Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » পুরোনো চিঠি || Shirshendu Mukhopadhyay

পুরোনো চিঠি || Shirshendu Mukhopadhyay

নিশুতরাতে এসেছিল এক ডাকপিয়োন। দরজা খুলে দেখি ব্যাগ ভরতি চিঠি, হাত ভরতি চিঠির ভারে কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বুড়ো-সুড়ো লোকটা। জ্যোৎস্নায় ভেজা তার দাড়ি, চাঁদের গুঁড়ো লেগে আছে তার উল্লেখুড়ো পিঙ্গল চুলে, জ্যোৎস্নার রস টলটল করছে তার চোখভরে। উজাড় করে সে চিঠি ঢেলে দিল আমার দুই আঁজলায়। হাত উপচে চিঠির-পর-চিঠি গড়িয়ে পড়ল মেঝেয়, সিঁড়িতে, ছিটকে পড়ল সিঁড়ির নীচেকার ঘাসে। ব্যস্ত হয়ে চিঠিগুলো কুড়িয়ে নিতে থাকি। খুলে পড়তে গিয়ে দেখি, এ সবই পুরোনো সব চিঠি, আদালতের সপিনা, জীবনবিমার প্রিমিয়ারের নোটিশ, বিয়ের আগেকার প্রেমপত্র। সুসংবাদ-দুঃসংবাদে ভরা এসব চিঠি তো আমি কবেই পেয়েছি, তবে কোথা থেকে আবার ঘুরে এল এগুলো? শুনতে পেলাম বুড়ো পিয়োনটা পাড়ার দরজায় দরজায় নিশুতরাতে কড়া নেড়ে ফিরছে, বিলি করছে পুরোনো সব চিঠি, দলিল, নোটিশ।

ঘুম ভেঙে উঠে বসলাম বিছানায়। স্বপ্ন। শিয়রের জানালা দিয়ে একটু শেষরাতের জ্যোৎস্না এসে পড়েছে আমার ঘুমন্ত মেয়ে আর বউয়ের মুখে। একটু চেয়ে থাকলাম মুখ দুটোর দিকে।

মায়ের বুক ঘেঁষে কেমন নিবিড়ভাবে শুয়ে আছে মেয়েটা। জেগে উঠে আবার স্বপ্নে দেখা পিয়োনটার কথা মনে পড়ল। চিঠির ভারে নুয়ে পড়া বুড়ো বিড়বিড় করে আপন মনে কথা বলছে,

আর বিলি করছে তামাদি সব কাগজ, ভুলে যাওয়া সব পুরোনো চিঠি। স্বপ্নটার মানে কী?

নিঃসাড়ে বিছানা ছেড়ে উঠে আসি। জানলার গরাদের ফাঁক দিয়ে দেখি, আকাশে স্টিমারের আলোর মতো এক গোল চাঁদ। নির্জন জ্যোৎস্নায় চোরের মতো পা ফেলে হেঁটে যাচ্ছে বাতাস, জানালায় উঁকি দেয় লোভী বেড়ালের চোখ। রাস্তায় চৌকিদার লাঠি ঠুকে–ঠুকে হাঁটছে।

বুকের বাঁ-ধারে একটু ব্যথা টের পাই। মনটা বিষণ্ণ। জল খেলাম, একটা আস্ত সিগারেট শেষ করলাম, তবু আর শুতে ইচ্ছে করল না। মনের মধ্যে একটু ভয়-ভয় ভাব। ঘড়ি দেখলাম। তিনটে। রাত ফুরোতে ঢের দেরি। অন্ধকারে একা ভূতের মতো বসে রইলাম। রাতটা অস্বস্তির সঙ্গে কেটে গেল।

সকালে মেয়েকে নিয়ে বেড়াতে বেরোই। আমার পাঁচ বছরের মেয়ে মুন্নি কুকুর দেখে, বেড়াল দেখে, পাখি দেখে, থেমে-থেমে হাঁটে। আমি মাঝে-মাঝে এগিয়ে যাই, সে পিছনে পড়ে থাকে। তারপর দৌড়ে এসে আমাকে আবার ধরে। এত সকালে রাস্তায় লোক চলাচল থাকে না। ভারী নির্জন রাস্তা। ভোরের গন্ধটি কেমন সতেজ, আলোটি কেমন ছায়াময়। হাঁটতে-হাঁটতে আমরা কথা বলি।

মুন্নি বলে–আমার হাত ছেড়ে দাও বাবা, আমি তো একাই হাঁটতে পারি।

–ঠিক তো। বলে আমি হাত ছেড়ে দিই তার।

মুন্নি হাসে-তবে কেন আমার হাত ধরে থাকো রোজ? আমি কি হারিয়ে যাই?

–না-না। আমি তাড়াতাড়ি বলি,–’তুমি তো হারাও না, আমিই হারিয়ে যাই মা, সেই ভয়ে হাত ধরে থাকি।’

–তুমি কি ছোট্ট?

বলি–হুঁ।

–আমার চেয়েও ছোট্ট।

–তোমার চেয়েও।

–কাল থেকে তো আমি ইস্কুলে যাব, তখন কার সঙ্গে তুমি বেড়াবে?

একটু চমকে উঠি। ঠিক। মুন্নি কাল থেকে প্রথমে ইস্কুলে যাবে। কাল থেকে আমি কার সঙ্গে

হাঁটব?

ম্লান হেসে বলি–একাই বেড়াব মা।

–যদি হারিয়ে যাও?

‘হারিয়ে যাব?’ হঠাৎ আমাকে ঘিরে এক স্তব্ধতা নেমে আসে। নিজেকেই প্রশ্ন করি ‘হারিয়ে যাব?’

মুন্নি পিছিয়ে পড়ে। তার জুতোয় কাঁকর ঢুকেছে। জুতো খুলে কাঁকরটা বের করছে সে। আমি একটু এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াই। পিছু ফিরে দেখি, শূন্য রাস্তার মাঝখানে আমার শিশু মেয়ে একা। ঝাঁকড়া চুল মুখের ওপর ফেলে উবু হয়ে জুতো পরিষ্কার করছে। দৃশ্যটা থেকে চোখ ফেরাতে পারি না।

নিশুতরাতে এসেছিল এক ডাকপিয়োন। আমার সারাজীবনের সব স্মৃতি ফিরিয়ে দিয়ে গেছে। বোধহয় আমার আর কোনও চিঠি আসবে না। আমি যেন ঠিক মোহনার কাছে পৌঁছনো এক নদী, যার স্রোতের আর কোনও ঢল নেই। সামনে মহাসমুদ্র।

আমি মুন্নির জন্য অপেক্ষা করি। কিন্তু আমার দিকে তার আর মনোযোগ নেই। সে কাককে ঢিল ছুড়ছে। আমি একটু হাসি, তারপর এগিয়ে যেতে থাকি। মুন্নি একা আসতে পারবে। আমি যখন থাকব না, তখনও তো মুন্নিকে একাই হাঁটতে হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *