আমি কান পেতে রই
যখন দখিণা বাতাসে ফাল্গুনী ক্ষণে-
বসন্ত পিওন এসে হৃদয়দুয়ারে কড়া
নাড়ে ,তখুনি বিলক্ষণ টের পেয়ে যাই, মিষ্টি স্নিগ্ধ পরশে আলতো ছোঁয়ায় আমার বুকের চাতালে স্মৃতিরা খুশির মাতনে ঢেউ তুলে। উন্মনা মন ঘরের আগল খুলে ছুট দেয়–
কি দারুন চনমনে সে অনুভূতি গো!
পা দুটো যেন পথে চলছে না, হাত দুটো ও কেমন ডানার মতন,আমি উড়েই চলেছি ,খেয়ালী বাতাসের সাথে নিবিড় মগ্নতায়। আমি কান পেতে শুনছি ,ভারী মিঠেল মর্মর ধ্বনিতে তরঙ্গায়িত হয়ে ফরফর্ করে ওড়ে ওড়ে
ঝরাপাতারা আমায় ডাকছে আকুল ব্যাকুল উচাটনে–
–বেলা যায় দখিণা হাওয়ার কোলে
ও সই,স্মৃতির বাথানে মন যে দোলে,
কতো কথা বিমূর্ত হয় দখিণা বাতাসে
ঝরাপাতা হয়ে আমি কাঁদি দীর্ঘশ্বাসে
সকলেই গেছে চলে দূর- অচিনপুরে
রয়ে গেলি তুই, নিঃসঙ্গ জীবনজুড়ে!
মনটা আমার বেদনায় ভরে যায় তা শুনে,মৃদু হেসে বাতাসের গায়ে মুখ চেপে বলি,এইতো এলাম বলে ,তোর জন্যেই নিরালা দুপুরে হা-পিত্যেশে বসে থাকি ,দখিণা বাতাসের ছোঁয়া পেলেই আঁকুপাঁকু করে মন,আর ,দুষ্টু বসন্ত পিওন বড্ড জ্বালাতন করে গো,এদিক – ওদিক,সেদিক কেবলি ফিচকেমি করে বেড়ায়,বয়েসটাও তো বসন্তের কম,তারুন্যের জৌলুস বলে কথা ,তাই বসন্ত পিওন সক্কলের কানে বসন্তের অনুরাগের আবীর মাখাতে মাখাতে তবেই না আসে ।
হ্যাঁগো , সই ঝরাপাতা ,সত্যি তাই।
তোর কাছে গেলেই জানি আমার মনখারাপের অসুখটাও দিব্যি গা’ ঝাড়া দিয়ে পালায়।
যেখানটাতে তুই আঁচল দুলিয়ে প্রজাপতির মতন ওড়ে যাস বাতাসের পরশ পেলেই,সেখানে– ওইযে,আরো একজন আমাদের বন্ধু আছে! ওইযে,বেঞ্চটা! আগে কি সুন্দর চকচকে জৌলুস ছিলোনা?
এখন,বেশ পুরনো মানে বয়েস হলে যা হয়ে থাকে তাই হয়েছে।
সেও কিন্তু তোকে ভালোবাসে ,ঠিক আমার মতন। তুই যে একটু বাতাসের ঠেস লাগলেই ফুরফুরে করে ওড়ে ঝাঁপিয়ে পড়িস ওর বুকে,ও কিন্তু একটুও রাগ করেনা।বন্ধুত্ব ভারী চমৎকার বন্ধন গো ঝরাপাতা,একথা তো তুই আমি এবং ওই পুরনো বেঞ্চ –তিনবন্ধুই জানি,তাইনা?
মনে পড়ে,সেই যখন আমিও কিশোরী ,তুইও কচি খুকির মতন শ্যামলী,তখন ওই বঞ্চবন্ধুর কোলে বসে কতো কথা,গান কতো কতো প্রিয়জনের প্রীতিময়তায়,সোহাগী আলাপনের মাদকতায় মুখরিত ছিল ফাল্গুনী বসন্তের দিনগুলি।
আমি আজো কান পেতে রই,যেন , অস্পষ্ট মিহি সুরে স্মৃতির দোলাচলে
মধুর ছবিরা হেলেদুলে আগের মতোই তোকে মুঠোতে করে তুলে ফিসফিস করে কৌতুক ভরে শূন্যে ছড়িয়ে দিচ্ছে ,আর তুই ফিনফিনে চিকন শরীর নিয়ে হেসে উঠছিস।
এখন তো আমরাও প্রবীণ তাইনা ঝরাপাতা ?
সময়ের স্রোত বলে কথা গো সই,সময় যে বড়ো চতুর।
আর,এর জ্বলন্ত উদাহরণ আজ ওই পুরনো জীর্ণ বেঞ্চ,বয়েসের ভারে ধূসর ,শুকনো তুই ,আর সময়ের চাবুক খাওয়া ন্যূব্জ আমি।তবু দ্যাখ্ ,ঝরাপাতা,আজো আমাদের বন্ধুত্ব কিন্তু অটুট।
আসলে,আমরা যে ভালবাসতে জানি ।ভালবাসা বিলিয়ে দিতেও জানি ।এ্যাইযে,আমি পুরনো হয়ে যাওয়া বন্ধু বেঞ্চেই বসে তোর মর্মর ধ্বনিতে একনাগাড়ে বলে যাওয়া দুঃখের গাঁথা কান পেতে শুনছি ,আমার সাতকাহন তোদেরকে বলছি,– এটুকুই আমাদের প্রাপ্তি ।
আর জানিস,বন্ধু বেঞ্চ,সখি ঝরাপাতা ,তোদের মতোই ,আমিও অধীর হয়ে বসন্ত পিওনের পদধ্বনি শোনার জন্যে কান পেতে রই গো– কান পেতে রই——