Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » কেশকাল-এর বাঘিনী || Buddhadeb Guha

কেশকাল-এর বাঘিনী || Buddhadeb Guha

চৈত্রের শেষ। এখনও কালবৈশাখীর সময় আসেনি তবু দুপুর থেকেই মেঘলা করেছিল। বিকেলের দিকে সেই মেঘের কালোতে সিঁদুরের ছোঁয়া লাগল আর শুরু হল তাণ্ডব।

হাওয়ার এক দমকে বহুবর্ণ শুকনো পাতারা বৃন্তচ্যুত হয়ে একঝক বহুবর্ণ পাখির মতো একই সঙ্গে যেন ডাল ছেড়ে উড়ে গেল দিগ্বিদিকে।

আমি, ভটকাই আর ঋজুদা কেশকাল বাংলোর বারান্দাতে চেয়ারে বসেছিলাম। গতকালই রাতে এখানে এসেছি নাগপুর থেকে প্রদীপ কাকাদের সঙ্গে। ওঁদেরই বন্দোবস্ত, ইন্তেজাম। একটা এয়ারকন্ডিশানড টাটা সুমো আর একটা এয়ারকন্ডিশানড টোয়াটা কালিস-এ এসেছি আমরা। দলও তো ছোট নয়। ওঁরা গেছেন কেশকাল-এর ডি. এফ. ও.-র কাছে। ওখানে থেকে নারায়ণপুরে ফোনও করবেন অবুঝমারে যাওয়ার পারমিশনের জন্যে। অন্য প্রদীপ কাকা, উনি প্রদীপ মৈত্র, প্রথমজন প্রদীপ গাঙ্গুলি, বলেছিলেন যে, পারমিশন নারায়ণপুর থেকে হবে না, বস্তার ডিস্ট্রিক্টের হেড কোয়ার্টার্স জগদলপুর থেকেই নিতে হবে। সঞ্জীব কাকা আর তাপস কাকা, সঞ্জীব গাঙ্গুলি আর তাপস সাহা, বলছিলেন এখান থেকে ফোন-টোন করার ঝামেলা না করে একেবারে সশরীরে জগদলপুরে কাল পৌঁছেই এ ব্যাপারে তত্ত্বতল্লাস করা যাবে।

অবুঝমারে বাইসন-হর্ন মারিয়াদের বাস। তাদের মেয়েরা এখনও উর্ধ্বাঙ্গে কাপড় রাখে না। তারা মারিয়াদের মধ্যে এক বিশেষ প্রজাতি, যারা নিজেদের রীতিনীতি, সহবত, নিজেদের মূল্যবোধ সব চারদিকের এই ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও আওয়াজের মধ্যে অটুট রেখেছে। রেখেছে যে শুধু তাই নয়, তারা রাখতে পারার জন্যে অশেষ গর্বিত। এখনও কেরোসিনের কুপির আলোয় হিংস্র জন্তু-ভরা গভীর জঙ্গলের মধ্যে তাদের কুটিরে বসে তাদের ছেলেমেয়েরা ঠাকুরদা-ঠাকুমা, দাদু-দিদিমার কাছে তাদের নানা রূপকথা শোনে। বাইরে থেকে মাদল ধামসা আর বাঁশির আওয়াজ ভেসে আসে। তখন হয়তো কোনও ঘোটুল-এ নাচ-গান হয়।

ভাবলে ভাল লাগে। আমাদের রাজ্যের শিশুদের জগৎ থেকে তো টিভি, ইন্টারনেট, রেডিয়ো ইত্যাদির কারণে ওইসব সুখবিলাস এখন শুধুমাত্র কল্পনার।

ঋজুদা বলছিল, এই ঘোটুল ব্যাপারটা শুধু বাইসন-হর্ন মারিয়াই নয়, অন্য নানা আদিবাসীর মধ্যেই এখনও চালু আছে। ঘোটুল হল গ্রামের সীমানার বাইরে অথচ সীমানা থেকে খুব দূরে নয় এমন জায়গায় একটি বড় ঘর। তার সামনে মস্ত উঠোন থাকে। উঠোনের মধ্যে একমানুষ মতো উঁচু একটি স্তম্ভমতো থাকে। সেই স্তম্ভর উপরে পেট্রলের হ্যাঁজাক জ্বেলে রাখা হয় পুরো উঠোন আলোকিত করার জন্য আর সেই আলোকিত উঠোনে ছেলে ও মেয়েরা নাচে, গান গায় গভীর রাত অবধি। বিহারে যেমন মহুল ফুলের রস খায় আদিবাসীরা, এখানেও খায়, তবে এখানকার বিখ্যাত হচ্ছে সালফি।

ওড়িশাতে আমরা ঋজুদার সঙ্গে শিকারে গিয়ে বেড়াতে গিয়ে দেখেছি যে ওখানে সপ বলে একরকমের বড় গাছ হয় জঙ্গলে, ডেট-পাম-এর মতো, সেই গাছে হাঁড়ি বসিয়ে, যেমন করে তাল-খেজুরের রস আমাদের রাজ্যে সংগ্রহ করে মানুষে তেমন করেই সংগ্রহ করে। তার পরে খেজুর বা তাল রস বেলা বাড়লেই যেমন গেঁজে গিয়ে নেশার সামগ্রী হয়ে যায়, ওই সল্প রসের বেলাও তাই-ই হয়। ওড়িশার সপ রস’কেই মধ্যপ্রদেশের বস্তার জেলাতে বলে সালফি।

বস্তার কিছুদিন আগেও মধ্যপ্রদেশ রাজ্যের অন্তর্গত ছিল, এখন ছত্তিশগড়ের অন্তর্গত হয়ে গেছে। বিহার, ওড়িশা এবং মধ্যপ্রদেশের আরও নানা অঞ্চলেরই মতো।

এই ঘোটুল-এ অবিবাহিত ছেলেমেয়েরা কৈশোর পেরোনোর পরে যৌবনে পা দেওয়ার কিছু পরেই সারাদিন নিজের নিজের কাজ করার পর ঘোটুল-এ এসে রাতে থাকে। বিয়ের আগে তারা তাদের জীবনসাথীকে এইরকমই একসঙ্গে থেকে নির্বাচন করে। এই সাথী নির্বাচনের আবার দুটি রকম আছে। প্রথমটিকে বলে ‘জোড়িদার’–মানে যাদের জুড়ি ঠিক হয়ে গেছে। মানে, যারা জোড় লেগেছে। অন্যরা, যারা মনস্থির করতে পারেনি তখনও তারা বিভিন্ন সঙ্গী বা সঙ্গিনীর সঙ্গে মিশে তার জীবনসাথী নির্বাচন করে। এই দ্বিতীয় দলের ছেলেমেয়েরা অদল বদল’ প্রথার অন্তর্ভুক্ত।

শুনে, ভটকাই বলেছিল–দারুণ প্রথা তো। এমন প্রথা আমাদের দেশের সব রাজ্যেই চালু হওয়া উচিত।

ঋজুদা বলেছিল ওরা আদিবাসী, জামাকাপড় বিশেষ পরে না, ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ে ধরাকে সরা জ্ঞান করে না, অনেক টাকা রোজগারকেই জীবনের একমাত্র গন্তব্য বলে বিশ্বাস করে না অথচ ওরা কত আধুনিক ওদের চিন্তাতে। অত্যন্ত উচ্চবিত্ত শিক্ষিত সমাজে যে প্রথা আছে–যদিও অলিখিত–যে প্রথা আছে অধিকাংশ পশ্চিমি এবং জাগতিকার্থে উন্নত দেশে বাইসন-হর্ন মারিয়ারা ঠিক সেই প্রথাকেই সামাজিক স্বীকৃতি দিয়েছে।

পশ্চিমি দেশে যখন এই প্রথা ব্যক্তিগত পর্যায়ে আছে, ওরা তখন তার জনগণায়ন করেছে।

বাংলাতে পণ্ডিত মিস্টার ভটকাই বলেছিল।

জনগণায়ন। বেশ তো শব্দটা। অভিধানে কি আছে?

ভটকাই বলল, অভিধান যাঁরা লেখেন, তারা তো বৈয়াকরণ।

সেটা আবার কী বস্তু?

ঋজুদা আরও অবাক হয়ে প্রশ্ন করেছিল ভটকাইকে।

বৈয়াকরণ মানেও জান না? বৈয়াকরণ বলে তাদের, যাঁরা ব্যাকরণে পণ্ডিত। তারাই তো অভিধান লেখেন। তারা ওই ঘটকের সম্বন্ধ করা বিয়ের দিনেই পড়ে আছেন, ঘোটুলে এসে পৌঁছতে পারেননি। ভাষাও যদি নিয়ত নবীকৃত না হয়, তাহলে সে ভাষাও কেওড়াতলাতেই গেছে বলতে হবে।

নবীকৃত মানেটা কী? সেটা বল।

তোমাকে নিয়ে তো ভারি মুশকিল হল ঋজুদা। তুমি ইংরেজি, ফরাসি, জার্মানে পণ্ডিত অথচ নিজের মাতৃভাষাটাই ভাল করে শিখলে না।

আমি মাতৃভাষাতে পণ্ডিত হলে তো সব ঋজুদা কাহিনি আমিই লিখতাম, রুদ্রর কি ঋজুদা কাহিনি লিখে এত নামডাক হত?

সে কথা অবশ্য ঠিক।

অত্যন্ত উদার মানুষের মতো বলেছিল ভটকাই।

তারপরে বলেছিল, ওর ঋজুদা কাহিনিও যদি না থাকত তবে তো রুদ্রর প্রচণ্ড আইডেনটিটি ক্রাইসিস হত।

ঋজুদা হো-হো করে হেসে উঠেছিল ভটকাইয়ের কথা শুনে। আমিও।

আমি নিজেকে ডিফেন্ড করে বলেছিলাম, বৈয়াকরণ হওয়া সোজা, অভিধান লেখা সোজা, পণ্ডিতিও সোজা কিন্তু লেখক হওয়া সোজা নয়। সবাই-ই যদি লিখতে পারত তবে লেখকের, রুদ্র রায়ের এত সম্মান থাকত না।

ভটকাই বলল, বাঁশবনে শেয়াল রাজা। বাংলা সাহিত্যে কজন লেখক আছেন রে আজকে, যাঁরা থাকবেন? অধিকাংশই পদ্মপাতার জল। টলটল করছেন, বিজ্ঞাপনের সূর্যর আলো লেগে জ্বলজ্বল করছেন কিন্তু কখন গড়িয়ে গিয়ে ভূতলশায়ী হবেন তা খোদাই জানেন।

নবীকৃত শব্দটার মানে জিজ্ঞেস করেছিলাম।

ঋজুদা বলল।

নবীকৃত এসেছে নবীকরণ থেকে। বুঝলে। নবী এসেছে নব থেকে। অর্থাৎ পুরনোকে নতুন করাকেই বলে নবীকরণ। নবীকরণ হয়ে গেলেই নবীকৃত।

বুঝলাম।

ঋজুদা বলল।

আমি বললাম, তুই ঘোটুলের গল্পটাই মাটি করলি।

ঋজুদা বলল, আমি তো পালাচ্ছি না। বলব পরে। বাইসন-হর্ন মারিয়ারা রং খুব ভালবাসে। তাদের আনুষ্ঠানিক পোশাকে তাদের দেখলে অবাক হয়ে যাবি। রঙের দাঙ্গা লাগিয়ে দেয় একেবারে। আর ওরা আবার রণপায়ে চড়েও নাচে। কেউ কেউ বাইসন সাজে। একজন না দুজনে। একজন রঙিন কাপড়ের মাথার দিকে থাকে, অন্যজন পেছন দিকে, চিনেরা যেমন ড্রাগন নৃত্য করে না, অনেকটা সেইরকম। আর একরকমের লাঠি ওরা নাচের সময়ে ব্যবহার করে, যে লাঠি শূন্যে নাড়লেই তা থেকে বাঁশির মতো আওয়াজ বেরয়।

দারুণ তো! আমাদেরও দেখাবে তো!

আগে তো অবুঝমারেই যাওয়া তোক। অবশ্য অবুঝমারে না যেতে পারলেও নারায়ণপুর আর ছোটিভোঙ্গরির মাঝে একটু ঘোটুল আছে। সেখানে নারায়ণপুরের ডি. এফ. ও. শর্মাসাহেবকে বলে নাচের বন্দোবস্ত করা যাবে।

তুমি চিনলে কী করে?

আরে এ কি আজকের কথা! আমি যখন কেশকাল-এর কুখ্যাত নরখাদক বাঘ মারতে এই কেশকাল-এ এসে ক্যাম্প করি, তখন শর্মা তার এক কাকার সঙ্গে কেশকাল-এ এসেছিল। তখন দিল্লির কলেজে পড়ে। তার কাকা ইন্ডিয়ান ফরেস্ট সার্ভিস জয়েন করে মধ্যপ্রদেশে বিখ্যাত সব জঙ্গল থাকাতে মধ্যপ্রদেশ ক্যাডার বেছে নেন। তিনিও শর্মাই ছিলেন। তিনি তখন কনজার্ভেটর। জগদলপুরে হেডকোয়ার্টার্স। চিফ কনজার্ভেটর সাহেবের নির্দেশানুসারে আমার কোনও অসুবিধা হচ্ছে কি না দেখতে জগদলপুর থেকে জিপ নিয়ে এসেছিলেন। সঙ্গে দিল্লি থেকে বেড়াতে-আসা ভাইপোকেও নিয়ে এসেছিলেন। তাই এই এখনকার নারায়ণপুরের ডি. এফ. ও. শর্মা যখন জানতে পারলেন টাইমস অফ ইন্ডিয়ার প্রদীপ মৈত্রর কাছ থেকে যে আমি বেড়াতে আসছি এ অঞ্চলে তখনই প্রদীপকে বলে রেখেছিলেন যে নারায়ণপুরে যেন অবশ্যই যাই।

কেশকাল-এর নরখাদক বাঘ মারতে তুমি কবে এসেছিলে?

তোদের জন্মের অনেকই আগে। ষাটের দশকের গোড়ার দিকে। তখন বস্তারের চেহারা অন্যরকম ছিল। ভয় করার মতো জায়গা ছিল। এ তল্লাটের খুব অল্প জায়গাতেই পিচের রাস্তা ছিল। কোনও পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ছিল না বলতে গেলে।

এখনও তো দেখছি শুনশানই। কটা বাস বা প্রাইভেট গাড়ি-ই বা যাওয়া-আসা করছে। ট্রাক যাওয়া-আসা করছে কিছু।

ট্রাক যে মাল বয়ে আনে মাল নিয়ে যায় ট্রাকেরাই তো সারা ভারতের লাইফ-লাইন চালু রাখে।

কেন? রেল?

রেলেও মাল যাওয়া-আসা করে তবে দেরি হয়, চুরি হয়, হাজারো ঝক্কি ঝামেলা। রেল যদি বেসরকারি হত তবে হয়তো অনেক বেশি মাল যাওয়া-আসা করত। আমাদের এখানে, যদিও এটা খুবই দুঃখের বিষয়, সরকার যাহাই স্পর্শ করে তাহাই…। সে সরকার কেন্দ্রীয়ই হোক কী রাজ্য।

ভটকাই বলল, তা আমরা তোমার সঙ্গে কেশকাল-এ এলাম আর কেশকাল-এর নরখাদক বাঘের ইন্তেকাল-এর গল্পটা শুনব না!

ঋজুদা বলল, আরেক কাপ করে কফি বল তো।

বলেই বলল, সেই সময়ে এই বাংলোটা কি এইরকম ছিল। এই বাংলো দেখে, ঘরে ঘরে রুম কুলারকার্পেট, তখনকার বাংলোর ধারণাই করতে পারবি না। তখনকার দিনে ভারতের সব রাজ্যেই ব্রিটিশদের বানানো বনবিভাগের বাংলোগুলোতে এমন বাহার ছিল না কিন্তু বৈশিষ্ট্য ছিল। দুটি বেডরুম, সঙ্গে অ্যাটাচড বাথ, মধ্যে ডাইনিং কাম-ড্রয়িং রুম। সি পি টিক-এর ফার্নিচার, কাটলারি-ক্রকারি সাধারণ ছিল কিন্তু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। ফরেস্ট বাংলোর চৌকিদার মাত্রই ভাল রাঁধুনি হত। সাহেবি রান্নাও তারা ভাল রাঁধতে পারত। আর তাদের ব্যবহার এবং সার্ভিসের তুলনা ছিল না।

তারপর বলল, আমি এই বাংলোতে থাকাকালীনই বাঘ চৌকিদারের বউকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল। সেই অবশ্য তার শেষ কিল। এই কেশকাল বাংলোর নীচেই তাকে চৌকিদারের বউয়ের ডেডবডির ওপরে মারি। তখন সবে ভোর হচ্ছে।

বলো না, বলো না গল্পটা ঋজুদা।

ভটকাই বলল।

আমি বললাম, প্রদীপকাকুরাও শুনবে বলেছিল, তোমার কাছ থেকে গাড়িতে এ তথ্য জেনেই। ওঁরা রাগ করবেন। ওঁদের ফিরে আসারও সময় তো হয়েই গেল।

ভটকাই বলল, তা হলে কফিটা কি এখনই বলব, না ওরা এলেই হবে?

তা হলে তাই হোক। ওরা এলেই হবে। পাইপের টোব্যাকো ফুরিয়ে গেছে। আমার ঘর থেকে গোল্ড ব্লক টোব্যাকোর একটা টিন নিয়ে আয় তো।

তুমি কলকাতায় বসে এই ইংলিশ গোন্ড টোব্যাকের অবিরত সাপ্লাই পাও কোথা থেকে?

সকল পদারথ হ্যায় জগমাহী
কর্মহীন নর পাওয়াত নেহি।

বুঝলে!

এটা কার দোঁহা, সন্ত কবীরের?

না, সন্ত তুলসীদাসের।

তা গোন্ড ব্লক কী করে পাও তা তো বললে না।

আমার বন্ধু ডেভিড ম্যাকফার্সন পাঠায়। যার হাত দিয়ে পারে তার হাত দিয়েই পাঠায়। তবে আর কতদিন পাঠাতে পারবে জানি না।

কেন?

পশ্চিমে তো এখন স্মোক করা আর গোহত্যা সমান অপরাধের ব্যাপার। আর কতদিন টোব্যাকো বানাবে তাই বা কে জানে?

স্বাস্থ্যর কারণে… আমি বললাম।

সে ওদের দেশে হতে পারে। কলকাতায় কি নিউ দিল্লি বা বম্বেতে, অন্য সব শহরের কথা ছেড়েই দিলাম, পলিউশন যা ভয়াবহ তাতে গড়িয়াহাট বা ধর্মতলায় বা শ্যামবাজারের মোড়ে পনেরো মিনিট দাঁড়ালে যা ক্ষতি তা পাঁচ টিন গোল্ডব্লক টোব্যাকো পাইপে ভরে খেলেও হয় না। এটা ডাবল স্ট্যান্ডার্ড। আমাদের দেশের কেন্দ্রীয় বা রাজ্য সরকারের এই পলিউশন কন্ট্রোলের কিছুমাত্র করতে না পেরেও মানুষের ব্যক্তিগত স্বাধীনতাতে হস্তক্ষেপ করার কোনও মানেই আমি দেখি না।

সে কথা ঠিক। ভটকাই বলল।

আমি বললাম, আমিও অনেক মানুষকে জানি যারা কোনওরকম নেশাই করেন না অথচ ক্যানসারে মারা গেলেন, আবার কেউ কেউ সবরকম নেশা করেও আশি পঁচাশি বছর পর্যন্ত দিব্যি বহাল তবিয়তে আছেন।

ভটকাই বলল, আসলে কী থেকে যে কী হয় তা বলা মুশকিল।

ঋজুদা বলল, আর জীবনের অনেকখানি তো কাটিয়ে দিলাম। তা ছাড়া আমার ক্যানসারই হোক, কি হার্ট অ্যাটাক সরকার তো আমার চিকিৎসা করবে না, কোনও দায়িত্বও নেবে না। নিজেদেরই যার যেমন সামর্থ্য সেইমতো সর্বস্বান্ত হতে হবে। তবে আবার এত জ্ঞান দেওয়া কেন?

ভটকাই একটু চুপ করে থেকে বলল, তা ছাড়া জীবনের দৈর্ঘ্যটাই বড় কথা নয়, কোয়ালিটি অফ লাইফটাই আসল।

ঋজুদা বলল, বাঃ বাঃ। এ ছোঁড়া বলে কী রে রুদ্র। এ যে দেখছি জ্ঞানতাপস হয়ে গেছে।

ভটকাই ঋজুদার মন্তব্যকে পাত্তা না দিয়ে বলল, সত্যি, তোমার মতো জীবনকে এমন পরিপূর্ণ ভাবে উপভোগ আর কে করেছে? তুমি মরে গেলে তোমার চেলাদের খুব দুঃখ হবে, তোমাকে তারা খুব মিস করবে কিন্তু। তুমি নিজে তো ড্যাং ড্যাং করে চলে যাবে–উইথ নো রিগ্রেটস।

বটে!

ঋজুদা বলল।

ভটকাই বলল, তবে আমার একটা রিগ্রেট থেকে গেল।

সেটা কী?

তোমার জীবন আরও পূর্ণতর হত যদি স্যেশেলসের সেই কোটিপতি মেমসাহেবকে তুমি বিয়েটা করতে। আমরা, তোমার চেলারাও তো মৌজ করে নিতাম। কী যে ভূত চাপে তোমার ঘাড়ে।

‘ঋজুদার সঙ্গে স্যেশেলসে’ যারা না পড়েছেন তারা তো সেই মেমসাহেবের কথা জানবেনও না।

ভটকাই বলল।

আমি বললাম, কেন, মণিপুরের সেই কন্যে? তিনিও কি কম?

যা বলেছিস। ভটকাই বলল।

বহুদিন পরে রুদ্র আমাকে কনট্রাডিক্ট না করে আমার সঙ্গে একমত হল।

ঋজুদা চুপ করে রইল।

আমরা সমস্বরে বললাম, কী হল? তুমি কিছু বলবে না?

ঋজুদা বলল, বলব। এক নম্বর কথা হল। তোরা বড় ডেঁপো হয়েছিস।

ভটকাই বলল, আর দু নম্বর কথাটা?

ঋজুদা বলল, সকল পদারথ হ্যায় জগমাহী, কর্মহীন নর পাওয়াত নাহি।

আমি ভাবছিলাম, ভটকাই জানে না, ও তো দুদিনের সন্ন্যাসী, আর কতদিন আর কাছে এসেছে ঋজুদার? সেই যে ঋজুদার সঙ্গে জঙ্গলে’ লিখেছিলাম আমি, ঋজুদাকে নিয়ে লেখা আমার প্রথম বই, তাতে ওড়িশার মহানদীর পারের টিকড়পারার বাংলোতে নয়না মাসিকে দেখে আমার মনে হয়েছিল যে কেসটা গড়বড়। আর ঋজুদা স্বীকার করুক আর নাই করুক আমার মনে হয় নয়না মাসির ওপরে ঋজুদার ভীষণই দুর্বলতা ছিল। কিন্তু…। এই কিন্তুটাই সকলেরই জীবনে মস্ত এক বাধা।

যাকগে। আমি চুপ করেই রইলাম।

ঋজুদা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আমার জীবনানন্দের লাইন মনে পড়ে গেল। ‘কে আর হৃদয় খুঁড়ে হায়, বেদনা জাগাতে চায়।

আমরা কথাবার্তাতে এমনই মগ্ন ছিলাম যে কেশকালের অপরূপ প্রকৃতির মধ্যে কালবৈশাখীটাকে পুরোপুরি উপভোগই করা হল না। ঝড় থেমে গেছে অনেকক্ষণ। বৃষ্টিও থেমে গেছে তখন। চৈত্রর বৃষ্টির পরে নানা মিশ্র বনগন্ধকে মুখে করে বৃষ্টিশেষের স্নিগ্ধ অশান্ত হাওয়া ল্যাব্রাডর গান-ডগের মতো এদিকে ওদিকে ছোটাছুটি করছে।

বড় সুন্দর এই সময়টা, বড় স্নিগ্ধ, পূর্ণ। ভাল কোনও সাহিত্য পড়ে ওঠার পরে বা কোনও ভাল গান শোনার পরে মন যেমন শান্ত, সমাহিত হয়ে যায় সেই অভিঘাতে, আমাদের প্রত্যেকেরই তেমনই অবস্থা।

আকাশে কালো মেঘ কালো কেশভারের মতো পরতে পরতে জমে আছে কেশকালের পাহাড়, বনের ওপরে। মাঝে মাঝে শব্দহীন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। ঝরা ফুল, মরা পাতা সেই আলোতে যেন বেঁচে উঠছে।

আজ সকালে ঘুম থেকে ওঠার পরে ঋজুদার অর্ডারে গেয়েছিলাম–

গানের সুরের আসনখানি পাতি পথের ধারে,
ওগো পথিক তুমি এসে বসবে বারে বারে।
আজ সকালে মেঘের ছায়া লুটিয়ে পড়ে বনে,
মেঘ জমেছে ওই গগনের দুই নয়নের কোণে।

ঋজুদা বলেছিল, খুব ভাল গেয়েছিস। রবীন্দ্রনাথ না থাকলে আমাদের যে কী হত।

ভাবছিলাম, সত্যিই তাই।

মুগ্ধ চোখে আমরা বাইরের প্রকৃতির দিকে চেয়ে আছি। এই চোখ আমাদের দিয়েছে ঋজুদাই। যাকে বলে চক্ষুদান করা, তাই। আক্ষরিক অর্থে নয়, কিন্তু অর্থটা তার চেয়েও অনেক বেশি তাৎপর্যময়। দুটি চোখ কত কোটি কোটি মানুষই তো জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি বয়ে বেড়ায়। কিন্তু দেখার চোখ যাকে বলে, তা থাকে কজনের? ঋজুদার কাছে আমাদের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। ঋজুদা আমাদের চোখ দিয়েছে, কান দিয়েছে, নাক দিয়েছে। আর সবচেয়ে বড় কথা, মন দিয়েছে এই নাক-কান-চোখের সম্মিলন ঘটিয়ে। এর চেয়ে বড় উত্তরাধিকার কোটিপতিও তার ছেলেদের দিয়ে যেতে পারে না। ঋজুদা আমাদের প্রত্যেকেরই বাবারই মতন। আমাদের সকলের মা-ই এই কথাতে রাগ না করে খুশিই হবেন।

ঋজুদা ‘কোয়েলের কাছে’ বলে একটা বই পড়তে দিয়েছিল আমাকে আমার চেলাগিরির প্রথম পর্বে। তার পরেও অনেক ভাল ভাল বই পড়িয়েছে আমাদের সকলকেই। সর্বশেষ বই পড়িয়েছেনৃ-তত্ত্ববিদ রামচন্দ্র গুহর লেখা Savaging The Civilized

‘কোয়েলের কাছে’র মুখবন্ধে একটি ইংরেজি চৌপদী আছে।

‘I had an inheritance from my father
It was the Moon and the Sun
I can spend it throughout the World now
And the spending of it is never done.’

পরে ঋজুদার কাছে শুনেছি যে, এই চৌপদী কী একটি স্প্যানিশ কবিতার। স্প্যানিশ সিভিল ওয়ারের সময়ে আর্নেস্ট হেমিংওয়ে অ্যাম্বুলেন্সের ড্রাইভার হিসেবে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে ছিলেন। এক শীতের শেষরাতে হেমিংওয়ে কটি তরুণ যোদ্ধাকে আগুনের পাশে দাঁড়িয়ে গিটার বাজিয়ে এই গানটি গাইতে শুনেছিলেন। এই তথ্য আছে আর্নেস্ট হেমিংওয়ের জীবনীতে–যে জীবনীটি প্রফেসর কার্লোস বেকারের লেখা। হেমিংওয়ের নাকি আরও জীবনী আছে। ঋজুদা আর্নেস্ট হেমিংওয়ের খুব ভক্ত। জীবনের নানা ব্যাপারে তার সঙ্গে ঋজুদার মিলও আছে, আবার অনেক ব্যাপারে বৈপরীত্যও আছে যে এটাও ঠিক।

কেশকালের এই বনবাংলোটি উঁচু একটি পাহাড়ের ওপরে। বনবাংলোর লাগোয়া একটি টিলার মাথায় বসবার জায়গা, গোল করে বেঞ্চ পাতা মাথার ওপর ছাউনি দেওয়া। মধ্যপ্রদেশের বহু বনবাংলোতেই এরকম আলাদা বসার জায়গা ও view-point আছে। অমরকন্টকের পথের লামনির বাংলোতেও আছে। অচানমারে তো একটি আলাদা, পুরোপুরি কাঠ দিয়ে তৈরি আশ্চর্য ছোট বাংলো ও চওড়া বারান্দা আছে। সামনে ও পেছনে অত্যন্ত চওড়া সে বারান্দা। অবশ্য ওড়িশার সিমলিপাল অভয়ারণ্যেও আছে জোরান্ডা বাংলোতে, যেখানে বসে জোরান্ডার গিরিখাদ দেখা যায় ও প্রপাতের শব্দ শোনা যায়।

আমরা বৃষ্টি থেমে যাওয়াতে বাংলো-সংলগ্ন সেই টিলাটার ওপরে গিয়ে ঢাকা জায়গাটিতে বসলাম। ভিজে সপসপ করছে। চৌকিদারের একজন চেলা ঝাড়ন হাতে দৌড়ে এসে বেঞ্চগুলো মুছে দিল।

চমৎকার দেখায় এখান থেকে চারদিকের পাহাড়ময় অরণ্যানী। অনেক নীচ দিয়ে চলে গেছে পিচ রাস্তা আঁকাবাঁকা বন আর পাহাড়কে পাক দিয়ে দিয়ে। বৃষ্টিভেজা পিচ রাস্তায় ট্রাক ও বাসের টায়ারের পিচপিচ শব্দ ভেসে আসছে অস্পষ্ট, দূর থেকে। চৈত্র মাসের অরণ্য যে কত রঙা পোশাক পরে থাকে তা বলার নয়। আর তিন দিন বাদেই দোলপূর্ণিমা। চাঁদ উঠলে রাতে এই বনের রূপ আলাদা হয়ে যাবে, অপরূপা, রহস্যময়ী। এখন গন্ধ উড়ছে। মনে হচ্ছে আতরভরতি একটি ট্রাক বুঝি উলটে গেছে বনের মধ্যে আর খসস, ফিরদৌস, হিথা, রাত-কি-রানি, থীল, গুলাব এবং আরও কতরকম আতরের সুবাস ভাসছে বাতাসে।

ঝড়-বৃষ্টি যতক্ষণ হচ্ছিল পাখিরা চুপ করে ছিল। এখন ডাকাডাকি আরম্ভ করেছে। সবচেয়ে বেশি মুখর ক্রোফেজেন্ট, তিতির, কপারস্মিথ, পিউ কাহা আর কোকিল। পিউ কাহার ডাক মাথার মধ্যে ছুরি চালিয়ে দেয়। তাই বোধহয় সাহেবরা এর নাম দিয়েছিল ব্রেইন-ফিভার। যে ডাকে সেও ব্রেইন-ফিভারের রোগী আর যারা তার ডাক শোনে তারাও সেই জ্বরে আক্রান্ত হয়। প্রতি বনেই একটি করে পাগলা কোকিল থাকবেই। কবি যেমন বলেছিলেন, ‘ফুল ফুটুক না ফুটুক আজ বসন্ত’–তেমনই বসন্ত আসুক আর নাই আসুক পাগলা কোকিল সবসময় কুহু কুহু করে ডেকে বুকের মধ্যে উঁহু উঁহু ভাব চারিয়ে দেয়। প্রকৃতির এসব লীলাখেলা বোঝে বা বোঝায় এমন সাধ্য কার।

ভটকাই কী যেন বলতে যাচ্ছিল, ঋজুদা বলল, চুপ করে থাক, বড় বেশি কথা বলিস তুই। বনের কী বলার আছে চুপ করে শোন। নিজেই যদি এত কথা বলবি তো বনের কথা শুনবি কখন?

ভটকাই লজ্জা পেয়ে চুপ করে গেল।

শুধু পাখির ডাকই নয়, বৃষ্টিতে বনের নিচু জায়গাতে যে স্বল্পমেয়াদি ধারার সৃষ্টি হয় তাদের কুলকুলানি, বাতাসের উসখুসানি, পাতাদের নাচানাচি। যে কোনও গাছের পাতাই হাওয়া লেগে উলটে গেলে তার ভিতর দিকটা বেরিয়ে পড়ে– সাদা দেখায়। শাড়িতে বা অন্য পোশাকে সবসময়েই ঢাকা থাকে বলে যে কোনও মানুষের, বিশেষ করে মেয়েদের মুখের রঙের চেয়ে ঢাকা জায়গার রং অনেক ফরসা ও উজ্জ্বল হয়। তেমন পাতাদের পিঠেই রোদ পড়ে, তাই তাদের নীচের রং সাদাটে ও ফ্যাকাশে হয়। তখন নড়াচড়া করা পাতাদের দেখতে ভারী ভাল লাগে।

আমরা তিনজনে কাছাকাছি বসে ছিলাম। একবার ঋজুদার পাইপ ধরানোর জন্যে লাইটারের খুট করে আওয়াজ হওয়া ছাড়া আমাদের দিক থেকে আর কোনও শব্দ ছিল না। চারদিকের শব্দ আর গন্ধ মঞ্জুরীর মধ্যে আমরা পুরোপুরি সমাহিত হয়ে বসে ছিলাম।

অনেকক্ষণ পরে ঋজুদা কথা বলল। বলল, কেশকালের ম্যানইটার যখন মারতে এসেছিলাম তখন বস্তারের জঙ্গল অনেক বেশি গভীর ছিল। কেশকালের চারদিকের জঙ্গল তো ছিলই। অনেক রহস্যময় ছিল এই সব বন তখন। গাছ অনেকই কাটা হয়েছে, বন পাতলা হয়ে গেছে চুল উঠে যাওয়া মানুষের মাথার মতো। তোরা প্রথমবার দেখছিস, তাই মনে হচ্ছে কী গভীর বন। আসলে আমি অনেক বছর আগে দেখেছি বলেই বুঝতে পারছি পরিবর্তন হয়েছে। প্রকৃতি আমাদের মা। মাকে দেখেশুনে না রাখতে পারলে সন্তানেরা বাঁচবে কী করে– তাদের অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে যাবে যে, এই কথাটাই অশিক্ষিত মানুষে বোঝে না।

আমি বললাম, শিক্ষিত মানুষেও বোঝে না ঋজুদা। চোরাই কাঠ কিনে রান্না করে, চানের জল গরম করে যেসব শিক্ষিত ভদ্রলোক, নানা রাজ্য সরকারের। আমলা, স্কুলের মাস্টারমশাইরা–তারাই আবার জ্বালাময়ী ভাষায় বিভিন্ন সংবাদপত্রের সম্পাদকদের কাছে অরণ্য সংরক্ষণের বিষয়ে ভাবিত হয়ে চিঠি লেখে। এটা ডাবল স্টান্ডার্ড নয়?

অবশ্যই। ঋজুদা বলল।

তারপর বলল, পড়তে-লিখতে পারলে, ইংরেজি কপচালেই মানুষ কিছু শিক্ষিত হয় না। শিক্ষাটা অন্য জিনিস, ভিতরের জিনিস। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক অধ্যাপককে আমি জানি যাদের অশিক্ষিত বলতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা হয় না।

তারপর বলল, কানাডাতে একটি গাছ কাটলে দশ বছর জেল হয়। আমাদের দেশেও তেমনই আইন করা উচিত।

ভটকাই বলল, আইন তো শুধু করলেই হল না, সে আইনকে তো মান্য করাতে হবে। সংসদে বা বিধানসভায় চেঁচামেচি করে টেবিল বাজিয়ে দেশপ্রেম দেখিয়ে আইন পাস করলেই কিছু হয় না, সেই সব আইন যাতে দেশের মানুষে মানে তা না দেখলে আইন একটা তামাশাই হয়ে দাঁড়ায়।

ঋজুদা বলল, আমাদের দেশের সব আইন তো তামাশাই। বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরো। তা শুধু আজকে নয়, আগেও ছিল। নিজে তখনকার দিনের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হওয়া সত্ত্বেও বঙ্কিমচন্দ্র কমলাকান্তর দপ্তরে লেখেননি কি? ‘আইন! সে তো তামাশামাত্র। বড়লোকেরাই পয়সা খরচা করিয়া সে তামাশা দেখিতে পারে। যে আইন মানা হচ্ছে কিনা তা দেখার কেউই নেই, তখন সে আইন করাটাই অর্থহীন।

ওই যে প্রদীপদারা আসছেন।

ভটকাই বলল।

কী করে জানলি?

সাদারঙা কালিস গাড়িটার এক ঝলক দেখতে পেলাম।

ও, ঋজুদা বলল।

তারপর বলল, এবারে ভটকাইচন্দ্রর কী ব্যাপার বল তো রুদ্র। খাওয়া-দাওয়াতে মন নেই। কিচেনে মোটে যাচ্ছেই না।

ভটকাই বলল, সকলের জন্যে করে মরি আর তোমাদেরই ঠাট্টা তামাশার পাত্র হই। আইন করারই মতো তোমাদের জন্যে কিছু করাটাও তামাশা যখন, তখন না করাই ভাল।

আমি আর ঋজুদা হেসে উঠলাম ভটকাইয়ের কথাতে।

ঋজুদা বলল, এবারে কফি বল। প্রদীপ গাঙ্গুলি আর প্রদীপ মৈত্র, সঞ্জীব গাঙ্গুলি আর তাপস সাহারা এসে গেল। আর ভটকাই তুই কিচেনেই যখন যাচ্ছিস, তোর কর্তব্যটাও করে আসিস।

ফ্রি হ্যান্ড দিচ্ছ তো?

অ্যাবসুলটলি। তোর দয়াতেই তো আমরা সব জায়গায় খেয়ে বাঁচি, আর কী সব খাওয়া!

ভটকাই খুশি হয়ে বলল, যাই তাহলে।

যা। প্লিজ।

তারপর বলল, নাগপুরের ওরা সবাই আমাদের জন্যে কত কী করছে বল?

সত্যি।

সুদীপ্ত কাকু আসতে পারলেন না বলে মন খারাপ লাগছে।

কী যেন পদবি সুদীপ্তর।

ভট্টাচার্যি।

খুব নলেজেবল ছেলে।

ঋজুদা বলল।

সাদা টয়োটা কালিস গাড়িটা পাহাড় উঠে আসছে কেশকাল বাংলোর দিকে। ওঁরা এলে, কফি খাওয়া হলে, ঋজুদাকে চেপে ধরতে হবে কেশকাল-এর মানুষখেকো মারার গল্পটার জন্যে। ওইরকম রোমহর্ষক গল্প শোনার জন্যে কেশকাল-এরই ওই টিলার ওপরের ছাউনির চেয়ে ভাল সেটিং আর কী হতে পারে! ঋজুদা আর আমাদের নিয়ে প্রদীপ কাকুরা জগদলপুর, নারায়ণপুর, ইন্দ্রাবতী নদী এবং সম্ভব হলে অবুঝমারেও যাবে। ঋজুদা তো বলেইছে যে। অবুঝমারে যেতে পারলে নারায়ণপুর আর ছোটিডোঙ্গরির মধ্যে একটি পরিত্যক্ত ঘোটুলে আমাদের বাইসন-হর্ন মারিয়াদের নাচও দেখাবে।

.

আমরা টঙে বসে আছি দেখে ওঁরাই সবাই উঠে চলে এলেন। চৌকিদারের একজন চেলা কয়েকটা চেয়ার নিয়ে এল।

ঋজুদা বলল, কী হল?

এখনও বোঝা যাচ্ছে না। নারায়ণপুরে গেলে বোঝা যাবে। কতগুলো ফর্মালিটি আছে। দিনকয় আগে নাকি কয়েকজন ট্যুরিস্ট পারমিশন নিয়ে অবুঝমারে কী সব অসভ্যতা করেছে মেয়েদের সঙ্গে। তাদের মারও লাগিয়েছে বাইসন-হর্ন মারিয়ারা। আবহাওয়া খুবই উত্তপ্ত হয়ে আছে। তাই ওরা দিকুদের আর বেশ কিছুদিন ঢুকতে দেবে না বলেছে। তা নইলে আপনি গভর্নর সিনহাসাহেবের অতিথি, আপনাকে এবং সঙ্গে আমাদেরও না ঢুকতে দেওয়ার কোনও কারণই ছিল না।

ঋজুদা বলল, বাইসন-হর্ন মারিয়ারা খুবই অনুভূতিপ্রবণ। ছেড়ে দাও। পরে আবার কখনও যাওয়া যাবে। আমাদের অসভ্যতা-অভব্যতার কারণেই ওরা বিরূপ হয়ে ওঠে। তা ছাড়া এখন তো বস্তার ছত্তিশগড়ে। ছত্তিশগড় সরকার এসব অসভ্যতা আদৌ বরদাস্ত করবে না। করা উচিতও নয়। আমাদের ব্যবহারই ওদের তিক্ত করে দেয়। পূর্ব আফ্রিকাতেও দেখেছি, মাসাইরা শহুরে অনাদিবাসী মানুষদের ওপরে এতটাই বীতশ্রদ্ধ যে কেউ ফটো তুলতে ক্যামেরা বাগালেই ওরা হাতের বর্শা ছুঁড়ে মারে। রুদ্র একবার খুব বেঁচে গিয়েয়েছিল গোরাংগোরোর মৃত আগ্নেয়গিরির বলয়ের ওপরে একজন মাসাই-এর ছবি তুলতে গিয়ে। নেহাত বর্শাটা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছিল। জিপের বনেটের ওপরে এসে পড়ে বনেট ফুটো করে দিয়েছিল। রুদ্রবাবু তিনদিন নার্ভাস ব্রেকডাউন হয়ে কাহিল হয়েছিলেন। বাবুকে জিজ্ঞেস করো না।

সকলেই সমস্বরে বললেন–তাই? রুদ্র?

আমি বললাম, শুনলেনই তো। আর কী বলব। সত্যিই আমার নার্ভাস ব্রেকডাউন হয়ে গেছিল। মাসাইরা সিংহের চেয়েও সিংহ-বিক্রম।

শুনেছি, মাসাই মেয়েরা নাকি এমন ছেলেকে বিয়েই করে না যে পায়ে হেঁটে বর্শা দিয়ে একটা সিংহ না মেরেছে। সত্যি?

প্রদীপ মৈত্র কাকু বললেন।

এখন অনেক বদলে যাচ্ছে ওরা। তথাকথিত সভ্যতার চাপে। তবে এখনও এ প্রথা অনেক জায়গাতেই আছে।

আমি বললাম, বাংলাতে একটা বই আছে, ইলমোরানদের দেশে’– মাসাইদের নিয়ে লেখা। লেখাটি পড়লে সব জানতে পারবেন।

তোমার লেখা?

সঞ্জীব কাকু জিজ্ঞেস করলেন।

আমি বললাম, না, না, আমার লেখা নয়।

ঋজুদা বলল, বুদ্ধদেব গুহর লেখা।

ইলমোরান মানে কী?

মাসাই যুবক যোদ্ধাদের ইলমোরান বলে।

ওরা গার্হস্থ্য জীবনে ঢোকার আগে জঙ্গলের মধ্যে আলাদা একটি ক্যাম্পে। থাকে–শুধুই ইলমোরানরা। সেখানে তাদের শিক্ষা সম্পূর্ণ হলে তারপর সিংহ শিকার করে বিয়ে করে সংসারী হয়।

ততক্ষণে কফি এসে গেছে। পেছন পেছন ভটকাইও।

ঋজুদা বলল, কী সমাচার মিস্টার ভটকাই?

রাতের খাওয়াটা সিম্পলই করলাম। কাল তো আমরা নারায়ণপুরেই পৌঁছে যাব। প্রদীপকাকু বলেছেন জগদলপুরেও এয়ারকন্ডিশানড ভাল হোটেলে থাকব আমরা। সে হোটেলে মোগলাই, চাইনিজ এবং পাঞ্জাবি খাবারও পাওয়া যায়। সেখানে তো ভাল চোব্য-চোষ্য হবেই, তাই।

তা মেনুটা কী করলি তাই বল না।

আমি বললাম।

সারাদিন বৃষ্টি হচ্ছে। ঠান্ডা পড়ে গেছে পাহাড়ে। তাই মুগের ডালের খিচুড়ি, মধ্যে কিশমিশ আর নারকোল কুচি দিয়ে, মুসুরির ডালের বড়া, ফিনফিনে করে কাটা আলু ভাজা, বেগুন ভাজা, শুকনো লঙ্কা ভাজা আর সুইট ডিশ তো প্রদীপ কাকুরা নিয়েই এসেছেন শহর থেকে।

প্রদীপ গাঙ্গুলি কাকু লজ্জা পেয়ে বললেন, শহর কোথায়! যেখানে গেছিলাম সেটা কি শহর। লাড়ু-মা ছিল কিছু তাও মনে হল বাসি। তোমার রাবড়ি তো পেলাম না।

ভটকাই বলল, নো প্রবলেম। একটা অল্টারনেটিভ মেক-শিফট বন্দোবস্ত করে আসছি। পাঁচ মিনিট।

বলেই ভটকাই টঙ থেকে নেমে গেল।

কফিটা খেয়ে যা।

ঋজুদা বলল।

এসেই খাচ্ছি। ঠান্ডা কফি খেলে গায়ের রং ফরসা হয়।

সঞ্জীব কাকু বললেন, তুমি আরও ফরসা হয়ে গেলে তো তোমার মা বাবা ঝামেলাতে পড়বেন। লোকে ভাবতে পারে তুমি সাহেবের বাচ্চা।

সে তাদের প্রবলেম। আমি ফিরে আসার আগে যেন গল্পটা শুরু কোরো না ঋজুদা।

ভটকাই নেমে যেতেই ওঁরা সবাই কফি খেতে খেতে ঋজুদাকে চেপে ধরলেন, বললেন, কেশকাল-এ বসে কেশকাল-এর বাঘের গল্পটা না শুনলে আর কোথায় শুনব বলুন? কফি খেয়ে পাইপটা ফিল করে নিয়ে এবারে শুরু করতে হবে কিন্তু ঋজুদা।

হবে।

ঋজুদা বলল।

তারপর বলল, ভটকাই ফিরুক। নইলে ও কেটে ফেলবে।

ভটকাই যেমন বলেছিল তেমনই পাঁচ মিনিটের মধ্যে ফিরে এল।

আমি বললাম, কী করলি? অল্টারনেটিভ?

বলল, যা করলাম তা কেউই খায়নি আগে।

কী করলি তাই বল না।

এর নাম দিলাম হানি-পোটাটো।

মানে?

টোম্যাটোর মিষ্টি চাটনির ড্রেসিং দিয়ে আস্ত আলুসেদ্ধর মধ্যেটা ফুটো করে তার মধ্যে বস্তারের মধু ভরে মুখটা আবার আলুসেদ্ধ দিয়ে সিল করে দেবে। আলুতে কামড় দিবি আর গলগল করে মধু ঢুকবে মুখে।

কী ফুলের মধু?

ঋজুদা জিজ্ঞেস করল।

গুন্দরী ফুলের। বস্তার স্পেশ্যাল। দেখো না, জমে যাবে।

নামটা বানালি, না?

আমি বললাম।

ভটকাই হেসে ফেলে বলল, না-হয় বানালামই। বানাতে কি সকলে পারে ভাইবাভোস-এর জন্যে রিহার্সাল দিচ্ছি। ফটাফট উত্তর দেওয়াটাই আসল। ইন্টারভিউ বোর্ডে তো থাকে যত পাঁঠা। তাদের জব্দ করতে হলে এমনই ফটাফট উত্তর দিতে হয়।

কীসের ভাইভা?

প্রদীপ কাকু বললেন।

এখনও কিছু ঠিক নেই। তবে একদিন না একদিন তো বসতে হবেই। এখন থেকে মহড়া দিয়ে রাখছি।

প্রদীপ মৈত্র কাকু বললেন, দুটি চেলা তৈরি করেছেন বটে ঋজুদা।

আমি আর কী তৈরি করব, তারাই আমাকে তৈরি করছে। আমাকে এরা এক হাটে কিনে অন্য হাটে যে কোনওদিন বেচে দিয়ে আসবে।

কফি খাওয়া শেষ, এবারে গল্প শুরু হোক।

এই কো-ইনসিডেন্সটা যদিও কাকতালীয় কিন্তু এমনই এক কালবৈশাখী ওঠা চৈত্র দিনে আমি নাগপুর থেকে জিপে করে এসে কেশকাল-এ পৌঁছেছিলাম। পৌঁছতে পৌঁছতে রাত হয়ে গিয়েছিল, আমাদের যেমন হল। তবে তখন রাস্তা রায়পুর শহর থেকে বেরোনোর পরেই পুরো কাঁচা ছিল। পথে রাতে এমনিতেই লোকজন যাবে না জঙ্গুলে জায়গায়, তার ওপরে ম্যানইটারের অঘোষিত কার্ফ। ইতিমধ্যেই বাঘটা চৌত্রিশজন মানুষ খেয়েছিল পঞ্চাশ বর্গমাইল, মাইল, কিমি নয়, এলাকাতে।

মাইল কেন?

তখন মাইলই ছিল। কিলোমিটার আসেনি এ-দেশে। টাকা আনা পাইও ছিল। ষোলো আনাতে এক টাকা।

তারপর?

পথে কোনও গাড়ি বা বাসও দেখলাম না। রাতের বেলা জীবন এ অঞ্চলে একেবারে স্তব্ধ হয়ে যেত।

নাগপুরে, রায়পুরে এত ভাল ভাল শিকারি থাকতে আপনাকেই কলকাতা থেকে তলব করলেন কেন কর্তৃপক্ষ?

জানি না। তাদের হয়তো মতিভ্রম হয়েছিল। আসলে ব্যাপারটা কী জান? যশ একটা অত্যন্ত গোলমেলে ব্যাপার। যশস্বী হওয়ার জন্যে, সে কারণেই জীবনের সব ক্ষেত্রেই গান, সাহিত্য, খেলাধুলো যে ক্ষেত্রেই বল, মানুষের কেমন আকুতি দেখতে পাও না? তবে গান বা খেলাধুলোর ক্ষেত্রে ফল ফ্লকে পাওয়া যায় না। গেয়ে দেখাতে হয়, খেলে দেখাতে হয় কিন্তু সাহিত্যের ব্যাপারে ছাইভস্ম লিখেও তুমি স্ট্রিং-পুলিং করে প্রাইজের পর প্রাইজ বাগিয়ে মস্ত লেখক বলে প্রতিপন্ন করতে পার নিজেকে। জীবদ্দশায় তুমি ক্যান্টার করে বেরিয়ে যেতে পার কিন্তু মৃত্যুর পরে তুমি যে মাকাল ফল এটা পাঠক-পাঠিকারা হৃদয়ঙ্গম করে পোটকা মাছের মতো তোমাকে ফুটপাথে ফেলে দেবে। মৃত্যুর তিন মাসের মধ্যেই তুমি বিস্মৃত হয়ে যাবে। সত্যিই এমন হয় যশ যেখানে চালাকি করে পাওয়া হয়।

শিকারি আপনার বেলাতে কী হয়েছিল?

আসলে অনেকগুলো মাথামোটা আর ব্যর্থ প্রেমিক নরখাদক বাঘ ও চিতা আমার হাতে মরে আমাকে শিকারি হিসেবে দারুণ যশস্বী করে দিয়েছিল। কৃতিত্বটা আমার একটুও নয়, সেসব সেই গুলিখোর নরখাদকের। তা ছাড়া, PRICOS 709 at nothing succeeds like success! fluke-43 wants to অনেকে যশস্বী হয়ে যায়, আর সেই যশের চক্করে মধ্যপ্রদেশের কর্তৃপক্ষও পড়লেন। এখানের নানা সংবাদপত্রে চিঠি বেরোতে লাগল কলকাতা থেকে ঋজু বোসকে আনানো হচ্ছে না কেন? আর কত মানুষকে বাঘ দিয়ে খাওয়ানো হবে? মধ্যপ্রদেশ বিধানসভাতেও কোনও কোনও বিধায়ক এ নিয়ে চেঁচামেচি করলেন। তারপরই ওঁরা আমার সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। তোমরা যে কথা বলছ আমিও ঠিক সেই কথাই বললাম, বললাম নাগপুর, রায়পুরে এত ভাল শিকারি থাকতে আমাকে ডাকা কেন? তা ওঁরা বললেন, এই হতচ্ছাড়া বাঘে তিনজন শিকারিকেও খেয়ে ফেলেছে। কেন আপনাকে ডাকছি তা নিয়ে আলোচনা করবেন না প্লিজ, ওপর থেকে চাপ আছে আমাদের ওপরে, দয়া করে চলে আসুন নেক্সট ফ্লাইটে।

অতএব আসতে হল।

ভটকাই বলল, এসব আজেবাজে কথা আমরা শুনতে চাই না। স্ট্রেইট জঙ্গলে চলে এসো। বাঘের সঙ্গে এনকাউন্টারে।

সকলেই বললেন, ঠিক বলেছে ভটকাই। ডিনারের আগে তো গল্প শেষ করতে হবে। আজ তাড়াতাড়ি খেতে হবে। এখান থেকে নারায়ণপুর অনেকখানি পথ। নিন শুরু করুন।

সেদিন রাতে এসে তো শুয়ে পড়লাম।

কী কী ওয়েপন এনেছিলে?

আমি জিজ্ঞেস করলাম।

রাইফেলের মধ্যে ফোর-ফিফটি ফোর হানড্রেড ডাবল ব্যারেল জেফরি নাম্বার টু। খুব ভাল মারত রাইফেলটা আর ম্যানুভার করতেও খুব সুবিধা ছিল। একেবারে হাতের রাইফেল। আর থার্টি ও সিক্স ম্যানলিকার শুনার লাইট রাইফেল। এক্কেবারে আকুরেট। আর বন্দুকের মধ্যে একটা টুয়েলভ বোর ওভার-আন্ডার ডাবল ব্যারেল।

ওভার আন্ডার হলে তো ডবল ব্যারেলই হবে।

আমি বললাম।

ঋজুদা বলল, ঠিক বলেছিস। আমার বোকামি হয়েছে।

সঞ্জীব কাকু বললেন, এসব রাইফেলবন্দুকের ব্যাপার আমরা বুঝি না। আসল গল্পে আসুন।

ঋজুদা বলল, সকলেই তো আমার মতো খালি গলার গায়ক নন! যাঁরা সত্যিকারের ভাল গায়ক, তাদের গানে বসার আগে তানপুরা, এসরাজ অথবা বেহালা, তবলা সব বেঁধে নিতে হয়। পিচ-পাইপ দিয়ে সুর বের করে প্রত্যেক যন্ত্রী ও বাজিয়ে নিজের নিজের বাজনা ঠিক স্কেলে বেঁধে নেওয়ার পরই গায়ক আলাপ আরম্ভ করেন। শিকারিও যদি তার যন্ত্র সব ঠিকঠাক না বেছে নেন আগেভাগে তখন আসল সময়ে সব গণ্ডগোল হয়ে যেতে পারে, যায়ও।

তারপর বলো।

ভটকাই বলল।

পরদিন সকালে আশপাশের বহু গাঁয়ের মুখিয়ারা এল। এসে তাদের মর্মন্তুদ অভিজ্ঞতা জানাল। তারা দুজন জংলি শিকারিকেও নিয়ে এসেছিল সঙ্গে করে। তাদের একজনের নাম প্রেমা, অন্যজনের নাম ভীমা। প্রেমা লোকটি একটু বেশি কথা বলে। সে একটা আসন গাছের ডালে বসে মওকা পেয়ে তার একনলা গাদাবন্দুক দিয়ে এই বাঘকে নাকি গুলিও করেছিল।

তারপর ঋজুদা বলল, গুলি করেছিল যখন তখন বাঘকে মারা উচিত ছিল। এইরকম দায়িত্বজ্ঞানহীন শিকারিরা বাঘকে যত্রতত্র গুলি করাতেই বাঘ মানুষখেকো হয়ে ওঠে। লোকটা নিজেকে বাহাদুর মনে করে। তদুপরি বাঘটা মারতে হলে আমাকে কী কী করতে হবে তাও বাতলাচ্ছিল, অবশ্য যথেষ্ট বিনয়ের সঙ্গেই। লোকটাকে আমার পছন্দ হল না। অগণ্য জংলি শিকারিকে ভারতের এবং আফ্রিকার জঙ্গলে আমি দেখেছি। যারা প্রকৃতই ভাল শিকারি তারা কথা কম বলে এবং এমন ভাব দেখায় যে তারা শিকারের কিছুই জানে না। খুবই বিনয়ী হয়। ওর চেয়ে ভীমা লোকটিকে আমার ভাল লাগল। লোকটির পায়ে একটু অসুবিধে আছে। বাঁ পায়ে। সামান্য খুঁড়িয়ে চলে। শুয়োরে তার উরু চিরে দিয়েছিল, তখনই কোনও নার্ভ-টার্ভ ছিঁড়ে গিয়েছিল হয়তো, সে সময়ে মাটিতে পড়ে যাওয়ার পর বাঁ পায়ের গোড়ালির ওপরে দাঁত চালিয়েছিল শুয়োর।

আমি রেঞ্জারকে তেমনই বললাম। রেঞ্জার ওরা আসার পরেই তার সাইকেলে করে এসে পৌঁছেছিলেন। ভীমাই আমাকে সাহায্য করবে। সে বড় গরিব। তার নিজের বন্দুক নেই। গাদাবন্দুকও নয়। এ গ্রাম সে গ্রামের বড়লোকেরা তাদের বন্দুক আর কার্তুজ দিয়ে ভীমাকে দিয়ে শুয়োরটা হরিণটা মারাত। জঙ্গলে যে মুরগি মারার জন্যেও ঘোরে তারও বাঘের সম্বন্ধে ধারণা থাকে। মুরগি মারতে গিয়েও বাঘের সামনে তাকে বহুবার পড়তে হয়। বাঘ ও চিতাও সে মেরেছে। তবে নানা গাঁয়ের বড়লোক আর বড়লোক শহুরে শিকারিদের জন্যে। গাঁয়ের বড়লোকেরা বাঘছালের ওপরে বসে পুজো করছে আর শহুরে শিকারিরা শহরে ফিরে বউ, শালি আর শাশুড়ির কাছে হিরো বনেছেন।

আজকে পাদরিকে বলারই মতো সকলেই সত্যি কথা বলছে। আমাকে ওরা কনফেশানাল করেছে। সব বে-আইনি কাজের ফিরিস্তি দিচ্ছে রেঞ্জারের সামনেই। আজকে কেউই তাদের অপরাধ নেবে না, কারণ এখন নরখাদক বাঘ মারাটাই আশুকর্তব্য। সেই বড় কাজে সামিল হয়ে ছোটখাটো অপরাধের কথা আর কেউই মনে রাখতে চায় না।

রেঞ্জার সূরপ্রসাদ ওয়ালকারও দেখলাম যথেষ্ট টেনশনে আছেন। তাঁর চোখমুখ শুকিয়ে গেছে টেনশনে। তা ছাড়া তাকে ওই নরখাদক বাঘের জঙ্গলে এখন পনেরো মাইল সাইকেল চালিয়ে ফিরে যেতে হবে। বাঘটা ইতিপূর্বে দুপুরবেলাতেও মানুষ মেরেছে তার মধ্যে দুজন সাইকেল আরোহীও ছিল। তার ভয়টা অমূলকও নয়।

সকলের সঙ্গে আলোচনা করে যা বোঝা গেল তাতে জানা গেল যে সেটা বাঘিনী এবং চেহারাতে খুব বড়সড়ও নয়। তার মানে বেশি বয়স নয়। তবে তার বিয়ে হয়েছে। কারণ মানুষখেকো হয়ে যাওয়ার আগে জঙ্গলের মানুষ আর জংলি শিকারিরা তাকে অন্য বাঘের সঙ্গে দেখেছিল। তার তিনটি বাচ্চাও হয়েছিল। তবে একটি বাচ্চাও বড় হওয়া অবধি বাঁচেনি। বাঘে দু-একটি খেয়েও ফেলতে পারে এবং বাচ্চারা হয়তো বা শিকারির গুলিতে মরে গিয়েও থাকতে পারে। বাচ্চাদের কী হয়েছিল তা জানে না কেউই।

এই বাঘিনীর ওপরে অনেক শিকারি গুলি চালিয়েছিল। সামনের বাঁ পা-টি খোঁড়া আছে সামান্য। সেও ভীমার মতো খুঁড়িয়ে হাঁটে। এর চেয়ে বেশি তথ্য আপাতত পাওয়া গেল না।

রেঞ্জার সাহেবকে বলে ভীমার কেশকাল বাংলোতেই থাকা-খাওয়ার বন্দোবস্ত করলাম। আমাকে সে যে মদত দিচ্ছে সেটা রেঞ্জ অফিসের রেকর্ডেও নথিভুক্ত করে নিতে বললাম।

তারপর?

সঞ্জীব কাকু বললেন।

তারপর বেলা এগারোটা নাগাদ রেঞ্জার সাহেব এবং ওরা সকলেই চলে গেল। আমি চৌকিদারকে বললাম, বারোটার সময়ে ভীমাকে খাবার দিয়ে দেবে এবং খাবার দিবে এবং আমাকেও। আধ ঘণ্টা জিরিয়ে নিয়ে আমরা জঙ্গলে বেরোব প্রাথমিক তদন্তে। বাঘের রাহান-সাহানের খোঁজ যদি কিছু মেলে সেই জন্যে আমরা বাঘকে ভয় করছি না। বাঘেরই উচিত হবে আমাদের ভয় করা। বাঘ যদি আমাদের ধরতে আসে, তাহলে তো আমাদের কার্যসিদ্ধিই হয়ে যাবে। মানুষখেকো বাঘ, যে বাঘ তিনজন শিকারিকে ইতিমধ্যেই খেয়েছে, তার হয়তো শিকারির মাংস খেতে ভাল লাগে। আমার যেমন বাঘের মাংস খেতে একটুও ভাল লাগে না। ওড়িশাতে একবার চেখে দেখার জন্যে বাঘের মাংস খেয়েছিলাম। মুখে দিয়েই ফেলে দিয়েছিলাম। অন্নপ্রাশনের ভাত উঠে এসেছিল। তাই বাঘের মাংস খাওয়ার কোনও ইচ্ছাই আমার নেই।

.

ভীমাকে আমার ওভার-আন্ডার বন্দুকটা দিয়েছি। কীভাবে ব্যবহার করতে হয় তাও দেখিয়ে দিয়েছি। আমার নির্বাচন ভুল হয়নি। ওই মিতবাক মানুষটি খুবই বুদ্ধিমান। ও এসেছিল একটা লালরঙা জামা ও ধুতি পরে। জামাটার বগলের কাছটা ছেঁড়া, ধুতিটাও নানা জায়গাতে ছেঁড়া। ওকে যখন বললাম, তোমার আর অন্য জামা নেই? ও বলল বাড়িতে আর একটা আছে সেটা নীল রঙের। ধুতি আরেকটাই আছে মাত্র।

তারপর ঋজুদা বলল, প্রদীপ গাঙ্গুলি কাকুকে, শহরে তোমরা যেমন নাইকে বা লেভিস বা অন্যান্য ব্র্যান্ডের শার্ট কেনো বহু দাম দিয়ে, তখন ভীমাদের ওয়াস্রোব বলতে মাত্র দুটি ছেঁড়া ধুতি ও ছেঁড়া শার্ট। চৌকিদারকে বললাম, ওদের কারও একটা খাকি জামা আর খাকি প্যান্ট ভীমাকে দিতে, আমি রেঞ্জার সাহেবকে বলে দেব ওদের নতুন ইউনিফর্ম দিতে। ভীমার জন্যেও দু সেট ইউনিফর্ম লাগবে নতুন, ভীমা এখন বনবিভাগেরই কর্মী। আমি অলিভ-গ্রিন রঙা বুশ শার্ট আর ট্রাইজার পরেছিলাম।

একটি কাঁধে-ঝোলানো থলিতে একটি পাঁচ ব্যাটারির টর্চ আমেরিকান বন্ড কোম্পানির, একটি দু ব্যাটারির টর্চ, আমার জলের বোতল ওপরে ফ্ল্যানেল দেওয়া, একগাছি সিল্কের দড়ি–বেশ অনেকখানি লম্বা, প্রয়োজনে মাচানবাঁধা বা গান ট্র্যাপ হিসেবে ব্যবহার করার জন্যে আর একটি রেমিংটনের ছুরি।

থলেটা ভীমাই নিয়েছে কাঁধে। ভীমা আমার সামনে সামনে চলেছে। নারকোলের দড়ি দিয়ে বেল্ট করেছে ঢোলা প্যান্টকে শাসন করার জন্যে। প্যান্টটার মধ্যে আমি শার্টটা খুঁজে নিতে বলেছি। বন্দুকটা ডান কাঁধে নিয়ে থলেটা বাঁ কাঁধে ঝুলিয়ে আমার পথপ্রদর্শক, সঙ্গী গাইড বড় গরিব ভীমা, আমার ভারতীয় ভাই, খালি পায়ে নিঃশব্দে কাটা এড়িয়ে শুকনো পাতা এড়িয়ে বাঘেরই মতো সাবধানী পা ফেলে ফেলে চলেছে। বৃষ্টিতে মাটি নরম, মাটিতে পড়ে থাকা কোনও পাতাই এখন শুকনো নয়, পা পড়লেও শব্দ হবে না, কিন্তু সাবধানে এবং নিঃশব্দে চলা অভ্যাস হয়ে গেছে বলেই অমনি করে চলেছে ভীমা। আমার পায়ে হালকা রাবার সোলের জুতো। আমারও সাবধানে চলা বহু বছরের অভ্যেস। ভীমার পেছন পেছন ফোর-ফিফটি ফোর হানড্রেড রাইফেলটা নিয়ে আমি চলেছি। রাইফেলটা খুব না হলেও ভারী। কিন্তু ফিরতে রাত হতে পারে, এমনকী রাতে ফেরা না-ও হতে পারে বলেই এই রাইফেলটা নিয়েছি। অন্ধকারেও ওর মার কাজে আসবে।

আমরা কথা বলতে বলতে চলেছি। বাঘ যদি আমাদের উপস্থিতি টের পায়, তবে সে-ই আমাদের খোঁজে আসবে। জানি না, এ বাঘ শিকারি চেনে কিনা, চিনতেও পারে, তিন-তিনজন শিকারিকে সে খেয়েছে, কিন্তু তবু শিকারিও তো মানুষ। মানুষ খেয়েই যখন সে বাঁচছে তখন, শিকারিকে ভয় না পেয়ে মানুষ বিচার করেও সে আসতে পারে কাছে।

এই ওভার-আন্ডার ব্যাপারটা কী।

ভেল-এর ইঞ্জিনিয়ার তাপস কাকু প্রশ্ন করলেন।

ঋজুদা বলল, দোনলা বন্দুকের সচরাচর নল দুটি পাশাপাশি থাকে, আর ওভার-আন্ডারে নল দুটি ওপর-নীচে থাকে।

তাতে লাভ কী হয়?

লাভ কিছু বিশেষ হয় এমন নয়। দোনলা বন্দুকে একনলা বন্দুকের চেয়ে যে বেশি লাভ হয়, তাই হয়। তবে অনেক শিকারি মনে করেন, ওভার-আন্ডারের ম্যানুভারেবিলিটি পাশপাশি নলের বন্দুকের চেয়ে বেশি। তাড়াতাড়ি নিশানাও নেওয়া যায় এতে।

আপনিও মনে করেন তাই?

আরে ব্যাটসম্যানের যেমন অনেক ব্যাট থাকে, লেখকের যেমন অনেক কলম থাকে, শিকারিরও তেমন অনেক বন্দুক থাকে। শখের জন্যেই সকলেই সংগ্রহ করেন। কাজ তো হয়তো একটি রাইফেল ও একটি বন্দুকেই চলে যেতে পারে। কিন্তু বহু বন্দুক ও রাইফেল রাখেন শৌখিন শিকারিরা। যতটা শখের জন্যে; ততটা প্রয়োজনের জন্যে নয়।

তারপর? ভটকাই বলল।

ভীমা আগে আগে চলছিল, কারণ সে নাকি একটা পাহাড়কে জানে, যেখানে অনেকগুলো গুহা আছে। ওর ধারণা, এই বাঘিনীর আসল আস্তানা ওই পাহাড়েরই কোনও গুহা। যোগ্য হাতিয়ার এবং যোগ্য সঙ্গীর অভাবে সে কোনওদিন সেই গুহার সন্ধানে যেতে পারেনি। আজ আমার মদতে সে সেইখানেই চলেছে।

তোমার বাড়িতে কে কে আছে? আমি ভীমাকে জিজ্ঞেস করলাম।

বউ, এক ছেলে আর মা। বাবা মারা গেছে গাছ চাপা পড়ে, গাছ কাটতে গিয়ে অনেকদিন আগে।

তোমাদের খেতি-জমিন আছে?

তা থাকলে তো দুঃখই ছিল না। একটা মস্ত তেঁতুল গাছতলাতে বসতবাড়িটুকু ছাড়া আর কিছুই নেই আমাদের।

সংসার চলে কী করে?

চলে না হুজৌর। সে চলাকে চলা বলে না।

তুমি কিছুই কর না?

ওই৷ কেউ কিছু মেরে দিতে বললে মেরে দিই। এক টাকা, দু টাকা দেয়। কেউ পাঁচ দশ টাকাও দেয়। শহরের বড়লোক শিকারিরা এলে বেশি দেয়। তবে সে তো ন মাসে ছ মাসে। তবে হরিণ, শুয়োর মারলে একটু মাংসের ভাগ পাই, মানে শিকার। তাই খেয়ে বড়লোকি করি এক-দুদিন।

তারপর ঋজুদা বলল, তোমরা সব ফিগার কনসাস ক্যালরি, হার্ট, ক্লোরোস্ট্রোল কনসাস স্বচ্ছন্দ মানুষেরা যখন ফ্যাট-ফ্রি দুধ, lean meat, পোলট্রি চিকেন খাও, ডিক্যাফিনেটেড কফি ইত্যাদি ইত্যাদি, তখন একজন জঙ্গুলে সাধারণ ভারতীয় একটু প্রোটিনের জন্যে হা-পিত্যেশ করে মরে। মেনকা গান্ধীরা সব জানেন না। এদের কাছে মাংসের আরেক নাম শিকার। মাংসকেই এরা শিকার বলে। বিহার, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ এবং ওড়িশাতেও। কালে-ভদ্রে বছরে চার-পাঁচবার একটু–প্রোটিন ওরা খেতে পায় ওই শিকার করা মাংসেরই মাধ্যমে। ওদের কারওরই পাঁঠা, হ্যাম বা বেকন বা চিকেন বা বিফও কিনে খাওয়ার সামর্থ্য নেই। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সকলেই সমান গরিব। আসল ভারতবর্ষ যে তিমিরে ছিল ব্রিটিশরাজের অধীনে সেই তিমিরেই আছে স্বরাজ পেয়েও। ব্রিটিশদের আমলে তবু আইনশৃঙ্খলার বাঁধনটা ছিল। দেশ স্বাধীন হয়ে সে বালাইও গেছে। আফগানিস্তানে বা অন্য অন্ধকারাচ্ছন্ন ছোট্ট দেশে স্বাধীনতার যে প্রকার, আমাদের দেশেও তাই। এ দেশীয় মিডিয়া এবং নেতারা দেশের কোনও খবর রাখেন না। দেশ চলেছে নৈরাজ্যের দিকে আর নেতাদের বক্তৃতার ফুলঝুরি আরও জোর হচ্ছে–মিডিয়া বিজ্ঞাপনের লোভে নিজেদের বিকিয়ে দিয়েছে। কনজুমারিজমের রমরমা। আরও টাকা আরও ক্ষমতার প্রতিযোগিতাতে সামিল হয়েছে তারা সবাই। দেশের কথা কে ভাবে।

এই ভীমা সিং-রাই গড়পড়তা ভারতীয়দের প্রতিভূ। শহুরে সচ্ছল ভারতীয়দের হিসেবে নিয়েও Mean, Median, Mode কষে দেখলে তার নিট ফল হবে ভীমা সিং। ভারতবর্ষ ভীমা সিংদের অবস্থাতেই আটকে আছে। কিছু কেতাবি আর খেতাব-পাওয়া অর্থনীতিবিদ তাদের থিওরেটিকাল কপচানি দিয়ে দেশকে আরও বড় সর্বনাশের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। এই সব অর্থনীতিবিদ দেশকেই জানেন না, বছরে তিনদিন দেশে এসে বক্তৃতা করেন দেশ সম্বন্ধে। হাস্যকর ব্যাপার-স্যাপার। আর এদেরই মাথায় চড়িয়ে লাফালাফি করি আমরা।

আমি বললাম, হচ্ছিল মানুষখেকো বাঘ মারার গল্প, তুমি দেখছি ইকনমিস্ট মারার গল্পে চলে গেলে।

ঋজুদা হেসে বলল, ইচ্ছে করে এইসব ইকনমিস্টকে ধরে ধরে বাঘ দিয়ে খাইয়ে দিই। কিন্তু আমার ইচ্ছার দাম আর কে দেবে?

ভটকাই বলল, গাড়ি ডিরেইলড হয়ে যাচ্ছে। ট্রাকে ফের।

শিকার আর বছরে কতদিন কর। অন্য সময়ে কী কর। আমি ভীমাকে শুধোলাম।

শিকার মাসে তিন-চারদিন করি গড়ে। অন্য সময়ে যে কাজ পাই তাই করি। কখনও জঙ্গলে কুপ কাটি, কখনও ট্রাকে মাল লাদাই করি, বললামই তো হুজৌর যে যা করতে বলে তাই করি।

বলেই ঋজুদা বলল, ভীমা সিং যে চুরি-ডাকাতি করে না, না খেয়ে থেকেও যে সৎ আছে, এ-ও এক ভারতীয় শিক্ষা। শহরের লেখাপড়া জানা সচ্ছল বামুন, কায়েত, শিডিউন্ড কাস্ট, শিডিউন্ড ট্রাইব–সকলে মিলে হাতে হাতে মিলিয়ে যখন লুট-মার চালাচ্ছে তখন ভীমা সিংরা না খেয়ে রয়েছে। এর পরও যদি তারা নকশাল হয়ে যায়, এম সি সি-তে যোগ দেয়, তাহলে কি ওদের দোষ দেওয়া যায়?

আমি এবারে বললাম, গল্পে ফেরো ঋজুদা। মাঝে মাঝেই দেশ তোমাকে ছারপোকার মতো কামড়ায়।

ঋজুদা গম্ভীর হয়ে বলল, কী করব! আমার দেশকে যে আমি ভালবাসি, আমার দেশের বিভিন্ন রাজ্যের দীনদরিদ্র মানুষদের যে আমি কাছ থেকে দেখেছি। তাদের জন্যে আমার সত্যিই যে দরদ আছে। তাদের কষ্টে আমার বুক ফেটে যায়।

প্রদীপ গাঙ্গুলি কাকু বললেন, আপনার কথা রুদ্রর কলমে আমরা বহুদিন হল পড়ে আসছি। আপনাকে রুদ্রর ঋজুদা কাহিনিগুলির মাধ্যমে স্পষ্টই চেনা যায়। আমরা চিনতে ভুল করিনি। আপনি তো আমাদের মতো অনেক মানুষের মধ্যে এই দেশপ্রেম জাগিয়ে দিয়েছেন। এইটুকুই বা কম কী?

আমি জাগাইনি, রুদ্র রায় জাগিয়েছে। সব কৃতিত্ব তারই।

ওই হল। আপনার কথাই তো সে লিখেছে।

ভটকাই বলল, এ কী পারস্পরিক পিঠ চুলকানি শুরু হল রে বাবা। বাঘের গল্প আর হবে না। আমি যাচ্ছি চান করতে। খিচুড়িটা এনজয় করতে হবে।

ঋজুদা বলল, বোস বোস। এবারে কথা দিচ্ছি একেবারে কেশকাল-এর মানুষখেকো ছাড়া অন্য প্রসঙ্গে যাবই না।

বলে, ঋজুদা আবার শুরু করল।

আকাশে ঘন কালো মেঘ। বেরুবার আগে এক পশলা জোর বৃষ্টি হয়ে গেছে। এখন বৃষ্টি থামাতে পাখিরা সব সরব হয়েছে। বৃষ্টির সময়ে পাতার নীচে মাথা বাঁচিয়ে নিশ্ৰুপ ছিল। তাদের এ ডাল থেকে এ ডালে, এ গাছ থেকে ও গাছে উড়ে যাওয়ার সময়ে ডাল কঁপছে, টুপ টুপ করে জল ঝরছে। সারা বন যেন কী দুঃখে ঝরঝর করে কাঁদছে। প্রত্যেক গাছ ও পাতায় জল টসটস করছে। আশ্চর্য এক সুন্দর গন্ধ উঠছে। বৃষ্টিভেজা মাটি থেকে, বৃষ্টিভেজা গাছেদের গা থেকে, পাখিদের গায়ের ভিজে পালক থেকে। এ গন্ধ যারা না চিনেছে তারা বড় অভাগা।

কেশকাল বাংলো থেকে প্রায় মাইলখানেক গিয়ে জঙ্গলটা হঠাৎই পাতলা হয়ে গেছে। ভীমা সিং সেখানে দাঁড়িয়ে দেখাল পাহাড়টাকে।

বললাম, ও পাহাড় তো কম করে মাইল পাঁচেক দূরে হবে। পৌঁছতে পৌঁছতেই তো বিকেল হয়ে যাবে।

হবে। ও বলল। কিন্তু আমরা তো যে কোনও মুহূর্তেই বাঘিনীর দেখা পেতে পারি। তা ছাড়া ডেরাটা যদি সত্যিই ওই পাহাড়ের কোনও গুহাতেই থেকে থাকে তাহলে তো আমাদের পক্ষে তাকে কবজা করা সহজ হবে। সব সময়ে ওই ডেরাতে না থাকলেও মাঝে মাঝে সে তো আসবেই। এই বাঘিনী কখনও তার মারা মানুষের মড়িতে ফিরে আসে না। যখন মারে, সে দিনে কি রাতেই তোক কিছুটা টেনে নিয়ে গিয়ে আড়াল দেখে বসে যতখানি পারে খায়। কেউ বিরক্ত না করলে তার পুরো খিদে মিটিয়ে নেয়। আর গ্রামের মানুষেরা গাদা বন্দুক ছুঁড়তে ছুঁড়তে কাসর ঘন্টা ক্যানেস্তারা বাজাতে বাজাতে যদি তার কাছাকাছি আসে তখন তাদের দিকে তেড়ে আসে। তারা ফিরে গেলে আবার খায়। কখনও বা বিরক্ত হয়ে লাশ ফেলে রেখে চলে যায়। যেদিন তার পেট পুরো ভরে না সেদিনের দু-একদিন পরেই আবার মানুষ মারে। পেট পুরো ভরলে দিন তিনেক মারে না।

তারপর ভীমা বলল, কী করবেন? যাবেন?

তুমি কী বল?

আমি বলি চলুন। রাতে আমরা ফিরেও আসতে পারি বাংলোতে, না হলে ওই গুহাটা খুঁজে পেলে তার কাছাকাছি কোনও গাছে বসে থাকতেও পারি। বাঘ যদি গুহাতে ফেরে বা যদি গুহাতেই থেকে থাকে তাহলে সন্ধের মুখে গুহা থেকে বেরোলে তার সঙ্গে আমাদের মোলাকাত হয়ে যাবে। তারপর ঋজুদা বলল, এই মানুষখেকো বাঘ যখন পুরো অঞ্চলে এমন আতঙ্কর সৃষ্টি করেছে যে মানুষ দিনে রাতে সমান ভয়ে কাঁটা হয়ে কাটাচ্ছে তখন ভীমার এই কথায়, ভীমা যে ভাল শিকারি শুধু তাই-ই নয়, তার যে ভয়ডর বলে কোনও ব্যাপারই নেই এ কথা প্রাঞ্জল হল। এমন স্থানীয় সঙ্গী পাওয়া পরম সৌভাগ্যের কথা। এতে আমার কাজ সোজা হয়ে যাবে, গুরুভার লাঘব হবে।

আমরা ওই পাহাড়টার দিকে চলতে লাগলাম। জিজ্ঞেস করলাম, পাহাড়টার নাম কী?

ঝিরিয়া।

ভীমা বলল।

আরেকটু গিয়ে একটা মস্ত পিপ্পল গাছ দেখিয়ে বলল, এই গাছেই এক শিকারিকে ধরেছিল বাঘে এবং গাছতলাতে বসে তার আধখানা খেয়েছিল।

বড় বাঘ গাছে চড়ে এবং তাও এত উঁচু গাছে এমন তো কখনও শুনিনি।

ভীমা বলল, কাছে চলুন। কারণটা বুঝতে পারবেন।

সেখানে পৌঁছে দেখলাম, গাছটার পেছনে কতগুলো বিরাট বিরাট কালো পাথরের জটলা।

তারপর আমার দিকে ফিরে বলল, অনেকটা আফ্রিকার সেরেঙ্গেটির কোপির মতো, বুঝলি রুদ্র।

কোপিটা কী বস্তু?

তাপস কাকু বললেন।

কোপি মানে KOPJE। বড় বড় কালো পাথরের জটলাকে সোয়াহিলি ভাষাতে KOPJE বলে, উচ্চারণ কোপি। এদের ওপরটাতে অনেক সময়েই একটি সমান চ্যাটালো পাথর থাকে। সিংহ এর ওপরে বসে অবজারভেশন টাওয়ার হিসেবে কোপিকে ব্যবহার করে। কোথায় কোন জন্তু চরছে, কীভাবে তাদের কাছে যাওয়া যায়–এইসব প্ল্যান পয়জার করে।

বলেই বলল, সিংহদের শিকার একটা সাদামাঠা ব্যাপার। ওরা তো ওদের শিকারের লক্ষ্যর পেছনে ধাওয়া করে গিয়ে ওদের ঘাড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে মারে তাদের। একেবারে gross ব্যাপার। আর বাঘের শিকার ধরাটা একটা উঁচুদরের আর্ট-এর পর্যায়ে পড়ে। আলো-ছায়ায় খেলা, দীর্ঘ প্রতীক্ষা, অশেষ ধৈর্য এবং চাতুরি দিয়ে বাঘের শিকারের ভিত গড়া।

তা ওই পাথরগুলোর সঙ্গে বাঘের গাছে চড়ার কী সম্পর্ক?

ভটকাই বলল।

একজন শিকারি কী করে এরকম মূর্খামি করলেন জানি না। ওই পিপ্পল গাছটা ওই পাথরগুলোর একেবারে গা-ঘেঁষা ছিল। শিকারির মাচাটা ছিল পনেরো ফিট মতো উঁচু। পিপ্পলের একটা মোটা ডালের ওপরে বাঁধা ছিল সে মাচা।

মড়ি কোথায় ছিল? মানে মানুষের লাশ?

আরে ভীমা যা বলল তাতে জানা গেল যে কোনও মড়ির ওপরে বসেনি শিকারি। বাঘ ঘোড়া খেতে খুব ভালবাসে–এ কথা সকলেই জানে, আর চিতা কুকুর। পাঁচ মাইল দূরের এক গ্রাম থেকে একটা বেতো টাট্ট ঘোড়া জোগাড় করে সেই ঘোড়া নীচে বেঁধেবাঘ সেই ঘোড়া মারবে এই আশায় তিনি বসেছিলেন। ভদ্রলোক নাগপুরের আবগারি ইনস্পেক্টর। এর আগে একটি বাঘ ও চিতা নাকি মেরেছেন তাড়োবার এবং বস্তারের জঙ্গলে।

তুমি এতসব জানলে কী করে?

আমি ভীমাকে জিজ্ঞেস করলাম।

আমাকে প্রেমা সিং বলেছে। সেই সঙ্গে করে নিয়ে গেছিল শিকারিকে। প্রেমা সিংও সেই মাচাতে ছিল। বাঘ তাকে না ধরে সেই শিকারিকেই ধরেছিল।

তা প্রেমা বাঘকে মারল না কেন?

প্রেমা বলে, গুলি করলে শিকারির গায়ে লেগে যায় যদি, ওই ভয়ে করেনি। আবগারি ইনস্পেক্টরকে গুলি করে মেরে সে গরিব লোক কি জেলে যাবে। তা ছাড়া বাঘ যে সেই পাথরগুলোর ওপর উঠে বেড়াল যেমন করে ইঁদুর ধরে, তেমনি এক ঝটকাতে শিকারিকে তুলে নিয়ে পাথরের আড়ালে অদৃশ্য হবে, তা তার কল্পনার বাইরে ছিল।

ওরা নাকি আন্দাজও করেছিল যে, বাঘ ওই পাথরের ওপর দিয়ে তাদের দিকে আসতে পারে। এলে তারা বাঘকে মারার সুযোগ পাবে, কারণ ওপরের পাথরটা মস্ত বড়, চ্যাটালো এবং সমান ছিল।

রাতও ছিল পূর্ণিমার। বাঘ যদি ওই পাথরের ওপর দিয়েই আসে, তবে দুজন শিকারির চোখে ধুলো দিয়ে আসতে পারবে না যে, এমন বিশ্বাস তাদের ছিল। ঘোড়াটা বাঘের কথা টের পেয়েছিল এবং পেয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে দড়ি ছিঁড়ে পালাবার চেষ্টা করছিল। প্রেমারা ভেবেছিল, বাঘ ঘোড়র কাছে আছে। হয়তো ছিলও। ওরা দুজনেই ঘোড়ার গতিবিধি দেখে বাঘ কোথায় আছে তো বোঝার চেষ্টা করেছিল। পূর্ণিমা রাতে সুবিধে যেমন হয় শিকারের, অসুবিধেও হয়। গাছপালা, ঘাসপাতা পাথর-মাথর সবকিছুরই ছায়াগুলো বড় হয়ে যায়। তাতে চোখে বিভ্রম হয়। যাই হোক, ভীমা বলল, যখন প্রেমা সিং আর শিকারি নীচে ঘোড়ার দিকে মনোযোগ দিয়েছে, বাঘ নিঃশব্দে এসে শিকারিকে তুলে নিয়েছে। নিমেষের মধ্যে।

শিকারিকে তার সামনে খেল আর প্রেমা সিং বসে বসে দেখল।

আমি বললাম ভীমাকে।

প্রেমা দেখতে পায়নি। বাঘ পাথরের আড়ালেই তাকে নিয়ে খেয়েছিল। তার হাড়গোড় ভাঙার কটাং কটাং আওয়াজ এবং মাংস খাওয়ার চপ চপ আওয়াজ সে

শুনতে পেয়েছিল।

সে তো পাথরের ওপর দিয়ে গিয়ে তখনও বাঘকে গুলি করতে পারত। শিকারিকে বাঁচাবার কোনও চেষ্টাই সে করল না?

ভটকাই বলল।

ঋজুদা বলল, বাঘ যে মানুষকে ঘাড় কামড়ে নিয়ে যায়, তার মৃত্যু তো সঙ্গে সঙ্গেই হয়। বাঘের দুটো ক্যানাইন দাঁত তো ঘাড় এবং কণ্ঠনালি ফুটো করে দেয়। প্রেমা তা জানত বলেই শিকারিকে বাঁচাতে না চেয়ে নিজে বাঁচতে চেয়েছিল। তা ছাড়া, ভীমা বলল, ভয়ে তার হাত-পা পাথর হয়ে গিয়েছিল। ওই ঘটনার পরে এক মাস সে ঘুমোতে পারেনি। জগদলপুরে কবিরাজ দেখিয়ে ওষুধপত্র করে তারপর তার ঘুম আসে নাকি।

ঋজুদা বলল, আমি প্রেমা সিংকে না নিয়ে তো দেখছি ভাল করেছি। তুমি হলে ওই সময়ে কী করতে?

আমি এক দৌড়ে পাথর বেয়ে গিয়ে বাঘকে গুলি করতাম। শিকারি যে বাঁচত না তা তো জানাই, কিন্তু আমি থাকলে সেদিন বাঘও বাঁচত না। তা ছাড়া, ওরা মস্ত ভুল করেছিল ঘোড়া বেঁধে। বাঘ কখনও-সখনও গ্রামের ঘোড়া ধরে অবশ্য কিন্তু গ্রাম থেকে অতদূরে একটা ঘোড়াকে বাঁধা অবস্থাতে দেখে এ যে কোনও শিকারিরই চক্কর, তা সে বুঝতেই পেরেছিল। বাঘও তো কিছু কম বড় শিকারি নয়। সেও তো মস্ত সেয়ানা। সেয়ানে-সেয়ানে কোলাকুলি হতে পারত। কিন্তু তার বদলে যমের সঙ্গে কোলাকুলি হল।

ঋজুদা বলল, আমি ভীমাকে বললাম, অন্য দুজন শিকারি কী করে বাঘের খাদ্য হল?

ভীমা বলল, তা আমি জানি না। সেই ঘটনা অনেক দুরে ঘটেছিল। আমার কোনও ধারণা নেই।

তোমাদের গ্রামের নাম কী?

সূর্যাটোলি, বিজা ডোংরির নীচে। আমাদের বস্তি একটি ছোট পাহাড়ের পায়ের কাছে।

তোমাদের গ্রাম থেকে কোনও মানুষ নিয়েছে বাঘ?

নিয়েছে। তবে গ্রাম থেকে নেয়নি। গানু মারিয়া বলে একজন লোক দুপুরবেলা পাকদণ্ডি দিয়ে সূর্যাটোলি থেকে কেশকাল-এ আসছিল পায়ে হেঁটে। বাঘ সেই পাকদণ্ডিতেই তাকে ধরে খেয়েছিল। আরও একজনকে ধরেছিল, একটি মেয়ে, ঘাস কাটতে গিয়েছিল দুপুরে। বাঘ তাকে জঙ্গলে ধরে আধখানা খেয়ে দেয়। তবে সে ঘটনা বছর তিনেক আগে ঘটে, যখন বাঘ সবে মানুষ ধরা আরম্ভ করে। তারপর বলতে নেই, আমাদের গ্রাম থেকে আর কারওকে ধরেনি।

আমরা চলেছি দুজনে। চোখ ও কান সজাগ রেখে। আধ মাইলটাক চলে যাওয়ার পরে একটা নালা পড়ল পথে। বৃষ্টিতে জলের তোড় বেড়েছে। পেরোনো যাবে কি না ভাবছি, এমন সময় ভীমা বলল, কিছুটা বাঁদিকে চলুন, নদীর ওপরে অনেক পাথর আছে বড় বড়। পাথরে পাথরে পা রেখে রেখে পার হয়ে যাব। আপনার প্যান্টও ভিজবে না আর আমি তো হাফ-পেন্টুলুন পরে আছি। খালি পা।

তারপর বলল, এই নদী পেরুবার পরে কিন্তু আর কথাবার্তা বলব না আমরা।

কেন?

না,বাঘের ডেরার কাছে চলে এসেছি আমরা, যদি বাঘ ডেরাতে থেকে থাকে।

কিছুটা বাঁদিকে গিয়ে দেখলাম সত্যিই নদীর বুকময় বড় বড় পাথর। সহজেই ট্রাউজার না-ভিজিয়ে নদী পেরোনো যাবে। কেশকাল বাংলো থেকে প্রায় মাইল তিনেক এসেছি। কোনও পাথরে বসে একটু জল খেয়ে একটু পাইপ খেয়ে নিলে হত।

ভীমাকে বললাম সে কথা। ভীমা বলল, তারও তেষ্টা পেয়েছে। খাওয়ার পরে এসেছে তো। শীতকাল হলে এই ঝোরার জলই খাওয়া যেত এখন বৃষ্টির জন্য জল ঘোলা হয়ে গেছে। তবে অসময়ের বৃষ্টি। কদিন পরেই জল আবার খাওয়ার মতো হয়ে যাবে।

একটা পাথরে বসে ওয়াটার বটল থেকে জল খেয়ে ভীমার দিকে সেটা এগিয়ে দিলাম। ভীমা বলল, আমি কিন্তু ছোট জাত হুজৌর।

আমি হেসে বললাম, আমি বজ্জাত।

সেটা কী জাত হুজৌর, কখনও তো শুনিনি।

শোনারও তো কথা নয়। এই জাত শুধু বড় বড় শহরেই দেখা যায়। আমি তোমার চেয়েও ছোট জাত। নির্ভাবনায় জল খাও।

.

জল খেয়ে আমি পাইপটা ধরিয়েছি। পাইপটাতে টোব্যাকো ভরাই ছিল। বুশ শার্টের বাঁদিকের বুক পকেটে রাখা ছিল পাইপটা। ভীমা জল খেয়ে ওয়াটার বটলের ছিপি আটকে আবার থলির মধ্যে ভরে নিল। তারপরে উঠে, যেন আমাকে দেখানোর জন্য যে কোন কোন পাথরে পা দিয়ে গেলে ট্রাউজার ভিজবে না, এগিয়ে গেল। আমি পাইপ খেতে খেতে ওর দিকে চেয়েছিলাম। চোখের ১৮০ ডিগ্রি দৃষ্টি অবশ্য ছড়ানো ছিল। শিকারি আর আমাদের দেশের মোটরগাড়ির চালকদের এই দৃষ্টি খুব জরুরি। সচেতনভাবে চেষ্টা করলেই এটি আয়ত্ত করা যায়। আমি অবশ্য ছেলেবেলাতেই আয়ত্ত করেছিলাম জেঠুমণির ট্রেনিংয়ে। দেখলাম ভীমা পাথরের ওপর পা রেখে রেখে ওপারে পৌঁছে গেল।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, এই নালাটার নাম কী?

ও বলল তিননদীয়া। কিন্তু ও যখন নামটা বলছে তখনই ওর মুখের চেহারা যেন পালটে গেল। ঝট করে ও গুলিভরা ওভার-আন্ডারটার কুঁদোটা কাধ থেকে নামিয়ে বগলের নীচে করল। আমি উঠে দাঁড়ালাম। ভীমা ততক্ষণে আমার দিকে পেছন ফিরে তিননদীয়ার ওপারের জঙ্গলে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখতে লাগল। আমি রাইফেলটা কাধ থেকে নামিয়ে ডান হাতে নিয়ে নালাটা পেরোলাম। কথা না বলে ওর কাছে গিয়ে চোখ দিয়ে ওকে শুধোলাম, কী?

ও আঙুল দিয়ে নালাটার পাড়ের লাল বৃষ্টিভেজা মাটি দেখাল।

আমি দেখলাম, বাঘের পায়ের টাটকা দাগ। সেও আমাদের আগে নালাটা পেরিয়েছে। সে কোন দিক থেকে এসেছে জানা গেল না। সে আমাদের অস্তিত্ব। টের পেয়েছে কি না তাও জানা গেল না। ভীমা কথা বলতে মানা করা সত্ত্বেও আমার নালার নাম জিজ্ঞেস করা আর ভীমার জবাব দেওয়াটা কাছাকাছি-থাকা বাঘ হয়তো শুনে থাকবে। বনের মধ্যে ক্ষীণতম শব্দও বহুদূর যায়। তা ছাড়া বৃষ্টির পরে বনের শব্দপ্রেরণ ক্ষমতা বেড়ে যায়। বাঘ ঠিক কতক্ষণ আগে নালাটা পেরিয়েছে তা বোঝা গেল না। পাড়ের জমি শুকনো হলে তার থাবার দাগের আর্দ্রতা দেখে তার একটা আন্দাজ করা যেত কিন্তু বৃষ্টি হওয়াতে সমস্ত দিকই ভিজে রয়েছে। ভেজা জমিতে তার জলসিক্ত থাবার দাগ দেখে ঠিক বোঝা গেল না। পাথরের ওপর দিয়ে গেলেও দেখলাম ও প্রান্তে পাথর না থাকায় জুতো ভিজিয়ে পার হতে হল। বাঘও থাবা ভিজিয়েই পেরিয়েছে। বাঘ না বাঘিনী তা নিয়েও ধন্দ হল আমার।

.

আমরা দুজনে দুজনের চোখে তাকিয়ে নীরবে বললাম, এখন কিংকর্তব্যম?

এই অবধি বলেই ঋজুদা বলল, একটু রিসেস। একটু পাইপ খেয়েনি। তোমরাও সিগারেট খেয়ে নিতে পারো। যারা খাও। যদি খাও।

ভটকাই বলল, এবারে বাপারটা জমেছে।

তাপস কাকু বললেন, আমার কিন্তু ভয় করছে।

ভয় করছে সকলেরই।

প্রদীপ মৈত্র কাকু বললেন।

ঋজুদা একগাল ধোঁয়া ছেড়ে বলল, ভয় তখন আমারও করছিল। কিন্তু ভয় গিলে ফেলতে হয়েছিল। তখন কী আর করার। এগোলেও নির্বংশ, পেছলেও নির্বংশ। যেসব শিকারি বলেন যে, তাদের ভয়ডর নেই, আমি তাদের মতো অতিমানব নই। তবে হ্যাঁ, ভয়ের বহিঃপ্রকাশ থাকে না। ভয়ের বহিঃপ্রকাশ থাকলে ভয় আরও গলা টিপে ধরে।

.

ঋজুদা বলল, আমরা মানে, আমি আর ভীমা যখন দাঁড়িয়ে পড়ে স্ট্র্যাটেজি ঠিক করছি, ঠিক সেই সময়ে আমাদের সামনে থেকে একটা কোটরা হরিণ হিস্টিরিয়া রোগীর মতো বারবার ডাকতে লাগল ধ্বক! ব্বক! ধ্বক করে। সেই ছোট হরিণের বড় ডাক বৃষ্টিভেজা বনময় প্রতিধ্বনিত হতে লাগল। আর তারই সঙ্গে একটা ময়ুর তীব্র কেকাধ্বনি করে উঠল। বৃষ্টি পড়ায় তার আনন্দ হয়েছিল, বাঘ দেখে তার উত্তেজনা হল। জঙ্গলের এ দিকটাতে সম্ভবত বাঁদর নেই, থাকলে তারাও বাঘ দেখে ডাকাডাকি করে মাথা গরম করে দিত।

আমি ফিস ফিস করে বললাম, এখান থেকে একসঙ্গে গেলে হবে না। চলো, আমরা দুজনে দুদিকে ছড়িয়ে যাই। একে অন্যকে দেখা যায় এমন দূরত্ব বজায় রেখে দুজনেই এগোব পাহাড়ের দিকে, কিন্তু একা একা।

ও মাথা নেড়ে আমার প্রস্তাব যে অভিজ্ঞ শিকারির, এমন একটা ভাব নীরবে প্রকাশ করে, তার সমর্থন জানাল। এবং ঠিক সেই সময়ে ও আমাকে ওইখানেই দাঁড়াতে ইঙ্গিত করে নালার দিকে ফিরে গেল। ওর খুঁড়িয়ে যাওয়ার ভঙ্গিটা দেখে আমার আর্নেস্ট হেমিংওয়ের Blue Hills of Africa বইতে তার কালো ট্র্যাকার Droopy-র কথা মনে পড়ে গেল। Droopy খুঁড়িয়ে হাঁটত না কিন্তু ওর চলার গতিতে একটা ঝাঁকুনি ছিল।

ভাবছিলাম, ভীমা কেন গেল নদীর দিকে? ভাবনা শেষ হতে না হতেই ভীমা সিং ফিরে এসে ফিসফিস করে বলল, এটা মানুষখেকো বাঘিনীর পায়ের দাগ নয়।

তবে?

এটা বাঘিনীর পায়ের দাগই নয়। একটা বাঘের দাগ।

বড় বাঘ?

হ্যাঁ।

চলো তো দেখি। একই জঙ্গলে অন্য বাঘ আসবে কী করে? জুড়ি লাগার সময় ছাড়া।

তাই তো।

ভীমা বলল।

আমি ও ভীমা ফিরে গিয়ে আবার ভাল করে পায়ের থাবার দাগটি দেখলাম। ঠিকই তাই। মনে হচ্ছে একটা বাঘেরই দাগ। মাটি ভেজা এবং বাঘ জল থেকে একলাফে ভিজে মাটিতে উঠেছে বলে পায়ের ছাপটা ধেবড়ে গেছে। যাই হোক, আমার মন বলল, মানুষখেকোর রাজত্বে তার থাকাটাই স্বাভাবিক। ভীমা তো ভুলও করতে পারে। আমাদের সাবধানতাতে এতটুকু ঢিলে দিলে চলবে না।

ফিরে গিয়ে দুজন দুদিকে গিয়ে আমরা ঝিরিয়া পাহাড়ের দিকে এগোতে লাগলাম. যথাসম্ভব সাবধান হয়ে সামনে এবং দুপাশে নজর রেখে এবং মাঝে মাঝে পেছনেও দেখতে লাগলাম।

চৈত্ৰশেষের বন বৃষ্টি পেয়ে কী আশ্চর্য স্নিগ্ধ আর সুগন্ধি হয়েছে তা কী বলব। নানা পাখির ডাক আর ওড়াউড়িতে মনে হচ্ছে এই বুঝি স্বর্গের নন্দনকানন। এখানে বসে কবিতা লিখতে হয়, কি ছবি আঁকতে। রাইফেল হাতে মানুষখেকো বাঘিনীর সন্ধানে ঘুরে মরতে ভাল লাগে না।

আকাশ একটু একটু করে পরিষ্কার হচ্ছে। হলেই ভাল। কারণ আমাদের কেশকাল-এর ওই বনবাংলোতে ফিরে আসতে আসতে রাত অবশ্যই হবে। কত রাত তা এখনই বলা যাচ্ছে না। পূর্ণিমার আর তিনদিন বাকি। এই দোল পূর্ণিমা। হোলি। জঙ্গলের মানুষে সেই সময়ে একটু অসতর্ক থাকবে, মহুয়া খাবে, সালফি খাবে, নাচবে, গাইবে, আর বাঘিনীর কবলে পড়বে সহজে। যা হওয়ার তা হবে। হোলির আগেই যদি ঈশ্বরের কৃপাতে বাঘিনীর একটা হেস্তনেস্ত করা যায়, তা হলে তো চমৎকার হয়। কিন্তু আমি চাইলেই কি আর চমৎকার ঘটনা ঘটবে?

এদিকে শালের জঙ্গল বেশি। আসন বিজা, গামহার ওরা এখানে বলে গামারি, পলাশ, শিমুল, সেগুনও আছে। তবে সেগুন কম। এই জঙ্গলে বাঘ ছাড়াও আছে। নানা জাতের হরিণ, কোটরা, চিতল, শম্বর। বারাশিঙা এদিকে নেই। বারাশিঙা বিস্তীর্ণ তৃণভূমি পছন্দ করে। নীলগাই, গাউর বা ভারতীয় বাইসন, শুয়োর, শজারু, বুনো কুকুর–এইসব আছে। কিন্তু খুবই আশ্চর্যের কথা দু-একটা বড় শুয়োরের পায়ের দাগ ছাড়া আর কোনও জানোয়ারেরই পায়ের দাগ দেখা গেল না এতখানি এসেও। কোটরা হরিণটা নিজে ডেকে তার অস্তিত্ব জানান না দিলে সেও যে আছে তা জানা যেত না। এমনও হতে পারে যে সব জানোয়ারের পায়ের দাগ বৃষ্টিতে ধুয়ে গেছে। অসম্ভব নয়। যাই হোক, জানোয়ারের এমন অনুপস্থিতির কারণ ভীমার কাছে এবং ফরেস্ট গার্ডদের জিজ্ঞেস করতে হবে। বাঘের স্বাভাবিক খাদ্যের এমন অভাবই কি এই বাঘিনীকে মানুষখেকো করে তুলল। কেন যে সে মানুষ খাচ্ছে, এ কথা তাকে মারার পর তার শরীরকে ভাল করে পর্যবেক্ষণ করেই জানা যাবে। সে হয়তো হরিণ, শম্বর, শুয়োর ধরতে অপারগ। কোনও ক্ষত বা ক্ষতি হয়তো সে বয়ে বেড়াচ্ছে। তাই প্রাণধারণের জন্যেই সে মানুষ মারছে। যাই হোক, সে কেন মানুষ মারছে, তা নিয়ে গবেষণা না করে তাকে মারাটা আগে জরুরি। সেই অপকর্ম করতেই আমার আসা এখানে।

পাহাড়ের কাছে পৌঁছনোর আগে একদল নীলগাই, বিহারে যাদের বলে ঘোড়ফরাস দুড়দাড় করে দৌড়ে যেতে দেখলাম। বেশ কিছুদিন হল এ বনে মানুষ ঢোকে না বাঘিনীর ভয়ে, তাই এই বিকেলে হঠাৎ দুজন উটকো মানুষ দেখে তারা আমাদের যত না চমকে দিয়েছিল, নিজেরা তার চেয়ে বেশি চমকাল। আর দেখলাম, পাঁচটি শম্বর। একটি শিঙাল ও চারটি মেয়ে শম্বর। শিঙাল তার বিরাট শিংটিকে পিঠের ওপর শুইয়ে দিয়ে, যাতে লতাপাতায় বা ডালে তা আটকে না যায়, এক দৌড়ে সঙ্গিনীদের সঙ্গে নিয়ে উধাও হল। এই শম্বরেরা ডাকে কম। উত্তেজিত হলে ডাকে। তাদের ডাক ঢ্যাং ঢ্যাং ঢ্যাংক। লাউড স্পিকারের মাউথপিসের সামনে যদি শ্যাম্পেন বা ওয়াইনের বোতলের ছিপি খোলা হয়, তাহলে যেমন আওয়াজ হয়, ওদের ডাকটাও তেমনি।

বাইসনের পায়ের দাগও দেখলাম না, অথচ দেখাটা উচিত ছিল। বাইসন-হর্ন মারিয়াদের দেশ বস্তারেই যদি বাইসন না দেখা যায়, তবে কোথায় দেখা যাবে! তবে বাইসন আর হাতি বাঁশবন খুব পছন্দ করে। অমরকণ্টকের পথে অচানকমার লামনি ইত্যাদি জায়গায় বাইসন আছে অনেক। নারায়ণপুর রেঞ্জেও নিশ্চয় আছে। ইন্দ্রাবতী নদীর বুকের নরম মাটিতে নতুন গজানো কচি ঘাস খেতে খেতে আমি এমন একটি বাইসনের বড় দল দেখেছিলাম যা পালামৌ বা মহীশূরের বন্দীপুরেও দেখিনি। এই বাইসনেরা আহত হলে অথবা উত্তেজিত হলে বোঁয়াও করে ডাকে। আসলে ওরাও তো গবাদি পশু। জংলি মোষ এবং বাইসনেরাও আমাদের গোরু, মোষের স্বজাতি।

এখানে হাতি নেই?

প্রদীপ মৈত্র কাকু ঋজুদাকে জিজ্ঞেস করলেন।

না, আশ্চর্য। পুরো মধ্যপ্রদেশেই সম্ভবত কোথাওই হাতি নেই। কানহা বান্ধবগড় বল, অচানকমার বল, কি সিংগরাউলির কাছের অত্যন্ত দুর্গম ব্যায়রান অঞ্চল কোথাও হাতি নেই। আমার মনে হয়, জলাভাবের জন্যেই হাতি নেই। হাতির প্রচুর জলের দরকার। অবগাহন চানের জন্যে, খাওয়ার জন্যে, গরমে ডুবে বসে থাকার জন্যে। তাই পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, বিহার, তামিলনাড়ু, কেরল, কর্ণাটক ইত্যাদি জায়গাতে হাতিকে দেখা যায়। জানি না, এটা আমার আন্দাজ। এসব প্রশ্নের উত্তর পণ্ডিত প্রাণীতত্ত্ববিদেরাই দিতে পারবেন। আমি তো আনপড়।

.

ভটকাই বলল, আবার গল্পে ফেরো।

প্রদীপ গাঙ্গুলি কাকু বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ। পাহাড়ে পৌঁছলেন? তারপর কী হল বলুন।

হ্যাঁ। পাহাড়ে যখন পৌঁছলাম, তখন প্রায় চারটে বাজে। আসলে পাঁচ মাইল পথটা আদৌ দূরত্বের নয়। কিন্তু আমরা তো জোরে হাঁটতে পারিনি।

বাঘিনীর কথা মনে রেখে অতি সাবধানে এগোতে হয়েছে আস্তে আস্তে তাতেই দেরি।

পৌঁছে দেখি, ভীমা সিং ঠিকই বলেছিল। অনেকগুলো গুহা আছে এ পাহাড়ে। আমরা পাহাড়ে উঠে এক এক করে তিনটি গুহামুখের সামনেই পায়ের চিহ্ন খুঁজলাম। কিন্তু বৃথা চেষ্টা। বৃষ্টিটাই সব মাটি করেছে। নইলে গুহার সামনে চৈত্র মাসের ঝুরো মাটিতে বাঘ বা ভালুক–যে-ই গুহার মালিক তোক না কেন, তার অস্তিত্ব টের পাওয়া যেত। চতুর্থটির সামনে যেই পৌঁছেছি, অমনি গুহার ভেতর থেকে একটি প্রকাণ্ড ভাল্লুক প্রচণ্ড আপত্তি জানিয়ে বাইরে বেরিয়ে বলল, কী চাই? এখানে ইয়ার্কি মারতে আসা হয়েছে?

ভারতের যত জানোয়ার আছে, তার মধ্যে ভাল্লুকের মতো পাজি, আনপ্রেডিক্টেবল জানোয়ার আর দুটি নেই। সম্পূর্ণ বিনা কারণে নিরপরাধ মানুষকে তারা তাড়া করে এসে নাক-মুখ খুবলে তুলে নেয়। যদি খাওয়ার জন্যেও নিত, তাহলেও না-হয় বোঝা যেত, নাক গলা চোখ বা ঠেটি খেতে ভালবাসে তাই ছিঁড়ছে। ভাল্লুক তো তৃণভোজী জানোয়ার, (হিমালয়ের আর মেরু অঞ্চলের ভাল্লুকরা ছাড়া অবশ্য) তবু তারা কেন মানুষের নাক কান চোখ ঠোঁট খুবলে নেয়, তা তারাই জানে। ভাল্লুক আলিঙ্গন করলে সে মানুষের বাঁচার আর কোনও উপায়ই থাকে না। ছত্রপতি শিবাজি যেমন বাঘনখ পরে আফজল খাঁকে মেরেছিলেন, তেমনই অবস্থা হয়।

তারপর?

আমাদের ভাল্লুকমশায় সাইজেও বিরাট। তবে তার ত্যান্ডাইম্যান্ডাই আমি কিংবা ভীমা জায়গামতো একটি গুলিতেই ঠান্ডা করে দিতে পারতাম কিন্তু আমরা এখানে বাঘিনীর খোঁজে এসেছি। তা ছাড়া, এই বনে রাইফেলের বা বন্দুকের আওয়াজ হলে পাহাড়ে যা প্রতিধ্বনি উঠত, তাতে পাঁচ বর্গমাইল এলাকাতেই সেই বজ্রনির্ঘোষ পৌঁছত। আর পৌঁছলেই চতুর বাঘিনী, যদি এ অঞ্চলে সে থেকে থাকে, তাহলে এ তল্লাট ছেড়ে পালাত। তাই আমরাই কাপুরুষের মতো রণে ভঙ্গ দিলাম। প্রাণপণে দৌড় লাগিয়ে প্রাণ বাঁচালাম। ভাল্লুকটা কিছুটা তাড়া করে এসে আমরা যে খুবই ভয় পেয়েছি সে সম্বন্ধে নিশ্চিত হয়ে আবার তার গুহাতে ফিরে গেল।

দুজনে একসঙ্গে হওয়ার পর আমি ভীমাকে বললাম, তোমার বাঘিনী এই সব গুহাতে সম্ভবত থাকে না। আমার মনে হয়, তার কোনও পাকাপাকি আবাস এখন আর নেই। যেখানে মানুষ ধরে তারই কাছাকাছি সুবিধে মতো জায়গা দেখে থেকে যায়, তারপর আবার স্থান পরিবর্তন করে।

ভীমা বলল, আমারও তাই মনে হয়। তা ছাড়া পাশের গুহাতে এতবড় ভাল্লুক থাকলে বাঘ গুহাতে থাকবে না। বাঘে আর ভাল্লুকে পটে না।

হ্যাঁ, সেটাও একটা কথা। তবে এ গুহাগুলোতে থাকে কে?

চিতা-টিতা থাকতে পারে। তবে দুর্গন্ধ পেলেন না সব গুহামুখ থেকেই? যারা থাকে তারা বহু সংখ্যাতেই থাকে।

আমি বললাম, বাদুড়?

হ্যাঁ।

ভীমা বলল।

তারপর বলল, আপনাকে মিছিমিছি কষ্ট দিলাম এতখানি হটিয়ে। আমি বললাম, না এলে জানতামই বা কী করে! তা ছাড়া এই বনে জঙ্গলে কিছুই মিছিমিছি নয়। সব মিছিমিছিরই মূল্য আছে। জীবনে কোনও অভিজ্ঞতাই ফেলা যায় না।

.

তারপর বললাম, চলো, এবারে ফিরি। কিন্তু নালার পাড়ে যে পায়ের দাগ দেখলে সেটা বাঘিনীর যে নয়, সে সম্বন্ধে তুমি কি নিশ্চিত?

না। নিশ্চিত যে, সে কথা বলতে পারি না। তাই তো চিন্তা হচ্ছে। ফেরার সময়ে রাতও হয়ে যাবে। আমাদের খুব সাবধানে ফিরতে হবে।

আমি হেসে বললাম, আমরা তো তাকেই খুঁজছি। তার সঙ্গে দেখা হয়ে যাক, তাই তো আমরা চাই। সে থাকুক সাবধানে সাধের গায়ের চামড়াটি বাঁচিয়ে।

ভাল্লুকের গুহা থেকে দৌড়ে নেমে এসে আমরা একটা বড় কালো পাথরের ওপর দাঁড়িয়েছিলাম। আকাশ ততক্ষণে পরিষ্কার হয়ে গেছে। পশ্চিমাকাশে লাল সূর্য ডুবছে আর পুবাকাশে ভরা চাঁদ উঠছে একটা হলদেটে থালার মতো। পশ্চিমাকাশে সন্ধ্যাতারাটাও উঠেছে, জ্বলজ্বল করছে নীলাভ দ্যুতিতে। বৃষ্টি, পরিবেশের ধুলো-ময়লা যতটুকু ছিল, সব নিকিয়ে নিয়েছে। সূর্য এবং চাঁদের যে কী স্নিগ্ধ অমলিন রূপ তা কী বলব! মনে মনে বলাম, মানুষখেকো বাঘিনী মারতে পারি আর নাই পারি, এই মুহূর্তে যে দৃশ্যর সম্মুখীন হলাম এই কেশকাল-এর বনে তাতেই এ যাত্রা এখানে আসা আমার সার্থক হয়ে গেল। সত্যি! আমাদের চারপাশে প্রকৃতি যে কত দৃশ্য শব্দ গন্ধ ছড়িয়ে রেখেছেন আমাদের জন্যে। দু-হাত ভরে, শরতের শিউলিতলির শিউলির মতো তা কুড়িয়ে নিতে হয়। বুক ভরে ওঠে সুগন্ধে, সুদৃশ্যে ও মধুস্বরে।

তাপস কাকু বললেন, সকলেই কিসব পারে ঋজুদা? যে পারে সে এমনি পারে। এবার থেকে আমরাও চোখ কান নাক খুলে রাখব। গন্তব্যে তো পৌঁছতে হয়ই কিন্তু যাওয়ার পথের দুপাশে যা আছে তা যদি আমরা সকলেই কুড়িয়ে নিতে পারতাম!

পারবে পারবে। একটু সচেতন হও। হলেই পারবে।

ঋজুদা বলল।

ভটকাই বলল, আরেক রাউন্ড কফি হবে নাকি?

প্রদীপ গাঙ্গুলি কাকু বললেন, হয়ে যাক।

ভটকাই বলল, আমি না আসা অবধি আরম্ভ করবে না।

ঠিক আছে। আয় তুই।

ঋজুদা বলল।

ভটকাই কফির অর্ডার দিয়ে ফিরে এলে আবার শুরু করল ঋজুদা।

তিনদিন হল এসেছি। ইতিমধ্যে কোনও কিল করেনি। রেঞ্জার সাহেব এবং এস.ডি.পি.ও. সাহেব সবাইকে বলে রেখেছেন যে কিল হলেই ওঁদের খবর দিতে। খবর পেলেই জিপে করে খবর যারা আনবে, তাদের কেশকাল-এ আমার কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হবে।

ভীমা যা বলেছিল তা যদি সত্যি হয়, আজ বাঘিনীর মানুষ মারার দিন। তিনদিন হয়ে গেছে কিল হয়নি কোনও। আজ হোলিও।

বাসন্তী পূর্ণিমার চাঁদ কেশকাল-এর চারদিকের বনকে রুপোঝুরি করে তুলেছে। আমি যখনকার কথা বলছি তখন ওই ডুংরির ওপরে বসার টোংরিটি বানানো হয়নি। আমি আর ভীমা চন্দ্রালোকিত বন পাহাড়ের দিকে মুগ্ধ হয়ে চেয়ে বাংলোর বারান্দাতে বসে আছি। আমি দেওয়ালের দিকে পিঠ দিয়ে। ভীমা আমার পায়ের কাছে বসেছে মাটিতে, উলটোদিকে। অনেক বলা সত্ত্বেও সে চেয়ারে বসেনি। বহু পুরুষের সংস্কার। আমি বজ্জাত ‘ছোট জাত’ ভীমাকে বোঝাতে পারিনি যে আমাতে আর ভীমাতে কোনও তফাত নেই। আমার সামনের টেবিলের ওপরে গুলি ভরা থার্টি-ও-সিক্স রাইফেলটা রাখা আছে। এটা একনলি রাইফেল। ব্যারেলে একটি এবং চেম্বারে পাঁচটি গুলি নেয়। খুব অ্যাকুরেট রাইফেল। হালকাও। বহু দূর থেকে নির্ভুল নিশানাতে মারা যায়।

ভীমা পুটুর-পুটুর করে বাঘিনীর নানা রেকর্ড-এর কথা বলে যাচ্ছে। সেসব শুনলে রক্ত হিম হয়ে আসে। আমার মন বলছে যে কোনও সময়েই একটা খবর আসবে আজকে। আজকে শুলেও ঘুম আসবে না। কিল না হলে বাঘিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করা মুশকিল। এই পঞ্চাশ বর্গমাইল বনে বাঘিনীকে খুঁজে বের করা আর খড়ের গাদাতে সূঁচ খুঁজে বের করা একই ব্যাপার।

.

আজ হোলি, তাই ফরেস্ট গার্ড আর চৌকিদারেরাও একটু মহুয়া-টহুয়া খেয়ে বাংলোর হাতাতে মাদল আর ধামসা বাজিয়ে হোলির গান গাইছে। তারা ঘরের বাইরে এসেছে আমাদেরই ভরসাতে। ওদের গান শুরু হতেই আমি আমি ভীমাকে বললাম বন্দুকটা নিয়ে গিয়ে ওদের সঙ্গে বসতে। যে বাঘিনী বাঘমারা দুজন শিকারির মধ্যে থেকে এমনই পূর্ণিমার দিনে একজনকে তুলে নিয়ে যায়, তাকে বিশ্বাস নেই। এ বাঘিনীর পক্ষে অসম্ভব কিছুই নয়।

আধ ঘণ্টাও হয়নি ভীমা গেছে ওদের মধ্যে, এমন সময় একটা জিপকে লো-গিয়ারে খুব জোরে পাহাড় চড়ে কেশকাল বাংলোর দিকে হেডলাইট জ্বেলে আসতে দেখা ও শোনা গেল। আমি উঠে দাঁড়ালাম। ভীমাও উঠে দাঁড়াল। চৌকিদার ও গার্ডদের গান বাজনা সব বন্ধ হয়ে গেল। কী সংবাদ এনেছে জিপ কে জানে।

জিপ থেকে লাফিয়ে নামল যে লোকটা, তাকে চাঁদের আলোতে চিনতে পারিনি। সে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে আমার পায়ে এসে পড়ল। ভীমা বলল, কী হয়েছে প্রেমা ভাই?

লোকটা শিকারি প্রেমা সিং।

প্রেমার সঙ্গে আরও দুজন লোক ছিল। প্রেমা কাঁদতে কাঁদতে বলল, তাদের গ্রামের মুখিয়ার বাড়ির উঠোনে প্রায় শ’খানেক লোক জমায়েত হয়ে হোলির নাচগান করছিল প্রেমার সতেরো বছরের ছেলে ধামসা বাজাচ্ছিল। একপ্রস্থ নাচ-গান শেষ হলে বুক থেকে ধামসা নামিয়ে রেখে সে গ্রামের মধ্যেই একটু ঝোপ দেখে হিসি করতে গেছিল, আর বাঘিনী তাকে সেই সময়ে ধরে।

ভীমা বলে, তুই কাঁদছিস কোন লজ্জায়। তোর বন্দুক নিয়ে বাঘের পেছনে গেলি না কেন? তুই কেমন বাবা?

আমি পারিনি ভীমা। ওটা বাঘিনী নয়, কোনও প্রেতাত্মা। ওকে মারা কোনও মানুষের কর্ম নয়।

আমার জন্যে বনবিভাগ যে জিপটা দিয়েছিল, তাতে প্রেমাকে তুলে নিয়ে আমি আর ভীমা উঠে বসলাম। আগে আগে অন্য জিপটা চলতে লাগল। পায়জামা-পাঞ্জাবি পরেছিলাম আমি। পায়ে বাথরুম স্লিপার। তাই পরেই বেরিয়ে গেলাম। চৌকিদার আর গার্ডদের ক্ষণিক আনন্দ স্তব্ধ হয়ে গেল এই দুঃসংবাদে।

মিনিট কুড়ি লাগল আমাদের খুব জোরে জিপ ছুটিয়ে প্রেমাদের গ্রামে পৌঁছতে। গ্রামের নাম মিরপুর। গিয়ে শুনলাম, গ্রামের প্রায় জনা পঞ্চাশেক লোক বর্শা, তির-ধনুক আর গাদা বন্দুক নিয়ে বাঘিনীর পেছনে গেছে প্রেমার ছেলেকে উদ্ধার করতে।

শুনে, কথাটা অত্যন্ত নিষ্ঠুর শোনালেও, মনটা খারাপ হয়ে গেল। প্রেমার ছেলেকে তো আর জীবিত পাবে না ওরা। কিন্তু বাঘিনী যদি লাশ ফেলে চলে যায় তাকে মারার নিশ্চিত সুযোগ নষ্ট হবে। শুধু তাই নয়, বাঘ চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে (যদি ভীমার কথা সত্যি হয়!) আবার অন্য কোনও মানুষ ধরবে।

তাড়াতাড়ি জিপ থেকে নেমে গ্রামের দুজন লোকের সঙ্গে আমি আর ভীমা অকুস্থলের দিকে রওনা দিলাম। কিন্তু আমরা কিছুটা যেতেই অনেক মানুষের সোরগাল শুনতে পেলাম। ওরা ফিরে আসছে। আমরা দাঁড়িয়ে পড়লাম। ওরা যখন কাছে এল, ভীমা জিজ্ঞেস করল কী হল? ওরা সবাই একই সঙ্গে কথা বলতে লাগল। কী যে হল তা বোঝে কার সাধ্যি! যাই হোক, প্রেমা সিংয়ের ছেলের লাশ তারা প্রেমার বাড়ির দিকে বয়ে নিয়ে গেল। বুক আর পেছন থেকে বেশ কিছুটা খেয়েছে বাঘিনী। যারা রইল, তাদের কাছ থেকে জানা গেল যে, বাঘের গায়ে বেশ কটা তির বিঁধেছে এবং গাদা বন্দুকের দুটি গুলি। অবশ্য দূর থেকে মারা। বাঘিনীর কাছে যাওয়ার সাহস হয়নি ওদের। হইচই, তির এবং গুলির প্রকোপে প্রেমা সিংয়ের ছেলেকে ছেড়ে এক দৌড়ে পালিয়ে গেছে।

কোন দিকে গেছে?

ভীমা শুধোল।

দৌড়েছিল তো পুবদিকে, এখন পরে কোনদিকে যাবে কী করে জানব। কেশকাল গ্রামের পশ্চিমদিকে। কেশকালের দিকে গেলেও না-হয় হত। এখন আবার হা-পিত্যেশ করে কদিন বসে থাকতে হবে কে জানে। তবে যা শোনা গেল, তাতে বাঘ সামান্যই খেতে পেরেছে। অতএব তার ক্ষুন্নিবৃত্তি হয়নি। শিগগির মানুষ মারবে আবার ও।

আমি বললাম, একবার জায়গাটা দেখে আসি চলো ভীমা।

ভীমা বলল, চলুন।

টর্চের দরকার ছিল না। ফুটফুট করছে জ্যোৎস্না। গ্রামের একটি লোককে সঙ্গে নিয়েছিলাম আমরা। লোকটা সাহসী। সেও বলছিল, আমাদের গ্রামে প্রেমা সিংয়ের মতো এত বড় শিকারি থাকতে তার ছেলেকেই যখন বাঘে নিল সে হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগল বন্দুক নিয়ে বাঘের পেছনে না গিয়ে।

ভীমা বলল, এসব কথা তোমরা বুঝবে না। এক শিকারির পাশ থেকে অন্য শিকারিকে বাঘে টেনে নিয়ে গিয়ে কড়মড় করে হাড় মুড়মুড়িয়ে খেলে সে মানুষ আর মানুষ থাকে না, বনেজঙ্গলে এমন এমন ঘটনা ঘটে যখন তাবড় তাবড় শিকারিও শিশুর মতো ভয় পায়। ওই বাঘ প্রেমার শিকারি জীবনকে শেষ করে দিয়েছে। ঋজু সাহেব যদি ওকে সঙ্গে নিত তবে হয়তো ওর হারানো বিশ্বাস ফিরে আসতেও পারত। তা তো হল না। সাহেব আমাকেই বাছলেন।

জায়গাটাতে পৌঁছে আমরা লোকটির হাতে যে দু ব্যাটারির টর্চ ছিল তা দিয়ে বাঘিনীর পায়ের দাগ দেখলাম ভাল করে। আমি তো সেই দাগের সঙ্গে তিননদীয়া নালার পারে যে দাগ দেখেছিলাম তার কোনও তফাত বুঝতে পারলাম না। ভীমাকে বললাম, ভাল করে দেখতে। ভীমাও দেখে একটু অবাকই হল। বাঘিনী কেশকাল বাংলোর অত কাছে ছিল কাল। আমাদের নিশ্চয়ই নজর করেছে ভাল করে। কে জানে। চাঁদের আলোর আর ছায়ার বুটিকাটা বনে সে হয়তো আমাদের পিছু পিছু এসে দেখেও গেছে যে আমরা কেশকালের বাংলোতে উঠেছি। তাই হয়তো বাংলোর কাছ থেকে সরে গেছে।

গ্রামের লোকটা বলল যে, বাঘিনী আজ রাতেই এ গ্রাম থেকেই আর কাউকে ধরবে। এখানে কারও বাড়িতেই বাথরুম নেই। রাতে প্রাকৃতিক আহ্বানে সাড়া দেওয়ার জন্যে দরজা খুলে কেউ দুমিনিটের জন্যে বের হলেই বাঘিনী তাকে ধরবে। এরকম করে অনেক গ্রাম থেকে রাতে মানুষ নিয়েছে বাঘিনী। সে বলল, হুজৌর, আপনি আর ভীমা সিং এ রাতটা ওই গ্রামেই কারও ঘরে থেকে গেলে আমরা নিশ্চিন্ত হই, আর আপনারাও বাঘ মারার একটা সুযোগ পান।

আমার মনে অন্য চিন্তা ছিল। চিন্তার সূত্রটা কমজোরি। কিন্তু মনে কু ডাক দিচ্ছিল। আমি ভীমাকে বললাম, বন্দুকটা আমাকে দাও এবং রাইফেলটা তুমি রাখো। তুমি এ গ্রামে থাকো। কাল সকালে ওই জিপে করে কেশকালে ফিরে এসো। ও যখন এত করে বলছে তখন রাতটা থেকেই যাও। ওদেরও ভরসা হবে এবং তোমারও একটা সুযোগ এলেও আসতে পারে।

ভীমা বলল, থাকতে পারি। তবে কোনও ঘরে থাকব না। ঘরে বন্ধ হয়ে থাকলে লাভ হবে না। আমি রাইফেল হাতে টহল দিয়ে বেড়াব গ্রামে।

লোকটি বলল, আত্মহত্যা করতে চাইলে তো আমাদের গ্রামে মস্ত তেঁতুল গাছ। আছে। কুয়োর দড়ি গলায় দিয়ে তা থেকে ঝুলে গেলেই তো হয়। বাঘিনীর দাতেনখে ছিন্ন ভিন্ন হয়ে আত্মহত্যা করার দরকার কী?

ভীমা বলল, সে আমি বুঝে নেব।

ফিরে আসার আগ থার্টি-ও-সিক্স রাইফেলটার বোল্ট কী করে খুলে গুলি রিচার্জ করতে হয় তা ওকে দেখিয়ে দিলাম। ম্যাগাজিনটাও বোল্ট খুলে দেখালাম। ভীমা আগে রাইফেল ব্যবহার করেছে। কী করে ফ্রন্টসাইট আর ব্যাকসাইট মিলিয়ে নিয়ে নিশানা নিতে হয় তা ও জানে।

জিপে যখন কেশকালে ফিরে আসছিলাম তখন ঠান্ডা লাগছিল হাওয়ায়। এই আজকে যেমন ঠান্ডা, বৃষ্টির পরে। চলন্ত দুপাশ খোলা জিপে ঠান্ডা বেশি লাগেও। সে তো আর তোমাদের মতো টয়োটা-কালিস আর টাটা সুমো নয়, এয়ারকন্ডিশানড। তখন দেশে কারওরই এয়ারকন্ডিশানড গাড়ি ছিল না। রাজা-মহারাজার ইমপোর্টেড গাড়ি ছাড়া।

এমন সময়ে চৌকিদার এসে বলে গেল, খানা বন গিয়া হুজৌর। লাগা উঁ ক্যা?

ভটকাই বলল, নেহি নেহি। হাম ইনস্পেকশন করেগা। উসকি বাদই লাগানা খানা। ওর আভভি তো ইকদমই নেহি। আভি ম্যান-ইটিং টাইগ্রেস ফলো কর রহা হ্যায় হামলোগোকো।

বাক্যবন্ধর শেষাংশ বুঝতে পারল না চৌকিদার। তার দরকারও ছিল না। খাবার তখন লাগবে না এই কথাটা সে প্রাঞ্জলভাবে বুঝল।

.

ভটকাই হিন্দি একেবারেই বলতে পারত না। নাঃ, ছোঁড়ার অধ্যবসায় আছে। ও যে এই কবছরে কত উন্নতি করল কত ব্যাপারে চোখের সামনে, তা দেখেও ভাল লাগে। ভটকাই আমার কম্পিটিটর নয়, আমার কমপ্লিমেন্ট।

ভটকাই বলল, বলল ঋজুদা, বাঘিনীর দফা রফা হলে তার পরেই আজ খাওয়া হবে।

প্রদীপ কাকুরাও সমস্বরে বললেন, সেটা ঠিকই বলেছে ভটকাই। বাঘিনী যতক্ষণ না মরছে ততক্ষণ খেতে বসা ইমপসিবল।

ঋজুদা বলল, ভীমাটার খাওয়াই হল না আজ রাতে। জানি না গ্রামের কেউ ওকে খাইয়ে দেবে কিনা। চৌকিদারকে বললাম, ভীমার খাবার তুলে রাখতে, সকালে এসে খাবে।

ওরা সকলেই জিজ্ঞেস করল, প্রেমা সিংয়ের ছেলের কী হল? সব বললাম, ওদের। এও বললাম যে তোমরাও একটু সাবধানে থেকো। বাইরে বেশি রাত অবধি থেকো না। বাঘিনী যদিও কোনও বনবাংলো থেকেই কারওকে নেয়নি কিন্তু বাঘিনী তো আর বনবিভাগে কাজ করে না। বনবিভাগকে ভয় করার ধার সে ধারে না।

সামান্য খেয়ে শুয়ে পড়লাম। কিন্তু ঘুম আসছিল না। আসবার কথাও না। বাইরে পিউ কাহা আর কোকিল পাগলের মতো চাঁদভাসি বনে উথালপাথাল পূর্ণিমার রাতে ডেকে বেড়াচ্ছে। প্রকৃতি, এই কেশকালের মতো জায়গাতে একটা ঘোর তৈরি করে দেয়। তখন কাজকর্ম, মানুষখেকো বাঘিনী ইত্যাদি কোনও কথাই আর মনে থাকে না। নিজের মনে নিজে কুঁদ হয়ে গিয়ে চুপ করে পড়ে থাকতে ইচ্ছে হয়।

ঘুম কখন এল জানি না। কতক্ষণ ঘুমিয়েছি তাও নয়। রাত তখন কত তাও জানি না। হঠাৎ ঘরের দরজায় দুম দুম করে ধাক্কা দেওয়ার আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল। শুনলাম, বাইরে একটা শোরগোল হচ্ছে। বালিশের তলাতে রাখা হাতঘড়িটা তুলে নিয়ে দেখলাম, রেডিয়াম দেওয়া ডায়ালে সাড়ে চারটে দেখাচ্ছে। তাড়াতাড়ি দরজা খুলতেই দেখি ওরা পাঁচ-ছজন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। চৌকিদার আমার পায়ে পড়ে গিয়ে বলল, আমার বউকে বাঘে নিয়ে গেল হুজৌর। তাকে ফিরিয়ে আনুন। আপনি এই বাংলোতে থাকতে এমন ঘটতে পারে এ কি বিশ্বাস করার।

বড় ছোট লাগল নিজেকে। মানুষখেকো বাঘ বা বাঘিনী যে মানুষকে মুখে করে একবার নিয়ে যায় তাকে জীবন্ত ফিরিয়ে আনার মতো ক্ষমতা জিম করবেটেরও ছিল না আমি তো কোন ছার!

.

শুনলাম, ব্যাপারটা ঘটেছে মিনিট কুড়ি আগে। ওদের কোয়ার্টার্স থেকে বাথরুমটা সামান্যই দূরে। বড় বড় ইলেকট্রিক আলো জ্বলছে বনবাংলোর হাতায়, চৌহদ্দিতে। শেষরাতে বাথরুমে গিয়েছিল তার বউ। একটু পরে ঘোরের মধ্যে চৌকিদারের হুঁশ হয়েছে যে সে আসছে না কেন? যখন সে দরজা খুলে বাথরুমের দিকে এগিয়ে গেছে, মাঝপথে দেখে আলোর মধ্যে চকচক করছে তার বউয়ের ভাঙা কাঁচের চুড়ি আর গলার ছিঁড়ে যাওয়া পুঁতির মালা। দেখেই সে চিৎকার করে উঠেছে। ফরেস্ট গার্ড এবং তার চেলারাও সবাই বিছানা ছেড়ে উঠে এসেছে। আমার ঘরের দরজাতে ধাক্কা দিয়ে ঘুম ভাঙাবে কি না তা ভাবতে ভাবতে দশ-পনেরো মিনিট কেটে গেছে ওদের। কী আর বলব!

পায়জামা-পাঞ্জাবি পরেই টেবিলের ওপর শুইয়ে রাখা লোডেড ওভার-আন্ডার বন্দুকটা তুলে নিয়ে গুলির বাক্স থেকে আরও দুটি রোটাক্স বল পাঞ্জাবির পকেটে পুরেই আমি ঘরের বাইরে এলাম। তারপর বাথরুমের সামনে, যেখানে চৌকিদারদের বউকে বাঘিনী ধরেছিল, সেখান থেকে মাটিতে বাঘিনীর পায়ের দাগ দেখে দেখে এগোলাম। বাংলোটা যেহেতু ডুংরির ওপরে, তার সামনে খাড়া নেমে গেছে খাদ। তবে শ’খানেক ফিট মাত্র। তার পরে কয়েকটা ধাপে ধাপে উৎরাই নেমে গেছে প্রায় তিনশো ফিটের মতো। বাঘ সেখান দিয়েই নেমেছেনীচে চৌকিদারের বউকে ঘাড় কামড়ে ছ্যাঁচড়াতে ছ্যাঁচড়াতে টেনে নিয়ে। সামান্য দূর গিয়েই তার শাড়ি ছিঁড়ে গেছে পুটুস-এর কাটা লেগে। তারপর শাড়ি খুলে গেছে।

আমি প্রায় স্লিপ করে নামার মতো করে নামতে লাগলাম নীচে। সময় নষ্ট করার সময় নেই। আমারও পেছন ছড়ে গেল। পাজামা ছিঁড়ে গেল। পশ্চাৎদেশের অবস্থাও অতীব শোচনীয় যে সেটা পরে বুঝতে পারি। বন্দুকটাকে শুধু সামলে রাখলাম যেন ঠোক্কর না খায় কোথাও। টর্চের দরকার ছিল না কোনও, এত আলো ছিল চাঁদের। খাদের একেবারে নীচে নেমেই বাঘ বাঁদিকে ঘুরেছে। ছ্যাঁচড়ানোর দাগ দেখেই স্পষ্ট বোঝা গেল। এইখানে চৌকিদারের বউয়ের লালরঙা সায়াটাকে দাঁত দিয়ে খুলে নিয়েছিল বাঘ। লাল সায়াটা চাঁদের আলোয় কালো দেখাচ্ছিল। আসবার সময়ে একজন সাহসী ফরেস্ট গার্ড জিজ্ঞেস করেছিল আমার সঙ্গে যাবে কিনা। আমি বারণ করেছিলাম। যেখানে নিজের জীবনের দায়িত্ব নেওয়াই কঠিন, সেখানে নিরস্ত্র অন্য কারও জীবনের দায়িত্ব নেওয়াটা মূর্খামি। আজকে হয় বাঘিনী মরবে, নয় আমি। ইসপার উসপার হবে। বাঁদিকে অনেকখানি জায়গাতে শাল চারার জঙ্গল। চারাগুলো হাঁটু সমান হয়েছে। তার মধ্যে ঝড়ে পড়ে যাওয়া একটা মস্ত শিমূল গাছ শিকড়বাকড় বের করে পড়ে আছে। গাছটা পড়েছে মনে হয় বহু বছর আগে। প্রচণ্ড ঝড় হয়ে থাকবে, নইলে শিমূল গাছকে সহজে উপড়ানো যায় না। তার শিকড়ের জোর এমনই। তবে মাটিও এখানে আলগা। জায়গাটা ভিজে ভিজে। একটা ছোট্ট নালা বয়ে গেছে একটু দূর দিয়েই।

তিরতির করে জল যাওয়ার শব্দ আসছে। আমার তাড়া নেই কোনও। চৌকিদারের বউকে বাঁচানোর কথা ওঠেই না। সে এতক্ষণে শান্তির দুনিয়াতে চলে গেছে। তাকে বাঁচানো নয়, বাঘিনীকে মারাই তখন একমাত্র কাজ। আমি একটা পাথর দেখে তার ওপরে পা দুদিকে ছড়িয়ে বসলাম বন্দুকটা দুঊরুর ওপরে শুইয়ে। কান খাড়া করে নিজে নিশ্চল নিস্পন্দ হয়ে কিছু শুনতে পাই কিনা তার অপেক্ষায় থাকলাম। প্রেমা সিংয়ের ছেলেকে মেরেও সে খেতে পারেনি। বাঘিনী অত্যন্তই ক্ষুধার্ত। তাকে এখুনি খেতেই হবে। এবং বাঘ খেলে শব্দ হয়ই। এইটুকুই ভরসা।

মিনিট পাঁচ-সাত সেই পাথরের ওপরে বসে থাকার পরে চপ চপ করে মাংস ছেঁড়ার এবং চিবোবার আওয়াজ শোনা গেল। আমি চুপ করে বসে রইলাম। বাংলো থেকে নেমে আসার পরে মিনিট পঁচিশেক কেটে গেছে। ঠিক করলাম যে, বাঘ যখন নির্বিঘ্ন হয়েছে ভেবে খাওয়াতে মন দেবে, তখনই আমি গিয়ে চড়াও হব তার ওপরে কোনওরকম লুকোচাপা না করে। যা হবে তা হবে।

চাঁদের আলো তখনও আছে কিন্তু আর সামান্যক্ষণই থাকবে। সূর্য ওঠা আর চাঁদ ডোবার সন্ধিক্ষণে একটু অন্ধকার হবে। তার পরেই দিনের আলো পরিষ্কার হবে। আমি আরও দশ মিনিট বাঘকে খেতে দিয়ে পুবের আকাশ সাদাটে হতেই আস্তে আস্তে খুবই সাবধানে পা ফেলে ফেলে ওই শিমূল গাছটার দিকেই এগোতে লাগলাম। শিমূল গাছটার আড়ালেই বাঘ চৌকিদারের বউয়ের মৃতদেহ রেখে খাচ্ছে। শিমূল গাছটা থেকে হাত কুড়ি দুরে পৌঁছে গেছি, এমন সময়ে একটা শালচারা পাজামার মধ্যে ঢুকে যেতেই একটু শব্দ হল। শব্দ হওয়ামাত্রই বাঘ শিমূল গাছের গুঁড়ির ওপর দিয়ে মাথা উঁচিয়ে আমার দিকে তাকাল। তখন সবে ভোর হচ্ছে। সেই আবছা আলোতে দেখা বাঘিনীর সেই বীভৎস মুখ এ জীবনে কখনও ভুলব না। তার মাথা-মুখ-চিবুক-গোঁফসব মানুষের রক্তে লাল। বাঘিনী মাথা তুলে আমাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গেই বন্দুক তুলে আমি লেথাল বল ভরা ব্যারেলের ট্রিগার টানলাম বাঘের মাথা লক্ষ করে। চার চোখের মিলন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে। সে যে আমাকে গুলি করার আগেই ধরে ফেলতে পারল না তা ঈশ্বরের দয়া, আমার কোনও কৃতিত্বই নেই তার পিছনে।

বড় শিকারিরা বলেন যে, কখনও সামনা-সামনি বাঘকে গুলি করতে নেই। কারণ, বাঘের মাথার খুলিটা oval shape-এর। গুলি স্কিড করে বেরিয়ে যায়। অনেক সময়েই মস্তিষ্কে ঢোকে না। কিন্তু আমার উপায় ছিল না কোনও। শুধুমাত্র বাঘের মাথাটিই দেখা যাচ্ছিল।

ফোটা কার্তুজটা ইজেক্ট করে পকেট থেকে একটি গুলি তড়িৎগতিতে বের করে ফাঁকা ব্যারেলে ভরেই আমি দৌড়ে গেলাম শিমূল গাছের দিকে আর কোনওরকম লুকোচাপা না করে। বাঘ ধরলে ধরবে আমাকে, এই স্থির করে। শিমূল গাছের ডালের ওপরে পা দিয়ে উঠতেই দেখি বাঘিনী চৌকিদারের সুন্দরী স্ত্রীর শরীরের ওপরে মাথা দিয়ে শুয়ে আছে। বাঘের শরীরটা চৌকিদারের বউয়ের শরীরের বাইরে আছে। শুধু মাথাটা আছে বুকের ওপরে। কোনওরকম ঝুঁকি না নিয়ে আমি তার হার্ট লক্ষ করে আরেকটি গুলি করলাম। তাতে বাঘিনীর কোনও ভাবান্তর ঘটল না। বুঝলাম একটু আগে সে চৌকিদারের বউকে যে শান্তির রাজ্যে পাঠিয়েছিল, নিজেও তখন সেই শান্তির রাজ্যে পৌঁছে গেছে।

যখন বুঝলাম যে বাঘিনী মরেছে তখন আমার দরদর করে ঘাম ছুটল। পা যেন কাঁপতে লাগল। টেনশন হঠাৎ কেটে গেলে হয় এরকম।

.

কেশকাল বাংলোর সকলে যাতে বুঝতে পারে যে বাঘিনী মরেছে, তাই ব্যারেলের একটি গুলি আর পকেট থেকেও অন্য গুলিটি বের করে অন্য ব্যারেলে পুরে পরপর দুবার শূন্যে গুলি করলাম। তারপর নিজের আদ্দির পাঞ্জাবিটা খুলে চৌকিদারের সুন্দরী বউয়ের রক্তাক্ত, দগদগে শরীরটাকে ঢেকে দিয়ে শিমূলের ভূপতিত খুঁড়িতে এসে বসলাম। পাঞ্জাবি খোলার আগে বা পকেট থেকে পাইপ আর লাইটারটা বের করে নিয়েছিলাম। পাইপটা ধরালাম। আঃ, পাইপ খেয়ে বহুদিন এত আরাম পাইনি।

চৌকিদারের বউয়ের কথা ভেবে মনটা ভারি খারাপ লাগছিল। কিন্তু বাঘিনীর কথা ভেবে মনটা খুব ভালও লাগছিল। বউকে বাঁচানো আমার হাতে ছিল না। আমি এখানে পৌঁছবার অনেক আগেই সে মরে গিয়েছিল।

এদিকে আকাশে অনেকক্ষণ আগে চাঁদ মরে গেছে আর সূর্য জন্মেছে।

পরপর অতগুলো গুলির শব্দ শুনে ওরা পড়ি কি মরি করে একে একে স্লিপ কেটে নীচে যে নামছে তার আওয়াজ পেলাম। ধুপ ধুপ শব্দ করে ওরা লাফিয়ে লাফিয়ে আসছে এবারে। আমি ঝড়ে পড়া শিমূল গাছের কাণ্ডের ওপরে বাঘিনীর রক্তখাকি মুখটি দেখে যত না চমকে উঠেছিলাম, ওরা সকলে খালি গায়ে পাইপ মুখে কিম্ভুতকিমাকার আমাকে বসে থাকতে দেখে তেমনই চমকে উঠল।

বাঘিনী আমার পাঞ্জাবি খুলে নিল? হয়তো ভাবছিল ওরা।

চৌকিদার এসে আমার পায়ে পড়ল। যা হারাবার তা তো সে হারিয়েইছে। বদলা যে নিতে পারা গেছে এই তার সান্ত্বনা।

তার পর ঋজুদা বলল, এবারে চল, খাবার লাগাতে বল, খিদে পেয়েছে। কক্ষণ ধরে বকবক করছি না।

তা বাঘিনী কেন মানুষখেকো হল সেটা তদন্ত করে বের করলেন তো? পরে?

তাপসকাকু বললেন।

হ্যাঁ। বেলা প্রায় একটার সময়ে ভীমা আর আমি বাঘের চামড়া ছাড়াবার সময়ে খুব ভাল করে পরীক্ষা করে সেই রহস্যের একাধিক সূত্র অবশ্যই আবিষ্কার করেছিলাম। প্রেমা সিংও এসে যোগ দিয়েছিল আমাদের সঙ্গে। তার আগে স্কিন করা যায়নি। চারদিকের বিভিন্ন গ্রাম থেকে শয়ে শয়ে মানুষ এসেছিল বাঘিনীকে দেখতে। তারা নাচ-গান করছিল। লাড্ড বিলোচ্ছিল। প্রেমা তার ছেলের হত্যাকারীর চামড়া আক্ষরিকভাবে ছাড়িয়ে সান্ত্বনা পেয়েছিল একটু।

কী আবিষ্কার করেছিলেন?

মৈত্ৰকাকু বললেন।

আবিষ্কার করেছিলাম যে, মানুষখেকো হওয়ার জন্যে বাঘিনীর কোনও অপরাধ ছিল না। মানুষেরাই এর জন্যে দায়ী। এবং ভটকাইয়ের মতো কিছু অতি বাহাদুর অপরিণামদর্শী শিকারিই।

ভটকাই বলল, কথায় বলে মধুরেণ সমাপয়েৎ। আর তুমি কি ভটকাইয়ের পিণ্ডি না গেলে কোনও কাহিনিই শেষ করতে পার না, ঋজুদা? তোমাকে দেখি রুদ্রর রোগে পেল।

প্রদীপ গাঙ্গুলি কাকু বললেন, তা তদন্তের ফলটা কী হল? মানে একটু ডিটেইলসে বলুন দাদা।

ঋজুদা বলল, বলব, খাওয়ার পরে। এখন চলো, ওঠো। খাই গিয়ে। অবশ্য ভটকাইয়ের ডিরেকশনে রান্না, মুখে দেওয়া যাবে কিনা সন্দেহ আছে।

ওঁরা সকলে ডোংরি থেকে নেমে খানা কামরার দিকে এগোলেন। আলোকিত কেশকালের বাংলোর নীচের জমাট বাঁধা অন্ধকারের দিকে চেয়ে হঠাৎই আমার গা ছমছম করে উঠল।– তাপসকাকু ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে ঋজুদাকে বললেন, বাঘিনী যখন মুখ তুলল এবং আপনাকে দেখে ফেলল, আপনার ভয় করল না?

করল আবার না! মানুষমাত্ররই ভয় করে। পৃথিবীর সবচেয়ে সাহসী মানুষেরা, যেমন এয়ারফোর্সের ফাইটার পাইলটরা কি ভীরু নন? প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই ভয় ও সাহস-দুইই লুকিয়ে থাকে। কোন মুহূর্তে যে কোনটার প্রকাশ হবে তা ওপরওলাই জানেন।

একটু থেমে, সমতলে নেমে ঋজুদা বলল, তবে একটা জিনিস জীবনে অনেকদিন পরে উপলব্ধি করেছি।

কী সেটা?

সঞ্জীবকাকু বললেন।

নিজে মরতে রাজি না থাকলে কারওকেই মারা যায় না। সে মানুষখেকো বাঘই হোক কী জঙ্গল-দস্যু বীরাপ্পান। বীরাপ্পান আমাদের সকলের লজ্জা। আমার ধারণা, যারা তাকে মারতে ধরতে গিয়েছিল তারা কেউই মরতে রাজি ছিল না।

ভটকাই বলল, কেন? বহু মানুষই মরেছে এ পর্যন্ত।

মরেছে। কিন্তু বীরাপ্পানেরই ইচ্ছাতে। স্বেচ্ছায় নয়। স্বেচ্ছায় মরতে চাইতে হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress