Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » তৃতীয় পুরুষ || Taradas Bandyopadhyay

তৃতীয় পুরুষ || Taradas Bandyopadhyay

হেমন্তের পড়ন্ত হলুদ রৌদ্র বেলা

ভূমিকা

কাজল-এর প্রথম পর্ব প্রকাশিত হয়েছিল উনিশশো সত্তর-এর জুলাই মাসে। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের পঞ্চম বার্ষিক শ্রেণীতে পড়ি। শুরু করেছিলাম আরো অনেক আগে, যখন একাদশ শ্রেণীর ছাত্র। ত্রিশ কী বত্রিশ পাতা লিখে ফেলে রেখেছিলাম। এম.এ. পড়বার সময় সাহিত্যিক মনোজ বসুর প্রেরণায় গরমের ছুটিতে মাত্র দু মাসে লেখাঁটি শেষ করি।

তারপর সাতাশ বছর কেটেছে। এই দীর্ঘ আড়াই দশকেরও বেশি সময়ে অনেক চিঠি পেয়েছি, সভা-সমিতিতে বহু মানুষ জিজ্ঞাসা করেছেন–তারপরে কাজলের কী হল? সে কি ফিরে গেল নিশ্চিন্দিপুরে? কী পেশা গ্রহণ করল সে? কে কে তার জীবনে এল এবং গেল?

এসব প্রশ্নের উত্তর দেবার একটা দায় অনুভব করেছি। তাই কাজলের এ দ্বিতীয় পর্ব। আমার জীবন, আমার উপলব্ধির প্রতিফলন কাজল। আমার বর্তমান বয়েস পর্যন্ত কাজলকে এনে বই শেষ করলাম। এর পরে কী হবে তা তো আর আমি জানি না।

প্রথম পর্বের ভূমিকা মা লিখেছিলেন। অনেক পাঠক বলেন ভূমিকাটি না কি মূল উপন্যাসের চেয়েও ভালো হয়েছিল। মা নেই, চলে গিয়েছেন গতবছর। আমার লেখার সঙ্গে সঙ্গে তিনি কি বইটি পড়লেন? কেমন লাগল তার?

এই পর্বও সাধুভাষায় লিখলাম। ভাল কি মন্দ করলাম জানি না, কিন্তু চলিত বাংলায় লিখলে পূর্বের তিনটি উপন্যাসের সঙ্গে মেজাজের মিল হত না। দীর্ঘ ছ বছর লাগল এই বই লিখতে। শুরু করবার পর এসে গিয়েছিল বিভূতিভূষণ জন্মশতবর্ষ। প্রায় তিনবছর কিছুই লিখিনি।

গল্প জমাবার প্রলোভনে লুব্ধ হইনি, প্রকৃত জীবনকে মর্যাদা দিয়েছি। তবে লেখক লেখেন বটে, কিন্তু গ্রন্থ আসলে পাঠকদের। শেষ বিচারও তাদেরই।

কৃতজ্ঞতা মিত্র ও ঘোষ-এর সবার প্রতি। তাঁরা আজীবন আমার ওপর স্নেহবর্ষণের প্রতিশ্রুতিতে আরদ্ধ।

তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়

প্রথম পরিচ্ছেদ

হেমন্তের পড়ন্ত হলুদ রৌদ্র বেলা যাইবার সঙ্গে সঙ্গে অপূর্ব মায়াময় হইয়া উঠিলে চিরকালের অভ্যাসমতো কাজল একটা খাতা বা বই হাতে বাহির হইয়া পড়ে। জীবনে এমন কিছু শিক্ষা আছে যাহা কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুমহাশয়রা দান করিতে পারেন না, অথচ যাহার উপর নির্ভর করিয়াই মানুষের জীবন আরর্তিত হয়। প্রকৃতির ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য হইতে কাজল সেই একান্ত প্রয়োজনীয় শিক্ষা গ্রহণ করিতেছিল। সদ্যোজাত শিশুকে যেমন মাতৃস্তন্য পান করিবার কৌশল শিখাইয়া দিতে হয় না, আপন ক্ষুধার তাড়নায় এবং সহজাত প্রবৃত্তিবশত সে নিজেই জীবনদায়িনী পীযুষধারার প্রতি আকৃষ্ট হয়—তেমনি কাজলের হৃদয়ের একেবারে গভীরে যে বিপুল ক্ষুধা জাগিয়া উঠিয়াছিল তাহারই নিবারণের জন্য সে ব্যগ্র দুই হাতে প্রকৃতির ভাণ্ডার হইতে বাঁচিবার উপাদান সংগ্রহ করিয়া লইতেছিল।

তার সহজাত প্রবৃত্তির দিকটা আসিয়াছিল বাবার কাছ হইতে। বাহিরে যতই আলো থাক, বন্ধ ঘরে সে আলো প্রবেশ করে না। বাবা তাহার মনের জানালাগুলি নিজের হাতে খুলিয়া দিয়া গিয়াছে।

বয়েস বাড়িবার সঙ্গে সঙ্গে কাজল লক্ষ করিল অশৈশব লালিত সহজ বিশ্বাসগুলি একে একে বিদায় লইতেছে। দেবমূর্তি দেখিলে অভ্যাসবশত এখনও দুই হাত প্রণামের ভঙ্গিতে কপালের দিকে ওঠে বটে, কিন্তু তাহার সহিত বিশ্বাস ও প্রাণের যোগ থাকে না। মানুষের সারল্য এবং ভালো দিকের ওপর যে গভীর আস্থা ছিল, দুনিয়ার রকমসকম দেখিয়া তাহাও অনেকখানি ক্ষয় পাইয়াছে। বস্তুত এখন তাহার মনে হয় পৃথিবীর বেশির ভাগ লোক জীবনের গূঢ় রহস্য জানিবার জন্য বা সততার পরীক্ষা দিবার জন্য উদগ্রীব হইয়া বসিয়া নাই, তাহারা বাঁচিয়া আছে জীবনযাপনের বেলায় মোটারকম লাভ করিয়া সুখে কাল কাটাইবার জন্য। কেহ অন্যরকম কিছু করিলে তাহারা অবাক হইয়া তাকাইয়া থাকে।

প্রকৃতির অনাদ্যন্ত প্রসারের মধ্যে এই হীনতা নাই। সেখানে সব কিছুই বড়ো মাপের। আকাঙ্ক্ষা, বিস্ময়, আনন্দ এবং বেদনা যত বড়ো মাপেরই হোক, প্রকৃতির বিস্তারের ভিতব তাহা বেশ খাপ খাইয়া যায়। বোধহয় এই কারণেই তীব্র হর্ষ বা বেদনার মুহূর্তে মানুষ উধ্বমুখে আকাশের অসীমতার দিকে তাকায়। বোধহয় এইজন্যই কাজল জীবনের গঢ় প্রশ্নগুলির উত্তর খুঁজিবার জন্য বই হাতে মাঠের দিকে চলিয়া যাইবার অভাস করিয়াছিল।

কিছুই তুচ্ছ নয়, কিছুই ফেলিয়া দিবার মতো নয়। গ্রামের পথে চলিয়া যাইতে যাইতে বাশঝাড়ের পাশে কুড়াইয়া পাওয়া একটা পাখির পালক—তাই যেন কী অমূল্য সম্পদ। বহুদিন পরে পুরানো ডায়েরির পাতার ভাজ হইতে অকস্মাৎ বাহির হইয়া পালকটা মনোরাজ্যে কী ভয়ানক গোলযোগ উপস্থিত করে। কবেকার বিস্মৃত প্রথম যৌবনের আনন্দমাখা দিনের স্পর্শ এখনও উহার গায়ে লাগিয়া আছে। কী হইয়াছিল সেদিন? কেমন করিয়া সুর্য উঠিয়াছিল? দক্ষিণ হইতে বহিয়া আসা সুরভিত বাতাস কোন্ স্বপ্নরাজ্যের সন্ধান দিয়াছিল?

সমস্তটা মনে পড়ে না। পাখিটাও মরিয়া গিয়াছে হয়তো কবেই। তবু ফেলিয়া দেওয়া যায় না। রেলওয়ে স্টেশনের সামনে হইতে পরবর্তী মহকুমা শহরের দিকে যে পাকা সড়ক চলিয়া গিয়াছে তাহা ধরিয়া মাইলখানেক হটিলেই পথের দুইধারে ছোট ছোট সুন্দর গ্রাম পড়িতে থাকে। রঙ্গপুর, সাইবনা-ভারি মিষ্টি নাম গ্রামগুলির। এই সড়ক ধরিয়া মাইল তিনেক যাইবার পর বাঁদিকে নামিয়া গেলে একটা বিশাল বিলের প্রান্তে রাস্তা শেষ হইয়া যায়। গতবৎসর বসন্তকালে আমের বউল দেখিবার জন্য বাহির হইয়া কাজল জায়গাটা আবিষ্কার করিয়াছে। সেই প্রথম দিনটার কথা সে কখনও ভুলিবে না। পাকা সড়ক হইতে নামিয়া প্রথমে চাষিদের কয়েকটি বাড়ি-খড়ের চাল, গোবর দিয়া উঠান নিকানো। শালিক চড়ইয়ের দল মাটিতে ছড়ানো শস্যের দানা খুঁটিয়া খাইতেছে। উঠানের প্রান্তে মাচার উপর শসা, কুমড়া বা লাউয়ের লতা বাড়িয়া উঠিয়াছে। বাতাসে রৌদ্রদগ্ধ মাটির গন্ধ। সব মিলাইয়া চারদিকে কেমন একটা শান্তির ছবি। বাড়ি কয়খানা ছাড়াইলেই একটা বেশ বড়ো আমবাগান। সবগুলি গাছেই অসম্ভব বউল আসিয়াছে, পাতা দেখা যায় না। আশ্চর্য গভীর সুবাসে বসন্ত-অপরাহের বাতাস মদির হইয়া আছে। ওয়ার্ডসওয়ার্থের লাইনস রিট ইন আর্লি সামার মনে পড়াইয়া দেয়। কবিরা ঠিকই বলেন, এইরূপ গন্ধে মাতাল হইয়া মৌমাছিরা ফুলের উপর ঘুমাইয়া পড়িতে পারে বটে।

ওই বসন্তের রৌদ্র, ওই প্রস্ফুটিত আম্রমুকুলের সৌরভ আরও যেন কত কী কথা মনে আনিয়া দিয়াছিল। কবেকার হারাইয়া যাওযা হাসিকান্না এবং জীবনযাপনের ইতিহাস—এই জন্মের কয়েকটা বৎসর মাত্র নয়, অতীত ও বর্তমানের সীমারেখার ঊর্ধ্বে কোন নিত্য আনন্দের রাজ্যে যে শাশ্বত জীবনপ্রবাহ চিরবহমান, সেদিনের আমের বউলের মাদকতাময় গন্ধ সেই দৈবী জীবনের স্পর্শ এক খণ্ডমুহূর্তের জন্য বহন করিয়া আনিয়াছিল।

তার পর হইতে কাজল মাঝে মাঝে এখানে বেড়াইতে আসে। নির্জন স্থান আরও আছে, কিন্তু দিগন্তপ্রসারী বিলের ধারে পিটুলি ফলের গাছের নিচে তাহার প্রিয় জায়গাটিতে বসিলেই চোখে কে যেন স্বপ্নের তুলি বুলাইয়া দেয়। অন্য স্থানে সহসা এমন হয় না। জায়গাটার গুণ আছে মানিতেই হইবে।

বিলের ধারে পৌঁছাইতে বৈকাল সাড়ে তিনটা বাজি গেল। এ বৎসর প্রায় কালীপূজা পর্যন্ত বেশ ভালোরকম বৃষ্টি হইয়াছে। ফলে অন্যান্য বৎসবেব মতো হেমন্তের শেষে বিল শুকাইয়া যায় নাই, এখানে-ওখানে জল বাধিয়া আছে। পিটুলি গাছের তলায় যেখানে সে বসে তাহার কাছেই হাঁটুসমান জল ও কাদার মধ্যে দাঁড়াইয়া একটা লোক লম্বামতো অর্ধমগ্ন কী জিনিস লইযা ভযানক ধস্তাধস্তি করিতেছে। ব্যাপার কী দেখিবার জন্য কাজল তাহার কাছে গিযা দাঁড়াইল।

রহস্যময় প্রচেষ্টায় সাময়িক ক্ষান্তি দিয়া লোকটা সোজা হইয়া কোমরে জড়ানো গামছা খুলিয়া কপালের ঘাম মুছিতে লাগিল। কাজল বলিল—কী করছছা ভাই? ওটা কি জলের মধ্যে?

লোকটা মুখ তুলিয়া কাজলকে দেখিল—এবং কিছুমাল বিস্মিত হইল না। কাজল কে, কোথা হইতে আসিয়া এই মাঠের মধ্যে দাঁড়াইয়া আছে, সে সম্বন্ধে কিছুমাত্র ঔৎসুক্য প্রকাশ না করিয়া এমন সহজ স্বরে কথা বলিতে আরম্ভ করিল যে, শুনিলে মনে হইতে পারে গত একঘণ্টা ধরিয়া সে কাজলের সহিত তাহার সমস্যার বিষয়ে গভীর আলোচনা করিতেছে।

–আর বলেন কেন দাদাবাবু! রোজই তো সাবধান করি, করি না? তবু এমন বজ্জাতি করলে ঠাণ্ডা মানুষের মাথায় রক্ত ওঠে কিনা আপনিই বলেন? বলি, পয়সা দিয়া কেনা জিনিস তো-নাকি মাগনার? আপনার কাছে আর মিথ্যে বলি কেন, গণেশ ছুতোর,এখনও তিন গণ্ডা টাকা পাবে এর দরুন। পইপই করে বারণ করি রোজ, রোজ তবু সেই একই কাণ্ড!

কাজল মাথা চুলকাইয়া বলিল—কিন্তু জলের মধ্যে ওটা কী?

-নৌকো দাদাবাবু, নৌকো। বিলের ভেতর মাছ ধরে র্যা দু-পয়সা পাই তাতে কষ্টেস্ৰেষ্টে সংসার চলে, আর গরমেন্টের রাস্তার ধারে নতুন গাঁয়ের ছেলেগুলো রোজ করবে কি, নৌকোখানা ডুবিয়ে রেখে যাবে! একবার ধরতে পারলে ঠেঙিয়ে বেন্দাবন দেখিয়ে দেব

কোমরে গামছা জড়াইয়া লোকটা আবার কিছুক্ষণের আপ্রাণ প্রচেষ্টায় জলমগ্ন নৌকাটি সোজা করিয়া ভাসাইয়া তুলিল। জিনিসটাকে নৌকা বলিলেও চলে, ডিঙি বলিলেও মিথ্যা বলা হয় না। পাড়ে রাখা হোট হাতজাল, দুই-তিনটা মেটে কলসী আর একখানা দাঁড় গুছাইয়া লইয়া লোকটা নৌকায় গিয়া উঠিল। দাঁড়ের ধাক্কায় সে পাড় হইতে দূরে সরিয়া যাইবার উদ্যোগ করিতেছে, এমন সময় কাজল বলিল–আমি উঠব তোমার নৌকোয়? নেবে আমায়?

লোকটার শরীরে কৌতূহল বলিয়া জিনিস নাই। কাজল কে, কেনই বা সে নৌকায় সঙ্গী হইতে চাহিতেছে এসব কালক্ষেপকারী অকারণ প্রশ্ন না তুলিয়া সে সহজ গলায় বলিল—উঠবেন? উঠে পড়ন তাহলে–

–উলটে যাবে না তো?

গণেশ ছুতাবের তৈয়ারি এই অপূর্ব শিল্পকীর্তি সম্বন্ধে সন্দেহ প্রকাশ করাতে লোকটা কিঞ্চিৎ চটিয়া গেল। বলিল—ডুবে যাবে জানলে কী উঠতে বলতাম?

আর বাক্যব্যয় না করিয়া কাজল সন্তর্পণে নৌকায় উঠিয়া পড়িল। নৌকা বিপজ্জনকভাবে দুইদিকে কয়েকবার দুলিয়া আবার সমান হইল বটে, কিন্তু কাজল দেখিল গৌরবার্থে নৌকা বলিয়া প্রচারিত এই সংকীর্ণ ডিঙিতে দাঁড়াইয়া থাকা সম্ভব নয়। সে সাবধানে উবু হইয়া বসিয়া দুইদিকের কানার কাঠ চাপিয়া ধরিল। লোকটা তাহা দেখিয়া বলিল—কী, ভয় করছে বুঝি?

কাজল হাসিয়া বলিল—না, ভয় করবে কেন? তবে অভ্যেস নেই তো, দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না!

তারপর জলের দিকে তাকাইয়া বলিল—অবশ্য পড়ে গেলেই বা কী? এখানে জল বোধহয় এক কোমরও হবে না, তাই না? আমি শীতকালে এসে শুকনো মাঠ দেখে গিয়েছি।

—জল কম, কিন্তু কাদা বেশি। পড়লে থকথকে কাদায় গেঁথে যাবে বুক অবধি। তাছাড়া এ বিল বড়ো খারাপ জায়গা, এখানে জলের নিচে কালামনিষ আছে—

কাজল অবাক হইয়া বলিল–কালামনিষ আবার কী?

–তা জানিনে। তাকে তো কেউ দেখতে পায় না। কেবল জলে পড়ে গেলে, কিংবা নৌকো থেকে পা ঝুলিয়ে বসলে কালামনিষ সাঁই করে জলের নিচে টেনে নেয়।

কাজল বলিল–বিলের এটুকু জল তো আর ক-দিনের মধ্যেই শুকিয়ে যাবে, তখন কালামনিষকে দেখতে পাওয়া যাবে না?

লোকটা একবার চোখে কাজলের দিকে তাকাইল, তারপর বলিল—না, জল শুকোনোর আগেই কালামনিষ মাটির তলায় চলে যায়। একবচ্ছর মাটির নিচে ঘুমোবার পর নতুন বর্ষার জল পেলেই তার ঘুম ভাঙে। সেজন্য প্রথম বর্ষার সময়টা বড্ড খারাপ দাদাবাবু কালামনিষের পেটে তখন দারুণ খিদে, বছরভোর খায়নি কিনা। নির্জন বিলের মধ্যে একা পেলেই হল, সে মানুষকে আর ফিরতে হচ্ছে না।

-তোমার পরিচিত কাউকে কখনও কালামনিষ ধরেনি?

–ধরেনি আবার! এই তো তিনবছর আগেকার কথা, আষাঢ়ের শেষ, বুঝলেন? চার-পাঁচদিন ধরে উপুরঝান্ত বিষ্টি হচ্ছে, দুপুরবেলা মেঘে সন্ধের মতো অন্ধকার। আর কী বাজ পড়া! গড়ম গুড়ম আওয়াজে কানে তালা লেগে যায়! শোঁ শো করে ভেজা বাতাস বইছে সারাদিন। এর মধ্যে দুপুরে কাঁচালঙ্কা আর পেঁয়াজ দিয়ে পান্তাভাত খেয়ে আমাদের গ্রামের নবীন হালদারের ছেলে হারাধন খ্যাপলা জাল আর পোলো নিয়ে বিলে গেল মাছ ধরতে। তার ঠাকুরমা বারণ করেছিল-হারু, এই দুজোগে বেরুস না মানিক আমার! তা দাদাবাবু, হারাধনকে তখন কালে ধরেছে, সে ভালো কথা কানে তুলবে কেন? তারপর দুপুর যায়, বিকেল যায়, হারাধন আর ফেরে না। তার ঠাকুরমা কান্নাকাটি শুরু করাতে গ্রামের লোকজন দল বেঁধে খুঁজতে বেরিয়ে বিলের ওপারে হারাধনের দেহ দেখতে পায়। কাদাজলের ভেতর মুখ-গুজড়ে পড়ে ছিল, পোলোটা পাশে পড়ে, কিন্তু খ্যাপলা জালখানা আর পাওয়া যায়নি।

–বেঁচে ছিল?

-না দাদাবাবু, মরে কাঠ। শরীলে কোনো দাগ নেই, ঘা নেই–শুধু এমনি এমনি প্রাণটা বেরিয়ে গিয়েছে—

কাজল বলিল–সাপেও তো কামড়ে থাকতে পারে?

-সাপে কামড়ালে শরীলে তার দাগ থাকবে তো? তাছাড়া সাপে কাটলে মানুষ সঙ্গে সঙ্গে মরে যায় না। তেমন হলে গামছার বাঁধন দিয়ে বাড়ি পৌঁছে যেত হারাধন।

শরীরটা যখন খায় না, তাহলে খামোকা কালামনিষ মানুষ ধরে কেন? তার পেটই বা ভরে কীভাবে?

লোকটা দাঁড় টানা বন্ধ করিয়া বলিল—কালামনিষ মাংস খায় না, রক্ত খায়। হারাধনের দেহটা ফ্যাকাসে মেরে গিয়েছিল।

বেলাশেষের আকাশ দিগন্ত প্রসারী বিলের ওপর ঝুঁকিয়া পড়িয়াছে। বহুদূরে একটি গ্রামের সীমারেখা দেখা যায়। প্রান্তরের উপর আসন্ন সন্ধ্যায় হাল্কা কুয়াশা জমা হইতেছে। কোথা হইতে একটা পাখি ডাকিয়া উঠিল—ট্টি-টি-ট্টি–

হারাধন সম্ভবত বজ্রাহত হইয়া মারা পড়িয়াছিল, ঝড়বৃষ্টির সময় খোলা মাঠে জলের মধ্যে দাঁড়াইয়া থাকিলে যা হয়। কিন্তু এই সরল মানুষটিকে বিজ্ঞানবৃক্ষের ফল খাওয়াইয়া লাভ নাই। ইহার সরল জীবনযাত্রা, সামান্য দুই-একটা অপ্রাকৃতে বিশ্বাস ইহার জীবনকে সরস ও অর্থপূর্ণ করিয়াছে। যুগান্তের চর্চায় সঞ্চিত সেই জীবনদৃষ্টিকে আধুনিক বিজ্ঞানের আঘাতে ধ্বংস করিয়া তাহার বদলে কোন্ নতুন মূল্যবোধ সে ইহার হাতে তুলিয়া দিবে? না, কালামনিষই ভালো!

মুখে বিশ্বাস, ভয় এবং সম্ভ্রম একসঙ্গে ফুটাইবার চেষ্টা করিতে করিতে কাজল বলিল–সত্যি, এ ঘটনা শোনবার পরে আর অবিশ্বাস থাকে না বটে। তুমি অনেক কিছু দেখেছে, না? আমি মাঝে মাঝে এসে তোমার গল্প শুনে যাব।

প্রাজ্ঞতার অভিমানে লোকটি একখানা বিড়ি ধরাইল।

বিলের প্রায় অপর প্রান্তে জল শেষ হইয়া চাষের ক্ষেত শুরু হইয়াছে। সংকীর্ণ একটি নালা দিয়া বিলের জল বাহির হইয়া চাষের জমিতে পড়িবার ব্যবস্থা করা আছে। নালার মুখে বেতের একটি বাক্সমতো বসানো, জল তাহার মধ্য দিয়া প্রবাহিত হয়। লোকটি জলের মধ্যে হাত দিয়া ঘোট আর মাঝারি আকারের কয়েকটি মাছ সেই বাক্সের ভিতর হইতে বাহির করিয়া মেটে কলসীতে পুরিল।

আবার এপারে ফেরা। বিলের ধারে ধারে অগভীর জলকাদার মধ্যে লম্বা লম্বা ঘাস জন্মাইয়াছে। অনেক দূরে মাঠের উপর দিয়া সাদারঙের কয়েকটা গরু সন্ধ্যার আভাস পাইয়া বাড়ির দিকে ফিরিতেছে। জলের উপর দাঁড়ের ছপছপ শব্দ। পশ্চিম আকাশে মেঘের স্তূপে যেন অগ্নিকাণ্ডের প্রতিচ্ছবি পড়িয়াছে। কাজলের মনে হইল—When barred clouds bloom the soft-dying day এখানে সময়ের আলাদা কোন মূল্য নাই, মহাকাল এখানে মানুষের নির্মিত মানযন্ত্র দ্বারা কৃত্রিমভাবে খণ্ডিত নয়। আকাশের নিচে শুইয়া থাকা এই বিস্তীর্ণ প্রান্তরে, এই বিলের প্রসারে, দূরের ওই আরছা-দেখিতে-পাওয়া গ্রামে দ্রুতগতিতে ধাবমান কাল লেনও প্রভাব ফেলিতে পারে নাই। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরিয়া শান্তভাবে দিন আসে যায়, বিলের ধারে জলজ ঘাসের সারি বাড়িয়া ওঠে—আবার ঋতুর অন্তে শুষ্ক হইয়া ঝরিয়া পড়িয়া যায়। নদী দিপরিবর্তন করে, উদ্ধত রাজচক্রবর্তীর বিজয়স্বপ্ন শরতের মেঘের মতো কোথাও কিছুমাত্র চিহ্ন না রাখিয়া মিলাইয়া যায়কেবল সরল, পরিশ্রমশীল সাধারণ মানুষের কালজয়ী জীবনপ্রবাহ সমস্ত কিছুকে উপেক্ষা করিয়া শাশ্বতধারায় বহিতে থাকে। সাক্ষী থাকে কেবল আকাশের নক্ষত্রেরা।

বিলের এপারে আসিয়া নামিতে নামিতে সন্ধ্যা হইয়া গেল। কাজল জিজ্ঞাসা করিল–-তোমার নাম কী ভাই? সেটাই তো জানা হল না—

লোকটি বলিল—আমার নাম কানাই। কানাই জেলে বললে, এখানে সবাই চিনবে।

-আমি কিন্তু সময় পেলেই আসব তোমার কাছে। গল্প শুনব।

কানাই জেলে গল্প বলিতে পারে বটে, কিন্তু ব্যক্তিগত সংলাপ খুব বেশিক্ষণ চালাইবার ব্যাপারে তাহার পারদর্শিতা নাই। সে সংক্ষেপে বলিল—আসবেন।

কাজল পেছন ফিরিয়া কয়েক পা চলিয়া আসিয়াছে, কানাই জেলে পিছন হইতে ডাকিল দাদাবাবু, ও দাদাবাবু!

কাজল তাকাইয়া দেখিল কানাই কী একটা হাতে লইয়া তাহার দিকে আগাইয়া আসিতেছে। সে বলিল—কী হয়েছে কানাই? কিছু বলবে?

তাহার হাতে কচুপাতায় জড়ানো একখানি আন্দাজ দেড়পোয়া ওজনের শালমাছ দিয়া কানাই বলিল–নিয়ে যান, রান্না করে খাবেন–

সরল মানুষটির আর কিছু নাই। প্রথম পরিচয়ের নিদর্শনস্বরুপ তাই সে তাহার সারাদিনের পরিশ্রমের কিছু অংশ কাজলকে দিল।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25
Pages ( 1 of 25 ): 1 23 ... 25পরবর্তী »

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *