শুভ জন্মদিন
সমীরের জন্মদিন আজ। এবছর ও পচিশ বছর পার করে ছাব্বিশ বছরে পা দিল। ওর ফেসবুক অ্যাকাউন্ট উপছে পড়ছে শুভেচ্ছা বার্তায়। ওর হাজারখানেক বন্ধুদের মধ্যে ইতিমধ্যেই প্রায় শ তিনেক বন্ধু শুভেচ্ছা জানিয়ে ওর সময়সারণিতে লিখেছে। ও আজ খুবই ব্যস্ত,সবাইকে প্রত্তুত্তর জানাতে। সমীরের বাবা-মা এমনকি ভাইবোনগুলো সবাই শুভেচ্ছা জানিয়েছে। সবাইকে ও প্রত্তুত্তর জানাচ্ছে। অফিসের সহকর্মী থেকে শুরু করে পাড়াপড়শিরাও শুভেচ্ছা জানিয়েছে। একবার ফেসবুকে প্রত্যুত্তর দিচ্ছে তো আর একবার হোয়াটসঅ্যাপে প্রত্যুত্তর দিচ্ছে। সবাইকেই ও খুব ভালোভাবে মন্তব্য করছে। গত তিন বছর থেকে এই সোশ্যাল মিডিয়াতে আছে। গত বছর থেকে এই শুভেচ্ছা বার্তার স্রোতটা অনেকগুণ বেড়ে গেছে। আজ ও অফিস থেকে ছুটি নিয়েছে এই দিনটা নিজের মতো করে কাটাবে বলে। কিন্তু এই মন্তব্য প্রতি মন্তব্য করতে করতেই ও হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে। বাবা-মা ছাড়াও ওর এক ভাই এক বোন আছে। বেলা বারোটা বেজে গেছে এখনো ওর জলখাবার খাওয়া হয়নি। আজ ওকে কেউ ডাকেও নি জল খাবার খেতে। এদিকে ওর পেটে ছুঁচোয় ডন মারছে। বাধ্য হয়ে একটু রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেল। দেখল ওর মা যথারীতি রান্নায় ব্যস্ত অন্যদিনের মত।
সমীর ওর মাকে খাবারের কথা জিজ্ঞাসা করাতে ওর মা বললেন “আজ তো তুই নিজের মতো করে দিনটা কাটাবি বলে ঠিক করেছিস তাই আর ডাকিনি। ডাকলে যদি আবার রাগ করিস। আজকের দিনে রাগারাগি করতে নেই”। এবার ও খাবার টেবিলে গিয়ে বসলো। ওর মা জলখাবার এগিয়ে দিলেন। সেই থোড়-বড়ি-খাড়া আর খাড়া বড়ি থোড়। দেখেই ওর মাথাটা গরম হয়ে গেল। মাকে জিজ্ঞাসা করল আজকের দিনেও এই খাবার অন্য কিছু করতে পারলে না?
মা বললেন চুপ করে খেতে পারলেখা না হলে খেতে হবে না। এদিকে পেটে টান পড়াতে সমীর আর কোন কথা বাড়ালো না। চুপ করে খেয়ে উঠে গেল। খেয়েদেয়ে উঠে আবার বসে গেল প্রত্যুত্তর দিতে। আবার ঘাড় গুঁজে বসে প্রত্যুত্তর দিয়ে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে আরোও শ’খানেক শুভেচ্ছা বার্তা জমে গেছে। উত্তর দিতে দিতে সমীরের হাত ব্যাথা করতে শুরু করেছে। ঘাড়টাও টনটন করছে। চোখের কোনা দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে এতক্ষণ একটানা মোবাইলের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে। এবার ও মোবাইলটা পাশে রেখে দিয়ে চুপ করে বিছানায় শুয়ে পড়ল। এবং নিদ্রা মত চলে এলো। বেলা আড়াইটে নাগাদ ওর মা ঘরে এসে দেখলেন ছেলে ঘুমিয়ে পড়েছে। সমীরকে ডেকে তুলে দিলেন দুপুরের স্নান খাওয়া করবার জন্য।
সমীর ঘুম থেকে উঠে স্নান করে এলো। ঘরে ফিরে এসে দেখল ওর বিছানার ওপর নতুন জামা-কাপড় রাখা রয়েছে। তার মানে ওর মা এগুলো রেখে গেছেন। ও নতুন জামাকাপড় পড়ে খাবার ঘরের দিকে গেল। ওকে দেখে ওর মা পুজোর ঘরে ডেকে নিলেন। প্রদীপ জ্বলছে,ওর মা পাশে বসে চন্দন বাঁটছেন। এবার একটা আসন পেতে সমীরকে বসতে বললেন।সমীরকে বসিয়ে ওর মা ছেলের কপালে চন্দনের ফোটা এঁকে দিলেন। এরপর প্রদীপের শিখার ওপর নিজের বুড়ো আঙুলটা একটু গরম করে ছেলের চোখেমুখে কপালে ছুইয়ে দিলেন। পরম আদরে ছেলের কপালে একটা চুমু দিলেন। সমীরের মনে হল এর থেকে বড় প্রাপ্তি আর কিছুই হয়নি এতক্ষণে। এবার মা এক প্লেট ভর্তি মিষ্টি ওর দিকে এগিয়ে দিলেন সাথে এক বাটি পায়েস। এর থেকে ভালো আর কি হতে পারে। একটু খেলো। এবার ওর মা ওকে নিয়ে খাবার ঘরে এলেন। ওখানে ইতিমধ্যেই ওর বাবা ভাইবোনেরা চলে এসেছে। ওর বাবাও আজ অফিসে যান নি। সবাই সমীরকে শুভেচ্ছা জানালো। ও খাবার টেবিলে এসে বসলো। মা খাবার গুছিয়ে নিয়ে এলেন। পঞ্চ ব্যঞ্জন সাজানো থালা। ওর চক্ষুচড়কগাছ হয়ে গেছে। এত কিছুর আয়োজন হল অথচ কিছুই টের পাইনি। ওর ভাই-বোনেরাও কিছুই জানায়নি। ওকে সারপ্রাইজ দেবে বলে সবাই চুপ করেছিল। ওরা সবাই মিলে খাবার টেবিলে হইচই করে খেতে লাগলো। ওর মাও খাবার দিতে দিতে সবার সাথে যোগ দিলেন। একটা নির্মল আনন্দ সবার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল। সমীর ভাবছিল সারাদিন ধরে যতই মন্তব্য প্রতিমন্তব্য করুক না কেন এই সবার সাথে একসাথে বসে আনন্দে কাটানোর সময়টাই আজকের দিনে সবচাইতে সেরা মুহূর্ত। মাকে বললো আজকের দিনে এই মুহূর্তটা উপহার দেবার জন্য তোমার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। তোমাকে অনেক অনেক ভালোবাসা মা। লোকে যতই শুভেচ্ছা জানাক এই সশরীরে স্পর্শের মূল্যই অনেক। যতই আমরা এগিয়ে যাই না কেন এই অনুভূতি কোনোভাবেই ভার্চুয়াল জগত দিতে পারবে না। মানুষের মনকে ভার্চুয়াল জগত বেঁধে রাখতে পারবে না কখনোই।