বিদ্যাসাগর ও শরৎচন্দ্র
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর জন্মেছিলেন ১৮২০ সালে, আর তার অর্ধ শতাব্দীর কিছু পরে জন্ম শরৎচন্দ্রের ১৮৭৬ সালে।
বিদ্যাসাগর যখন পরোলোক যাত্রা করেন (১৮৯১)তখন শরৎচন্দ্রের বয়স পনেরো বছর, তখনও তিনি নারীদের যন্ত্রণার প্রতিবাদে কলম ধরেন নি। তারও আগে মাত্র ছত্রিশ বছর বয়সে, ১৮৫৬ সালে বিদ্যাসাগর “বিধবা বিবাহ” এর আইন প্রনয়ণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। অর্থাত শরৎচন্দ্রের জন্মের বহু পূর্বেই ঐ আইন বলবৎ হয়েছিল। কিন্তু আইন হয়েছিল ঠিকই আর তার পরবর্তী ইতিহাস ? সে কথা সকলেই জানেন।
আইন করে রীতি বদলানো যায়, কিন্তু, সংস্কার পাল্টানো যায় না, তার জন্য চাই —- সময়, উপলব্ধি, উদারতা, সর্বোপরি অন্ধত্ব দূরীকরণের শিক্ষা। ১৮৫৬ সালের পর বিদ্যাসাগর উপলব্ধি করলেন, সর্বাগ্রে শিক্ষার প্রয়োজন, বিশেষ নারীশিক্ষা। স্থাপন করেছিলেন নিজ গ্রামে “মা ভগবতী দেবী”র নামে স্কুল। প্রায় ৫৫/56 টি স্কুল নানা স্থানে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। অবশ্য অনেক আগেই বেথুন সাহেবের উদ্যোগে সহায়তা করেছিলেন “বেথুন স্কুল ” উদ্বোধনে।
এ বিষয়ে, শরৎচন্দ্র খুব দুঃখ করে তিনি বলেছেন, ‘‘স্বর্গীয় বিদ্যাসাগর মহাশয় যখন গভর্নমেন্টের সাহায্যে বিধবা–বিবাহ বিধিবদ্ধ করেছিলেন, তখন তিনি কেবল শাস্ত্রীয় বিচারই করেছিলেন, হিন্দুর মনের বিচার করেননি৷ তাই আইন পাশ হল বটে, কিন্তু হিন্দুসমাজ তাকে গ্রহণ করতে পারলে না৷ তাঁর অতবড় চেষ্টা নিষ্ফল হয়ে গেল৷ নিন্দা, গ্লানি, নির্যাতন তাঁকে অনেক সইতে হয়েছিল।” ঠিক কথা। কিন্তু বিদ্যাসাগরের এই নারী শিক্ষার বিষয়ে শরৎচন্দ্রও ঠিক বুঝেছিলেন, নারীশিক্ষার প্রয়োজন। গ্রামে পাঠশালা স্থাপনের ব্যাপারে শরৎচন্দ্রের “পণ্ডিতমশাই” উপন্যাসে দেখতে পাই শিক্ষা বিষয়ক মতবাদের সুন্দর প্রকাশ গ্রামে একটি ছোট্ট পাঠশালা সম্পর্কে বৃন্দাবন ও কেশবের মধ্যে আলোচনায়—
“কেশব বলছে , কিন্তু তোমার আমার সামর্থ্য কতটুকু? এই ছোট্ট একটুখানি পাঠশালায় জনকতক ছাত্রকে পড়িয়ে কতটুকু প্রায়শ্চিত্ত হবে? বৃন্দাবন বিস্মিতভাবে একমুহূর্ত চাহিয়া থাকিয়া কহিল, কথাটা ঠিক হল না ভাই৷ আমার পাঠশালার একটি ছাত্রও যদি মানুষের মত মানুষ হয়, তো এই ত্রিশ কোটি লোক উদ্ধার হয়ে যেতে পারে৷ নিউটন, ফ্যারাডে, রামমোহন, বিদ্যাসাগর ঝাঁকে ঝাঁকে তৈরি হয় না কেশব৷ বরং আশীর্বাদ কর যেন এই ছোট পাঠশালার একটি ছাত্রকেও মরণের পূর্বে মানুষ দেখে মরতে পারি৷” ১৮৫৬ সালের পর আইন বলবৎ সত্ত্বেও চূড়ান্ত সামাজিক অপ্রিয়তা ও অস্থিরতা দেখা যায় কোন বিধবার পুনরায় বিবাহ ব্যবস্থার তৎকালীন কোন বুদ্ধিজীবী বা রচনাকার বা সাহিত্যিকও এগিয়ে আসেন নি এ বিষয়ের পক্ষে। সবচেয়ে বিপক্ষে ছিলেন নারীরাই বেশি। সংস্কারের শিকড় এতদূর গভীরে ছিল যে, শরৎচন্দ্রও খুব সাহস করে তার উপন্যাসে কোন বিধবা বিবাহ দিয়ে যবনিকা টানতে পারেন নি। তার “বড়দিদি” গল্পে অনেক দ্বিধা ছিল বিধবা মাধবী ও সুরেন্দ্র এর প্রেম উপাখ্যানে। চাতুরী করে সুরেন্দ্রনাথের চরিত্র সৃষ্টি করলেন এক অনন্যোপায়ে। জানতেন সাধারণ শিক্ষিত কোন যুবকের ভূমিকায় সুরেন্দ্র মাধবীর প্রেম ফলপ্রসূ হতো না। পাঠক পারতনা তা গ্রহণ করতো । তাই শিশুর মতো সরল করলেন সুরেন্দ্রকে।
তেমনই চরিত্রহীন উপন্যাসে বিধবা মেসের পরিচারিকা সাবিত্রীর প্রেম যথার্থ হলেও বিবাহের ব্যাপারে তার মহান ত্যাগের পরাকাষ্ঠাই প্রধান হলো। ভ্রষ্টা কিরণময়ীকেও শেষ সময়ে মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটিয়ে পাঠকদের সহানুভূতি আদায়ের এক সুকৌশল উপসংহার টানলেন। এ ছাড়া উপায় ছিল না শরৎচন্দ্রের, কারণ তখনও বিধবার প্রেম বা বিবাহ খোলা মনে মেনে নিতে পারত না পাঠক সমাজ। একই পরিণতি দেখি ” পথনির্দেশ ” গল্পে, গুণেন্দ্র ব্রাহ্ম- সন্তান হলেও পথ বেছে নেয় নি বিবাহের, হিন্দু বিধবা হেমনলিনীর মত পরিবর্তন হলেও। উপমা দিলেন রাধাকৃষ্ণ প্রেমের বিয়োগান্তক সার্থকতার। ” গৃহদাহ” এর অচলা (এক ভ্রষ্টা নারী)কে মহিমের গ্রহণ বিষয়ও এক অস্পষ্ট আচ্ছাদনে মোড়ান প্রকাশ।
শরৎচন্দ্র লিখেছেন “গৃহদাহ” এর শেষ অংশে মৃণাল ও মহিমের কথোপকথন—
“”মহিম কহিল, সুরেশের মৃত্যু হয়েছে। অচলা আমাকে একটা আশ্রমের কথা জিজ্ঞাসা করেছিল মৃণাল , কিন্তু আমি তার জবাব দিতে পারি নি। তোমার কাছে হয়ত সে একটা উত্তর পেতেও পারে। মৃণাল তাহার মুখের প্রতি দৃষ্টি নিবন্ধ করিয়া শুধু কহিল,পাবে বৈ কি, সেজদা। কিন্তু আমার সকল শিক্ষা ত তোমারই কাছে। আশ্রমই বল আর আশ্রয়ই বল, সে যে তার কোথায়, এ খবর সেজদিকে আমি দিতে পারব, কিন্তু সে ত তোমারই দেওয়া হবে। মহিম কথা কহিল না। বোধহয় নিজেকে সে এই তীক্ষ্ণ- দৃষ্টি রমণীর কাছ হইতে গোপন করিবার জন্যেই মুখ ফিরিয়া লইল।….””
“পল্লীসমাজ” এর রমা, “বিন্দুর ছেলে” এর বিন্দু “রামের সুমতি” এর নারায়নী ইত্যাদি শরৎচন্দ্র সৃষ্ট নারী চরিত্র গুলি অনেক কুসংস্কার মুক্ত। উদাহরণ আরও অনেক।
যে পরাশর সংহিতা” থেকে জোড়ালো যুক্তি বিদ্যাসাগর দিয়েছিলেন—- বিধবাদের বিবাহ নিয়ে । তা হলো “নষ্টে মৃতে প্রব্রজিতে ক্লীবে চ পতিতে পতৌ। পঞ্চস্বাপৎসু নারীনাং পতিরন্যো বিধীয়তে।।” পরাশর সংহিতা। (পরাশর মুনি —বশিষ্ঠদেবের পৌত্র, এবং, কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বা ব্যাসদেবের পিতা। ঋগ্বেদের বহু ঋক্ মন্ত্র তিনি লিখেছেন এবং পৃথক “পরাশর সংহিতা”)
অর্থাৎ পাঁচটি কারণে স্ত্রী পুনরায় বিবাহ করতে পারেন—- ১)স্বামী নিরুদ্দিষ্ট হলে, ২)মারা গেলে, ৩)সন্ন্যাসী হলে, ৪)সন্তান উৎপাদনে অক্ষম হলে বা ৫)সমাজে পতিত হলে। এ বিদ্যাসাগরের এই প্রচেষ্টার প্রয়োগ মাথা পেতে নিয়েছিলেন নারীবাদী ও সমাজ সচেতন শরৎচন্দ্র। শরৎচন্দ্রের লেখনীতে ঐ শ্লোকের সমর্থনে নানাচরিত্র নানাভাবে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে প্রকাশ পেয়েছে… উদাহরণস্বরূপ যেমন অন্নদাদিদি, বিরাজ, অভয়া,শুভদা,কমল, নতুনমা চরিত্র সকল। লেখনীতে তিনি দৃঢ় অথচ অতি সতর্কতার সাথে সমাজকে যেন সইয়ে সইয়ে নিয়েছিলেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাই বিয়োগান্তক রচনা লিখে সমস্যার উত্থাপনে পাঠকদের মনে সমাধানের আশু পরিবর্তন বা সুযোগের অপেক্ষায় ছেড়ে দিয়েছিলেন।
অনেক পরিবর্তনের মাঝে, আজ দুহাজার একুশে এসেও সে লড়াই যেন এখনও চলছে— স্মরণে প্রণাম —- ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।