কৃষক ও লাশ
আশীষ একজন বর্ধিষ্ণু কৃষক। আগে ও নিজেই চাষাবাদ করত। কিন্তু এখন আর ও নিজে কৃষিকাজ করে না। লোক দিয়েই চাষাবাদ করিয়ে নেয়। তবে ভালোবেসে মাঝে মাঝে ও জমিতে যায় আগাছা পরিষ্কার করতে। আসলে নিজের পরিচিতিটা ও কৃষক হিসেবে করাতেই বেশি পছন্দ করে। কারণ ওর জীবন শুরু হয়েছিল কৃষিকাজ দিয়ে। তবে যবে থেকে ও আখের চাষ করতে শুরু করল তখন থেকে ওর ভাগ্য ঘুরতে শুরু করলো। এখন ও পুরোদস্তুর একজন জোতদার।
আখ চাষের লাভ দিয়ে ও বিশাল জমির মালিক হয়েছে। ও এখন আর অন্য কোন সবজি চাষ করেই না বলা চলে। ওর বিশবিঘা জমির মধ্যে পনেরো বিঘাতেই আখের চাষ করে। বাকি পাঁচ বিঘায় বিভিন্ন সবজি চাষ করে।
এখন ওর আখ কিনতে অনেক জায়গা থেকে চিনিকলের লোকেরা আসেন। ও তাদের সাথে কথা বলে ফাইনাল করে।
এবছরও আশীষ আখের চাষ করেছে। মাঝেমাঝেই জমিতে যায় আগাছা পরিষ্কার করতে। তখন আখ গুলো বেশ বড় বড় ও মোটা হয়ে গেছে। আখ গাছের নিচের দিকটা একদম অন্ধকার। কিছু থাকলে বোঝা যায় না। এরকমই একদিন ও জমিতে গেছে আগাছা পরিষ্কার করতে। পরিষ্কার করতে করতে অনেকটা গভীরে চলে গেছে ও। হঠাৎ ওর হাতে কিছু একটা ঠেকলো। ও ভালো করে লক্ষ্য করে দেখল একটি লাশ।
ভয়ে কেঁপে উঠলো ও। এই অঞ্চলে এই ধরনের ঘটনা তো আগে ঘটেনি। ও জমি থেকে বেরিয়ে এসে সোজা পুলিশকে ফোন করে জানালো। আধা ঘন্টার মধ্যে পুলিশ এল।
পুলিশ এসে আশীষকেই জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলো। পুলিশের লোকেরা লাশটাকে বাইরে বের করে আনল। লাশটাকে বাইরে আনবার পরে দেখা গেল একটি মেয়ের লাশ এবং সম্পূর্ণ বিবস্ত্র । পুলিশ অনুমান করল মেয়েটিকে ধর্ষণ করে খুন করা হয়েছে। মেয়েটির বয়স আনুমানিক চব্বিশ পঁচিশ।
আশীষকে জিজ্ঞাসাবাদ করার পর পুলিশ লাশটাকে তাদের গাড়িতে তুলে নিয়ে যায়।পরের কাজগুলো পুলিশ শুরু করে।
এদিকে আশীষের জমিতে লাশ পাবার খবরটা হাওয়ার বেগে ছড়িয়ে পড়ে। ও সবাইকে বলে দেখো আমরা কৃষক। আমরা তৈরি করি আমরা ধ্বংস করিনা। আমরা সমাজের বন্ধু। আমরা কারোর ক্ষতি করবো কিভাবে? এসবই আমার মনে হয় শহরের শিক্ষিত বখাটে ছেলেদের কাজ। যারা ধর্ষণ করে খুন করেছে মেয়েটিকে। রাতের অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে তারা আখের ক্ষেত দেখে তার মধ্যে ফেলে দিয়ে গেছে। আর তোমাদের সবার কাছে আমি এটা স্বীকার করছি পুলিশের সাথে আমি সম্পূর্ণ সহযোগিতা করব যাতে এই খুনিরা ধরা পড়ে।
দ্বিতীয় পর্ব
পুলিশ মেয়েটির লাশ নিয়ে চলে গেছে। তারা ময়নাতদন্তের জন্য লাশটাকে পাঠিয়েছে। এদিকে গ্রামে প্রায় প্রতিদিনই পুলিশ আসতে শুরু করেছে। আশীষ সহ গ্রামের লোকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। পুলিশের হাতে তখনও ময়নাতদন্তের রিপোর্ট আসেনি। তবে পুলিশ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে একটি খুনের মামলা দায়ের করেছে অজানা ব্যক্তির নামে।
এদিকে গ্রামের লোকজন বিরক্ত হয়ে উঠছে এই জিজ্ঞাসাবাদের কারণে। কিন্তু কেউ আশীষের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলতে পারছে না কারণ তাদের বিপদে আপদে আশীষই সবার আগে পাশে এসে দাঁড়ায়। গ্রামের লোকজনকে এককাট্টা করে সুদখোর মহাজনদের গ্রামছাড়া করেছিল আশীষ। চাষাবাদের জন্য কারোর টাকা পয়সার প্রয়োজন পড়লে আশীষই ব্যবস্থা করতো। এর জন্য ও কোন সুদ নিত না।
এছাড়া গ্রামটাকে ঋণের বোঝা থেকে মুক্ত করে দিয়েছিল। শুধু তাই না গ্রামের চাষাবাদ আরও কিভাবে উন্নত করা যায় সেটা নিয়েও আলোচনা করত সবার সাথে । এখন গ্রামের অলিখিত মোড়ল এই আশীষ। কিন্তু এই ঘটনাটা গ্রামে আলোড়ন ফেলে দিয়েছিল। আর পুলিশের এই জিজ্ঞাসাবাদ ওদের অসহিষ্ণু করে তুলেছিল। যে কারণে দু-চারজন প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছিল।
পুলিশের হাতে ময়নাতদন্তের রিপোর্ট এলো। আদালতে মামলা চলছে আর পুলিশ তদন্ত করছে তাদের নিজেদের মতন করে। ময়নাতদন্তের রিপোর্টে দেখা গেল মেয়েটিকে ধর্ষণ করে খুন করা হয়েছে। এটাও ময়নাতদন্তের রিপোর্টে পরিষ্কারভাবে লেখা রয়েছে তিনজন মিলে মেয়েটিকে ধর্ষণ করে শ্বাসরোধ করে খুন করা হয়েছে। পুলিশ তদন্তে নেমে জানতে পারল মেয়েটির নাম সীমা এবং দুটি পাড়া পরে থাকে। পুলিশ নিজের মতো তদন্ত করছিল। কিন্তু আশীষদের গ্রামের অনেকেরই মনে হচ্ছিল তদন্ত বোধহয় খুব ধীর গতিতে এগোচ্ছে। সেই কারণে ওরা কয়েকজন গেল স্থানীয় থানাতে।
তদন্ত চলছে বলে পুলিশ ওদের কিছুই বলল না। এদিকে পুলিশ সীমার ব্যাপারে খোঁজ নিতে গিয়ে জানতে পারল মেয়েটি পড়াশুনা শেষ করে চাকরির চেষ্টা করছিল। কিন্তু বাড়ির অবস্থা ভালো নয় বলে টিউশন পড়াতে যেত। টিউশনির টাকায় ও ওর সংসার খরচ চালাত। সংসারের দিকে তাকিয়ে সীমা প্রেমের সম্পর্কে আসেনি। যদিও অনেকেই প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছিল কিন্তু ও সবাইকেই প্রত্যাখ্যান করে।
এই প্রত্যাখ্যাত প্রেমিকদের মধ্যে একজনের নাম সমীর। সমীরের বাবা একজন বিরাট ফাইন্যান্সার। যিনি সুদের বিনিময়ে প্রচুর টাকা পয়সা ধার দিয়ে থাকেন। আশীষদের গ্রামেরও বেশ কিছু লোক ওনার থেকে টাকা ধার নিয়ে চাষাবাদ করত। কিন্তু আশীষ সবাইকে সাহায্য করতে শুরু করলে ওনার ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায় ওই গ্রামে।
পুলিশ এইসব তথ্য জোগাড় করে নিয়ে আসে। তদন্তের ফলে অনেক নতুন নতুন তথ্য সামনে আসতে থাকে। সমীরের বাবা আশীষকে হুমকি দিয়েছিল নাস্তানাবুদ করে দেবে ওকে।
আদালতে মামলা উঠেছে প্রায় মাস দুই তিনেক হয়ে গেছে। প্রায় প্রতিদিনই শুনানি চলছে। আশিসরাও প্রায় প্রতিদিনই যাচ্ছে। এমন সময় একদিন স্থানীয় থানা থেকে পুলিশ আশীষকে ডেকে পাঠাল। পুলিশ ওকে জানায় আজ আমরা চার্জশিট তৈরি করছি। আপনাদের গ্রামের একটি ছেলে এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত রয়েছে। এছাড়া আরো দুজন ধর্ষক যাদের আমরা শনাক্ত করে ফেলেছি এবং একজনের বাবাও এই খুনের সাথে জড়িত।
আশীষ পূর্ণ সম্মতি দিয়ে ফিরে এলো গ্রামে। সেদিনই আদালতে শুনানির সময় পুলিশ চার্জশিট পেশ করল। চারজনের বিরুদ্ধে চার্জশিট তৈরি হয়েছে। প্রথম তিন জনকে সরাসরি ধর্ষণ করে শ্বাসরোধ করে হত্যার দায়ে অভিযুক্ত করা হয়েছে এবং একজনকে সরাসরি খুনের দায়ে অভিযুক্ত করা হয়েছে এবং প্রমাণ লোপাটের চেষ্টার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
আদালত সেদিনই চারজনেরকে দোষী সাব্যস্ত করল এবং পরের দিন শাস্তি ঘোষণা করা হবে জানিয়ে আদালত বন্ধ হল। আদালত পুলিশকে নির্দেশ দিল চারজনকে আটক করতে। পুলিশ পরদিন চারজনকে আটক করে আদালতে পেশ করল। আশীষদের গ্রামের ইয়াকুব নামের একটি ছেলেকে আটক করে আদালতে নিয়ে গেছে পুলিশ। এছাড়া সমীর ও তার বন্ধু সুমন কেও আটক করেছে সরাসরি ধর্ষণ ও খুনের অভিযোগে। ওদের সাথে সমীরের বাবাকে আটক করা হয়েছে প্রমাণ লোপাটের চেষ্টার অপরাধে এবং সরাসরি খুনের মামলায়। আদালত পরের দিন চারজনকেই যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের নির্দেশ দিল।
আশীষ আজ আবার সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল তোমাদের বলেছিলাম আজ সেটাই প্রমাণিত হলো। আমরা কৃষক আমরা তৈরি করি ধ্বংস করিনা। আমার ওপর ব্যক্তিগত আক্রোশ মেটানোর জন্যই লাশটাকে আমার জমিতে ফেলে দেয়া হয়েছিল এবং এটা হয়েছে শুধুমাত্র তোমাদেরকে সাহায্য করবার জন্য। এতদিনে শাপমুক্ত হলাম। সত্যের পথে থাকলে কোনো ঝড়ই ঝড় বলে মনে হবে না।আজ আদালতের রায়ে ন্যায়প্রতিষ্ঠা হলো।