Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » বেড়ালের ডাক || Sharadindu Bandyopadhyay

বেড়ালের ডাক || Sharadindu Bandyopadhyay

রাত্রি তখন একটা কি দুটা হইবে। ইজিচেয়ারে শুইয়া বোধ হয় তন্দ্রা আসিয়া পড়িয়াছিল। কেরাসিনের ল্যাম্পটা ঠিক মাথার শিয়রে সতেজে জ্বলিতেছিল। এমন সময় স্ত্রীর কণ্ঠস্বরে চমকিয়া জাগিয়া উঠিলাম;—ওগো, দূর করে দাওনা আপদটাকে। আবার ডাকছে।

ঠিক যে বিছানার উপর খোকা জ্বরের ঘোরে অজ্ঞান অচৈতন্য হইয়া পড়িয়াছিল তাহার মাথার দিকের বদ্ধ জানালার ওপারে বসিয়া বিড়ালটা ডাকিতেছিল। ডাকটা ঠিক স্বাভাবিক বিড়ালের মতোই। কিন্তু তাহার মধ্যে যেন একটা বিরস পরিশ্রান্ত কান্নার রেশ ছিল। সেই ক্ষিন্ন পীড়িত কান্নার সুরটা একেবারে বুকের মধ্যে গিয়া লাগে এবং মনে হয় এটা শুভ নয়।

জানালা খুলিয়া তাড়া দিতেই বিড়ালটা লাফাইয়া সরিয়া গিয়া অন্ধকারে মিশাইয়া গেল।

মফস্বলের ছোট শহর—চাকরি উপলক্ষ্যে বদলি হইয়া প্রায় বছরখানেক হইল এই বাড়িটায় আমি বাস করিতেছি। কিন্তু বিড়ালের উপদ্রব এতদিন ছিল না। মাসখানেক পূর্বে হঠাৎ কোথা হইতে একটি শীর্ণ মড়াখেকো বিড়াল আসিয়া জুটিল। তাহার গায়ের রং নোংরা পাঁশুটে এবং মাঝে মাঝে লোম উঠিয়া গিয়া অত্যন্ত কদাকার মূর্তি ধারণ করিয়াছে। তাহার উপর ঐ ডাক!—ঠিক যেন মূর্তিমান অমঙ্গল আমাদের বাড়ির চারিপাশে প্রদক্ষিণ করিয়া ফিরিতে লাগিল।

প্রথম দিনই স্ত্রী বলিলেন, বেড়ালের কান্না—ভারি অলক্ষণ। আমার অজু-বিজয় ভাল থাকলে হয়।

শব্দটা আমাকেও কোথায় যেন আঘাত করিয়াছিল। কিন্তু স্ত্রীলোকে যাহা সহজে স্বীকার করে আমরা তাহা করি না, তাই বলিলাম, তুমিও যেমন—

তারপর প্রত্যহ এইরূপ চলিতে লাগিল। দিন পাঁচ-ছয় পরে স্ত্রী আবার সশব্দে বলিলেন, ওগো, আমার ভারি ভয় কচ্চে। বাড়িতে রোজ রোজ এরকম বেড়াল কান্না ভাল নয়। তাড়ালেও তো যায় না। তুমি লক্ষ্মীছাড়া জন্তুটাকে গুলি করে মেরে ফেল।

ইতস্তত করিতে লাগিলাম। শুধু কাঁদিয়া বেড়ানোর অপরাধে একটা জীবকে মারিয়া ফেলিতে হাত উঠে না। কিন্তু কি উপায়ে যে তাহাকে বাড়িছাড়া করিব তাহাও বুঝিতে পারিলাম না। বামুন ঠাকুরকে ধরিতে আদেশ করিলাম। ফলে বামুন ঠাকুর দুই ঘণ্টাকাল একটা ধামা লইয়া তাহাকে তাড়া করিয়া বেড়াইল। রুগ্ন বলিয়া বিড়ালটার পালাইবার ক্ষমতা কম নয়। সে ধরা দিল না।

তখন বাড়িতে জারি করিয়া দিলাম—যে বিড়াল ধরিতে পারিবে তাহাকে একটাকা বকশিশ দিব। বাড়িসুদ্ধ চাকরবাকর উঠিয়া পড়িয়া লাগিয়া গেল। এমন কি আমার বড় ছেলে অজয়—তাহার বয়স আট বৎসর—সে পর্যন্ত তাহাকে ধরিবার জন্য নানাপ্রকার ফন্দি-ফিকির আঁটিতে লাগিল। কিন্তু আশ্চর্য ধূর্ত ওই বিড়ালটা। সকলের ষড়যন্ত্র অবহেলে ব্যর্থ করিয়া দিয়া সে বাড়ি প্রদক্ষিণ করিয়া বেড়াইতে লাগিল। এবং তাহার কান্নার সুর যতই মর্মভেদী হোক না কেন, সে যে আমাদের মিলিত প্রয়াস বিফল করিয়া দিয়া বেশ আমোদ উপভোগ করিতেছে তাহা বুঝিতে পারিয়া আমাদের উত্তেজনা আরও বাড়িয়া গেল।

এক এক সময় তাহার নির্জীব ক্ষুধাক্লিষ্ট নিতান্ত শ্রীহীন চেহারাটা দূর হইতে দেখিয়া ভাবিতাম— কি চায় ও? কিসের জন্য এই অতৃপ্ত বুভুক্ষিত রোদন? এ পর্যন্ত একদিনও সে রান্নাঘরে পদার্পণ করে নাই এবং খাদ্যের প্রলোভনে তাহাকে ধরিবার সমস্ত চেষ্টাই ব্যর্থ হইয়াছে। তবে কেন–? কিন্তু তখনও জানিতে পারি নাই কি বিরাট ক্ষুধা লইয়া সে আমার বাড়িতে দেখা দিয়াছিল।

একদিন সন্ধ্যাবেলা চাকর ছেলেদের লইয়া বেড়াইতে গিয়াছিল, ছোট ছেলে বিজয় এক গা কাদা মাখিয়া কাঁদিতে কাঁদিতে ফিরিয়া আসিল। চাকর অপরাধ কুণ্ঠিত কণ্ঠে জানাইল যে রাস্তার পুলের উপর খেলা করিতে করিতে খোকাবাবু হঠাৎ নীচে পড়িয়া গিয়াছেন; তবে শরীরে আঘাত লাগে নাই কাদার মধ্যে পড়িয়াছিলেন এই ভাগ্য। ভাগ্যের কথা শুনিয়া আমার মাথা ঘুরিয়া গেল। কারণ সেই পুলটার নীচে দিয়াই শহরের গলিত দুর্গন্ধ নালা গিয়াছে। বিজয় তাহারি কাদার মধ্যে পড়িয়া গিয়াছিল।

পরদিন একটু জ্বর এবং দিন-তিনেকের মধ্যে টাইফয়েড রোগের কোনও লক্ষণই অপ্রকাশ রহিল। স্ত্রী অপূর্ণ চক্ষে আমার পানে তাকাইলেন-বুঝিলাম তিনি সেই অপয়া বিড়ালটার কথা ভাবিতেছেন।

ভাবনার বস্তুটি তখন দ্বিগুণ উৎসাহে বাড়িময় কাঁদিয়া বেড়াইতেছিল।

যে রাত্রির কথা লইয়া আরম্ভ করিয়াছি সে রাত্রি কাটিল। কাটিবে বলিয়া আশা করি নাই কিন্তু সত্যই যখন কাটিল তখন আমি হাত-মুখ ধুইয়া নীচে নামিয়া গেলাম। ডাক্তার ডাকিতে পাঠাইয়া এবং তাড়াতাড়ি এক পেয়ালা চা গলাধঃকরণ করিয়া রোগীর ঘরে ফিরিয়া আসিয়া দেখি, ছেলেটা আরও বেশী ছটফট করিতেছে। জ্ঞান আছে কিনা বুঝিতে পারিলাম না। মাঝে মাঝে চিৎকার করিয়া উঠিতেছে। আমি ঘরে প্রবেশ করিবামাত্র সে তাহার মার গলাটা সজোরে জড়াইয়া ধরিয়া নিজেকে বাহুর জোরে তাহার বুকের কাছে টানিয়া আনিয়া কাঁদিয়া উঠিল, মা, ওই বেড়াল! আমি যাব না।

স্ত্রী দুহাতে ছেলেকে বুকে চাপিয়া ধরিয়া কাঁদিয়া উঠিলেন, কিন্তু তখনি আবার দাঁত দিয়া ঠোঁট চাপিয়া কান্না নিরোধ করিলেন। সেই মুহূর্তে নীচে হইতে বিড়ালের ডাক শোনা গেল।

আমি আর সেখানে দাঁড়াইলাম না—দাঁতে দাঁত চাপিয়া নিজের ঘরে গিয়া বন্দুকটা তুলিয়া লইলাম। টোটা ভরিয়া ভিতরের বারান্দায় আসিয়া দাঁড়াইলাম।

শীতের সকাল। রোদ উঠিয়াছে কিন্তু কুয়াশা সম্পূর্ণ দূর হয় নাই। মস্ত উঠানের অন্য প্রান্তে একটা অনুচ্চ বাঁশের মাচা ছিল—পুঁইডাঁটা এবং আরও কি কি লতা দিয়া মাচাটা আগাগোড়া ঢাকা। তাহারি উপর বসিয়া জন্তুটা আরামে অঙ্গ লেহন করিতেছিল। বন্দুক তুলিয়াই ফায়ার করিলাম। বোধ হয় অত্যধিক উত্তেজনায় হাত কাঁপিয়া গিয়াছিল—বিড়ালটা লাফাইয়া অদৃশ্য হইয়া গেল। সঙ্গে সঙ্গে মাচার অপর পারে একটা গুরুভার পতনের শব্দ হইল।

বন্দুক সেইখানে ফেলিয়া দ্রুত নীচে নামিয়া গেলাম। দেখি, আমার বড় ছেলে অজয় মাচার পাশে পড়িয়া আছে। বন্দুকের গুলিটা ঠিক তাহার রগের ভিতর দিয়া মস্তিষ্কে প্রবেশ করিয়াছে। দেহে প্রাণ নাই—মরিবার পূর্বে একটা ক্ষুদ্র কাতরোক্তি করিবারও সে অবসর পায় নাই। একটা ছোট চুপড়ি তাহার হাতের কাছে পড়িয়া আছে।

.তারপর আর কি? ছোট ছেলে বিজয় বাঁচিয়া উঠিয়াছে। চিকিৎসা বা সেবার গুণে নয়—তাহার পরমায়ু ছিল বলিয়া।

যে বিড়ালটাকে ক্ষুধিত অবস্থায় হাজার চেষ্টা করিয়াও তাড়াইতে পারি নাই আজ ক্ষুধার অবসানে সে আপনিই চলিয়া গিয়াছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress