Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » ভ্রমণকাহিনী || Tarapada Roy

ভ্রমণকাহিনী || Tarapada Roy

বিশাল বিমানের একপ্রান্তে জানলার পাশে কম্পিত হৃদয়ে বসেছিলাম। সেই আমার সামান্য জীবনের আদি এবং অকৃত্রিম বিদেশ ভ্রমণ। একটু আগে বিমানের সিঁড়ি সরিয়ে নেওয়া হয়েছে, ভেতরে ঢোকার দরজা বন্ধ করা হয়েছে, কোমর-বন্ধনী শক্ত করে আটকানোর জন্যে আলোক-সংকেত জ্বলে উঠেছে। জানলার কাচের সোজাসুজি দেখলাম বিমানের সামনের পাখা তিরবেগে ঘুরছে, এই পাখাকেই বোধহয় প্রপেলার বলে। সে যাই হোক, মুহূর্তের মধ্যে বিমান গতি পেল এবং সেই মুহূর্তে জানলা দিয়ে তাকিয়ে দেখি নীচের মানুষগুলোকে ছোট ছোট কালো পিঁপড়ের মতো দেখাচ্ছে। সত্যি কী আশ্চর্য, কী তাড়াতাড়ি উড়োজাহাজ কত উঁচুতে উঠে গেছে ! বিজ্ঞানের কী আশ্চর্য লীলা !

আমার পাশে যে ভদ্রমহিলা বসেছিলেন, তিনি আমার মতোই এই প্রথম বিদেশ যাচ্ছেন। কিছুকাল আগে তাঁর স্বামী নিউইয়র্কে গেছেন, এবার তিনি স্বামীর সঙ্গে যুক্ত হতে যাচ্ছেন। আমার সঙ্গে একই বিমানে আজ সকালে কলকাতা থেকে দিল্লি এসেছেন, এখন আবার একই বিমানে আমরা বিদেশমুখী। সামান্য আলাপ হয়েছে মহিলার সঙ্গে। ক্ষণিকের মধ্যে বিমানের ঊর্ধ্বারোহণে মানুষগুলি পিঁপড়ের মতো দেখতে হয়ে যাওয়ায় আমি আমার উত্তেজনা দমন করতে পারিনি, আমি মহিলাকে জানলার কাচের বাইরে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বললাম, ‘দেখুন, দেখুন, এক মিনিটের মধ্যে প্লেনটা কত উঁচুতে উঠে গেছে, মানুষজন সব পিঁপড়ের মতো দেখাচ্ছে।’ কৌতূহলী হয়ে ভদ্রমহিলা উঠে দাঁড়িয়ে আমার মাথার ওপর দিয়ে জানলার বাইরে উঁকি দিয়ে দেখে খিলখিল করে হেসে ফেললেন, ‘প্লেন এখনও ছাড়েইনি, উপরে উঠবে কী করে ? আপনি যেগুলোকে মানুষ ভাবছেন, ছোট হয়ে পিঁপড়ের মতো হয়ে গেছে ভাবছেন, সেগুলো সত্যিই পিঁপড়ে, সত্যিকারের আসল খাঁটি পিঁপড়ে। প্লেনের জানলায় ঘুরছে, এগুলো মানুষ নয়।’

তদবধি আমার ভ্রমণ-ভ্রমের শুরু, তদবধি আমার ভ্ৰমাবলি আমার মসৃণ যাত্রাকে ক্রমাগত কণ্টকিত করেছে।

অবশ্যই সমস্তই ভ্রম বলে চালানো যাবে তা বোধহয় নয়। অনেকখানিই আমার মূর্খতা ও অজ্ঞানতা।

কিন্তু আমিই বা জানব কী করে ?

আমি যে সময়টা মার্কিন দেশে ছিলাম, সেটা সাংঘাতিক শীত ঋতু। বাংলা কাগজে যেমন গরম বা বর্ষা বা বন্যা বা খরা নিয়ে সদাসর্বদাই বলে যে নিদারুণ ব্যাপার, এ রকম আর ইতিপূর্বে কখনওই হয়নি, তেমনিই সে বছর সমস্ত মার্কিনি দৈনিকগুলো বলে যাচ্ছিল, এটাই হচ্ছে শতাব্দীর শীতলতম শীত ঋতু।

সে যাই হোক, আমি আয়োজনের ত্রুটি করিনি। দক্ষিণ কলকাতায় আমার পরিচিত সমস্ত বাড়ি থেকে আমার গায়ের কাছাকাছি মাপের যত সোয়েটার, কোট, ওভারকোট, গরম টুপি, পশমের মোজা সব সংগ্রহ করে নিয়েছিলাম। গলা-উঁচু ফুলহাতা তুলোর গেঞ্জি, তার উপরে সার্জের ফুলশার্ট, তার উপরে হাতকাটা সোয়েটার, হাতকাটার উপরে ফুলহাতা সোয়েটার, তারপর গলাবন্ধ কোট, তারপর গলায় মাফলার, মাথায় টুপি, সর্বোপরি আমার থেকে তিন সাইজ বড় একটি ওভারকোট—এই ছিল আমার উত্তমাঙ্গের পোশাক; নিম্নাঙ্গের সাজসরঞ্জামও কম ছিল না। এ ছাড়া ছিল হাতে গরম দস্তানা, পায়ে গরম ফুল মোজা। জামাকাপড় পরে ওজনের যন্ত্রে ওজন নিয়ে দেখেছিলাম, আমার স্বাভাবিক ওজনের চেয়ে ওজন তিরিশ কেজি বেড়ে যাচ্ছে। ওয়াশিংটন-নিউইয়র্কে মাঝে মাঝে ভিড়ের মধ্যে টের পেয়েছি সাহেবরা আমাকে গোপনে টিপে টিপে দেখছে, বুঝতে চাইছে আমি প্রকৃতই কীরকম, আমার সারমর্ম কী !

দুঃখের বিষয়, এত সাজসরঞ্জাম সত্ত্বেও আমার সঙ্গে মাফলার ছিল মাত্র একটি। একদিন বিকেলে হোটেলে ফেরার পথে ঝোড়ো হাওয়া, ঝিরঝিরে বৃষ্টি আর উড়ন্ত শিমূল তুলোর মতো বরফের আঁশে আমার মাফলারটি জবজবে ভিজে গেল। পশমের জিনিস একবার ভিজে গেলে সহজে শুকোতে চায় না; পরদিন সকালে বেরনোর সময় দেখলাম আমার মাফলার তখনও রীতিমতো ভেজা রয়েছে, গলায় জড়িয়ে বেরলে নির্ঘাত নিমুনিয়া হবে। যে রাস্তায় ছিলাম সেই গলির মোড়েই একটা বড়সড় জামাকাপড় এবং আরও নানা জিনিসের দোকান। কাচের শো-কেসে দেখলাম, বহু দ্রব্যের মধ্যে দু’-চারটি চমৎকার মাফলারও রয়েছে। দোকানে ঢুকে একটা মাফলার চাইলাম।

সুন্দরী বিক্রয়-বালিকা দু’বার স্মিত হেসে আমার ক্ষমা ভিক্ষা করে জানতে চাইল আমি কী চাইছি, আমি আবার বললাম, ‘মাফলার।’ স্বাভাবিক সৌজন্যবশতই হোক আর বিদেশি বলেই হোক, মেমসাহেব দোকানের বাইরে সিঁড়িতে বেরিয়ে এসে দূরে অঙ্গুলি নির্দেশ করে আমাকে দেখিয়ে বলে দিলেন, এই ব্লকের অন্যপ্রান্তের দোকানে মাফলার পাওয়া যাবে।

এই দোকানেই মাফলার রয়েছে অথচ আমাকে অন্য দোকানে পাঠাচ্ছে কেন বুঝতে পারলাম না। এমন হতে পারে এদের জিনিসটা তেমন ভাল নয়, একজন বিদেশিকে ঠকাতে চায় না তাই ওখানে পাঠাচ্ছে। আবার এমনও হতে পারে দুটো একই দোকান, জামাকাপড় ইত্যাদি ওখান থেকে বিক্রি হয়, আর সব এখানে।

কিঞ্চিৎ দ্বিধাগ্রস্তভাবে ও-প্রান্তের দোকানে গিয়ে পৌঁছলাম। ও মা ! এ তো একটা মোটর পার্টসের দোকান, কাচের শো-কেসে গাড়ির যন্ত্রপাতি সাজানো রয়েছে। মাফলার এখানে কী করে পাব ?

তারপর ভাবলাম, এদেশে ড্রাগ স্টোরে রেস্টুরেন্ট চলে, রেস্টুরেন্টে ডাকটিকিট বিক্রি করে, হয়তো গাড়ির যন্ত্রপাতির দোকানে গলার মাফলার পাওয়া যাবে। বিরাট মোটামতো লম্বা চওড়া এক দশাসই সাহেব দেড় ফুট একটা লোহার রেঞ্জ হাতে, আমি ভয়ে ভয়ে ঢুকতেই, তার বিরাট থাবা আমার কাঁধে চেপে দিয়ে একটা প্রচণ্ড ঝাঁকি সহকারে চেঁচিয়ে উঠল, ‘হ্যাল্‌লো।’ কারও কণ্ঠস্বর যে আমার থেকে কর্ক্‌শ হতে পারে এই অভিজ্ঞতা আমার প্রথম হল।

একটু হকচকিয়ে গিয়েছিলাম। চিরদিনের নামকরা কাপুরুষ আমি। সবরকম বিপজ্জনক স্থান ও অবস্থা থেকে সবসময় যথাসাধ্য দূরে থাকি। কোনওরকমে কাঁধটাকে সংকুচিত করে সাহেবের সচল থাবার বন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করতেই থাবাটা আরও চেপে বসে গেল এবং সঙ্গে সঙ্গে আবার অমায়িক গর্জন, ‘হ্যাল্‌লো।’ থাবার ঝাঁকির ধাক্কাটা কিঞ্চিৎ ধাতস্থ করে নিয়ে আমি অবশেষে আমার পক্ষে যতটা মিনমিন করে বলা সম্ভব সেইভাবে করুণ কণ্ঠে ঐতিহ্যময় টাঙ্গাইল ইংরিজিতে নিবেদন করলাম, আমি একটা মাফলার কিনতে এসেছি। তারপর ভয় এবং মনের দুঃখে বুদ্ধির খেই হারিয়ে ফেললাম, আমার অসুবিধের কথা বলতে লাগলাম। বললাম, ওয়াশিংটনের এই মারাত্মক বৃষ্টি-বরফে আমার মাফলার ভিজে গেছে এবং এই ঠান্ডায় ভিজে মাফলারে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।

একটা সামান্য মাফলার, তাও নিজের পয়সা দিয়ে নগদ কিনব, তার জন্যে কেন যে আমি এত কাকুতি-মিনতি করতে গেলাম, কেন যে আমার এমন বুদ্ধিভ্রংশ হল বলা কঠিন।

কিন্তু আমার ভাষার প্রসাদগুণেই হোক কিংবা করুণ কাহিনীর জন্যেই হোক, সাহেব যত শোনে তত ভ্রূকুঞ্চন করে, চোখ গোল গোল করে আর অবাক হতে থাকে। সেই সঙ্গে মধ্যে মধ্যেই প্রশ্ন করতে থাকে, ‘মাফলার ? ইউ মিন মাফলার ? ওয়েট মাফলার ?’ আমিও সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিই, ‘ইয়েস স্যার, মাফলার স্যার, মাই মাফলার ওয়েট স্যার।’

এইরকম আশ্চর্য কথোপকথন কিছুক্ষণ চলার পরে ওই দুর্দান্ত সাহেবের বোধহয় একটু মায়া হল, তার বজ্র থাবা কিঞ্চিৎ শিথিল হল। তারপর হঠাৎ সাহেব আমাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘তোমার গাড়ি কোথায় ?’

কেন যে সাহেব এই প্রশ্ন করল আমি বুঝতে পারলাম না। আমি আরও বিনীতভাবে জানালাম, ‘আমার কোনও গাড়ি নেই। সাহেব, আমি গরিব বিদেশি, এখানে কেন, দেশেও আমার কোনও গাড়ি নেই।’

আমার কথা শুনে সাহেব ভীষণরকম ঘাবড়িয়ে গেল, ‘ইউ ডোন্ট হ্যাভ এ কার ? তোমার গাড়ি নেই ? অথচ মাফলার চাইছ ? মাফলার দিয়ে কী করবে ?’

এখনও কিছু বুঝতে না পেরে আমি বললাম, ‘সাহেব, মাফলার আমার গলার জন্য চাইছি। আমার একটাই মাফলার, সেটা ভিজে গেছে।’

সাহেব এবারে সশব্দে হো হো করে হেসে উঠল, তারপর দোকানের ভিতরে যত লোক ছিল সবাইকে আমার চারপাশে ডেকে আনল, ‘হিয়ার ইজ এ ফানি গাই, এ লোকটার গাড়ি নেই কিন্তু মাফলার চাই।’ বলে পরমানন্দে আমার কাঁধ ধরে ঝাঁকাতে লাগল।

এই ঘটনার কার্যকারণ সেদিন বুঝতে পারিনি। পরে জেনেছি, আমেরিকানরা মাফলার অর্থে বোঝে গাড়ির সাইলেন্সার। আমার গাড়ি নেই অথচ সাইলেন্সর চাইছি, এ রকম অসম্ভব কথা তারা কখনও শোনেনি। সাহেবদের অট্টহাসি পিছনে রেখে আমি বেকুবের মতো সেই মোটরপার্টসের দোকান থেকে সেদিন বেরিয়ে এলাম।

Pages: 1 2 3
Pages ( 1 of 3 ): 1 23পরবর্তী »

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *