ব্ল্যাকমেল ডট কম
ব্যাপারটা শুরু হয়েছিল মোবাইল ফোনের একটা ক্রস কানেকশন থেকে। তা না হলে কোনওদিনই কিছু জানা যেত না। আর ক্যালকাটা পুলিশের নাকের ডগায় এরকম একটা মারাত্মক ক্রাইম চলতেই থাকত।
অফিসে আমার চেম্বারে বসে কম্পিউটারের কীর্বোডে আঙুল চালাচ্ছিলাম। গত দশ বছরে কলকাতার নানান ধরনের ক্রাইম কী হারে বেড়েছে তার একটা তুলনামূলক গ্রাফিক্স তৈরি করছিলাম। হঠাৎই কাচের দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকল অরিন। অরিনকে বেশ উত্তেজিত দেখাচ্ছিল।
স্যার, একটা ইন্টারেস্টিং ইনফরমেশান আছে।
আমি কম্পিউটার ছেড়ে অরিনের দিকে তাকালাম। শরীরের মোচড়ে রিভলভিং চেয়ারটাকে ঘুরিয়ে অরিনের মুখোমুখি হলাম।
কী ইনফরমেশান? ইশারায় অরিনকে বসতে বললাম।
অরিন বসল। তারপর বলল, আজ সকাল নটা নাগাদ আমি মোবাইল ফোনে একজন রিলেটিভকে ফোন করছিলাম। তখন হঠাৎ করে ক্রস কানেকশান হয়ে যায়। শুনতে পেলাম একটি মেয়ে একজন পুরুষের সঙ্গে কথা বলছে। কথাগুলো অস্পষ্টভাবে শোনা যাচ্ছিল। ভদ্রলোক বললেন, না, না–প্লিজ, বলবেন না। উত্তরে মেয়েটি খুব হাসল। তারপর বলল, আপনার বুদ্ধি আছে। চট করে ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছেন। যারা বুঝতে না পারে, শুধু তর্ক করে, পুলিশের ভয় দেখায়– তারা শেষ পর্যন্ত সুইসাইড করে। লাস্ট দু-মাসে তিনজন কোটিপতি সুইসাইড করেছে আপনি জানেন তো? নাকি আপনার খবরের কাগজে চোখ বোলানোর সময় হয় না।
কথা শেষ করে মেয়েটি আবার হাসল। তখন ভদ্রলোক বললেন, না, নাজানি কাগজে দেখেছি। তবে কেন সুইসাইড করেছে বুঝিনি। আমি আপনাকে টাকা দিয়ে দেব।
মেয়েটি বলল, পাঁচ লাখ ক্যাশ। অবশ্য চেকে দিলেও কোনও অসুবিধে নেই। আপনি তো আসল কথাটা কাউকে বলতে যাচ্ছেন না! আপনি বরং বলবেন আমার চ্যারিটেবল ইন্সটিটিউশানে আপনি টাকাটা ডোনেট করেছেন। নইলে আমি কিন্তু সব সিক্রেট ফঁস করে দেব–আপনি আমার মুখ বন্ধ করতে পারবেন না।
ভদ্রলোক খুব ভয় পাওয়া গলায় বললেন, না, না কাউকে বলব না। আপনি কাল বেলা এগারোটায় আমার থিয়েটার রোডের অফিসে এসে নিয়ে যাবেন। পাঁচ লাখ ক্যাশ।
খিলখিল করে হাসল মেয়েটি। মিষ্টি করে বলল, গুড বাই, মিস্টার টাটা। সি য়ু টুমরো অ্যাট ইলেভেন। তারপর লাইন কেটে দিল।
কথা শেষ করে হাঁফাচ্ছিল অরিন। আমি ডান পাশে রাখা ক্যাবিনেট থেকে একটা কোকের ক্যান ওকে দিলাম। লালবাজারের গোটা বিল্ডিংটাই সেন্ট্রালি এয়ারকন্ডিশন্ড। সুতরাং আলাদা করে কোক ঠান্ডা করার দরকার হয় না। কোল্ড ড্রিঙ্কস আমার পার্কস-এর মধ্যে পড়ে।
অরিন খুব পরিশ্রমী আর সৎ। স্পেশাল ব্রাঞ্চে জয়েন করেছে বছর দুয়েক। আমরা সবাই ওর মতো হলে কলকাতা পুলিশের গল্প অন্যরকম ভাবে লেখা হত। আজ একুশ শতকের শেষ দিকে পৌঁছেও কলকাতা পুলিশের চরিত্র বিশ শতকের মতোই রয়ে গেছে। ঐতিহ্য একেই বলে!
কোকটা প্রায় এক নিঃশ্বাসে শেষ করল অরিন। তারপর হাতের পিঠ দিয়ে ঠোঁট মুছে নিয়ে বলল, স্যার, এটা তো স্ট্রেট কেস অফ ব্ল্যাকমেল।
আমি টেবিলে আঙুলের টোকা মারছিলাম আর চিন্তা করছিলাম।
থিয়েটার রোডে অফিস, পদবি টাটা–যিনি এক কথায় পাঁচ লাখ ক্যাশ দিতে পারেন…। এরকম একজনই আছেন কলকাতায় : রাজীব টাটা–টাটা হেভি ইলেকট্রিক্যালস লিমিটিড-এর চেয়ারম্যান এবং ম্যানেজিং ডিরেক্টর সাদা কথায় যাকে মালিক বলা যায়।
রাজীব টাটাকে একটি মেয়ে ব্ল্যাকমেল করছে!
এটাও ঠিক যে, গত দুমাসে কলকাতায় তিনজন কোটিপতি সুইসাইড করেছেন। সুইসাইডের কারণ আমরা খুঁজে বের করতে পারিনি। মিনিস্টারদের প্রচণ্ড চাপ থাকায় আমরা তন্নতন্ন করে ইনভেস্টিগেট করেছি, কিন্তু কিছুই পাইনি। এখন তা হলে একটা ব্লু পাওয়া গেল। সম্ভবত এই মেয়েটিই ওদের তিনজনকে ব্ল্যাকমেল করছিল। তারপর ওঁরা টাকা দিতে রাজি না হওয়ায় ওঁদের পুরোনো কেলেঙ্কারি ফাঁস করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছে। ফলে ওঁরা স্রেফ ভয় পেয়ে সুইসাইড করেছেন।
আমি অরিনকে বললাম, অরিন, তোমাকে এখনই একটা অ্যাকশন প্ল্যান দিচ্ছি। তুমি কাজে নেমে পড়ো। সঙ্গে লোরাকে নিয়ে নাও। খুব এনার্জিটিক মেয়ে–ওকে আমি পছন্দ করি। তা ছাড়া ও খুব ভালো ফটো তুলতে পারে…।
আমি জানি, অরিন লোরাকে আমার চেয়ে টু-কে টাইমস বেশি পছন্দ করে। আর লোরাও অরিনের সঙ্গে থাকতে ভালোবাসে। সেইজন্যেই ওদের দুজনকে একসঙ্গে অ্যাসাইনমেন্ট দিতে আমি ভালোবাসি তাতে অনেক বেশি কাজ আদায় করা যায়।
তোমরা কাল সকাল সাড়ে দশটা থেকে রাজীব টাটার থিয়েটার রোডের অফিসে হাজির থাকবে। লোরাকে আমি বলে দিচ্ছি, সঙ্গে আমাদের ডিপার্টমেন্টের বেস্ট ফাজি ডিজিটাল ক্যামেরাটা নিয়ে যাবে। মেয়েটি এগারোটার সময় রাজীব টাটার অফিসে এলেই ওর পটাপট ছবি তুলবে। আবার অফিস থেকে যখন বেরোবে তখনও শট নেবে। আমি ওর অন্তত দু-ডজন ছবি চাই ডিস্কে ছবিগুলো স্টোর করে নেবে–অ্যান্ডারস্ট্যান্ড?
ও.কে, স্যার।
মেয়েটি টাটার অফিস থেকে বেরোলে তুমি রাজীব টাটার সঙ্গে গিয়ে কথা বলবে। একটা জেনারাল এনকোয়ারি গোছের করবে…যতটা ডিটেইল বের করতে পারো আর কী! আর লোরা মেয়েটিকে ফলো করবে–ওর বাড়িটা চেনার চেষ্টা করবে। তারপর বিকেল চারটে নাগাদ আমাকে তোমরা ফুল রিপোর্ট দেবে। তখন আমি নেক্সট অ্যাকশন প্ল্যান চক আউট করব।
অরিন মাথা নেড়ে উঠে দাঁড়াল। আমি ভিডিয়োফোনে লোরার নম্বর ডায়াল করলাম।
ছোট পরদায় লোরার ছবি ফুটে উঠল। ওকে দেখলেই বয়েসটা কমাতে ইচ্ছে করে।
লোরাকে সংক্ষেপে গাইডলাইন দিলাম। তারপর বললাম, অরিনের সঙ্গে ও যেন কথা বলে নেয়।
তখনও জানি না, একটা অদ্ভুত রিপোর্ট আমার জন্য অপেক্ষা করছে।
*
পরদিন বিকেল চারটের সময় লোরা আর অরিন আমার চেম্বারে এল।
ওদের বসতে বললাম।
অরিন একটা ফোল্ডার আমার দিকে এগিয়ে দিল? এতে তিরিশটা কালার প্রিন্টআউট আছে।
ফোল্ডার খুলে ছবিগুলো দেখলাম।
ডিজিটাল ক্যামেরার ডিস্ক থেকে কম্পিউটারে ট্রান্সফার করে ছাপা ছবি। ছবিগুলো ফটোগ্রাফের চেয়েও জীবন্ত।
মেয়েটিকে দেখতে অতি সাধারণ। লম্বাটে মুখ। গায়ের রং মাঝারি। কপালে ছোট টিপ। গলায় সোনার চেন। পরনে গাঢ় নীল পাড় আকাশি রঙের শাড়ি। সাদা ব্লাউজ।
মেয়েটির কাঁধে সমাজসেবিকা ঢঙের একটা ব্যাগ ঝুলছে।
এই আমাদের ব্ল্যাকমেলার?
হ্যাঁ, স্যার। অরিন বলল।
অনেকক্ষণ ধরে মেয়েটিকে দেখলাম আমি।
এই সাদামাটা মেয়েটা একের পর এক কোটিপতিকে অকাতরে ব্ল্যাকমেল করে চলেছে! চেহারা দেখে বিশ্বাস হতে চায় না।
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর অরিন বলল, রাজীব টাটা গতকাল ওকে পাঁচ লাখ টাকার চেক দিয়েছেন। বললেন, এই ভদ্রমহিলা নানারকম সোশাল ওয়েলফেয়ারের কাজে যুক্ত আছেন। তাই তিনি খুশি হয়ে ওঁকে পাঁচলাখ টাকা দিয়েছেন। এটা ওঁদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। যদি কখনও ব্যাপারটা পুলিশের আওতায় আসে রাজীব টাটা নিশ্চয়ই আমাদের জানাবেন আমাদের হেল্প চাইবেন।
আমি ব্ল্যাকমেল শব্দটা উচ্চারণ করার সঙ্গে-সঙ্গে উনি যেভাবে হেসে উঠলেন তাতে মনে হল আমি যেন চাঁদকে চৌকো বলেছি। আমার খুব ইনসাল্টিং লেগেছে, স্যার। এরপর চুপচাপ চলে আসা ছাড়া কোনও পথ ছিল না।
অরিন গম্ভীর মুখে কথা শেষ করল। বুঝলাম, সকালের অপমানটা বিকেলেও মিলিয়ে যায়নি।
এবার লোরার পালা।
ও যা বলল সেটা সত্যি-সত্যিই অবাক হওয়ার মতো।
মেয়েটির নাম নিশিকা। এলগিন রোডে থাকে। লোরা ওকে অনুসরণ করার সময় নিশিকা বেশ কয়েকবার পেছন ফিরে তাকিয়েছিল। লোরার মনে হয়েছে নিশিকা অনুসরণের ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছে। কিন্তু তাতে ভয় পাওয়া তো দূরের কথা, একফোঁটাও বিচলিত হয়নি। ফলে লোরা অতি সহজেই ওর বাড়ির কাছে পৌঁছে যায়। ওর নাম-ঠিকানাটাও টুকে নিয়ে আসে।
তোমার ফলো করার কাজটা তা হলে জলের মতো সহজ হয়ে গেছে? লোরাকে জিগ্যেস করলাম।
হ্যাঁ, স্যার–অ্যাট লিস্ট আমার তাই মনে হয়েছে।
সত্যি, একজন ব্ল্যাকমেলারের পক্ষে এ ভারী অদ্ভুত প্রতিক্রিয়া।
কিছুক্ষণ চিন্তা করার পর অরিনকে বললাম, অরিন, নিশিকা রাজীব টাটাকে কিছু একটা ফাঁস করে দেবে বলে ভয় দেখাচ্ছিল। লেট আস ডিগ ইনটু রাজীব টাটাস পাস্ট। খুঁজে বের করো, রাজীব টাটা কী এমন কেলেঙ্কারির কাজ করেছেন যা ফাস হলে ওঁর মানসম্মান ধুলোয় মিশে যাবে। আর যে-তিনজন মালটি মিলিওনেওয়ার গত দুমাসে সুইসাইড করেছেন খোঁজ করে দ্যাখো ওঁদের লাইফে কোনও গোপন স্ক্যান্ডাল ছিল কি না। সিক্রেট ইনফরমেশানই ব্ল্যাকমেলারদের স্ট্রেংথ।
অরিন বলল, ও.কে, স্যার।
এই পাস্ট হিস্ট্রিগুলো স্ক্যান করার কাজে লোরা তোমাকে হেল্প করবে। য়ু আর পাটনার্স।
অরিন আড়চোখে লোরার দিকে দেখল। লোরার মুখে একটা উজ্জ্বল আভা ফুটে উঠল।
ওরা চলে গেলে আমি ছবির ফোল্ডারটা টেবিলে নামিয়ে রেখে কম্পিউটারের দিকে ঘুরে বসলাম। পুরো ব্যাপারটার একটা ব্রিফ রিপোর্ট তৈরি করতে শুরু করলাম। কাজ করতে করতে আমার চোখ বারবার টেবিলে রাখা খোলা ফোল্ডারটার দিকে চলে যাচ্ছিল।
সেখান থেকে নিশিকা আমার দিকে তাকিয়ে হাসছিল। চ্যালেঞ্জের হাসি।
মেয়েটা আরও কজন কোটিপতিকে ব্ল্যাকমেল করছে কে জানে!
.
নিশিকা আমার মুখোমুখি চেয়ারে বসল। শাড়িটা সামান্য গুছিয়ে নিয়ে কাঁধের ব্যাগটা কোলের ওপরে রাখল। তারপর আত্মবিশ্বাস ভরা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে হাসল।
হাসিটা এমন যেন ও বুঝতে পেরেছে আমার ডিপার্টমেন্টের তদন্তের নিটফল শূন্য, কিংবা মহাশূন্য।
অরিন আর লোরা আমাকে গতকাল রিপোর্ট দিয়েছে যে, রাজীব টাটা এবং সুইসাইডে মারা যাওয়া তিন কোটিপতির জীবনে বলার মতো তেমন কোনও কুকাজ নেই। চারজনেরই জীবন মোটামুটিভাবে যুধিষ্ঠির কিংবা সত্যবানের মতো।
সুতরাং নিশিকাকে আমার দপ্তরে একবার ডেকে পাঠিয়েছি।
এসব ভাবছিলাম আর নিশিকার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। ওর চোখদুটো আমার কেমন অলৌকিক মনে হচ্ছিল। সোজা চেয়ে আছে আমার দিকে। চোখে পলক পড়ছে না।
ঠান্ডা গভীর চোখ। আত্মবিশ্বাসে ভরপুর। যেন আমার আপাদমস্তক অন্তরতম আনাচকানাচ পর্যন্ত নিখুঁতভাবে জরিপ করে নিয়েছে। আমার সম্পর্কে কিছুই আর ওর জানতে বাকি নেই।
কোনওরকমে অস্বস্তি কাটিয়ে আমি কথা বললাম, নিশিকা, আপনি রাজীব টাটাকে ব্ল্যাকমেল করছেন। আরও তিনজন মালটি মিলিওনেয়ার আপনার ব্ল্যাকমেলের টার্গেট হয়ে সুইসাইড করেছেন। এখনও আমরা কোনও কংক্রিট প্রুফ পাইনি–তবে আজ না হয় কাল প্রমাণ পাবই। তখন আপনার এই হাসি মিলিয়ে যাবে। তার চেয়ে বেটার আপনি এখন নিজে থেকেই পুরো ব্যাপারটা খুলে বলুন।
নিশিকার চোখ অপলক। ঠোঁটে একচিলতে হাসি। ও বলল, আপনাকে সব বলব।
আমি মাথা নেড়ে ইন্টারকম ভিডিয়োফোনের দিকে হাত বাড়ালাম : হ্যাঁ, কনফেস করাটাই বেটার। শাস্তি কম হবে।
নিশিকার হাসিটা চওড়া হল? কাউকে ফোন করে ডাকার দরকার নেই। আমি কনফেস করব শুধু আপনার কাছে–আর কারও কাছে নয়।
তার মানে! আমার কেমন যেন নার্ভাস লাগছিল।
রামা-শ্যামার কাছে সব খুলে বলে কোনও লাভ নেই। আমি আপনার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলাম। জানতাম আমাদের দেখা হবেই। আপনি আমাকে ডেকে পাঠাবেন।
কীভাবে জানলেন আমি ডেকে পাঠাব?
হাসল নিশিকা, বলল, জানি। এই জানাটাই আমার অলৌকিক ক্ষমতা।
মেয়েটা কি জ্যোতিষী নাকি! কে জানে, হয়তো ব্লাফ দিচ্ছে! কিন্তু ওর চোখ তো সে কথা বলছে না। বরং মনে হচ্ছে সত্যি কথাই বলছে। ওঃ, ওর চোখের দিকে তাকিয়ে আমার ভেতরটা কেমন করছে!
এবারে বলুন, রাজীব টাটাদের মতো বড়লোকদের কী কেলেঙ্কারির ঘটনা আপনি জানেন যা ফাঁস করে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে ওঁদের থেকে কাড়ি কাড়ি টাকা নিচ্ছেন! ওঁদের পাস্ট লাইফের কী গোপন খবর আপনি জানেন?
নিশিকা হাসল, মাথা নাড়ল এপাশ-ওপাশ–যেন আমি কোনও ছেলেমানুষি কথা বলেছি। তারপর ও ওঁদের অতীতের কোনও খবর তো আমি জানি না! আমি জানি শুধু ওঁদের ভবিষ্যতের কথা–আগামী দিনে ওঁদের জীবনে কী হতে চলেছে।
কী বলছেন আপনি! বুঝতে পারছিলাম আমার মুখ হাঁ হয়ে গেছে, চোখ বড় বড় : আপনি কি জ্যোতিষী? ফরচুন-টেলার?
না। জ্যোতিষীরা আন্দাজ করে ভাগ্যের কথা বলে। প্রতিদিনের খবর জানে না। আমার সামনে ঝুঁকে এল নিশিকা? আমি প্রতিদিন, প্রতিটি ঘণ্টা, প্রতিটি মুহূর্তের খবর জানি। আমি আন্দাজে কিছু বলি না। আমি ফরচুন-টেলার নই…ফিউচার-টেলার।
আমি নিশিকার অন্তর্ভেদী চোখের দিকে দেখছিলাম। অপলক ওই চোখ ভবিষ্যতের সবকিছু দেখতে পাচ্ছে!
সুতরাং বুঝতেই পারছেন, ব্যাপারটা খুব সহজ–আমি ওই বড়লোকগুলোর কাছে গিয়ে বলি আমি ওদের ভবিষ্যতের সব খবর জানি। তাই আমাকে টাকা দিতে হবে। একটু থেমে তারপর ও বড়লোকদের আমি ঘেন্না করি। আর আপনার মতো সমাজে যারা উঁচু চেয়ারে বসে রয়েছে তাদেরও আমি দু-চক্ষে দেখতে পারি না। আপনারা সবাই মিলে দেশটাকে উচ্ছন্নে পাঠাচ্ছেন।
নিশিকা উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল, বড়-বড় শ্বাস ফেলছিল।
আমি হাত তুলে ওকে শান্ত হতে বললাম। তারপর ও তার মানে ওঁদের ভবিষ্যতের কুকীর্তি গোপন রাখার জন্যে ওঁরা আপনাকে টাকা দেন? যাতে কাউকে আপনি সেসব কথা না বলে দেন?
না, না! আপনি ঠিক বুঝতে পারেননি। ফিউচারের সব গোপন কথা অন্যদের কাছে ফাস করে দেব বলে আমি ওদের ভয় দেখাই না। আমি ওদের ভবিষ্যতের কথা ওদেরই বলে দেব– এই বলে ভয় দেখাই। যেমন ধরুন, রাজীব টাটা কোন বছরে কোনদিন কটার সময় কীভাবে মারা যাবে আমি জানি। সেটা যদি ওকে জানিয়ে দিই তা হলে লোকটা কি আর নিশ্চিন্তে বাঁচতে পারবে? রোজ গুনবে মরতে ওর আর কদিন বাকি। এই টেনশানে-টেনশানে ওর লাইফ হেল হয়ে যাবে। তারপর একদিন আর সইতে না পেরে সুইসাইড করবে। তাই না?
আমি পাথর হয়ে বসে রইলাম। ব্ল্যাকমেলের রহস্য আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল।
আমার আরও কাছে ঝুঁকে এল নিশিকা। প্রায় ফিসফিস করে বলল, আপনার মারা যাওয়ার দিনক্ষণও আমি জানি। যদি আপনি আমাকে পুলিশের তরফ থেকে প্রোটেকশান দেন–মানে, আমাকে ডিসটার্ব না করেন, তা হলে সেসব সিক্রেট আপনাকে বলব না। আপনি নিশ্চিন্তে জীবনটাকে এনজয় করতে পারবেন।
আমার চোয়াল ঝুলে পড়ল। ওর কথায় ঘাড় নেড়ে সায় দিলাম। আমি সুইসাইড করতে চাই না–নিশ্চিন্তে বাঁচতে চাই।
নিশিকা চলে যাওয়ার আগে বলে গেল, ব্ল্যাকমেল করে পাওয়া টাকার প্রায় সবটাই ও সত্যি-সত্যি সোশাল ওয়েলফেয়ারের কাজে খরচ করে।