২২শে শ্রাবণ আর আমার রবীন্দ্রনাথ
সেদিন ছিল সুন্দর ঝমঝমাঝম বৃষ্টিস্নাত টিনের চালের বাড়ি? সত্যি, চৌদ্দ বছরের আমি। তখন স্কুলে হতো বর্ষার ছুটি, গরমের নয়। স্বল্প বিশ্রামের সেই সাঁঝকালো দুপুর— গায়ে হালকা কাঁথা, হাতে ধরা বঙ্কিমচন্দ্র বা শরৎচন্দ্র বা রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস। মাথার উপর নৃত্য করে চলছে— ঝমঝমাঝম ঝমঝমাঝম শব্দে অম্বরঝরা অসংখ্য বৃষ্টি ফোঁটার তরিত গতিবিধি।
সে শ্রাবণ মাস, আর শ্রাবণ মানেই মনে— তোলপাড় ২২শে শ্রাবণ যে রবীন্দ্রনাথের !!!!
সন্ধ্যবেলায় আমার পেছনবাড়ির বন্ধু বারান্দায় হারমোনিয়ম বাজিয়ে গান গাইত —- “বজ্র মানিক দিয়ে গাঁথা, আষাঢ় তোমার মালা। তোমার শ্যামল শোভার বুকে বিদ্যুতেরই জ্বালা।” সে বন্ধুর সাথে আজও অমলিন বন্ধুত্ব অটুট।
রাতে মায়ের পাশে আরামের ঘুম, মাথার উপর ঝমঝমাঝম শ্রাবণ-বৃষ্টি লহরা, মৃদু হ্যারিকেন সৃষ্ট আলো আঁধারি রহস্য, পাশে পুকুরে তারস্বরে গ্যাঙর গ্যাঙ্, গ্যাঙর গ্যাঙ্ ভেকগীতি।
জানি দুদিন পরই হবে শ্রাবণী বন্যা। দুরন্ত উচ্ছৃংখল তিস্তার যে বাঁধ দেওয়া হয়নি তখনও সে শহরে!!! চারদিক জল থৈথৈ কখনও কালো জল কখনও তিস্তার ঘোলা জল, উঠোন বয়ে কলকল— একধার থেকে আর এক ধার….. মাঝে মাঝে পুকুরভাসা কুচো মাছের ঝলক পথ ভুলে এদিক ওদিক…….
সেই মাঝেই আসত ২২শে শ্রাবণ, বার বার যার কথা শুনে শেষ হয় না। পড়েও শেষ হয় না। জেনেও অজানা। রবীন্দ্রনাথ মিশে আছেন সকল সত্ত্বায় –অনু থেকে পরমানুতে। তারপর কত ২২শে শ্রাবণ এলো জীবনে ফিরে ফিরে—
“আবার শ্রাবণ হয়ে এলে ফিরে
মেঘ-আঁচলে নিলে ঘিরে।…..”
শ্রাবণ সন্ধ্যার এক মন খারাপের দিন— একলা বারান্দার গ্রীল ধরে একা আমি ছবি। খোলা আকাশ স্তবকে স্তবকে মেঘ ঠাসা, হুড়মুড়িয়ে এলো শ্রাবণ বৃষ্টিমালা….. বারান্দা ছাপিয়ে ঘরে জলঝাপটার দাপট, সাথে বজ্রকুলের শাসানি—- শাণিত তীরের মতো বৃষ্টির দানা , ধুয়ে দিতে লাগল আমার চুল মুখ শরীর আর আর মন —- না কোন ক্লান্তি কোন আক্ষেপ, কোন নালিশ নেই, কখন ধুয়ে মুছে নিয়ে গেছে। পরণের কাপড় ভিজে সপ সপ ভারী আর অন্তর মন হালকা পলকা ভার বিহীন । বৃষ্টিস্নাত তখন আমি, মুক্তি আমার শ্রাবণ।
“চিত্ত আমার হারাল আজ
মেঘের মাঝখানে….”
সুখে দুঃখে, সর্বস্তরে সর্বসময়ে সাথে আছেন রবীন্দ্রনাথ, আসে ২৫শে বৈশাখ আর ২২শে শ্রাবণ । ২২শে শ্রাবণ কখনই কবির তিরোধান নয়।আত্মার সাথে যেখানে যোগসূত্র, সেখানে স্থুল দেহের অবক্ষয় নিয়ে ভাববার কোন আবেগ নেই। তিনি ত সর্বক্ষণ অন্তরে।
আজ ২২শে শ্রাবণ, কদিন ধরে কি বৃষ্টি কি বৃষ্টি—চারদিক বানভাসী লোকেরা কষ্ট পাচ্ছে, চলছে ত্রাণ প্রচেষ্টা, খবরে পাই, শুনি, ব্যথিত —- রবীন্দ্রনাথ, কত দুঃখ, কত শোক আর তার মাঝে কিছু সুখের পরশ, তোমার জীবনের বন্ধুর পথ উপেক্ষা করে সৃষ্টি করেছ মধুসঞ্জীবন, দুখের মাঝে সুখ সন্ধানের অমৃতসুখের বাণী ,শুধু আমাদের জন্য।
সূর্যরোশনাই, চাঁদের কিরণ,নক্ষত্রের আলোর মতো রবি-রচনার সিঞ্চনে নিত্য সিনান স্নিগ্ধতায় বেঁচে আছি।
“আজ আকাশের মনের কথা
ঝরে ঝরো বাজে।
সারা প্রহর আমার বুকের মাঝে।”