Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » ভ্রান্তিবিলাস || Ishwar Chandra Vidyasagar

ভ্রান্তিবিলাস || Ishwar Chandra Vidyasagar

প্রথম পরিচ্ছেদ

বিজ্ঞাপন

কিছু দিন পূর্ব্বে, ইংলণ্ডের অদ্বিতীয কবি সেক্সপীরের প্রণীত ভ্রান্তিপ্রহসন পাঠ করিয়া আমার বোধ হইয়াছিল, এতদীয় উপাখ্যানভাগ বাঙ্গালাভাষায় সঙ্কলিত হইলে, লোকের চিত্তরঞ্জন হইতে পারে। তদনুসারে ঐ প্রহসনের উপাখ্যানভাগ বাঙ্গালাভাষায় সঙ্কলিত ও ভ্রান্তিবিলাস নামে প্রচারিত হইল।

সেক্সপীর, পঁয়ত্রিশখানি নাটক রচনা করিয়া, বিশ্ববিখ্যাত ও চিরস্মরণীয় হইয়া গিয়াছেন। তাঁহার প্রণীত নাটকসমূহে কবিত্বশক্তির ও রচনাকৌশলের পরা কাষ্ঠা প্রদর্শিত হইয়াছে। এতদ্ব্যতিরিক্ত, তিনি চারিখানি খণ্ড কাব্য ও কতকগুলি ক্ষুদ্রকাব্য রচনা করিয়াছেন। অনেকে বলেন, তিনি যে কেবল ইংলণ্ডের অদ্বিতীয় কবি ছিলেন, এরূপ নহে; এ পর্য্যন্ত ভূমণ্ডলে যত কবি প্রাদুর্ভূত হইয়াছেন, কেহই তাঁহার সমকক্ষ নহেন। এই সিদ্ধান্ত অভ্রান্ত বা পক্ষপাতবিবর্জিত কি না, মাদৃশ ব্যক্তির তদ্বিচারে প্রবৃত্ত হওয়া নিরবচ্ছিন্ন প্রগল্‌ভতাপ্রদর্শন মাত্র।

ভ্রান্তিপ্রহসন কাব্যাংশে সেক্সপীরের প্রণীত অনেক নাটক অপেক্ষা অনেক অংশে নিকৃষ্ট; কিন্তু উহার উপাখ্যানটি যার পর নাই কৌতুকাবহ। তিনি এই প্রহসনে হাস্যরস উদ্দীপনের নিরতিশয় কৌশল প্রদর্শন করিয়াছেন। পাঠকালে হাস্য করিতে করিতে শ্বাসরোধ উপস্থিত হয়। ভ্রান্তিবিলাসে সেক্সপীরের সেই অপ্রতিম কৌশল নাই, সুতরাং, ইহা পাঠ করিয়া লোকের তাদৃশ চিত্তরঞ্জন হইবেক, তাহার সম্ভাবনা নাই।

বাঙ্গালাপুস্তকে ইয়ুরোপীয় নাম সুশ্রাব্য হয় না; বিশেষতঃ, যাঁহারা ইঙ্গরেজী জানেন না, তাদৃশ পাঠকগণের পক্ষে বিলক্ষণ বিরক্তিকর হইয়া উঠে। এই দোষের পরিহারবাসনায়, ভ্রান্তিবিলাসে সেই সেই নামের স্থলে এতদ্দেশীয় নাম নিবেশিত হইয়াছে। উপাখ্যানে এবংবিধ প্রণালী অবলম্বন করা কোনও অংশে হানিকর বা দোষাবহ হইতে পারে না। ইতিহাসে বা জীবনচরিতে নামের যেরূপ উপযোগিতা আছে, উপাখ্যানে সেরূপ নহে।

যদি ভ্রান্তিবিলাস পাঠ করিয়া, এক ব্যক্তিরও চিত্তে কিঞ্চিন্মাত্র প্রীতিসঞ্চার হয়, তাহা হইলেই শ্রম সফল বোধ করিব।

শ্রীঈশ্বরচন্দ্র শর্ম্মা
বর্দ্ধমান।
৩০ এ আশ্বিন। সংবৎ ১৯২৬।

————–

প্রথম পরিচ্ছেদ

হেমকূট ও জয়স্থল নামে দুই প্রসিদ্ধ প্রাচীন রাজ্য ছিল। দুই রাজ্যের পরস্পর ঘোরতর বিরোধ উপস্থিত হওয়াতে, জয়স্থলে এই নৃশংস নিয়ম বিধিবদ্ধ হয়, হেমকূটের কোনও প্রজা, বাণিজ্য বা অন্যবিধ কার্য্যের অনুরোধে, জয়স্থলের অধিকারে প্রবেশ করিলে তাহার গুরুতর অর্থদণ্ড, অর্থদণ্ড প্রদানে অসমর্থ হইলে প্রাণদণ্ড, হইবেক। হেমকূটরাজ্যেও, জয়স্থলবাসী লোকদিগের পক্ষে, অবিকল তদ্রূপ নিয়ম প্রতিষ্ঠিত হয়। উভয় রাজ্যই বাণিজ্যের প্রধান স্থান। উভয় রাজ্যের প্রজারাই উভয়ত্র বিস্তারিত রূপে বাণিজ্য করিত। এক্ষণে, উভয় রাজ্যেই উল্লিখিত নৃশংস নিয়ম ব্যবস্থাপিত হওয়াতে, সেই বহুবিস্তৃত বাণিজ্য এক কালে রহিত হইয়া গেল।

এই নিয়ম প্রচারিত হইবার কিঞ্চিৎ কাল পরে, সোমদত্ত নামে এক বৃদ্ধ বণিক, ঘটনাক্রমে জয়স্থলে উপস্থিত হইয়া, হেমকূটবাসী বলিয়া পরিজ্ঞাত ও বিচারালয়ে নীত হইলেন। জয়স্থলে অধিরাজ বিজয়বল্লভ স্বয়ং রাজকার্য্য পর্য্যবেক্ষণ করিতেন। তিনি, সবিশেষ অবগত হইয়া, সোমদত্তের দিকে দৃষ্টি সঞ্চারণ পূর্ব্বক কহিলেন, অহে হেমকূটবাসী বণিক! তুমি, প্রতিষ্ঠিত বিধি লঙ্ঘন পূর্ব্বক, জয়স্থলের অধিকারে প্রবেশ করিয়াছ, এই অপরাধে আমি তোমার পাঁচ সহস্র মুদ্রা দণ্ড করিলাম; যদি অবিলম্বে এই দণ্ড দিতে না পার, সায়ংকালে তোমার প্রাণদণ্ড হইবেক।

অধিরাজের আদেশবাক্য শ্রবণ করিয়া, সোমদত্ত কহিলেন, মহারাজ! ইচ্ছা হয়, সচ্ছন্দে আমার প্রাণদণ্ড করুন, তজ্জন্য আমি কিছুমাত্র কাতর নহি। আমি অহর্নিশ দুর্বিষহ যাতনা ভোগ করিতেছি; মৃত্যু হইলে পরিত্রাণ বোধ করিব। কিন্তু, মহারাজ! যথার্থ বিচার করিলে, আমার দণ্ড হইতে পারে না। সাত বৎসর অতীত হইল, আমি জন্মভূমি পরিত্যাগ করিয়া দেশপর্য্যটন করিতেছি। যৎকালে হেমকূট হইতে প্রস্থান করি, উভয় রাজ্যের পরস্পর বিলক্ষণ সৌহৃদ্য ছিল। এক্ষণে পরস্পর যে বিরোধ ঘটিয়াছে, এবং ঐ উপলক্ষে উভয় রাজ্যে যে এরূপ কঠিন নিয়ম বিধিবদ্ধ হইয়াছে, তাহা আমি অবগত নহি। যদি, প্রচারিত নিয়মের বিশেষজ্ঞ হইয়া, আপনকার অধিকারে প্রবেশ করিতাম, তাহা হইলে আমি অবশ্য অপরাধী হইতাম।

এই সকল কথা শ্রবণ করিয়া, বিজয়বল্লভ কহিলেন, শুন, সোমদত্ত! জয়স্থলের প্রচলিত বিধি সর্ব্বতোভাবে প্রতিপালন করিয়া চলিব, কদাচ তাহার অন্যথাচরণ করিব না, ধর্ম্মপ্রমাণ এই প্রতিজ্ঞা করিয়া, আমি অধিরাজপদে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছি। সুতরাং জয়স্থলে, হেমকূটবাসী লোকদিগের পক্ষে যে সমস্ত বিধি প্রচলিত আছে, আমি প্রাণান্তেও তাঁহার বিপরীত আচরণ করিতে পারিব না। জয়স্থলের কতিপয় পোতবণিক দুই রাজ্যের বিরোধ ও অভিনব বিধি প্রচলনের বিষয় কিছুমাত্র অবগত ছিল না। তাহারাও, তোমার মত, না জানিয়া হেমকূটের অধিকারে প্রবেশ করিয়াছিল। তোমাদের অধিরাজ, নবপ্রবর্ত্তিত বিধির অনুবর্ত্তী হইয়া, প্রথমতঃ, তাহাদের অর্থদণ্ড বিধান করেন। অর্থদণ্ড প্রদানে অসমর্থ হওয়াতে, অবশেষে তাহাদের প্রাণদণ্ড হইয়াছে। এই নৃশংস ঘটনা জয়স্থলবাসীদিগের অন্তঃকরণে সম্পূর্ণ জাগরূক রহিয়াছে। এ অবস্থায়, আমি, প্রচলিত বিধি লঙ্ঘন পূর্ব্বক, তোমার প্রতি দয়া প্রদর্শন করিতে পাবি না। অবিলম্বে পাঁচ সহস্র মুদ্র দিতে পারিলে, তুমি অক্ষত শরীরে স্বদেশে প্রতিগমন করিতে পার; কিন্তু আমি তাহার কিছুমাত্র সম্ভাবনা দেখিতেছি না; কারণ, তোমার সমভিব্যাহারে যাহা কিছু আছে, সমুদয়ের মূল্য ঊর্দ্ধসংখ্যায় দুই শত মুদ্রার অধিক হইবেক না; সুতরাং সায়ংকালে তোমার প্রাণদণ্ড একপ্রকার অবধারিত বলিতে হইবেক।

এই সমস্ত কথা শ্রবণ করিয়া, সোমদত্ত অক্ষুব্ধচিত্তে কহিলেন, মহারাজ! আমি যে দুঃসহ দুঃখপরম্পরা ভোগ করিয়া আসিতেছি, তাহাতে আমার অণুমাত্রও প্রাণের মায়া নাই। আপনকার নিকট অকপট হৃদয়ে কহিতেছি, এক ক্ষণের জন্যেও আমি বাঁচিতে ইচ্ছা করি না। আপনি সায়ংকালের কথা কি বলিতেছেন, এই মুহূর্ত্তে প্রাণবিয়োগ হইলে, আমার নিস্তার হয়।

ঈদৃশ আক্ষেপ বাক্য শ্রবণে, অধিরাজের অন্তঃকরণে বিলক্ষণ অনুকম্পা ও কৌতূহল উদ্ভূত হইল। তখন তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, সোমদত্ত! কি কারণে তুমি মরণ কামনা করিতেছ, কি হেতুতেই বা তুমি, জন্মভূমি পরিত্যাগ করিয়া, ক্রমাগত সাত বৎসর কাল দেশপর্য্যটন করিতেছ; কি উপলক্ষেই বা তুমি অবশেষে জয়স্থলে উপস্থিত হইয়াছ, বল। সোমদত্ত কহিলেন, মহারাজ! আমার অন্তর নিরন্তর দুঃসহ শোকদহনে দগ্ধ হইতেছে; জন্মভূমি পরিত্যাগের ও দেশপর্য্যটনের কারণ নির্দ্দেশ করিতে গেলে, আমার শোকানল শতগুণ প্রবল হইয়া উঠিবেক। সুতরাং, আপনকার আদেশ প্রতিপালন অপেক্ষা আমার পক্ষে অধিকতর আন্তরিক ক্লেশকর ব্যাপার আর কিছুই ঘটিতে পারে না। তথাপি, আপনকার সন্তোষার্থে, সংক্ষেপে আত্মবৃত্তান্ত বর্ণন করিতেছি। তাহাতে আমার এক মহৎ লাভ হইবেক। সকল লোকে জানিতে পারিবেক, আমি, কেবল পরিবারের মায়ায় বদ্ধ হইয়া, এই অবান্ধব দেশে রাজদণ্ডে প্রাণত্যাগ করিতেছি; আমার এই প্রাণদণ্ড কোনও গুরুতর অপরাধ নিবন্ধন নহে।

মহারাজ! শ্রবণ করুন, আমি হেমকূটনগরে জন্মগ্রহণ করি। যৌবনকাল উপস্থিত হইলে, লাবণ্যময়ী নাম্নী এক সুরূপা রমণীর পাণিগ্রহণ করিলাম। লাবণ্যময়ী যেমন সৎকুলোৎপন্না, তেমনই সদ্‌গুণ সম্পন্ন ছিলেন। উভয়ের সহবাসে উভয়েই পরম সুখে কালহরণ করিতে লাগিলাম। মলয়পুরে আমার বহুবিস্তৃত বাণিজ্য ব্যবসায় ছিল, তদ্দ্বারা প্রভূত অর্থাগম হইতে লাগিল। যদি অদৃষ্ট মন্দ না হইত, অবিচ্ছিন্ন সুখসম্ভোগে সংসারযাত্রা নির্ব্বাহ করিতে পারিতাম। মলয়পুরে আমার যিনি কর্ম্মাধ্যক্ষ ছিলেন, হঠাৎ তাঁহার মৃত্যু হওয়াতে, তত্রত্য কার্য্য সকল অত্যন্ত বিশৃঙ্খল হইয়া উঠিল। শুনিয়া অতিশয় ব্যাকুল হইলাম এবং, সহধর্ম্মিণীকে গৃহে রাখিয়া, মলয়পুর প্রস্থান করিলাম। ছয় মাস অতীত না হইতেই, লাবণ্যময়ী, বিরহবেদনা সহ্য করিতে না পারিয়া, তথায় উপস্থিত হইলেন, এবং অনধিক কাল মধ্যেই অন্তর্বত্নী হইয়া, যথাকালে দুই সুকুমার যমজ কুমার প্রসব করিলেন। কুমারযুগলের অবয়বগত অণুমাত্র বৈলক্ষণ্য ছিল না। উভয়েই সর্ব্বাংশে এরূপ একাকৃতি সে উভয়ের ভেদগ্রহ কোনও মতে সম্ভাবিত নহে। আমরা যে পান্থনিবাসে অবস্থিতি করিতাম, তথায় সেই দিনে সেই সময়ে এক দুঃখিনী নারীও সর্ব্বাংশে একাকৃতি দুই যমজ তনয় প্রসব করে। উহাদের প্রতিপালন করা অসাধ্য ভাবিয়া, সে আমার নিকট ঐ দুই যমজ সন্তান বিক্রয় করিতে উদ্যত হইল। উত্তরকালে উহারা দুই সহোদরে আমার পুত্ত্রদ্বয়ের পরিচর্য্যা করিবেক, এই অভিপ্রায়ে উহাদিগকে ক্রয় করিয়া, পুত্ত্রনির্বিশেষে প্রতিপালন করিতে লাগিলাম। যমজেরা সর্ব্বাংশে একাকৃতি বলিয়া, এক নামে এক এক যমলের নামকরণ করিলাম; পুত্ত্রযুগলের নাম চিরঞ্জীব, ক্রীত শিশুযুগলের নাম কিঙ্কর রাখিলাম।

কিছু কাল গত হইলে, আমার সহধর্ম্মিণী, হেমকূট প্রতিগমনের নিমিত্ত নিতান্ত অধৈর্য্য হইয়া, সর্ব্বদা উৎপীড়ন করিতে লাগিলেন। আমি অবশেষে, নিতান্ত অনিচ্ছা পূর্ব্বক, সম্মত হইলাম। অল্প দিনের মধ্যেই, চারি শিশু সমভিব্যাহারে, আমরা অর্ণবপোতে আরোহণ করিলাম। মলয়পুর পরিত্যাগ করিয়া যোজনমাত্র গমন করিয়াছি, এমন সময়ে অকস্মাৎ গগনমণ্ডল নিবিড় ঘনঘটায় আচ্ছন্ন হইল; প্রবল বেগে প্রচণ্ড বাত্যা বহিতে লাগিল; সমুদ্র উত্তাল তরঙ্গমালায় আন্দোলিত হইয়া উঠিল। আমরা জীবনের আশায় বিসর্জ্জন দিয়া, প্রতি ক্ষণেই মৃত্যু প্রতীক্ষা করিতে লাগিলাম। আমার সহধর্ম্মিণী সাতিশয় আর্ত্ত স্বরে হাহাকার ও শিরে করাঘাত করিতে লাগিলেন। তাঁহাকে তদবস্থাপন্ন দেখিয়া, দুই তনয় ও দুই ক্রীত বালক চীৎকার করিয়া রোদন করিতে লাগিল। গৃহিণী, বাষ্পাকুল লোচনে, অতি কাতর বচনে, মুহুর্মুহুঃ কহিতে লাগিলেন, নাথ! আমরা মরি তাহাতে কিছুমাত্র খেদ নাই; যাহাতে দুটি সন্তানের প্রাণ রক্ষা হয়, তাহার কোনও উপায় কর।

কিয়ৎ ক্ষণ পরে অর্ণবপোত মগ্নপ্রায় হইল। নাবিকেরা, পোত রক্ষা বিষয়ে সম্পূর্ণ হতাশ্বাস হইয়া, আত্মরক্ষার চেষ্টা দেখিতে লাগিল, এবং অর্ণবপোতে যে কয়খানি ক্ষুদ্র তরী ছিল, তাহাতে আরোহণ পূর্ব্বক প্রস্থান করিল। তখন আমি, নিতান্ত নিরুপায় দেখিয়া, অনেক ভাবিয়া চিন্তিয়া, এক উপায় স্থির করিলাম। অর্ণবপোতে দুটি অতিরিক্ত গুণবৃক্ষ ছিল; একের প্রান্তভাগে জ্যেষ্ঠ পুত্ত্র ও জ্যেষ্ঠ ক্রীত শিশুকে, অপরটির প্রান্তভাগে কনিষ্ঠ পুত্ত্র ও কনিষ্ঠ ক্রীত শিশুকে বন্ধন পূর্ব্বক, আমরা স্ত্রী পুরুষে একৈকের অপর প্রান্তভাগে এক এক জন করিয়া আপনাদিগকে বদ্ধ করিলাম। দুই গুণবৃক্ষ, স্রোতের অনুবর্ত্তী হইয়া, ভাসিতে ভাসিতে চলিল। বোধ হইল, আমরা কর্ণপুর অভিমুখে নীত হইতেছি। কিয়ৎ ক্ষণ পরে, সূর্য্যদেবের আবির্ভাব ও বাত্যার তিরোভাব হইল। তখন দেখিতে পাইলাম, দুই অর্ণবপোত অতি বেগে আমাদের দিকে আসিতেছে। বোধ হইল, আমাদের উদ্ধরণের জন্যই উহারা ঐ রূপে আসিতেছিল। তন্মধ্যে একখানি কর্ণপুরের, অপর খানি উদয়নগরের। এ পর্য্যন্ত দুই গুণবৃক্ষ পরস্পর অতি সন্নিহিত ছিল; কিন্তু, উল্লিখিত পোতদ্বয় আমাদের নিকটে আসিবার কিঞ্চিৎ পূর্ব্বে, আকস্মিক বায়ুবেগবশে পরস্পর অতিশয় দূরবর্ত্তী হইয়া পড়িল। আমি এক দৃষ্টিতে অপর গুণবৃক্ষ নিরীক্ষণ করিতে লাগিলাম। দেখিতে পাইলাম, কর্ণপুরের পোতস্থিত লোকেরা, বন্ধন মোচন পূর্ব্বক, আমার গৃহিণী, পুত্ত্র ও ক্রীত শিশুকে অর্ণবগর্ভ হইতে উদ্ধৃত করিল। কিঞ্চিৎ পরেই, অপর পোত আসিয়া আমাদের তিন জনের উদ্ধরণ করিল। এই পোতের লোকেরা যেরূপ সুহৃদ্ভাবে সাহায্য করিতে আসিয়াছিলেন, অপর পোতের লোকেরা সেরূপ নহেন; ইহা বুঝিতে পারিয়া, আমাদের উদ্ধারকেরা, আমার গৃহিণী ও শিশুদ্বয়ের উদ্ধারার্থ উদ্যুক্ত হইলেন; কিন্তু অপর পোত অধিকতর বেগে যাইতেছিল, সুতরাং ধরিতে পারিলেন না। তদবধি আমি পুত্ত্র ও প্রেয়সী উভয়ে বিয়োজিত হইয়াছি। মহারাজ! আমার মত হতভাগ্য আর কেহ নাই—

এই কথা বলিতে বলিতে, সোমদত্তের নয়নযুগল হইতে প্রবল বেগে বাষ্পবারি বিগলিত হইতে লাগিল। তিনি স্তব্ধ হইয়া রহিলেন, আর কিছুই বলিতে পারিলেন না। তখন বিজয়বল্লভ কহিলেন, সোমদত্ত! দৈববিড়ম্বনায় তোমার যে শোচনীয় অবস্থা ঘটিয়াছে, তাহা শুনিয়া আমার হৃদয় অতিশয় শোকাকুল হইতেছে; ক্ষমতা থাকিলে, এই দণ্ডে, তোমার প্রাণদণ্ড রহিত করিতাম। সে যাহা হউক, তৎপরে কি কি ঘটনা হইল, সমুদয় শুনিবার নিমিত্তে, আমার চিত্তে, অত্যন্ত ঔৎসুক্য জন্মিতেছে; সবিস্তর বর্ণন করিলে, আমি অনুগৃহীত বোধ করিব।

সোমদত্ত কহিলেন, মহারাজ! তৎপরে কিছু দিনের মধ্যেই, কনিষ্ঠ তনয় ও কনিষ্ঠ ক্রীত শিশু সমভিব্যাহারে, নিজ আগারে প্রতিগমন পূৰ্ব্বক, কিঞ্চিৎ অংশে শোক সংবরণ করিয়া, শিশুযুগলের লালন পালন করিতে লাগিলাম। বহু কাল অতীত হইয়া গেল, কিন্তু, গৃহিণী ও অপর শিশুযুগলের কোনও সংবাদ পাইলাম না। কনিষ্ঠ পুত্ত্রটির যত জ্ঞান হইতে লাগিল, ততই সে জননী ও সহোদরের বিষয়ে অনুসন্ধান আরম্ভ করিল। আমার নিকট স্বকৃত জিজ্ঞাসার যে উত্তর পাইত, তাহাতে তাহার সন্তোষ জন্মিত না। অবশেষে, অষ্টাদশবর্ষ বয়সে, নিতান্ত অধৈৰ্য্য হইয়া, আমার অনুমতি গ্রহণ পূৰ্ব্বক, স্বীয় পরিচারক সমভিব্যাহারে, সে তাহাদের উদ্দেশার্থে প্রস্থান করিল। পুত্ত্রটি, অন্ধের যষ্টিস্বরূপ, আমার জীবনের একমাত্র অবলম্বন ছিল; এজন্য তাহাকে ছাড়িয়া দিতে কোনও মতে ইচ্ছা ছিল না। তৎকালে এই আশঙ্কা হইতে লাগিল, এ জন্মে যে গৃহিণী ও জ্যেষ্ঠ পুত্ত্রের সহিত সমাগম হইবেক, তাহার আর প্রত্যাশা নাই; আমার যেরূপ অদৃষ্ট, হয় ত এই অবধি ইহাকেও হারাইলাম। মহারাজ! ভাগ্যক্রমে আমার তাহাই ঘটিয়া উঠিল। দুই বৎসর অতীত হইল, তথাপি কনিষ্ঠ পুত্ত্র প্রত্যাগমন করিল না। আমি তাহার অন্বেষণে নির্গত হইলাম; পাঁচ বৎসর কাল অবিশ্রান্ত পর্য্যটন করিলাম, কিন্তু, কোনও স্থানেই কিছুমাত্র সন্ধান পাইলাম না। পরিশেষে, নিতান্ত নিরাশ্বাস হইয়া, হেমকূট অভিমুখে গমন করিতেছিলাম; জয়স্থলের উপকল দর্শন করিয়া মনে ভাবিলাম, এত দেশ পর্য্যটন করিলাম, এই স্থানটি অবশিষ্ট থাকে কেন। এখানে যে তাহাকে দেখিতে পাইব, তাহার কিছুমাত্র আশ্বাস ছিল না; কিন্তু না দেখিয়া চলিয়া যাইতেও, কোনও মতে, ইচ্ছা হইল না। এইরূপে জয়স্থলে উপস্থিত হইয়া, কিয়ৎ ক্ষণ পরেই ধৃত ও মহারাজের সম্মুখে আনীত হইয়াছি। মহারাজ! তাজ সায়ংকালে আমার সকল ক্লেশের অবসান হইবেক। যদি, প্রেয়লী ও তনয়েরা জীবিত আছে, ইহা শুনিয়া মরিতে পারি, তাহা হইলে আর আমার কোনও ক্ষোভ থাকে না।

এই হৃদয়বিদারণ আখ্যান শ্রবণে নিবতিশয় দুঃখিত হইয়া বিজয়বল্লভ কহিলেন, সোমদত্ত! আমার বোধ হয়, তোমার মত হতভাগ্য ভূমণ্ডলে আর নাই। অবিচ্ছিন্ন ক্লেশভোগে কালহরণ করিবার নিমিত্তই, তুমি জন্ম পরিগ্রহ করিয়াছিলে। তোমার বৃত্তান্ত আদ্যোপান্ত শ্রবণ করিয়া, আমার হৃদয় বিদীর্ণ হইতেছে। যদি ব্যবস্থাপিত বিধির উল্লঙ্ঘন না হইত, তাহা হইলে, আমি তোমার প্রাণ রক্ষার নিমিত্ত প্রাণপণে যত্ন করিতাম। জয়স্থলের প্রচলিত বিধি অনুসারে তোমার প্রাণদণ্ডের ব্যবস্থা হইয়াছে; যদি, অনুকম্পাব বশবর্ত্তী হইয়া, ঐ ব্যবস্থা রহিত করি, তাহা হইলে, আমি, চিরকালের জন্য, জয়স্থলসমাজে যাব পর নাই হেয় ও অশ্রদ্ধেয় হইব। তবে, আমার যে পর্য্যন্ত ক্ষমতা আছে, তাহা করিতেছি। তোমাকে সায়ংকাল পর্য্যন্ত সময় দিতেছি, এই সময়ের মধ্যে যদি কোনও রূপে, পাঁচ সহস্র মুদ্রা সংগ্রহ করিতে পার, তোমার প্রাণ রক্ষণ হইবেক, নতুবা তোমার প্রাণদণ্ড অপরিহার্য্য। অনন্তর, তিনি কারাধ্যক্ষকে কহিলেন, তুমি সোমদত্তকে যথাস্থানে সাবধানে রাখ। কারাধ্যক্ষ, যে আজ্ঞা মহারাজ! বলিয়া, সোমদত্ত সমভিব্যাহারে প্রস্থান করিল।

কর্ণপুরের লোকেরা কুবলয়পুরের অধিপতি মহাবল পরাক্রান্ত বিখ্যাত বীর বিজয়বর্ম্মাব নিকট চিরঞ্জীব ও কিঙ্করকে বিক্রয় করে। তৎপরে কিয়ৎকাল অতীত হইলে, বিজয়বর্ম্মা নিজ ভ্রাতৃপুত্ত্র বিজয়বল্লভের সহিত সাক্ষাৎ করিতে গিয়াছিলেন। তিনি চিরঞ্জীব ও কিঙ্করকে এত ভাল বাসিতেন, যে ক্ষণকালের জন্যেও তাহাদিগকে নয়নের অন্তরাল করিতেন না। সুতরাং, জয়স্থল প্রস্থানকালে তিনি তাহাদিগকে সঙ্গে লইয়া যান। ঐ দুই বালককে দেখিয়া ও তাহাদের প্রাপ্তিবৃত্তান্ত শুনিয়া, বিজয়বল্লভের অন্তঃকরণে অত্যন্ত দয়া উপস্থিত হয়, এবং দিন দিন তাহাদের প্রতি সাতিশয় স্নেহসঞ্চার হইতে থাকে। পিতৃব্যের প্রস্থানসময় সমাগত হইলে, ভ্রাতৃব্য আগ্রহ প্রদর্শন পূর্ব্বক তাঁহার নিকট বালকদ্বয়ের প্রাপ্তিবাসনা জানাইয়াছিলেন। তদনুসারে বিজয়বর্ম্মা তদীয় প্রার্থনা পরিপূর্ণ কবিয়া স্বস্থানে প্রতিগমন করেন। অভিপ্রেতলাভে আহ্লাদিত হইয়া, বিজয়বল্লভ পরম যত্নে চিরঞ্জীবের লালন পালন করিতে লাগিলেন, এবং, সে বিষয়কার্য্যের উপযোগী বয়স প্রাপ্ত হইলে, তাহাকে এককালে সেনাসংক্রান্ত উন্নত পদে প্রতিষ্ঠিত করিলেন। চিরঞ্জীব প্রত্যেক যুদ্ধেই বুদ্ধিমত্তা, কার্য্যদক্ষতা, অকুতোভয়তা প্রভৃতির প্রভূত পরিচয় দিতে লাগিলেন। একবার বিজয়বল্লভ একাকী বিপক্ষমণ্ডলে এরূপে বেষ্টিত হইয়াছিলেন, যে তাঁহার প্রাণবিনাশের সম্পূর্ণ সম্ভাবনা ঘটিয়াছিল, সে দিবস কেবল চিরঞ্জীবের বুদ্ধিকৌশলে ও সহসগুণে তাহার প্রাণরক্ষা হয়। বিজয়বল্লভ, যার পর নাই, প্রীত ও প্রসন্ন হইয়া, তদবধি তাঁহার প্রতি পুত্ত্রবাৎসল্য প্রদর্শন করিতে লাগিলেন।

এই ঘটনার কিছু দিন পূর্ব্বে, জয়স্থলবাসী এক শ্রেষ্ঠী, অতুল ঐশ্বর্য্য এবং চন্দ্রপ্রভা ও বিলাসিনী নাম্নী দুই পরম সুন্দরী কন্যা রাখিয়া, পরলোক যাত্রা করেন। মৃত্যুকালে তিনি অধিরাজ বিজয়বল্লভের হস্তে স্বীয় বিষয়ের ও কন্যাদ্বিতয়ের রক্ষণাবেক্ষণ সংক্রান্ত সমস্ত ভার প্রদান করিয়া যান। বিজয়বল্লভ শ্রেষ্ঠীর জ্যেষ্ঠা কন্যা চন্দ্রপ্রভার সহিত চিরঞ্জীবের বিবাহ দিলেন। চিরঞ্জীব, এই অসম্ভাবিত পরিণয় সংঘটন দ্বারা, এককালে এক সুরূপা কামিনীর পতি ও অতুল ঐশ্বর্য্যের অধিপতি হইলেন। এই রূপে তিনি, বিজয়বল্লভের স্নেহগুণে ও অনুগ্রহ বলে, জয়স্থলে গণনীয় ব্যক্তি হইয়া উঠিলেন, এবং স্বভাবসিদ্ধ দয়া, সৌজন্য, ন্যায়পরতা ও অমায়িক ব্যবহার দ্বারা সর্ব্বসাধারণের স্নেহপাত্র ও সম্মানভাজন হইয়া, পরম সুখে কাল যাপন করিতে লাগিলেন।

চিরঞ্জীব অতি শৈশবকালে পিতা, মাতা ও ভ্রাতার সহিত বিয়োজিত হইয়াছিলেন, তৎপরে আর কখনও তাঁহাদের কোনও সংবাদ পান নাই। সুতরাং, জগতে তাঁহার আপনার কেহ আছে বলিয়া কিছুমাত্র বোধ ছিল না। তিনি শৈশবকালের সকল কথাই ভুলিয়া গিয়াছিলেন; সমুদ্রে মগ্ন হইয়াছিলেন, কোনও রূপে প্রাণরক্ষা হইয়াছে; কেবল এই বিষয়টির অনতিপরিস্ফুট স্মরণ ছিল। জয়স্থলে তাঁহার আধিপত্যের সীমা ছিল না। যদি তিনি জানিতে পারিতেন, সোমদত্ত তাঁহার জন্মদাতা তাহা হইলে সোমদত্তকে, এক ক্ষণের জন্যেও, রাজদণ্ডে নিগ্রহভোগ করিতে হইত না।

যে দিবস সোমদত্ত জয়স্থলে উপস্থিত হন, কনিষ্ঠ চিরঞ্জীবও সেই দিবস, স্বকীয় পরিচারক কনিষ্ঠ কিঙ্কর সমভিব্যাহারে, তথায় উপনীত হইয়াছিলেন। তিনি, স্বীয় পিতার ন্যায়, ধৃত, বিচারালয়ে নীত ও রাজদণ্ডে নিগৃহীত হইতেন, তাহার সন্দেহ নাই। দৈবযোগে, এক বিদেশীয় বন্ধুর সহিত সাক্ষাৎ হওয়াতে, তিনি কহিলেন, বয়স্য! তুমি এ দেশে আসিয়াছ কেন। কিছু দিন হইল, জয়স্থলে হেমকূটবাসীদিগের পক্ষে ভয়ানক নিয়ম প্রবর্ত্তিত হইয়াছে। তুমি হেমকূটবাসী বলিয়া কোনও ক্রমে কাহারও নিকট পরিচয় দিও না। মলয়পুর তোমার জন্মস্থান, এবং সে স্থানে তোমাদের বহুবিস্তৃত বাণিজ্য আছে; কেহ তোমায় জিজ্ঞাসা করিলে, মলয়পুরবাসী বলিয়া পরিচয় দিবে। অত্রত্য লোকে তোমার প্রকৃত পরিচয় পাইলে, নিঃসন্দেহ তোমার প্রাণদণ্ড হইবেক। হেমকূটবাসী এক বৃদ্ধ বণিক আজ জয়স্থলে আসিয়াছিলেন। অধিরাজের আদেশক্রমে, সূর্য্যদেবের অস্তাচলচূড়ায় অধিরোহণ করিবার পূর্ব্বেই, তাঁহার প্রাণদণ্ড হইবেক। অতএব, যত ক্ষণ এখানে থাকিবে, সাবধানে চলিবে। আর আমার নিকট যাহা রাখিতে দিয়াছিলে, লও।

এই বলিয়া, তিনি স্বর্ণমুদ্রার একটি থলী চিরঞ্জীবের হস্তে প্রত্যর্পণ করিলেন। তিনি তাহা স্বকীয় পরিচারকের হস্তে দিয়া কহিলেন, কিঙ্কর! তুমি এই স্বর্ণমুদ্রা লইয়া পান্থনিবাসে প্রতিগমন কর; অতি সাবধানে রাখিবে, কোনও ক্রমে কাহারও হস্তে দিবে না। এখনও আমাদের আহারের সময় হয় নাই, প্রায় এক ঘণ্টা বিলম্ব আছে; এই সময় মধ্যে নগর দর্শন করিয়া, আমিও পান্থনিবাসে প্রতিগমন করিতেছি। তুমি যাও, আর দেরী করিও না। কিঙ্কর যে আজ্ঞা বলিয়া প্রস্থান করিলে, চিরঞ্জীব সেই বৈদেশিক বন্ধুকে কহিলেন, বয়স্য! কিঙ্কর আমার চিরসহচর ও যার পর নাই বিশ্বাসভাজন। উহার বিশেষ এক গুণ আছে; আমি যখন দুর্ভাবনায় অভিভূত হই, তখন ও পরিহাস করিয়া আমার চিত্তের অপেক্ষাকৃত সাচ্ছন্দ্য, সম্পাদন করে। এক্ষণে চল, দুই বন্ধুতে নগর দর্শন করিতে যাই; তৎপরে উভয়ে পান্থনিবাসে এক সঙ্গে আহার আদি করিব। তিনি কহিলেন, আজ এক বণিক আহারের নিমন্ত্রণ করিয়াছেন, অবিলম্বে তদীয় আলয়ে যাইতে হইবেক। তাঁহার নিকট আমার উপকারের প্রত্যাশা আছে। অতএব আমায় মাপ কর, এখন আমি তোমার সঙ্গে যাইতে পারিব না; অপরাহ্নে নিঃসন্দেহ সাক্ষাৎ করিব, এবং শয়নের সময় পর্য্যন্ত তোমার নিকটে থাকিব। এই বলিয়া, সে ব্যক্তি বিদায় লইয়া প্রস্থান করিলে, চিরঞ্জীব একাকী নগর দর্শনে নির্গত হইলেন।

জয়স্থলবাসী চিরঞ্জীব অতি প্রত্যুষে গৃহ হইতে বহির্গত হইয়াছিলেন; আহারের সময় উপস্থিত হইল, তথাপি প্রতিগমন করিলেন না। তাঁহার গৃহিণী চন্দ্রপ্রভা, অতিশয় উৎকণ্ঠিত হইয়া, কিঙ্করকে আহ্বান করিয়া কহিলেন, দেখ, কিঙ্কর! এত বেলা হইল, তথাপি তিনি গৃহে আসিতেছেন না। বোধ করি, কোনও গুরুতর কার্য্যে আবদ্ধ হইয়াছেন, তাহাতেই আহারের সময় পর্য্যন্ত ভুলিয়া গিয়াছেন। তুমি যাও, সত্বর তাঁহাকে ডাকিয়া আন; দেখিও, যেন কোনও মতে বিলম্ব না হয়; তাঁহার জন্যে সকলকার আহার বন্ধ। কিঙ্কর, যে আজ্ঞা বলিয়া, তৎক্ষণাৎ প্রস্থান করিল, এবং কিয়ৎ ক্ষণ পরেই, নগরদর্শনে ব্যাপৃত হেমকূটবাসী চিরঞ্জীবকে দেখিতে পাইয়া, স্বপ্রভুজ্ঞানে সত্বর গমনে তাঁহার সন্নিহিত হইতে লাগিল।

চিরঞ্জীবযুগল ও কিঙ্করযুগল জন্মকালে যেরূপ সর্ব্বাংশে একারুতি হইয়াছিলেন, এখনও তাঁহারা অবিকল সেইরূপ ছিলেন, বয়োবৃদ্ধি বা অবস্থাভেদ নিবন্ধন কোনও অংশে আকৃতির কিছুমাত্র বিভিন্নতা ঘটে নাই। এক ব্যক্তিকে দেখিলে অপর ব্যক্তিজ্ঞান একান্ত অপরিহার্য্য। সুতরাং, হেমকূটবাসী চিরঞ্জীবকে দেখিয়া, জয়স্থলবাসী কিঙ্করের যেমন স্বীয় প্রভু বলিয়া বোধ জন্মিয়াছিল, জয়স্থলবাসী কিঙ্কর সন্নিহিত হইবামাত্র, তাহাকে দেখিয়া, হেমকূটবাসী চিরঞ্জীবেরও তেমনই স্বীয় পরিচারক বলিয়া বোধ জন্মিল, সে যে তাহার সহচর কিঙ্কর নয়, তিনি তাহার কিছুমাত্র উপলব্ধি করিতে পারলেন না। তদনুসারে, তিনি কিঙ্করকে জিজ্ঞাসিলেন, কি হে, তুমি এত সত্বর আসিলে কেন। সে কহিল, এত সত্বর আসিলে, কেমন; বরং এত বিলম্বে আসিলে কেন, বলুন। বেলা প্রায় দুই প্রহর হইল, আপনি এ পর্য্যন্ত গৃহে না যাওয়াতে, কত্রী ঠাকুরাণী অতিশয় উৎকণ্ঠিত হইয়াছেন। অনেক ক্ষণ আহারসামগ্রী প্রস্তুত হইয়া রহিয়াছে এবং ক্রমে শীতল হইয়া যাইতেছে। আহারসামগ্রী যত শীতল হইতেছে, কর্ত্রী ঠাকুরাণী তত উষ্ণ হইতেছেন। আহারসামগ্রী শীতল হইতেছে, কারণ আপনি গৃহে যান নাই; আপনি গৃহে যান নাই, কারণ আপন: কার ক্ষুধা নাই; আপনকার ক্ষুধা নাই, কারণ আপনি বিলক্ষণ জলযোগ করিয়াছেন; কিন্তু আপনকার অনুপস্থিতি জন্ত আমরা অনাহারে মারা পড়িতেছি।

এই সমস্ত কথা শুনিয়া, হেমকূটবাসী চিরঞ্জীব ভাবিলেন, পরিহাসরসিক কিঙ্কর কৌতুক করিতেছে। তখন তিনি কিঞ্চিৎ বিরক্তি প্রকাশ করিয়া কহিলেন, কিঙ্কর! আমি এখন তোমার পরিহাসরসের অভিলাষী নহি; তোমার হস্তে যে স্বর্ণমুদ্রা দিয়াছি, কাহার নিকট রাখিয়া আসিলে, বল। সে চকিত হইয়া কহিল, সে কি, আপনি স্বর্ণমুদ্রা আমার হস্তে কবে দিলেন; কেবল বুধবার দিন, চর্ম্মকারকে দিবার জন্য, চারি আনা দিয়াছিলেন, সেই দিনেই তাহাকে দিয়াছি, আমার নিকটে রাখি নাই; চর্ম্মকার কর্ত্রী ঠাকুরাণীর ঘোড়ার সাজ মেরামত করিয়াছিল। শুনিয়া সাতিশয় কুপিত হইয়া, চিরঞ্জাব কহিলেন, কিঙ্কর! এ পরিহাসের সময় নয়; যদি ভাল চাও, স্বর্ণমুদ্রা কোথায় রাখিলে, বল। আমরা ঘটনাক্রমে এই নিতান্ত অপরিচিত অবান্ধব দেশে আসিয়াছি; কি সাহসে, কোন বিবেচনায়, তত স্বর্ণমুদ্রা অপরের হস্তে দিলে। কিঙ্কর কহিল, মহাশয়। আপনি আহারে বসিয়া পরিহাস করিবেন, আমরা আছাদিত চিত্তে শুনিব। এখন আপনি গৃহে চলুন; কর্ত্রী ঠাকুরাণী সত্বর আপনারে লইয়া যাইতে বলিয়া দিয়াছেন; বিলম্ব হইলে, কিংবা আপনারে না লইয়া গেলে, আমার লাঞ্ছনার সীমা থাকিবেক না; হয় ত, প্রহার পর্য্যন্ত হইয়া যাইবেক। চিরঞ্জীব নিতান্ত অধৈর্য্য হইয়া কহিলেন, কিঙ্কর! তুমি বড় নিবোধ, যত আমায় ভাল লাগিতেছে না, ততই তুমি পরিহাস করিতেছ; বারংবার বুারণ করিতেছি, তথাপি ক্ষান্ত হইতেছ না; দেখ, সময়ে সকলই ভাল লাগে; অসময়ে অমৃতও বিস্বাদ ও বিষতুল্য বোধ হয়। যাহা হউক, আমি তোমার হস্তুে যে সমস্ত স্বর্ণমুদ্রা দিয়াছি, তাহা কোথায় রাখিলে, বল। কিঙ্কর কহিল, না মহাশয়! আপনি আমার হস্তে কখনই স্বর্ণমুদ্রা দেন নাই। তখন চিরঞ্জীব কহিলেন, কিঙ্কর। আজ তোমার কি হইয়াছে, বলিতে পারি না। পাগলামির চুড়ান্ত হইয়াছে, আর নয়, ক্ষান্ত হও। বল, স্বর্ণমুদ্রা কোথায় কাহার নিকটে রাখিয়া আসিলে। সে কহিল, মহাশয়! এখন স্বর্ণমুদ্রার কথা রাখুন। আমার হস্তে স্বর্ণমুদ্রা দিয়া থাকেন, পরে বুঝিয়া লইবেন; সে জন্যে আমার তত ভাবনা নাই। কিন্তু, কর্ত্রী ঠাকুরাণী আজ কাল অতিশয় উগ্রচণ্ডা হইয়াছেন, তাহার ভয়েই আমি অস্থির হইতেছি। তিনি সত্বর আপনাকে বাটতে লইয়া যাইতে বলিয়া দিয়াছেন। আপনারে লইয়া না গেলে, আমার লাঞ্ছনার একশেষ হইবেক। অতএব, বিনয় করিয়া বলিতেছি, সত্বর গৃহে চলুন। তিনি ও তাঁহার ভগিনী নিতান্ত আকুল চিত্তে আপনকার প্রতীক্ষা করিতেছেন। এই সকল কথা শুনিয়া, কোপে কম্পান্বিতকলেবর হইয়া, চিরঞ্জীব কহিলেন, আরে দুরাত্মন! তুমি পুনঃ পুনঃ কর্ত্রী ঠাকুরাশীর নাম করিতেছ; তোমার কর্ত্রী ঠাকুরাণী কে, কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না। কিঙ্কর কহিল, কেন মহাশয়। আপনি কি জানেন না, আপনকার সহধর্ম্মিণীকে আমরা সকলেই কর্ত্রী ঠাকুরাণী বলিয়া থাকি; তিনি ভিন্ন আর কাহাকে কর্ত্রী ঠাকুরাণী বলিব। তিনিই আমায় আপনাকে গৃহে লইয়া যাইবার নিমিত্ত পাঠাইয়াছেন। চলুন, আর বিলম্ব করিবেন না; আহারের সময় বহিয়া যাইতেছে। চিরঞ্জীব কহিলেন, নিঃসন্দেহ তোমার বুদ্ধিভ্রংশ ঘটিয়াছে, নতুবা উন্মাদগ্রস্তের ন্যায় কথা কহিতে না। আমি কবে কোন কামিনীর পাণিগ্রহণ করিয়াছি যে, তুমি বারংবার আমার সহধর্ম্মিণীর উল্লেখ করিতেছ। এখানে আমার বাটী কোথায় যে, আমায় বাটীতে লইয়া যাইবার জন্য এত ব্যস্ত হইতেছ। কিঙ্কর শুনিয়া হাস্যমুখে কহিল, মহাশয়। যেরূপ দেখিতেছি, তাহাতে আপনারই বুদ্ধিভ্রংশ ঘটিয়াছে; আপনিই উন্মাদগ্রস্তের দ্যায় কথা কহিতেছেন। এ সকল কথা কর্ত্রী ঠাকুরাণীর কর্ণগোচর হইলে, তিনি আপনাকে বিলক্ষণ শিক্ষা দিবেন; তখন, এখানে আপনকার বাটী আছে কি না এবং কখনও কোনও কামিনীর পাণিগ্রহণ করিয়াছেন কি না, অক্লেশে বুঝিতে পারিবেন। যাহা হউক, আপনি হঠাৎ কেমন করিয়া এমন রসিক হইয়া উঠিলেন, বলুন। চিরঞ্জীব, আর সহ্য করিতে না পারিয়া, এই তোমার পাগলামির ফল ভোগ কর; এই বলিয়া, তাহাকে প্রহার করিতে আরম্ভ করিলেন। কিঙ্কর হতবুদ্ধি হইয়া কহিল, মহাশয়! অকারণে প্রহার করেন কেন; আমি কি অপরাধ করিয়াছি। আপনকার ইচ্ছা হয়, বাটীতে যাইবেন, ইচ্ছা না হয়, না যাইবেন; যাঁহার কথায় লইয়া যাইতে আসিয়াছিলাম, তাঁহার নিকটেই চলিলাম।

ইহা কহিয়া কিঙ্কর প্রস্থান করিলে, চিরঞ্জীব মনে মনে এই আন্দোলন করিতে লাগিলেন, বোধ হয়, কোনও ধূর্ত্ত, কৌশল করিয়া, কিঙ্করের নিকট হইতে স্বর্ণমুদ্রাগুলি অপহরণ করিয়াছে, তাহাতেই ভয়ে উহার বুদ্ধিভ্রংশ ঘটিয়াছে; নতুবা পূর্ব্বাপর এত প্রলাপবাক্য উচ্চাচরণ করিবেক কেন; প্রকতিস্থ ব্যক্তি কখনও এরূপ অসম্বদ্ধ কথা কহে না, হয় ত, হতভাগ্য উন্মাদগ্রস্ত হইল। সকলে বলে, জয়স্থলে ঐন্দ্রজালিকবিদ্যা বিলক্ষণ প্রচলিত; এখানকার লোকে এরূপ প্রচ্ছন্ন বেশে চলে যে,উহাদিগকে কোনও মতে চিনিতে পারা যায় না; উহারা, দুর্বিগাহ মায়াজাল বিস্তার করিয়া, বৈদেশিক লোকের ধনে প্রাণে উচ্ছেদ সাধন করে। শুনিতে পাই, এখানকার কামিনীরা নিতান্ত মায়াবিনী; বৈদেশিক পুরুষদিগকে অনায়াসে মুগ্ধ করিয়া ফেলে; একবার মোহজালে বদ্ধ হইলে, আর নিস্তার নাই। আমি এখানে আসিয়া ভাল করি নাই, শীঘ্র পলায়ন করাই বিধেয়। আর আমার নগরদর্শনের আমোদে কাজ নাই; পান্থনিবাসে যাই এবং যাহাতে অবিলম্বে এ স্থান হইতে প্রস্থান করিতে পারি, তাহার উদ্যোগ করি। এখানে আর এক মুহূর্ত্তও থাকা উচিত নহে।

চিরঞ্জীব, এই বলিয়া, নগরদর্শনকৌতুকে বিসর্জন দিয়া, আকুল মনে, সত্বর গমনে, পান্থনিবাস অভিমুখে প্রস্থান করিলেন।

Pages: 1 2 3 4 5
Pages ( 1 of 5 ): 1 23 ... 5পরবর্তী »

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *