসের বেসিনে হাত-মুখ ধুতে এসে বিধানপতি দেখলেন, ডাইনিং টেবিলে ধোঁয়া-ওঠা গরম চা আর তার পাশেই প্লেটে দুটো বিস্কুট। এটা ঠিকই, তিনি অফিস থেকে ফিরে এসে রোজ চা-বিস্কুট খান। কিন্তু চোখের পলকে চা তৈরি হল কেমন করে!

হাত-মুখ ধুয়ে রান্নাঘরে উঁকি মেরে তিনি সে-কথাই জিগ্যেস করলেন শ্রীরাধাকে।

শ্রীরাধা একটা গোলাপি শাড়ি পরে রান্না করছিলেন। স্বামীর কথায় ফিরে তাকালেন না। শুধু অস্পষ্টভাবে বললেন, ‘তৈরি যখন হয়ে গেছে তখন খেয়ে নাও।’

বিধানপতি আন্দাজ করলেন, কোনও কারণে শ্রীরাধা রেগে আছেন। তাই কথা না-বাড়িয়ে চা খেতে বসে গেলেন।

চায়ের কাপে দু-চার চুমুক দেওয়ার পরই হঠাৎ ওঁর মনে হল কলতলায় কাপড় কাচার শব্দ হচ্ছে। এ-বাড়িতে কোনও কাজের লোক নেই। শ্রীরাধা রান্নাঘরে রান্না নিয়ে ব্যস্ত। তা হলে কাপড় কাচছে কে!

চায়ের কাপ ফেলে রেখে উঠে পড়লেন বিধানবাবু। ভুরু কুঁচকে এগোলেন কলতলার দিকে।

সেখানে গিয়ে অবাক হয়ে দেখেন একটা আকাশি শাড়ি পরে শ্রীরাধা স্বামীর জামাকাপড় কাচছেন।

বিধানবাবু অবাক হয়ে বলে উঠলেন, ‘কী ব্যাপার! তুমি না এক্ষুনি গোলাপি শাড়ি পরে রান্না করছিলে!’

কলতলার মেঝেতে উবু হয়ে বসে শ্রীরাধা কাপড় কাচছিলেন। ঘাড়-কাত করে তাকালেন স্বামীর দিকে। হেসে বললেন, ‘রান্না তো এখনও করছি।’

বিধানপতি কেমন যেন বিমূঢ়ভাবে ছুটে এলেন ডাইনিং স্পেসে। রান্নাঘরে উঁকি মারতে সাহস পেলেন না। কিন্তু শুনতে পেলেন শ্রীরাধা কড়াইয়ে খুন্তি নাড়ছেন।

কী করবেন ভাবছেন, ঠিক তখনই বিধানবাবু দোতলার ছাদে পায়ের শব্দ পেলেন। ছাদে কেউ হেঁটে বেড়াচ্ছে। কিন্তু তাতে এত জোরে-জোরে শব্দ হচ্ছে কেন!

পাগলের মতো ছাদে ছুটে গেলেন বিধানপতি। গিয়ে যা দেখলেন তাকে কোনও কিছু দিয়েই ব্যাখ্যা করা যায় না।

শ্রীরাধা ভেজা জামাকাপড় তারে ছড়িয়ে ক্লিপ আঁটছেন। পরনে একটা সবুজ ছাপা শাড়ি।

হতবাক বিধানপতি বউকে জিগ্যেস করলেন, ‘এর মধ্যেই তোমার কাচাকুচি হয়ে গেল! শাড়িটাই বা বদলে নিলে কখন?’

স্বামীর দিকে চেয়ে হাসলেন শ্রীরাধা : ‘আকাশি শাড়ি পরে কাপড় তো এখনও কাচছি! তোমাকে খুশি করতে হলে একটা নয়—চার-চারটে শ্রীরাধা দরকার।’

‘কীসব বলছ তুমি। চারটে শ্রীরাধা দরকার! তার মানে! এসব কী ব্যাপার! আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না!’

উত্তরে তিন নম্বর শ্রীরাধা হাসলেন আবার। বললেন, ‘চার নম্বর শ্রীরাধা ছাদের ওই কোণের দিকটায় আছে। ওকে দেখলেই সব বুঝতে পারবে।’

তৃতীয় শ্রীরাধার কথা মতো ছাদের কোণের দিকটায় এগিয়ে গেলেন বিধানপতি। সেখানে চতুর্থ শ্রীরাধাকে দেখতে পেলেন। ওঁকে দেখামাত্রই সবকিছু স্পষ্ট হয়ে গেল।

এই শ্রীরাধার দেহটা অগোছালোভাবে পড়ে রয়েছে। গলার নলী ফাঁক হয়ে সেখানে রক্ত জমাট বেঁধে রয়েছে। কয়েকটা মাছি উড়ে বেড়াচ্ছে। ওঁর পরনের হালকা হলুদ শাড়িতে রক্তের বিশ্রী ছোপ। অথচ ছাদে কোথাও রক্ত নেই। কারণ, মৃতদেহের চারপাশটা কেউ সুন্দর করে ধুয়ে-মুছে সাফ করে দিয়েছে।

সুতরাং, অভিযোগ করার মতো কিছুই পেলেন না বিধানপতি।

হঠাৎই শ্রীরাধার মৃতদেহ চোখ খুলে তাকাল বিধানবাবুর দিকে। ফ্যাকাসে ঠোঁট ফাঁক করে কথা বলল, ‘ছুরিটা ধুয়ে মুছে আলামারিতে আগের মতো সাজিয়ে রেখে দিয়েছি। আলমারির চাবি আমার কোমরে গোঁজা আছে।’

বিধানপতি একটা ভয়ঙ্কর চিৎকার করে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেলেন।

তখন সন্ধের আঁধার গুড়ি মেরে নেমে আসছিল। বাতাস যেন হঠাৎই থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। আশপাশের গাছ-গাছালির একটা পাতাও নড়ছিল না।

আর, তৃতীয় শ্রীরাধা তখনও কাপড় শুকোতে দিচ্ছিলেন।

প্রিয়নাথ থামলেন।

ঘরে কোনও কথা নেই। আড্ডার পরিবেশ কেমন যেন নষ্ট হয়ে গেছে।

প্রায় ফিসফিসে গলায় সুপ্রকাশ পালিত জিগ্যেস করলেন, ‘তারপর কী হল?’

বিষণ্ণ হাসলেন প্রিয়নাথ। মাথা নীচু করে আঙুলের নখ খুঁটলেন কয়েকবার। তারপর সামান্য কেশে বললেন, ‘শ্রীরাধার মৃত্যুর তদন্ত করতে পুলিশ এসেছিল। তারা বিধানপতিকে জেরা করে-করে একেবারে জেরবার করে দিল। পুলিশের বক্তব্য খুব পরিষ্কার ছিল। শ্রীরাধা মোটেই আত্মহত্যা করেননি। কারণ, ওইভাবে গলা কেটে দু-ফাঁক করার পর কেউ একমিনিটও বেঁচে থাকতে পারে না। তা ছাড়া সুইসাইডের অস্ত্রটা তো বডির কাছেই পড়ে থাকবে। ওটা তো আর ডানা মেলে আলমারিতে ঢুকে পড়তে পারে না! তার ওপর ছাদের রক্ত কে ধুয়ে-মুছে সাফ করল? ছুরিটাই বা কে ধুয়ে রাখল? আলমারিতে চাবি দিয়ে সেই চাবি শ্রীরাধার কোমরেই বা কে গুঁজে রাখল?

‘বিধানবাবু পুলিশকে পুরো ঘটনাটা জানিয়েছিলেন। কিন্তু স্বাভাবিক কারণেই পুলিশ ওঁর কথা বিশ্বাস করতে পারেনি। বাড়িতে ওঁরা স্বামী-স্ত্রী ছাড়া আর কেউ ছিল না। তা হলে তৃতীয় কোনও মানুষ শ্রীরাধাকে এইরকম রহস্যময়ভাবে খুন করে চম্পট দিয়েছে—এ-কথা কিছুতেই বিশ্বাস করা যায় না।

‘কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিধানবাবুকে ছেড়ে দিল দুটো কারণে। এক : সারা বাড়িতে তন্নতন্ন করে খুঁজেও বিধানবাবুর কোনও রক্তমাখা জামাকাপড় পাওয়া যায়নি। দুই : ঘটনার দিন রাত ন’টা নাগাদ পাড়ার লোকজন যখন দরজা ভেঙে বিধানবাবুর বাড়িতে ঢোকে তখনও তিনি ছাদে মৃতদেহের কাছে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন। তাই শেষ পর্যন্ত পুলিশ কেসটাকে ”আনসলভড” হেডিং দিয়ে ফাইল বন্ধ করে দেয়।

‘ওই দুর্ঘটনার পর থেকে বিধানপতিবাবুর মাথাটা একটু-আধটু গোলমেলে হয়ে যায়। আর চোখের পাতার ওঠা-পড়া ওরকম এলোমেলো হয়ে যায়। ওঁর এই খুঁতটা কিন্তু আর গোপন নয়—বরং সবসময় সকলের চোখে পড়ে। বহু ডাক্তার এই খুঁত সারানোর চেষ্টা করে শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে দিয়েছে। বিধানপতি মনে করেন, এটা শ্রীরাধার অভিশাপ…।’

প্রিয়নাথ একটু থামতেই বরেন মল্লিক প্রশ্ন করলেন, ‘বাকি তিনজন শ্রীরাধার কী হল?’

প্রিয়নাথ সঙ্গে-সঙ্গে কোনও জবাব না দিয়ে একটা সিগারেট ধরালেন। তারপর একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে রহস্যময় হেসে বললেন, ‘আমি কী জানি! আপনারাই বলুন—।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *