Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » ঘুঁটেপাড়ার সেই ম্যাচ || Narayan Gangopadhyay

ঘুঁটেপাড়ার সেই ম্যাচ || Narayan Gangopadhyay

চোরবাগান টাইগার ক্লাবের সঙ্গে পটলডাঙা থান্ডার ক্লাবের ফুটবল ম্যাচ হয়ে গেল। প্রথমে টাইগার ক্লাব ঝাঁ ঝাঁ করে আমাদের ছটা গোল ঢুকিয়ে দিলে, ওদের সেই ট্যারা ন্যাড়া মিত্তির একাই দিলে পাঁচখানা। আর বাকিটা দিলে আমাদের ব্যাক বলটুদা–সেমসাইডে।

তারপরেই পটলডাঙা থাণ্ডার ক্লাব পর পর ছটা গোল দিয়ে দিলে। টেনিদা দুটো, ক্যাবলা তিনটে, দলের সবচেয়ে ছোট্ট আর বিচ্ছু ছেলে কম্বল দিলে একটা। তখন ভারি একটা গোলমাল বেধে গেল, আর খেলাই হল না– রেফারি ফুঁ করে হুইসিল বাজিয়েখেলা শেষ করে দিলেন।

ব্যাপারটা এই :

আমাদের গোলকিপার পাঁচুগোপাল চশমা পরে। সেদিন ভুল করে ওর পিসিমার চশমা চোখে দিয়ে মাঠে নেমে পড়েছে। তারপরে আর কী- একসঙ্গে তিনদিকে তিনটে বল দেখতে পায়, ডাইনের বলটা ঠেকাতে যায় তো বাঁয়েরটা গোল হয়ে যায়। বলটুদা আবার বুদ্ধি করে একটা ব্যাক পাস করেছিল, তাতে করে একটা সেমসাইড।

এখন হল কী, ছটা গোল দিয়ে টাইগার ক্লাব কী রকম নার্ভাস হয়ে গেল। আনন্দের চোটে ওদের তিনজন খেলোয়াড় অজ্ঞান হয়ে পড়ল, বাকিরা কেবল লাফাতে লাগল, সেই ফাঁকে ছটা বল ফেরত গেল ওদের গোলে। তখন সেই ফুর্তির চোট লাগল থাণ্ডার ক্লাবে–আর কে যে কোন দলে খেলছে খেয়ালই রইল না। টেনিদা বেমক্কা হাবুল সেনকেই ফাউল করে দিলে, আর ন্যাড়া মিত্তির তখন নিজেদের গোলে বল ঢোকাবার জন্যে মরিয়া–থান্ডার ক্লাবের দুজন তাকে জাপটে ধরে মাঠময় গড়াগড়ি খেতে লাগল। ব্যাপার দেখে রেফারি খেলা বন্ধ করে দিলেন, আর কোত্থেকে একটা চোঙা এনে সমানে ভাঙা গলায় চ্যাঁচাতে লাগলেন; ড্র-ড্র-ড্রন গেম এক্ষুনি সব মাঠ থেকে কেটে পড়ো, নইলে পুলিশ ডাকব–হুঁ!

সেদিন সন্ধের পর এই নিয়ে দারুণ আলোচনা চলছিল আমাদের ভেতরে। হঠাৎ টেনিদা বললে, ছোঃ, বারোটা গোল আবার গোল নাকি? একবার একাই আমি বত্রিশটা গোল দিয়েছিলুম একটা ম্যাচে।

অ্যাঁ! চুয়িং গাম চিবুতে চিবুতে ক্যাবলা একটা বিষম খেল।

হাবুল বললে, হ, ফাঁকা গোলপোস্ট পাইলে আমিও বায়ান্নখান গোল দিতে পারি।

–নো স্যার, নো ফাঁকা গোল বিজনেস। দুদলে এ ডিভিসন বি ডিভিসনের কমসে কম বারোজন প্লেয়ার ছিল। যা-তা খেলা তো নয়– ঘুঁটেপাড়া ভার্সাস বিচালিগাম।

–খেলাটি কোথায় হয়েছিল?

ঘুঁটেপাড়ায়। কী পেলে, ইউসেবিয়ো, মুলার নিয়ে লাফালাফি করিস! জীবনে একটা ম্যাচে কখনও বত্রিশটা গোল দিয়েছে তোদের রিভেরা, জেয়ার জিনহো? ববি চার্লটন তো আমার কাছে বেবি রে!

একটা মোক্ষম চাল মারতাছে- বিড়বিড় করে আওড়াল হাবুল সেন।

হাবুলার কপাল ভালো যে টেনিদা সেটা ভালো করে শুনতে পেল না। বললে, কী বললি, মোক্ষদা মাসি? কী করে জানলি রে? ওই মোক্ষদা মাসির বাড়িতেই তো আমি গিয়েছিলুম ঘুঁটেপাড়ায়। সেইখানেই তো সেই দারুণ ম্যাচ। কিন্তু মোক্ষদা মাসির খবর তোকে বললে কে?

আমি জানি– হাবুল পণ্ডিতের মতো হাসল।

ওর ওস্তাদি দেখে আমার রাগ হয়ে গেল। বললুম, বল দেখি ঘুঁটেপাড়া কোথায়?

–ঘুইট্যাপাড়া আর কোথায় হইব? গোবরডাঙার কাছেই। গোবর দিয়াই তো ঘুইট্যা হয়।

ইয়াহ! টেনিদা এত জোরে হাবুলের পিঠ চাপড়ে দিলে যে হাবুল চ্যাঁ করে উঠল। নাকটাকে জিভেগজার মতো উঁচু করে টেনিদা বললে, প্রায় ধরেছিস। তবে ঠিক গোবরডাঙার কাছে নয়, ওখান থেকে দশ মাইল হেঁটে, দুই মাইল দৌড়ে

দৌড়তে হয় কেন?–ক্যাবলা জানতে চাইল।

–হয়, তাই নিয়ম। অত কৈফিয়ত চাসনি বলে দিচ্ছি। ওখানে সবাই দৌড়য়। হল?

ক্যাবলা বললে, হল। আর পথের বিবরণ দরকার নেই, গল্পটা বলল।

গল্প!–টেনিদা মুখটাকে গাজরের হালুয়ার মতো করে বললে, এমন একটা জলজ্যান্ত সত্যি ঘটনা, আর তুই বলছিস গল্প! শিগগির উইথড্র কর–নইলে এক চড়ে তোর নাক

আমি বললুম, নাগপুরে উড়ে যাবে।

ক্যাবলা বললে, বুঝেছি। আচ্ছা আমি উইথড্র করলুম। কিন্তু টেনিদা ইংরেজীতে উচ্চারণ উইথড্র নয়।

আবার পণ্ডিতী! টেনিদা গর্জন করল : টেক কেয়ার ক্যাবলা, ফের যদি বিচ্ছিরি একটা কুরুবকের মতো বকবক করবি তো এক্ষুনি একটা পুঁদিচ্চেরি হয়ে যাবে বলে দিচ্ছি তোকে। যা শিগগির আট আনার ঝাল-মুড়ি কিনে আন– তোর ফাইন!

আলুভাজা-আলুভাজা মুখ করে ক্যাবলা ফাইন আনতে গেল। ওর দুর্গতিতে আমরা কেউ দুঃখিত হলুম না বলাই বাহুল্য। সব কথাতেই ক্যাবলা ওরকম টিকটিকির মত টিকটিক করে।

বুঝলি ঝালমুড়ি চিবুতে চিবুতে টেনিদা বলতে লাগল : ছ দিনের জন্যে তো বেড়াতে গেছি মোক্ষদা মাসির বাড়িতে। মেসোমশাই ব্যবসা করেন আর মাসিমা যা রাঁধেন না, খেলে অজ্ঞান হয়ে যাবি। মাসির রান্না বাটি-চচ্চড়ি একবার খেয়েছিস তো ওখান থেকে নড়তেই চাইবি না–ঘুঁটেপাড়াতেই ঘুঁটের মতো লেপটে থাকবি।

আমার খুব মনের জোর, তাই বাটি-চচ্চড়ি আর ক্ষীরপুলির লোভ কাটিয়েও কলকাতায় ফিরে আসি। সেবারেও গেছি- দুটো দিন একটু ভালোমন্দ খেয়ে আসতে। ভরা শ্রাবণ, থেকে থেকেই ঝুপঝাপ বৃষ্টি। সেদিন সকালে মাসিমা তালের বড়া ভেজে ভেজে তুলছেন। আর আমি একটার-পর-একটা খেয়ে যাচ্ছি, এমন সময় কটা ছেলে এসে হাজির।

অনেকবার তো ঘুঁটেপাড়ায় যাচ্ছি, ওরা সবাই আমায় চেনে। বললে, টেনিবাবু, বড় বিপদে পড়ে আপনার কাছে ছুটে এলুম। আজ বিকেলে শিবতলার মাঠে বিচালিগ্রমের সঙ্গে আমাদের ফুটবল ম্যাচ। ওরা ছজন প্লেয়ার কলকাতা থেকে হায়ার করেছে, আমরাও ছজন এনেছি। কিন্তু মুশকিল হল, আমাদের এখানকার একজন জাঁদরেল খেলোয়াড় হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। আপনাকেই আমাদের উদ্ধার করতে হচ্ছে দাদা।

জানিস তো, লোকের বিপদে আমার হৃদয় কেমন গলে যায়। তবু একটু কায়দা করে বললুম, সব হায়ার করা ভালোভালো প্লেয়ার, ওদের সঙ্গে কি আর আমি খেলতে পারব? তা ছাড়া এবছরে তেমন ফর্ম নেই আমার। ওরা তো শুনে হেসেই অস্থির।

কী যে বলেন স্যার, আপনি পটলডাঙার টেনিরাম শর্মা- আপনার ফর্ম তো সব কাজে সব সময়েই থাকে। প্রেমেন মিত্তিরের ঘনাদা, হেমেন্দ্রকুমারের জয়ন্ত, শিব্রামের হর্ষবর্ধন–এদের ফর্ম কখনও পড়তে দেখেছেন?

আমি হাতজোড় করে প্রণাম করে বললুম, ঘনাদা, জয়ন্ত, হর্ষবর্ধনের কথা বললেন–ওঁরা দেবতা– আমি তো স্রেফ নস্যি। ওঁরা যদি গরুড় পাখি হন, আমি স্রেফ চড়ুই।

ওরা বললে, অত বুঝিনে দাদা, আপনাকে ছাড়ছিনে। আমাদের ধারণা, মোহনবাগান ইস্টবেঙ্গল তো তুচ্ছ– আপনি ইচ্ছা করলে বিশ্ব একাদশে খেলতে পারেন। আর আপনি যদি চড়ুই পাখি হন, আমরা তো তা হলে–কী বলে, মশা।

আমি বললুম, ঘুঁটেপাড়ার মশাকে তুচ্ছ করবেন না মশাই, এক-একটা প্রায় এক ইঞ্চি লম্বা।

ওরা হেঁ-হেঁ করে চলে গেল, কিন্তু আমাকে রাজি করিয়েও গেল। আমার ভীষণ ভাবনা হল রে। থান্ডার ক্লাবে যা খেলি– তা খেলি, কিন্তু অতগুলো এ-ডিভিসন বি-ডিভিসন খেলোয়াড়ের সামনে! ওরা না হয় আপ করে গেল, কিন্তু আমি দাঁড়াব কী করে?

কিন্তু ফিরিয়েও তো দেওয়া যায় না। আমার নিজের প্রেস্টিজ-পটলডাঙার প্রেস্টিজ সব বিপন্ন! কোন্ দেবতাকে ডাকি ভাবতে-ভাবতে হঠাৎ মা নেংটীশ্বরীকে মনে পড়ে গেল। আরে সেই নেংটীশ্বরী- আরে সেই যে রে-কম্বল নিরুদ্দেশ-এর ব্যাপারে যে-দেবতাটির সঙ্গে আমাদের দেখা হয়ে গিয়েছিল। মনে-মনে বলতে লাগলুম, এ-বিপদে তুমিই দয়া করো মা–গোটা কয়েক নেংটি ইঁদুর পাঠিয়ে দাও তোমার–খেলার সময় ওদের পায়ে কুটুরকুটুর করে কামড়ে দিক। নিদেনপক্ষে পাঠাও সেই অবকাশরঞ্জিনী বাদুড়কে– সে ওদের সকলের চাঁদি ঠুকরে বেড়াক।

এসব প্রার্থনা-ট্রার্থনা করে শ-দেড়েক তালের বড়া খেয়ে আবার বেশ একটা তেজ এসে গেল। কেবল মনে হতে লাগল, আজ একটা এসপার-ওসপার হয়ে যাবে। তখন কি জানি, গুনে-গুনে বত্রিশটা গোল দিতে পারব, আমি একাই?

বিকেলে আকাশ জুড়ে কালো কালো হাতির পালের মতো মেঘ। মনে হল, দুর্দান্ত বৃষ্টি নামবে। তবু মাঠে গিয়ে দেখি বিস্তর লোক জড়ো হয়ে গেছে। এক দল হাঁকছে : বিচালিগ্রাম হিপ হিপ হুররে আর এক দল সমানে উত্তর চড়াচ্ছে : ঘুঁটেপাড়া হ্যাপ-হ্যাপ-হ্যাররে।

ক্যাবলা হঠাৎ আঁতকে উঠল–হ্যাপ-হ্যাপ-হ্যাররে মানে কী? কখনও তো শুনিনি।

-ওটা ঘুঁটেপাড়ার নিজস্ব স্লোগান। ওরা হিপ-হিপ বলছে কিনা, তাই পালটা জবাব। ওরাও যদি হিপ-হিপ করে, তা হলে এরা বলবে না, এদের নকল করছে? ওরা যদি বলত বিচালিগ্রাম জিন্দাবাদ–এরা সঙ্গে সঙ্গে বলত ঘুঁটেপাড়া মুর্দাবাদ।

–হ্যাঁ, মুর্দাবাদ! নিজেদেরই?

হ্যাঁ, নিজেদেরই। পরের নকল করে অপমান হওয়ার চাইতে মরে যাওয়া ভালো বুঝলি না?

-বিলক্ষণ! আচ্ছা বলে যাও।

–এতেই বুঝতে পারছিস, দুটো গ্রামে রেষারেষি কী রকম। দারুণ চিৎকারের মধ্যে তো খেলা শুরু হল। দু-মিনিটের মধ্যেই বুঝতে পারলুম, বিচালিগ্রামকে এঁটে ওঠা অসম্ভব। এরা ছজনেই এ-ডিভিশনের প্লেয়ার এনেছে–খেলায় তাদের আগুন ছোটে। আর ওদের গোলকিপার! সে একবারে ছহাত লাফিয়ে ওঠে, তার লম্বা লম্বা হাত বাড়িয়ে বল তো বল, বন্দুকের গুলি অব্দি পাকড়ে নিতে পারে।

ঘুঁটেপাড়ায় মাত্র দুজন এ-ডিভিশনের, বাকি চারজনই বি-ডিভিশনের। এ-মার্কা দুজনও ওদের তুলনায় নিরেস। খেলা শুরু হতে না হতেই বল এসে একেবারে ঘুঁটেপাড়ার ব্যাক লাইনে চেপে পড়ল, মাঝ-মাঠও আর পেরোয় না। আর ওদের গোলকিপার শুনিয়ে-শুনিয়ে বলতে লাগল : একটা বালিশ আর শতরঞ্চি দাও হে– একটু ঘুমিয়ে নেব।

আমি আর কী করব- মিডফিলডে দাঁড়িয়ে আছি, দাঁড়িয়েই আছি। নিতান্তই ঘুঁটেপাড়ার বাকি দশজনই ডিফেন্স লাইনে দাঁড়িয়ে আছে তাই গোল হচ্ছে না কিন্তু দেখতে-দেখতে ওরা গোটা পাঁচেক কর্নার কিক পেয়ে গেল। আর কতক্ষণ ঠেকাবে।

আমি তখনও মা নেংটিশ্বরীকে ডাকছি তো ডাকছিই। এমন সময় আকাশ ভেঙে ঝমঝম বৃষ্টি। এমন বৃষ্টি যে চারদিক অন্ধকার। কিন্তু পাড়াগেঁয়ে লোক, আর কলকাত্তাই খেলোয়াড়ের গোঁ-খেলা দাপটে চলতে লাগল। বল জলে ভাসছে- ধপাধপ আছাড়–এই ফাঁকেও পর-পর দুখানা গোল খেয়ে গেল ঘুঁটেপাড়া। ভাবলুম-যাঃ, হয়ে গেল।

বিচালিগ্রাম তারস্বরে চিৎকার করছে, হঠাৎ এদিকের লাইন্সম্যান ফ্ল্যাগ ফেলে মাঠে ঝাঁপিয়ে পড়ল। বললে, শিবতলার পুকুরে ভেসেছে রে– মাঠ ভর্তি মাছ!

অ্যাঁ-মাছ!

দেখতে দেখতে যেন ম্যাজিক। গাঁয়ের লোকে বর্ষায় পুকুর-ভাসা মাছ তো ধরেই, কলকাতার ছেলেগুলোও আনন্দে কেঁপে গেল। রইল খেলা, রইল বিচালিগ্রাম আর ঘুঁটেপাড়ার কম্পিটিশন– তিনশো লোক আর একুশজন খেলোয়াড়, দুজন লাইন্সম্যান সবাই কপাকপ মাছ ধরতে লেগে গেল। প্লেয়াররা জার্সি খুলে ফেলে তাতেই টকাটক মাছ তুলতে লাগল। খেলতে আর বয়ে গেছে তাদের।

এই রে, মস্ত একটা শোলমাছ পাকড়েছি।

আরে–একটা বাটামাছের ঝাঁক যাচ্ছে রে।

ইস–কী বড় বড় কই মাইরি। ধরধর

সে যে একখানা কী কাণ্ড, তোদের আর কী বলব। খেলার মাঠ ছেড়ে ক্রমেই দূরে-দূরে ছড়িয়ে পড়তে লাগল সবাই। শেষে দেখি, মাঠে আমরা দুজন। আমি আর রেফারি।

রেফারি ওখানকার স্কুলের ড্রিল-মাস্টার। বেজায় মারকুটে, ভীষণ রাগী। দাঁত খিঁচিয়ে বললেন, হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছো কী? ইয়ু গো অন প্লেয়িং।

ঘাবড়ে গিয়ে বললুম, আমি একাই খেলব?

ইয়েস– একাই খেলবে। আমি তো খেলা বন্ধ করিনি।–ধমক দিয়ে রেফারি বললেন, খেলো। প্লেয়াররা মাঠ ছেড়ে মাছ ধরতে দৌড়লে খেলা বন্ধ করে দিতে হবে, রেফারিগিরির বইতে এমন কোনও আইন নেই।

তখন শুরু হল আমার গোল দেবার পালা। একবার করে বল নিয়ে গিয়ে গোল দিয়ে আসি, আর রেফারি ফুরর করে বাঁশি বাজিয়ে আবার সেন্টারে নিয়ে আসে। এই-ই চলতে লাগল।

ওদের দু-একজন বোধহয় টের পেয়ে ফেরবার কথা ভাবছিল, এমন সময় মা নেংটীশ্বরীর আর-এক দয়া। মাঠের কাছেই ছিল সারে সারে তালগাছ। হঠাৎ হু-হু করে ঝোড়ো হাওয়া, আর ঝপাসঝপাস করে পাকা তাল পড়তে লাগল।

তাল পড়ছে– তাল পড়ছে—

যারা ফিরতে যাচ্ছিল, তারা প্রাণপণে ছুটল তাল কুড়োতে।

এর মধ্যে আমি যা গোল দেবার দিয়েছি– মানে গুনে-গুনে বত্রিশটি। আমি গুনছি না, গোল দিতে দিতে আমার মাথা বোঁ-বোঁ করছে, আর ওই ভারি ভেজা বল বারবার সেন্টার থেকে জলের ওপর দিয়ে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছি–চাড্ডিখানা কথা নাকি! একবার বলেছিলুম, অনেক তো গোল দিয়েছি স্যার, আর পারছি না–পা ব্যথা করছে। রেফারি আমায় তেড়ে মারতে এলেন, বিকট মুখ ভেংচে বললেন, ইয়ু গো অন গোলিং–আই সে।

গোলিং আবার ইংরেজী হয় নাকি ক্যাবলা বলতে যাচ্ছিল, টেনিদা একটা বাঘা ধমক দিয়ে বললে, ইয়ু শাটু আপ! যে মারকুটে মাস্টার, তার ইংরেজীর ভুল ধরবে কে? আমি গোল দিচ্ছি আর উনি গুনেই যাচ্ছেন, থার্টি–থার্টিওয়ান-থার্টিটু।

ওরে গোল দিচ্ছে বুঝি– বলে ওদের সেই গোলকিপারটা দৌড়ে এল। সে যে রকম জাঁদরেল, হয়তো একাই বত্রিশটা গোল ফেরত দিত, আমি আটকাতে পারতুম না– বেদম হয়ে গেছি তখন। কিন্তু রেফারি তক্ষুনি ফাইন্যাল হুইসেল বাজিয়ে দিলেন। দিয়ে বললেন, খেলা ফিনিশ। তারপর আমাকে বললেন, এখন যাও কই মাছ ধরো গে, তাল কুড়োও গে।

কিন্তু তখন কি আর মাছ, তাল কিছু আছে? খেলা ফিনিশের সঙ্গে তাও ফিনিশ। অতগুলো লোক!

টেনিদা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল : তখন প্রাণের আনন্দে মাছ ধরে আর তাল কুড়িয়ে বিচালিগ্রাম চিল্লোতে লাগল : থ্রি চিয়ার্স ফর বিচালিগ্রাম, আর ঘুঁটেপাড়া চ্যাঁচাতে লাগল : থ্রি টিয়ার্স ফর ঘুঁটেপাড়া!

টিয়ার্স? মানে চোখের জল?-ক্যাবলা আবার বিস্মিত হল। হ্যাঁ–টিয়ার্স। পালটা জবাব দিতে হবে না? সে যাক। কিন্তু একটা ম্যাচে একাই বত্রিশটা গোল দিলুম, পেলে-ইউসেবিয়ো-রিভেরা-চার্লটন কাত করে দিলুম, কিন্তু একটা কই মাছ, একটা তালও পেলুম না–এ-দুঃখ মরলেও আমার যাবে না রে। –আবার বুকভাঙা দীর্ঘশ্বাস ফেলল টেনিদা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress