Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » একতিলের জন্য || Anish Deb

একতিলের জন্য || Anish Deb

বেঁচে গেল অমৃতা।

প্রথমটা ও ঠিক বুঝতে পারেনি। ডানদিক দেখে, বাঁ-দিক দেখে, তারপর আবার বাঁ-দিকে তাকিয়ে রাস্তা পার হওয়ার জন্য একটা পা সামনে বাড়িয়েছে কি বাড়ায়নি–কোথা থেকে একটা মানুষ-বোঝাই মিনিবাস ছুটে এসে হুস করে বেরিয়ে গেল ওর নাকের ডগা দিয়ে। মিনিবাসের গা ঘেঁষে ছুটে যাওয়া বাতাসের ঝাপটা ওর সোনার নাকছাবিটা ছুঁয়ে গেল। মৃত্যুভয়ে অমৃতার শরীরটা পলকে পাথর হয়ে গেল।

মিনিবাসটা ডানদিক থেকে আচমকা ছুটে এসেছিল। ট্র্যাফিক লাইট সবুজ হয়ে থাকায় ওটা আর দাঁড়ায়নি–মরণপণ ছুট লাগিয়েছে বড় রাস্তা ধরে।

সন্ধের মুখে অফিসপাড়ায় ভিড় কিছু কম ছিল না। তাই অমৃতার একতিলের জন্য বেঁচে যাওয়াটা অনেকেরই নজরে পড়েছে। ব্যস্তসমস্ত হয়ে বেশ কিছু মানুষ ছুটে এল ওর কাছে। শুরু হয়ে গেল চেঁচামেচি, গুঞ্জন, জ্ঞানবর্ষণ এবং কলকাতার জঘন্য যানবাহন চলাচল-ব্যবস্থা নিয়ে বিচিত্র সব মন্তব্যের ফুলঝুরি।

চারপাশের প্রায় কোনও কথাই অমৃতার কানে ঢুকছিল না। পাথর হয়ে ও শুধু ভাবছিল, কেমন করে বেঁচে গেলাম? মরে গেলে বেশ হত…পিছনে কাঁদার কেউ ছিল না। একা-একা অনেকগুলো বছর কেটে গেছে। বসন্ত কবে থেকেই যাই-যাই করছে–তাকে সরিয়ে দিয়ে হেমন্ত উঁকিঝুঁকি মারতে শুরু করেছে।

নাঃ, শুধু গানকে আঁকড়ে ধরে বাঁচা যায় না। অমৃতা এখন একজন পুরুষকে আঁকড়ে ধরতে চায়–অন্তত একটিবারের মতো।

ওর গানের প্রশংসা অনেকে করে। পুরুষরাই বেশি। কিন্তু ওই পর্যন্তই। গান ডিঙিয়ে ওরা আর এগোতে চায় না। অমৃতার চেহারা ওদের থামিয়ে দেয়। ওরা সৌজন্যের হাসি হেসে চলে যায়। ওদের আড়ো-আড়ো ছাড়ো-ছাড়ো ব্যবহার অমৃতাকে মনে পড়িয়ে দেয় ওকে দেখতে মোটেই ভালো নয়। ওর মুখটা অচল পয়সার মতো।

আচ্ছা, রূপই কি সব! মনটা কিছু নয়!

তিলতিল সাধনা করে গান শিখেছে অমৃতা। গানকে সুন্দর করে তুলেছে। তেমনই মনটাকেও ও সুন্দর করে তুলেছে। অথচ সেটার খবর কেউ জানতেই চাইল না!

গান গেয়ে এখন যৎসামান্য নাম-ডাক হয়েছে ওর। সকলেই এগিয়ে আসে ওই গান পর্যন্ত বাইরের কুরূপের আড়াল সরিয়ে মনের অন্দরে কেউ উঁকি দিতে চায় না।

আপনি খুব লাকি।

ভরাট পুরুষালি কণ্ঠস্বরে চমকে উঠল অমৃতা। মুখ ঘুরিয়েই দেখতে পেল সুন্দর চেহারার এক তরুণকে। কাটা কাটা নাক, ঠোঁট, চোখে এক অদ্ভুত দীপ্তি। ফরসা রং, একমাথা চুল, গায়ে ঢোলা জিন্স-এর শার্ট, পায়ে বাদামি কটন প্যান্ট, কোমরে চওড়া বেল্ট হাতে ছোট্ট একটা ব্রিফকেস।

আর গায়ে কেমন এক হালকা পুরুষ-পুরুষ গন্ধ।

এক নিশ্বাসে যুবকটিকে জরিপ করে নিল অমৃতা।

গানের ক্যাসেটে অমৃতার কোনও ছবি ছাপা হয় না। তাই ওর যারা ফ্যান তারা বেশিরভাগই ওকে চেনে না। বছরে দু-চারটে ফাংশান করে অমৃতা। তার দৌলতে কিছু লোক ওকে চেনে। এই পুরুষটি…।

আপনি যেভাবে বেঁচে গেলেন সেটাকে মিরাকল বলে। চওড়া হাসল ছেলেটি : এখন কোথাও বসে একটু রেস্ট না-নিয়ে কিছুতেই যেন বাড়ির দিকে রওনা হবেন না! এরকম বিপদ থেকে বাঁচলে পর মনটাকে সেল করার টাইম দিতে হয়।

অমৃতা ফুটপাথের ওপর সরে এসেছিল। চারপাশে নজর বুলিয়ে দেখল, সবাই যে-যার কাজে ব্যস্ত–অমৃতার দিকে নজর দেওয়ার সময় কারও নেই। তবুও অমৃতা একটু অস্বস্তি পাচ্ছিল।

আপনি গান করেন?

একটা ধাক্কা খেল অমৃতা। আবার সেই গানের প্রশংসা, ন্যাকা-ন্যাকা অভিনন্দন, তারপর পিঠ বাঁচিয়ে পিঠটান! এর চেয়ে মিনিবাসের ধাক্কা অনেক ভালো ছিল।

কী করে বুঝলেন? ভীষণ রুক্ষভাবে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিল অমৃতা। তার পর আরও বিরক্ত হয়ে? আপনি জ্যোতিষী না কি?

উত্তরে মিষ্টি করে হাসল ও না, জ্যোতিষী নয়…পরপর তিনদিন ওই রেকর্ডিং স্টুডিয়োটা থেকে আপনাকে বেরোতে দেখলাম…তাই। আমি গান ভালোবাসি, তবে ভালো বুঝতে পারি না বলে সবসময় কাঁচুমাচু হয়ে থাকি। যেমন এখন।

অমৃতার হাসি পেয়ে গেল। ছেলেটিও হাসছে। ওর মুখটা মোটেই কাঁচুমাচু মনে হচ্ছে না। তবে সন্দেহ একটা তৈরি হচ্ছিল অমৃতার মনে। মেয়েদের সঙ্গে গায়ে পড়ে যারা আলাপ করতে চায় এই ছেলেটি কি সেই দলের? বোধহয় না। কারণ আজ পর্যন্ত অমৃতার সঙ্গে গায়ে পড়ে কেউ আলাপ করতে চায়নি। কোনও গীতিকার, সুরকার, কিংবা ক্যাসেট কোম্পানির মালিক কখনও ওকে উলটোপালটা প্রস্তাব দেয়নি। কেউ ডিনারে নিয়ে যেতে চায়নি। কেউ সন্ধের পর ওর এক কামরার ফ্ল্যাটে আসতে চায়নি। পুরুষের হ্যাংলাপনা থেকে ও বরাবরই নিরাপদে থেকেছে–পঞ্চাশ কি ষাট পেরোনো কোনও মহিলা যেমন নিরাপদ।

আপনি কি রোজ এই স্টুডিয়োর ওপর নজর রাখেন না কি?

না। আসলে সেলসম্যানের চাকরি করি। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ানোই আমার পেশা। তারই মাঝে ফাঁক পেলে মানুষ দেখি…ওটা আমার নেশা। এই যে, আমার কার্ড…। কথা শেষ হতে-না হতেই জামার পকেট থেকে একটা ভিজিটিং কার্ড বের করে অমৃতার হাতে তুলে দিয়েছে ছেলেটি।

রাস্তার সোডিয়াম-আলোয় কার্ডটা পড়তে পারল অমৃতা।

সুকান্ত চক্রবর্তী। বি. এ. এল. এল. বি.। সেলস এক্সিকিউটিভ।

তার নীচে একটা সাহেবি ধরনের কোম্পানির নাম লেখা।

আপনার পারসোনালিটি আমাকে খুব স্ট্রাইক করেছে। মিনিবাসের ওরকম ডেঞ্জারাস অ্যাক্সিডেন্ট থেকে বেঁচে যাওয়ার পর আপনাকে যেরকম স্টেডি দেখলাম…রিয়েলি…খুব রেয়ার কোয়ালিটি। যাদের মনের জোর খুব বেশি তাদের সঙ্গে আলাপ করতে আমার ভালো লাগে।

কেন?

আমার মনের জোর কম–তাই।

অমৃতা ছোট্ট করে হাসল। মনে মনে ভাবল, দেখাই যাক না, আলাপটা কতদূর গড়ায়। সুকান্তকে দেখে মনে হচ্ছে না ও সুযোগ-খোঁজা পুরুষের দলে। সেরকম হলে ও অনায়াসে কোনও সুন্দরী মেয়েকে বেছে নিত। সুন্দরী না-হোক, অন্তত অমৃতার মতো বত্রিশ-তেত্রিশের কোনও অসুন্দরী মেয়েকে বেছে নিত না।

আচ্ছা, প্রেম কি এভাবেই শুরু হয়?

ধুৎ, কীসব যা-খুশি ভাবছে অমৃতা। মনে হয়, সুকান্ত..।

আমরা কি এভাবে রাস্তায় দাঁড়িয়েই কথা বলব? সুকান্ত জিগ্যেস করল, যদি আপনার অমত না-থাকে আমরা কোনও একটা দোকান-টোকানে বসতে পারি। অবশ্য আপনার তাড়া থাকলে অন্য কথা।

তাড়া? আগামী একশো বছরে অমৃতার কোনও তাড়া নেই।

সুতরাং কথা বলতে বলতে একটা ছোটখাটো রেস্তোরাঁয় পৌঁছে গেল ওরা।

ধোঁয়া-ওঠা ফিশ ফ্রাই সামনে রেখে মুখোমুখি বসে চলল কথার-পর কথা।

জানেন, একসময় আমার গায়ক হওয়ার শখ ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হল না।

কেন? আপনার গলার স্বর তো বেশ…।

দোয়াত আছে, কালি নেই। স্বর আছে, সুর নেই। হাসল সুকান্ত। তারপর আলতো করে বলল, আপনার দুটোই আছে। ভগবান আপনাকে অনেক কিছু দিয়েছেন।

মাথা নাড়ল অমৃতা : দিয়েছে আবার অনেক কিছু দেয়নি। কথাটা বলতে গিয়ে অমৃতার গলা কেঁপে গেল।

সুকান্ত বুঝল। বলল, মনখারাপ করবেন না। ভগবান লোকটা কৃপণ নয়। আপনাকে যা দিয়েছে তা-ই যথেষ্ট। ভাবুন তো, যদি এই জীবনটাই আপনাকে না-দিত! তখন তো অনেক কিছুই আপনি হারাতেন। এই যে এখন এই রেস্তোরাঁয় বসে আপনার সঙ্গে গল্প করছি, সেটাও হত না। তার মানে আমিও অনেক কিছু হারাতাম।

অমৃতা সুকান্তর মুখের দিকে তাকাল। সুকান্তর কথাগুলো ওর ভালো লেগেছে বলেই তার মধ্যে তোয়াজ আছে কি না খুঁজল।

না, সেরকম কোনও ইশারা পেল না।

আপনাকে একটা মনের কথা বলি, ম্যাডাম। এই দেওয়া-নেওয়া ব্যাপারটা ভারি মিস্টিরিয়াস। এক ধরনের মানুষ আছে যারা কিছু দিলে তার বদলে কিছু নেয়…।

ঘাড় নেড়ে সায় দিল অমৃতা। হ্যাঁ, এইরকম মানুষ ও দেখেছে।

ফিশ ফ্রাই-এর টুকরো চিবোতে চিবোতে সুকান্ত বলল, ম…ম…ম..আর-এক টাইপের মানুষ আছে যারা কিছু দিলে তার বদলে কিছু নিতে চায় না।

আপনি কোন টাইপের? অমৃতা মজা করে জিগ্যেস করল।

সেটা বললে কি আপনি বিশ্বাস করবেন? বরং খানিকটা বন্ধুত্ব হোক, তা হলে টের পাবেন।

তারপর অমৃতার গানের কথা জানতে চাইল সুকান্ত। অমৃতা বলতে লাগল, সুকান্ত মনোযোগী ছাত্রের মতো শুনতে লাগল। সময় কাটতে লাগল একটু-একটু করে।

অনেক গল্পের পর ওরা উঠল।

সুকান্ত একরকম জোর করেই রেস্তোরাঁর বিল মিটিয়ে দিল।

তারপর রাস্তায় পা দিয়ে বলল, আপনি এখন বাড়ি ফিরবেন তো?

হ্যাঁ–।

আপনার বাড়িতে আর কে-কে আছে?

কেউ না। আমি একা। একটা বড় শ্বাস ফেলল অমৃতা : শুধু-আমি, আর গান। মা-বাবা আর ছোট ভাই দেশের বাড়িতে থাকে। আমার এই গানের ব্যাপারটা ওরা খুব একটা পছন্দ করে না। আমাকে অনেক স্ট্রাগল করতে হয়েছে।

সেটা আপনাকে দেখে বোঝা যায়।

আপনার বাড়িতে কে কে আছে?

সবাই। তবে মনে-মনে আমি সবসময় একা-একা থাকি।

কেন?

দুঃখ পাওয়া আমার ছোটবেলাকার অভ্যেস। তাই সুখের হদিস পেলে খুব ভয় পাই। এই বুঝি সুখের খেলনাটা কেউ কেড়ে নিল। তাই মনে-মনে একা থাকাটাই ভালো।

আমার ব্যাপারটাও অনেকটাই তাই। মনখারাপ গলায় বলল অমৃতা।

মোটেই না। আপনার গান আছে। এখন বাড়ি গিয়ে আপনি গানের রেওয়াজ করতে বসবেন। আর আমি? হুঁ…চারপাশে আড়াল তুলে আকাশপাতাল ভাবব। তবে আজ হয়তো আপনার কথা ভাবব। কালও, পরশুও…। সেইজন্যেই আমার আজ বাড়ি ফেরার তাড়া নেই।

অমৃতা সুকান্তকে দেখল। রাস্তার ঠিকরে পড়া আলোর ওর মুখে হাইলাইট তৈরি হয়েছে। সেখানে নুন-গোলমরিচের মতো দুঃখ ছিটিয়ে দিয়েছে কেউ।

জিগ্যেস করে জানল সুকান্তর বাড়ি টালিগঞ্জে। তাও ওর বাড়ি ফেরা তাড়া নেই! সেকি অমৃতার জন্য?

অসম্ভব। মনে-মনে নিজেকে এক বকুনি লাগাল অমৃতা। একটু আলাপ হতে-না-হতেই বুকের ভেতরে সারস পাখি ডানা মেলে দিয়েছে!

আপনার বাড়ি কোথায়? সুকান্ত জানতে চাইল।

কলেজ স্ট্রিটের কাছে…সূর্য সেন স্ট্রিটে…।

আপনার সঙ্গে কথা বলতে খুব ভালো লাগছিল। আপনার বাড়ি গেলে আপনাকে ব্রিফকেসটা খুলে দেখাতে পারতাম। রাস্তায় তো দেখানো যায় না!

কী আছে আপনার ওই ব্রিফকেসে? হেসে জিগ্যেস করল অমৃতা।

আমার সবকিছু। আমার জীবনদর্শন। মানে…ঠিক বোঝাতে পারছি না। থাকগে, পরে কখনও দেখানো যাবে।

ব্রিফকেসটা কি অজুহাত? এই ছুতোয় অমৃতার ফ্ল্যাটে গিয়ে ওর সঙ্গ চাইছে সুকান্ত? না, না, প্রথম আলাপেই এতটা দুঃসাহসী কেউ হবে না। তা ছাড়া, ও যদি আজ চলে যায়, আবার কবে ওর সঙ্গে অমৃতার দেখা হবে…।

চলুন, আপনাকে কলেজ স্ট্রিট পর্যন্ত এগিয়ে দিই। নীচু গলায় সুকান্ত বলল।

ওর কি অভিমান হল? নিশ্চয়ই ও অমৃতাকে ভীতু ভাবছে।

আপনার ব্রিফকেসে কী আছে ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করছে। কিশোরী গলায় আবদার করল অমৃতা।

খুব দেখতে ইচ্ছে করছে?

ইয়েস, খুব।

ও. কে.। তা হলে দুটো অপশান দিচ্ছি। আপনার বাড়ি যাব না। বি–আপনার বাড়ি যাব। বলুন, আপনার চয়েস কোনটা?

বি।

শিয়োর।

হ্যাঁ।

কনফিডেন্ট?

ইয়েস।

ফাইনাল জবাব? কম্পিউটার লক কর দিয়া যায়ে?

হ্যাঁ।

ও. কে. ডান। বলে হেসে অমৃতার দিকে ডানহাত বাড়াল সুকান্ত।

অমৃতাও হাত বাড়াল।

ওরা হ্যান্ডশেক করল।

ঠিক তখনই অচেনা এক উত্তেজনার তরঙ্গ অসংখ্য ডালপালা মেলে ছড়িয়ে গেল অমৃতার শরীরে। অমৃতার ভালো লাগল। এরকম নতুন ভালো-লাগা আগে কখনও ও টের পায়নি।

হাত নেড়ে একটা ট্যাক্সি দাঁড় করাল সুকান্ত। তারপর দুজনে উঠে পড়ল তাতে। অমৃতা লক্ষ করল, সুকান্ত ভদ্রমাপের দূরত্ব রেখেই পাশে বসল।

মিনিটকুড়ির মধ্যেই অমৃতার বাড়ির কাছে পৌঁছে গেল ট্যাক্সি। অমৃতা কিছু বলে ওঠার আগেই সুকান্ত ভাড়া মিটিয়ে দিল। তারপর ঢুকে পড়ল সদর দরজা পেরিয়ে।

বাড়িটা বেশ পুরোনো। দু-পাশে দুটো বাড়ির দেওয়ালে দেওয়াল সাঁটিয়ে তৈরি। দু-পাশের বাড়ি দুটো রং-চং করে ভোল ফেরানো হয়েছে। তাদের তুলনায় মাঝেরটা বয়েসের ভারে এতই নুয়ে পড়েছে যে, পাশের বাড়ি দুটো যেন দু-পাশ থেকে বাড়িটাকে সযত্নে সামলে রেখেছে। গান্ধীজির কথা মনে পড়ে গেল সুকান্তর–দুই সঙ্গিনীর কাঁধে ভর দিয়ে তার পথ চলা।

অমৃতার ফ্ল্যাট তিনতলায়। ফ্ল্যাট না-বলে আস্তানা বলাই ভালো। তবে ও নিজের মতো করে একটু-আধটু সাজিয়ে নিয়েছে।

ঘরে ঢুকে টিউব লাইট জ্বেলে দিল অমৃতা। ছোট্ট করে হেসে সুকান্তকে আহ্বান জানাল ও আসুন।

সুকান্ত চৌকাঠ পেরিয়ে ঘরে ঢুকল। তারপর দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে খিল আর ছিটকিনি এঁটে দিল।

অমৃতা একটু অবাক হল। সেইসঙ্গে একটু বিরক্ত। কিন্তু ধৈর্য না হারিয়ে ও শান্ত গলায় প্রশ্ন করল, দরজা বন্ধ করলেন কেন?

সুকান্ত একটু বিব্রত হয়ে বলল, যদি হুট করে কেউ এসে পড়ে। এসময়ে কেউ এসে পড়লে আমার ভীষণ নার্ভাস লাগবে।

কেন, নার্ভাস লাগার কী আছে! দরজাটা খুলে বরং পরদাটা টেনে দিন। বুঝতেই তো পারছেন…মি ক্লাস পাড়া…এখানে পান থেকে চুন খসলেই লোকের জিভ লকলক করে।

দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়াতে লাগল সুকান্ত। মিনমিন করে বলল, ঠিক আছে, খুলে দিচ্ছি। তার আগে আপনি টিভিটা চালিয়ে দিন।

এই অনুরোধটা অমৃতাকে অবাক করে দিল। কিন্তু ও কিছু বলল না। ঘরের এককোণে চোদ্দো ইঞ্চি একটা কালার টিভি দাঁড় করানো ছিল। ও পায়ে-পায়ে এগিয়ে গিয়ে সেটা অন করে দিল। তারপর ঘরের দুটো বন্ধ জানলা খোলার জন্য পা বাড়াতেই সুকান্তর গলা ওকে থামিয়ে দিল।

ওসব পরে হবে, ম্যাডাম–আগে আমার ব্রিফকেসটা দেখে নিন।

অমৃতা অবাক হয়ে ফিরে তাকাল সুকান্তর দিকে। ওর আচরণে কোথায় যেন একটু সুর কেটে গেছে।

কী চায় সুকান্ত? সব পুরুষ যা চায় তাই? কিন্তু অমৃতার কাছে তোত কেউ কখনও তা চায়নি! চাইলে কী হত কে জানে! অমৃতা হয়তো খুশি হয়ে সবকিছু উজাড় করে দিত। হয়তো দিত না। কিন্তু সুকান্তকে পছন্দ হয়েছে বলেই না ওকে ঘর পর্যন্ত নেমন্তন্ন করেছে!

অমৃতার হঠাৎই খেয়াল হল, সুকান্ত এখনও দাঁড়িয়ে আছে। তাই বলল, বসুন।

সুকান্ত ঘরের দেওয়াল ঘেঁষে রাখা একটা সোফায় বসল।

সামনেই খাটো টি-টেবল। তার ওপরে ব্রিফকেসটা রেখে শব্দ করে লক খুলল। তারপর ধীরে-ধীরে ঢাকনা তুলল।

অমৃতার চোখের নজর ঢাকনার দেওয়ালে আটকে গেল। ব্রিফকেসের ভেতরটা ও দেখতে পাচ্ছিল না। তবে ঢাকনার ওপর দিয়ে সুকান্তর মুখটা দেখা যাচ্ছিল।

একটু চা করি আপনার জন্যে?

ব্রিফকেসের ভেতরটা মনোযোগ দিয়ে দেখছিল সুকান্ত। অমৃতার প্রশ্নে চমকে মুখ তুলে তাকাল। বলল, না, এখন চায়ের তেষ্টা নেই। আগে এগুলো আপনাকে দেখাই…।

অমৃতা সুকান্তর কাছে এগিয়ে আসতে যাচ্ছিল, কিন্তু তখনই ফোন বেজে উঠল। তাই থমকে দাঁড়িয়ে ও টিভির পাশে রাখা টেলিফোনের রিসিভার তুলে নিল।

ফোনে কথা বলতে বলতেই অমৃতা দেখল সুকান্ত কয়েকটা কাগজ ব্রিফকেস থেকে বের করে টেবিলের ওপরে সাজিয়ে রাখল। তারপর অমৃতার মুখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল।

ফোনে কথা বলা শেষ হতেই কাগজগুলো তুলে নিল সুকান্ত। চট করে উঠে দাঁড়াল। অমৃতার দিকে দু-পা এগিয়ে কাগজগুলো বাড়িয়ে দিল ওর দিকে, বলল, এগুলো একটু পড়ে নিন…তা হলে সুবিধে হবে।

অমৃতা অবাক চোখে সুকান্তর দিকে তাকিয়ে কাগজগুলো নিল।

অনেকগুলো খবরের কাগজের কাটিং। সাদা কাগজে আঠা দিয়ে লাগানো। ওপরে এককোণে তারিখ লেখা। আট-দশটা কাগজ সুকান্ত ওকে পড়তে দিয়েছে।

অমৃতা কাগজগুলো পড়ছিল। সেই ফাঁকে সুকান্ত টিভির কাছে গিয়ে ভলিয়ুমটা বেশ বাড়িয়ে দিয়েছে।

কাটিংগুলো পড়তে-পড়তে অমৃতার দম আটকে এল। কাগজ-ধরা হাতটা কাঁপতে লাগল থরথর করে।

একজন খুন-পাগল মানুষের কথা লিখেছে। পরিভাষায় যাকে বলে সিরিয়াল কিলার। খবরের কাগজওয়ালারা তার নাম দিয়েছে নাইফম্যান। অজানা-অচেনা এই খুনি গত ছ-মাসে পাঁচটি মেয়েকে নৃশংসভাবে খুন করেছে। প্রতিটি মেয়ের শরীরে অসংখ্য ছুরির আঘাত ছিল। বিশেষ করে তাদের মুখগুলো এমনভাবে বিকৃত করা হয়েছে যে, ঠিকমতো শনাক্ত করাই মুশকিল হয়ে পড়েছে। পাঁচটি ক্ষেত্রেই ক্ষতবিক্ষত নগ্ন মৃতদেহ পায় পুলিশ। তারা আপ্রাণ চেষ্টা করেও খুনের মোটিভ বুঝতে পারেনি–খুনিকে ধরা তো দূরের কথা! এই পাঁচজন ভিকটিমের মধ্যে এমন কোনও মিল পুলিশ খুঁজে পায়নি যা থেকে বলা যায় একটি বিশেষ ধরনের মেয়েই খুনির শিকার হতে পারে। কোনও ক্ষেত্রে খুন হয়েছে নির্জন রাস্তায়। কখনও-বা খোলা মাঠে কিংবা পার্কে। আবার কখনও মেয়েটিকে খুন করা হয়েছে তার ফ্ল্যাটে। অর্থাৎ, মোডাস অপারেন্ডাই-এরও কোনও সুনিশ্চিত ধারা খুঁজে বের করা যায়নি। শুধু এটুকু পুলিশ বুঝতে পেরেছে, খুনির পছন্দ ছুরি। তা-ও একরকম নয়নানা ধরনের। তিনটে খুনের বেলায় দেখা গেছে, খুনি প্রতিটি ক্ষেত্রে কম করেও চাররকমের ছুরি বা ধারালো অস্ত্র ব্যবহার করেছে। সেই কারণেই কোনও-কোনও সাংবাদিক ঠাট্টা করে মন্তব্য করেছে : খুনির বোধহয় ছুরি কাঁচির দোকান আছে।

অমৃতা কাগজে নাইফম্যান-এর কথা পড়েছিল। গত পনেরো-বিশদিনে স্মৃতি যেটুকু বা ঝাপসা হয়ে এসেছিল, খবরের কাগজের কাটিংগুলো পড়তে শুরু করামাত্র সব মনে পড়ে গেছে। সঙ্গে-সঙ্গে কয়েক হাজার ভোল্টের বিদ্যুৎ খেলে গেছে অমৃতার শরীরে। ওর হাত-পা কাঁপতে শুরু করেছে। কেন যে ও অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে না, সেই কথা ভেবে ও অবাক হয়ে যাচ্ছিল।

এইবার সবকিছুর মানে ধীরে-ধীরে ওর কাছে স্পষ্ট হল।

কেন সুকান্ত গায়ে পড়ে ওর সঙ্গে আলাপ করেছে। কেন ওর সঙ্গে বাড়ি আসতে চেয়েছে। কেন জানলা খুলতে বারণ করেছে। কেন টিভির ভলিয়ুম বাড়িয়ে দিয়েছে।

অমৃতা এখন না দেখেও বুঝতে পারছে সুকান্তর ব্রিফকেসের মধ্যে কী আছে।

অমৃতার হাত থেকে কাগজগুলো খসে পড়ে গেল।

যেন তেমন কিছুই হয়নি এমন ভঙ্গিতে সুকান্ত সেগুলো কুড়িয়ে নিল। তারপর চাপা গলায় খুকখুক করে হাসতে-হাসতে ঢাকনা খোলা ব্রিফকেসের কাছে গেল। কাগজগুলো ব্রিফকেসের পাশে রেখে একজোড়া সার্জিক্যাল গ্লাভস বের করে নিল।

রবারের গ্লাভস টেনে পরতে-পরতে নির্লিপ্ত গলায় বলল, এখন আপনার আর কোনও উপায় নেই..অপেক্ষা করা ছাড়া…।

কীসের অপেক্ষা? চাপা খসখসে গলায় জিগ্যেস করল।

নিয়তির.. গ্লাভস পরা শেষ করে সুকান্ত বলল। ওর হাত দুটো এখন কী শক্তিশালী আর পুরুষালি মনে হচ্ছে।

অমৃতা চিৎকার করার জন্য চেষ্টা করতে যাচ্ছিল, কিন্তু চিৎকারটা ওর গলা দিয়ে বেরোল না। কারণ, ঠিক তক্ষুনি সুকান্ত হাতের একটানে ব্রিফকেসটা অমৃতার দিকে ঘুরিয়ে দিয়েছে। আর অমৃতা দেখতে পেয়েছে সুকান্তর সবকিছু, সুকান্তর জীবনদর্শন।

ব্রিফকেসের ভেতরটা ঝকঝক করছে।

নানা ধরনের নানা মাপের পাঁচটা ছুরি সেখানে শুয়ে আছে। কারও ফলা সোজা, কারও ফলা বাঁকানো, আবার কারও-বা করাতের মতো খাঁজ কাটা।

সুকান্ত একটা বড় মাপের ছুরি হাতে তুলে নিল। সেটা ডাক্তারি নজরে খুঁটিয়ে পরখ করতে করতে বলল, চিৎকার করতে চাইছেন? চাইতেই পারেন। তবে ওই যে, কে যেন বলে গেছেন, চাওয়া আর পাওয়ার মাঝে খানিকটা ফাঁক থেকে যায়। এখানে সেই ফাঁকটা তৈরি করবে এই ছুরিটা– আপনার গলায়…গানের গলায়। আর যদি একটুকরো চিৎকার ভুল করে গলা দিয়ে বেরিয়ে যায় তা হলেও অসুবিধে নেই। ওই টিভির শব্দ সেটাকে চাপা দেবে…।

সুকান্ত একচিলতে হাসল, তবে হাসিটা ঠোঁটেই থেকে গেল–চোখ পর্যন্ত ছড়াল না।

আ-আমি বাঁচতে চাই…। কাঁপা গলায় বলল অমৃতা।

আবার সেই চাওয়া! গ্লাভস-পরা হাতে ছুরিটা ধরে অমৃতার কাছে এগিয়ে এল সুকান্ত। চাপা গলায় প্রায় ফিশফিশ করে বলল, কাগজগুলো পড়ে তো দেখলেন, আমি কেন খুন করি কেউ জানে না। আপনাকে বলতে পারি…আপনি জানলে কোনও অসুবিধে নেই, কারণ, আপনার জানাটা আর কেউ জানতে পারবে না। আপনার চুলটা খুলে ফেলুন।

শেষ কথাটা একই ঢঙে বলে ফেলায় অমৃতা ঠিক বুঝতে পারেনি।

সুকান্ত আবার বলল, মাথার চুলটা খুলে ছড়িয়ে দিন।

ঠান্ডা গলায় কথাটা বলে বাঁ-হাতে আলতো করে অমৃতার চুলে হাত দিল সুকান্ত।

অমৃতা শিউরে উঠল। তাড়াতাড়ি মাথার পিছনে হাত দিয়ে শৌখিন ক্লিপটা খুলে ফেলে দিল মেঝেতে। তারপর মাথা ঝাঁকিয়ে চুলগুলো ছড়িয়ে দিল পিঠের ওপরে।

সুকান্ত খুব খুঁটিয়ে অমৃতাকে দেখতে লাগল। ওর চুল পরখ করতে করতে চলে এল অমৃতার পিছনে। মাথা ঝুঁকিয়ে ফুঁ দিল চুলে। কয়েকটা চুল উড়ল কি উড়ল না।

অপছন্দের ঢঙে মাথা নাড়ল সুকান্ত? উঁহু, আপনার চুল তেমন লম্বা নয়। রেশমের মতো ফিনফিনেও নয়…।

বিড়বিড় করে কথা বলতে বলতে অমৃতার চুলে হাত দিল। আলতো করে ওর চুলের গোছা ধরে মুখ নামিয়ে ঘ্রাণ নিল। আবার এপাশ-ওপাশ মাথা নাড়ল।

অমৃতা কাঠ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। প্রাণপণে ঠোঁট চেপে রাখা সত্ত্বেও একটা মিহি গোঙানির টুকরো কীভাবে যেন বাইরে বেরিয়ে আসছিল। বড়-বড় শূন্য চোখে টিভির দিকে ও তাকিয়ে ছিল– কিন্তু ওর চোখ কিছু দেখতে পাচ্ছিল না। আর কানেও কোনও শব্দ ঢুকছিল নাসুকান্তর ঘন নিশ্বাসের শব্দ ছাড়া।

অমৃতার চুলের গোছা একপাশে সরিয়ে ওর ঘাড়ের হালকা পালকের মতো চুলে ফুঁ দিল সুকান্ত।

অমৃতা শিউরে উঠল।

চুলের গোছা ছেড়ে দিয়ে হুট করে সামনে চলে এল সুকান্ত। সরল চোখে ওর দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বলল, আমি কেন খুন করি জানেন? পৃথিবীকে সুন্দর করে তোলার জন্যে। আর সুন্দর করে তুলতে হলে অসুন্দরকে বিসর্জন দিতে হয়। যেমন, ফুলের বাগানকে সুন্দর করে তোলার জন্যে আগাছা উপড়ে ফেলতে হয়…।

সুকান্ত বড়-বড় শ্বাস নিচ্ছিল আর হাতে-ধরা ছুরিটা অমৃতার গায়ে ছোঁয়াচ্ছিল।

মাসছয়েক ধরে আমি এই সুন্দর করার কাজে নেমেছি। তাই অসুন্দরকে খতম করাই এখন আমার একমাত্র লক্ষ্য…। হাসল সুকান্ত। তারপর ও আপনি তো জানেন, অসুন্দর থেকে অসুন্দরের জন্ম হয়। তাই মেয়েদের দিয়ে কাজ শুরু করেছি। আপনি ছনম্বর। এবার শাড়িটা খুলে ফেলুন।

আবারও বুঝতে পারেনি অমৃতা। কারণ, একটানা সুরে বেশ মোলায়েম গলায় কথাটা বলেছে সুকান্ত।

অমৃতা ইতস্তত করছে দেখে সুকান্ত ছোট্ট করে হাসল, বলল, যে-কাজ নিজে পারেন সেটা আমাকে দিয়ে করাবেন না…করালে আপনার ভালো লাগবে না। শাড়িটা খুলে ফেলুন।

এইমুহূর্তে কেউ কি এসে অমৃতার ঘরে কড়া নাড়বে না? এমন কিছু কি একটা হতে পারে না যাতে সুকান্ত অমৃতাকে ছেড়ে পালিয়ে যায়? একটা লাইফলাইনও কি অমৃতার কপালে নেই?

শাড়ি খুলতে শুরু করল অমৃতা। ওর মনে লজ্জা যেটুকু-বা তৈরি হচ্ছিল তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরল একরাশ ভয়। সুকান্তর হাতের ছুরিটা কখন ওর গায়ে বসবে? কখন?

সুকান্ত একটু পিছিয়ে দাঁড়াল। অমৃতার শাড়ি খোলা দেখতে লাগল।

কোনও পুরুষের সামনে ও পোশাক ছাড়বে এমন গোপন ইচ্ছে অমৃতার ছিল। কিন্তু সেটা যে এইরকম একটা অবস্থায়, তা ও কল্পনা করেনি। ওর কপালে ঘাম ফুটে উঠেছিল অনেক আগেই। এখন কয়েকটা ফোঁটা একজোট হয়ে নাকের পাশ দিয়ে গড়িয়ে নেমে এল। তারপর ঠোঁটের কোণ ছুঁতেই নোনা স্বাদ টের পেল।

কাগজওয়ালারা আমার নাম দিয়েছে নাইফম্যান। হাসল সুকান্ত। আপনমনে মাথা নাড়ল। তারপর বলল, আসলে আমি কী জানেন? লাইফম্যান। কুৎসিত জীবন থেকে মুক্তি দিই সুন্দর জীবনে। কারণ, মৃত্যু না-হলে তো পুনর্জন্মের কোনও চান্স নেই! আগে যে-পাঁচটা কুৎসিত মেয়েকে আমি মুক্তি দিয়েছি তার বিনিময়ে আমি কিন্তু কিছু নিইনি। আপনাকে তো আগেই বলেছি, কিছু দিলে তার বদলে কিছু-না-কিছু নেওয়া অনেকের অভ্যেস। আমি সেরকম শাইলক নই। আমি যা দিই এমনি দিই। ফ্রি।

দুঃখ দিলে সেটাকে কি দেওয়া বলে? মৃত্যু দিলে সেটাও কি দেওয়া?

অমৃতার সবকিছু কেমন গুলিয়ে যাচ্ছিল। ও যন্ত্রের মতো শাড়ি খোলা শেষ করে ফেলেছিল। শাড়িটা পায়ের কাছে জড়ো হয়ে পড়েছিল। সুকান্ত পা দিয়ে ওটাকে সরিয়ে দিল একপাশে।

সত্যি কথা বলুন তো, ম্যাডাম, এইরকম একটা বিচ্ছিরি রূপ নিয়ে আপনার বাঁচতে ইচ্ছে করে?

অমৃতা বোবা চোখে সুকান্তর দিকে তাকিয়ে পাগলের মতো মাথা নেড়ে বলতে চাইল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, হ্যাঁ বাঁচতে ইচ্ছে করে…।

কিন্ত সুকান্ত যেন সেটা বুঝতেই পারল না। আপনমনেই বলে চলল, আমি জানি, করে না। আমি পুনর্জন্মে বিশ্বাস করি। আমার বিশ্বাস, পরের জন্মে আপনি অবশ্যই সুন্দরী হয়ে জন্মাবেন। সেই জীবনটা আপনার এই হতচ্ছাড়া জীবনের চেয়ে অনেক বেশি ভালো লাগবে। কী এক্সাইটিং, তাই না? এবার ব্লাউজটা খুলে ফেলুন।

কেন জানি না, অমৃতা এই নির্দেশটাই আশা করছিল।

টিভির দিকে তাকাল ও। একটা ভয়ের সিরিয়াল আছে আগামীকাল রাত নটায়–তারই বিজ্ঞাপন দেখাচ্ছিল। কিন্তু ওর মনে হল আগামীকাল নয়, এখনই সিরিয়ালটা এই ঘরে শুরু হয়ে গেছে। আর টিভির ভেতরের মানুষগুলো অবাক হয়ে দম বন্ধ করে এই সিরিয়াল দেখছে।

অমৃতা আগে কখনও ভাবেনি ব্যাপারটা এরকম উলটে যেতে পারে।

একা-একটা আয়নার সামনে নগ্ন হয়ে কতবার নিজেকে দেখেছে। মুখ থেকে শুরু করে পায়ের নখ পর্যন্ত এককণা সৌন্দর্য খুঁজেছে। না, নেই। কোথাও রূপের ছিটেফোঁটামাত্র নেই। আপাদমস্তক কুরূপা কোনও তরুণীকে অনায়াসে বৃদ্ধা বলা যেতে পারে। এরকম কোনও মেয়ের যৌবনের বিন্দুমাত্র প্রয়োজন নেই। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে অমৃতার কতবার যে মরে যেতে ইচ্ছে করেছে!

অথচ এখন! মনে হচ্ছে, বেঁচে থাকার চেয়ে সুন্দর কিছু আর নেই।

তাই, বেঁচে থাকার জন্য, ব্লাউজটা খুলে ফেলল অমৃতা।

তারপর, সুকান্তর জরিপ-নজরের সামনে, খুলে ফেলতে হল ভেতরের জামাটাও।

কারণ, নির্দেশ সেরকমই আসছিল।

সুকান্ত এবার এগিয়ে এল অমৃতার খুব কাছে। যেমন করে বসন্তের টিকে দেয়, অনেকটা সেইরকম ঢঙে ছুরির ডগা দিয়ে আঁচড় কাটল অমৃতার বুকের মাঝে।

ডুকরে কেঁদে উঠল অমৃতা। কেঁপে উঠল। সরু রক্তের রেখা মাধ্যাকর্ষণের টানে গড়িয়ে নামতে লাগল নীচের দিকে। জ্বালা হয়তো করছিল, কিন্তু সেটা অনুভব করার মতো মনের অবস্থা ছিল না।

না, আপনার চামড়া তেমন মোটা নয়। ছুরির ডগাটা পরীক্ষা করতে করতে অনেকটা ডাক্তারি সুরে মন্তব্য করল সুকান্ত, অনেকের চামড়া অস্বাভাবিক মোটা থাকে। জোরে চাপ দিয়ে ছুরি বসাতে হয়। সবসময় আমি আগে একটু টেস্ট করে নিই–টি ই এস টি টেস্ট, টি এ এস টি ই নয়। আমি দুশ্চরিত্র নই।

কথা বলতে-বলতে ব্রিফকেসের কাছে গেল সুকান্ত, আপনার মনের অবস্থা বুঝতে পারছি, কিন্তু আমার কোনও উপায় নেই। এটা সৌন্দর্যের স্বাধীনতা-যুদ্ধ… ব্রিফকেসের ওপরে ঝুঁকে পড়ল ও ..পরের জন্মের কথা ভাবুন–ভালো লাগবে। উ উ.এইটা নিই…শুরুর কাজটা দারুণ হবে… ব্রিফকেস থেকে বাঁকানো ফলার একটা ছুরি তুলে নিল ও .এবার শায়াটা ছেড়ে ফেলুন। আমার হাতে আর বেশি সময় নেই…।

অমৃতার দিকে ঘুরে দাঁড়াল সুকান্ত। দু-হাতে দুটো ছুরি। চোখে বরফের দৃষ্টি।

তড়িঘড়ি শায়ার দড়ি খুলে ফেলল অমৃতা। আঙুলগুলো অসম্ভব কাঁপছিল বলে দড়ি খুলতে দেরি হয়ে গেল।

শায়াটা খসে পড়ল পায়ের কাছে।

অমৃতা সুন্দরী হলে বলা যেতে পারত গুটিপোকার খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এল প্রজাপতি। কিন্তু সুকান্তর মনে হল, প্রজাপতি নয়–শুয়োপোকা।

ও চটপটে পায়ে চলে এল অমৃতার কাছে। হাঁটুগেড়ে বসে পড়ল। কাস্তে দিয়ে আগাছা কাটার মতো শায়াটার একটা অংশ এক হাতের মুঠোয় চেপে ধরে বাঁকানো ছুরি দিয়ে একপোচে কেটে দিল। শায়ার বৃত্ত ছিন্ন হল। ওটা একটানে দূরে ফেলে দিল সুকান্ত। তারপর অ্যাটলাসের ভঙ্গিতে মাথা ঝুঁকিয়ে বসে রইল অমৃতার পায়ের কাছে।

অমৃতা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল। ওর শরীরটা ফুলে-ফুলে উঠছিল বারবার। মৃত্যুর এত কাছাকাছি এসে দাঁড়ালে মনের অবস্থাটা কীরকম হয় সেটা ও বেশ বুঝতে পারছিল। না, আর কোনও আশা নেই। অমৃতা খবরের কাগজের খবর হতে চলেছে আগামীকাল। নাইফম্যানের ছনম্বর শিকার। কোনও অলৌকিক ঘটনা ওকে আর বাঁচাতে পারবে না।

সুকান্ত পায়ের কাছে মাথা ঝুঁকিয়ে বিড়বিড় করে মন্ত্রের মতো কীসব আওড়াচ্ছিল। হঠাৎই বলল, আপনি ইচ্ছে হলে চোখ বুজে ফেলতে পারেন। তা হলে শক্টা কম হবে…।

অমৃতা চোখ বুজে ফেলল। মায়ের কথা মনে পড়ল ওর। ও শেষ মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। ভালোবাসার কাঙাল হয়ে কী ভুলটাই না ও করেছে!

সুকান্ত মাথা সোজা করে তাকাল। অমৃতার দু-পায়ের ফাঁক দিয়ে পিছনের দেওয়ালটা ওর নজরে পড়ছে। ওর চোয়াল শক্ত হল। চোখে একটা প্রতিজ্ঞা নিয়ে ও হাঁটুতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াতে গেল।

ঠিক তখনই তিলটা ওর চোখে পড়ল।

সুকান্ত পাথর হয়ে গেল। মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে রইল তিলটার দিকে।

অমৃতার ডান উরুর ওপরের দিকে একটু ভিতর ঘেঁষে একটা কালো তিল। মাপে মসুরডালের মতো। কাজলের মতো কুচকুচে কালো। অমৃতার ময়লা রঙের ওপরেও তিলটা জ্বলজ্বল করছে।

কী সুন্দর! অপূর্ব!

সুকান্তর হাত থেকে ছুরি খসে পড়ল। অতি সাবধানে আঙুল বাড়িয়ে তিলটাকে ছুঁয়ে দেখল ও।

আসল।

পোশাকের আড়ালে কেউ কখনও নকল বিউটিস্পট তৈরি করে না।

সুকান্তর শরীরে কাঁটা দিল। আসল সৌন্দর্যকে ছোঁয়ার একটা আলাদা রোমাঞ্চ আছে।

এবারে মুখটা এগিয়ে নিয়ে গেল ও।

আলতো করে ঠোঁট ছোঁয়াল অমৃতার তিলে। তারপর বিড়বিড় করে বলল, এ-কী সুধারস আনে / আজি মম মন প্রাণে…।

অমৃতা থরথর করে কাঁপছিল। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল সামনের দেওয়ালে ঝোলানো একটা ক্যালেন্ডারের দিকে।

ক্যালেন্ডার আড়াল করে ওর দৃষ্টিপথে এসে হাজির হল সুকান্তর মুখ! কারণ, ও উঠে দাঁড়িয়েছে। অদ্ভুত এক হাসি ওর মুখে আলো জ্বেলে দিয়েছে।

আপনার সৌন্দর্যের কোনও জবাব নেই, ম্যাডাম। প্রিয়ার তিলের জন্যে কবি সমরখন্দ বোখারা দিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। আর আমি আপনার প্রাণ দিতে পারব না! তা ছাড়া আপনি তো জানেন, কিছু দিলে তার বদলে আমি কিছু নিই না। আমি শাইলক নই…।

এরপর ছুরি-টুরি সব চটপট নিজের ব্রিফকেসে গুছিয়ে নিল সুকান্ত। হাসিমুখে এগিয়ে গেল দরজার কাছে। শেষবারের মতো ফিরে তাকাল অমৃতার দিকে। বলল, এবার ভেবে দেখুন, আমি নাইফম্যান, না লাইফম্যান…।

তার পর খিল-ছিটকিনি খুলে বাইরে বেরিয়ে দরজাটা আবার টেনে দিয়ে গেল।

একটা ঘোরের মধ্যে দাঁড়িয়ে রইল অমৃতা। ওর মধ্যে তা হলে সৌন্দর্য আছে!

না, এই নাইফম্যানের কথা ও কাউকে বলবে না, ওর গোপন সৌন্দর্য আবিষ্কারের কথা গোপনই থাক।

সত্যি, জীবন কী আশ্চর্য! একতিলের জন্য ও আবার বেঁচে গেল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress