ডাক্তার সুরেশ রক্ষিত
ডাক্তার সুরেশ রক্ষিত বলিলেন, ‘আপনাকে একবার যেতেই হবে, ব্যোমকেশবাবু। রোগীর যেরকম অবস্থা, আপনি গিয়ে আশ্বাস না দিলে বাঁচানো শক্ত হবে।’
ডাক্তার সুরেশ রক্ষিতের বয়স চল্লিশের আশেপাশে, একটু রোগা শুষ্ক গোছের চেহারা, দামী এবং নূতন বিলাতি পোশাক তাঁহার গায়ে যেন মানায় নাই। কিন্তু ভাবভঙ্গী বেশ চটপটে এবং বুদ্ধিমানের মত। আজ সকালে তিনি ব্যোমকেশের সঙ্গে দেখা করিতে আসিয়াছেন এবং এক বিচিত্র প্রস্তাব করিয়াছেন।
বলা বাহুল্য, ব্যোমকেশের রোগী দেখিতে যাইবার ইচ্ছা নাই। সে অর্ধ-নিমীলিত নেত্ৰে ডাক্তার রক্ষিতের দিকে চাহিয়া বলিল, ‘রোগটা কী?’
ডাক্তার বলিলেন, ‘প্যারালিসিস–মানে পক্ষাঘাত। প্ৰায় তিন মাস আগে অ্যাটাক হয়েছিল। প্রথম ধাক্কাটা সামলে গেছেন, কিন্তু রক্তচাপ খুব বেশি। মাথাটা অবশ্য পরিষ্কার আছে। আমাকে পাঠালেন, আপনি যদি দয়া করে একবার আসেন। মনে ভরসা পেলে হয়তো বেঁচে যেতে পারেন।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘আপনি চিকিৎসা করছেন?’
ডাক্তার বলিলেন, ‘আজ্ঞে হ্যাঁ। আমি তাঁর বাড়ির একতলার ভাড়াটে। এবং গৃহ-চিকিৎসকও। লোকটি মহা ধনী, সুদের কারবার করেন। বিশু পালের নাম হয়তো আপনারা শুনে থাকবেন।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘কি নাম বললেন–শিশুপাল?’
ডাক্তার হাসিলেন, ‘বিশু পাল। তবে কেউ কেউ শিশুপালও বলে। কেন বলে জানি না, লোকটি সুদখোঁর মহাজন বটে। কিন্তু অর্থ-পিশাচ নয়। বিশেষত গত তিন মোস শয্যাশায়ী থেকে একেবারেই অসহায় হয়ে পড়েছেন।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘কিন্তু আমি কি করতে পারি? আমি তো আর ডাক্তার নই।’
ডাক্তার কহিলেন, ‘তবে আসল কথা বলি। বিশু পালের এক খাতক আছে, নাম অভয় ঘোষাল। লোকটা ভয়ঙ্কর পাজি। বিপদে পড়ে বিশু পালের কাছ থেকে অনেক টাকা ধার নিয়েছিল, এখন আর শোধ দিচ্ছে না। বিশু পাল জোর তাগাদা লাগিয়েছিলেন, তাইতে অভয় ঘোষাল নাকি ভয় দেখিয়েছে, টাকা চাইলে তাঁকে খুন করবে। তারপরই বিশু পালের ষ্ট্রোক হয়, সেই থেকে তিন মাস বিছানায় পড়ে আছেন। অবশ্য প্রাণের আশঙ্কা নেই, সাবধানে চিকিৎসা করলে হয়তো আবার চলে ফিরে বেড়াতে পারবেন। কিন্তু আসল কথা তা নয়, ওঁর প্রাণে ভয় ঢুকেছে। অভয় ঘোষাল ওঁকে খুন করবেই, তিনি যদি টাকা ছেড়েও দেন তবু খুন করবে।–আপনাকে চিকিৎসা করতে হবে না, বিশু পালের ইচ্ছে আপনার কাছে তাঁর হৃদয়-ভার লাঘব করেন; আপনি যদি কিছু উপদেশ দেন তাও তাঁর কাজে লাগতে পারে।’
ব্যোমকেশ একটু বিমনা থাকিয়া বলিল, ‘কেউ যদি শিশুপাল বধের জন্য বদ্ধপরিকর হয়ে থাকে তাকে ঠেকিয়ে রাখা শিবের অসাধ্য। যাহোক, ভদ্রলোক যখন আমার সঙ্গলাভের জন্যে এত ব্যাকুল হয়েছেন তখন আমি যাব। ইহলোকেই হোক আর পরলোকেই হোক, মহাজনদের হাতে রাখা ভালো। কি বল, অজিত?’
আমি বলিলাম, তা তো বটেই।’
ডাক্তার রক্ষিত উঠিয়া দাঁড়াইলেন, হাসিমুখে বলিলেন, ‘ধন্যবাদ। এই নিন আমাদের ঠিকানা। কখন আসবেন? তিনি একটি কার্ড বাহির করিয়া ব্যোমকেশের হাতে দিলেন।
ব্যোমকেশ কার্ডটি দেখিয়া আমার দিকে বাড়াইয়া দিল। দেখিলাম বিশু পালের বাসস্থান বেশি। দূর নয়, আমহার্স্ট স্ত্রীটের একটা গলির মধ্যে। ব্যোমকেশ বলিল, ‘আজ বিকেলবেলা পাঁচটা নাগাদ যাব।–আচ্ছা, আসুন।’
ডাক্তার প্রস্থান করিলে ব্যোমকেশ হাসিতে হাসিতে বলিল, ‘পক্ষাঘাতগ্রস্ত রুগীকে সান্ত্রনা দেবার কাজ আমার এই প্রথম।’