অদ্ভুত রয়ায়ন
“…এই যে মশাই বলি কি হচ্ছে এটা….!??”
বেশ কিছুক্ষন বেয়াদপি সহ্য করে আগুন ঝরা গলায় চোখ পাকিয়ে বাসের সাইড সিটে বসে প্রশ্ন ছুঁড়লো অমিয়।
মানে…!! ছেলেটিও উল্টে ঝাঁজ নিয়ে সোচ্চার যেন কি আর হয়েছে বা আপনি বলার কে এমন একটা ভাবখানা!
চোখে চোখ রেখে তখনো অমিয়,ছেড়ে দেওয়ার মোটেও পাত্র নয়। বললো আমি তো সেটাই সোজাসুজি প্রশ্ন করছি আপনাকে, পাবলিক প্লেসে প্রকাশ্যে এসব কি হচ্ছে!?এই বলে সে একরাশ অস্বস্তি নিয়ে থ্রি সিটার বাসের সাইড সিট থেকে উঠে পড়লো।
কলকাতা মালদা গামি বাসটাতে বর্ধমান হাইরোড থেকে অমিয় উঠে সিট পেয়ে রীতিমতো উচ্ছ্বসিত।বছরের শেষ দিনে অফিস যাবে না ভেবেই সকালে আরামের লেপ ঘুম দিচ্ছিল কিন্তু উফ এই একুশ সাল কিনা শেষ দিনেও ঝাপটা মারলো তাকে!অফিসের হঠাৎ পরিদর্শন আসছে কলিগ শুভর ম্যসেজ আসতেই গো গো রেডি!কিন্তু ট্রেন তো আর নেই সুতরাং বাসে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে হলো।
মিনিট দশ এটা সেটা ভেবে ভালই যাচ্ছিল কিন্তু অনেক ক্ষন থেকে টের পেলো পাশের ছেলেটি তার সফর সঙ্গী বছর চোদ্দ কি পনেরর মেয়েটিকে উত্যক্ত করছে।মেয়েটির বিরক্তি অমিয় বারংবার দেখছে ,সে বার বার ওই ভিম চেহারার ছেলেটির হাত তার শরীরের প্রাইভেট অংশ থেকে যতবার সরাচ্ছে তত ছেলেটি অধিক উৎসাহে একই কাজ করে চলেছে! এ যেন একটা বেশ করেছি অধিকার সুলভ খেলা!অমিয় মানছে দুজনে দুজনার বেশ পরিচিত,সম্পর্ক টাও হাসি ঠাট্টার তাবলে এইভাবে কোনো মেয়েকে তাও প্রকাশ্যে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু করা কি আদৌ যায়, না করা উচিত!?
তাকাবে না ভেবেও খানিক ক্ষণ হেড ফোন লাগিয়ে অমিয় চোখ বুজে গান শুনছিল ,হঠাৎ কনুইয়ের গুঁতো খেয়ে মেজাজ গেলো বিগড়ে!অমিয় ঝেড়ে উঠে পড়তে বাধ্য হলো এবার,তার বাড়িতেও বছর বারোর কন্যার কথা খুব মনে পড়ছে।সমাজ বলে মেয়েদের সাহস নিয়ে এগিয়ে আসা উচিত,পুরুষ দের মুখোশ খুলে দেওয়া দরকার কিন্তু এমন কিছু পরিবেশ পরিস্থিতির তারা সম্মুখীন হয় সত্যিই কতখানি রুখে দেওয়া সম্ভব?এই দুর্বলতা উপলব্ধি করেই শুধু ট্রেন বাস নয়,কলেজ বিশ্ব বিদ্যালয় , উচ্চ শিক্ষার প্রতিষ্ঠান এমনকি যেখানে নিয়মানুবর্তিতা অত্যন্ত কঠোর সেই আর্মি ,সুরক্ষা বল ফোর্সেও প্রায়শই শ্লীলতা হানির খবর পেপারে আসে। অমিয়র কেন অস্বস্তি হচ্ছিল মেয়েটি অন্তত বুঝতে পেরেছে,ওর করুন দৃষ্টি অমিয়কে কিছুটা হলেও প্রতিবাদের সাহস যুগিয়েছে।
ছেলেটি মচকাবে তবু ভাঙবে না ভাবখানা তে অমিয়র দাঁড়িয়ে থাকা দেখছিল! অমিয় নিজেকে চেপে না রাখতে বলেই ফেললো,” বাসে আর একটা সিট থাকলে এখানে মোটেও দাঁড়াতাম না।সে আপনারা উভয়ের সম্মতিতে যা খুশি করুন কিন্তু এটা তো মাথায় রাখতে হবে যে এটা বাস!প্রকাশ্য পাবলিক প্লেস এরা আর আমি অপরিচিত একজন পাশেই! বলা মাত্রই এবার ছেলেটির অদ্ভুত পরিবর্তন লক্ষ্য করলো অমিয় ।উঠে দাঁড়িয়ে হাত দুটো ধরে ফেলে বললো দাদা আপনি বসুন,”হম বুঝতে পারছি আমি আবেগের বসে একটু নিয়ন্ত্রন হারিয়ে ফেলেছিলাম। উনি আমার স্ত্রী,বিরক্ত হয়ে বাধা দিচ্ছিল আমার শোনা উচিত ছিল”।
স্ত্রী শুনে চমকে ওঠে এবার অমিয়।সে এতক্ষন অনেক কিছু ভেবেও ফেলেছিল। ছোট্ট চেহারার মেয়েটি যেভাবে লাল টুকটুকে একটা জ্যাকেট পরে ছিল অমিয় তো রীতিমতো বাচ্চা মনে করেছে ওকে । মেয়েটিও লাজুক কণ্ঠে বলল,”এই তুমি একটু সরে এসো,নিন দাদা বসুন”।এবার মেয়েটির হাতের কব্জি থেকে জ্যাকেট সরে যেতেই শাখা পলা সব দেখতেও পেলো অমিয়।বসে বললো ভাই তোমরা বিবাহিত,তোমাদের তো অনেক দায়িত্ব পরস্পরকে কেয়ার করা তাই না বলো!তোমার স্ত্রী,সে তোমার অত্যন্ত প্রিয়জন একটু অন্তত তাকে সম্মান দিও।যদি আমারও কোনো ভুল হয় মাফ করো।”না না দাদা আপনি আবার ভুল করলেন কখন,বরং আপনি আমার স্বামীকে বাস্তব শিক্ষাটা আজ দিয়ে আমাদের উপকার করলেন।আমার শরীরটা একদমই ভালো নেই দাদা,ওকে যত বাধা দিচ্ছি ওর প্রেম ততো উথলে উঠছে বলে একটা ফ্রুট কেকের প্যাকেট খুলে তিনটে ভাগ করতে লাগলো।আরে না না,আমি একদম খাবো না,তোমরা খাও তবু ওরা নাছোড়বান্দা।অগত্যা অমিয় দুপিস কেক নিয়ে মনে মনে ভাবলো,এটা প্রেম উথলানো নয়,এটা একপ্রকার বাড়াবাড়ি,নোংরামির চূড়ান্ত পর্যায়।
যাই হোক এরপরের ঘটনাটি সম্পূর্ন আলাদা ,তিনজনের কত গল্প,একদম অমিয় কে পরিবার নিয়ে মালদা ঘুরতে যাওয়ার আমন্ত্রণ করলো ওরা।ফোন নাম্বার,ফেসবুক আইডি আদান প্রদান সহ এভাবে প্রকাশ্যে স্ত্রী কে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিরক্ত করার জন্য পুনরায় দুঃখ প্রকাশ শেষে,অমিয় তার গন্তব্য আসতে নেমে গেল।হাঁটতে হাঁটতে অমিয় ভাবছে বছরের শেষ দিনেও কিনা তার শখের ভাবুক কলম এমন ঘটনার সাক্ষী হয়ে গল্পের প্লট পেয়ে তো গেলো।অফিস পৌঁছে ঘাড় গুঁজে কাজ আর কাজ তারওপর অফিসারদের পরিদর্শনে ফাইলের পাহাড় জমে উঠলো অফিস টেবিলে।
ফেরার পথে ট্রেনে অনলাইন হতেই দেখলো স্বামী স্ত্রী দুজনেরই ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট।ভাবছে সত্যিই কি অদ্ভুত ঘটনা তাই না রাগ, দৃশ্য দূষণ দিয়ে শুরু আর কিনা বন্ধুত্বে পরিণতি! একদিন ফোন এলো ওই মহিলার,গলাটা বেশ উদ্বিগ্ন শোনালো,কি হয়েছে বলতে কিছু না দাদা কিছু না বলে এড়িয়ে গেল।সেদিন মাঝরাত,হঠাৎ নোটিফিকেশন!এই এত্ত বড়ো একটা লম্বা ম্যাসেজ তৃষার।কি এত লিখলো ইচ্ছাও করছে,অথচ ঘুমে চোখ জ্বালা করছে তাই মোবাইলটা পাশে রেখে ঘুমিয়ে পড়লো অমিয়। ভোর বেলা চোখ খুলতেই দেখে ওই ম্যসেজ টা স্ক্রিনেই,নেট বন্ধ করতে ভুলে গেছে রাতে।যা লিখেছে তার সারাংশ হলো,”দাদা ছোট বোনের মতো আপনাকে কিছু কথা জানাচ্ছি, সেদিন যে বাসে আমায় রীতিমতো উত্যক্ত করার দৃশ্য আপনাকে বিব্রত করেছে ওটা তো সামান্য মাত্র দাদা,বাইরে গেলে লোক জন মানে না,বড্ড কামুক অথচ ঘরে থাকলে ওই মানুষটাই এমন ভান করে যেন চেনেই না,একদম নিস্পৃহ।আমি বুঝে উঠতে পারি না দাদা এ কেমন ধরনের চরিত্র।তাই আমি চেষ্টা করি অনেক বুঝিয়ে রাজি করে বাইরে একদুদিনের জন্য ঘুরে আসতে দাদা,কিছু মাইন্ড করবেন না আপনি”!
একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে অমিয় ভাবতে বসলো সত্যিই তো এই দুনিয়ায় কত রকম মানুষ,তাদের কত কি যে স্বভাব,যা অনেকটা এই ব্যস্ত আধুনিক জীবন শৈলীর কু প্রভাব। জীবনের শুরু থেকে ঠিক মতো সোসালাইজেশনেরও অভাব আজ এমন বিচিত্র আচরণের জন্ম দিচ্ছে বলে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে অফিস যাওয়ার জন্য রেডি হতে লাগলো।