ত্যাগ
আমাদের চারিপাশে এমন কিছু লোক আছে যাদের নিজের কোন পূর্বনাম নেই। প্রতিবেশীগণ যে নামে ডাকেন সেটাই তার পরিচয় হয়ে দাঁড়ায়। এমনই একজন লোক যার প্রকৃত নাম আজ পর্যন্ত উদ্ধার করা যায়নি। তবে তার একটি সার্বজনিক নাম আছে— ‘মামু’, বাংলায় যাকে আমরা ‘মামা’ বলে ডাকি। পাড়ার পূর্বদিকে এক পশ্চিমা বস্তিতে তার বসবাস। এক মধ্যবিত্ত লোকের বাড়ীর এক কোণে ছোট্ট এক কুঁড়েঘর রচনা করে একাকী বাস করতেন। আর ঐ কুড়ে ঘরের এক কোণে নিজহাতে রান্নাবাড়ি করে একভাবে দিন কাটাতেন।
বয়স তার ষাট পার হয়ে এক বিন্দুতে এসে থেমে গেছে। এক কথায় তাকে খাটো বললেও ভুল হবে না। পরনে সাধারণ একখানা ধুতি ও হাতাওয়ালা গেঞ্জি। ডান কাঁধে লাল রঙের গামছা। মাথার উপর যে চুলগুলো এখনও আছে তা সবগুলোই পেকে সাদা হয়ে গেছে। শ্মশ্রু ও গোফ একেবারে পরিপাটি করে কামানো। ধূলিধূসরিত পদযুগল দেখে মনে হয় কখনও চটি পরেন না। মুখে দুঃশ্চিন্তার লেশ মাত্র নেই। বা কাধের উপর সরু বাঁশের একদিকে ঝোলানো একখানা লোহার ফলক আর অন্যদিকে খাকি রঙের একটি মাঝারি আকারের ঝোলা। যার ভেতর রয়েছে হাতুরী, বাটালি, রকমারী মোটা সুতা এবং নানাবিধ যন্ত্রপাতি। পেশায় উনি মুচি। অন্যান্য হকারদের মতো তাকে হাক দিতে হয় না। কয়েক মাস পরপর তিনি স্বইচ্ছায় পরিচিত ব্যক্তিবিশেষের বাড়ীতে উপস্থিত হওয়া মাত্রই ভীড় জমে উঠে। বাড়ীর লোকজন তো বটেই, প্রতিবেশীদের মধ্যেও তার আগমন বার্তা ছড়িয়ে পরে। কত লোকের কত কথা। কেউ বা বসার জন্য ছোট জলচকি এনে দেয়, আবার কেউ বা তার কাঁধ থেকে ভার নামাতে সাহায্য করে। এমন এক ব্যক্তিত্ব যে তার প্রতি কোন প্রাণীর বিদ্বেষ মাত্র নেই। অল্প বয়সের বাচ্চারাও তার হাসিখুশি মুখটি দেখার জন্য কয়েক মাস অপেক্ষায় থাকে। বহু প্রশ্নের উত্তর দিতে কখনও মুখে জড়তা এসে পরতো।ইতোমধ্যে তার সম্মুখে ছেড়া চটি,জুতো, ছাতা, ত্রিপাল ইত্যাদী বস্তুসামগ্রীতে স্তূপীকৃত হয়ে গেল। আর তিনি ধীরে ধীরে সবকিছুই সুন্দরভাবে সারিয়ে তুললেন । কাজের ফাঁকে ফাঁকে গুন-গুন করে ভোজপুরী গীতের ঝর্ণা ধারা বালক বালিকার মনকে সুড়সুড়ি দিয়ে যেত। কাজ শেষে কর্তা বাবু জিজ্ঞেস করলেন : “মামু, তোমার পারিশ্রমিক কত দিতে হবে ? “
ঝট্ করে হিসেব করার অভ্যাস তার কখনও ছিল না। তিনি নিখুঁতভাবে ছোট বড় সব কাজগুলি একত্রে গুছিয়ে নিয়ে সর্বমোট টাকার হিসেবখানি বলে দিতেন। অযথা অতিরিক্ত টাকা তিনি কখনও চেয়ে বসতেন না।
মামু ধীরভাবে উত্তর করলেন : “মোটে পাঁচ টাকা পঞ্চাশ পয়সা, কর্তাবাবু” ।
কর্তাবাবু কাল বিলম্ব না করে ঘর থেকে পারিশ্রমিক এনে মামুর হাতে তুলে দিলেন। মামু তখন নিজের কোমর হতে ছোট্ট একখানা থলে বের করে অতি যত্ন সহকারে দিনের প্রথম পারিশ্রমিক রেখে দিলেন। কাজ শেষ হলে পোটলা গুটিয়ে অন্য কোন বাড়ীতে যাবার পূর্বেই কর্তাগিন্নী মুড়ি, চিড়ে, গুড় ও একগ্লাস জল এনে বললেন:
“মামু, এবার হাত ধুয়ে জল খাবার সেরে নিন। সকাল থেকে আপনার কিছু খাওয়া হয়নি।”
মামু যেমন নিজের কাজকে সেবার চোখে দেখেন, ভূ-স্বামীর খবর রাখেন, কচি কাচ্চাদের সঙ্গে ঠাট্টা করেন; প্রতিটি গৃহিনীর যত্নও তেমনই পেয়ে থাকেন। সংসার সমরাঙ্গনে ঝাপ না দিলেও সংসারের নানান স্বাদের মধ্যে টক-ঝাল-মিষ্টি ইত্যাদি অনেকটাই উপলব্ধি করতে পারেন। নিজের ঘর সংসার না হলেও অন্যের সংসারে কখনও টিটকারি মারতে শেখেননি।
প্রভুত অর্থের জোরে প্রভাবশালী লোক সম্মান পেয়ে থাকেন। আর যার অর্থবল, লোকবল, বাহুবল নেই— আছে শুধু সরলতা ও মিষ্টি স্বভাব— লোকের স্নেহ ও ভালবাসার অধিকারী তারাই। যে ফুলের সুগন্ধে মন মেতে উঠে, সে যে আকৃতিরই হোক না কেন, হৃদয়ে স্থান পাবেই। আমাদের এই বামন ‘মামু’ তদ্রূপ সকলের কাছে আদ্রিত।
বহুবৎসর অতীত হয়ে গেল। আমরা বালক জীবনের বহু আনন্দ স্মৃতির পটে সঞ্চয় করে কৈশরে পা রেখেছি। গৃহকর্মের ছোট খাট দায়িত্ব এসে আমাদের দু- হাতের অবসর সময়টুকু ধীরে ধীরে গ্রাস করতে শুরু করেছে মাত্র। যা কিছু বুদ্ধিমত্তা অদ্যাবোধি নিজের ঝুলিতে গচ্ছিত ছিল, তার বেশীর ভাগই সেকেলে বলে বেকার হবার উপক্রম হল। নীল আকাশের নীচে সবুজ মাঠে কুঁড়ি – পঁচিশজন বালক বালিকা মিলে নিত্য নতুন খেলায় যেভাবে সময় কাটত ; বাঁধন হারা আনন্দে দিক বিদিক উদ্ভাসিত হতো ; সে ভাব লুপ্ত হয়ে আজ সকলের মধ্যে দূরত্বের এক অমিল লক্ষিত হলো।
সকালের শান্ত রবির কিরণ ক্রমশই প্রখরতর হয়ে মাথার উপর এসে দাঁড়িয়েছে। দূর হতে শোনা গেল— “মামু এসেছে। মামু এসেছে।”
কোথায় এসেছে জানার চেষ্টা করলে দেখতে পেলাম কয়েকটি বালক-বালিকা ছুটে চলেছে বাবলু কাকার বাড়ীর দিকে। উচ্ছসিত হয়ে সেখানে গিয়ে দেখি বাড়ীর লোকজন সমেত গুটি কতক ছেলেমেয়ে তাকে ঘিরে ধরেছে। কেউবা মামুর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে; কেউ তার হাতের কাজ দেখছে; আবার বাড়ীর অনেকে তার সঙ্গে নানা প্রসঙ্গে গল্পে জড়িয়ে আছে। এমন সময় বাবলুকাকা মামুকে বললেন:
“মামু, আপনি বড় একা, এতটা বয়স হয়েছে তবুও সেই আগের মতোই কাজ করে বেড়াচ্ছেন। এবার একটু অবকাশ জীবনের কথা ভাবুন।”
মামু একগাল হেসে উত্তর করলেন: ‘প্রাণ যতদিন আছে, পরিশ্রমও ততদিন। একাহাতে রাঁধি বাড়ি— বলারও কেউ নেই। এভাবেই জীবন কেটে যাবে।
—-তা তো বুঝলাম মামু। নিজের যদি কেউ থাকত তা হলে শেষ বয়সে একটু সেবা পেতেন।
দেখতে দেখতে মামুর মুখের হাসি প্রায় লুপ্ত হয়ে গেল। কাজের গতিও ক্রমশঃ থমকে দাঁড়াতে লাগল। নিজেকে একটু সামলে নিয়ে অতীত জীবনের ব্যথা ভরা স্মৃতি রোমন্থন করার চেষ্টা করলেন। বললেন: “সে কথা ভেবে আর লাভ কি? মা-বাবা উভয়ে ইহলোকের মায়া ত্যাগ করেছেন। কাছের বলতে সবাই দূরে চলে গেছে ! পাল ছেঁড়া নৌকার মতো একাকী ভেসে চলেছি।”
—আপনি তো বিয়েও করতে পারতেন? করেননি কেন?
‘বিয়ে’ ব্যাপারটি ব্যক্তিগত জীবনে কতটা মাহাত্মের, সেই অল্প বয়সে বুঝে উঠতে পারিনি। যতটুকু বুঝতে পারলাম তাতে মনে হল নারী-পুরুষের সামাজিক মিলন যার থেকে শুরু হয় সংসার ধর্ম।
মামুর চোখে আনন্দের ঝলক দেখা দিল। হাতের কাজ হঠাৎ থেমে গেল। লজ্জায় দুগালে কিছুটা রক্তিম আভা ভেসে উঠায় আমরা সকলে স্তব্ধ হয়ে অপলক দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে রইলাম। মামু ধীরে ধীরে চোখ তুলে সম্মুখের কৃষ্ণচূড়ার দিকে তাকিয়ে বললেন: “বাংলাদেশে থাকার সময় এক রূপবতী মুসলমান কন্যাকে আমার বেশ ভাল লেগে গেল। কিন্তু কিছু বলার আগেই সেই কন্যার বিয়ে হয়ে গেল। সেই থেকে অন্য কাউকে বিয়ে করার ইচ্ছে জাগেনি। নিখোঁজ হয়ে যাওয়া সেই কন্যার স্মৃতি ভুলতে গিয়ে আমি আজ পরদেশী। “
নারীর রূপ সৌন্দর্য পুরুষের চোখকে সর্বাগ্রে আকৃষ্ট করে; যদি সেই সৌন্দর্য একবার মনের পদ্মাসনে স্থান পায় তবে সেই ব্যক্তি যতই ক্ষুদ্র হোক না কেন, কোন মহান আদর্শে নিজেকে উন্নিত করতে এমনকি ত্যাগ স্বীকার করতেও সক্ষম হন।