অর্থমনর্থম্ ১
স্নানাহারের জন্য উঠি-উঠি করিতেছিলাম, বেলা সাড়ে দশটা বাজিয়া গিয়াছিল-এমন সময় পাশের ঘরে টেলিফোনের ঘন্টি বাজিয়া উঠিল। ব্যোমকেশ উঠিয়া গিয়া ফোন ধরিল
শুনিতে পাইলাম, সে বলিতেছে, ‘হ্যালো, কে আপনি? বিধুবাবু? ও..নমস্কার! নমস্কার! কি খবর? অ্যাঁ। বলেন কি?..আমায় যেতে হবে? তা বেশ ..কত নম্বর?….ও আচ্ছা…আধঘন্টার মধ্যেই গিয়ে পৌছুব…’
পাঞ্জাবির বোতাম লাগাইতে লাগাইতে ব্যোমকেশ ঘর হইতে বাহির হইয়া আসিল, বলিল, ‘চল হে, একটু ঘুরে আসা যাক। একটা খুন হয়ে গেছে, বিধুবাবু স্মরণ করেছেন।’
আমি দাঁড়াইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘কোন বিধুবাবু? ডেপুটি কমিশনার?’
ব্যোমকেশ হাসিয়া বলিল, ‘হ্যাঁ-তিনিই। আমার ওপর এত দয়া কেন হল, বুঝতে পারছি না। নিজের ইচ্ছায় যে ডাকেন নি, তা তাঁর কথার ভাবেই বোঝা গেল। বোধহয় ওপর থেকে হুড়ো এসেছে।’
পুলিশের ডেপুটি কমিশনার বিধুবাবুর সঙ্গে কাজের সুত্রে আমাদের আলাপ হইয়াছিল। তিনি বেশ মুরুব্বিগোছের লোক ছিলেন, দেখা হলেই প্রাম্ভারিকভাবে ব্যোমকেশকে অনেক সদুপদেশ দিতেন; ব্যোমকেশ যে বুদ্ধি ও কর্মদক্ষতায় তাঁহার অপেক্ষা সর্বাংশে ছোট, এই কথাটি ঘুরাইয়া ফিরাইয়া নানাভাবে প্রকাশ করিবার চেষ্টা করিতেন। ব্যোমকেশ অত্যন্ত বিনীতভাবে তাঁহার লেকচার শুনিত ও মনে মনে হাসিত। বিধুবাবু নিজের গুণ গরিমার বর্ণনা করিতে করিতে অনেক সময় পুশিসের অনেক গুঢ় খবর প্রকাশ করিয়া ফেলিতেন। তাই,পুলিস-সংক্রান্ত কোনও খবর প্রয়োজন হইলেই ব্যোমকেশ তাঁহার সমীপে উপস্থিত হইয়া একদফা লেকচার শুনিয়া আসিত। যৌবনকালে বোধ করি বিধুবাবু একেবারে নির্বোধ ছিলেন না; বিশেষত এই বয়স পর্যন্ত তাঁহার অসাধারণ ধৈর্য ও কর্মোৎসাহ ছিল। কিন্তু পুলিস-আইনের কলে পড়িয়া তাঁহার বুদ্ধিটা যন্ত্রবৎ হইয়া পড়িয়াছিল। সহকর্মীরা আড়ালে তাঁহাকে ‘বুদ্ধুবাবু ’ বলিয়া ডাকিত।
যা হোক, তাড়াতাড়ি কিছু জলযোগ করিয়া লইয়া আমরা দু’জনে বাহির হইলাম। বাসে যথাস্থানে পৌছিতে মিনিট কুড়ি সময় লাগিল। স্থানটা শহরের উত্তরাংশে, ভদ্র বাঙ্গালী পল্লীর কেন্দ্রস্থল। নম্বর খুঁজিতে খুঁজিতে চোখে পড়িল, একটি বাড়ির দরজায় দুইজন লালপাগড়ি দাঁড়াইয়া সতর্কভাবে গোঁফে চাড়া দিতেছে; বুঝিলাম, এই বাড়িটাই ঘটনাস্থল।
ব্যোমকেশের নাম শুনিয়া কনেস্টবলদ্বয় পথ ছাড়িয়া দিল; আমরা প্রবেশ করিলাম। বাহির হইতে দেখিলে দোতলা বাড়িটা ছোট বলিয়া মনে হয়, কিন্তু ভিতরে বেশ সুপ্রসর, অবস্থাপন্ন লোকের বাড়ি বলিয়া মনে হয়। বাড়িতে প্রবেশ করিয়াই সম্মুখের খোলা দালানে বড় বড় টবে বাহারে তালগাছ সাজানো রহিয়াছে চোখে পড়িল। একটা প্রকান্ড কাচের পাত্রে লাল মাছ খেলা করিতেছে। দালানের তিন ধারে বারান্দাযুক্ত কয়েকটি ঘর। প্রবেশদ্বারের সম্মুখে দালানের অপর প্রান্তে উপরে উঠিবার দু’মুখো সিঁড়ি। ডানধারের একটা ঘরে অনেক লোক গিসগিস করিতেছে দেখিয়া আমরা সেই দিকেই গেলাম। দেখিলাম, ঘরের মধ্যস্থলে টেবিলের সম্মুখে স্থুলকায় পক্কগুম্ফ বিধুবাবু ভ্রু কুঞ্চিত করিয়া বসিয়া আছেন; বাড়ির চাকরের এজেহার হইয়া গিয়াছে—বামুনের এজেহার হইতেছে। লোকটা কাঁদো-কাঁদো মুখে জোড়-হস্তে দাঁড়াইয়া বিধুবাবুর কড়া কড়া প্রশ্নের জবাব দিতেছে ও ধমক খাইয়া চমকাইয়া চমকাইয়া উঠিতেছে। কয়েকজন নিম্নতন পুলিস-কর্মচারী চারিদিক ঘিরিয়া দাঁড়াইয়া আছে।
আমাদের দেখিয়া বিধুবাবুর মুখ আরও অপ্রসন্ন হইয়া উঠিল। তিনি বলিলেন, ‘আপনারা এসেছেন, বসুন। বিশেষ কিছু নয় –একটা খুন হয়েছে, সামন্য ব্যাপার। কে আসামী, তাও পরিষ্কার বোঝা যাচেছ। ওয়ারেন্টও ইসু করিয়ে দিয়েছি। কিন্তু কর্তার হুকুম হল আপনাকে ডাকতে—তাই –’ বিধুবাবু সজোরে গলাঝাড়া দিয়া বলিলেন, ‘কর্তার ইচ্ছায় কর্ম—আপনিও দেখুন,যদিও দেখবার কিছুই নেই।’
কৈতববাদের অপার মহিমা; দেবতা একটু প্রসন্ন হইলেন, বলিলেন, ‘এ বাড়ির কর্তা করালীবাবু গতরাত্রে ঘুমন্ত অবস্থায় খুন হয়েছেন। মৃত্যুর ধরনটা একটু নুতন গোছের, তাই সাহেবে একেবারে ঘাবড়ে গেছেন। কিন্তু আসলে ব্যাপার খুব সহজ—করালীবাবুর এক ভাগনে—মতিলাল , সে-ই এ কাজ করেছে; আর করেই ফেরার হয়েছে।’
ব্যোমকেশ বিনীতভাবে বলিল, ‘গোড়া থেকেই সমস্ত কথা না বললে আমার মত লোকের বুঝে ওঠা সম্ভব নয়। দয়া করে একটু খোলসাভাবে বলবেন কি?’
বিধুবাবুর মুখের মেঘ সম্পূর্ণ কাটিয়া গেল, তিনি একটু প্রাম্ভারি হাস্য করিয়া বলিলেন, ‘একটু বসুন। এই লোকটির এজেহার শেষ করে নিই, তারপর সব কথা আপনাকে বুঝিয়ে বলব।’
পাচক ব্রাহ্মণটা তখনও দাঁড়াইয়া কাঁপিতেছিল, বিধুবাবু তাহাকে প্রচণ্ড এক ধমক দিয়া বলিলেন, ‘সাবধান হয়ে বুঝে-সমঝে কথা বলবে। মিথ্যে কথা একটি বলেছ কি সঙ্গে সঙ্গে হাতে হাতকড়া—বুঝলে?
বামুনঠাকুর শীর্ণকণ্ঠে বলিল, ‘আজ্ঞে।’
বিধুবাবু তখন অসমাপ্ত জেরা আরম্ভ করিলেন, ‘কাল রাত্রে তুমি মতিলালবাবুকে কখন বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে দেখেছিলে?’
‘আজ্ঞে, ঘড়ি তো দেখিনি—বোধহয়, একটা দুটো হবে।’
‘ঠিক করে বল, একটা না দুটো?’
‘আজ্ঞে, বারোটা একটা হবে।’
বিধুবাবু হুমকি দিয়া উঠিলেন, ‘আবার পাঁচরকম কথা! ঠিক বল, বারোটা, না একটা, না দুটো?’
পাচক একটা ঢোক গিলিয়া বলিল, ‘আজ্ঞে, বারোটা।’
দারোগা ক্ষিপ্রহস্তে জবানবন্দী লিখিয়া লইতে লাগিল।
‘তিনি চোরের মত পা টিপে টিপে বেরিয়ে গেলেন?’
‘আজ্ঞে, হ্যাঁ—তিনি প্রায় রোজ রাত্তিরেই বাড়ি থাকেন না।’
‘আবার বাজে কথা! যা জিজ্ঞেস করছি, তার উত্তর দাও। মতিলালবাবুকে তুমি উপর থেকে নেমে আসতে দেখেছিলে?’
‘আজ্ঞে না হুজুর। তিনি যখন সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে যান, তখন দেখেছিলুম।’
‘উপর থেকে নামতে দেখনি! তুমি তখন কোথায় ছিলে?’
‘আজ্ঞে আমি—আজ্ঞে আমি—’
‘সত্যি বল, তুমি তখন কোথায় ছিলে?’
পাচক ভয়-কম্পিত স্বরে জড়াইয়া জড়াইয়া বলিল, ‘আজ্ঞে ধর্মাবতার, আমার দেশের লোকেরা এ বাড়ির সামনে মেছ করে থাকে—তাই রাতের কাজকর্ম শেষ হলে তাদের আড্ডায় গিয়ে একটু বসি।’
‘ওঃ—তুমি তখন আড্ডায় বসে গাঁজায় দম দিচ্ছিলে!’
‘আজ্ঞে—’
‘সদর দরজা তাহলে খোলা ছিল?’
ভয়ে পাচকটা শুকাইয়া গিয়াছিল, অস্ফুট কণ্ঠে বলিল, ‘আজ্ঞে হ্যাঁ—’
বিধুবাবু কিছুক্ষণ ভ্রুকুটি করিয়া থাকিয়া বলিলেন, হুঁ। তাহলে রাত্রে বাড়িতে কারা আসা—যাওয়া করেছিল, তুমি আড্ডায় বসে বসে দেখেছিলে?’
‘আজ্ঞে, আর কেউ বাড়ি থেকে বাড়ি থেকে বেরোননি।’
‘হুঁ। তুমি কখন বাড়ি ফিরলে?’
‘আজ্ঞে, মতিলালবাবু চলে যাবার আধঘণ্টা পরেই আমি বাড়িতে এসে দরজা বন্ধ করে দিলুম। সুকুমারবাবু তার আগেই ফিরে এসেছিলেন।’
‘অ্যা! সুকুমারবাবু আবার কোথা থেকে ফিরে এসেছিলেন?’
‘তা জানি না হুজুর।’
‘তিনি কখন ফিরেছিলেন?’
‘মতিবাবু বেরিয়ে যাবার কুড়ি-পঁচিশ মিনিট পরে।’
বিধুবাবুর ভ্রুকুটি গভীরতর হইল। তিনি কিছুক্ষণ চিন্তা করিলেন, তারপর বলিলেন, ‘তুমি এখন যেতে পার। দরকার হলে আবার তোমার এজেহার হবে।’
পাচকঠাকুর ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিয়া পলায়ন করিল। বিধুবাবু তখন ঘর হইতে অনক্য পুলিস—কর্মচারীদের সরিয়া যাইতে বলিলেন। ঘরে কেবল আমি আর ব্যোমকেশ রহিলাম। বিধুবাবু আমাদের দিকে ফিরিয়া বলিলেন, ‘দেখলেন তো, একজনকে জেরা করেই সব কথা বেরিয়ে পড়ল। ভাল করে জেরা করতে জানলে—যা হোক, আপনাকে গোড়া থেকে না বোঝালে আপনি বুঝতে পারবেন না। বাড়ির সকলের জবানবন্দী নিয়ে যেসব কথা জানা গেছে, তােই মোটামুটি আপনাকে বলছি—মন দিয়ে শুনুন।’
ব্যোমকেশ মাথা হেট করিয়া নীরবে কথা শুনিতে লাগিল। বিধুবাবু বলিতে আরম্ভ করিলেন, ‘এই বাড়ির যিনি কর্তা ছিলেন, তার নাম করালীবাবু। তিনি বিপত্নীক ও নিঃসন্তান ছিলেন। বেশ অবস্থাপন্ন লোক, কলকাতায় চার-পাঁচখানা বাড়ি আছে, তা ছাড়া ব্যাঙ্কেও দু‘তিন লাখ টাকা জমা আছে।
‘স্ত্রী-পুত্র না থাকলেও তাঁর পুষ্যির অভাব নেই। তিনটি ভাগনে—মতিলাল, মাখনলাল আর ফণিভূষণ এবং শ্যালীর দুটি ছেলে-মেয়ে—সবসুদ্ধ এই পাঁচটি লোককে করালীবাবু প্রতিপালন করতেন। তারা সবাই এই বাড়িতে থাকে। তাদের তিন কুলে কেউ নেই।
‘যতদুর জানা যায়, করালীবাবু ভয়ঙ্কর ক্ষপিশ মেজাজের লোক ছিলেন। বাতব্যাধিতে পঙ্গু ছিলেন, বয়সও ষাট-বাষট্টি হয়েছিল—তাই নিজের ঘর থেকে বড় একটা বেরুতেন না। কিন্তু বাড়িসুদ্ধ লোক তাঁকে বাঘের মতন ভয় করত। তাঁর এক অদ্ভুদ পাগলামি ছিল—তিনি কেবলই নিজের উইল তৈরি করতেন। তাঁর তিনখানা উইল দেরাজ থেকে বেরিয়েছে। প্রথমটায় তিনি মাখনকে ওয়ারিস করে যান, দ্বিতীয়টায় ওয়ারিস মতিলাল, এবং সবশেষটায় তাঁর সমস্ত সম্পত্তি সুকুমারকে দিয়ে গেছেন। শেষ উইলটা তৈরি হয়েছে—পরশু। সুকুমারই এখন তাঁর ওয়ারিস।
‘করালীবাবু থেকে থেকে উইল বদলাবার কারণ ছিল এই যে, যখন যার ওপর তিনি চটতেন, তখনই তাকে উইল থেকে খারিজ করে দিতেন।
‘এই উইলের ব্যাপার নিয়ে কাল দুপুরবেলা মতিলালের সঙ্গে করালীবাবুর খুব একচোট ঝগড়া হয়ে যায়। মতিলালের শরীরে অনেক দোষ আছে—সে তাঁকে ‘ঘাটের মড়া’ ‘বাহাত্তুরে বুড়ো’ ইত্যাদি গালাগাল দিয়ে চলে আসে।
‘তারপর রাত্রি প্রায় বারোটার সময় মতিলাল চুপিচুপি বাড়ি থেকে পালায়—বামুন এবং চাকর দু’জনেই তাকে পালাতে দেখেছে। আজ সকালবেলা দেখা গেল, করালীবাবু তাঁর বিছানায় মরে পড়ে আছে।
‘কি করে মৃত্যু হল, প্রথমটা কেউ বুঝতে পারেনি। আমি এসে বার করলুম—তাঁর ঘাড়ে, ঠিক মেডালা আর ফার্স্ট ভার্টিরা‘র মাঝখানে একটা ছুঁচ আমুল ফুটিয়ে দিয়ে তাঁকে খুন করা হয়েছে।’
বিধুবাবু চুপ করিলে ব্যোমকেশ মুখ তুলিল, ‘ভারি আশ্চর্য ব্যাপার তো! মেডালা আর ফার্স্ট সার্ভিক্ল ভার্টিব্রা‘র সন্ধিস্থলে ছুঁচ ফুটিয়ে খুন করেছে, এ যে একেবারে Bride of Lammermoor!’ কিছুক্ষণ চিন্তা করিয়া বলিল, ‘মতিলালের নামে ওয়ারেন্ট বার করে দিয়েছেন? লোকটা কাজকর্ম কিছু করে কি না, খবর পাওয়া গেছে কি?’
বিধুবাবু বলিলেন, ‘কিছু না—কিছু না! থার্ড ক্লাস অবধি বিদ্যে, ঘোর বয়াটে। মামার অন্ন মারত, আর বেলেল্রাগিরি করে বেড়াত।’
ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল, ‘আর মাখনলাল?’
‘তিনিও প্রায় দাদার মত, তবে অতটা নয়। কোকেন, গাঁজা-টাজা খায় বটে, কিন্তু দাদার মত এখনও নাম-কাটা সেপাই হয়ে ওঠেনি।’
‘আর ফণিভূষণ?’
‘তিনি আবার খোঁড়া। কথায় বলে—কানা খোঁড়া এক গুণ বাড়া, কিন্তু এ ছোড়া বোধহয় অতটা খারাপ নয়। তার কারণ, খোঁড়া বলে বাড়ি থেকে বেরুতে পারে না। তিন ভাইয়ের মধ্যে এই ফণিভূষণই একটু মানুষের মতন বোধ হল।’
‘আর সুকুমার?’
‘সুকুমার বেশ ভাল ছেলে, মেডিক্যাল কলেজের ফিফথ ইয়ারে পড়ে। তার বোন সত্যবতীও কলেজে পড়ে। এরা দুই ভাই-বোনে বুড়োর যা কিছু সেবা-শুশ্রুষা করত।’
‘এরা সকলেই বোধহয় অবিবাহিত?’
‘হ্যা—মেয়েটিও।’