“কচ” ও “দেবযানী” প্রেম উপাখ্যান (পুরাণ কথা,বিজ্ঞান ও বেদ)
[ঋণ স্বীকার:
ভাগবত পুরাণ
মৎষ্য পুরাণ
বায়ু পুরাণ
“বিদায় অভিশাপ “— রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ]
প্রথম পর্ব
হিন্দু, গ্রীক ও রোমান, সব পুরাণ হলো বড়দের রূপকথারূপ ধর্মকথা—মূলত আদিরস, বীররস, ভক্তি রস,করুণ রস— সব রস- রসায়নের এক মিশ্রণ। আর আছে কিছু জড় ও জীবের সমান্তরাল “পার্সনিফিকেসন”। আপাতদৃষ্টিতে কিছুটা আজগুবি ও অবৈজ্ঞানিক মনে হলেও, যেহেতু আমরা “শেষ কোথা জ্ঞান” জানি না বলেই অনেক যুক্তিতর্কের অবমাননার শিকার হই। যাক্, সে কথা আপাতত। শিরোনাম প্রসঙ্গে আসি, কচ ও দেবযানীর এ এক প্রগাঢ় প্রেমের বিয়োগান্তক কাহিনী–কমপক্ষে উঠে আসে একাধিক সুরাসরের নাম যেমন ইন্দ্র, জয়ন্তী, অসুর বৃষপর্বা, অবশ্যই ব্রাহ্মণদ্বয় বৃহস্পতি ও শুক্রাচার্য , ক্ষত্রিয় রাজা — যযাতি এবং শুদ্রানী শর্মিষ্ঠা যিনি অসুর বৃষপর্বার কন্যা। আসছি সেই চমৎকৃত অসফল প্রেম কাহিনী, যা উদ্দেশ্য করে রবীন্দ্রনাথ কবিতা লিখেছেন “বিদায় অভিশাপ”, মাইকেল মধুসূদন লিখেছেন, ” শর্মিষ্ঠা” নাটক কথিত হয়ে আছে ক্ষত্রিয় রাজা “যযাতি”র যৌবন ভিক্ষার কাঙালতা। বৃহস্পতি দেবতাদের কুলগুরু আর শুক্রাচার্য অসুরদের। দুজনেই ব্রাহ্মণ ও পণ্ডিত। আর দেবযানী ছিলেন শুক্রাচার্যের কন্যা , কচ বৃহস্পতির পুত্র। দেবাদিদেব মহেশ্বরকে ধ্যানে সন্তুষ্ট করে শুক্রাচার্য বর পেয়েছিলেন “মৃত সঞ্জীবনী বিদ্যা”। সে বিদ্যার ফলে তিনি মৃত অসুরদের পুনরায় জীবিত করে তুলতেন। তখন ত সুরাসুরের যুদ্ধ লেগেই থাকত। কিন্ত বৃহস্পতি এ বিদ্যা জানতেন না, তাই দেবতাদের সংখ্যা ক্রমশই কমে আসতে লাগল অথচ অসুরদের নয়। এ সমস্যা সমাধানের জন্য ক্ষুরবুদ্ধি দেবতারা (বলা বাহুল্য দেবতাদের intelligence quotient অসুরদের চেয়ে অনেক বেশি ছিল) ঠিক করলেন— অসুরদের গুরু শুক্রাচার্য এর কাছ থেকে মৃতসঞ্জীবনী বিদ্যা আয়ত্ত করতেই হবে। সুনিশ্চিত এক ছক করলেন তারা, যেহেতু সোজাপথে তা হবার নয় বলে। তাহলে শুরু থেকে গল্পে আসি— অসুরদের রাজা বৃষপর্বার এক সুন্দরী কন্যা ছিলেন, রূপে গুণে আকৃষ্টময়ী, নাম তার —শর্মিষ্ঠা। দেবযানী ও শর্মিষ্ঠা দুজনেই সুন্দরী ও গুণবতী, দুজনে সখীভাবাপন্ন কিন্ত শর্মিষ্ঠার একটু হীনমন্নতা ছিল– তিনি অসুররাজ বৃষপর্বার কন্যা তথা রাজকন্যা হলেও শুদ্রানী, আর দেবযানী অত্যন্ত দেমাকী , সে ব্রাহ্মণ কূলগুরুর কন্যা, তার পিতার কাছে শর্মিষ্ঠার পিতা রাজা হয়েও নমিত। দেবযানী জন্মের পরই তাঁর মাতা ইন্দ্রকন্যা জয়ন্তী তাকে ত্যাগ করে স্বর্গে ফিরে যান। শুক্রাচার্য তার কন্যাকে জয়ন্তীকে দেন নি। কেন? আরও একটু পেছনে যেতে হবে। শিবের ধ্যানে শুক্রাচার্য যখন নিমগ্ন, শিবের বর পেলে শুক্রাচার্য আরও ক্ষমতাশালী হবেন, বেগতিক দেখে ভয়ে ইন্দ্র তাঁর নৃত্য পটিয়সী সুন্দরী নিজ কন্যা জয়ন্তীকে পাঠালেন শুক্রাচার্যের ধ্যান ভঙ্গ করার জন্য। জয়ন্তী সফলকাম হলেন,কিছুদিন পর তাদের এক কন্যাসন্তানের জন্ম হয়, তিনিই দেবযানী। কিন্ত শুক্রাচার্য পরে ধ্যানে জানতে পারেন ইন্দ্র ও জয়ন্তীর ষড়যন্ত্র। জয়ন্তী দেবরাজ্যে ফিরে যাবার প্রাক্কালে শুক্রাচার্য কন্যা দেবযানীকে কোনমতেই জয়ন্তীকে নিয়ে যেতে দেন নি, জব্দ করার প্রচেষ্টায়। পরে শুক্রাচার্য মায়ের অভাব ভুলিয়ে অত্যন্ত আদরে দেবযানীকে বড়ো করে তোলেন। দেবযানীর শত অন্যায় আবদারও শুক্রাচার্য অতি প্রশ্রয়ে রক্ষা করতেন, পরোক্ষে জয়ন্তীর প্রতি প্রতিশোধস্পৃহায়। ফলে ক্রমশঃ দেবযানী অসামান্য সুন্দরী ও গুণবতী হয়েও , হয়ে উঠলেন দেমাকী ও স্বেচ্ছাচারী, আদুরে ও খামখেয়ালী।
(দ্বিতীয় পর্ব)
অহংকারী, উগ্র আকর্ষণীয় সৌন্দর্য ও বুদ্ধিদীপ্ত ব্যক্তিত্বের তরুণী দেবযানীর সামনে এসে দাঁড়ালেন তরুণ সুর্দশন তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমান “কচ” , বৃহস্পতি পুত্র, অসুররাজ বৃষপর্বার রাজ্যে, এক পুষ্প উদ্যানে। যে কচের সম্মুখে, দেবরাজ্যে সুন্দরী শ্রেষ্ঠ রমনী সকল মুগ্ধাভিভূত হয়ে পড়েন, সেই কচ। বুদ্ধিমান দেবতারা চাতুরি করে সেজন্যই ত যোগ্যতম কচকে পাঠিয়েছিলেন, শুধুমাত্র প্রেমের অভিনয়ে ভুলিয়ে দেবযানীকে হাতিয়ার করে কৌশলে শুক্রাচার্যের কাছ থেকে ” মৃত সঞ্জীবনী বিদ্যা” শিখে আসবার জন্য। এই গূঢ় উদ্দেশ্যপুর্ণ বুদ্ধির খেলায় কচকে জয়ী হতেই হবে। কচ সেই অঙ্গীকারেই ত ঘুরপথে এসেছেন। সোজাপথে এলে শুক্রাচার্য তাকে শিষ্য করতেনই না, আর অসুরেরাও তাকে মেরে ফেলতে দ্বিধা করতেন না। না, কার্যত প্রেমের অভিনয় নয়, সত্যি করেই কচ প্রথম সাক্ষাতেই দেবযানীর প্রেমে পড়লেন। আর দেবযানীও ,লাজ লজ্জার মাথা খেয়ে আশ্রয় দিলেন কচকে। কন্যার অনুরোধে শুক্রাচার্যও বাধ্য হলেন কচকে “মৃতসঞ্জীবনী বিদ্যা” শিক্ষা দিতে। বিদ্যাশিক্ষা ও প্রেমানুভবের ধারা দুইই চলল কচের অন্তরে ও প্রকাশ্যে। দেবযানীরও তখন কচময় জগৎ। মন প্রাণ সমর্পণ। এরমাঝে তিনবার কচের প্রাণসংশয়ে সংকট অবস্থা এমন কি অসুরেরা কচকে হত্যাও করে— তার পরিচয় জেনে। দেবযানীর অনুরোধে পিতা শুক্রাচার্য তিনবারই কচকে পনরুজ্জীবিত করেন। শেষেরবার, অসুরেরা ত কচকে মেরে সোজা শুক্রাচার্যের উদরে লুকিয়ে রেখেছিল, সেখান থেকেও শুক্রাচার্য তাকে উদর থেকে বাঁচিয়ে তোলেন, সবই কন্যার মন রাখবার জন্য। তারপর এলো সেই দিন, দরকার হলো না, চাঁদনি রাতে গান পরিবেশন, ঝর্ণা জলে অবগাহন, প্রত্যুষকালে পুষ্প চয়ন, একে অপরের সাথে মন নির্জন প্রকৃতি দর্শন। সব শেষ, কচ আয়ত্ত করেছেন দুর্লভ সেই অনুশীলন, ” মৃতসঞ্জীবনী বিদ্যা”। হায়, একি হলো !!! দেবযানীর মাথায় বজ্রাঘাত! কচ ফিরে যাবেন অমর্ত্যলোকে!!! বিদায় নিতে এসেছেন দেবযানীর কাছে। কচ যে অঙ্গীকারবদ্ধ, বিদ্যা আয়ত্ত হলে দেবলোকে তার অনেক কাজ, সেই ত ছিল প্রতিশ্রুতি। তারপর হ্যাঁ, বিস্ময়াভিভূত দেবযানী ,যে প্রেমিককে তিনি স্বামীবন্ধনে ধরে রাখবেন, ভেবেছিলেন তা ছিন্নভিন্ন, বিরহানলে ভষ্মীভূত। হায়। এ আঘাত কেমনে সইবে দেবযানী, সন্দিহান কচের ব্যবহারে, সত্যিই কি কচ ভালবেসেছিলেন দেবযানীকে? অহংকারে ঘা দিল, তীব্র বেদনার সাথে অপমান ও প্রত্যাখ্যানের জ্বালা। সে জ্বালার আঁচ দেবযানীর অন্তরে বহ্নিশিখাহীন তুষের আগুনের মতো ধিকি ধিকি জ্বলতে থাকল , অহংকার প্রতিবন্ধক তখন প্রকাশের। মুখে দেবযানী স্বভাববিরুদ্ধ হলেও, নানা স্মৃতি মন্থন করে কচকে আকৃষ্ট করতে থাকলেন। সরাসরি অনুযোগ করলেন, কচের অভিনয় ছলাকলা ব্যবহারের জন্য। শেষে ভেঙ্গে পড়লেন, চোখ থেকে ঝড়ে পড়ল হিরককুচিসম জল কচের পায়ে—- বিশ্বাস যে কিছুতেই হয় না, কচের ভালবাসা নিছকই অভিনয় !!! তারপর, না, কোনমতেই টলাতে পারলেন না দেবযানী কচকে, তার সিদ্ধান্ত থেকে একটুও সরে আসতে, প্রেমের চেয়ে দেবতাদের কাছে তার প্রতিশ্রুতিই অনেক ন্যায্য ও বড়ো। তবুও বিস্মিত, ব্যথিত বিরহকাতর দেবযানী মরিয়া হয়ে, অভিমান ভুলে কচের পূর্ব প্রণয় স্মৃতি সকল এক এক করে বলে যেতে যেতে প্রায় বিলাপগ্রস্ত, আহত হরিণীসম হয়েঝ। উঠলেন। না, নাঃ—- কচ শত অনুরোধেও তাঁর সিদ্ধান্তে রইলেন অটল অচল— মনে মনে তিনি দেবযানীকে ভালবাসলেও দেবতাদের কাছে অঙ্গীকারবদ্ধ, তাই তার কাছে প্রধান কর্তব্য। [আরও একটি কথা কচের মনে তোলপাড় করছিল এবং তা ব্যক্তও করেন দেবযানীর কাছে। কচ বলেন “শোনো দেবী, তোমার আমার বিবাহ কোনমতেই হতে পারে না, কারণ কার্যত আমরা সহোদর। মনে আছে— তৃতীয়বার, অসুরেরা আমায় বধ করে গুরুদেব, মানে তোমার পিতার , উদরেই স্থাপন করে। সেখান থেকে আমি পনরুজ্জীবিত হই, তো সেই হিসেবে আমরা সহোদর ভ্রাতা-ভগ্নী।”] না, কোন পুরাণে এই কথা উল্লেখ নেই যে , কচ মনে মনে স্বীকার করে অন্তরে দেবযানীর প্রেমে দগ্ধ হচ্ছিলেন কিন্ত বাহিরে কঠোর । না তা বিবৃত নেই কোন পুরাণে সে তো কবি তার অন্তরদ্রষ্টা হয়ে উপলব্ধি করেছিলেন মাত্র, বিশ্বকবি বুঝেছিলাম কচের মনস্তত্ত্ব। তাই লিখলেন– ” বিদায় অভিশাপ ” যেখানে দেবযানীর “অভিশাপ”এর প্রত্যুত্তরে দিলেন “বর” তার প্রেমিকা দেবযানীকে। “আমি বর দিনু, দেবী, তুমি সুখী হবে— ভুলে যাবে সর্ব গ্লানি বিপুল গৌরবে।” কিন্ত এ তো কবির কল্পনাবিলাসমাত্র। বড়ো কষ্টের যে এই বিদায় দৃশ্য!!! কবি ব্যতীত কে বুঝবেন প্রেমিক কচের মনোবেদনা!!! তাই বাহ্যত মুখে যাই বলুন, অন্তরে যে শতবিরহের কাব্যগাথা। কিন্ত, সত্যিই কি, গ্লানি ভুলে পরে দেবযানী সুখী হয়েছিলেন। না, পুরাণে সে কথা নেই, কচের সে “বর” যে শুধু কবিকল্পনা।
(তৃতীয় পর্ব)
পুরাণ অনুসারে, কচ ও দেবযানী দুজনেই দুজনকে অভিশাপ দিয়েছিলেন। ক্ষত বিক্ষত মনে আশাহত দেবযানী, প্রত্যাখাতা দেবযানী, অসফল ব্যর্থপ্রেমিকা দেবযানী হিংস্র সিংহিনী ন্যায় দেবযানী সর্বশেষে গর্জে ফুঁসে উঠলেন—– তীব্র ধিক্কারে অভিশাপ দিলেন কচকে— “তুমি, যে বিদ্যা আমার পিতার কাছ থেকে শিখেছ, আয়ত্ত করেছ, তা কোনদিন প্রয়োগ করতে পারবে না কোন মৃত জনের উপর— তুমি অসফল হবে।” প্রত্যুত্তরে, কচ হাসলেন, বললেন, ” বেশ,তাই হবে,দেবী, অভিশাপ দিলে, কিন্ত আমি যাদের এ বিদ্যা শিখিয়ে যাবো, তারা ত প্রয়োগ করতে পারবেন , তাহলেও দেবকুল রক্ষা পাবে।” সংযত কচ এ অভিশম্পাতের প্রতিদানে নিজেও দিলেন দেবযানীকে এক অবমাননার অভিশাপ, তার অহংকারে ঘা দেওয়া প্রয়োজন মনে করেই হয়ত। সেজন্য আরও বললেন কচ, ” তুমি কোনদিন কোন ব্রাহ্মণকে পতিরূপে পাবে না, তোমার ‘বিলোম’ বিবাহ হবে।” সর্বনাশ! মাথায় বাজ তখন দেবযানীর, হিতাহিত জ্ঞান শূন্য, স্তব্ধ হয়ে পড়ে রইলেন ভূমিতে। ব্রাহ্মণ কন্যা তিনি, তার “বিলোম” বিবাহ হবে? কচ ত্যাগ করলেন সে স্থান, অতএব ফিরে গেলেন স্বর্গলোকে। না, গল্প এখানে শেষ হলো না, হতভাগিনী দেবযানীর পরবর্তীতে কি হলো, জানতে কি ইচ্ছা হয় না? তারপর, আগে বলে নি “বিলোম” বিবাহ কি? intercast বিবাহকে বলা হতো তখন বিলোম বিবাহ, তা সংঘটিত হতো পাত্রপাত্রীদের নিজস্ব পছন্দ বা অনেক সময় অভিভাবকদের ইচ্ছানুযায়ী। উচ্চবর্ণের পুরুষ ও নিম্ন বর্ণের নারী হলে তা অনুলোম বিবাহ এবং নিম্ন বর্ণের পুরুষ উচ্চ বর্ণের নারী হলে বলা হতো প্রতিলোম বিবাহ। এরপর বিষন্নমনা দেবযানীকে ছল করে শর্মিষ্ঠা বসন কেড়ে তাকে বনমাঝে এক কূপে নিক্ষেপ করে জব্দ করেন একদিন। দেবযানী কূপ থেকে উঠতে না পেরে আর্তনাদ করতে থাকেন—– সেই সময় ক্ষত্রিয় রাজা যযাতি যাচ্ছিলেন বনের পথে শিকার সেরে—- কূপ থেকে তিনিই দেবযানীকে উদ্ধার করেন। দেবযানী কৃতজ্ঞতা স্বরূপ রাজা যযাতিকে বিবাহের প্রস্তাব দেন। কারণ, দেবযানী কচের অভিশাপ মনে রেখে অন্তত শুদ্র অপেক্ষা ক্ষত্রিয় স্বামী বরং ভালো ভেবেছিলেন আর অবশ্যই প্রথম কোন পুরুষের কাছে নারীর নির্মোহ হবার সুবাদেও। যযাতির প্রথম অসম্মত হলেও শুক্রাচার্যের আদেশে বিবাহ করেন। দেবযানী যযাতির গৃহে আসবারকালে শর্মিষ্ঠাকে প্রতিহিংসা দরুণ পিতার কাছে আবদার করে চেয়ে বসলেন, শর্মিষ্ঠাকে নিয়ে যেতে চিরদাসী করে। শুক্রাচার্যের আদেশে রাজা বৃষপর্বাও বাধ্য হয়ে রাজী হলেন। সুন্দরী,বুদ্ধিমতি শর্মিষ্ঠা চললেন দেবযানীর সাথে দাসী হয়ে আর প্রতিহিংসার এক দারুণ ছল প্রচেষ্টার পরে সফলকামও হলেন।
(চতুর্থ পর্ব)
যযাতি দেবযানীকে প্রথমেই বিবাহে আপত্তি করছিলেন, কারণ তিনি ইতিপূর্বেই শর্মিষ্ঠার প্রেমে পড়েছিলেন। তারপর? পরিণতি সহজেই অনুমেয়। দেবযানীর মনে সর্বদা প্রেমিক কচ বিরাজমান, তার সুখস্মৃতিতেই ভরপুর দেহমন। ফলে যযাতি ও দেবযানীর দাম্পত্য জীবন সুখের হয় নি কোনদিন। দিন যায়—- দেবযানীর দুই পুত্র হয়— যদু ও তর্বসু তার বেশ অনেকদিন পর হঠাৎই একদিন দেবযানী রাজবাড়ির উদ্যানে ভ্রমণ করতে করতে দেখতে পেলেন তিনটি ক্রীড়ারত বালক , জানতে পারলেন , তাদের নাম— দ্রুহ্য, অনু, পুরু। পিতার নাম যযাতি আর মায়ের নাম —- শর্মিষ্ঠা — যার বাসস্থান ছিল উদ্যান সংলগ্নই এক প্রাসাদে, (দেবযানীরই নির্দেশে অবশ্য)। দাসীর গর্ভে তার স্বামী রাজা যযাতির সন্তান !!! অপমানিত, ক্ষুব্ধ, প্রতারিত দেবযানী দুই পুত্রদের নিয়ে চলে এলেন, পিতা শুক্রাচার্যের কাছে। সমস্ত শুনে শুক্রাচার্য তৎক্ষণাৎ যযাতিকে ডেকে অভিশাপ দিলেন তার রূপ যৌবন কেড়ে নিয়ে করলেন তাকে এক জরা বৃদ্ধরূপে। যযাতি অতি ধূর্ত, বললেন, ” এমনিতেই আপনার কন্যা আমাকে নিয়ে সুখী নন, এক্ষেত্রে আমি জরাগ্রস্ত হলে, সে ত আরও অসুখী হবে।” শুক্রাচার্য বুঝলেন, ভেবে বললেন, ” বেশ, কেউ যদি স্বেচ্ছায় তোমায় যৌবন দান করেন, তাহলে তুমি আবার তা ফিরে পাবে।” পরে , যযাতি তার সকল পুত্রের কাছে যৌবন ভিক্ষা চাইলেন। না , দেবযানীর পুত্ররা কেউ সম্মত নন। চাইলেন, শর্মিষ্ঠার ছেলেদের কাছে , বড়ো দুজন কেউ রাজী হলেন না— রাজী হলেন খুসী মনে শুধু ছোট সন্তান — পুরু। পুরু পিতার জরারূপ নিয়ে কোনমতে বেঁচে থাকলেন, আর যযাতি ছেলের যৌবনসুখ নিয়ে যথেচ্ছার দিনযাপন করতে থাকলেন। অনেক পরে যযাতি অনুতপ্ত হয়ে পুরুকে তার যৌবন ফিরিয়ে দিয়ে, নিজে আবার জরাগ্রস্ত হলেন। আর পুরুকেই দিলেন রাজ্য শাসনভার। শুরু হয় পুরু রাজবংশ। দেবযানী প্রধান মহিষী হয়েও তার পুত্ররা কেউ রাজা হতে পারলেন না। সারাজীবন কি পেলেন দেবযানী? অহংকার দাম্ভিকতা , রূপগুণ যেদিকেই পাল্লা হেলে পড়ুন না কেন, দেবযানী জন্মলগ্ন থেকেই ভাগ্য বিরম্বিতা, প্রকৃত মর্যাদা কারো কাছ থেকে সে পায় নি, সবাই তাকে সুযোগ মতো ব্যবহার করেছেন। কেমন? তাহলে বলি—
১) মা জয়ন্তী জন্মলগ্নেই তাকে ফেলে অমরালোকে চলে যান, কোনদিন খোঁজ করেন নি।দেবযানী মাতৃস্নেহ থেকে চির বঞ্চিত।
২) পিতা শুক্রাচার্য যারপরনাই আদর দিয়ে দেবযানীকে বড়ো করে তুললেন, যাতে কোন সময় দেবযানী অভিযোগ বা অভিমান করে মায়ের কাছে যাবার বায়না না করে। উপযুক্ত শাসনে আদরে বড়ো হলে,দেবযানী হয়ত ওমন দেমাকী ও একরোখা হয়ে উঠতেন না। পিতার ভালবাসায় ছিলই শুধু প্রশ্রয় ও স্বার্থের ছোওয়া।
৩) প্রেমিক কচ তার ভালবাসা উপেক্ষা করে গুরুত্ব দিলো তার নিজের অহংকার ও অঙ্গীকারকে। দেবযানী সে ব্যথা সারাজীবন বহন করেছিলেন।
৪) স্বামী যযাতি তাকে প্রতারণা করে তারই দাসীর সাথে প্রণয় সম্পর্ক স্থাপন করেন।
৫) শেষে দেবযানী যযাতির প্রধান মহিষী হওয়া সত্ত্বেও রাজমাতা হতেও পারেন নি। হলেন শর্মিষ্ঠা। সারাজীবন দেবযানী প্রকৃত ভালোবাসা কারো কাছ থেকে পান নি , জীবনে শুধুই ব্যর্থতার গ্লানি ও হাহাকার। যথেষ্ট রূপগুণ সম্পন্না নারীর অহংকারই কি তার অতৃপ্তি ও অসুখী হবার কারণ? না , পুরাণ করে নি সে কথা বিশ্লেষণ , শুধুই ঘটনার উপস্থাপন। বিশ্লেষণ ও বিস্তার— সে ত পাঠকের অধিকার।
এখন অবধি বিজ্ঞান বিরোধি ” মৃতসঞ্জীবনী বিদ্যা” । জানা নেই বিজ্ঞান কত প্রযুক্তিগত ছিল যে সে যুগে, মৃত প্রাণীদের প্রাণ ফিরিয়ে দেবার। জানা নেই, কিভাবে তৃতীয়বার, অসুরেরা কচকে শুক্রাচার্যের (জরায়ু ব্যতীতপুরুষ )উদরেই স্থাপন করে, আবার কচ পনরুজ্জীবিত হয়। এ সব মিথ হয়েই আসছে। হয়ত বিজ্ঞান কোনদিন এর উত্তর দেবে।