Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » শালিক ও শ্যালিকা || Tarapada Roy

শালিক ও শ্যালিকা || Tarapada Roy

শালিক ও শ্যালিকা

০১.

সম্রাট শালিবাহন..
শিবরাম চক্রবর্তী

শিবরাম চক্রবর্তীকে মনে আছে? সেই যে মহর্ষি শিবরাম চক্রবর্তী।

অনেকদিন আগের কথা, সে আমাদের হারিয়ে যাওয়া অমল কৈশোরের কথা। সত্যযুগ না হলেও, সে প্রায় ক্রেতা-দ্বাপরের কথা। তখন টাকায় চার-পাঁচ সের চাল পাওয়া যেত, তিন-চার সের দুধ। কলকাতা থেকে নৈহাটি রেলভাড়া আট আনা। ঢাকা বরিশাল যেতে দলিল-দস্তাবেজ লাগে না

তখনও বঙ্গজননীর বাম হাতে কমলার ফুল। লোকজন রাস্তাঘাটে, চায়ের দোকানে আলোচনা করে, সুভাষ বসু দুয়েকদিনের মধ্যেই এসে যাচ্ছেন, গত মাসে তাকে সিঙ্গাপুরে দেখা গেছে, কিংবা আগের সপ্তাহে রেঙ্গুন শহরে।

সেই প্রাচীন যুগে মহর্ষি শিবরাম সম্রাট শালিবাহনের কথা লিখেছিলেন। সে গল্প পাঠ করে আমরা হেসে আকুল হয়েছিলাম।

বলা বাহুল্য, শিবরাম ইতিহাসখ্যাত সম্রাট শালিবাহনের কথা লেখেননি। ইতিহাস রসিকতা পছন্দ করে না। সে বড় জবরদস্ত বিষয়।

ইতিহাসের সম্রাট শালিবাহনও জবরদস্ত নৃপতি ছিলেন। শালিবাহন ছিলেন শক বংশের রাজা, সেই যে শকহুণ দলের কথা আছে ভারতভাগ্যবিধাতায়, সেই শক। তিনি শকাব্দ প্রবর্তন করেন যা আজও চলে আসছে। সে প্রায় খ্রিস্টাব্দের সমবয়সি। সবচেয়ে বড় কথা প্রবল-পরাক্রান্ত নরপতি বিক্রমাদিত্যকে শালিবাহন যুদ্ধে পরাস্ত করেছিলেন।

.

না। ইতিহাসের রাজা শালিবাহনকে নিয়ে শিবরাম চক্রবর্তী কিছু লেখেননি। লেখার কথাও নয়। রাজা-উজির নিয়ে সময় নষ্ট করার লোক ছিলেন না শিবরাম।

শিবরাম যে সম্রাট শালিবাহনের কথা লিখেছিলেন, তিনি কোনও রাজাগজা ছিলেন না। শ্যালিকাবাহন এক গোলগাল, বিপর্যস্ত জামাইবাবুর কথা লিখেছিলেন শিবরাম।

আমাদের চিরচেনা সেই সেকালের জামাইবাবু, শ্যালিকা পরিবেষ্টিত হয়ে হাঁসফাঁস করে, টালমাটাল হয়ে বারবার হাস্যকর হওয়াই যার অনিবার্য পরিণতি।

আজকাল সংসারে শ্যালক-শ্যালিকার খুব অভাব। সেকালের সেই শালিবাহন জামাইবাবুদের একালে আর বিশেষ দেখা যায় না। তারাও এখন ত্রেতা বা দ্বাপর যুগের জীব।

তবু এখনও যা দু-চারজন আছেন। অল্প কিছু দিন পরে, পরের প্রজন্মে তাও আর দেখা যাবে না। পরিবার পরিকল্পনার প্রকল্পে অদ্বিতীয়-অদ্বিতীয়বার পৃথিবীতে শ্যালক-শ্যালিকাই থাকবে না, জামাইবাবু আসবে কোথা থেকে।

এবং একই কারণে পিসি-মাসি, কাকা-জ্যাঠা, মামাতো-পিসতুতো কিছুই থাকবে না। জামাইবাবুরা থাকবে না।

তুলসী মঞ্চ, আকাশ প্রদীপ, একান্নবর্তী পরিবার ইত্যাদির মতো হারিয়ে যাবেন জামাইবাবুরা। প্রাগৈতিহাসিক ডায়নোসরের মতো নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবেন তারা।

আফসোস করে লাভ নেই। হাসির গল্প লিখতে বসে আফসোসের সুযোগ নেই। আবার এই ছলে প্রবন্ধ লেখার চেষ্টা করাও উচিত নয়।

সুতরাং এবার সরাসরি গল্পে প্রবেশ করার কথা ভাবতে হচ্ছে। স্বীকার করা ভাল গল্পটি পুরনো ঢংয়ের এক শ্যালিকা বিহ্বল জামাইবাবুকে নিয়ে। গোলগাল, ঢিলেঢালা ভাল মানুষ জামাইবাবু, হয়তো ইনিই বঙ্গীয় সমাজের শেষ জামাইবাবু। আর, তা না হলেও ইনি শেষ জামাইবাবুদের মানে শেষতম জামাইবাবু প্রজন্মের একজন তো বটেই।

০২.

দেখে শুনে বুঝিলাম
করি তালিকা,
সবচেয়ে ভাল মোর
ছোট শ্যালিকা।

গোলাম মোস্তাফা বেশিক্ষণ ধরে শুধু জামাইবাবু জামাইবাবু করলে চলবে না। জামাইবাবুর নাম বলতে হবে, না হলে গল্প জমবে কী করে।

অবশ্য জামাইবাবুরা শেষ হয়ে যাওয়ার ঢের আগে এই মধুর সম্বোধনটি প্রায় অচল হয়ে গিয়েছিল। নব্য যুগের আধুনিকা শ্যালিকাগণ জামাইবাবু না বলে দাদা বলা শুরু করেছিল। খগেনদা, বলরামদা, কপোতাক্ষদা, ইত্যাদি। অন্যদিকে আজিজ-মফিজকে যারা দুলাভাই বলত তারা হঠাৎ আলোকপ্রাপ্তা হয়ে জামাইবাবুদের আজিজ ভাই, মফিজ ভাই বলতে লাগল। ৪২৪

এই সাবালিকা ও নাবালিকাদের কেউ কোনওদিন বোঝানোর চেষ্টা করেনি জামাইবাবু দাদা কিংবা ভাই নন, সহস্র বর্ষের সখী সাধনার ধন।

সে যা হোক, কথা বাড়িয়ে লাভ নেই, আমাদের এই ক্ষুদ্র কথিকার জামাইবাবুর নাম মেঘলাল চক্রবর্তী এবং সৌভাগ্যক্রমে মেঘলালবাবু শুধুই জামাইবাবু, দাদা কিংবা ভাই নন।

প্রায় দশ বছর হল মেঘলালবাবু বিয়ে করেছেন, যথারীতি সম্বন্ধ করে, পাত্রী দেখেশুনে যাচাই করে। মেঘলালবাবু বসবাস করেন হাওড়া-বর্ধমান কর্ড লাইনের হুগলি জেলার একটি পরিচিত রেল স্টেশনের থেকে মাইল পাঁচেক ভিতরের দিকে একটি পুরনো বর্ধিষ্ণু গ্রামে।

গ্রামের নাম হরিশপুর। পাশের গ্রামে একটি উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে মেঘলালবাবু শিক্ষকতা করেন। তার একটি স্কুটার আছে, স্কুটারেই যাতায়াত করেন। প্রয়োজনে হাওড়া-কলকাতা পর্যন্ত স্কুটারে আসেন।

তবে স্কুল শিক্ষকতাই মেঘলালবাবুর একমাত্র বা মূল জীবিকা নয়। তিনি প্রাক্তন জোতদার বংশের সন্তান। এখনও কিঞ্চিৎ ধানজমি আছে, সম্বৎসরের খোরাকি চলে যায়। আরও জমিজমা ছিল, সেগুলো যথাকালে হস্তান্তর করেছেন। এখন আসল ব্যবসা বাজারের পাশে একটা টিনের আটচালা ঘরে ভিডিও পারলার।

তবে মেঘলালবাবু বেআইনি কিছু করেন না। তাঁর সরকারি লাইসেন্স আছে, স্থানীয় থানাতেও যথারীতি মাসোহারা দেন। অশ্লীল বা নীল বই ফাঁকে-ফুরসতে দেখানো হয় না এমন কথা নিশ্চয়ই করে বলা যাবে না, তবে বাজার চালু হিন্দি সিনেমার ক্যাসেটই সাধারণত দেখানো হয়। সেও কম উত্তেজনাপ্রদ নয়।

মেঘলালবাবুর স্ত্রীর নাম হেমছায়া। হেমছায়ারা দুই বোন, এক ভাই। হেমছায়াই বড়। পরের ভাই গণনাথ নাসিকে টাকার কারখানায় কাজ করে। সবচেয়ে ছোট মহামায়া। আমাদের মেঘলালবাবুর একমাত্র শ্যালিকা।

মেঘলালবাবুর শ্বশুরবাড়ি আরও দু স্টেশন দূরের ভিতরের দিকের একটা গ্রামে। মেঘলালবাবুর বিয়ের সময় গণনাথের বয়স আঠারো-উনিশ। মহামায়া চোদ্দো-পনেরো বছরের নাবালিকা, স্কুলে ক্লাস নাইনে পড়ে।

শুধু ছোট শ্যালিকা বলে নয়, একমাত্র শ্যালিকা বলেও মেঘলালবাবু মহামায়াকে খুব স্নেহ করেন। মেঘলালবাবুর নিজের কোনও বোন নেই, কয়েকটি অপোগন্ড ভাই আছে, এদিক ওদিক করে বেড়ায়। আগে মহামায়া ছুটি-ছাটায় জামাইবাবুর বাড়িতে এলে তারা তাকে খুব বিরক্ত করত। এখন আর অবশ্য সেরকম ঝামেলা নেই, বছর দুয়েক হল মহামায়ার বিয়ে হয়ে গেছে।

মহামায়ার বিয়ে হয়েছে কলকাতায়। তার বর অনুপম কাজ করে একটা কেন্দ্রীয় সরকারি অফিসে। চারপুরুষের বসবাস কলেজ স্ট্রিট-বউবাজার অঞ্চলে। ছেলেটি এমনিতে চমৎকার; কথাবার্তা, চালচলন, লেখাপড়া সবাই ভাল। কিন্তু এই অনুপমের একটি মহৎ দোষ আছে, সে সুদূরের পিয়াসী।

অনুপম, গিরিবান্ধব সমিতির অবৈতনিক সম্পাদক। পাহাড় বলতে সে অজ্ঞান। সমতল কলকাতায় ইট-কাঠের জঙ্গলে জন্মে এবং বড় হয়ে পাহাড়ের প্রতি তার এই আকর্ষণ কী করে জন্মাল সেটা বলা কঠিন।

প্রতি বছর গ্রীষ্মকাল পড়তে না পড়তে, কলকাতার রাস্তায় পিচ গলে যাওয়ার অনেক আগে, যখন পাহাড়তলির আমের গাছে মুকুল ঝরে গিয়ে সবে গুটি এসেছে, গিরিবনে সদ্য কোকিলের ডাক শুরু হয়েছে সেই মুকুলের ঘ্রাণ না পেয়েও, সেই ডাক না শুনেও অনুপমের মন চঞ্চল হয়ে ওঠে। গিরিবান্ধব সমিতির সদস্যেরা আবার পাহাড়ে যাওয়ার তাল করতে থাকে।

তারপর সঙ্গীসাথী জুটিয়ে কোনও এক শুভদিনে কপালে চন্দনের ফোঁটা দিয়ে এবং শুভার্থী কোনও মন্ত্রী বা আমলা মহোদয়ের পরিয়ে দেওয়া গাঁদা ফুলের মালা গলায় পরে অনুপমেরা বেরিয়ে পড়ে, লোটা কম্বল, টর্চ-অক্সিজেন, কুড়ুল-গাঁইতি, তাঁবু-দড়ি এইসব নিয়ে।

শ্রাবণ বা চৈত্রসংক্রান্তির রঙিন কাপড় পরে তারকেশ্বর যাত্রার মতো প্রায় ব্যাপার। কয়েক সপ্তাহ ধরে অনুপমেরা একের পর এক পাহাড় ডিঙিয়ে যায়। এ এক মারাত্মক নেশা।

বিয়ের প্রথম বছরে নতুন বউ কী ভাবতে পারে ভেবে কিংবা হয়তো প্রণয়ের আধিক্যবশত অনুপম পাহাড়ে চড়তে যায়নি। তারপর সারা বছর সে নিজেই শুধু হা-হুঁতাশ করেছে তা নয়, গিরিবান্ধব সমিতির বন্ধুবান্ধবেরাও তাকে প্রচুর টিটকিরি দিয়েছে।

তাই এ বছর অনুপম প্রাণের টানেই হোক কিংবা বিদ্রুপের ভয়েই হোক গিরিলঙ্ঘনে শামিল হয়েছে। তবে যাওয়ার আগে মহামায়াকে সে ছোট একটি উৎকোচ দিয়েছে। মধ্য কলকাতার ঘিঞ্জি গলির চার দেওয়ালে বন্দি শ্বশুরবাড়ির নিগড়মুক্ত করে তাকে পিত্রালয়ের খোলামেলা পাখিডাকা, ছায়াভরা পরিবেশে রেখে গেছে। বসন্ত শেষে নবগ্রীষ্মের দিনের পল্লীগ্রাম এখনও মনোরম।

পাহাড় জয় করে অনুপমদের ফিরে আসতে সপ্তাহ পাঁচেক লাগে। এই পাঁচ সপ্তাহের মধ্যে দেড় সপ্তাহ বোনের বাড়িতে কাটিয়ে আগের দিন মহামায়া দিদি হেমছায়ার কাছে এসেছে। আগের মতোই জামাইবাবু মেঘলাল গিয়ে তাকে স্কুটারের পিছনে বসিয়ে নিয়ে আসছে। বিয়ের আগে মহামায়া বহুবার এ গাড়িতে এসেছে। মেঘলালবাবু জামাইবাবু হিসেবে উৎকৃষ্ট শ্রেণীর, প্রিয়তমা শ্যালিকার আদর-আপ্যায়ন যত্ন-তদ্বিরে কখনও কোনও ত্রুটি হয়নি।

মহামায়া এবং হেমছায়া দুজনায় পিঠোপিঠি বোন না হলেও প্রায় একই আদলের। উচ্চতা গায়ের রং সবই প্রায় এক রকম। তফাত শুধু এইটুকু যে হেমছায়া একটু থেমে থেমে ভেবেচিন্তে কথা বলে, তার আবেগ-অনুভূতি একটু চাপা।

এদিকে মহামায়া দিদির একেবারে বিপরীত। সে খিলখিল করে হাসে, গমগম করে রাগ করে, তেমন অঘটন ঘটলে ঝিরঝির করে চোখের জলে ভাসে।

দুই বোনের এই পার্থক্য নিতান্ত ব্যক্তিগত। পুরোপুরি মন মেজাজের ব্যাপার। কিন্তু চেহারা এবং চালচলনের দিকটা চোখে পড়ার মতো।

নিজের বিয়ের পরে প্রথম প্রথম মেঘলাল এদিকটায় খুব নজর দেননি, সে অবকাশও ছিল না কারণ তখন তার পুরো নজর হেমছায়ার ওপরে।

তবে প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে একদিন আকর্ষণ কমে যায়, তখন মেঘলাল আবার চার পাশে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে লাগলেন। মেঘলাল দুশ্চরিত্র বা সাদা কথায় যাকে বলে লম্পট তা নন, সুতরাং তার বিপথগামী হওয়ার প্রশ্ন ওঠে না। শুধু বিবাহিতা স্ত্রীর প্রতি মনোযোগ একটু হ্রাস পেল।

এই সময় মহামায়া বড় হচ্ছে। শ্বশুরালয়ে গেলে কিংবা যখন মহামায়া দিদির কাছে বেড়াতে আসত মেঘলাল শ্যালিকাকে দেখতে পেতেন। তার চোখের সামনে সাধের শ্যালিকা পল্লবিতা, কুসুমিতা হয়ে উঠল। হেমছায়া বেশ সুন্দরী। মহামায়াও ভাল দেখতে, তবে সেই সঙ্গে তার নবযৌবনের চটক ছিল।

দু বোনই প্রায় এক রকম দেখতে, আকারে-প্রকারে সুতরাং দূর থেকে দেখে কিংবা অন্যমনস্কভাবে মেঘলাল অনেক সময় ক্ষণিকের জন্যে দুজনকে গুলিয়ে ফেলতেন।

মেঘলালের এই সমচেহারায় স্ত্রী ও শ্যালিকাকে গুলিয়ে ফেলার কথা আগে কোথায় যেন লিখেছি। কিন্তু এই শালিক ও শ্যালিকা নামক গল্পে বিষয়টি এড়িয়ে গেলে অন্যায় হবে।

বেশ কয়েক বছর আগের কথা। তখনও অনুপমের সঙ্গে মহামায়ার বিয়ে হয়নি, বোধহয় কথাবার্তাও চলছে না। সেই সময়ে একদিন, বোধহয় সেটা কোনও ছুটির দিন ছিল, মহামায়া দিদির কাছে বেড়াতে এসেছে।

বিকেলবেলা বাইরের বারান্দায় বসে মেঘলালবাবু দুজন সহকর্মীর সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিলেন। দুজনই বয়েসে মেঘলালের থেকে একটু ছোট। মেঘলালের সঙ্গে একই ইস্কুলে মাস্টারি করে।

বাড়ির মধ্যে থেকে হেমছায়া বোনের হাত দিয়ে বারান্দার আড্ডায় চা পাঠিয়ে দিল। মফস্সলের বিকেলে তখন একটু আবছায়া ভাব। চায়ের ট্রে হাতে মহামায়া বারান্দায় আসতেই মেঘলালের তরুণ বন্ধুদ্বয় তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়াল। মেঘলাল ব্যাপারটা অনুমান করে দুজনাকেই বসতে বললেন, তারপর বললেন, কাকে দেখে উঠে দাঁড়াচ্ছ? ইনি তোমাদের বউদি নন, বউদির ছোট বোন।

দুজনারই তখন বেশ অপ্রস্তুত অবস্থা। মহামায়াও লজ্জায় মুখে আঁচল চাপা দিয়ে বাড়ির মধ্যে চলে গেল। কিছুক্ষণ হতবাক হয়ে থাকার পরে এদের মধ্যে একজন বলল, আমরা তো বউদি ভেবে উঠে দাঁড়িয়েছিলাম। একটু জব্দই হয়ে গেলাম।

মেঘলাল বলেছিলেন, সাহেবরা মহিলা এলেই উঠে দাঁড়ায়। তোমরাও সাহেবি আচরণ করছ।

যেমন হয়, চা খেতে খেতে এরা আবার কৌতূহলী হয়ে উঠল, আচ্ছা, বউদি আর বউদির বোন দুজনে একই রকম দেখতে।

মেঘলাল স্বীকার করলেন, ঠিক এক রকম না হলেও, অনেকটাই একরকম।

সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন হল, আপনার অসুবিধে হয় না?

প্রশ্নটা বুঝতে পেরেও একটু হেসে মেঘলাল প্রশ্ন করলেন, কীসের অসুবিধে?

এবার আসল জিজ্ঞাসা এল। মেঘলালদা, আপনি চট করে আলাদা করে বুঝতে পারেন কে সত্যি সত্যি বউদি। আর কে বউদির ছোট বোন?

মেঘলাল মৃদু হেসে জবাব দিয়েছিলেন, চট করে আলাদা করে বোঝার খুব একটা চেষ্টা করি না। প্রয়োজনও বোধ করি না।

এই প্রয়োজনীয় পুরনো ব্যাপারটি পুনরুল্লেখ করলাম নিতান্ত গল্পের খাতিরে। এরপরেও যদি গল্প না জমে সে দোষ আমার নয়, পাঠিকা ঠাকুরানি বুঝুন বা না বুঝুন সম্পাদক মহোদয় অবশ্যই বুঝতে পারছেন যে আমি চেষ্টার কোনও ত্রুটি করছি না।

সুতরাং এবার বর্তমান সময়ের সমীপবর্তী হচ্ছি। সেই যেখানে আমরা এই গল্পটাকে ফেলে এসেছিলাম, সেই বসন্তশেষ, নবগ্রীষ্মের বিহ্বল দিন, মহামায়ার বর অনুপম গেছে পাহাড় জয় করতে। মহামায়ার মনের যা অবস্থা আগেকার দিন হলে সে পাহাড়কে সতীন বলে ধরে নিত।

কিন্তু মহামায়া গ্রামের মেয়ে হলেও, মোটেই গ্রাম্য নয়। দু-চারটি প্রাচীন পাড়াগেঁয়ে সংস্কার হয়তো তার মনের মধ্যে আছে। কিন্তু একথাও মনে রাখা উচিত সে মাধ্যমিকে অঙ্কে আর জীববিজ্ঞানে লেটার পেয়েছিল। উচ্চ মাধ্যমিকে তার বিদ্যালয়ের মেয়েদের মধ্যে সেই একা গ্রেস ছাড়া ইংরেজিতে পাশ করেছিল।

কিন্তু লেখাপড়ার কথা নয়। এসব নীরস ব্যাপারে গিয়ে লাভ নেই। বরং এবার আমরা শ্রীমতী মহামায়াকে একটু ভাল করে নিরীক্ষণ করি। মেঘলালবাবুর দৃষ্টিতে তাকে একটু পর্যবেক্ষণ করা যাক।

দিদি হেমছায়ার বাড়িতে এবার মহামায়া এসেছে উৎসব উপলক্ষে। আজ অক্ষয় তৃতীয়া। এ বাড়িতে খুব ধূম।

ওই মহামায়া আসছে। তার হাতের থালায় রুপোর বাটি, লম্বা প্রদীপ। চন্দন আর সিঁদুরের দুটো রুপোর বাটি থেকে শোয়ার ঘরের, বাইরের ঘরের, রান্নাঘরের, গোয়ালঘরের দরজায় দরজায় নিপুণ তর্জনী ফোঁটা দিচ্ছে।

সালংকারা, সযৌবনা, বেনারসি পরিহিতা শ্যালিকাকে বারান্দায় ইজিচেয়ারে বসে পর্যবেক্ষণ করতে করতে মেঘলালের আগের দিনের বিকেলের কথা মনে পড়ছিল। যখন মহামায়াকে স্কুটারের পিছনে বসিয়ে নিয়ে সে এসেছিল সেই সময়কার ঘনিষ্ঠ শিহরনের কথা মনে পড়ছিল।

একটু আগে অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলেন মেঘলাল। পুরোহিত এখনও আসেনি। লোকজন, অতিথি অভ্যাগতও বেলার দিকে আসবে। একটু আগে বারান্দায় মহামায়া ছিল, কিন্তু এখন তাকে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না।

মেঘলাল ভাবলেন, বোধহয় উঠোনের ওদিকটায় পুরনো পেঁকিঘরের দরজায় সিঁদুরচন্দন লাগাতে গেছে। একটু সাবধান করতে হবে। গরমের দিন। ওদিকে আবার সাপ আছে।

বারান্দা থেকে উঠোনে নেমে মেঘলালবাবু দেখলেন মহামায়া উঠোনের চারপাশে, ঘরের ছাদে, গাছের ডালে চারপাশে তাকাচ্ছে। তারপর হঠাৎ মাথা ঘুরিয়ে মেঘলালবাবুকে দেখে আকুল কণ্ঠে বলল, জামাইবাবু, কী হবে?

চিন্তিত হয়ে মেঘলালবাবু বললেন, কেন কী হয়েছে?

মহামায়া বলল, ভারী অমঙ্গুলে ব্যাপার হয়েছে, মাত্র একটা শালিক দেখে ফেললাম। বলে গোয়ালঘরের চালে বসা একটা শালিককে আঙুল দিয়ে দেখাল। মেঘলালও চোখ দিয়ে চারদিকে খুঁজে দেখলেন দ্বিতীয় কোনও শালিক নজরে আসছে না। অবশ্য রান্নাঘরের পিছনে একটা বহু প্রাচীন কঁকড়া গাছ আছে। তার ডালপাতার ভিতরে বহুরকম পাখি কিচমিচ করছে, যার মধ্যে নিশ্চয় শালিকও আছে। তবে এখান থেকে দেখা যাচ্ছে না।

০৩.

একটি শালিক অমাঙ্গলিক
অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত

বাঙালি মাত্রেই একথা অবশ্য জানেন যে একটা শালিক হঠাৎ দেখে ফেলা খুবই অমঙ্গল ব্যাপার। বাঙালি কবি এ বিষয়ে কবিতা পর্যন্ত লিখেছেন।

একটি শালিক দৃষ্টিপথে আসা মানেই চরম দুর্ভাগ্যের ইঙ্গিত পাওয়া, খুঁজে পেতে যেভাবে হোক দ্বিতীয় শালিকটির দেখা না পেলে এই অমঙ্গলের হাত থেকে পরিত্রাণ নেই।

এই ব্যাপারটা মেঘলালবাবু জানেন। আর হেমছায়া আর মহামায়া দুজনেরই এ ব্যাপারে সংস্কার অতি প্রবল, পিত্রালয় থেকে পেয়েছে।

একটা শালিক দেখে দেখে এবং হাজার চেষ্টা করেও দ্বিতীয় শালিক দেখতে না পেয়ে হেমছায়া বেশ কিছুদিন হল ঘরের বাইরে উঠোনে বা গাছপালায় দৃষ্টিপাত করে না।

কিন্তু আজ এই অক্ষয় তৃতীয়ার পুণ্য প্রভাতে গোল বাধাল মহামায়া। বহু খুঁজে দ্বিতীয় শালিকটির সন্ধান না পেয়ে জামাইবাবুর কাছে এসে ব্যাকুল চোখে আবার বলল, কী হবে জামাইবাবু?

জামাইবাবু মেঘলাল চক্রবর্তী সামান্য লোক নন। তাঁর ধমনীতে তালুকদারের রক্ত রয়েছে। তিনি শ্যালিকাকে বললেন, দাঁড়াও। বলে শোয়ার ঘরের মধ্যে গিয়ে বড় কাঠের আলমারিটা খুলে। বহুকালের পুরনো একটা গাদা বন্দুক বার করে আনলেন। তারপর বন্দুকের নলটা শূন্যে মুখ করে। একটা ফঁকা আওয়াজ করলেন।

সঙ্গে সঙ্গে সেই প্রাচীন কাঁঠাল গাছ থেকে এবং আশপাশের থেকে অসংখ্য পাখি কিচমিচ, কিচির মিচির কা-কা ইত্যাদি নানারকম চেঁচামেচি করতে করতে দ্রুত বেগে বেরিয়ে উড়তে উড়তে বিভিন্ন দিকে চলে গেল।

এই পাখির দলের মধ্যে অন্তত দশটা শালিক।

মহামায়ার অমঙ্গল ভঙ্গ হল।

পাখিদের চিৎকার চেঁচামেচি মিটে যাওয়ার পরে মেঘলাল মহামায়াকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, কলকাতায় বউবাজারের শ্বশুরবাড়িতে জোড়া শালিক দেখতে পাও?

মহামায়া বলল, আমাদের ওদিকে কোনও শালিক নেই। একটা শালিক দেখে যেমন অমঙ্গল হয়। আবার জোড়া শালিকের সৌভাগ্যও মেলে না।

বলা বাহুল্য, জামাইবাবু মেঘলাল চক্রবর্তী শ্যালিকার এই দুঃখের সমাধান করেছেন। মহামায়ার যাতে নিয়ত সৌভাগ্য সূচিত হয় সেই জন্যে শেয়ালদা রথের মেলা থেকে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ দপ্তরের দৃষ্টি বাঁচিয়ে একটি খাঁচা সুদ্ধ এক জোড়া শালিক পাখি কিনে শ্যালিকাকে গত মাসে উপহার দিয়ে এসেছেন।

কিন্তু আজ সকালের শালিক নিয়ে বেশ সুখেই ছিল কিন্তু পাখি দুটোকে গতকাল স্নান করাতে গিয়ে দুটোরই গা থেকে রং উঠে গিয়ে ধূসর রং বেরিয়েছে। স্নানের পর পাখি দুটো দেখে মহামায়ার। শাশুড়ি বলেছেন, এ দুটো ছাতারে পাখি।

চিঠিটা পড়ার পর বাংলা অভিধান খুলে মেঘলালবাবু দেখলেন ছাতারেও শালিকজাতীয় পাখি। কোথাও কোথাও এই পাখিকে ভাটশালিক বলে।

মহামায়াকে এই কথা মেঘলালবাবু জানালেন। তবে শালিকের জায়গায় ভাটশালিক, জোড়া ভটশালিক কতখানি মঙ্গলজনক হবে সে বিষয়ে জামাইবাবু কোনও ভরসা দিতে পারলেন না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress