Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » চিত্রার অদৃশ্য মৃতদেহ || Anish Deb

চিত্রার অদৃশ্য মৃতদেহ || Anish Deb

আসুন, আমার বউ চিত্রার সঙ্গে আপনাদের আলাপ করিয়ে দিই। ওই যে, সোফায় শরীর এলিয়ে দিয়ে বেশ জোরালো গলায় গান গাইছে। গানে সুর নেই বটে, কিন্তু কথা তো আছে! কথা হল চিত্রার সবচেয়ে প্রিয়। দিনে কম করে আড়াই লক্ষ শব্দ উচ্চারণ করে এই রমণী। বোধহয় আগের জন্মে শালিখ কিংবা চড়ুই ছিল।

চিত্রার শরীরের যৌবন আছে। বড় বেশিরকম যৌবন। গায়ের রং মাজা। মুখের শ্রী মাঝারি। যখন, প্রায় এক যুগে আগে, ওর সঙ্গে আমার বিয়ে হয়, তখনও ওর চেহারা একইরকম ছিল। না, ভুল ভেবেছেন–ভালোবেসে আমাদের বিয়ে হয়নি। বরং বলা যায়, ওই ব্যাপারটা হয়ে গিয়েছিল। প্রয়োজন থেকেই।

আমরা দুজনে সরকারি আর্ট কলেজে ছবি আঁকা শিখতাম। তখন চিত্রা একটু বেশি আহ্লাদি আর গায়ে-পড়া ছিল। ওকে দেখে আমার সবসময়েই মনে হত, সন্তান উৎপাদনের কযন্ত্র। কথাটার আদৌ কোনও মানে হয় কিনা জানি না, কিন্তু মনে যে হত সেটা সত্যি। অথচ বিয়ের পরে জেনেছিলাম চিত্রা বন্ধ্যা বসুন্ধরা।

দারুণ নম্বর পেয়ে পাশ-টাশ করার পর বিদেশে যাওয়ার একটা সুযোগ পেলাম। এরকম স্বপ্ন আমার একটু-আধটু ছিল। কিন্তু যাতায়াতের প্লেনভাড়া জোটানোর ব্যাপারটা আমার কাছে ছিল রীতিমতো দুঃস্বপ্ন। কোত্থেকে টাকা পাই? ঠিক তখনই সহপাঠী অতনু একটা মতলব শোনাল। বলল, চিত্রার বাবা নাকি জামাই খুঁজছেন।

প্রথমটা আমার লজ্জা করেছিল। অনেক নীতি-ফিতি ছিল ছোটবেলা থেকে। কিন্তু বেশ মনে আছে, কয়েকটা রাত আমি ঘুমোতে পারিনি। মনের মধ্যে রোজই চলত লড়াই। উচ্চাশা আর নীতির দাঁত-নখ লড়াই। আমি জানতাম শেষ পর্যন্ত কে জিতবে। উচ্চাশাই জিতল। চিত্রার বাবার কাছে। মাথা জমা দিয়ে বিদেশে গেলাম। না, আমি একা নয়, সঙ্গে ছিল আমার নতুন বউ চিত্রা।

কলেজ থেকে পাশ করে বেরোনোর পর থেকেই চিত্রার ছবি আঁকার শখ মিটে গিয়েছিল। তার বদলে ওর নিত্যনতুন শখ গজাতে লাগল। দেশ বেড়ানো, সেলাই, মডেলিং, হাতের কাজ, আরও সব কতরকম কিম্ভুত শখ। আমি যখন মনপ্রাণ দিয়ে ছবি আঁকতাম তখন চিত্ৰা কানের কাছে ওর নতুন শখের বৃত্তান্ত বকবক করে যেত। আমার তুলির টান ভ্রষ্ট হত। নিবিড় মনোযোগ নষ্ট হত। কিন্তু ক্রীতদাস আমি কী-ইবা করতে পারি। সহ্য করাটাই যে আমার একমাত্র গুণ।

বিদেশ থেকে দেশে ফিরে বছর গড়াতে লাগল, আর চিত্রার কথাও বাড়তে লাগল সমানুপাতিক হারে। এ ছাড়া আমার প্রতিটি ছবির প্রথম সমালোচক হল চিত্রা। সাদা ক্যানভাসে তুলির প্রথম আঁচড়ের প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই কানের কাছে শুরু হয়ে যেত ওর সমালোচনার ধারাবিবরণী। এ যে কী অসহ্য যন্ত্রণা! এমনও হয়েছে, আমার অজান্তে আমার অসমাপ্ত ছবিতে নিজের খুশিমতো বেশ কিছু রদবদল করে দিয়েছে চিত্রা। তারপর ভোরবেলা চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বুক অসভ্যভাবে উঁচু করে আড়মোড়া ভাঙতে-ভাঙতে বলেছে, এবার ছবিটা অনেক বেটার দেখাচ্ছে না। আমি ছোট্ট করে হুঁ বলে চুপ করে থেকেছি। কিন্তু মাথার ভেতর তখন টগবগ করে রক্ত ফুটছে।

গত বারোবছর তিনমাস সময়ের মধ্যে চিত্রার অন্তত সতেরোটা ছবি আঁকতে বাধ্য হয়েছি। আমি। কখনও ওর পরনে চটুল পোশাক, কখনও-বা পোশাকহীন নিরাবরণ। কিন্তু একটা ছবিও ওর পছন্দ হয়নি। কারণ, ওর মতে ছবিগুলোতে হয় ওর ব্যক্তিত্ব ফোটেনি, কিংবা ওর চোখের অতলান্ত গভীরতা ধরা পড়েনি, নয়তো ওর সুললিত যৌবনের কোমলতা অনুপস্থিত।

হ্যাঁ, আমি জানি, ছবিগুলো ওর মতো হয়নি। কারণ, তুলির প্রথম টান শুরু করার পর থেকেই আমার বুকের ভেতরে দাস-মনোবৃত্তি তোলপাড় করত। মনে হত, একটা শেকল বাঁধা জানোয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছে শেকল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে। তখন ওই বিকৃত মনের অবস্থায় যে-ছবি আমি আঁকতাম তাতে চিত্রার ঠোঁটজোড়া হত বিশাল, চোখে থাকত শয়তানি, আর শরীরে ঝরে পড়ত পাশবিক কামনা।

এখন আমার ছবি বেশ ভালোই বিক্রি হয়। শিল্পী হিসেবেও আমার নাম-ডাক হয়েছে। ইচ্ছে করলে এবং চেষ্টা করলে চিত্রার বাবার দেওয়া সেই প্লেনের টিকিটের দাম এখন আমি সুদসমেত শোধ করে দিতে পারি। কিন্তু তাতে কোনও লাভ নেই। চিত্রা তো থাকবে আমার কাছেই, শোবে আমার সঙ্গে, আমার প্রতিটি তুলির টানের কুৎসিত সমালোচনা করবে, নিজের বীভৎস সব শখ নিয়ে অনর্গল কথা বলে যাবে, আর আমার কানের পরদা কেঁপে যাবে অবিরাম। এইভাবে চিত্রার শব্দদূষণে ক্রমাগত ডুবে যাব আমি। শেষ পর্যন্ত হয়তো পাগল হয়ে যাব।

সুতরাং এইরকম একটা মনের অবস্থায় যদি আমি চিত্রাকে খুন করার কথা ভেবে থাকি তা হলে আপনারা নিশ্চয়ই আমাকে দোষ দেবেন না। এও জানি, আপনাদের মধ্যে কেউ-কেউ হয়তো বলবেন, অ্যাদ্দিন কী করছিলেন, মশাই? বারোবছর ধরে এই যন্ত্রণা সহ্য করেছেন। অনেক অগেই আপনার ওকে খতম করে দেওয়া উচিত ছিল।

মানছি, উচিত ছিল। বহুবার ভেবেছি ওকে খুন করার কথা, কিন্তু ক্রীতদাসের সাহসে কুলোয়নি। তা ছাড়া, পুলিশের হাতে ধরা পড়ার ভয়ও ছিল। আর ধরা পড়লেই তো ছবি আঁকা শেষ। যে ছবি আঁকার চর্চার জন্যে এত কাণ্ড, সেই ছবিই যদি না আঁকতে পারি, তা হলে চিত্রাকে খুন করে আর লাভ কী।

কিন্তু নিয়তি বোধহয় আমার নিঃশব্দ হাহাকার শুনতে পেয়েছিল। তাই একদিন ধর্মতলার মোড়ে দেখা হয়ে গেল অনুতোষের সঙ্গে।

অনুতোষ আমার সঙ্গে হেয়ার স্কুলে পড়ত। এখন বিশাল বিজ্ঞানী। সবসময়েই লন্ডন আমেরিকা করে বেড়াচ্ছে। তা ছাড়া অনুতোষ ছবিরও সমঝদার। ফলে আমার নাম জানত। শুধু জানত না, আমিই ওর স্কুলের সেই মুখচোরা সহপাঠী।

অনুতোষ আমাকে জোর করে ধরে নিয়ে গেল ওর বাড়িতে। ওর নানান আবিষ্কার দেখাল। তার মধ্যে একটা যন্ত্র আমাকে অবাক করে দিল। যন্ত্রটা নিয়ে অনুতোষ এখনও গবেষণা করছে। তবে তার গুণাগুণ শুনে আমি তাজ্জব হয়ে গেলাম। আর তখনই চিত্রাকে খুন করার ইচ্ছেটা বাস্তব চেহারা নিতে চাইল আমার মনে। নাঃ, চিত্রাকে দেওয়ালে ঝোলানো ফটো করে দিতে আর কোনও বাধা নেই।

গত পাঁচ-সাত বছর ধরে প্রচুর খুনজখমের গল্প আমি পড়েছি। তার মধ্যে বউকে খুন করার গল্পগুলো বেশি মনোযোগ দিয়ে পড়েছি। তাতে দেখেছি, এক-একটা গল্পে খুনের পদ্ধতি এক-একরকম। আবার মৃতদেহ লুকিয়ে ফেলার চেষ্টাও নানারকমের। যেমন, একজন সাহেব তার বউয়ের মৃতদেহটা ছোট-ছোট টুকরো করে পুড়িয়ে ফেলেছে ফায়ার প্লেসে। কাজটা এতই ভয়াবহ যে, আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তা ছাড়া ফায়ার প্লেস হাতের কাছে পাবই বা কোথায়? বড়জোর মৃতদেহের টুকরোগুলোকে গ্যাসের উনুনে পুড়িয়ে ফেলার চেষ্টা করতে পারি। কিন্তু মাংস পোড়ার গন্ধ পেয়ে আমার প্রতিবেশীরা অবশ্যই হাত গুটিয়ে বসে থাকবে না। এমনিতেই তারা সবসময় পরের ছিদ্র খুঁজে বেড়ায়, সুতরাং তাদের হাত থেকে নিস্তার পাওয়ার কোনও কারণ নেই। তা ছাড়া বউ নিরুদ্দেশ হওয়ার একটা জুতসই ব্যাখ্যাও তো খাড়া করতে হবে আমাকে।

আর-একটা গল্পে নায়ক তার বউয়ের মৃতদেহ পাতালঘরের দেওয়ালের ফঁপা অংশে লুকিয়ে দেওয়ালটা নতুন করে গেঁথে দিয়েছিল। পুলিশ তন্নতন্ন করে খানাতল্লাশ চালিয়েও সেই মৃতদেহের হদিস পায়নি। কিন্তু অহঙ্কারী নায়ক পুলিশের সামনেই যখন পাতালঘরের দেওয়ালের গায়ে লাঠি ঠুকে গাঁথুনির প্রশংসা করতে থাকে, তখনই কোথা থেকে যেন শোনা যায় অপার্থিব এক কান্নার সুর। গাঁথুনির ভেতর থেকেই যেন ভেসে আসছে সেই কান্না। তৎপর পুলিশের দল সন্দিহান হয়ে গাঁথুনি ভেঙে ফেলে। তখনই দেখা যায়, নায়কের বউয়ের বিকৃত মৃতদেহের মাথার ওপরে বসে আছে তারই পোষা কালো বেড়াল। ভুল করে বউয়ের মৃতদেহের সঙ্গে সে এই কালো বেড়ালটিকেও জীবন্ত কবর দিয়েছিল। ফলে, একটা বেড়াল চোখের পলকে যেন ফাঁসির দড়ি হয়ে গেল।

গল্পগুলোর মধ্যে উদ্ভট গল্পও বেশ কয়েকটা ছিল। একটা লোক তো তার বউয়ের মৃতদেহ দু-বোতল চাটনি দিয়ে স্রেফ খেয়েই ফেলেছিল। এই জঘন্য কাজ করার সময় খিদে বাড়ানোর জন্যে লোকটা কুড়ুল দিয়ে তার বাগানের সবকটা গাছ কেটে ফেলেছিল। নাঃ, পড়লে বিশ্বাস হতে চায় না। এটা শুধু গল্পেই মানায়।

তারপর চোখে পড়েছে খুব জনপ্রিয় পদ্ধতির গল্প–যেখানে বউয়ের মৃতদেহ বড় ট্রাঙ্ক কিংবা সুটকেসে ভরে পাচার করা হচ্ছে, ফেলে রেখে আসা হচ্ছে ট্রেনের কামরায়, অথবা নির্জন কোনও রাস্তার ধারে। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে দেখেছি পুলিশ মৃতদেহটা খুঁজে পাওয়ার পর থেকেই বিপদের শুরু। কী করে যেন গন্ধ পেয়ে ওরা ঠিক খুঁজে পায় খুনিকে। তা ছাড়া নাকগলানে পাড়াপড়শিরা যদি ট্রাঙ্ক বা সুটকেস নিয়ে রওনা হতে দ্যাখে তা হলেই চিত্তির।

আর আপনারা নিশ্চয়ই জানেন, বউ যখন খুন হয় তখন সন্দেহের তালিকায় প্রথম নামটি সবসময়েই তার স্বামীর। সুতরাং, চিত্রা খুন হলে আমার নামই থাকবে সবার আগে। তা ছাড়া ওর বাবা, আমার ডার্লিং শ্বশুরমশায়, বিকট বড়লোক। আদরের মেয়ের খুন হওয়াটা বা নিরুদ্দেশ হওয়াটা উনি কিছুতেই চুপচাপ মেনে নেবেন না।

দিনের পর দিন ভেবে-ভেবে মাথার চুল ছিঁড়েছি আমি। চিত্রার মৃত্যুটাকে আত্মহত্যা কিংবা দুর্ঘটনা হিসেবে চালানো যায় কি না তাও ভেবেছি। কিন্তু মনের মতো কোনও প্ল্যান আসেনি মাথায়। বহু ভেবে-ভেবে সার কথা যা বুঝেছি তা হল, চিত্রাকে খুন করতে হবে, মৃতদেহ লোপাট করতে হবে, এবং সবশেষে ওর উধাও হয়ে যাওয়ার একটা জুতসই ব্যাখ্যা খাড়া করতে হবে।

তবে গল্পে হোক আর সত্যি হোক, একটা ব্যাপার আমি লক্ষ করে দেখেছি : মৃতদেহ যদি খুঁজে পাওয়া না যায় তা হলে কিছুতেই পুলিশ জুতসই কোনও কেস দাঁড় করাতে পারে না। সুতরাং কী করে চিত্রাকে খুন করব, তার চেয়েও বড় প্রশ্ন হচ্ছে, কী করে ওর মৃতদেহ লোপাট করব।

এই প্রশ্নের উত্তরই আমি খুঁজে চলেছি গত পাঁচ-সাত বছর ধরে।

না, মনের মতো কোনও উত্তর পাইনি। মনে-মনে যে কত লক্ষ গল্প আমি লিখে ফেলেছি! কিন্তু সবকটা গল্পেই শেষ পর্যন্ত স্বামী বেচারা ধরা পড়ে গেছে। আর তারপরই ইলেকট্রিক চেয়ার কিংবা ফাঁসির দড়ি।

সুতরাং অনুতোষের যন্ত্র আমাকে হাতে চঁদ পেড়ে দিল। আমার এতদিনের প্রশ্নের সঠিক উত্তর পাওয়া গেল যেন।

কফির কাপে চুমুক দিচ্ছিলাম আর গভীর টান মারছিলাম হাতের সিগারেটে। চোখ-কান মন সবই অনুতোষের দিকে। ও আমাকে তখন যন্ত্রটার কথা বলছিল।

যন্ত্রটার নাম দিয়েছি টাইম লকার, বুঝেছিস?

আমি অবাক হয়ে বললাম, টাইম লকার? তার মানে?

যন্ত্রটা আমাদের কাছ থেকে খানিকটা দূরেই দাঁড়িয়ে। চেহারায় দুশো লিটার মাপের একটা রেফ্রিজারেটরের মতো। রং হালকা নীল। চকচকে ধাতুর হাতল লাগানো দরজায়। আর পাশের দিকটায় ছোট্ট একটা ডায়ালের মতো কী যেন, তার পাশেই লাল রঙের একটা বোতাম।

অনুতোষ কফির কাপে শেষ চুমুক দিয়ে উঠে দাঁড়াল। সিগারেটে টান দিয়ে একমুখ ধোয়া ছেড়ে এগিয়ে গেল টাইম লকারটার দিকে। হাতলে টান মেরে দরজাটা খুলে দিল।

ভেতরে অনেকটা জায়গা। দুটো তাকও রয়েছে। সবটাই ধাতুর পাত দিয়ে তৈরি।

বুঝতেই পারছেন, যন্ত্রটার মধ্যে এমনিতে কোনও বিশেষত্ব নেই। নেহাতই সাদামাটা শৌখিন একটা আলমারি। কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তরে অনুতোষ কী বলল জানেন?

টাইম লকার। হাসল অনুতোষ ও এর মধ্যে কোনও জিনিস ঢুকিয়ে যদি পাশের দেওয়ালের ডায়ালটা এইদিকে কুড়ি ডিগ্রি ঘুরিয়ে বোতামটা টিপে দিস, তা হলে দরজা খুলে দেখবি ভেতরে কিছুই আর নেই। সব ফাঁকা।

যাঃ, অসম্ভব! আমি সিগারেট গুঁজে দিয়েছি অ্যাশট্রেতে। কফির কাপ হাতে চলে গেছি। বিজ্ঞানী অনুতোষের কাছে। বলেছি, না, ভাই, বিশ্বাস হচ্ছে না।

অনুতোষ একবার তাকাল আমার দিকে। তারপর হঠাৎই আমার হাত থেকে কফির কাপ প্লেট একরকম কেড়ে নিল। সেটা রেখে দিল টাইম লকারের ওপরের তাকে। এবং দরজা বন্ধ করে ডায়াল ঘুরিয়ে বোতাম টিপে দিল।

অনুতোষ চ্যালেঞ্জের ভঙ্গিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, নে, এবার দরজা খুলে দেখ–।

আমি অবাক চোখে আমার স্কুলজীবনের বন্ধুকে দেখতে-দেখতে টাইম লকারের হাতল ধরে টান মারলাম। এবং হতবাক হয়ে গেলাম।

টাইম লকার সেই আগের মতোই খালি।

আমার ফ্যালফ্যালে চাউনি দেখে অনুকম্পার হাসি হাসল অনুতোষ। বলল, ওই কাপ আর প্লেট এখন হাইপারস্পেসে চলে গেছে। আমাদের স্পেস-টাইম ছেড়ে চলে গেছে ফোর্থ ডায়মেনশনে।

আমার মাথায় ব্যাপারটা ঢুকল না। হাইপারস্পেস! ফোর্থ ডায়মেনশন। সব কেমন যেন গুলিয়ে যাচ্ছে। অবশ্য গুলিয়ে যাক, ক্ষতি নেই–শুধু টাইম লকার ঠিকমতো কাজ করলেই আমি খুশি।

অনুতোষের ভেতরে বিজ্ঞানী সত্তা তখন মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। ও আপনমনেই বকবক করে বলে চলেছে ওর টাইম লকার তৈরির ইতিহাস। আমি ওর কথাগুলো শুনছিলাম, কিন্তু মনে মনে গলা টিপে খতম করছিলাম চিত্রাকে। আমার বিষধর চিত্রসমালোচককে।

অনুতোষ বলছিল, সুপারকন্ডাক্টর দিয়ে কয়েকটা কয়েল তৈরি করে তাতে কারেন্ট পাঠিয়ে তৈরি করেছি সুপার-ম্যাগনেটিক ফিল্ড। তার ওপরে চালিয়েছি নকল মহাকর্ষ। তা ছাড়া আরও অনেক কিছু করেছি, তুই সেসব বুঝবি না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যেরকমটা চাইছিলাম সেরকম হল না। দেখি, এরপর আর কী কারিকুরি করা যায়…।

নিকুচি করেছে অনুতোষের বৈজ্ঞানিক কচকচির। আমি তখন মনে-মনে পেয়েছি অভয়পদ, আর ভয় কারে… গাইছি।

আমার মুখচোখে বোধহয় খুশি আর উত্তেজনার ছাপ পড়েছিল। সেটা দেখে অনুতোষ একটু অবাক হয়ে গেল। টাইম লকারের দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে বলল, কী ব্যাপার বল তো?

আমি নিজেকে সামলে নিয়ে মজা করে বলেছি, না, ভাই, এখন বলব না। আমার মতো ছবি আঁকিয়েদের এমনিতেই পাগল বলে বদনাম আছে। তবে এটুকু বলতে পারি, তোর এই যন্ত্রটা দেখে আমার একটা আইডিয়া এসেছে।

না, না, ভুলেও ভাববেন না চিত্রাকে নেই করে দেওয়ার আইডিয়াটা আমি অনুতোষকে বলতে চাইছি। ও আমার স্কুলের বন্ধু তার বেশি কিছু নয়। সুতরাং রহস্যময় হাসি হেসে বললাম, তোর এই যন্ত্রটা কদিনের জন্যে আমাকে ধার দিতেই হবে।

কেন বল তো? অনুতোষ অবাক চোখে তাকায় আমার দিকে।

আমি তখন চাপা গলায় বললাম, তোকে বলছি, কিন্তু ব্যাপারটা একদম ফস করবি না। আমি হাইপারস্পেস নিয়ে ছবি আঁকা শুরু করব। সুররিয়েলিস্টিক ঢঙে একটা সিরিজই এঁকে ফেলব। বুঝতেই তো পারছিস, এই দারুণ আইডিয়ার ব্যাপারটা যদি অন্য কোনও আর্টিস্ট টের পেয়ে যায় তা হলে আমারই ক্ষতি। আর্টিস্টদের মধ্যে কীরকম বাজে টাইপের রেষারেষি জানিস তো!

না, অনুতোষ যে আমার কথা পুরোপুরি বিশ্বাস করেছে তা বলব না। তবে আমি যেভাবে নাছোড়বান্দার মতো ওকে ধরেছি তাতে ওর ঠুনকো আপত্তি টিকল না। তা ছাড়া ওর গবেষণার জন্যে বিশহাজার টাকা ডোনেশান দিতেও রাজি হয়ে গেলাম আমি। আরও বললাম, বন্ধুত্বের খাতিরেই ওর একটা অয়েল পোর্ট্রেট করে দেব–একেবারে বিনা পারিশ্রমিকে।

অনুতোষের মুখ দেখেই বুঝলাম, আমার এক-একটা অয়েল পেইন্টিং কী দামে বিক্রি হয় সে সম্পর্কে বেশ ভালোরকম ধারণাই ওর আছে। ওর মুখে প্রত্যাশা ফুটে উঠল। সেটা দেখে আমার হাসি পেল। অনুতোষ জানে না, চিত্রার জোয়াল থেকে মুক্তি পেতে আমি একটা কেন, একহাজার অয়েল পেইন্টিং ফ্রি-তে বিলোতে পারি।

সুতরাং এইভাবে, অনেক অনুনয় ও মেহনতের পর, অনুতোষের টাইম লকার পরদিনই চলে এল আমার বাড়িতে। এবং এবার যে-গল্প আমি লিখতে চলেছি সারা দুনিয়া খুঁজেও যে তার জুড়ি পাওয়া যাবে না সেটা আমি জানি।

চিত্রা যে বাক্সটা মানে, টাইম লকারটা–দেখে একশো আটটা প্রশ্ন করবে সেটা নিশ্চয়ই আপনারা অনুমান করতে পেরেছেন। ও প্রথমেই জানতে চাইল, এই অকেজো ফ্রিজটা আমি কোন জাহান্নম থেকে কুড়িয়ে নিয়ে এসেছি।

আমিও মিনমিন করে জবাব দিয়েছি, সস্তায় পেয়ে গেলাম, তাই–মানে…।

ও ঠোঁট-মুখ বেঁকিয়ে বলল, ওঃ, সেই বিয়ের আগে থেকেই তোমার এইরকম ভিখিরি মেন্টালিটি। সবসময়েই হাত পেতে ঘুরঘুর করছ।

বুঝলাম, ও সেই একযুগ আগের প্লেনভাড়ার ব্যাপারটা আমাকে মনে করিয়ে দিতে চাইছে। কিন্তু আমি কোনও জবাব দিলাম না। কারণ, আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা পরেই চিত্রা–অথবা, বলা ভালো চিত্রার মৃতদেহ রওনা দেবে হাইপারস্পেস না কী যেন সেই জাহান্নমের পথে। যেখানে মা কালীর কোলে আমার বউ চিত্রা ডাকিনী-যোগিনী সেজে বসে থাকবে।

এরপর স্বাভাবিকভাবেই চিত্রার কথা বলার হার মারাত্মক রকমের বেড়ে গেল। আমি বেশ শান্তভাবেই ওকে বললাম যে, এই আলমারিতে আমার ছবি আঁকার সরঞ্জাম থাকবে, আর টুকটাক জিনিস থাকবে। তারপর মনে-মনে বললাম, আর থাকবে তোমার মৃতদেহ।

দেরি করতে চাইনি আমি। তাই সেদিন রাতেই চিত্রা যখন অচেতন ঘুমে নিঃঝুম তখন ওর গলা টিপে ধরলাম। বিশ্বাস করুন, গলা টেপার সময়ে হাসি পাচ্ছিল আমার। এই কি সেই গলা, যে-পথ বেয়ে গত বারোবছর তিন মাসে অন্তত সাড়ে সতেরো কোটি কথা বেরিয়ে এসেছে! কী ভয়ংকর অপশক্তিই না লুকিয়ে রয়েছে এই দানবীর ভোকাল কর্ডে! আমার হাত শিল্পীর হাত। কিন্তু খুনও বোধহয় এক শিল্পকলা। নইলে কী করে অমন শক্তি দিয়ে আমি চেপে ধরতে পারলাম চিত্রার গলা!

কিছুক্ষণ দাপাদাপি করল ও। চোখ খুলে নাইট ল্যাম্পের আলোয় বোধহয় চিনতে পারল ওর আততায়ীকে। ওর পায়ের ঝাপটায় মশারির একটা কোণের বাঁধন ছিঁড়ে গেল। কিন্তু একটু পরেই সব ছটফটানি শেষ। খেল খতম।

মনে হল আমি যেন পাখির মতো ডানা মেলে ভেসে পড়েছি আকাশে। আমার স্বাধীন ডানায় কারও শাসনের ছাপ নেই। ক্রীতদাসের শেকল ছিঁড়ে গেছে চিরতরে।

স্বপ্নের ঘোরের মধ্যে বাকি কাজগুলো সেরে ফেললাম আমি। চিত্রার মৃতদেহটা টেনে নিয়ে গেলাম টাইম লকারের কাছে। তারপর কোনওরকমে ঠেলেঠুলে গুঁজে দিলাম ভেতরে। ওর দ হয়ে বসে থাকা দেহটা দেখে মনে হল ওটা আমার গত বারোবছর তিনমাস বিবাহিত জীবনের প্রতীক। তবে ওর মুখের কঠিন রেখাগুলো এখন ততটা স্পষ্ট নয়। বরং চিত্রাকে এখন অনেক নিরীহ মনে হচ্ছে। শুধু মুখে একটা বিস্ময়ের ছাপ। হবেই তো। আচমকা গলা টিপে ধরেছিলাম যে!

আলমারি খুঁজে বের করে নিলাম ওর গোটাপাঁচেক প্রিয় শাড়ি-ব্লাউজ। তার সঙ্গে যোগ হল একজোড়া শৌখিন জুতো, টুথব্রাশ, স্নো-পাউডার, লিপস্টিক, ময়েশ্চারাইজার, আর কিছু মেয়েলি জিনিস। সেগুলো একে-একে ভরে দিলাম টাইম লকারে। তারপর অনুতোষের নির্দেশ মতো ডায়াল ঘুরিয়ে বোতাম টিপে দিলাম।

এর কারণ নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন। আমার ফ্ল্যাট থেকে শুধু চিত্রা উধাও হয়ে গেলেই তো হবে না। তার সঙ্গে এই শাড়ি, জামাকাপড়, প্রসাধনের জিনিসও উধাও হওয়া দরকার। কারণ, কাল সকালেই আমি আমার সুইট ডার্লিং শ্বশুরমশায়কে টেলিফোনে জানিয়ে দেব যে, চিত্রা আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। কোথায় গেছে জানি না।

এই একই কথা বলব পাড়াপড়শিকে এবং পুলিশকে। তার পরই পুলিশ শুরু করে দেবে তাদের চুলচেরা অনুসন্ধানের কাজ।

যা ভেবেছিলাম তাই হল। শ্বশুরমশায় এবং পুলিশ–এই দু-তরফের জেরায়-জেরায় জেরবার হয়ে গেলাম আমি। কিন্তু একটুও ভেঙে পড়লাম না। কারণ, গতকাল রাতেই টাইম লকারের বোতাম টিপে দরজা খুলে দেখে নিয়েছি লকার খালি। সেখানে চিত্রার মৃতদেহ নেই, শাড়ি-ব্লাউজ নেই, স্নো পাউডার নেই, কিচ্ছু নেই। অনুতোষ আমাকে হাতেনাতে দেখিয়ে দিয়েছিল টাইম লকারের মাহাত্ম। কিন্তু তবুও যেন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। অনেকবার হাত বোলালাম টাইম লকারের ভেতরে। আঙুলের ডগায় শুধু ঠান্ডা ধাতুর পাতের ছোঁওয়া। চিত্রা ইত্যাদি সত্যিই মিলিয়ে গেছে হাইপারস্পেসে।

সুতরাং একটুও ভেঙে পড়িনি আমি। পুলিশি জেরা চলল সারাদিন ধরে। সম্ভব-অসম্ভব নানান প্রশ্ন করল ওরা। সব প্রশ্নের উত্তরই যে ঠিকঠাক দিতে পারছিলাম তা নয়। বেশ কয়েক জায়গায় ওলটপালট হয়ে যাচ্ছিল। আমার শ্বশুর পাইপ টানতে-টানতে পায়চারি করছিলেন ঘরে। যেন খুব কঠিন কোনও সমস্যার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সমাধানের পথ খুঁজছেন স্বয়ং পুলিশ কমিশনার। আর সাদা পোশাকের দুজন অফিসার তন্নতন্ন করে সার্চ করছিল আমার ফ্ল্যাট। ইউনিফর্ম পরা দুজন কনস্টেবল ফ্ল্যাটের দরজায় পাহারায় দাঁড়িয়ে।

চিত্রার মৃতদেহ উধাও হওয়ার পর টাইম লকারের ভেতরে টুকিটাকি কিছু জিনিস সাজিয়ে রেখেছিলাম কাল রাতেই কয়েকটা তুলি, প্যালেট, বোর্ডপিন, আর কাপ-প্লেট। পুলিশ অফিসাররা সেগুলোও খুঁটিয়ে দেখল। লকারের গায়ের ছোট ডায়াল আর বোতামটা দেখিয়ে প্রশ্ন করল আমাকে, এগুলো কী?

আমি নির্বিকারভাবে জবাব দিলাম, কী জানি না। মান্ধাতার আমলের পুরোনো ফ্রিজ। আমি স্রেফ আলমারি হিসেবে ব্যবহার করব বলে জলের দরে কিনেছি। তারপর রংচং করে নিয়েছি।

সুতরাং পুলিশের যাবতীয় তৎপরতার ফলাফল অশ্বডিম্ব। কিন্তু চলে যাওয়ার সময় আমার ডার্লিং শ্বশুর যেভাবে আমার দিকে তাকালেন তাতে বুঝলাম, উনি সহজে আমাকে ছেড়ে দেবেন না। কারণ, আর কেউ না জানুক উনি জানেন, চিত্রা কখনও অন্য কোনও পুরুষকে নিয়ে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখেনি। স্বামী হিসেবে আমাকে ওর খুব পছন্দ ছিল। এরকম ক্রীতদাস স্বামী যে সহজে পাওয়া যায় না!

আমার শ্বশুরের টাকাপয়সা অঢেল। ফলে নিষ্ফল তদন্ত করে করে পুলিশ যদি ঝিমিয়ে পড়ে তা হলে তাদের চাঙ্গা করে তোলার দাওয়াই তার জানা আছে। তাই মনে হয়, পুলিশ খুব সহজে চিত্রা অন্তর্ধান রহস্যের তদন্তে ক্ষান্তি দেবে না।

দেখা গেল, আমার কথাই ঠিক। দিনের পর দিন পুলিশ আমাকে বিরক্ত করে চলল। দু চার দিন বাদেদেই তারা নতুন-নতুন প্রশ্ন নিয়ে হাজির হতে লাগল। আর আমার হাসি পাচ্ছিল। একটা মৃতদেহের এত দাম! মৃতদেহ খুঁজে না পাওয়া গেলে পুলিশ সত্যি কত অসহায়!

যতই দিন যেতে লাগল পুলিশের প্রশ্নের সংখ্যা কমে আসতে লাগল। আমার শ্বশুরের কপালে এখন দুশ্চিন্তার বলিরেখা। মুখের সেই প্রতিজ্ঞার ছাপ কোথায় মিলিয়ে গেছে। দুনিয়ার আত্মীয়স্বজনের কাছে খোঁজ করেও চিত্রার হদিস পাননি উনি। এমন কী চিত্রা বিদেশে পাড়ি দিতে পারে এই সম্ভাবনার কথা ভেবে চিত্রার ফটো নিয়ে এয়ারপোর্টেও খোঁজ করেছে পুলিশ। কিন্তু সেখানেও হতাশা।

এইভাবে, বুঝলেন, যখন প্রায় একমাস কেটে গেছে, তখন একদিন সন্ধেবেলা আমার ডার্লিং এল আমার ফ্ল্যাটে। সঙ্গে সাদা পোশাকের স্বাস্থ্যবান একজন লোক। লোকটাকে আগে দেখিনি, তবে তার চোখের চাউনি আর চোয়ালের রেখা স্পষ্ট বলে দিল, সে পুলিশের লোক।

আমরা সোফায় বসে কথা বলছিলাম। পুলিশের লোকটা আমার হাত ধরে দুঃখপ্রকাশ করল। বলল, এতদিন ধরে আমরা অকারণে আপনাকে ট্রাল দিয়েছি, কিছু মনে করবেন না।

শ্বশুরমশায়ও দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, চিত্রার জন্যে খুব কষ্ট হচ্ছে। ও বড় জেদি মেয়ে। কে জানে অভিমান করে কোথায় চলে গেছে। দেখো, আমার মন বলছে, ও আবার একদিন তোমার কাছে ফিরে আসবে। তোমাকে সন্দেহ করেছিলাম বলে কিছু মনে কোরো না।

ওদের অনুতাপ আমাকে খুশি করল। এতদিনের শত্রুতার ভাবটা সরে গেল মন থেকে। আমার চোখের সামনে এখন একজন অসহায় পিতা আর একজন ব্যর্থ পুলিশ অফিসার। এতদিন ওদের জন্যে আতিথেয়তার ছিটেফেঁটাও করিনি। আজ, এখন, চায়ের অনুরোধ করলাম।

চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে সাধারণ কথাবার্তা হচ্ছিল। আমি আমার চিত্রাহীন নিঃসঙ্গ জীবনের কথা বলছিলাম। আমার শ্বশুরমশায় মাঝে-মাঝেই সহানুভূতি দেখাচ্ছিলেন।

হঠাৎই যে আমার কী হল কে জানে! সোফা ছেড়ে সটান উঠে চলে গেলাম টাইম লকারের কাছে। ওটার গায়ে চাপড় মেরে বললাম, এই পুরোনো বাচ্চা আলমারিটা চিত্রার ভীষণ পছন্দ হয়েছিল, জানেন। ও বলছিল, যদি ও সারাটা জীবন এতটুকু পুঁচকে একটা আলমারির ভেতরে কাটাতে পারত তা হলে বেশ হত।

বুঝতেই পারছেন, অহঙ্কার, স্রেফ অহঙ্কার। খুন করে সকলের চোখে ধুলো দিয়ে মেডেল গলায় ঝুলিয়ে চ্যাম্পিয়ন হওয়াটা তো কম কথা নয়। সুতরাং সেই অহঙ্কারের বশেই লকারের দরজাটা একটানে খুলে ফেললাম আমি। টুকিটাকি জিনিসে সাজানো ছিমছাম ভেতরটা দেখিয়ে ওদের বললাম, কী সুন্দর, না!

আর তখনই বেখাপ্পা ব্যাপারটা নজরে পড়ল আমার। এটা এল কোথা থেকে? একটা চিনেমাটির প্লেট, তার ওপরে একটা কাপ। কাপে লালচে মতন তলানি রয়েছে খানিকটা। আর সেই কাপ-প্লেটের পাশে রাখা একটা কাপ কাত হয়ে পড়ে গেছে।

বুঝতে পেরেছেন কি ব্যাপারটা? পারেননি? কী করে পারবেন! আমারই যে বুঝে উঠতে অনেকটা সময় লেগেছিল। তারপর বুঝতে পারলাম, এটা হল অনুতোষের সেই কাপ-প্লেটটাইম লকারের মাহাত্ম্য বোঝানোর জন্যে যে-কাপ-প্লেট লকারের ভেতরে রেখে উধাও করে দিয়েছিল অনুতোষ। এতদিন পর আচমকাই সেই কাপ-প্লেট ফিরে এসেছে হাইপারস্পেস থেকে। এখন মনে পড়ছে, অনুতোষ বলেছিল, ওর যন্ত্রটা এখনও গবেষণা স্তরে রয়েছে। শেষ পর্যন্ত যেরকম চেয়েছিল সেরকমটা হয়নি। সেইজন্যেই কি টাইম লকারে রেখে উধাও করে দেওয়া জিনিস কিছুদিন পর খেয়ালখুশি মতো ফিরে আসে হাইপারস্পেস থেকে!

আমার কপালে ঘামের ফোঁটা, মাথা ঝিমঝিম করছে। চোখে কি ঝাপসা দেখছি সবকিছু? কোনওরকমে টাইম লকারের দরজা বন্ধ করে দিলাম। তারপর দম বন্ধ করে অপেক্ষা করতে লাগলাম।

আমার শ্বশুরমশায় আর অফিসার ভদ্রলোক সোফা ছেড়ে উঠে পড়ছে না কেন? ওদের চা খাওয়া কি এখনও শেষ হয়নি?

ঠিক তখনই টুকিটাকি জিনিস পড়ে যাওয়ার শব্দ হল লকারের ভেতরে। আর-একটা বীভৎস উৎকট দুর্গন্ধে ভরে উঠল গোটা ঘরটা। একমাসের বাসী মৃতদেহের দুর্গন্ধ!

সঙ্গে-সঙ্গে চায়ের কাপে চুমুক দেওয়া থামিয়ে দু-জোড়া তীব্র চোখ তাকাল টাইম লকারের দিকে। পুলিশ অফিসারটি উঠে পড়ল সোফা ছেড়ে। এগিয়ে গেল লকারের দিকে।

আমি জানি, টাইম লকারের দরজা খুললে এখন কী চোখে পড়বে।

মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার ঠিক আগে আমার মনে হল, চিত্রাই জিতে গেল শেষ পর্যন্ত। আমাকে শায়েস্তা করতে ও হাইপারস্পেস থেকেও ফিরে এসেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress