স্মৃতির এলাহাবাদ
সালটা ২০০৪ – ০৫ হবে। কলকাতা থেকে বেরোলাম এলাহাবাদের উদ্দেশ্যে। কালীপুজোর দিন। কালী পুজো বাদ দিয়েই রওনা দিলাম। যদিও টিকিট কনফার্ম হয়নি। ওয়েটিং লিস্ট। তখন অবশ্য ওয়েটলিস্ট টিকিট ক্যান্সেল হয়ে যেত না। সাধারণ কামরায় যাওয়া যেত। যাইহোক মুম্বাই মেল উঠে গেলাম। বসবার জায়গাও পেলাম। পরদিন সকালে এলাহাবাদ পৌছালাম। গিয়ে একটা হোটেলে উঠলাম। অর্থ বাহুল্য। সস্তার হোটেলে উঠলাম। সে সময় একটা মার্কেটিং কোম্পানিতে কাজ করতাম। সাত-আট মাস ওখানে ছিলাম। এলাহাবাদ মোটামুটি চষে ফেলেছিলাম। আলেপ্পি বাগ,সিভিল লাইন্স,এলাহাবাদ ইউনিভার্সিটি,মিউজিয়াম ,আনন্দ ভবন,মিন্টো পার্ক,নৈনি মোটামুটি সবটাই। এখন অত সব জায়গার নাম মনেও নেই।
এই সাত-আট মাসে অনেক অম্লমধুর স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে। কিছুদিন পর থেকে আমি সিভিল লাইন্সে একটা ভাড়া বাড়িতে থাকতাম। সেখানে আমরা ছয় সাতজন বাঙালি ছেলে একসাথে থাকতাম। রাতে সবাই মিলে রান্না করতাম। আমাদের মধ্যে একজনের হাতের রান্না খুব ভালো ছিল। বেশিরভাগ দিন ওর ওপরেই রান্নার ভার পড়তো। আমরা সবাই রান্নায় জোগাড় দিতাম। খেয়ে দেয়ে কিছুক্ষন খুনসুটি করে ঘুমিয়ে পড়তাম। পরদিন ঘুম থেকে উঠে আমরা সবাই কাজে বেরিয়ে পড়তাম।
একবার ঠিক করলাম এলাহাবাদ এসেছি অথচ ত্রিবেণী সঙ্গম দেখব না সেটা হয় না । একটা ছুটির দিন দেখে অটো ভাড়া করে চলে এলাম ত্রিবেণী সঙ্গম। আমরা যখন গেছিলাম তার মাসখানেক আগে মহাকুম্ভ শেষ হয়েছে। তখনও সব সন্ন্যাসী ফিরে যাননি। আমরা বালিরচর পেরিয়ে অনেকটা এগিয়ে এলাম। একটা নৌকো ভাড়া করলাম। মাঝি আমাদের মাঝ নদীতে নিয়ে গেল। দেখলাম দুটো স্রোত পাশাপাশি বয়ে চলেছে। একটা নীল যেটা যমুনা আর একটা ঘোলা যেটা গঙ্গা। কিন্তু সরস্বতীকে খুঁজে পেলাম না। মাঝিকে জিজ্ঞাসা করলাম সরস্বতী কোথায়? মাঝির উত্তর সরস্বতীকে খুঁজে পাওয়া যাবে না কারণ অন্তঃসলিলা। মানে মানে ফিরে এলাম।
দীর্ঘ সাত আট মাস কাটাবার পর আমি বাড়ি ফিরব স্থির করলাম। তাই সেইমতো ছুটি নিয়ে নিলাম অফিস থেকে। ফিরবার সময়ও টিকিট ওয়েটিং লিস্ট। আবার সেই মুম্বাই মেল। সাধারণ কামরায় উঠবার পর দেখি দাঁড়াবারও কোন জায়গা নেই। বাধ্য হয়ে রিজার্ভেশন কামরায় উঠলাম। দাঁড়াতে পারছিলাম না কারণ গায়ে প্রচন্ড জ্বর। রিজার্ভেশন কামরায় উঠে সরাসরি টিকিট পরীক্ষককে গিয়ে শারীরিক অবস্থার কথা জানালাম। উনি আমার টিকিট পরীক্ষা করে আমাকে একটা বার্থ দিয়ে দিলেন এবং বললেন আপনাকে একটা টাকাও দিতে হবে না। তবে আমি গোমো জংশন পর্যন্ত আছি। ততক্ষণে সকাল হয়ে যাবে জেনারেল কামরাও খালি হয়ে যাবে। আপনি তখন ওখানে চলে যাবেন। আমি বার্থে গিয়ে শুয়ে পড়তেই অচৈতন্য হয়ে পড়লাম। এলাহাবাদ ছাড়লো বুঝতে পারলাম তারপরে একটা স্টেশনে এসে দাঁড়াল ট্রেনটা। আবার ছেড়েও দিল। টিকিট পরীক্ষক ভদ্রলোক এসে আমাকে ধাক্কা দিলেন এবং বললেন এই ওষুধটা খেয়ে নিন জ্বরটা কমে যাবে।
সেদিন আমার চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে এসেছিল ওনাকে কিভাবে কৃতজ্ঞতা জানাবো জানিনা। তাই এই স্মৃতি রোমন্থনের মাধ্যমে ওনার প্রতি আমার এই কৃতজ্ঞতা। এতটা মানবিক টিকিট পরীক্ষক আমার অন্তত চোখে পড়েনি।