মাষ্টারদা
ডক্টর বিবেক তার স্ত্রীকে নিয়ে বেনারস গেছে।
ছেলের জন্মের পর ছেলের পা একটা পায়ের উপর ওঠানো ছিল।ঠিক যেন কৃষ্ণ ঠাকুর।ছেলের পা এক মাসের মধ্যে অপারেশন করা হয়।সফল তো তখন জানা যাবে না।যখন বাচ্চা হাঁটতে শিখবে তখন বোঝা যাবে ,ওর অপারেশন ঠিক হয়েছে কিনা!
প্রায় এক বছর ধরে মৌসুমী ঠাকুরের কাছে মানত করে গেছে।
বাবা বিশ্বনাথ তোমাকে বেনারসে গিয়ে পূজা দেব।আমার ছেলের পা ঠিক যেন হয়।
ছেলে যথারীতি হাঁটতে পারে।তখন থেকে মৌসুমী ঘ্যানঘ্যান করে যাচ্ছে,বেনারসে পূজা দিতে যেতে হবে।এক সময় বিবেক বলে কাছাকাছি মানত করতে পারতে।এর জন্য বেনারস।আমার কি সময় আছে??
তোমার বিশ্বনাথকে বলো ছুটি দিতে।তাহলে সপরিবারে মানত ছাড়াতে যাব।
এই বলতে বলতে ছেলের যখন তিন,ঠিক হয় বেনারস যাবে।
ছেলে বাবা ভক্ত খুব।মা তো পচা হয় ,বকা দেয়,পড়ার কথা বলে।
ছেলে বাবাকে কাছে পেলেই বাবার ছোট বেলার গল্প শুনবেই।আবার মার কাছে ও শোনে।তবে মার পুতুল খেলার গল্প কি শুনতে ভালো লাগে?তাই বাবার গল্প পছন্দ বেশী।
বাবা আমবাগান থেকে কাচা আম পেড়ে,খেতে খেতে স্কুলে যাবার গল্প।
ছোটোবলায় বিবেক অঙ্কে খুব কাচা ছিল।অঙ্কের জন্য স্কুলের সর্বমোট সংখ্যা কমে যেত। অঙ্ক ভালো ও লাগত না।একদিন বাবা স্কুলের বিমল স্যারকে বলেন আমার ছেলের অঙ্কের দায়িত্ব নিন।তাই বিমল স্যার ওয়ান থেকে মাধ্যমিক ক্লাস পর্যন্ত অঙ্ক করিয়েছেন।অঙ্কে প্রতিবার গোটা নম্বর।
তারপর বিবেক মাষ্টারদার কোনো খোঁজ পায় নি।স্কুলে গিয়ে শোনে ওনার মাথায় টিউমার ছিল।অপারেশনের পর কোথায় চলে গেছেন।আদৌ বেঁচে ছিলেন কিনা জানা নেই।তিন বছরের ছেলে হাঁ করে বাবার গল্প শোনে।মৌসুমী বলে ইস ঐ স্যারকে পেতাম তাহলে ছেলের জন্য ঘরে এনে রাখতাম।
হাওড়া থেকে ট্রেন ধরে মোগলসরাই।ওখান থেকে বাসে করে বেনারস যায়।হোটেলে পৌঁছে স্নান করে মন্দিরে পূজা দিতে যায়।জুতো একজন রাখছেন।প্রতি জনের জুতা এক টাকা করে।বুড়ো বাবার কাছে জুতো জমা রেখে মন দিয়ে ছেলেকে ধরে পূজা দেওয়া হয়।পূজার শেষে বাবা বিশ্বনাথ প্রণাম করে বিবেক। আমি এখন ডাক্তার,ছোটতে অঙ্কের নম্বর কোন রকমে পাশ করতাম,তখন মা ও বলতেন তুই অঙ্কে ভালো করলে বিশ্বনাথ দর্শন করে আসব।বাবা কোনোদিন সেই মানত পুরণ করেন নি।বাবা মজা করে মাকে বলতেন —ওর বাবা বিশ্বনাথ হলেন মাষ্টারদা।ওনাকে ভালো করে চা দিও গিন্নি।তাতেই তোমার ছেলেরপুন্যি হবে।হঠাৎ বাবা ও মার ঐ কথোপকথন,ছেলে বেলার কথা মনে আসে।
গিন্নিকে সেই কথাটি ডঃ বিবেক — মন্দিরে দাঁড়িয়ে বলে।মৌসুমী বলো তোমার শ্বাশুড়ি স্বর্গ থেকে দেখতে পাচ্ছেন।মৌসুমীকে অনেক আশীর্বাদ করছেন।
তারপর বাইরে এসে জুতো পড়ে,তিনটাকা দিতে হবে।
বিবেক পাঁচ টাকা দিয়ে চলে যাচ্ছিল।
বুড়ো ভদ্রলোক বলে বাবু আপনার দু টাকা ফেরত নিন।
বিবেক বলে না না ফেরত দিতে হবে না।বুড়ো মাথা তুলে বলে আমি খুব হিসাব ভালো পারি।
হ্যাঁ আপনাকে আমি বাড়তি দিলাম।
বাবু ভুল করছেন আমি দান নিই না।
বিবেক তাকিয়ে বলে মাষ্টারদা!!!
আপ—নি।উঠে আসুন।
দাঁড়ান বাবু এই জুতো যার দিয়ে দি ,তারপর বাবু শুনছি।আমি কানে শুনি না।বুড়ো হয়েছি তো।
বিবেক ঝাঁকানি দিয়ে মাষ্টারকে ওঠায়।
চিনতে পারছেন??
মাষ্টারদা আপনি এই কাজে?
আচ্ছা বাবা চিনব কি করে?কত লোক জুতো রাখে আমার কাছে।
বিবেক বলে মডেল স্কুলের অঙ্কের স্যার জুতো পাহারার কাজ!!
মাষ্টার দা বলে কত ছাত্র পড়েছে,কত আসে বিদ্যামঠ তলে ,এক ঝাঁক আসে এক ঝাঁক পাশ করে চলে যায় ,মনে কি আছে বাবা!!
সেই যে অংকে কম পেতো বলে—
পনেরো বছর হয়ে গেছে রে বিবেক ,তোকে কি ভুলতে পারি।তাও মাঝে স্মৃতিভ্রম হয়েছিল।
বিবেক হাউমাউ করে কেঁদে বলে দেখে যাও মৌসুমী আমার বিশ্বনাথ দর্শন হয়ে গেছে।
মৌসুমী প্রণাম করে মাষ্টারদাকে বলে ,আপনার কথা আমি শুধু নয় আমার ছেলে ও জানে।আপনি আমাদের সঙ্গে যাবেন।আমার ছেলেক অঙ্ক শেখাবেন।
তারপর শোনেন তাঁর ঘটনা।অপারেশনের পর তিনি কাউকে কিছু না বলে এই বেনারসে চলে আসেন।জানি না ছেলে ও ছেড়ে যেতে পারে!!দু এক বছর আগে পুরানো ঘটনা মনে পড়ে।ছেলেকে চিঠি দিয়।তার জবাব দেয় নি।
তারপর থেকে আমৃত্যু মাষ্টারদা ছাত্র বিবেকের বাড়িতে।
ঐ শুনতে পাচ্ছেন নামতা পড়ছে মাষ্টারদাদু আর নাতি দু এককে দুই—-।